Blog Archive

Friday, July 10, 2009

আমার মেয়েবেলা-হোস্টেরের স্মৃতিঃ পর্ব-৪

হোস্টেল পর্ব-৪
হোমের কথা সে ভাবে বলা হয়নি। হোমে যারা থাকত তাদের অনেকেরই মা-বাবা ছিল না। এ প্রসঙ্গে প্রতিমাদির কথা মনে পরল। উনি হোমেই বড় হন। বাইরে থেকে আমাদের হোস্টেলে পড়াতে আসতেন। ঠিক সবিতাদির উল্টো। খুব হাসি-খুশি। খেলার ছলে পড়া করিয়ে দিতেন। কিন্তু সবিতাদি ওনাকে বিশেষ পছন্দ করতেন না, বেশ বুঝতাম।

এ সময় আশ্রমে বড় উৎসব শুরু হয়। প্রতিমাদি ওনার মেয়েকে নিয়ে এলেন- সেই শিল্পীদিকে দেখি, ঠিক যেন শিল্পীর হাতে তৈরি। শিল্পীকে সবার ভাল লেগে যায়। লম্বা, ফর্সা, কোঁকড়ানো ঘাড় পর্যন্ত চুল, মুখে চাপা মিষ্টি হাসি। শিল্পীদির গজ দাঁত ছিল। মন খুলে হাসলে আরও সুন্দর লাগত। শিল্পীদি কোনো একটা নাটকে কৃষ্ণও সাজল।

কিন্তু তার কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিমাদি মারা গেলেন। ওনার স্বামীও ওনাকে ছেরে যান। ফলে শিল্পীদির স্থান হল হোমে। আমার চেয়ে বড় হলেও স্কুলে আমার ক্লাসেই ভর্তি করা হল। কিছুদিন পর দেখলাম ওকে নেড়া করে দিল। আমার খুব কষ্ট হত, সেই শিল্পীদি!মার সাথে সুন্দর সেজেগুজে পুতুলের মত আসত!হোস্টেলে সবাই কত ভালবাসত! তাকে হোমে না জানি কি কষ্টটাই না সহ্য করতে হত। অথচ শিল্পীদির মুখে সেই আগের মতই হাসি লেগে থাকত। ক্লাসে আমিও শান্ত ধরনের ছিলাম। তবু নানা ভাবে শিল্পীদিকে একটু সাহায্য করার চেষ্টা করতাম।

সে সময় ছুটিতে জলপাইগুড়ি গেলাম। পাপা জলদাপাড়ায় ঘুরতে নিয়ে গেল। হলং বাংলোতে ছিলাম। হাতির পিঠে জঙ্গলে গন্ডার, হরিণ দেখলাম। পাপা প্রচুর ছবি তুলল। সেগুলি হোস্টেলে ও স্কুলে সবাইকে দেখালাম। শান্ত শিল্পীদি তার থেকে আমার দুটো ছবি চেয়ে নিল। আমার এত ভাল লাগল, কি বলব!


হোমের মেয়েদের সাথে সবিতাদি বেশি মিশতে দিতেন না। ওরা আমাদের চেয়ে বেশি আনন্দ করত। মনে আছে দোলের আগের দিন রাতে ন্যাড়া-পোড়া হত। আমরা হোস্টেলের জানলা দিয়ে দেখতাম হোমের মেয়েরা বিশাল খড়ের পুতুল করে তাকে পোড়াচ্ছে। যদিও পরের দিন হোম-হোস্টেল ভুলে সবাই এক সাথে খুব মজা করতাম।

হোমের একটি মেয়েকে মনে পড়ছে। সেও আমার সাথে একই ক্লাসে পড়ত। ৫এ হোমের বেশ কয়েকটা মেয়ে আমার সাথে স্কুলে পড়ত। তারা হঠাৎ ঠিক করল হোস্টেলের সবচেয়ে ফর্সা আমি ও হোমে ওই মেয়েটি-নাম ছিল মনে হয় সোমা-আমাদের ‘প্রিয়বন্ধু’ হতে হবে। ঐ ‘সই’ পাতানোর মত ব্যাপার, আর কি! কি সব ছড়া কেটে বন্ধুত্বও করে দিল। কিন্তু আগে আমরা যাওবা কথা বলতাম, এবার দেখা হলেই লজ্জা পেতাম। বিকেলে মাঠেও সবাই আমাদের খ্যাপাত।

হোমে আরেকটি বিখ্যাত মেয়ে ছিল ‘ইংরেজ’। আসল নাম মনে নেই। হোমে-হোস্টেলে সবার একটা করে ডাক নাম থাকত। আমি গুটিসুটি মেরে শুতাম তাই ডাকত-খরগোস। তো, ইংরেজ একটু পাগলী ধরনের ছিল। খুব চ্যেঁচিয়ে গান ধরত। ওই দেখায় লিচুপাতা খেলে নাকি মুখ পান খাওয়ার মত লাল হয়।

হোস্টেলে আমরা দুষ্টুমীও করতাম। আমার আর সীমার ট্রাঙ্ক পাশাপাশি ছিল। বাড়ি থেকে আনা টুক-টাক খাবার আমরা ভাগ করে খেতেম। একবার ঝগড়া হল। সীমা আমার পাশে বসে আমায় না দিয়েই খেতে শুরু করল। আমি কিন্তু আমার থেকে ওকে দিলাম। এবার ও-ও আমায় দিল। আমি খেলাম না। এতে সীমা খুব রেগে গেল! আমায় জোর করে খাওয়াবেই! আমিও কিছুতেই খাবনা!ব্যাস্‌!ও আমায় মাটিতে ফেলে জোর করছে, আর ঠিক সে সময় সবিতাদি ঘরে ঢুকেছেন! বেশ করে দু’জনের মাথা ঠুকে দিলেন।

সীমার সাথেই দেখছি আমার বেশি লাগত! একবার আমরা পাশাপাশি বসে পড়ছি। হঠাৎ কি ভেবে আমি সীমার গালে আমার পেন দিয়ে দাগ দিলাম। পেনের কালি বোধহয় শেষ হয়েগেছিল। ফলে সীমার গালে দাগ লাগেনি, কিন্তু ওতো দেখতে পাচ্ছেনা! আমার ভারি মজা লাগল। সীমাটা খেপে গেল। এবার ও আমার হাতে দাগ দিল। তারপর আমি ওর পায়ে...ও আমার মুখে...এই ভাবে আমরা দু’জনে দু’জনকে রং করতে লাগলাম যতক্ষণ না সবিতাদি এসে পিট্টি দেন।


আরেকটা মজার ঘটনা বলি। আমাদের বড় হলের বাইরেই টানা চওড়া ও বড় বারান্দা ছিল, শেষে লাইব্রেরী। বারান্দায় বড় বড় টেবিল থাকত সেখানে দু’বেলা আমরা পড়তাম। বারান্দায় গ্রীল লাগান ছিল। সেখানে আমরা রুমাল, মোজা এসব শুকতাম। প্রায়ই সেগুলো গ্রীলের ফাঁক দিয়ে চওড়া কার্নিসে পরত। আর দেবিকাদির মাথাটা সরু বলে ও গ্রীলে মাথা গলিয়ে লাঠি দিয়ে তা তুলে দিত। সবিতাদি এটা জানতেন না। আমার দেবিকাদিকে দেখে ও রকম করার সখ হল। সে দিন স্কুলে যাবার সময় কার কি পরে গেছে, দেবিকাদিও স্কুলে চলে গেছে। আমি ময়দানে নামলাম। খুব কায়দা করে মাথা গলিয়ে জিনিষটা উদ্ধারও করলাম। কিন্তু আমার মুন্ডুটি গেলেন আটকে। কি করি! বেশি কেউ নেই সব স্কুলে গেছে, ক’জন যাবার তোরজোর করছে। সবিতাদিও এসময় কাজে যেতেন। উনিও ব্যস্ত!

এদিকে সামনে হাইস্কুলের বারান্দায় দু-একজন করে জড় হচ্ছে, পাশে আমার প্রাইমারী স্কুলের ছেলে-মেয়েরা নিচে ভীড় করছে। হাইস্কুলের বুড়ো নেপালী দারোয়ান কোথা থেকে খবর পেয়ে নিচে এসে চেঁচাচ্ছে। বিকেলে আমরা বড় মাঠে খেলতে যেতাম। দারোয়ান আমায় বেশ ভালবাসত। দিদু চিৎকার করচ্ছে গ্রীল কাটতে হবে। এসময় সবিতাদি এলেন। সবাই আমার মাথা নিয়ে অনেক টানাটানি করল। কিন্তু সে আর বেরতেই চায়না! সবিতাদি ঠিক পাপার মত ছিলেন। খুব চ্যাঁচামেচি করতেন, কিন্তু কিছু করতে ভয় পেতেন। সবাই বলছে-গ্রীল কাট। উনি রেগে গিয়ে চ্যাঁচাচ্ছেন ‘আমি গ্রীল কাটব না, দীপান্বিতার মুন্ডু কাটব।’ হাঃ-হাঃ, এখন লিখতে লিখতে কত মজাইনা পাচ্ছি। কিন্তু তখন ভয়ে, লজ্জায় মাটিতেও মিশতে পারছিলাম না।

শেষে মুনমুনদির বোন মঞ্জুদি-যে একটু-আধটু ম্যাজিক দেখাত, সে আমার পার নিচে ইট দিয়ে, কায়দা করে হ্যাচকা টান মেরে মুন্ডুটি উদ্ধার করলেন।
তারপর!...আমায় খাটে বসিয়ে ১মে সবিতাদি দু’গালে ঠাস্‌ ঠাস্‌ শুরু করলেন। তারপর দিদু, তারপর যারা যারা ছিল প্রায় সবাই হাত ঝালিয়ে নিল। তবু সবিতাদি চ্যাঁচাচ্ছেন। কারণ আমি কাঁদচ্ছি না, মুখ ফুলিয়ে, লাল করে বসে আছি!

অনেক পরে হোস্টেলে যেতে সবিতাদি হেসে আবার সে প্রসঙ্গ টেনে বললেন-তুমি কি ভাবে অমন বুদ্ধি মাথায় এনেছিলে! আমি দেবিকাদির কথা বল্লাম। উনি বললেন, তখন বলনি কেন?...কিন্তু তখন আর কে কার কথা শুনছিল!


আমরা রবিবার দুপুরে বারান্দায় বসে ক্যারাম, বিস্‌নেস্‌ম্যান-এসব খেলতাম। আমার ক্যারামে খুব নেশা, এদিকে হেরে যাই। শিখাদি তুখোড় ক্যারামে। তবু ও কিন্তু সব সময় আমায় ওর জোড় নিত।


আরেকটা ঘটনা বলে হোস্টেল পর্ব শেষ করব।

দিনটা ছিল শনিবার। পরের দিন গার্জেন ডেট। শনিবার হাফ স্কুল হয়। সামনে কোন টানা ছুটিও পড়বে, সবাই বাড়ি যাব। তাই মনের আনন্দে সব মাঠে খুব খেলছি। বড় আর ছোটোরা আলাদা খেলতাম। কিন্তু সেদিন কি হল, আনন্দে সব এক সাথে খেলছিলাম। খেলাটা ছিল-‘বুড়ি ছোঁয়া’। আমাদের মাঠ ছিল বিশাল বড়। সেখানে একদিকে বড় বড় বকুলগাছ সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। মাঝে ইটের বেদী, সেখানে যে বুড়ি সে বসে। দৌড়ে এসে তাকে ছুঁতে হবে। যে চোর সে আমায় তাড়া করেছে। বড় কোন দিদি হবে। সারা মাঠ দৌড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বুড়ির কাছে এসেই দড়াম্‌! মুখের নিচের দিক ফেটে রক্তারক্তি কান্ড। সবাই ভয় পেয়ে গেল! সবিতাদির সামনে নিয়ে যাবে কি করে! উনি যা রাগী!
কিন্তু আমার এই অবস্থা দেখে উনিও ভয়ে চুপ করে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। সবাই আমায় কোলে করে নিয়ে গেল। সারা বিকেল, সন্ধে ঘিরে রয়েছে। রাতে মুখ বেশ ফুলে উঠল। রাতে খাওয়ার ব্যবস্থাও আলাদা হল। আত্রেয়ীদি তখন ছিল, ওই আমায় খাইয়ে দিচ্ছিল। জনে জনে আমার খবর নিচ্ছে। সব খুব ভাল লাগছিল। ভয় শুধু ছিল, সেই গার্জেন ডেটে পাপা আসবে বহুদিন পর, যদি সবিতাদি বা অন্যদের কিছু বলে! সবিতাদি বারবার বলছিলেন-কখন এমন হয়না, ঠিক আজই হল? উনি কতদিন পর তোমায় দেখবেন!

বিকেলে পাপা এলো এত্তো জিনিষ নিয়ে। পাপা সবার সাথে কথা বলত। খুব আড্ডাবাজ ছিল। পাপা সবিতাদিকে কিছুই বললো না। সব শুনে, আমায় বরং বলল এভাবে পড়ে, উঠে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দিতে হবে। বড়দিদিরাও পাপার সাথে দেখা করল। পাপা কাউকে কিছু বললনা।
আজ খুব ভাল লাগছে এই ভেবে যে, সেদিন কত স্নেহ-ভালবাসা পেয়েছিলাম, আর আজ তা সবার সাথে প্রথম শেয়ারও করতে পারলাম।

Wednesday, July 8, 2009

হোস্টেলের স্মৃতিঃ পর্ব-৩

হোস্টেল পর্ব-৩

আগের পর্বে অপর্ণাদির কথা বলেছি। এবার হোস্টেলের অন্য কথায় আসি। ক্লাস ফোর-ফাইভ এ হোস্টেলে বেশি মেয়ে ছিল না। আমি ক্লাস ফাইভে উঠতে অপর্ণাদি, শেলীদিরা চলে গেল। রুমকি, চৈতালী এলো। এভাবে ফোর-ফাইভ এর গুটিকয় মেয়ে সবিতাদির সামনে ছোট্ট হয়েই রয়ে গেল। ৬থেকে সবাই বড়র দলে হয়ে গেল আর আমাদের একটু স্নেহ করত।

ঠাকুরবাড়িতে হোমের কেউ ভোরে খুব জোরে শাঁখ বাজাত। ঠাকুরবাড়ির কাজের দায়িত্ব সব চেয়ে বড় দিদিরাই করত। আমাদের মাথার কাছে কোন দিদি ঘণ্টা বাজিয়ে যেত সেই আওয়াজে সব উঠে ঠাকুরবাড়ি যেতাম। ঠাকুরবাড়ি থেকে এসে খাবার খেয়ে পড়তে বসতাম, তারপর চান করে, ভাত খেয়ে স্কুল। স্কুল থেকে এসে আবার ভাত খেয়ে মাঠে খেলতে যেতাম। বিকেলে আবার ঠাকুরবাড়ির শঙ্খ ধ্বনি শুনে আরতিতে যেতাম। এসময় রামকৃষ্ণ মিশনের আরাত্রিকের সব গানগুলি আমরা হারমোনিয়াম, তবলা, খঞ্জনী বাজিয়ে গাইতাম। হল ঘর গম্‌ গম্‌ করত। আরতি শেষ হলে হোস্টেলে এসে পড়তে বসতাম। শেষে রাতে রুটি খেয়ে ঘুম। এই ছিল রোজের রুটিন।

আমাদের প্রতিদিনের কাজের রুটিন আগের রাতে কোন এক দিদিই করে রাখত। তাই দেখে ভোর থেকে কাজ হত। ভোর ৫টায় আমরা উঠতাম। তার আগে ঠাকুরবাড়ি যার কাজ সে উঠে সেখানে চলে যেত। ঠাকুরবাড়ি থেকে এসে খেয়ে পড়তে বসার আগে যে যার কাজ করে নিত। আমাদের বড় হল ঘর ৪জন মিলে ঝাঁট দিতাম। ৮জনে মুছত। এ ছাড়া লাইব্রেরী, দিদুর ঘরও পরিষ্কার হত। নিচে বড়দিদিরা কুটনোও কুটতে যেত। সকালের টিফিনের ও রাতের রুটি তৈরিতেও হোস্টেলের মেয়েরা সাহায্য করত। খাবার পরিবেশনের দায়িত্বও আমাদেরই ছিল। আমি যখন এলাম তখন সব চেয়ে ছোট ছিলাম তাই কোন কাজ কেউ করতে দিত না। মাঝে মাঝে একটু ঝাঁটের কাজ পেলে খুব যত্ন নিয়ে করতাম। এত্তো নোংরা বার করে সবিতাদির দৃষ্টি আকর্সন করতাম।

আমাদের হোস্টেলের সামনে সাধু-মাদের ছোট্ট বাড়ি ছিল। ক’জন সন্ন্যাসিনী সেখানে থাকতেন। তবে নিচের তলায় বড়দি কেন থাকতেন বুঝতাম না। উনি লাল পাড় শাড়ি পড়তেন। ওনার ঘরে গেলে মন ভরে যেত। একতলাতে থাকতেন। ওনার ছোট্ট সাদা-মাটা ঘরে ৩টে জানলা, বাইরে জানলার নিচেই কত্তো বেল ফুলের গাছ, আর ভর্তি সুগন্ধি বেলফুল। গরমে ওনার ঘরের মেঝেতে বসে পড়তে খুব ভাল লাগত। উপরে সাধু–মা থাকতেন। উনি শাড়ি খুবই কম পরতেন। ভগিনী নিবেদিতার মত গেড়ুয়া বস্ত্র পরতেন। আমাদের পৌরানিক গল্প শোনাতেন আর লজেন্স দিতেন। কখনও রাগ করতেননা বা গম্ভীর থাকতেন না। তাই ওনাকে দেখলেই আমরা দৌড়ে গিয়ে ঘিরে ধরতাম।

আমি তখন বেশ ছোট তাই যাদের কাছ থেকে দেখেছি তাদেরই মনে আছে। তবে শুনতাম ঠাকুরবাড়িতে এক দিদি থাকেন। ৯০এর উপর বয়স। তিনি মা সারদার সাথে ছিলেন। বাইরে থেকে উৎসবের দিন ওনার কাছে বড় বড় লোকরা আশীর্বাদ নিতে আসতেন। খুব সুস্থ ছিলেন না, তাই বাচ্চাদের ওনার কাছে যেতে দেওয়া হত না। দুর থেকে কয়েকবার ওনাকে দেখেছি। ওনার কাছে নাকি মার মাথার চুলও ছিল!


আমাদের হোস্টেলে দিদি-বোন পাতানোর একটা রেওয়াজ ছিল। দিদি যা বলবে তাই বোনকে শুনতে হবে। দিদিরা অনেক উপকার করত আবার প্রচন্ড শাসনও করত যা অনেক সময় অত্যাচার মনে হত। বোন কি জামা পরবে, কার সাথে কথা বলবে সব দিদি ঠিক করত। আমারও এমন দিদি ছিল আত্রেয়ীদি। কিন্তু সে যে কি ভাল ছিল কি বলব! তাকে যদিও বেশি কাছে পেতাম না। চোখের পাতায় একটা ছোট্ট খুস্‌কুড়ি হল, কেউ গা করল না। শেষে সেটা বড় হতে হতে পুর চোখ ফুলিয়ে দিল। আত্রেয়ীদিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। মাঝে মাঝে আসত, আবার বারাবারি হলে চলে যেত। শেষে কি হল হোস্টেল ছেরে চলে গেল।
একবার হোস্টেলে কি একটা ছোঁয়াচে অসুখ হচ্ছিল তখন আমার ও খুব জ্বর হল। সবিতাদি আমায় আলাদা রেখে দিল। তখন সারা রাত আত্রেয়ীদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

সুমনাদি এসময় এলো। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর মত দেখতে। সফিস্টিকেটেড, বেশ চুপচাপ, লেখাপড়ায় খুব ভাল। ও আমায় বিবেকানন্দের উপর একটা রচনা লিখে দিয়েছিল, যা বহু দিন আমি রেখে দিই। এই সুন্দরী সুমনাদির দিদি হল মুনমুনদি। মুনমুনদি বেঁটে, একটু মোটা, খুব সাধারণ। মুনমুনদিরা ৩বোন হোস্টেলে থাকত। এদের গার্জেন বিশেষ আসত না। লেখাপড়ায়ও খুব ভাল ছিল না। কেন যেন লুকিয়ে লুকিয়ে থাকত। যখন সুমনাদি এলো মুনমুনদি নিজে থেকেই ওর কত্তো কাজ করে দিত! সুমনাদিও ভাল ভাবে তার সুযোগ নিত। যদিও পরে সুমনাদিও মুনমুনদিকে ভালবেসে ফেলে। যে সুমনাদি বিকেলে মাঠে না গিয়ে বই পড়ত সেও শেষে মুনমুনদিকে নিয়ে মাঠে ঘুরত।

হোস্টেলে সবচেয়ে বড় একজনই ছিল। ১২র নন্দিনীদি। কালো, লম্বা, মুখটা সুন্দর। চায়ের নেশা ছিল। এই একজন যে বারান্দায় ছোট্ট স্টোভ জ্বেলে লিকার চা খেত, চাটা ছাঁকতও না, পাতা থিতিয়ে খেত। কানাঘুঁসো ছিল এ এক ক্লাসে ২বার করে পড়ে।

নন্দিতাদি ১০এ পড়ত। ভিষণ রোগা। একটু কাঠ কাঠ। বেশ ভয় পেতাম। সারাদিন উল-কাঁটা বুনত। নিজের তৈরি সোয়েটার শীতে পরত। বাড়ি বিশেষ যেতনা। এর একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে, খপ্‌-খপ্‌ করে মাছি ধরতে পারত।

নন্দিতাদির সঙ্গে পড়ত রেখা সিং। খুব সুন্দরী। কিন্তু সুন্দরী হলেই যে মন সুন্দর হয় না তা রেখাদিকে দেখে যেনেছি। ছোটদের উপর খুব চোটপাট করত। কখনও ছোটদের মধ্যে বেশি বন্ধুত্ব দেখলে খুব পেছনে লাগত।

ছন্দাদি বোধহয় ৮এ পড়ত। দাঁত উচু, লম্বা, ভাল মানুষ। বড়রা ‘দান্তে’ বলত, এতে খুব কষ্ট পেত।

(হোস্টেলে যাদের নাম মনে আছে- সীমা, পিংকি, রুমকি, চৈতালী, সীমা দেবনাথ, অপর্ণাদি, শেলীদি, শর্মিষ্ঠাদি, দেবিকাদি, সুস্মিতাদি, সুনেত্রাদি, ইন্দ্রানীদি, শুক্লাদি, কণিকাদি, সুমনাদি, সুজাতাদি, অলোকাদি, রূপছন্দাদি, ছন্দাদি, মহুয়াদি, লক্ষ্মীদি, শিখাদি, মিতাশাদি, মঞ্জুরীদি, সুছন্দাদি, কাকলিদি, কাকলি মুখার্জিদি, বিপাশাদি, পাপিয়াদি, মঞ্জুদি, সুমিতাদি, তাপসীদি, মুনমুনদি, সম্পাদি, ছবিদি, নন্দিতাদি, নন্দিনীদি, রেখাদি, দীপান্বিতাদি, ডালিয়াদি, চয়নিকাদি, দেবজানীদি, মৌসুমী কর্মকারদি, মৌসুমী ভট্টাচার্যদি, শুভ্রাদি, আত্রেয়ীদি)

এভাবে ৩০-৪০জনের কথা বলতে গেলে সবাই ঘুমিয়ে পড়বে, তার চেয়ে সোজা শিখাদির কথায় আসি।

শিখাদিরা ৩জন S.O.S village থেকে হোস্টেলে এলো। শিখাদির মুখেই শুনতাম ওর ২বছর বয়সে কাজের লোক ওকে চুরি করে, বাড়ির কথা মনে থাকলেও কোন সূত্র দিতে পারেনি। ফলে S.O.S village এ স্থান হয়। এখানে কোন বিধবা বা সম্বলহীনা মহিলাকে ৩-৪টি বাচ্চা ও একটি নাকি ঘর দেওয়া হয়। শিখাদির এমন মা ও ২টি ভাই ছিল। শিখাদিরা ৯এ পড়ত। কিন্তু বড়দের গ্রুপে হয়েও আমাদের জন্য শিখাদি খুব লড়ত। একটু খেপি ধরনের ছিল। অপর্ণাদি যাবার পর ওরা এলো। আর শিখাদির অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আমার খুব ভাল লাগত। ও এক রকম আমার মন্ত্র-গুরু বলা যায়। বড়রা শিখাদিকে এড়িয়ে চলত। সবিতাদির মুখে মুখেও শিখাদি কথা বলতে পারত।

তবু শিখাদির মন কিন্তু খুব নরম ছিল। বিড়াল অসম্ভব ভালবাসত। ও আসার পর কোথা থেকে এক গাদা ছোট্ট ছোট্ট বিড়াল তুলে আনল। তার মধ্যে একটি ধপ্‌ ধপে সাদা। এটি ওর বিশেষ প্রিয় ছিল। সবিতাদি এসব পছন্দ করতেন না। তাই ছাদের পাশে সিঁড়ির তলায় তাদের থাকার ব্যবস্থা হল। শিখাদির পরিচালনায় আমরা ছোটরা বিড়ালের মাথার বালিশ, পা-বালিশ বানাতাম। শিখাদি তার প্রিয় সাদা বিড়ালছানার গলায় লাল সার্টিনের ফিতে, রুমাল-এসব বেঁধে দিত।

শিখাদির লিড করার দক্ষতা ছিল। সবিতাদির কাছে শুনেছি শিখাদি এখন শান্তিনিকেতনের টিচার। আশ্রমে কোন অনুষ্ঠান হলে, সবিতাদি হোস্টেলের বাচ্চাদের দায়িত্ব শিখাদিকে দিতেন। আমাকে আর সীমাকে ও নাচ করিয়ে ছিল।
‘এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার
আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হলো কার
কাহার অভিষেকের তরে সোনার ঘটে আলোক ভরে...’
সেই প্রথম আমি নাচ করি।

এছাড়া প্রাইমারী স্কুলে যে কোন ছুটির আগে অনুষ্ঠান হত। মাঠে যে নাচ বা গান করত তাকে ঘিরে বাচ্চারা বসত। বড়দি আমাকে গান করতে বলতেন। শিখাদি গান শিখিয়ে দিত। আবার অনুষ্ঠানের সময় বাচ্চাদের পিছনে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কি গাইছি শুনত, কোথায় আটকে যাব জানত, তাই মুখ নেরে কথাগুলো বলত। আমি বরাবর ভীতু প্রকৃতির, একভাবে ওর দিকে তাকিয়ে গান করতাম।

শিখাদির আমেরিকান বয়ফ্রেন্ড ছিল। S.O.S village এ ওর প্রকৃত অভিভাবকও বোধ হয় কোন আমেরিকানই ছিলেন। তার ছেলের সাথেই শিখাদির ভাব হয়। শিখাদির জন্মদিনে অনেক গিফট আসে। তার সাথে বড় একটা সুন্দর কারড আসে। যেটা খুলতেই জন্মদিনের সুরটা বাজত। সেই প্রথম দেখলাম।

যে কোন ছুটিতে সবাই বাড়ি যেত। আমরা ক’জন যাদের বাড়ি দুরে তারা রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি যেতাম। ফলে ছুটির পরও আমায় হোস্টেলে থাকতে হত। বড় হলে একদিকে সব খাট ডাঁই করে তুলে রাখা থাকত। ৪-৫ জন থাকতাম। ভিতরটা খাঁ খাঁ করত। স্কুলও থাকত না। সবিতাদি লাইব্রেরী থেকে ছোটদের জীবনীমুলক বই আমায় পড়তে দিতেন, আবার রাতে পড়া ধরতেন। তখন চাচা চৌধুরী, ফেন্টম ছাড়া কিছুই বাইরের বই পড়তে ভাল লাগত না। সে সময় শিখাদিদেরও কেউ নিতে আসত না। শিখাদি দুপুরে ছাদে বসে আমায় বই পড়ে শোনাত। সেই শুনে রাতে পড়া দিতাম। পরে শিখাদি আমায় পড়তে বলত আর ও খুব মন দিয়ে শুনত। এই করে আমি গল্পের বই পড়তে শিখি।

দুপুরে হোমের তাঁত ঘরের পিছনে বসে, পুকুরে মাছরাঙার খেলা দেখতে দেখতে তেঁতুলের আচার খেতাম। শিখাদিই কিনত। ৫টাকার এত্তো আচার। বিকেলে আমার বন্ধুরা নেই! শিখাদির সাথে ঘুরতাম। ও দেশ স্বাধীনের গল্প বলত।

সেই থেকে আমার মনে হয় আমি হোস্টেলে পরাধীন আছি। তার উপর তখন ‘স্বাধীনতা হীনতা কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায় হে’ কবিতাটা পড়ছি। হোস্টেলে টিভি ঠিক হল, কিন্তু রবিবার মহাভারত ছাড়া কিছুই সবিতাদি দেখতে দেন না। একবার রাতে ‘ববি’ সিনেমা দিল। বড়রা দেখবে কিন্তু ৪-৫এর স্টুডেন্টরা টিভির দিকে পিছন করে শোবে। এসব আর ভাল লাগছিল না। পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের উদ্দেশ্যে আমি তখন পাপাকে বড় বড় চিঠি পাঠাচ্ছি। পরে পাপা সেগুলো দেখিয়ে খুব লজ্জায় ফেলত।

Sunday, July 5, 2009

আমার ধ্রুবতারা-অপর্ণাদি ...হোস্টেল পর্ব-২

হোস্টেল পর্ব-২
আগের পর্বে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েও একটু পিছতে হচ্ছে। কারণ অপর্ণাদির কথা বলব। মাথায় যখন দুষ্টু বুদ্ধি খেলছে ততদিনে অপর্ণাদি হোস্টেল ছেরে চলে গেছে...শেলীদিও। ক্লাস ফোর স্কুল যেমন হোস্টেলও তেমনি সুন্দর ছিল।
অপর্ণাদির কাছে যে কত কিছু শিখেছি! অথচ ও ক্লাস ফাইভে পড়ত, আমার চেয়ে এক বছরেরই বড়।

হোস্টেলের বাইরে একটা ছোট্ট ফাঁকা জায়গায় অপর্ণাদি আমাদের সঙ্গে নিয়ে বাগান বানায়। নিজেরাই মাটি খুরি। ইট দিয়ে বর্ডারও দেওয়া হয়। ভিতরে দোপাটি, গ্যাদা-এসব গাছ লাগান হয়। দু’বেলা সবাই জলও দিতাম। বড়রা মজা করত। তবু সবাই অপর্ণাদিকে খুব ভালবাসতো। অপর্ণাদি নিজে হাতে কোথা থেকে একটা জবার ভাঙ্গা ডাল তুলে আনে, পরম মমতায় সেটা ঐ বাগানে দেওয়ালের ধারে পোঁতে। সবিতাদি পর্যন্ত দুঃখ করেছিলেন-“আহাঃ, মেয়েটা এত ভালবেসে মরা ডালটা পুঁতছে!” আশ্চর্য! সেই ডালেও অপর্ণাদির ভালবাসায় কচি কচি পাতা এলো!
অপর্ণাদি চলে যেতে আস্তে আস্তে বাগানটাও নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এত বছর পর গিয়েও সেই জবা গাছটাকে দেখি কত্তো বড় হয়েছে! বেশ ফুলও ধরেছে। দেখে কি যে আপন মনে হল! কারণ আমরা দু’জনেই যে অপর্ণাদিকে চিনি, আর তখন দু’জনেই যেন একবার অপর্ণাদিকে ভেবে আনন্দও পেলাম।
অপর্ণাদি ফাংশানে দু-তিন দিন, দু-তিনটে নাটকও করেছিল। প্রাইজও পায়।
অপর্ণাদির বাবা ছিল না। কিন্তু ও প্রতিদিন সকালে আমাদের টিফিনে যে রুটি-তরকারি দিত, সেই খাবার থেকে আগে রুটি ছিঁড়ে কাককে খাওয়াত। একবার বলেছিল বাবা মারা যাবার কিছুদিন পর বাড়িতে একটা কাক এসে খুব ডাকছিল। তখন দুপুরবেলা, অপর্ণাদির মাকে বোধ হয় চাকরি করতে হত, বাড়িতে অপর্ণাদি বোধ হয় একা ছিল। সবে খেতে বসেছিল। কি ভেবে ভাত-ডাল মেখে বারান্দায় দেয়। কাকটা সঙ্গে সঙ্গে খেতে শুরু করে। মৌরী-আদা দিয়ে বিঊলীর ডাল আর আলু-পোস্ত অপর্ণাদির বাবা খুব ভালবাসতেন। সেদিন অপর্ণাদি ঠিক তাই খাচ্ছিল। কাকটা খেতে অপর্ণাদির ধারনা হয় তার বাবাই এসেছিলেন। এই স্নেহে প্রতিদিন আগে কাককে খাওয়াত। অপর্ণাদির দেখে আমারও তখন থেকে সেই অভ্যেস হয়েছে।
এছাড়া, অপর্ণাদি অনেক ছোট ছোট গল্প বলত, শুয়ে শুয়ে। আমরা ছোটরা যারা সবিতাদির একটু প্রিয় ছিলাম, তারা ঠিক সবিতাদির সামনে থাকতাম। উনি হলের সামনের দিকে দুটো ছোট্ট আলমারি আর মিটসেফ রেখে নিজের একটা বাউন্ডারী করে নেন। তার ভিতরেই স্টোভ জ্বেলে উনি চা খেতেন, ওনার চায়ের নেশা ছিল। উনি দিদুকে ভিষণ ভালবাস্তেন, একটা লজেন্সও ভাগ করে দিতেন। তো, ওনার সামনেই দু-তিনটে চৌকি জোড়া দিয়ে আমরা ৫-৬জন বাচ্চা থাকতাম। মাঝে অপর্ণাদি শুত। ও সুন্দর সুন্দর গল্প বলব। আমরা হাঁ করে শুনতাম।
অপর্ণাদি ছোট্ট ছোট্ট প্রাণীদেরও খুব ভালবাসতো। কোথাও প্রজাপতি বা টিক্‌টিকি মরেছে-শেলীদি, আমি, সীমা এসে অপর্ণাদিকে খবর দিতাম। অপর্ণাদি তাকে নিয়ে যেত বড় স্কুলের মাঠে-বকুলতলায়। পিছন পিছন আমরা যেতাম। ছোট্ট কাগজে ঐ প্রাণীটির দেহ অপর্ণাদিই নিয়ে যেত। আমরাও পেছনে কিছু ফুল নিয়ে চলতাম। আমাদের আশ্রমে ছোট্ট ছোট্ট সুগন্ধি বেল ফুলের অভাব ছিল না। এছাড়া বকুলতলায় অজস্র বকুলফুল পড়ে থাকত। ভাল জায়গায়, যেখানে চট্‌ করে কারো পা পরবে না, সেখানে গর্ত খুঁড়ে প্রাণিটিকে সমাধি দেওয়া হত। অপর্ণাদি তার উপর কোন চারাগাছ লাগিয়ে দিত। আমরা ফুল ছরিয়ে দিতাম।
অপর্ণাদিকে সবিতাদিও খুব স্নেহ করতেন। সবিতাদিকে দেখতে আগেকার বাংলা অভিনেত্রী মঞ্জু দের মত ছিল, যিনি তপন সিন্‌হার ‘কাবুলিওয়ালা’য় মিনির মা সাজেন। হোস্টেল ছাড়ার পর যখনই মঞ্জু দের সিনেমা দেখতাম তখনই সবিতাদিকে মনে পড়ত, মঞ্জু দে সে কারণেও আমার খুব প্রিয়। তবে আমাদের সবিতাদিকে সচরাচর হাসতে দেখা যেত না। কিন্তু অপর্ণাদি ঠিক ওনাকে হাসাতে পারত।
অপর্ণাদির মার সারা গায়ে ছোট ছোট আমের মত কি যেন ছিল। অপর্ণাদি খুব সুন্দরী ছিল, কিন্তু মাকে চেনাই যেত না। ওদের অবস্থা তখন বোধ হয় ভাল ছিলনা। বরাবর দেখতাম অপর্ণাদি রঙ চটা, কটা জামা পরত। কিন্তু তখনতো ছোট! অপর্ণাদি যা পরত, যা করত তাই আমার ভাল লাগত। আমার কাছে অপর্ণাদি রূপকথার রাজকন্যা ছিল। সেই অপর্ণাদি যেই হোস্টেল ছারল আমিও গড্ডালিকায় পরলাম।

এবার যখন হোস্টেলে যাই, তখন সবিতাদিকে পুরনো সবার কথা জিজ্ঞেস করতে করতে অপর্ণাদির কথাও উঠল। উনি একবার কোন কাজে নরেন্দ্রপুর গেছিলেন। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন হঠাৎ একটা লম্বা মত সুন্দর মেয়ে হেঁট হয়ে ওনাকে প্রণাম করলে উনি অবাক হন। মেয়েটি পরিচয় দেয়। এই আমাদের অপর্ণাদি। হাসিটা দেখে সবিতাদিও চিনতে পারেন। এই ঘটনা বলতে বলতে সবিতাদির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

Saturday, July 4, 2009

হোস্টেলের স্মৃতিঃ পর্ব-১

হোস্টেল পর্ব-১
আনন্দ আশ্রম হোস্টেলের কথা এলে প্রথমেই সবিতাদির কথা বলতে হয়। উনি আমাদের দেখাশোনা করতেন। অনেক বছর পর হোস্টেলে গিয়ে ওনাকে দেখতে গেছিলাম। উনি একদম একরকম আছেন, শুধু কানের পাশে কিছু চুলে সাদা পাক ধরেছে। সবিতাদিকে প্রচন্ড ভয় পেতাম। স্কুলে পরীক্ষার খাতা সৈ করাতে আমাদের কাল ঘাম ছুটে যেত। উনি বেশি চ্যাঁচামেচি করতেন না, কিন্তু খুব শাস্তি দিতেন, কান ধরে, ঠাস২ করে খুব মারতেন। আমি একবারই ওমন মার খেয়েছিলাম। এছাড়া ছিলেন দিদু। উনি ঠিক কেন আমাদের সাথে উপরে থাকতেন জানি না। কারণ নিচে অনেক বৃদ্ধারা থাকতেন, মনে হয় নিচে বৃদ্ধাশ্রম ছিল। ২তলা বাড়িতে উপরে সবিতাদি ও দিদুর সাথে আমরা ৩০-৪০ জন মেয়ে থাকতাম। বিশাল হল ঘরে ২দিকে বেড পাতা থাকত। দেওয়ালের দিকে ট্রাঙ্ক রাখতাম। পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট ঘরে দিদু ৫-৬ জনকে নিয়ে থাকতেন। নিচে বয়স্ক বৃদ্ধারা থাকতেন, টুকটাক কাজ করতেন। একজনকে মনে পরছে খুব লম্বা, হাত-পা কেমন বেঁকে গেছিল, চুল সব প্রায় পাকা। উনি কেবল লাল পাড় সাদা শাড়ি, কপালে বড় লাল টিপ পরতেন। ইনি তেমন কাজ করতে পারতেন না, সবজি এলে লঙ্কার বোঁটা ছারিয়ে ঝুড়িতে সুন্দর করে রাখতেন। বাকি কেউ আচার করে স্কুলে বিক্রী করতেন। একজন নাম মনে হয় মুকুলদি, আমাদের স্কুলের সামনে ছোট্ট একটা ক্যান্টিন চালাতেন। ১০পয়সার বড়২ সুজির বিস্কুট খুব খেতাম।
আমাদের বিল্ডিং ছিল ছোট। ওদিকে ঠাকুরবাড়ি চারতলা আর বিশাল। ৪তলাতে ঠাকুর ঘর। রামকৃষ্ণ, সারদামা ও বিবেকানন্দের পুজো হত। সামনে বিশাল দালানের মত জায়গায় আমরা প্রায় ৪০০মেয়েরা ও দিদিমনিরা বসে আরতি দেখতাম। দেওয়ালে বিবেকানন্দের বিভিন্ন সময়ের বড়২ ছবি, সারদামা ও ভগিনী নিবেদিতার সেই বিখ্যাত ছবি- সব থাকত। ঠাকুর ঘরে বিশেষ২ দিনে খুব বড়২ উৎসব হত। শিবরাত্রিতে হোম, হোস্টেলের দিদিরা শাড়ি পরে, রাত জাগত। একাদশীতে রাম-নাম হত, এত ভাল লাগত! এখনও তার সুর কানে বাজে।
এই বাড়ির পিছনে লাগয়া আর একটা বিল্ডিং ছিল, সামনে থেকে দেখলে বোঝাই যেত না। ওটাও বেশ বড়। এই দুই বাড়িতেই হোমের ৩০০-৩৫০ মেয়ে থাকত। বড়২ হলে মাটিতেই বিছানা করে শুত। সকালে আবার হল পরিষ্কার, আমি ভাবতাম এত্ত বিছানা গেল কোথায়! এছাড়া, কদমতলা, কলাবাগানের কাছে একটা বিশাল সেড দেওয়া হলঘর ছিল। অনেকদিন বন্ধ ছিল। হোস্টেলের ১০০ বা ১২৫বছর যখন হল তখন তা খুলে পরিষ্কার হয়। সে সময় অনেক ভাম বের হয়। সেগুলোকে খাঁচায় রাখা হত। সকালে আমরা দেখতে যেতাম। দুপুরে নাকি চিড়িয়াখানা থেকে এসে নিয়ে যেত। এই হলে সে বার বেশ কিছুদিন ধরে মাইক-টাইক লাগিয়ে অনুষ্ঠান হল। অপর্ণাদি নাটক করল, খুব প্রশংসা পেল। আমিও হারমোনিয়াম নিয়ে মাইকে হল ভর্তি লোকের সামনে কি গাইলাম ভগবান যানেন! তবে স্টেজ থেকে নামতেই বাড়ি থেকে আসা মেজমা বলল সব ভুল হয়েছে, তবে সবিতাদি তার কিছুদিন পর ঠাকুর ঘরে বাইরে থেকে আসা কিছু বিদেশীর সামনে আমায় হারমোনিয়াম নিয়ে বসিয়ে দেয়। আর এমন ভাগ্য! তখন বোধহয় ঐ একটা গানই শিখেছি। এবারতো খুব লজ্জা করছে! বিদেশীরা কি বুঝল ভগবান যানে! শেষ হতে সবাই খুব আদর করল। এতে সবিতাদি খুব গর্ব বোধ করলেন। হোস্টেলে আমার অলিখিত প্রমশন হল। সবিতাদি যখনই বাইরে যান আমাকে সাজিয়ে-গুজিয়ে নিয়ে যান। এবং বাচ্চা মেয়েটাকে টুকটাক খাওয়াতেনও। আমি আসলেই বাইরে কি২ হল তার খবর বন্ধুরা নিত। হোস্টেলটা তখন সবার খাঁচা লাগত।
কদমতলার পিছনে, বড় পুকুর ছিল, জাল দিয়ে ঘেরা। তার সামনে একটা বাড়ি ছিল সেখানে হোমের মেয়েদের তাঁত শেখান হত। প্রায়ই খট্‌, খট্‌ করে আওয়াজ হত।
ঠাকুরবাড়ির ঠাকুর ঘরের নিচেরতলায় আশ্রম মার ঘর ছিল। ঘরটাতে গেলে এক অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি হত। আশ্রম মা অনেক দিন মারা গেছিলেন কিন্তু ঘরে ঢুকলে মনে হবে উনি হয়ত একটু বেরিয়েছেন, এক্ষুনি আসবেন। খাটটা টান২ করে পাতা, ওনার ছবি বসান, তাতে কাপড় পরান, পাশে ছোট টেবিল, তাতে পেন, লেখার প্যাড, চশমা। ওদিকে একটা মিডসেফ। সেখানে খাবারও রাখা হত। আশ্রম মার পায়ের ছাপ দেওয়ালে টাঙান থাকত।
সে সময় হোস্টেলে টিভি ছিল না। প্রতি রবিবার ‘রামায়ণ’ সিরিয়াল হত আর ঠাকুরবাড়ি আমরা লাইন করে যেতাম। বিশাল হলঘরে আগেকার বিশাল কালো-সাদা টিভি। দু পাশে লাইন দিয়ে ২০-৩০টা মোড়া পাতা, যারা বয়স্ক এবং নিচে বসতে পারতেন না তাদের জন্য। আমরা হোস্টেলের গোটা ৩০-৪০ মেয়ে আর হোমের ৩০০-৩৫০ মেয়ে এবং তাদের প্রচুর দিদিমনিরা সবাই পূজো করার মত হাত জোর করে বসে ওই একটাই সিরিয়াল সপ্তাহে দেখতাম।
একবার এখানে দুপুরে বাঞ্ছারামের বাগান হবে বলে রটে যায়। আর এটা নাকি না দেখলে জীবনই বৃথা। এদিকে আমাদের স্কুল আছে! কিন্তু হোমের মেয়েগুলো বেশ স্কুল কাটতে পারত। সবিতাদি হোমের মেয়েদের সাথে আমাদের বেশি মেলামেশা পছন্দ করতেন না। আর আমরা গুটি কয় মেয়েকে তিনি হাতের তেলোর মধ্য রাখতেন। ফলে স্কুল কি করে কাটা যায় ভেবে পাচ্ছি না! তবে সবিতাদি বাচ্চাদের অসুখকে ভিষণ ভয় পেতেন। শীত পড়লেই আমাদের লাইন করিয়ে কাঁচা হলদ আর গুড় খাওয়াতেন। পড়ে কি একটা হোমিওপাতিক মিষ্টি গুলি। শেষেরটাই কেবল ভাল লাগত। কিন্তু উনি দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে খাওয়াতেন তাই ফেলতেও পারতাম না। সবিতাদি কিন্তু অনেক খাবার আমায় জোর করে খাইয়ে২, খেতে শেখান। বাড়িতে কেউ হয়ত অত দেখত না। আমি ডিমের কুসুম, তেতো, ফল –এসব সবিতাদির দৌলতে খেতে বাধ্য হতাম। তো, স্কুল ফাঁকির প্ল্যান হল অসুখের অযুহাতে। সে সময় দুষ্টু বুদ্ধি গজাচ্ছে মগজে। আমি ক্লাস ফাইভে, আমার সঙ্গী ফোরের পিংকি আর সীমা। ওরা দুটোই আমার চেয়ে লম্বা। আর নাটের গুরু বেশিটাই পিংকি। ও রাজস্থানী মেয়ে। খুব লম্বা-চওড়া। তখন ও ছোট হয়েও বড়দের কাছেও খুব পাত্তা পাচ্ছে। কারণ ছুটির দিন সবিতাদি ঘরে না থাকলে আমাদের ছোটর দলকে দরজা, সিঁড়িতে পাহারায় বসিয়ে বড় দিদিরা পিংকির নাচ দেখত। পিংকি ‘এক-দো-তিন-চার-পাঁচ-ছেয়-.........তেরা করু...’ এ সব হিন্দি নাচ নাচত। আমাদের বাড়িতে দাদু একরকম হান্টারের উপর রাখত। টিভি ছিল কিন্তু দেখতে পেতামনা, আক্ষেপও ছিলনা। কারণ আমরা ৮ভাই-বোন মনের সুখে টিচার২, চোর-পুলিস, বাড়ি২-খুব খেলতাম। ফলে আমি মিঠুন-হেমামালিনীকেও চিনিনা বলে খুব হেও হতাম। ফলে পিংকি আমাদের লিড করছে তখন। সীমাটা প্রচন্ড ভীতু ছিল। পিংকি কিকরে যেন নিচ থেকে গোটা পিয়াজ নিয়ে এলো। আমরা চান করে বগলে সেই পিয়াজ কেটে দিয়ে রোদে বসে গা গরম করে কাঁচু-মাচু মুখে সবিতাদিকে বল্লাম জ্বর হয়েছে। উনি কপালে হাত দিয়ে দেখে আমাদের শুতে পাঠিয়ে, নিজে কাজে চলে গেলেন। সারা হোস্টেল ফাঁকা। দিদু আর আমরা তিন মূর্তি। দিদু যথারীতি দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ল, হোমের মেয়েকে বলাছিল ওরা একটা নিচ থেকে আওয়াজ দিল, আমরা গুটি২ নিচে নেমে এলাম। নিচ ও নিস্তব্ধ। সব প্ল্যান মতই চলছিল। এবার মেন গেটে গিয়ে দেখি সেটি সবিতাদি তালা মেরে গেছেন। তিনজন যা বোকা বনলাম! তারপর আর কি! মুখ চুন করে গুটি২ আবার বিছানায়!
পরে রুমকি আর চৈতালী এলে আমি আর পিংকিদের পাত্তা দিতামনা। রুমকি যদিও পিংকিদের সাথে পড়ত। ও অনেক বড় ছিল। বাড়িতে কি সব গন্ডোগোলের জন্য স্কুল যেতে পারেনি। মামার বাড়িতেই পড়ত। পরে মামারা বিয়ে করলে হোস্টেলে ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়। তবে ও ক্লাস নাইনের অংকও পারত। বড়দের কতবার ওর কাছে অংক দেখাতে আসতে দেখেছি! চৈতালী আমার সাথেই পড়ত। এবার আমরা তিনজন অভিন্ন আত্মা হলাম।

Thursday, July 2, 2009

আমার মেয়েবেলা......



স্কুল পর্ব-
আমার মেয়েবেলা –প্রকৃত বা সুখের মেয়েবেলা বলতে আমার একটা বছরই উজ্জ্বল রূপে মনে আসে। সেই নাকতলা আনন্দ আশ্রমে ক্লাস ফোরের দিনগুলির কথা।
দিদা-দাদু-কাকা-কাকিদের যৌথ পরিবারে মানুষ হচ্ছিলাম। পাপাকে তখন কাছে পেতাম না। এখন বুঝি তখন পাপা আবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। সে সময় আমার হোষ্টেলে ভর্তির ব্যবস্তা হয়। পিসি, দিদা ও পাপা হোষ্টেলে দিতে যায়। হোষ্টেলে ভর্তির জন্য প্রথমে প্রাইমারী স্কুলে পরীক্ষা দিতে গেলাম। চান্সও পেলাম। হোষ্টেলে ভর্তি হয়ে গেলাম। সে সময় আমিই হোষ্টেলে সবচেয়ে ছোট ছিলাম। আমার উপরে অপর্ণাদি ও শেলীদিকে পেলাম। অপর্ণাদি আমার জীবনের ধ্রুবতারা। দেখতে সুন্দর কিন্তু কদম ছাঁট চুল। মানে ন্যাড়া হয়েছিল হয়ত-তখন কচি২ চুল উঠছে। অপর্ণাদি নাটকে অভিনয় করতে ভালবাসত। বিশেষ করে কমেডি। জহর-ভানুর ক্যারিকেচারও করত। হাসির নাটকের বই পড়ে আবার সকলকে নিয়ে তা মঞ্চস্থ করার প্ল্যানও করত। শেলীদি একটু আদুরে ছিল, একটূ বকুনি খেলেই কাঁদত। চাঁপা দেখতে, ছোট২ চোখ, কোঁকড়ান মাথা ভর্তি চুল। একটু চুপচাপ ধরনের। অপর্ণাদির আড়ালেই থাকত। অপর্ণাদি যা বলত তাই করত। ওরা প্রাইমারীতে ক্লাস ফাইভে পড়ত। এদের কথা আমার হোষ্টেল-পর্বে বলব।
প্রাইমারী স্কুল ক্লাস ফাইভ পর্যন্তই ছিল। ক্লাস ফাইভ কেবল মেয়েদের। ফোর অবধি কোএড ছিল। ফোরের ক্লাস টিচার ছিলেন শান্তিদি। উনি আমাদের অঙ্ক নিতেন। ৫০এর উপর বয়স, বেশ রাগী, সব চুল সাদা আর বয়েস্‌কাট, চোখে গোল চশমা, ধপ্‌ধপে সাদা শাড়ি। সোজা হাঁটতেন। একবার স্কুলে ওনার ছেলে ও তার বৌ গাড়ি করে দেখা করতে আসে। শান্তিদিকে প্রচন্ড ভয় পেতাম। ক্লাসে একটা বেঞ্চের দু’দিকে দু’জন মেয়ে বা ছেলে আর মাঝে একজন ছেলে বা মেয়ে বসতো। প্রতি সপ্তাহে বেঞ্চ চেঞ্জ হত। অর্থাৎ ১ম বেঞ্চের স্টুডেন্ট লাস্ট বেঞ্চে ২য় বেঞ্চের স্টুডেন্ট ১ম বেঞ্চের চলে আসত। ফলে সকলেই দিদিমণির চোখের সামনে থাকত। বড়দি ছিলেন বাসন্তিদি(যত দূর মনে হয়)- পরে রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পান। ইনি ইতিহাস পড়াতেন। পড়া না পারলে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। তবে আমায় খুব ভালবাসতেন। শান্ত ছিলাম বলে হতে পারে, আবার পাপা ওনাকে বড়২ হরলিক্সের শিশিতে খাঁটি মধু পাঠাত-সে কারনেও হতে পারে। আমি বরাবর মাঝারি ধরনের স্টুডেন্ট ছিলাম। এবার স্টুডেন্টদের বর্ণনাও দিই। কারণ ছবির মত সব আমার মনে আসছে। শান্তিদি রোল কল করতেন (যত দুর মনে পড়ছে লিখছি)-সৌমেন, দেবশংকর, সুপ্রদীপ, সুব্রত, অশোক, প্রদীপ, অরূপ, রাজু বারুই, রাজু দেবনাথ, অম্বর, দীপঙ্কর, অমিতাভ, গৌতম, সঞ্জয় দত্ত, মধুশ্রী, মধুমিতা, পিংকি ঘোষ, পিংকি সিং, সোনালি সরকেল, সোমা বাগ, সুমনা, ভাষ্যতী, পাপিয়া, উমা, রুবি, সীমা(১), সীমা(২), শিপ্রা, চৈতালী, পম্পা, ঝুমুর, মহাশ্বেতা, ফাল্গুনী, পিয়ালী, সঞ্চিতা, শ্রাবণী, মনিষা......।
১ম হত সৌমেন। ওর ভাই ছিল রাণা। সে নিচু ক্লাসে পড়ত। টিফিনে দাদার কাছে আসত। সেবার হাফিয়ারলির আগে আমবাগানে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল। রাজু বারুই-খেলায় পটু, পড়াশুনায় ভাল নয়। ও ব্যাট করছিল গাছের ডাল দিয়ে, সৌমেন বোধ হয় কাগজের বল নিয়ে দৌড়ে আসছিল, রাজু ওদিকে ব্যাটটা খালি মাটিতে ঠুকছে, শেষে একটা ডালের ছোট্ট টুকরো ছিটকে সৌমেনের চোখে লাগল। সঙ্গে২ ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, এরপর অনেক দিন ও আর স্কুলে আসত না, শেষে যখন এলো, কালো চশমা পড়ে থাকত।
২য় হত দেবশংকর। ও এবার ১ম হয়ে গেল। দেবশংকরকে দেখতে বেশ ভাল ছিল। শান্তিদি ওকে খুব পছন্দ করতেন। আমাদের গল্পের ক্লাস হত। দেবশংকর এই ক্লাসে এগিয়ে-পিছিয়ে ডিটেক্টিভ গল্প বলত। মনে আছে, ঘড়িতে টিক্‌ টিক্‌ করে শব্দ হচ্ছে-এরকম একটা মূহুর্ত পুর ক্লাস খুব নিস্তব্ধ ভাবে রুদ্ধশ্বাসে উপভোগ করতাম। আমিও গল্প বলতাম। সিন্ডারেলা, স্নোহোয়াইট...যথারীতি গল্প শেষ হতনা, আর ঘন্টা পরে যেত। তবু টিফিনে বন্ধুরা আমার পেছনে ঘুরত শেষ শোনার জন্য। তা, দেবশংকর ভাল ছবি ও আঁকত। আমি অনেকদিন পর্যন্ত যানতাম না। আমি তখন খুব ছবি আঁকতাম। সবাই প্রশংসাও করত। শেষে আঁকার প্রতিযোগীতায় শান্তিদি দেবশংকরদের নিয়ে চলে গেলেন। ওরা প্রাইজ ও আনে। পুর প্রাইমারী স্কুলে এই ছেলেটি বিশেষ জনপ্রিয় হয়। একবার অপর্ণাদি ‘ক্ষীরের পুতুল’ নাটকটা স্কুলে করল। নিজে বাদর সাজল, হোষ্টেলের শর্মিষ্ঠাদি রাজকন্যা। শেষে রাজপুত্রের জন্য আসল ছেলে দরকার তখন দেবশংকর পাঠটা করবে ঠিক হল। এদিকে শর্মিষ্ঠাদি হোষ্টেলে সারাদিন ঐ অল্প একটু আভিনয় বার২ দেখিয়ে২ মাথা খারাপ করছে। আমার খুব রাগ হত। শেষে কোন কারণে দেবশংকর অভিনয় করেনি, হোষ্টেলের ইন্দ্রানীদি ওটা করে। এতে আমি খুব সন্তুষ্ট হই। এখন ভাবলে হাসি পায়।
সে সময় যারা র্যা ঙ্ক করত তারা ক্লাসে ভাল স্টুডেন্ট আর যারা এমনি পাশ করছে তারা বাজে। মেয়েদের মধ্যেও এমন ভাগ ছিল, আমি অবশ্যই শেষ দলের। আমাদের সাথে ভাল মেয়েরা তেমন মিশত না। ওরা একটু অহংকারী ছিল। আমরাও তা মেনে নিতাম। কিন্তু ছেলেদের মধ্যে অমন ভাগ ছিল না। দেবশংকরের সাথে ক্লাসের সব বাজে ছেলেদের খুব বন্ধুত্ব ছিল। গৌতম নামে একটা বোকা-হাবা ধরনের ছেলে ছিল। একবার টিফিনে আমার চুল টেনে ধরল। সে সময় আমি চুল নিয়ে ভিষণ প্যাক খাচ্ছি। বাড়িতে যখন থাকতাম, স্কুলে ছুটি পরলেই দিদা আমাকে আর আমার খুড়তুতো বোনকে নিয়ে আমাদের মন্দিরের পাশে যে নাপিত বসে তার কাছে চুল কাটতে নিয়ে যেত। আমরা হাতে টুপি নিয়ে যেতাম। দুজনে ন্যাড়া হয়ে টুপি মাথায় ফিরতাম। হোষ্টেলে আসার পর আমি এর প্রতিবাদ করলাম, তো দিদা কানের নিচ থেকে চুল কেটে পাঠালো, যাতে চুল বেশি না বারে। কিন্তু তাও স্কুলে রক্ষা পেলাম না। ফলে গৌতমের উপর ভয়ানক রেগে তাড়া করলাম মারবো বলে। ও দৌড়াতে২ হাইস্কুলের সামনে বকুলতলায় চলে গেল। ওখানে দেবশংকররা টিফিন করছিল। গৌতম ওকে গিয়ে ধরল, ওরা সবাই দেবশংকরকে ‘গুরু’ বলত। এবার দেবশংকর বলল গৌতমকে ছেরে ওকে ধরতে হবে। এবার ওর পিছু নিলাম। ও পাই২ করে দৌড়াচ্ছে, পেছনে আমি। আমাদের পেছনে আমাকে ওস্‌কাচ্ছে আমার বন্ধুরা-শিপ্রা, সোমা। আর ওর সাথে ওর ছায়া প্রদীপ। প্রদীপটা প্রতি ক্লাসে ২বার করে পড়ত। গাছে উঠে পা উপরে মাথা নিচে করে হাত ছেড়ে ঝুলত। আমরা ওকে হনুমান বলতাম। তো, আমরা দৌড়াতে২ আমাদের প্রাইমারী স্কুলের কাছে আসতেই টিফিন শেষের ঘন্টা পরে গেল। সে সপ্তাহে দেবশংকর পেছন বেঞ্চে বসে। আমি সামনের বেঞ্চের উল্টো দিকে। অফ্‌ পিরিয়ডে শিপ্রা বলল দেবশংকরকে ছুঁয়ে দিতে তাহলেই আমি জিতে যাব। কিন্তু প্রদীপের জন্য হল না।
ক্লাসে ভাল ছেলে আরো ছিল-সুপ্রদীপ, সুব্রত। সুপ্রদীপ কেমন আলাদা২ থাকত। ওর বোন ও ওর মত দেখতে ছিল। নিচু ক্লাসে পড়ত। খুব ফর্সা, মোটাসোটা, মিষ্টি মত। এখন মনে হয় সুপ্রদীপ খুব গম্ভীর বিজ্ঞানী বা ডাক্তার গোছের কিছু হবে। সুপ্রদীপকে আমার ভাললাগত না। কারণ মনে আছে একবার পাপা বন্ধুদের উপহার দেবার জন্য অনেক ছোট২ ডাইরী দেয়। সবাই নিয়েছিল শুধু সুপ্রদীপ নেয়নি। এটা আমার ভাল লাগেনি। পরে ফাইভে উঠলে একবার দীপঙ্কর স্কুলে কোন কারনে আসে আর আমার সাথে দেখা হলে সেই ডায়রীটাও দেখায়।
সুব্রতও র্যা ঙ্ক করত। খুব লম্বা ছিল। আমি বরাবর খুব ছোটখাট, ফলে সুব্রতকে আমার তালগাছ মনে হত। ও একবার একটা বাবুই পাখির বাসা ক্লাসে আনে। সেটা অনেক দিন আমাদের রুমে সাজান ছিল।
ক্লাসে বেশ ডাকাবুকো কিছু মেয়েও ছিল। প্রথমেই মনে পরে উমার কথা। বেশ ফর্সা, লম্বা, মোটাসোটা। মনে আছে ওর মুখে একটা বড় আঁচিল ছিল। উমা ছারাও ছিল, শ্রাবণী, এ একটু তোতলা ছিল। সোমা বাগ, সবাই আমাকে আর ওকে বাঘ-সিংহ বলত। সোমা বেশ সুন্দর দেখতে ছিল। এছাড়া, পিংকি সিং ও সে বছর আমার সাথেই ভর্তি হয়। ভাষ্যতীও আমাদের সাথে আসে। মেয়েদের মধ্যে ১ম হত মধুশ্রী। খুব গম্ভীর! মোটা হাই পাওয়ারের চশমা চোখে, কারো সাথে মিশত না। আমার তখন বিখ্যাত আঁকা ছিল ২-৩টে ‘M’এর মত পাহাড়, তাদের মাঝে অর্ধেক সূর্য উদিত হচ্ছে, আকাশে অনেক ‘V’এর মত পাখি উড়ছে, পাহাড় থেকে সরু নদী নেমে এসে মোটা হয়েছে, পাশে একটা কুঁড়ে ঘর, চারপাশে কিছু বড় গাছ- এই সব। সবাই প্রশংসা করত, নিজেকে বড় আর্টিষ্ট মনে হত। তবু মধুশ্রীও আমাকে ফেলে কমপিটিসনে চলে যায়।
এখন শারীর শিক্ষার ক্লাস হয় ঠিকই তবে আমাদের বাংলা মিডিয়ম স্কুলে তখন খুব ব্রতচারী হত। ‘চল কোদাল চালাই/ফুলের বাগান বানাই’ ইত্যাদি। ক্লাস টেস্টে হেড দল তৈরি করত। ছেলে ও মেয়েদের আলাদা ভাবে পরীক্ষা হত। শান্তিদি প্রায় সব সময় দেবশংকরকে হেড করতেন। দড়ি ধরে টানাটানির একটা খেলাছিল। মেয়েদের দুটো দল হল। দড়ির দুদিকের সামনে নেত্রী থাকবে। এক দলের নেত্রী হল মধুশ্রী। অন্য দলের নেত্রী দেবশংকর আমায় করল। এদিকে মধুশ্রী আমার চেয়ে বেশ লম্বা। নেত্রী হওয়াতে আমার খুব ভাল লাগল। কিন্তু আফশোস আমাদের দল শেষ পর্যন্ত হারে।
আমাদের অফ্‌ পিরিয়ডে যাতে গন্ডগোল না হয় তাই হেড যারা কথা বলত তাদের নাম বোর্ডে লিখে রাখত। পরে শান্তিদি তাদের শাস্তি দিতেন। তবে যে নাম লিখবে সেও যদি বানান ভুল লেখে তবে তাকেও শাস্তি পেতে হত। শাস্তি ছিল বেঞ্চে মাথা ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ান। যখন দেবশংকর বা অন্য কেউ হেড হয়েছে তখন আমার নাম কখনও বোর্ডে ওঠেনি। এর কারণ অবশ্যই আমার নামের বানান। আমিও মাঝে২ ভুল করতাম। কারণ ১মে ‘দী’, তার উপর ২য়তো নিতায় ‘ন্ব’ করতে হত। অনেকেই ভুল করে ফেলত। ফলে আমি মনের আনন্দে কথা বলতাম। অম্বর নামে একটা ছেলে হেড হয়ে ১ম আমায় কথা বলার জন্য শাস্তি খাওয়ায়। ও আমার খাতা নিয়ে গিয়ে বোর্ডে নাম তোলে।
টিফিনে আমরা হস্টেলের মেয়েরা পাশেই হোস্টেলে চলে যেতেম। ফোরে আমিই শুধু ছিলাম। টিফিন খাবার পরও বেশ খানিকটা সময় থাকত। আমাদের হোস্টেল, ৩টে স্কুল, হোম নিয়ে আনন্দ আশ্রমের বিশাল এলাকা ছিল। বড় স্কুলের সামনে বড়২ অনেক বকুলগাছ ছিল, আমরা বকুলতলা বলতাম। এরকম আমবাগান, কলাবাগান-সব ছিল। আমরা ছোটরা আমবাগানেই বেশি খেলতাম। আমরা মেয়েরা একটা খেলা খেলতাম। দু’দলে ভাগ হয়ে যেতাম। সবাই সবার কোমর জড়িয়ে ধরতাম। অনেকটা সাঁওতাল নাচের মত। তারপর এক পা এগিয়ে আর এক পা পিছিয়ে সুর করে দু’দল ছড়া কাটতাম-
“১ম দলঃ ইলারিং বিলারিং সৈ লো!
২য় দলঃ কিসের খবর আইলো!
১ম দলঃ রাজামশাই একটি বালিকা চাইলো।
২য় দলঃ কোন বালিকা চাইলো।
১ম দলঃ (২য় দলের কোন মেয়ের নাম করে)-বালিকা চাইল।
২য় দলঃ কিসে করে নিয়ে যাবে?
১ম দলঃ পালকি/রথ/ঘোড়া-(যে কোন একটা)করে নিয়ে যাবে।।”
শেষে ঐ মেয়েটি ১ম দলে চলে যেত। এভাবে খেলা চলত।
এছাড়া, খুব কিৎ কিৎ খেলা হত। হোষ্টেলেও এটা খুব খেলা হত। শর্মিষ্ঠাদি কিৎ কিৎ চ্যাম্পিয়ন ছিল। শুয়ে২ ঘুমের ঘোরেও ও কিৎ কিৎ খেলত। স্কুলে আমাদের চ্যাম্পিয়ান ছিল-পাপিয়া। মনে আছে পাপিয়া আমার চেয়েও উচ্চতায় ছোট ছিল। একবার ওর মাঝের দাঁত পড়ে গিয়ে ফোগ্‌লা হয়ে যায়। দেখতে খুব দুষ্টু আর মিষ্টি ছিল। আমি আবার কোন খেলাতেই তেমন পাকা ছিলাম না। আর ও চ্যাম্পিয়ান হয়েও সব সময় আমাকেই ওর জুটি হিসাবে নিত। আমরা ছোট২ চোট্টামিও করতাম। ও আমায় খুব ভালবাসত। ক্লাস ফাইভে ও অন্য স্কুলে চলে যায়। তবু সরস্বতী পূজোয় শাড়ি পরে আমার সাথে দেখা করতে আসে।
এভাবে আমার ভীষণ সুন্দর ক্লাস ফোর শেষ হয়ে যায়। ভেবেছিলাম সরকারী বই জমা দেবার সময় আবার সবার সাথে দেখা হবে। কিন্তু সবাই যখন এলো, আমি তখন ছুটি কাটাচ্ছি জলপাইগুড়িতে।

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers