Blog Archive

Sunday, January 15, 2012

বিস্মৃত এক শিল্পী- তুলসী চক্রবর্তী


আজ তুলসী চক্রবর্তী সম্পর্কে একটু জানাতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে তিনি –হেঁশেল বাড়ির হলুদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের কাছে যিনি ছিলেন ভারতের মরিস শিভ্যালিয়র।

১৮৯৯সালের ৩রা মার্চ কৃষ্ণনগরেরর গোয়ারীতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আশুতোষ চক্রবর্তী রেলে কাজ করতেন, ফলে ছেলেবেলা তুলসী চক্রবর্তী অনেক ঘুরেছেন। পরে বাবার অকালমৃত্যুর পর তুলসী অল্প বয়সে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে জ্যাঠামশাই প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় আশ্রয় পান্।

মা নিস্তারিণী দেবীকে নিয়ে কলকাতায় এসে তার প্রথম লক্ষ্যই ছিল একটা ভাল চাকরী খোঁজা। ভাল গান গাইতে পারতেন, বিশেষ করে কীর্তনাঙ্গের গান। গিরিশ পার্কের পার্বতী ঘোষ লেনের ব্যায়ামাগারে নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীরচর্চাও করতেন।

জ্যাঠামশাইয়ের অর্কেষ্ট্রা পার্টির গ্রুপ ছিল। কলকাতার বড়লোক রাড়িতে নানা অনুষ্ঠানে তাঁর দল নাটক করত। তুলসী চক্রবর্তীও সে দলে যোগ দিয়ে কীর্তন ও শ্যামা সঙ্গীত গাইতেন। পরে জ্যাঠামশাই স্টার থিয়েটারে যোগ দিলে কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে চিৎপুরের এক মদের দোকানে বয়ের কাজ জোটালেন। জ্যাঠামশাই খবর পেলে কাজ ছাড়তে হল।
এরপর কাজ নিলেন ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে। সেখানে বেশিদিন মন টিকল না তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে বর্মা গেলেন। যে জাহাজে পালালেন সেটিতে বোসেস সার্কাস পার্টিও চলেছিল। সেখানেই চাকরি নিলেন। মাঝে মধ্যে শোয়ের ফাঁকে জোকারও সাজতেন। এভাবেই তিনি হাস্য-কৌতুকের প্রতি ঝোঁকেন। একথা সত্য যে সারা জীবন হাস্য-কৌতুক করলেও তিনি কখনও ভাঁড়ামো করেন নি।


অ্যান্ড্রু রবিনসন ‘পরশপাথর’-এ তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘chakravarti recalls Chaplin to his best. Instead of moustache, he has a pair of eyes as bulbous as a frog’s which he opens wide with every emotion known to man.’
যদিও চার্লি চ্যাপলিন সম্পর্কে তুলসী চক্রবর্তী খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন বলে জানা যায় না। তার সম্পর্কে সৌমিত্র চ্যাটার্জির বলেছেন, ‘তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়ে কোথাও বিদেশের অভিনেতাদের কোনও প্রভাব লক্ষ করা যায় না। সে অভিনয় নিতান্তই দেশজ। দেশের মানুষের চরিত্র লক্ষণের মধ্যেই তার শেকড় খুঁজতে হয়।’

তুলসী চক্রবর্তী সার্কাসে থেকে কিছু খেলা যেমন শিখলেন তেমনি শিখলেন উর্দু ও হিন্দী বলতে। সার্কাসে তিনি ছয়মাস মত ছিলেন। চলে আসার কারণ জিজ্ঞাস করলে বলতেন,‘শরীর থেকে জন্তু জানোয়ারের গন্ধ বেরচ্ছে দেখে চলে এলুম।’

জ্যাঠামশায় তখন ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ জুটিয়ে দিলেন। সেখানে থিয়েটারের হ্যান্ডবিল ও পোস্টার ছাপা হত। তা দেখে তার অভিনেতা হতে ইচ্ছে করল। জ্যাঠামশায়কে অনেক অনুরোধ করায় তিনি স্টার থিয়েটারে অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের সাহায্যে ঢোকালেন। সে সময় প্রেসে তার মাইনে ছিল ৩২টাকা। স্টারে এলেন ৮ টাকার মাইনেতে!
ত্ৎকালীন ষ্টার থিযেটারের মালিক ছিলেন অপরেশ মুখোপাধ্যায়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই চোখে পড়ে যান অপরেশবাবুর। সালটা ছিল ১৯১৬। এই অপরেশবাবুই তালিম দেন তুলসী চক্রবর্তীকে। টপ্পা গান, পাখোয়াজ বাজানো সব শিখেছিলেন। ধিরে ধিরে তিনি ‘থেটার’ করার সুযোগও পেলেন। ১৯২০ তে প্রথম ষ্টেজে অভিনয় করেন। নাটকের নাম ছিল ‘দুর্গেশনন্দিনী’। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তিনি ষ্টার থিযেটারেই ছিলেন। পরে যোগ দেন, মনমোহন থিয়েটারে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪২টি নাটকে অভিনয় করেন। শেষ নাটক ছিল- শ্রেয়সী ( ১৯৬০)। তার পর তাঁর শারীরিক অসুস্থতার জন্য ( হৃদযন্ত্র) আর নাটকে অভিনয় করেন নি। মঞ্চে অভিনয় তিনি চুটিয়ে উপভোগ করতেন। অসুস্থ থাকলে কিছুদিন ছুটি নিলে থিয়েটার মালিক বাড়িতে মাইনে পাঠালে আনন্দে বলেন, ‘রোগে শুয়ে থাকলেও থিয়েটারের মালিক মাইনে দেন, এই অভিজ্ঞতা এই আনন্দ নিয়ে আমি চোখ বুজবো।’

থিয়েটারে ঢোকার পর খুব যত্ন করে শেখেন পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম, তবলা, ঢোল। সেই সঙ্গে আরেকটা বিষয়েও চর্চা করলেন-নাচ। ‘কবি’ সিনেমায় কবির লড়ায়ে যার পরিচয় পাওয়া যায়।

একবার এক সিনেমা শুটিং–এ অনাহুতের মত হাজির হয়ে বৈষ্ণব সাজার অনুমতি পেলেন। তুলসী চক্রবর্তী বৈষ্ণব সেজে শ্রীখোল হাতে পরিচালকের সামনে যেতেই তিনি তাকে একেবারে সামনের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তুলসী চক্রবর্তী শট দিলেন, খোল বাজাচ্ছেন, মুখে হরিনাম, চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। পরিচালক এত খুশি হলেন যে দেড় মিনিটের শট তিনি চার মিনিট নিলেন এবং সিনেমায়ও রাখলেন।
একবার ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’ নাটকে তবলিয়ার হঠাৎ কলেরা হলে জহর গাঙ্গুলির কথায় তুলসী চক্রবর্তীকে অনুরোধ করা হলে তিনি ধ্রুপদী গানের সাথে অনায়াসে সংগত করে দিলেন। এভাবে যে যখন যা বলছেন করে দিতেন এক লহমায়।


তুলসী চক্রবর্তীর সিনেমা শুরু ১৯৩২সালে নিউ থিয়েটারের ‘পুনর্জন্ম’ সিনেমায়। পরিচালক ছিলেন সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। তাঁর শেষ সিনেমা মৃত্যুর আঠারো বছর পর মুক্তি পায় ১৯৭৯সালে ‘আমি রতন’।
‘শুভদা’য় এক গাঁজাখুড়ের ভূমিকায় অভিনয় করার সময় স্বকন্ঠে গান করেছিলেন।

‘'কবি’'তে কবির লড়াইয়ে নাচ যেমন করছেন তেমনি তিনি গানও করেন।
অভিনেতা তরুণকুমার তাঁর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে জানান যে তুলসী চক্রবর্তীর মুখে প্রায়ই শোনা যেত ‘জয় গুরু জয় গুরু দিপম দিপ্পা দিপম দিপ্পা হরিবোল’। দিপম দিপ্পা হল তবলার বোল।

তরুনকুমার তুলসী চক্রবর্তীকে স্মরণ করতে গিয়ে তার নির্লোভ চরিত্রের কথাও বলেছেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ‘অবাক পৃথিবী’ প্রযোজনা করেন। সেখানে একটা মুদির চরিত্রে উত্তমকুমারের কথায় তুলসী চক্রবর্তীকে নেওয়া হলে তাকে ডাকতে লোক যায় এবং ট্যাক্সিভাড়া দেওয়া হয়। কিন্তু তুলসী চক্রবর্তী কিছুতেই তা নেবেন না, তার বক্তব্য তিনি ট্রামে-বাসে যাতায়াত করেন। পরেরদিন একবেলা কাজ করে যখন উত্তমকুমারের কথা মত তাঁকে তিনশো টাকা দেওয়া হয়। তখনও তিনি তা নিতে অস্বীকার করেন। কারণ তখন তার রেট ছিল ডেলি একশো পঁচিশ টাকা। এ সময় তিনি উত্তমকুমারের সাথে ‘স্টার’-এ ‘শ্যামলী’ নাটকটি করছিলেন।

সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’ সিনেমার সময়ও এমন ঘটনা ঘটে। অনেকদিনের কাজ পাচ্ছেন বলে তিনি অসম্ভব কম পারিশ্রমিক চান। সত্যজিৎ রায় জানিয়েছিলেন তিনি তার ছবির নায়ককে এত কম টাকা দিতে পারবেন না। শোনা যায় ‘পরশপাথর’ করে তিনি ১৫০০ টাকা পান।হাওড়ার নিজের বাড়ীতে ট্রাম ধরে ফিরে যেতেন স্যুটিং এর পর। টাক মাথা, ধুতি হাফ ফতুয়া পরা এই ভদ্রলোক পৌরহিত্যও করতে হত টাকার জন্য।




সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘পরশপাথর’ মুক্তি পায় ১৯৫৮সালে। এর আগেও তুলসী চক্রবর্তী ‘পরশপাথর’ নামে ১৯৪৯সালে আর একটি সিনেমায় ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয় করেন যার পরিচালক ছিলেন অতীনলাল ও ললিতকুমার।

চরিত্র সামান্য হোক বা গুরুত্বপূর্ণ- মনপ্রাণ দিয়ে তিনি অভিনয় করতেন।
তার এই অসামান্য অভিনয় প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে বলতেন,‘আমি একটু চোখ–কান খোলা রাখি, আর সব ধরনের মানুষ দেখে বেরাই। এবার চরিত্র মত তাদের তুলে ধরি। যেখানে যে লাগে আর কি!’
কেউ বাহবা দিলে বলতেন, '‘এই চরিত্র করার জন্য ভাল অভিনয় করার দরকার হয় না কি? তোমার চারপাশে এরা ঘুরে বেরাচ্ছে, একটাকে তুলে এনে নিজের কাঁধে ভর করাও।’'

আসলে তিনি দেখতে জানতেন, যা সকলে পারে না। কেবল ব্যক্তি নয় তিনি সমাজের কাছ থেকেও অভিনয় শিখেছিলেন, তাই তাঁর অভিনয় এত সাবলীল।



‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘একটি রাত’-তিনটি সিনেমায় কোথাও তিনি মেস মালিক, হোটেল মালিক, সরাইখানা-কাম-ধর্মশালার মালিক-সবকটি চরিত্রে তার স্বকীয়তা বজায় আছে। কখনও অভিনয় এক ছাঁচের হয়ে যায় নি।






'সাড়ে চুয়াত্তর' ’-এ গ্রামের বাড়িতে গিয়ে খালি গায়ে পৈতে পরিমার্জনার দৃশ্য প্রসঙ্গে পরে বলেছিলেন,‘পরিচালক নির্মল দে আমায় বলেছিলেন-আপনি বাড়িতে যেমন করেন, তেমনই করবেন। তাই-ই করেছি।’ এই সিনেমায় মলিনা দেবীর সঙ্গে জুটি বেঁধে দারুন অভিনয় করেন।
তাঁর কাঠ-ঘটির '‘কই, কোথায় গেলে গো!'’-ডাক যেন এখনও কানে বাজে।



ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন নিঃস্বার্থ, পরোপকারী। কাননবালা দেবী, জহর গাঙ্গুলিদের তিনি সাহায্য করেন সিনেমা জগতে আসতে।
জহর গাঙ্গুলি শেষদিন পর্যন্ত সে ঋণ স্বীকারের কথা বলতেন। তিনি সবে গ্রাম থেকে এসে কলকাতার মিত্র থিয়েটারে ভিড়ের দৃশ্যে অভিনয় করতেন এবং অন্যদের কাছে খুব খারাপ ব্যবহার পেতেন। তুলসী চক্রবর্তী তখন স্টারে। তাদের আলাপ হয় ও জহর গাঙ্গুলির দুঃখের কথা শুনে এবং নিজের চোখে তা দেখে এসে তাকে স্টারে পরেরদিন আসতে বলেন। সে সময় নির্দেশক অপরেশ মুখার্জির হাতে–পায়ে ধরে অনুরোধ করেন,‘ 'ওকে যদি একটু জায়গা দেন, তা হলে ছেলেটা বেঁচে যাবে'।’ সেই ছেলে পরে নায়কও হন। অন্যদিকে তুলসী চক্রবর্তী সারা জীবন নায়ক-নায়িকার সঙ্গে অল্প সিনেই জীবন কাটিয়ে দিলেন। এজন্য হয়ত হাল্কা দুঃখ তার মনে ছিল।

তিনি ৩১৬টি বাংলা ও ২৩টি মত হিন্দী সিনেমা করেন। তবে জীবনে সব থেকে বেশি আনন্দ পান সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’-এ অভিনয় করে। দর্জি তাঁর পাঞ্জাবির মাপ নিতে আসছে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য, তিনি আপ্লুত হয়ে বলছেন, ‘'উফ! এ আমি কখনও ভাবতেও পারিনি!’'



সত্যজিৎ রায় তাঁর অভিনয় প্রতিভা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। পরশুরামের কলম থেকে বেরনো পরেশ দত্তকে কেমন অবলীলায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। এই ছবিতে তিনি বড় দড়ের অভিনেতা।

‘পরশপাথর’-এ অভিনয়ের সুযোগ পেলে বন্ধু মহলে বলেছিলেন,‘'আমি ছবির নায়ক, বিশ্বেস হচ্ছে না গো!’'

বিখ্যাত সাংবাদিক রবি বসু লিখেছেন- '‘পরশপাথর ছবি রিলিজের সময় তুলসীদা কেমন উদ্‌ভ্রান্তের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। একদিন আমাকে বললেন, এইবারে আমি নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাব। বড় বড় হোর্ডিংয়ে ইয়া বড় বড় মুখ আমার। জীবনে তো কখনও এত বড় বড় মুখ হোর্ডিংয়ে দেখিনি। এর আগে যাও বা দু-চারবার হয়েছে, তা সে সব মুখ তো দুরবিন দিয়ে খুঁজে বার করতে হত। এ আমি কী হনু রে!’'

‘পরশপাথর’ ছাড়া তিনি সে ভাবে আর কোনও সিনেমায় বড় চরিত্র পাননি। তবে নীরেন লাহিড়ীর ‘ভাবীকাল’ ও ফণী বর্মার ‘জনক নন্দিনী’তে সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয় করেন। যদিও এ সিনেমাগুলির প্রিন্ট এখন আর পাওয়া যায় না। ‘জনক নন্দিনী’তে সীতা দেবীর বাবার চরিত্র এবং ‘ভাবীকাল’-এ নায়ক অমর মল্লিকের এক সহচরের ভূমিকায়। ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে আদর্শবাদী নায়ক বদলে যায় কিন্তু সহচর বদলায় না, সেখানেই বাধে সংঘাত। দুর্দান্ত অভিনয় করেন তুলসী চক্রবর্তী।


উত্তমকুমার অভিনীত প্রায় তিন ডজন সিনেমায় তুলসী চক্রবর্তী অভিনয় করেছেন। উত্তমকুমার বলতেন,'‘তুলসীদা যেভাবে অভিনয় করেন, আমি তো কোন দিনই পারব না। ওঁর মতো ‘জীবন্ত’ হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবে না।......তুলসী চক্রবর্তীকে প্রণাম জানানোর একটাই পথ আমার কাছে। যখনই কাজ পাই, পরিচালক প্রযোজককে বলে ওঁকে ডেকে নিই। তুলসীদা থাকলে সিনটা দারুনভাবে উতরে যায়। ওঁর ঋণ শোধ তো করতে পারব না, যেটুকু পারি সাহায্য করি।’'

দুঃখের কথা এই যে আমৃত্যু তুলসী চক্রবর্তী সিনেমায় কমেডিয়ান হয়েই বেঁচে ছিলেন, অভিনেতা হয়ে নয়। এমনকী ‘পরশপাথর’-এর পরও। সেই সাথে দারিদ্র ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী।




সংসার পাতেন স্ত্রী ঊষারানী চক্রবর্তীর সাথে ২নং কৈলাস বসু থার্ড লেন-এ, মধ্য হাওড়ার এক সংকীর্ণ গলির দু’কামরার দোতলা বাড়িতে। ঘরে আসবাব বলতে ছিল একটি প্রাচীন পালঙ্ক, একটি কাঠের আলমারি, গোটা কয়েক টুল আর একটা ইজি-চেয়ার। অবসর সময়ে ঘরেই বসাতেন সংগীতের আসর। তাঁর কিছু গান স্বরচিতও ছিল। সেগুলোতে পছন্দ মতো রাগ বসাতেন।
একটি গান তিনি প্রায় গেয়ে শোনাতেনঃ
‘শিবরাত্রির পরের দিন / শিবের হল সর্দিকাশি/ ঘটি ঘটি জল ঢেলেছে/ জ্যেঠি কাকী মামী মাসী/ তাই শিবের হল সর্দিকাশি/ আদা দিয়ে চা করে/ দুগ্‌গা এসে সামনে ধরে/ ‘সিদ্ধি আজকে খেও না, বাপু’/ বললে শিবে মুচকি হাসি/ শিবের হল সর্দিকাশি।’

এই দোতলাবাড়ি যাওয়ার আগে তিনি একটা ‘বারো ঘর, এক উঠোন’-এ ভাড়া থাকতেন। দোতলা বাড়িটা যখন ছ’হাজার টাকায় কেনেন তাঁর স্ত্রী তখন তাকে তার জমানো বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা পেয়ে তিনি যেমন অবাক হন, তেমনি ভয়ও পান। কারণ তাঁর স্ত্রীর কাছে টাকা কি ভাবে এল ভেবে পাচ্ছিলেন না। তিনি অল্প রেটে যা কাজ করে পেতেন বাড়ি ফিরেই স্ত্রীকে দিতেন, তাতেই সংসার চলতো। স্ত্রী যে তার থেকে জমাতে পারেন ভাবতেই পারেন নি। তবু বাড়ি কেনার সময় স্ত্রীকে বলেছিলেন, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে ‘বাপের বাড়ি থেকে দিয়েচে।’ শুনে স্ত্রী হেসেছিলেন। কারণ বিধবা মা বিয়েই দিয়েছিলেন গোটা দু-তিনটে শাড়ি সম্বল করে।



সাহিত্যিক শংকর তাঁর ‘মানব সাগর তীরে’বইতে লিখেছেন,‘যদি তুলসী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, নৃপতি চ্যাটার্জির মতো অভিনেতা বিদেশে জন্মাতেন, তা হলে তাঁদের স্মরণে এক-একটি সরণি থাকত।’ তুলসী চক্রবর্তীর স্মরণে হাওড়ার মানুষ তাঁর নামে একটি পার্ক গড়ে তুলেছেন।



চক্রবর্তী সম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। সিনেমার লোকজনকে ‘ছেলে’ বলে ডাকতেন। উত্তমকুমার, তরুনকুমারকেও ‘ছেলে’ বলে সম্বোধন করতেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে স্বস্নেহে ‘সৌমিত্তির’ বলতেন। এই সব স্বনামধন্য অভিনেতারাও তাঁকে ভীষণ ভালবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। শোনা যায় শীতে কষ্ট পাচ্ছিলেন বলে, অনুপকুমার তুলসী চক্রবর্তীকে একটা কোট কিনে দিয়েছিলেন। সেটা পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন সন্তানহীন তুলসী চক্রবর্তী। অনুপকুমারকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ছেলে হিসেবে। “

সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন জহর গাঙ্গুলি। ছবি বিশ্বাস, কালী ব্যানার্জি, নৃপতি চ্যাটার্জিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। কখনও বাড়িতে মদ খেতেন না। ঘরে ঠাকুর থাকায় নেশা কাটলে স্নান করে ঘরে ঢুকতেন।

সেলাইয়ের কাজও ভাল জানতেন। থিয়েটারে একবার অন্যের বদলে ক‘দিন রাজার অভিনয় করতে গিয়ে রাজার নাগরা নেই দেখে মোজার উপর নাগরা এঁকে সেলাই করে, মঞ্চে নেমে পরেন। বড় সরল-সাধারণ ছিলেন মানুষটি। সরল–সাধারণ জীবনের অন্তরালে থেকে অন্তরের দুঃখরূপী গরলকে স্তিমিত রাখতেন। সন্তান না হওয়ার দুঃখ। চিন্তা ছিল তাঁর অবর্তমানে ব্রাহ্মণীর ভবিষ্যতের।
এই বরেণ্য অভিনেতাকে অপেক্ষা করতে হত ছোট্ট মাস্টার বিভু ভট্টাচার্যের জন্য বরাদ্দ গাড়িতে বাড়ি ফেরার জন্য। ছবি বিশ্বাস বলেছিলেন উনি হলিউডে জন্মালে অস্কার পেতেন। শুনে নিশ্চয়ই মুচকি হাসেন ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের এই যাত্রী। প্রথাগত স্বীকৃতি হয়ত পাননি কিন্তু তাঁর অভিনয়, দীর্ঘ সিনেমায় স্বল্প উপস্থিতির পরিসর স্বল্প থাকেনি। বাড়ি ফেরার পথে দর্শকের গল্পের বিষয় হতেন তুলসী চক্রবর্তী।

আর পাঁচজন গৃহস্থের মতো ভালবাসতেন স্ত্রীর হাতের রান্না। ভাল সরু চালের ভাত আর মাছের ঝোল তাঁর প্রিয় ছিল। তাছাড়া পছন্দ ছিল ডাল-ভাত, ঘি, ডিম আর মাংস।

মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়ে পরেন। পয়সাও ছিল না চিকিৎসার জন্য। প্রচণ্ড দারিদ্র তো ছিলই, তার ওপরে নিজের বাড়ীটা দান করেছিলেন এলাকার দরিদ্র পুরোহিতদের জন্য।খানিকটা সেরে উঠেই বাজারে গিয়ে একদিন কিনে আনলেন গলদাচিংড়ি, ফুলকপি, কড়াইশুঁটি। রাতে রান্না হল, খেয়ে শুলেন। ভোররাত থেকে শুরু হল ভেদবমি। ভোরে ডাক্তার আসতে না আসতেই সব শেষ। ১৯৬১-র ১১ই ডিসেম্বর তিনি চলে গেলেন অনন্তলোকে। স্ত্রী উষারাণী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন একমুঠো খাবারের জন্য। দারিদ্রের কারণে স্বামীর সবকটি মেডেল বিক্রী করতে বাধ্য হয়েছেন। এভাবে ৩৫ টা বছর কাটিয়েছেন।

মারা যাবার পর সরকারের তরফ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোরও কোনও বন্দোবস্ত ছিল না তখন। যদিও তাতে কিছু আসে যায় না । তিনি আছেন বাঙালির অন্তরে, থাকবেনও।



তুলসী চক্রবর্তীকে না পেলে সত্যজিৎ রায় যে ‘পরশপাথর’ করতে পারতেন না, তা তিনি তাঁর অন্তিমজীবনেও স্পষ্ট করে বলে গেছেন। ‘পরশ পাথর’-এর পরেশ বাবু (তুলসী চক্রবর্তী) পরশ পাথরের মাধ্যমে ধনী হয়েও নির্লোভ থেকে যান। হাতের মুঠোয় অতুল ক্ষমতা হঠাৎ পেলেও তার অপব্যবহার করা উচিত নয়- এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীই যেন পরেশের চরিত্রে ফুটে ওঠে। ছবিতে তাই ‘টুপি’ একটি চমৎকার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। গান্ধীটুপিতে তার টাক ঢেকে রাখা মন্ত্রীদের পরিহাস করে যেন তৃপ্ত হয়েছিলেন পরেশবাবু। ভোটে নামতে গেলে বিদ্যাবুদ্ধির প্রয়োজন নেই। তাই পরেশবাবু নিজেই ভোটে নামতে দ্বিধা করেন না।এই সিনেমায় তাঁর মাথায় সাদা ‘গান্ধী’ টুপি পরা নিয়েও তর্ক ওঠে সেন্সর বোর্ডে। শেষে নিজের টাক ঢাকতে টুপি পরেছেন এই যুক্তিতে আর বিরোধিতা করেনি সেন্সর বোর্ড।



সত্যজিৎ রায়ের জীবনীকার মারি সিট্‌ন লিখেছেন, ‘thanks to Ray's insight into Chakraborty's untapped talent, the culmination of his career was an interpretation of Dutta reminiscent of the rich performances of Michel Simon in it combination of comic, serious and pathetic elements.’
মৃত্যুর পরে অভিনয়ের জন্য এমন স্বীকৃতিই বা ক’জন পান!



তুলসী চক্রবর্তী অভিনীত কিছু সিনেমার তালিকাঃ

প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ‘পুনর্জন্ম’ (১৯৩৩) দিয়ে সিনেমা যাত্রা শুরু
শ্রী গৌরাঙ্গ(১৯৩৩)
দক্ষযজ্ঞ (১৯৩৪)
মানময়ী গার্লস স্কুল (১৯৩৫)
কন্ঠহার (১৯৩৫)
প্রবাস মিলন(১৯৩৭)
নর নারায়ণ (১৯৩৯)
জনক নন্দিনী (১৯৩৯)
বামনাবতার (১৯৩৯)
নিমাই সন্যাসী (১৯৪০)
কমলে কামিনী (১৯৪০)
উত্তরায়ণ (১৯৪১)
প্রতিশ্রুতি (১৯৪১)
সৌগন্ধ (১৯৪২)
শেষ উত্তর (১৯৪২)
পাষাণ দেবতা (১৯৪২)
গড়মিল (১৯৪২)
উদয়ের পথে (১৯৪৩)
মেরি বেহেন (১৯৪৪)
হামরাহি (১৯৪৪)
মানে না মানা (১৯৪৫)
কলঙ্কিনী (১৯৪৫)
দুই পুরুষ (১৯৪৫)
ভাবিকাল (১৯৪৫)
প্রতিমা (১৯৪৬)
মন্দির (১৯৪৬)
বিরাজ বৌ(১৯৪৬)
পথের দাবী (১৯৪৭)
ভুলি নাই (১৯৪৮)
সমাপিকা (১৯৪৮)
পুরবী(১৯৪৮)
বঞ্চিতা(১৯৪৮)
অনির্বান(১৯৪৮)
মঞ্জুর (১৯৪৯)
কবি (১৯৪৯)
বিষ্ণুপ্রিয়া (১৯৪৯)
বামুনের মেয়ে (১৯৪৯)
আশাবরী (১৯৪৯)
দেবী চৌধুরানী (১৯৪৯)
শেষবেশ(১৯৫০)
রূপকথা (১৯৫০)
মেজদিদি (১৯৫০)
মানদন্ড (১৯৫০)
জীবন সৈকতে(১৯৫০)
পন্ডিত মশাই(১৯৫১)
আনন্দমঠ (১৯৫১)
মেঘমুক্তি (১৯৫২)
মহাপ্রস্থানের পথে (১৯৫২)
কপালকুন্ডলা (১৯৫২)
দর্পচূর্ণ (১৯৫২)
সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩)
নবীন যাত্রা(১৯৫৩)
বনো হংসী(১৯৫৩)
জয়দেব (১৯৫৪)
জদুভট্ট(১৯৫৪)
চাঁপা ডাঙার বৌ (১৯৫৪)
উপহার (১৯৫৫)
শ্রীবৎস চিন্তা (১৯৫৫)
নিষিদ্ধ ফল (১৯৫৫)
কালিন্দী (১৯৫৫)
গোধুলি(১৯৫৫)
দুজনে(১৯৫৫)
ভালবাসা(১৯৫৫)
অপরাধী (১৯৫৫)
পথের পাঁচালী (১৯৫৫)
সাঁঝের প্রদীপ (১৯৫৫)
শাপমোচন (১৯৫৫)
জয় মা কালী বোর্ডিং (১৯৫৫)
সবার উপরে (১৯৫৫)
শ্যামলী (১৯৫৬)
একটি রাত (১৯৫৬)
চোর (১৯৫৬)
সাহেব বিবি গোলাম (১৯৫৬)
চিরকুমার সভা (১৯৫৬)
পৃথিবী আমারে চায় (১৯৫৭)
হরিশচন্দ্র (১৯৫৭)
চন্দ্রনাথ(১৯৫৭)
সোনার কাঠি (১৯৫৭)
আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৫৭)
অবাক পৃথিবী (১৯৫৭)
রাজলক্ষী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮)
সদানন্দের মেলা(১৯৫৮)
অন্নপূর্ণার মন্দির (১৯৫৮)
ছেলে কার(১৯৫৮)
গৃহ প্রবেশ(১৯৫৮)
পরশপাথর (১৯৫৮)
যৌতুক (১৯৫৮)
জলসাঘর (১৯৫৮)
অযান্ত্রিক (১৯৫৮)
পার্সোনাল এসিস্টেন্ট (১৯৫৯)
গলি থেকে রাজপথ (১৯৫৯)
শুন বরনারী (১৯৫৯)
চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯)
দীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৯)
নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে (১৯৫৯)
মৃতের মর্তে আগমন(১৯৫৯)
মায়ামৃগ (১৯৬০)
কুহক(১৯৬০)
খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন(১৯৬০)
শেষ পর্যন্ত(১৯৬০)
কেরী সাহেবের মুন্সি(১৯৬১)
স্বয়ম্বরা (১৯৬১)
কাঞ্চনমূল্য (১৯৬১)
সপ্তপদী(১৯৬১)
বিপাশা(১৯৬২)
সূর্যস্নান(১৯৬২)
বেনারসী(১৯৬২)
বিজ্ঞান ও বিধাতা (১৯৭১)
মৃত্যুর আঠেরো বছর পর মুক্তি পায় ‘আমি রতন’(১৯৭৯)



[কৃতজ্ঞঃ গুগুল, ইউটিউব,সংবাদ প্রতিদিনঃ নির্মল ধর, বিশ্বনাথ বসু, বিকাশ মুখোপাধ্যায়]

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers