Blog Archive

Thursday, April 21, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২৫

[পূর্বকথা - অগ্নির হাত থেকে রক্ষা করায় কৃতজ্ঞ ময়দানব কৃষ্ণের আদেশে ত্রিলোক বিখ্যাত দিব্য মণিময় সভা নির্মাণ করলেন ইন্দ্রপ্রস্থে... একদিন নারদমুনি সভায় উপস্থিত হলেন এবং নানা উপদেশ দিয়ে লোকপালদের সভা-বর্ণনা করলেন এবং সব শেষে জানালেন পান্ডুর মনের ইচ্ছে পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে যেন স্থান করে দেয়.....]



যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ চিন্তা ও শ্রীকৃষ্ণের নিকট দূত প্রেরণঃ 

নারদমুনির মুখে পিতা পান্ডুর মনের ইচ্ছের কথা শুনে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির চঞ্চল হলেন। অন্য কিছুতে আর মন দিতে পারেন না। 
তিনি ভাইদের ডেকে বলেন –নারদমুনি বলে গেলেন পিতার ইচ্ছে আমরা রাজসূয় যজ্ঞ করি, তাহলে তিনি ইন্দ্রপদের স্থান পাবেন। আমি এ যজ্ঞ করতে চাই। সকলের কি মতামত! 
চারভাই মত দিলেন। 
সব শুনে মন্ত্রী ও পারিষদরা যজ্ঞের সপক্ষে বলে – চিন্তা করবেন না মহারাজ, আপনি এ যজ্ঞ করুন। কার সাধ্য আপনাদের বিরোধ করে! 

মন্ত্রীদের কথা শুনে যুধিষ্ঠির মনে মনে ভাবলেন –যার যে কাজে শোভা পায় না, তার সে কাজেই বেশি লোভ হয়। তারপরে বিড়ম্বনা হতে পারে। চারদিকে সবাই নিন্দা করবে। তার উপর রাজসূয় এক বিষম যজ্ঞ, সকলে তার যোগ্যও হয় না। কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে গোবিন্দের পরামর্শ নিতে হবে। এই কর্ম আমার যোগ্য কিনা তিনিই সঠিক বলতে পারবেন। তিনি যদি সম্মতি দেন তবেই আমি এ যজ্ঞে ব্রতি হব। 
এই ভেবে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের কাছে ইন্দ্রসেনকে(যুধিষ্ঠিরের সারথি) দূত হিসেবে পাঠালেন। 

দূত দ্রুত দ্বারকায় পৌঁছে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ করে সকল কথা নিবেদন করে যোড়করে বলে –আপনার অদর্শনে কুন্তীপুত্র মনের দুঃখে আছেন। 

একথা শুনে গোবিন্দ দ্রুত বৈনতেয়(বিনতার পুত্র-গরুড়) আরোহণ করে ইন্দ্রসেনের সাথে চললেন। 
সূর্য পাটে গেলে তারা ইন্দ্রপ্রস্থে এসে পৌঁছালেন। 

কৃষ্ণ স্বয়ং এসেছেন শুনে আনন্দিত যুধিষ্ঠির ভাই ও মন্ত্রীদের ডেকে পাঠালেন। তিনি নিজে এসে কৃষ্ণের অভ্যর্থনা করলেন।

কৃষ্ণ ধর্মপুত্রকে নমস্কার জানিয়ে সকলের কুশল সংবাদ নিলেন। 
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির ভক্তিভরে কৃষ্ণের পূজা করেন। সবশেষে সকলে মিলে সভায় আলোচনা করতে বসলেন। 

তাদের দেখে মনে হল যেন চন্দ্রের মণ্ডলী। 

যিনি নিজ হৃদয়ে সদা শ্রীহরির চরণ বন্দনা করেন, তার চরণকমল সদা কাশীরাম ভজেন।
....................................



গোবিন্দ-যুধিষ্ঠির সংবাদঃ

ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কৃষ্ণ-গোবিন্দকে বলেন –নারদমুনিকে পিতা পান্ডু মহারাজ বলেছেন যে রাজসূয় মহাযজ্ঞ সংসারে দুর্লভ। এই যজ্ঞ করলে পিতা খুশি হবেন, ইন্দ্রসভায় স্থান পাবেন। সে কারণে আমি এযজ্ঞ করতে চাই। 
এখন আপনার অনুমতি প্রয়োজন। সকলেই আমার মতে মত দিচ্ছেন। কেউবা আমার উপর প্রীত হয়ে, কেউবা ধনের লোভে। 
কিন্তু আপনার মুখ থেকে অনুমতি না পেলে মনের সন্দেহ দূর হবে না। আমার এখন কি কর্তব্য বলুন। আপনি পাণ্ডবদের পতি, আপনার অনুমতি বিনা আমরা কোন পথ দেখতে পাই না। 

গোবিন্দ বলেন –আপনি সর্ব গুণবান। আপনার সমান রাজা পৃথিবীতে কেউ নেই। আপনি এই যজ্ঞের যোগ্য ব্যক্তি। 
তবে আপনার কাছে আমার এক নিবেদন আছে। আমি যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। এই মহাযজ্ঞের জন্য এক লক্ষ রাজার সহযোগিতা চাই। মগধের রাজা জরাসন্ধ এখন শ্রেষ্ঠ রাজা। পৃথিবীর অধিকাংশ রাজাই এখন তার বশ্যতা মেনে নিয়েছে। সকলে তাকে ভয় পায়। অধিকাংশকে সে বলপ্রয়োগ করে বেঁধে এনেছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু দুষ্ট রাজারা। এদের মধ্যে উল্লেখ্য-শিশুপাল, করূষরাজ দন্তবক্র, যবনরাজ, পুণ্ডরীক, কোশলরাজ, বাসুদেব, বিদর্ভরাজ রুক্মি, প্রাগজ্যোতিষের রাজা নরকের পুত্র মহাবীর ভগদত্ত-এমন অনেক রাজা তার দলে আছে। 
ইক্ষ্বাকু(সূর্যবংশীয় প্রথম রাজা, বৈবস্বত মনুর পুত্র) ও ইলার বংশের যত রাজারা আছে তাদের অধিকাংশ জরাসন্ধের বশ্যতা মেনেছে। যারা মানেনি তারা নিজ রাজ্যে অত্যাচারিত হয়ে উত্তরে পালাতে বাধ্য হয়েছে। জরাসন্ধের দুই কন্যা অস্তি ও প্রাপ্তির বিবাহ হয় আমার মামা কংসের সাথে, তাই সম্পর্কে তারা আমার মাতুলী (মামী)। কংসকে হত্যা করায় তারা পিতা মগধরাজকে বাধ্য করে মথুরা আক্রমণের জন্য। জরাসন্ধ এত সৈন্যসামন্ত নিয়ে এলো যে শত বছরেও তাদের ধ্বংস করে শেষ করা যাবে না। বলরাম ও আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের সংহার করতে থাকি। সে কারণে জরাসন্ধ আঠারোবার যুদ্ধ করল। তখন অনেক চিন্তা করে আমরা সবাই বুঝলাম মথুরায় আর থাকা নিরাপদ নয়। দুই মাতুলী সব সময় পিতাকে উস্কাবে আর মগধরাজ জরাসন্ধ বার বার মারতে আসবে। 
অনেক বিচার বিবেচনা করে মথুরা ত্যাগ করে অনেক দূরে দ্বারকায় চলে এলাম। 
আমার সাথে সে যুদ্ধে যারা জরাসন্ধের সাথে যোগ দেয়নি সেই ছিয়াশী রাজাদের সে নিজ ভবনে এখনও বন্দি করে রেখেছে। তাদের সাথে পাশবিক অত্যাচার করা হচ্ছে। এদের সকলকে তার ইষ্ট শিব-রুদ্রের সামনে পূজার পর বলি দেওয়া হবে। এই রাজারা মুক্ত হলে তবেই আপনার এই যজ্ঞ সম্ভব হবে। 
জরাসন্ধকে হত্যা করতে পারলেই আপনি নিষ্কন্ট হয়ে যজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারবেন। জরাসন্ধ বেঁচে থাকলে এ যজ্ঞ অসম্ভব। তার মৃত্যু হলে তার বশ্য রাজারাও আপনার বশ্যতা মানবে। ফলে সংসারে আপনার অনন্ত জয় ঘোষিত হবে। আমার এই মত। 

কমললোচন কৃষ্ণের এত কথা শুনে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলেন –আপনি ঠিকই বলেছেন। আমিও প্রথমে চারদিকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তারপরে না হয় জরাসন্ধের বিষয়টি বিচার করব। 

ভীমসেন তখন বলে ওঠেন –আমি আর ধৈর্য্য ধরতে পারছি না। প্রথমে আমি বৃহদ্রথের এই পুত্রের হত্যা করতে চাই। তাকে হত্যা করলেই বহু রাজা মুক্ত হবে। তাদের সাহায্য পেলে আর কেউ আমাদের যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটাতে পারবে না। রাজা হয়ে ভয়ে শান্তির ভজনা করলে লক্ষ্মী পাবেন না। পূর্বে এমন অনেক রাজা ছিলেন। বাহুবলে ভরতরাজ ভূমণ্ডল শাসন করে গেছে। তারও পূর্বে মান্ধাতার কাছে সকলে বশ্যতা মানে। কৃতবীর্য্যের প্রতাপের কথা এখনও জগতে ঘোষিত হয়। ভগীরথও প্রজা পালনে এভাবে খ্যাতি পান। 

শ্রীকৃষ্ণ বলেন –মহারাজ শুনুন, যখন মগধরাজ জরাসন্ধ হত হবে সকল রাজারা অনায়াসে বশ্যতা মানবে। আপনি আমার সাথে ভীমার্জুনকে দিন। আমরা জরাসন্ধের দুর্দান্ত সৈন্যের সাথে যুদ্ধ করব না। কৌশলে মগধপতিকে হত্যা করতে হবে। 

সব শুনে চিন্তিত যুধিষ্ঠির বলেন –আপনারা যা বলছেন তাতে আমার মন মানছে না। মগধরাজ জরাসন্ধ রাজচক্রবর্তী। তাকে সুরপতি ইন্দ্রও ভয় করেন। 
এখনি শুনলাম তার ভয়ে আপনি স্বয়ং জগন্নাথ মথুরা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে পশ্চিমে সমুদ্রতীরে আশ্রয় নিয়েছেন। 
ভীমার্জুন আমার দুই চক্ষু, আপনি শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং আমার প্রাণ। এই সংকটে আপনাদের পাঠাতে মন চায় না। এমন সাংঘাতিক যজ্ঞের আমার প্রয়োজন নেই। আমি আপনাদের জন্য সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হতেও রাজি আছি। 

এত কথা শুনে ধনঞ্জয় অর্জুন বলেন –মহারাজ, এসব কি বলছেন! সংসারে কেউই চিরজীবী হয় না। যুদ্ধ না করেও কেউ কি এখনও অমর হতে পেরেছে! সঙ্কটকালে দুঃখ পেতেই হয়, তাবলে সুকর্ম বিহীন রাজা হওয়া তো বৃথা জন্মের সমতুল্য। 
আমরা চেষ্টা করে দেখি, যদি সফল না হই তখন আপনি পুনরায় চিন্তা করবেন। এখন শ্রীকৃষ্ণের সাথে আমাদের যেতে দিন। 

ইন্দ্রপুত্র অর্জুনের এই কথা শুনে নারায়ণ কৃষ্ণ “সাধু, সাধু” রবে প্রশংসা করলেন। 

সভাপর্ব সুধারস জরাসন্ধ বধে, কাশীরাম দাস কহেন গোবিন্দের পদে।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers