Blog Archive

Sunday, May 31, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৯০

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হলেন .......রাজা দ্রুপদ পুরোহিত পাঠিয়ে পঞ্চপাণ্ডবদের আমন্ত্রণ জানান....যুধিষ্ঠির বলেন মায়ের বচনানুসারে দ্রৌপদীকে পাঁচভাই বিবাহ করতে চান....যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে...দ্রুপদরাজ যখন তার কন্যার বিবাহ নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত, সে সময় অন্তর্যামী সর্বজ্ঞ মুনিরা পান্ডবদের বিবাহের উদ্দেশ্যে সেখানে উপস্থিত হলেন, তারা দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী হওয়ার কারণ জানালেন........]

কেতকীর প্রতি সুরভীর শাপঃ



সুরভী(স্বর্গের কামধেনু)

কেতকীর অপূর্ব কাহিনী শুনে দ্রুপদ জিজ্ঞেস করেন –হে তপোধন আরো বলুন –কার কন্যা ছিলেন কেতকী, কেনই বা তিনি তাপসী হলেন। কি হেতুই বা তিনি গঙ্গাতীরে বসে কাঁদছিলেন। সে কাহিনী ও আমায় জানান মহাঋষি।

অগস্ত্য বলেন –শুনুন তার কাহিনী-সত্যযুগে সে দক্ষের কন্যা ছিলেন। বিবাহ না করে সন্ন্যাস ধর্ম নিয়ে হিমালয়ের মন্দিরে শিবের পূজায় নিজেকে নিবেদন করল।

হরের কাছে সে প্রার্থনা করল –তোমার বাসস্থানে আমি তপস্যা করতে চাই। তুমি আজ্ঞা দিলে আমি নির্ভয়ে থাকব।


হর(শিব) বললেন -থাক এই গিরিবরে। আমার কাছে থাক, কোন ভয় নেই। কোন পুরুষ যদি তোমায় কামনা করে তবে দ্রুত তাকে আমার কাছে আনবে।

হরের আশ্বাস পেয়ে কেতকী সেখানে একাসনে তপস্যায় নিযুক্ত হলেন।

দৈবক্রমে একদিন সেখানে সুরভী(স্বর্গের কামধেনু) উপস্থিত হলেন। ঋতুমতী গাভী দেখে পাঁচটি ষন্ড তাকে অনুসরণ করল। সুরভীকে পাওয়ার জন্য ষন্ডে ষন্ডে যুদ্ধ শুরু হল।
ষন্ডের গর্জনে কেতকী ধ্যানভঙ্গ হল। পাঁচটি শক্তিশালী ষন্ডের সাথে সুরভীকে দেখে কেতকী ঈষৎ হাসলেন।

কেতকীর হাসি দেখে সুরভী বুঝলেন উপহাস করা হচ্ছে তাকে, মনে মনে তিনি কষ্ট পেলেন এবং বেগে গিয়ে গোমাতা-সুরভী কেতকীকে শাপ দিলেন –আমি গরু জাতির তাই এতে আমার কোন লজ্জা নেই। নরযোনি হয়ে তোরও পঞ্চস্বামী হবে। বারবার তুই মানবী হয়ে জন্মাবি। দুই জন্ম তোর বৃথা যাবে, হে বিরহিনী! তৃতীয় জন্মে তোর পাঁচ স্বামী হবে। সে জন্মে লক্ষ্মীর অঙ্গে জন্মে মুক্তি পাবি। তোর পঞ্চস্বামী একজন অংশে জন্মাবে, তাদের মধ্যে ভেদাভেদ থাকবে না, সবার মনের মিল থাকবে।

কেতকী যোড়হাতে বলেন –অল্প দোষে এত বড় শাপ দিলেন! কতকালে এই শাপ মোচন হবে। এক অংশে কারা পাঁচজন হবেন। আপনি যখন শাপ দিলেন তখন আমিও অবশ্যই তা ভোগ করবো কিন্তু আমার সব প্রশ্নের উত্তরগুলি দিন।

সুরভী বলেন -তবে শোন। একা ইন্দ্র অংশেতে হবেন পাঁচজন।
বৃত্রাসুর নামে ত্বষ্টামুনির পুত্র ত্রিভুবন জয় করলে ইন্দ্র তাকে বজ্র মেরে হত্যা করেন।
শুনে ত্বষ্টামুনি ক্রোধে আগুন হয়ে বলেন –আজ আমি ইন্দ্রকে মারব। আমার তপস্যাব্রত বৃথা হওয়ার নয়। ইন্দ্রের মত ব্রহ্মবধী বিশ্বাসঘাতক দুরাচারের পাপের ভার ধর্মদেব কি ভাবে বহন করছেন! ত্রিশিরস পুত্র আমার তপস্যা করছিল। অনাহারী, মৌনব্রতী সে কাউকে হিংসাও করত না। এমন পুত্রকেও সেই দুষ্টাচার মেরেছিল। আজ আমি দৃষ্টির দ্বারা তাকে ভস্ম করবই।

এই বলে মুনি দাঁত কড়মড় করতে করতে ধেয়ে চললেন। দেখে সুরাসুর সকলে ভয়ে পালাতে থাকে।

বায়ু দ্রুত ইন্দ্রের কাছে গিয়ে বলেন –ইন্দ্র আপনি নিশ্চিন্তে বসে আছেন! ক্রোধান্বিত ত্বষ্টামুনি আপনাকে হত্যা করতে আসছেন। হাতে হাত কচলে, উরুতে চড় মারতে মারতে তিনি এগিয়ে আসছেন। তার চরণভারে পৃথিবীও কাঁপছে। লম্বা ঘন দাড়ি নাড়তে নাড়তে, মেঘের গর্জনের মত নিশ্বাসের ঝড় তুলতে তুলতে, নেত্রানলে বন পুড়িয়ে, পায়ের চাপে বৃক্ষ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে তিনি এগিয়ে আসছেন। আমার মতে আপনি এখন আর বাহনে না চড়ে এগিয়ে তার হাতেপায়ে ধরে পরুন। নয়ত এখনই পালান।

শুনে ইন্দ্র ভয় পেলেন। মুখে কথা ফুটল না, জড়ের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। কোথায় লুকাবেন ভেবে পেলেন না। আদেশ দিলেন যত হাতি ঘোড়া আছে সব নিয়ে আসার জন্য। ঐরাবত প্রমুখ বড় বড় হাতিরা তাকে চতুর্দিকে ঘিরে রাখল।

দূর থেকে ক্রোধে ত্বষ্টামুনিকে দেখে ইন্দ্র প্রচন্ড ভয় পেলেন। কোথায় পালাবেন ভেবে পেলেন না।
কাছেই চারজন দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের নিজের চারঅংশ সমর্পণ করে পঞ্চ আত্মা নিজের মধ্যে ধারণ করে রাখলেন। সেই চারজন হলেন–ধর্ম, বায়ু ও অশ্বিনীকুমার দুই ভাই।
সে সময় সেখানে ত্বষ্টা মহাঋষি এসে দৃষ্টিমাত্রে পুরন্দর-ইন্দ্রকে ভস্ম করলেন।
ইন্দ্রকে ভস্ম করে তিনি ইন্দ্রের আসনে বসে দেবতাদের বললেন –আজ থেকে আমিই ইন্দ্র।

সুরভী কেতকীকে বলেন –এভাবে ইন্দ্র পাঁচভাগে বিভক্ত হলেন। সেই পাঁচ অংশ থেকেই তোমার পাঁচ স্বামীর জন্ম হবে এবং তাদের স্ত্রী তুমি হবে।
কেতকী বলেন –হে গো জননী, কি ভাবে বজ্রপাণি ইন্দ্র পুনরায় প্রাণ পেলেন, সে কথা জানান।



সুরভী বলেন –ত্বষ্টামুনি ইন্দ্রের সিংহাসন জয় করলে দেবতারা ব্রহ্মার কাছে গিয়ে বলেন–ইন্দ্র ছাড়া আমরা স্বর্গপুরে থাকতে পারছি না। ইন্দ্রের সেই সুন্দর সভা ভেঙ্গে গেছে। অপ্সরা অপ্সরীরা আর নৃত্য-গীত করে না। সব সময় অসুরদের উপদ্রপ চলছে। তাই আমরা থাকতে না পেরে আপনার কাছে চলে এলাম।
সব শুনে ব্রহ্মা নারদকে ত্বষ্টামুনির কাছে দূত করে পাঠালেন।

নারদ গিয়ে ত্বষ্টামুনিকে বলেন –ইন্দ্রত্ব নিয়ে তুমি ইন্দ্রের কাজ করতে চাইলে। কিন্তু ইন্দ্র বিনা রাজ্যে উপদ্রপ বেরে চলেছে।

মুনি বলেন –ইন্দ্রত্বে আমার প্রয়োজন নেই। জপ-তপ-ব্রতই আমার প্রকৃত কর্ম। যার ইচ্ছে এই ইন্দ্রত্ব আমার কাছ থেকে এখন নিয়ে যেতে পারে।

ত্বষ্টার কথা শুনে নারদ বলেন –ইন্দ্রকে সৃষ্টির কারণেই বিধাতা তৈরী করেছিলেন। বিনা ইন্দ্রে ইন্দ্রত্ব কে নেবেন। আপনি যদি ইন্দ্রত্ব না নিতে চান তবে ক্রোধ ত্যাগ করে বজ্রপাণি(ইন্দ্র)কে প্রাণ দান করুন। আমার অনুরোধে বিধাতার সৃষ্টিকে রক্ষা করুন।

শুনে ত্বষ্টামুনি সব বুঝতে পারলেন। ইন্দ্রের ভস্ম তার সামনে আনা হল। শান্ত দৃষ্টিতে ভস্মে দৃষ্টিপাত করে ইন্দ্রকে জীবন্ত করলেন। এইভাবে ইন্দ্র পুনরায় প্রাণ পেলেন।

তোমাকে পুরাণের অনেক কথা বললাম। এই বলে সুরভী নিজের স্থানে চলে গেলেন।

অনেক চিন্তা করে কেতকী ধ্যান করতে বসলেন। একদিন গঙ্গাতীরে বসে মনের দুঃখে যখন কাঁদছিলেন তখন তার অশ্রুবিন্দু সোনার পদ্ম হয়ে ভেসে যাচ্ছিল।

অগস্ত্যমুনি এসব গল্প বলতে বলতে স্বর্গের দুন্দুভি বেজে উঠল।
দেবতারা এসে বলেন –পঞ্চপান্ডবের জন্যেই কৃষ্ণার জন্ম। শীঘ্র শুভকর্ম সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করুন। আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি শুরু হল। ইন্দ্র পাঠালেন দিব্য আভরণ(অলঙ্কার)-কেয়ুর(বাহুর), কুন্ডল(কানের), হার, কঙ্কণ, অম্লান অম্বর(বস্ত্র), পারিজাত(সমুদ্রজাত) পুষ্পরাজ(পদ্মরাগমণি)। বিচিত্ররথ সহ সুন্দরী রমণীদল।

সেই সময় বলরাম ও নারায়ণ কৃষ্ণ উপস্থিত হলেন। তাদের সাথে দ্বারকার সকল স্ত্রী ও পুরুষরাও এল।

বিবাহের মঙ্গলদ্রব্য নিয়ে কৃষ্ণের পিতা বসুদেব এলেন। স্ত্রীলোকেরা গরুড়ের পিঠে চড়ে এলেন। কৃষ্ণের মা-দেবকী, বলরামের মা-রোহিনী, বলরামের স্ত্রী রেবতরাজকন্যা রেবতী, কৃষ্ণের স্ত্রীরা-রুক্মিণী, কালিন্দী, সত্যভামা, জাম্বুবতী, লগ্নজিতা, মিত্রবৃন্দা, ভদ্রা, সুলক্ষণা ও আরো সব যদুনারী। তারা সকলে নানা রত্ন-ভূষণ-অলঙ্কার উপহার আনলেন। দশকোটি অশ্ব, দশকোটি রথ, দশকোটি মাতঙ্গ(হাতি), অগণিত বৃষভ(ষাঁড়), উট, খর(গাধা)টানা গাড়ি এলো-যেগুলি ধনে পূর্ণ। এসবই কৃষ্ণ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে উপহার দিলেন। মনে মনে যুধিষ্ঠির অপার আনন্দ লাভ করলেন। পঞ্চপান্ডব মাতুলালয়ের সকল যদুদের প্রণাম জানালেন।
দ্রুপদরাজও সকলকে পূজা করে আদর আপ্যায়ন করলেন।

মহাভারতের কথা অপ্রমিত সুধা, সতত শুনহ নর ভারতের কথা।
...................................

Sunday, May 24, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৮৯

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হলেন .......পঞ্চপান্ডবরা গৃহে উপস্থিত হলে মা কুন্তী ঘরের ভিতর থেকে বললেন –যা এনেছ তা পাঁচভাই ভাগ করে নাও।...পরে ভুল বুঝে বিলাপ করতে থাকেন.....দ্রুপদরাজ যজ্ঞসেন যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীর শোকে অভিভূত...পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন তাকে প্রবোধ দেয়...রাজা দ্রুপদ পুরোহিত পাঠিয়ে পঞ্চপাণ্ডবদের আমন্ত্রণ জানান....যুধিষ্ঠির বলেন মায়ের বচনানুসারে দ্রৌপদীকে পাঁচভাই বিবাহ করতে চান....যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে...দ্রুপদরাজ যখন তার কন্যার বিবাহ নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত, সে সময় অন্তর্যামী সর্বজ্ঞ মুনিরা পান্ডবদের বিবাহের উদ্দেশ্যে সেখানে উপস্থিত হলেন........]

দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী হইবার কারণঃ



ব্যাস বলেন –মুনিগণ শুনুন, হে দ্রুপদ রাজা আপনিও পূর্বের ঘটে যাওয়া সকল কথা জানুন।
ত্রেতাযুগে(সত্য ও দ্বাপর যুগের মধ্যবর্তী যুগ) দ্রৌপদী দ্বিজকন্যা ছিলেন।
মনমত স্বামী লাভের আশায় তিনি শিবের কঠোর তপস্যা ও পূজা করছিলেন। মাটির লিঙ্গ তৈরী করে নানা পুষ্প-ঘৃত-মধু দিয়ে বাজনা বাজিয়ে পূজা করে অবশেষে প্রণাম করে ভূমিতে পরে গেলেন এবং ‘পতিং দেহি’ বলে পাঁচবার প্রার্থনা করলেন।
এভাবে বহুকাল পূজা করলে মহাদেব তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিয়ে বলেন –তোমার পরম সুন্দর পঞ্চস্বামী হবে।

শুনে কন্যা বিস্মিত হয়ে যোড়হাতে বলেন –কেন এমন উপহাস করছেন, শূলপাণি! এমন কথা তো লোকে বা বেদে কখনও শুনিনি।

শঙ্কর বলেন –কন্যা এতে আমার কোন দোষ নেই। তুমিই পাঁচবার সর্বগুণ সম্পন্ন স্বামী প্রার্থনা করে গেছ। এখন অকারণে রোদন করছ। আমার বচন খন্ডন হবার নয়। শোন তোমার পঞ্চ মহারথী স্বামী হবে, তবু তুমি পৃথিবীতে সতী নারী রূপেই সন্মান পাবে। তোমার চরিত্রকথা সকলে শুনবে, তোমার নাম নিলে লোকে পবিত্র হবে।
এই বলে শিব অন্তর্হিত হলেন।
গঙ্গাজলে গিয়ে কন্যা প্রাণত্যাগ করেন।

পুনর্বার তিনি কাশীর রাজার কন্যা হয়ে জন্মান। সে জন্ম তিনি পতিহীন থাকেন। বিবাহ না করে যৌবনকাল কেটে গেল।
তিনি নিজেকে তিরস্কার করে হিমাদ্রি পর্বতে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। তার তপস্যা দেখে দেবতারা বিস্মিত হলেন। সবাই তার কাছে এসে তাকে দেখে যেতে লাগল।

ধর্ম, ইন্দ্র, পবন ও অশ্বিনীভাইরা তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন –কন্যা কি কারণে এই নবযৌবনে এমন কঠোর তপস্যা করছেন। হে সুন্দরী আপনি যদি পতিলাভের ইচ্ছায় তপস্যা করেন তবে আমাদের মধ্যে যাকে খুশি স্বামী হিসাবে নির্বাচন করতে পারেন।

এত শুনে কন্যা চোখ মেলে পাঁচজনকে দেখেন। পাঁচজনেই সমান সুন্দর রূপবান, পাঁচজনকেই ভাল লেগে গেল। কাকে বরণ করবেন ভেবে পেলেন না তাই অধোমুখে নিশব্দে কন্যা রয়ে গেলেন।

কন্যার হৃদয়ের কথা বুঝতে পেরে পাঁচজনেই তাকে বর দিয়ে বলেন –তপস্যা এবার ত্যাগ করুন, কন্যা। পরের জন্মে আমরা আপনার স্বামী হব।
এই বলে দেবতারা অন্তর্হিত হলেন।
কন্যা এরপর তপস্যা করে প্রাণত্যাগ করলেন।

সেই কন্যাই আজ আপনার ঘরে দ্রৌপদী রূপে এসেছেন। ইনি অযোনিসম্ভবা। এঁনার জন্ম হল যজ্ঞভেদ করে।
অন্যদিকে ধর্ম, ইন্দ্র, বায়ু ও অশ্বিনীভাইরাও পঞ্চঅংশে পান্ডব হয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। পঞ্চপান্ডবের জন্যই বিধাতা কৃষ্ণাকে নির্মাণ করেছেন। পূর্বেই তা নির্ধারিত।

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পূণ্যবান।
.....................
দ্রৌপদীর পূর্ব্ববৃত্তান্তঃ

ব্যাসের কথা শুনে অগস্ত্যমুনি বলেন –ঠিক বলেছেন, ব্যাসমুনি। আমিও যা জানি বলছি শুনুন -

পূর্বে একবার শমন/যমরাজ যজ্ঞে ব্যস্ত ছিলেন ফলে প্রাণীর মৃত্যু বন্ধ হল। পৃথিবীতে মানুষ অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে লাগল, দেখে দেবতারা ভয় পেলেন। সকলে ব্রহ্মার কাছে সমাধানের জন্য গেলেন। সব শুনে ব্রহ্মা দেবতাদের নিয়ে নৈমিষ কাননে চললেন যেখানে শমনরাজ যজ্ঞ করছিলেন।
ব্রহ্মাকে দেখে যমরাজ উঠে এসে প্রণাম জানালেন।

ব্রহ্মা যমকে বলেন –এখানে তুমি কি করছ! সৃষ্টির উপর তোমার অধিকার। তাদের পাপ-পূণ্য বুঝে দন্ড দেওয়া তোমার কাজ, সে সব ছেড়ে যজ্ঞ করছ। আমার আজ্ঞা ঠিক মত পালন করছ না!

শুনে যম করযোড়ে বলেন –হে পদ্মযোনি (বিষ্ণুর নাভিপদ্ম যার উৎপত্তিস্থল), আমি আর সে কর্ম করতে পারছি না। এ কঠিন কর্ম আমার পক্ষে আর সম্ভব না। দেব পুরন্দর (ইন্দ্র) ত্রিলোকের রাজা হয়ে যজ্ঞ করে পূর্ণ অর্জনের সময় পান। কুবের, বরুণরাও ইচ্ছে মত যজ্ঞ করার সুযোগ পান। কেবল আমারই কোন অবকাশ নেই। আপনি এ কাজের দায়িত্ব দয়া করে অন্য কাউকে দিন। আমি আর পরের পাপপূণ্য বিচার করতে পারছি না।

যমের কথায় ব্রহ্মা প্রজাপতি চিন্তিত হলেন। তখন তার শরীর থেকে এক কায়স্থের জন্ম হল- ইনিই চিত্রগুপ্ত, যার ডানহাতে লেখনী এবং বামহাতে তালপাতা।

ব্রহ্মা যমকে বলেন –তুমি এই চিত্রগুপ্তকে তোমার সঙ্গে রাখ। এই সব হিসাব রাখবে। এর কাছ থেকেই তুমি সবার কাজের খবর পাবে। ব্যাধিরূপে অন্যায়ের বিনাশ করবে। সংসারে সকল প্রাণী তার কর্ম অনুসারে ফল ভোগ করবে। এসব কাজের দায়িত্ব তোমারই থাকবে। ব্রহ্মার বচনে যম আশ্বস্থ হলেন।

যজ্ঞ শেষ করে সঞ্জীবনী স্থানে যাত্রা করেন। যমকে প্রবোধ দিয়ে অন্য দেবতারাও যাত্রা করেন।
যেতে যেতে তারা গঙ্গার জলে স্বর্ণপদ্ম দেখতে পেলেন। সহস্র সহস্র পুষ্প স্রোতে ভেসে যাচ্ছে দেখে সকলে বিস্মিত হলেন। সেই কমলপুষ্পের গন্ধে সকলের মন মোহিত হল।

দেবরাজ ইন্দ্র ধর্মরাজকে সেই ফুলের সম্বন্ধে তথ্য নিতে পাঠালেন। ইন্দ্রের আজ্ঞায় ধর্মরাজ দ্রুত এগিয়ে গেলেন কিন্তু বহুক্ষণ সময় চলে গেলেও আর ফিরলেন না।
ইন্দ্র চিন্তিত হলেন। ধর্মকে খুঁজতে বায়ু গেলেন। তিনিও ফিরলেন না। তাদের খুঁজতে ইন্দ্র অশ্বিনীভাইদের পাঠালেন। কিন্তু চারজনের কেউই আসছে না দেখে তিনিই এগিয়ে গেলেন।
হিমালয়ের গঙ্গাকূলে দেখলেন এক সুন্দরী যুবতী কাঁদছেন। সেই সুন্দরীর অশ্রুবিন্দু স্বর্ণপদ্ম হয়ে জলে পরে ভেসে যাচ্ছে।

দেবরাজ ইন্দ্র কন্যাকে জিজ্ঞেস করেন –কে আপনি, কেন কাঁদছেন! হে মৃগনয়না, বিম্বাধর(লাল ঠোঁট), ধূমহীন আগুনের মত মনোহর অঙ্গ। চাঁদের মত মুখে মৃগের মত চঞ্চল আখিঁ। সুন্দর আপনার ভুরু, যুগ্ম ঊরু হস্তিহাতকেও নিন্দা করবে। কি কারণে আপনি একাকিনী কাঁদছেন! হে বিরহিনী আমাকে বরণ করতে পারেন।

কন্যা বলেন –আমি দক্ষের কন্যা। সংসারে সুখ ছেড়ে তপস্বিনী হয়েছি। আমাকে এমন বলা আপনার উচিত হয়নি। পাপ চক্ষে আমাকে দেখলে অনেক কষ্ট পেতে হয়। এর আগেও চারজন একই কথা আমায় বলেছেন। তারা যে কষ্ট এখন পাচ্ছেন তা বলে বোঝান সম্ভব নয়।

ইন্দ্র উৎকন্ঠিত হয়ে বলেন –তাঁরা কোথায় আছেন আমায় দ্রুত বলুন।

কন্যা বলেন –তাদের দেখতে ইচ্ছে করে তো আমার সাথে আসুন।

ইন্দ্র কন্যার পিছু পিছু কিছু দুর গিয়ে দেখেন পর্বতের উপর এক সুন্দর পুরুষ।

সেই কন্যা সুন্দর পুরুষকে বলেন –হে মহাদেব, আমি কেতকী। একা তপস্বিনী দেখে ইনি আমাকে কুপ্রস্থাপ দিলেন।

ক্রুদ্ধ হয়ে শিব ইন্দ্রকে বলেন –মূঢ় না দেখে বুঝে যা খুশি বললে এর ফল তুমিও এখনই পাবে। তুমি তো অসীম বলশালী ওই পর্বতটি তুলে দেখ।

শিবের আজ্ঞায় ইন্দ্র পর্বত তুলে দেখেন সেই পর্বতের গহ্বরের শিবের অদ্ভূত কারাগার। সেখানে ধর্ম, বায়ু ও অশ্বিনীভাই-চারজনে বন্ধি আছেন। দেখে সহস্রলোচন ইন্দ্র ভয় পেলেন। হাতযোড় করে শিবের স্তব শুরু করলেন।



বিস্তর স্তব করার পর মহাদেব তুষ্ট হয়ে বলেন –তোমার পূজায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। তোমার কারণে এই চারজনকেও ক্ষমা করলাম। তোমাদের আমি বিষ্ণুর কাছে নিয়ে যাব। তিনি যা আজ্ঞা দেন তাই করবেন বাসব(ইন্দ্র)।

এই বলে ত্রিলোচন শিব তাদের শ্বেতদ্বীপে নিয়ে গেলেন যেখানে নারায়ণ আছেন। মহাদেব বিষ্ণুকে কেতকীর সকল কথা জানালেন।

শুনে শ্রীমধুসূদন ইন্দ্রকে বলেন –ইন্দ্রত্ব পেয়েও আপনার লোভ গেল না। সেই পাপে আপনাকে মর্তে জন্মাতে হবে এবং কর্মফল ভোগ করতে হবে। এই কেতকী সুন্দরী আপনাদের স্ত্রী হবেন। আপনারা পাঁচজনেই মানুষ হয়ে জন্মাবেন। কেতকী আপনাদের পাঁচজনেরই ভামিনী(স্ত্রী) হবেন। আপনাদের ভালর জন্য আমিও জন্মগ্রহণ করব। দ্বাপরে ক্ষত্রিয়দের অহংকার চূর্ণ করব।
এত বলে তিনি মহেশকে দুটি কেশ দিলেন। শুক্ল কেশ বলরাম ও কৃষ্ণ কেশ কৃষ্ণ হলেন।

-এত বলে অগস্ত্যমুনি বলেন –শুনুন দ্রুপদ সেই দেবী কেতকীই হলেন যাজ্ঞসেনী কৃষ্ণা দ্রৌপদী।

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীদাস কহে সদা শুনে পূণ্যবান।

...................................

Sunday, May 17, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৮৮

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হলেন .......পঞ্চপান্ডবরা গৃহে উপস্থিত হলে মা কুন্তী ঘরের ভিতর থেকে বললেন –যা এনেছ তা পাঁচভাই ভাগ করে নাও।...পরে ভুল বুঝে বিলাপ করতে থাকেন.....দ্রুপদরাজ যজ্ঞসেন যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীর শোকে অভিভূত...পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন তাকে প্রবোধ দেয়...রাজা দ্রুপদ পুরোহিত পাঠিয়ে পঞ্চপাণ্ডবদের আমন্ত্রণ জানান....যুধিষ্ঠির বলেন মায়ের বচনানুসারে দ্রৌপদীকে পাঁচভাই বিবাহ করতে চান....যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে দ্রুপদ চিন্তিত হন..] 



দ্রুপদ রাজার নিকট মুনিগণের আগমনঃ 

দ্রুপদরাজ যখন তার কন্যার বিবাহ নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত, সে সময় অন্তর্যামী সর্বজ্ঞ মুনিরা পান্ডবদের বিবাহের উদ্দেশ্যে সেখানে উপস্থিত হলেন। 
শিষ্যসহ মহাতপস্বী পরাশর মুনি [ব্যাসদেবের পিতা ও ধর্মশাস্ত্রের সঙ্কলয়িতা], 
জমদগ্নি [সপ্তর্ষির অন্যতম, পরশুরামের পিতা, রেনুকার স্বামী], 
জৈমিনি [মীমাংসাদর্শনপ্রণেতা মুনি(এঁনার নাম বজ্রপাত নিবারক, এই বিশ্বাসে বজ্রপাতের সময় লোকে এই মুনির নামকীর্তন করেন)], 
শ্রী অসিত দেবল [দক্ষকন্যা বসুর আট পুত্র অষ্টবসুর অন্যতম প্রত্যুষের পুত্র], 
কৌন্ডমুনি মান্ডব্য [যম দ্বারা ভুল বশত শাস্তি পান। এঁনার শাপে যম বিদুর রূপে জন্মান।(কথাচ্ছলে মহাভারত-৪১ Click This Link)], 
ভার্গব [ভৃগুবংশজাত, পরশুরাম], 
গর্গ মুনি [ইনি কৃষ্ণের নামকরণ করেন], 
অগস্ত্য [এঁনার স্ত্রী লোপামুদ্রা, যিনি বিদর্ভরাজকন্যা, তপস্বিনী। এঁদের পুত্র দৃঢ়স্যু। অগস্ত্যমুনি বিন্ধ্যপর্বতের গুরু], 
দুর্বাসা [অত্রি ও অনসূয়ার সন্তান। অল্পে রেগে যান ও অভিশাপ দেন। ঔর্বমুনির কলহপ্রিয় কন্যা কন্দলীকে বিবাহ করেন। একশত দোষ ক্ষমা করে এবং পরে তাকে ভষ্ম করলে ঔর্বমুনি শাপ দেন দর্পচূর্ণের], 
লোমশ [সারা দেহ লোমে ঢাকা। ইনি বিমানে করে ঘুরতেন। ইনি যুধিষ্ঠিরকে অর্জুনের ইন্দ্রলোকের খবর জানাতেন], 
জরদ্গব, আঙ্গিরস, দ্বৈপায়ন প্রমুখ এত মুনি এলেন যে বর্ণনা করা যায় না। 

দ্বারী(দারোয়ান) এসে দ্রুত দ্রুপদকে সে কথা জানালে রাজা উঠে এসে দ্বার থেকে মুনিদের নিয়ে আসেন। ভূমিষ্ট হয়ে সকলকে প্রণাম জানান। 
সকলকে বসার আসন দিয়ে পাদ্য অর্ঘ্য করে দীপ-ধূপ-গন্ধে পূজা করে বলেন –আমি খুবই ভাগ্যবান, আপনারা কন্যার বিবাহের কারণে উপস্থিত হয়েছেন। আমার এই বিবাহ নিয়ে মনে সংশয় দেখা দিয়েছে। আপনারা অবশ্যই এর বিধান ঠিক করে আমাকে চিন্তা মুক্ত করবেন। 

মুনিরা বলেন –আমরা আর কি ঠিক করব। বিধাতা পূর্ব থেকেই সব ঠিক করে রেখেছেন। কৃষ্ণার পঞ্চপতি বিধির লিখন। সুরভির শাপ ও পশুপতি শিবের বরে সতী কৃষ্ণা পঞ্চপতি পাবেন। 
মুনিদের মুখে একথা শুনে দ্রুপদ স্তব্ধ হলেন। 

ধৃষ্টদ্যুম্ন বলে –এমন তো সংসারে দেখা যায় না। লোকে যা করে না, আমরা কি ভাবে তা হতে দিতে পারি! এই বিবাহ দিলে লোকে উপহাস করবে, নিন্দা করবে। 

যুধিষ্ঠির বলেন –এত সব জানি না। মায়ের বচন আমাদের কাছে বেদবাণী। 
মুনিদের কাছে পূর্বে শুনেছি জটিল নামে এক সর্বশাস্ত্র জ্ঞানী ব্রাহ্মণ ছিলেন তিনি দ্বিজদের সর্বশাস্ত্র-বেদ-গ্রন্থ-ব্যাকরণ পড়াতেন। তিনি বলেছিলেন -যত শাস্ত্র পাঠ করলাম সার কথা জেনেছি মার আজ্ঞা যত্নে পালন করতে হবে। মনে দ্বিধা রাখা চলবে না-এ বেদের বচন। লোকের থেকে গুরু শ্রেষ্ঠ আর সর্বগুরুর শ্রেষ্ঠ জননী। জননী আমাদের পাঁচজনকে ভিক্ষা ভাগ করতে বললেন। ধর্মাধর্ম কে বোঝে। অধর্মেও ধর্ম আছে, ধর্মও পাপ করেন। অধর্ম কর্মে আমি মন দিতে পারি না। মায়ের আজ্ঞা পালন করতেই আমার মন সম্মত। তাকে আমরা খন্ডন করতে পারব না। 

বৃকোদর ভীম বলেন –কার শক্তি এই ধর্মের বিরোধ করে! আমাদের সবার কর্তা যুধিষ্ঠির তিনি যা বলবেন আমরা তাই প্রাণপণে পালন করব। হে পাঞ্চালরাজ আপনাকে অনেক সহ্য করেছি। আপনি তখন থেকে কেবল যুধিষ্ঠিরের কথার বিপরীত বলে চলেছেন। অন্য কেউ হলে আজ তার প্রাণ নিতাম। সম্বন্ধে শ্বশুর তাই গুরুজন ভেবে নিজের ক্রোধানল শান্ত করে নিচ্ছি। লোকে কি বলবে তাতে আমরা ভীত নই। আজ থেকে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির যা বলবেন তাই আমাদের কাছে সর্ব শাস্ত্র। দেখি কে তা খন্ডন করতে পারে। 

ভীমের গর্জন শুনে কুন্তী বেরিয়ে এসে মুনিদের প্রণাম করেন। 
ব্যাসের চরণ ধরে কেঁদে বলেন –আমাকে আমার এই আজ্ঞা থেকে মুক্ত করুন। যুধিষ্ঠিরের কথাই সত্য। আমার বাক্য পুত্রেরা কিভাবে 
লঙ্ঘন করবে! সবের মূলে আমিই রয়ে গেলাম। 

মুনি বলেন –ভয় ত্যাগ কর। রোদন করো না। তুমি কোন অন্যায় কর নি এবং মাতৃ আজ্ঞাও পুত্রেরা লঙ্ঘন করবে না। 

মহাভারতের কথা সুধার সাগর, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন সাধু নর।
................................... 

Monday, May 4, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৮৭

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হলেন .....অর্জুনের সঙ্গে দ্রৌপদী কুম্ভকারালয়ে গমন করলেন...পঞ্চপান্ডবরা গৃহে উপস্থিত হলে মা কুন্তী ঘরের ভিতর থেকে বললেন –যা এনেছ তা পাঁচভাই ভাগ করে নাও।...পরে ভুল বুঝে বিলাপ করতে থাকেন...বলরাম ও কৃষ্ণ কুন্তীর সাথে দেখা করতে এলেন...দ্রুপদরাজ যজ্ঞসেন যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীর শোকে অভিভূত...পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন তাকে প্রবোধ দেয়...রাজা দ্রুপদ পুরোহিত পাঠিয়ে পঞ্চপাণ্ডবদের আমন্ত্রণ জানান...

 

যুধিষ্ঠিরকে দ্রুপদের পরিচয় জিজ্ঞাসাঃ 

দ্রুপদরাজ যজ্ঞসেন পুত্রদের সাথে বসেন, পাত্রমিত্র ও দ্বিজ পুরোহিত তাদের বেষ্টিত করে থাকে। সকলে পঞ্চভায়ের মুখচন্দ্র নিরীক্ষণ করে আনন্দিত হয়। 

রাজা সুখি মনে প্রশ্ন করেন –কে তোমরা, কোথায় বসবাস কর-সব সত্য করে বল। কে তোমাদের পিতা-মাতা। তোমাদের আকৃতি প্রকৃতি দেবতুল্য। রূপে পাঁচজনেই সমান শ্রেষ্ঠ। দেখে ইন্দু(চাঁদ), ইন্দ্র, কামদেব ও অশ্বিনীকুমারদের কথা মনে হয়। আমাদের মনে হচ্ছে তারাই উপস্থিত হয়েছেন। 
জেনে রাখ সত্যের সমান ধর্ম নেই ও মিথ্যের সমান পাপ নেই-সর্বশাস্ত্রে তাই বলে। আমার বিশ্বাস এসকল সত্য তোমরা জান ও বিশ্বাস কর। তাই সব কথা খুলে বল, আমার মনের অন্ধকার দুর কর। 

এত শুনে ধার্মিক যুধিষ্ঠির সজল জলদ গম্ভীর বচনে বলেন –আমরা পাঁচভাই পান্ডুর পুত্র। আমি যুধিষ্ঠির, এরা দুজন ভীমার্জুন। এরা নকুল ও সহদেব। অন্তপুরে গেলেন আমাদের মা কুন্তীদেবী। 

এত শুনে রাজা আনন্দিত হলেন। মুখে কথা ফুটে না। কদম্বকুসুমের মত কলেবর আনন্দের ফুলে ওঠে। আনন্দে চক্ষে অশ্রু দেখা দেয়। 
দ্রুত উঠে এসে তিনি যুধিষ্ঠিরকে আলিঙ্গন করেন ও চারভাইকে একে একে সম্ভাষেণ। 

রাজা বলেন –আমার পূর্বের ভাগ্যের ফল পাচ্ছি। মনের কামনা আজ পূর্ণ হতে চলেছে। সকল ঘটনা বল আমরা তো গৃহদাহে তোমাদের মৃত্যুর কথা শুনেছিলাম। 

যুধিষ্ঠির বলেন –সে গৃহ-দাহ নয়, জৌগৃহ করেছিল পুরোচন পাপাশয়। বিদুরের মন্ত্রণায় সে যাত্রায় রক্ষা পাই। 

শুনে দ্রুপদরাজা প্রচন্ড রেগে বলেন –অন্ধ নৃপরাজ ধৃতরাষ্ট্র এত নির্দয় হয়ে উঠেছেন! তার কি ধর্ম ভয়, লোক ভয়–লজ্জা নেই! ধর্মপথে ছিলে বলে তোমরা বেঁচে গেলে। পাপিরা তাদের কপটতার দোষেই মরবে। গৃহদাহে তোমরা মারা গেছ প্রচার করল। এখন জানছি জতুগৃহে তোমাদের পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল। এখন আর সে সব দুঃখের কথা মনে রেখ না। আমার ধন-রাজ্য সব তোমাদেরই। 

এই ভাবে তারা অনেক্ষণ আলাপচারিতা করলেন। 

শেষে রাজা অনুরোধ করেন –এবার শুভক্ষণ দেখে তবে পার্থ কৃষ্ণাকে বিবাহ করুন। 
শুনে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির অসম্মতি দিলে তিনি বলেন –ঠিক আছে তোমার যা বিচার! তুমি অথবা ভীম কিংবা মাদ্রীর দুইপুত্রের একজন কৃষ্ণাকে গ্রহণ কর। 

যুধিষ্ঠির বলেন –মায়ের বচনানুসারে দ্রৌপদীকে আমরা পাঁচভাই বিবাহ করতে চাই। 

যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে দ্রুপদ বিস্মিত হলেন। অধোমুখে ভূমি নিরীক্ষণ করে বলেন –কুন্তীপুত্র শ্রেষ্ঠ তুমি ধর্ম অবতার। তুমি এমন কথা বলছ শুনে বিস্মিত হচ্ছি। পুরুষের বহু স্ত্রী হতে পারে কিন্তু এক স্ত্রীর বহুপতি বেদে বা লোকমাঝে কখনও শুনিনি। পূর্বে সাধুরা যা করেন নি, বর্তমানে ধার্মিকরাও তা করেন না। এমন অদ্ভূত কথা কখনও শুনিনি। ইতরপ্রায় বাক্য তুমি কি ভাবে বললে! 

যুধিষ্ঠির বলেন –রাজন আপনার কথাই সত্য। পূর্বের সাধুদের নির্দেশকে মান্য করতে হয়। লোকে-বেদে সকলেই বলে গুরুবাক্য লঙ্ঘন অনুচিত। লোকমত কর্ম আমরা সব সময় করব। 
লোকমতে গুরু শ্রেষ্ঠ হলেন জননী। সেই মায়ের বাক্য কিভাবে লঙ্ঘন করবো বলুন। মাকেই আমরা গুরু ও ইষ্টদেবতা জানি। মায়ের বচন আমরা দেবতুল্য মানি। মায়ের বচন যে দুরাচার লঙ্ঘে তার সকল সুকৃতি কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। 

যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে দ্রুপদ চিন্তিত হলেন। অধোমুখে বসে বিপদ গণেন। অনেক্ষণ পর তিনি বলেন –এ বিধি মানার শক্তি আমার নেই। আমি ধৃষ্টদ্যুম্ন ও পুরোহিতদের সাথে এখন বিচার বিবেচনা করতে চাই। আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় প্রয়োজন। 

মহাভারতের কথা সুধাসিন্ধুবত। কাশীদাস কহেন সাধু পিয়েন অনুব্রত। 
................................... 

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers