Blog Archive

Thursday, July 29, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৬


উতঙ্কের উপাখ্যানঃ

উতঙ্ক তৃতীয় শিষ্য। ইনিও গুরু গৃহে থেকেই শিক্ষাগ্রহণ করতেন।
একদিন গুরুকে যজ্ঞের কারণে বাইরে যেতে হলে তিনি উতঙ্ককে বললেন –গৃহে থাকবে এবং দেখবে কিছু যেন নষ্ট না হয়।
এই বলে তিনি যজ্ঞ করতে চলে গেলেন।

একদিন গুরু পত্নী উতঙ্ককে ডেকে বললেন –তোমার হাতে স্বামী গৃহের সব অর্পণ করে গেছেন এবং লক্ষ রাখতে বলেছেন যেন কিছু নষ্ট না হয়। আমি ঋতুমতী হয়েছি, তা যেন নষ্ট না হয় তা দেখার দায়িত্বও তোমার। তুমি আমায় গ্রহণ কর।

সব শুনে উতঙ্ক চমকে উঠলেন, বিস্মিতও হলেন। ভেবে ভেবে তিনি আতঙ্কিত হলেন। কারণ গুরু গৃহের কিছু যেন নষ্ট না হয় তা দেখতে বলেছেন। কিন্তু ঋতু রক্ষা তিনি করতে পারেন না। একে পরের স্ত্রী, তার উপর গুরু পত্নী – মহাপাপ।
তিনি গুরু পত্নীকে বুঝালেন –গুরু পিতার সমান এবং তার স্ত্রী মায়ের মত।

এর কিছুদিন পর গুরু গৃহে ফিরলেন। গুরু পত্নীর মনে উতঙ্কের উপর রাগ ছিল। তিনি স্বামীকে বললেন উতঙ্ক যখন গুরুদক্ষিণা দিতে চাইবে তখন যেন তাকেও বলা হয়।

পরে গুরু ধিরে ধিরে সকল ঘটনা জানতে পারলেন এবং উতঙ্কের উপর খুশি হয়ে তাকে আশির্বাদ করে বললেন –তুমি সর্ব শাস্ত্রে পারদর্শি হবে। শুনে শিষ্য যোড়হাতে গুরুকে দক্ষিণা দিতে চাইলেন।

গুরু বললেন –আমি তোমার কাছে কিছু চাই না। তবে গুরুদক্ষিণা দিতেই হলে আমার স্ত্রী যা চান তাই তাকে দিও। শিষ্য গুরুপত্নীর সামনে গিয়ে যোড়হাতে দাড়ালেন।

গুরু পত্নী অনেক ভেবেচিন্তে বললেন তিনি পৌষ্যরাজের মহিষীর শ্রবণ কুন্ডল অর্থাৎ কানের দুল চান। সাতদিনের মধ্যে এনে দিতে না পারলে তিনি উতঙ্ককে শাপ দেবেন।

উতঙ্ক গুরুকে সব বললেন। গুরু তাকে আশির্বাদ দিলেন।

গুরুর আশির্বাদ নিয়ে শিষ্য যাত্রা শুরু করলেন। পথে তার এক বৃষভ অর্থাৎ ষাঁড়ের সাথে দেখা হল। সে পুরীষ বা মল ত্যাগ করে দাড়িয়ে ছিল। সে উতঙ্ককে ডেকে সেই গোবর খেতে বললো, এতে তার ভাল হবে। উতঙ্ক খেতে না চাইলে বৃষ তাকে গুরুর দিব্যি দিল। বাধ্য হয়ে উতঙ্ককে সেই মল খেতে হল।


সেখান থেকে উতঙ্ক পৌষ্যরাজার গৃহের অভিমুখে গমন করলেন। পৌষ্যরাজার কাছে কুন্ডলের আবেদন করলে তিনি উতঙ্ককে রাণির কাছে পাঠালেন। রাণী কান থেকে দুই কুন্ডল উতঙ্কের হাতে দিলেন।

কুন্ডল পেয়ে উতঙ্ক গুরুগৃহে যাত্রা শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তক্ষকও তাকে অনুসরণ করল। ব্রাহ্মণকে ছোঁয়ার শক্তি তার নেই, তাই সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে তার পিছু পিছু চলতে লাগলো।
উতঙ্ক অনেক পথ চলার পর এক সরোবর দেখে সেখানে স্নান করতে নামলেন। ঘাটে রাখা বস্ত্রের মধ্যে থেকে তক্ষক কুন্ডল দুটি চুরি করলো। উতঙ্ক জলের মধ্যে থেকে দেখলেন সন্ন্যাসী কুন্ডল নিয়ে একটি গর্তে প্রবেশ করছেন। উতঙ্ক তাড়াতাড়ি উঠে এসে গর্তে হাত ঢোকাতে যায়, কিন্তু আঙ্গুলও ঢোকে না। বিষণ্ণ মনে তিনি নখ দিয়ে গর্ত খুড়তে শুরু করলেন।

এই ঘটনার কথা ইন্দ্র জানতে পেরে দুঃখিত হলেন এবং তখনই নিজের বজ্রের সাহায্যে ছিদ্র এত বড় করলেন যে সে পথে উতঙ্ক পাতালে চলে গেলেন। সেখান থেকে তিনি অনেক কিছু দেখলেন-চন্দ্র, সূর্য, তারাদের যাতায়াতের পথ, মাস, বছর এবং ছয় ঋতুর সদন।

কিন্তু অনেক খুঁজেও সেই সন্ন্যাসীর দেখা পেলেন না। উতঙ্ক চিন্তিত হলেন।
তখন অশ্বরূপী অগ্নি তাকে বললেন -আমায় গুরুজ্ঞানে বিশ্বাস কর। আমি তোমায় আজ্ঞা করছি আমার গুহ্যে অর্থাৎ মলদ্বারে বাতাস কর।
গুরুর নাম শুনে উতঙ্ক দেরি না করে কিছু না পেয়ে মুখ দিয়েই মলদ্বারে বাতাস করলেন।


গুহ্যে ফুঁক দিতেই মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হল যা নাগলোকে অন্ধকার ডেকে আনল। সকল নাগ এত ধোঁয়ায় অবাক হল।

বাসুকি চরের মাধ্যমে তক্ষকের সব বৃত্তান্ত শুনে রেগে গেলেন। তাকে ডেকে পাঠান হল। তক্ষক এলে তাকে সকলে মিলে শাসন করল এবং ব্রাহ্মণকে কুন্ডল ফিরিয়ে দিতে বললো।

কুন্ডল ফিরে পেয়ে উতঙ্ক খুশি মনে অশ্বের কাছে ফিরে গেলেন। অশ্ব পিঠে করে তাকে সপ্তমদিন গুরুগৃহে নিয়ে এলো।

গুরুগৃহে ফিরে উতঙ্ক দেখলেন গুরুপত্নী জল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন শাপ দেওয়ার জন্য। তিনি মুখ দিয়ে যে মুহূর্তে শাপ নির্গত করছিলেন সেই মুহূর্তে উতঙ্ক কুন্ডল দুটি তার হাতে দিলেন। কুন্ডল পেয়ে গুরুপত্নী সন্তুষ্ট হলেন।

গুরুকে উতঙ্ক পথের সকল ঘটনা জানালেন। গুরু বললেন গোবর যে বৃষ খাওয়ালেন, তিনি আসলে ইন্দ্র-তিনি তোমায় অমৃত খাওয়ালেন। সন্ন্যাসীর বেশে যেই তক্ষক কুন্ডল চুরি করে গর্তে ঢুকলো, তখনই তার ভাগ্য রসাতলে গেল। অশ্বরূপে যিনি তোমায় সাহায্য করলেন তিনি আমার পরম প্রিয় অগ্নি।


এতশুনে উতঙ্কের মনে সাপেদের উপর রাগ হল। কারণ তারা বিনা দোষে তাকে এত কষ্ট দিল। তিনি ঠিক করলেন সাপদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে। এরপর তিনি গুরুকে প্রণাম করে রাজা জন্মেজয়ের কাছে গেলেন।

উতঙ্ক রাজাকে বললেন –রাজা, তুমি পিতার শত্রুদের যতক্ষণ না শাসন করবে ততক্ষণ তোমার পুত্র ঋণ শোধ হবে না। চন্ডাল তক্ষক তোমার পিতাকে দংশন করে, একথা সংসারে সবাই জানে। তোমার উচিত প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নাগকুলের বিনাশ ঘটান।

উতঙ্কের কথায় রাজা জন্মেজয় বিস্মিত হয়ে মন্ত্রীদের কাছে সত্য ঘটনা জানতে চাইলেন। জন্মেজয় জানতেন ব্রহ্মশাপে পিতার মৃত্যু হয়। তক্ষকের দংশনের কারণ তিনি মন্ত্রীদের কাছ থেকে জানলেন।
..........................................

Tuesday, July 27, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত – ১৫

উপমন্যু ও আরুণির উপাখ্যানঃ



সৌতি বলেন –মুনিগণ এবার পুরাণের কাহিনী শ্রবণ করুন।

অবন্তীনগরে ধৌম নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার গুরুকুলে শিষ্যরা শিক্ষাগ্রহণ করতে আসত।

এক শিষ্যকে গুরু তার গরুগুলিকে দেখভালের দায়িত্ব দিলেন। গুরুর আজ্ঞায় শিষ্য গরুগুলির সেবা করে।

একদিন গুরু বললেন –তোমায় বেশ পুষ্ট দেখছি! তুমি কি খাও, কোথায়ই বা এত খাবার পাও!

শুনে শিষ্য জোর হাতে বলে –বাছুরদের দুধ পানের পর আমি দুধ পান করি।

গুরু বললেন –এবার বুঝেছি বাছুরগুলি এত দূর্বল কেন। আর কখনও এমন কাজ করো না।

কিছুদিন পর আবার গুরু শিষ্যকে ডেকে বললেন –আবারও তোমায় বেশ পুষ্ট লাগছে, এর কারণ কি! তুমি কি আবার বাছুরদের বরাদ্দ দুধ পান করছ!

শিষ্য বলে –না প্রভু! তুমি বারণ করার পর থেকে আমি আর দুধ খাই না। ভিক্ষা করে পেট ভরাই।

গুরু বলেন –এবার থেকে ভিক্ষা করে সব আমার কাছেই এনে দিও।

এর কিছুদিন পর আবার গুরু শিষ্যকে বললেন –এখনও তোমায় বেশ পুষ্ট লাগছে!

শিষ্য বলে -গাভীদের চরতে দিয়ে আমি সকালে ও সন্ধ্যায় ভিক্ষা করি। সকালেরটা তোমায় দিই। সন্ধ্যার ভিক্ষায় নিজের চলে যায়।

শুনে গুরু হেসে বলেন –সন্ধ্যার ভিক্ষা বেশি হয়। সেটি তুমি নিজে নিচ্ছ! এবার থেকে সকাল ও সন্ধ্যার ভিক্ষাও আমায় দেবে।

এরপর শিষ্য গাভী নিয়ে বনে গেল। খিদেতে তার পাগলের মত অবস্থা। সারা বনে খাদ্যের সন্ধানে ঘুরে ফেরে। শেষে অর্ক বা আকন্দের কোমল পাতা খেয়ে পেট ভরায়। কিন্তু ধিরে ধিরে সে দূর্বল হয়ে পড়ল। এমনকি চোখেও কিছু দেখতে পাচ্ছে না! তবু গরু চরান বন্ধ করল না।

ঘুরতে ঘুরতে শেষে সে এক কূপে গিয়ে পড়ল। সমস্ত দিন গেল সন্ধ্যা উপস্থিত হল। সব গরুরপাল গৃহে ফিরে এল।

কিন্তু শিষ্যের দেখা নেই। গুরু চিন্তিত হলেন। নিজেই বনে শিষ্যকে খুঁজতে বেরলেন।
বনে গিয়ে গুরু ‘উপমন্যু, উপমন্যু’ নাম ধরে ডাকতে লাগলেন।
উপমন্যু কূপের ভিতর থেকে বললো –আমি এখানে আছি।
গুরু এগিয়ে এসে বললেন -তুমি কূপের মধ্যে পড়লে কি করে!
উপমন্যু বলে –আমি চোখে দেখতে পাচ্ছি না, প্রভু! অর্কের পাতা খেয়ে অন্ধ হয়ে গেছি।
গুরুর অনুশোচনা হল। তিনি উপমন্যুকে সঙ্গে সঙ্গে দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারদের স্মরণ করতে বললেন।
শিষ্য জোড়হাতে বহু স্তব করলে আবার চোখে দেখতে পেল। গুরুর হাত ধরে সে কূপ থেকে উঠে এলো।
গুরু সন্তুষ্ট হয়ে তাকে আশির্বাদ করলেন। সেই আশির্বাদে চারবেদে উপমন্যু পন্ডিত হলেন। গুরু আজ্ঞায় তিনি গৃহে ফিরে গেলেন।


আরুণি নামে গুরুর আরেক শিষ্য ছিল। গুরু তাকে ডেকে একদিন বললেন –ধানের ক্ষেতে আল ভেঙেছে। সব জল বেরিয়ে যাচ্ছে। যাও আল ভাল করে বাঁধ দাও।

আরুণি ক্ষেতে গিয়ে আল বাঁধার অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু জলের বেগে বারবার আল ভাঙতে লাগলো। জল বেরিয়ে যাচ্ছে! যদি গুরু রাগ করেন! এই ভেবে সে নিজেই শুয়ে পড়ে আলে বাঁধ দিল।

সমস্ত দিন গেল, সন্ধ্যা নেমে এলো। তবু শিষ্যকে ফিরতে না দেখে গুরু চিন্তিত হলেন। শেষে শিষ্যের খোঁজে বের হলেন।

ক্ষেতের মাঝে গিয়ে তিনি শিষ্যকে ডাক দিতে লাগলেন।
শিষ্য বলে –আমি আলে শুয়ে আছি। অনেক চেষ্টা করলাম তবু বাঁধ দিতে পারলাম না। তাই নিজেই শুয়ে বাঁধ দিচ্ছি।

গুরু তাকে উঠে আসতে বললেন। শিষ্য উঠে এসে গুরুকে প্রণাম করলেন।

গুরু আরুণিকে আশির্বাদ করে বললেন –তুমি চারবেদ ও ছয় শাস্ত্রে পন্ডিত হও।

আরুণি গুরুকে প্রণাম করে গৃহে ফিরে গেলেন। তাকে গুরু উদ্দালক উপাধি দিলেন।

গুরুকুল
..............................

Sunday, July 25, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪

আস্তীকের জন্মঃ

জরৎকারু পত্নীকে রেখে চলে গেলেন। জরৎকারী অশ্রুজলপূর্ণ চক্ষে, বুকে করাঘাত করতে করতে ভ্রাতৃগৃহে আশ্রয় নিলেন।

বোনকে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসতে দেখে বাসুকি চমকে উঠলেন। মুখে কথা খুঁজে পেলেন না।

বাসুকি কান্নার কারণ জানতে চাইলে জরৎকারী বললেন –মুনি আমায় ছেড়ে বনে চলে গেছেন।


শুনে বাসুকি বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। একে মায়ের শাপে সব সময় ভীত, তার উপর এই দূর্ঘটনা!
বোনকে বললেন –তোমায় জিজ্ঞাসা করতে লজ্জা করছে। তবু তুমি দয়া করে বল, তোমার গর্ভে জরৎকারুর পুত্র এসেছে কিনা। তার কারণেই তোমায় চিরদিনের জন্য জরৎকারুকে দিলাম। এদিকে সন্তান এখনও হয়নি, অথচ মুনি চলে গেলেন। মাতৃশাপের কি হবে! লজ্জা করলেও আমরা সব ভাইরা চিন্তিত, সত্য কথা বল, বোন!

সলজ্জ ভাবে জরৎকারী জানালেন –তোমাদের দুঃখের সব কথাই জানি। মুনি চলে যাচ্ছেন দেখে আমি তার পায়ে পড়ি। তিনি ‘অস্তি, অস্তি’ বলে আমার গর্ভে আশির্বাদ করেন। এবং বলেন দুই কুলেরই সে রক্ষা করবে। এই বলে তিনি বনে যান। তোমরা চিন্তা ত্যাগ কর, মুনির বাক্য মিথ্যা হবে না।


জরৎকারীর কথা শুনে খুশিতে সব নাগ ভাইরা উৎসবে মেতে উঠল। আনন্দিত বাসুকি রাজা বোনকে পূজা করে, নানা অলঙ্কারে সাজালেন।

শেষে সব উৎসবের পর একান্তে বোনকে ডেকে কি কারণে মুনি ছেড়ে গেলেন জানতে চাইলেন। জরৎকারী সমস্ত ঘটনা দাদাকে বললেন। সব শুনে বাসুকি অবাক হলেন।
শেষে বললেন –ভালই হয়েছে ব্রাহ্মণ বনে গেছে। বোন তুমি দুঃখ করো না। এই গৃহ নিজের ভেবে সুখে থাক। তুমি আমার গৃহে দেবীর মত থাকবে। সহস্র ভ্রাতা এবং তাদের স্ত্রীরা তোমার সেবা করবে।

এই বলে বাসুকি সবাইকে ডেকে সে আদেশ দিয়ে সবাইকে তার সেবায় নিযুক্ত করলেন।
এভাবে জরৎকারী সব দুঃখ ভুলে ভাইদের সাথে থাকতে লাগলেন।


নির্দিষ্ট সময়ে কোল আলো করে তিনি একটি শিশুপুত্র জন্ম দিলেন। শিশুটি খুবই সুন্দর, পূর্ণ শশীর মত তার রূপ। সব নাগরা তাকে দেখে আনন্দিত হল। রূপে গুণে অনুপম শিশুটির নাম রাখা হল –আস্তীক। যেহেতু গৃহ ত্যাগের সময় পিতা এ কথাই উচ্চারণ করেন, তাই এই নামকরণ।

শৈশব থেকেই পুত্র সর্ব গুণে গুণান্বিত। বেদ, বিদ্যা, ব্রতে পারঙ্গম।


আস্তীকের জন্মকথা অপূর্ব ভারত গাঁথা। তা শুনলে সব অধর্ম নাশ হয়। কমলাকান্তের পুত্র কাশীদাস এই গাঁথা রচনা করেন।

মনসা/জরৎকারী
..........................................

Wednesday, July 21, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৩

জরৎকারুর পত্নীত্যাগঃ

শৌনকাদি মুনিরা বললেন -সুত্রধরের পুত্র সৌতি অনেক অদ্ভূত কথা শোনালেন, এবার জরৎকারু মুনিকে বাসুকি ভগ্নী দিলে কি ভাবে আস্তিকের জন্ম হল তা বলুন।

সৌতি বললেন -জরৎকারু বিবাহ করে বনে বনে আবার ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। একদিন বাসুকি বোনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন জরৎকারুর সাথে তার কি কথা হল। মুনি ঠিকভাবে বোনের দেখাশোনা করেন কিনা তাও জানতে চাইলেন।

বোন জরৎকারী বললেন –মুনিকে প্রায় আমি দেখতেই পাই না। তিনি কোথায় থাকেন, কোথায় যান-আমি কিছুই জানি না।

এসব শুনে বাসুকি দুঃখিত হলেন।

একদিন তিনি জরৎকারুর দেখা পেলেন।
বাসুকি বললেন –মুনি তোমাকে আমার বোন দান করেছি। তাকে যত্ন করে রেখেছিলাম তোমার জন্য, তুমি তাকে ভাল ভাবে পালন করবে ভেবে।


জরৎকারু বললেন –আমার বিয়ের ইচ্ছে ছিল না। পিতৃপিতামহদের জন্য বিবাহ করতে হল। ঘরে আমার মন লাগে না। বাড়িতে কারো কথা আমি সহ্য করতে পারি না। তোমার বোন সত্যবচন করুক যে, সে কখনও আমায় কোন কথা শোনাবে না, তাহলে ঘর করবো। যদি সত্যবচন ভাঙ্গে তা হলে তাকে আমি ত্যাগ করবো।

বাসুকি বললেন –আমার বোন সত্যবচন করবে। যেদিন সে তোমায় অপ্রিয় কথা শুনাবে সেদিন তুমি তাকে ত্যাগ করো।

তারপর বাসুকি বোনের জন্য অনেক মনিরত্ন দিয়ে প্রাসাদ বানিয়ে দিলেন। জরৎকারু পত্নীকে নিয়ে সেখানে সুখে বাস করতে লাগলেন। এভাবে জরৎকারী গর্ভবতী হলেন। এভাবে নাগিনীর গর্ভে মুনির সন্তান ধিরে ধিরে শশিকলার মত বাড়তে লাগলো। জরৎকারী সব সময় স্বামীর সেবা করেন, তার সামনে করযোড়ে থাকেন। যখন যা আজ্ঞা করেন জরৎকারু তখনই তা পালন করেন। এভাবে নাগিনী মুনির অনেক সেবা করতে লাগলেন।

একদিন দেখলেন দিন শেষ হচ্ছে, সূর্য ডুবছে, এদিকে মুনি তার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। সন্ধ্যা উপস্থিত দেখে জরৎকারী ভয় পেলেন। সন্ধ্যাও যায়, এদিকে ডাকলে স্বামী যদি রাগ করেন! ভেবে ভেবে নাগিনী চিন্তিত হলেন। শেষে ঠিক করলেন মুনি যা করে করবেন কিন্তু সন্ধ্যা কর্ম না করলে পঞ্চপাপ হবে স্বামীর। এই ভেবে জরৎকারী মুনিকে ডেকে বললেন –প্রভু, সন্ধ্যা শেষ হতে চলেছে, উঠুন!

নিদ্রা ভঙ্গ হতে মুনি রাগে কাঁপতে লাগলেন। রাগে মুখ লাল হল, ঠোঁট কাঁপতে লাগলো।
তিনি বললেন –অহঙ্কার করে আমায় অমান্য করলি! আমি আর তোর মুখ দেখবো না।

জরৎকারী বললেন –প্রভু, আমার উপর অকারণে রাগ কর! আমার কোন দোষ নেই। সূর্য কখন ডুবে গেল, সন্ধ্যাও পিছে যায়। সন্ধ্যা না দিলে কত পাপ হয় তুমিতো তা জান! সে জন্যই ঘুম ভাঙালাম। এটাকে যদি দোষ ভাব তা হলে অবশ্যই ত্যাগ কর।

মুনি বললেন –নাগিনী না বুঝে কথা বলিস না। আমি সন্ধ্যা না করলে সন্ধ্যাকাল শেষ হতে পারবে না। সন্ধ্যার এত সাহস আমায় না বলে চলে যাবে!

সন্ধ্যাও করযোড়ে বলে –মুনি রাগ করো না, আমি এখনো তোমার জন্য আছি।

মুনি বলেন –শুনলি নাগিনী নিজের কানে! আমার কথা তুই অমান্য করেছিস, আমি অবশ্যই তোকে ত্যাগ করে বনে যাব। আর কখনও তোর মুখ দেখব না।


মুনির কথা শুনে জরৎকারী কাঁদতে কাঁদতে তার পায়ের উপর পড়লেন। বলেন –না জেনে প্রভু দোষ করেছি, এবারের মত ক্ষমা কর। ভাইরা আমার দুঃখ পাবে। ভাইরা তোমার হাতে আমায় অনেক আশা নিয়ে দিয়েছিলেন। মায়ের শাপে ভাইদের মনে ভয় হয়, তোমার হাতে আমায় দিয়ে সে ভয় দুর হয়। তোমার ঔরসে, আমার গর্ভে যে সন্তান হবে তারই আমার ভাইদের রক্ষা করার কথা। সন্তান না হতেই তুমি চলে যাচ্ছ! ভাইদের আমি কি বলবো। তুমি যদি আমায় ছেড়ে যাও তা হলে আমি তোমার সামনেই প্রাণ ত্যাগ করবো।

এত শুনে মুনি সদয় হলেন। তিনি নাগিনীর উদরে হাত দিয়ে ‘অস্তি, অস্তি’ বলে হাত বোলালেন।
বললেন –এই গর্ভে আছে নাগকুলের রক্ষাকর্তা এবং আমার ও তোমার কুল রক্ষক। চিন্তা ছেড়ে তুমি ভাইদের গৃহে যাও। ভাইদের বুঝিও তারা যেন দুঃখ না করেন। আমার কথা কখনও মিথ্যা হবে না, তোমাকে আমি অবশ্যই ত্যাগ করেছি। এতকিছু বলে পত্নীকে সান্ত্বনা দিয়ে মুনি গৃহ ত্যাগ করে বনে তপস্যা করতে যান।

ব্রাহ্মণের বাক্য অব্যর্থ বুঝে নাগিনী মুনিকে আর কিছু বললেন না। মাথায় ব্রাহ্মণের পদধুলি নিয়ে ভ্রাতৃগৃহে গমন করলেন।
..........................................

Thursday, July 15, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২

পরীক্ষিতের নিকট তক্ষকের আগমনঃ


সৌতি বললেন ভাল ভাবে শুনুন মুনিগণ –মন্ত্রীরা অনেক উপায় করলেন রাজাকে রক্ষা করার জন্য। কাশ্যপ নামে এক মুনি রাজাকে সাপে কামড়াবে শুনে রাজ দরবারের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন-ধন, ধর্ম, যশ পাওয়ার আশায়।

তিনি তাড়াতাড়ি হস্তিনাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। অন্যদিকে তক্ষক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে আসছিলেন। পথে দু’জনের দেখা হল বটগাছের তলায়।
তক্ষক বললো –ব্রাহ্মণ, তুমি কোথা থেকে আসছ, কোথায় বা এত দ্রুত চলেছ!
ব্রাহ্মণ তাকে তার মনের আকাঙ্খার কথা জানালেন। এবং আশা প্রকাশ করলেন তিনি রাজাকে মন্ত্রবলে রক্ষা করতে পারবেন।

তক্ষক তাকে বললো –তুমি অবোধ! কারো শক্তি নেই রাজাকে তক্ষকের হাত থেকে রক্ষা করে। শুধু শুধু লজ্জা পাবে। তার আগেই বাড়ি ফিরে যাও।

তখন ব্রাহ্মণ তাকে বললেন –গুরুমন্ত্রবলে তক্ষকের বিষও আমি তুলতে পারি।

সব শুনে তক্ষক রেগে গিয়ে নিজের পরিচয় দিল এবং বললো -তুমি কেমন বিষ হরণ করতে পার দেখি! আমি এই গাছটিকে দংশন করবো। দেখি কেমন এটিকে রক্ষা করতে পার।

এই বলে তক্ষক দংশনের মাধ্যমে গাছটিকে ছাই-এ পরিণত করল।

লাফ দিয়ে কাশ্যপ ছাই মুঠিতে ধরে নিলেন এবং মন্ত্রবলে ভষ্ম গর্তে ফেললেন। দেখতে দেখতে সেখানে অঙ্কুর হল, তার দু’টি পাতা থেকে ধিরে ধিরে সেটি বৃক্ষে পরিণত হল। শেষে পূর্বের রূপে ফিরে এলো।

দেখে তক্ষল বিষণ্ণ হল! কাশ্যপকে বিনয়ের সঙ্গে বুঝাতে শুরু করল দৈববাক্য খন্ডান উচিত নয়। ব্রাহ্মণ যে শাপ দেয়, তাকে ভগবানও ভয় পান। তাদের জোর হাতে ভয়ে স্তব করেন। তাদের গালি দিয়েই চাঁদের কলঙ্ক হল, ইন্দ্রের ভগাঙ্গ হল। পৃথিবীতে সবাই সে কারণে তাদের ভয় পায়। তা ব্রহ্মার শাপের বিরোধ করারই সমকক্ষ!

শেষে বললো –তুমি যদি ব্রহ্মার শাপের বিরোধ করতে চাও তবে অবশ্যই সভায় যাও। যশ অর্থাৎ খ্যাতির আশায় গেলে সভায় লজ্জা পাবে। ধনের আশায় গেলে, আমি দেব রাজার রাজ ভান্ডারের থেকেও বেশি।

এতশুনে কাশ্যপ ভাবনায় পরলেন। ভাবলেন তক্ষক ঠিকই বলছে। ব্রহ্মার শাপের বিরোধি হওয়া উচিত নয়। তিনি বুঝলেন রাজার আর আয়ু নেই।
তাই তক্ষকের কথাই মেনে নিয়ে বললেন –আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ! ধন, যশ, ধর্মের আশায় রাজসভায় যাচ্ছিলাম। তুমি যদি তা দাও আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ব্রহ্মার বিরোধ করাও ভয়ের! তুমি যদি ধন দাও তো ফিরে যাই।

এত শুনে তক্ষক কাশ্যপকে এক মণি দিলেন, যার পরশে লোহা সোনা হয়। হৃষ্ট চিত্তে ব্রাহ্মণ বাড়ি ফিরে গেলেন। তক্ষকের চিন্তাও দুর হল।

এদিকে রাজ্যে বিভিন্ন কথা শোনা গেল। রাজা উচ্চস্থানে অবস্থান করছেন। তাকে তক্ষক কখনও কামড়াতে পারবে না, সবাই ধরে নিল। এছাড়া তক্ষক বিষ ঢাললেই গুণিরা নানান মহৌষধি দেবেন। তারা মন্ত্রবলে মৃত্যুর পথ রোধ করবেন।

সব শুনে কদ্রুপুত্র তক্ষক চিন্তিত হলেন। রাজার সাথে ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারো সাক্ষাৎ করান হচ্ছে না শুনে, তক্ষক অনুচর সাপদেরও ব্রাহ্মণের বেশ ধরতে বললো।
আরো বললো -ব্রাহ্মণের বেশে রাজাকে আশির্বাদ করে এই ফলমূলগুলি তার হাতে দেবে। তাড়াতাড়ি ফিরবে না, ধিরে ধিরে ফিরবে। কেউ যেন চিনতে না পারে। এই বলে সেই ফলের মধ্যে তক্ষক প্রবেশ করল।

সকল অনুচর নাগ ব্রাহ্মণের মূর্তি ধরে সেই ফল ও নানা ফুল হাতে নিয়ে যে মঞ্চে রাজা বসে আছেন সেখানে গেল। আনন্দের সাথে রাজা ফলমূল নিলেন। ব্রাহ্মণবেশী সাপেরা তাকে আশির্বাদ করল।

খুঁত ফল দেখে রাজা নখ দিয়ে তা খুঁটলেন। দেখলেন ছোট্ট একটি কীট। তার বর্ণ লাল এবং মুখ তার কৃষ্ণবর্ণ।



এই সময় রাজা মন্ত্রিদের বললেন –আজ ব্রহ্মশাপের সাতদিন শেষ হতে চললো, অথচ ব্রহ্মশাপ ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে এ জন্য আমার মন আশঙ্কিত।
ব্রাহ্মণের শাপ সফল হোক। এই মুহূর্তে এই কীট তক্ষকের রূপ ধারণ করুক, এবং আমায় দংশন করুক। এই বলে রাজা কীটটিকে মস্তকে ধারণ করলেন।

সব দেখে মন্ত্রীরা ‘নাঃ, নাঃ!’ করে উঠলেন।

এভাবে যখন বাকবিতন্ডা চলছে তখন তক্ষক নিজ মূর্তি ধরল। প্রলয়ের মেঘ যেন গর্জন শুরু করল। তা শুনে সব মন্তীরা পালাল। ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে সবাই ভয়ে কেঁপে উঠল। তক্ষক তখন তার ল্যাজ দিয়ে রাজাকে জড়াতে শুরু করেছে। সহস্র ফণা ছাতার মত তুলে রাজার ব্রহ্মতালু শব্দ করে দংশন করল। রাজাকে দংশন করেই সে আকাশে উড়ে গেল। সবাই আকাশে রক্তপদ্মের আভা তনু দেখল।

এদিকে বিষের আগুনে রাজাসহ মঞ্চ জ্বলছে! মন্ত্রীরা হাহাকার করছে! অন্তপুরেও কান্নাকাটি শুরু হল। তারপর বিধিমত রাজার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করা হল। প্রজাবৎসল রাজা স্বর্গে গেলেন।

মন্ত্রী এবং প্রজারা পরামর্শ করে তার পুত্র জন্মেজয়কে রাজা করলেন। বালক হলেও জন্মেজয় বুদ্ধিমান। তার বিক্রমে দুষ্টেরা শান্ত। মন্ত্রীরা তার প্রশংসা করতে লাগল।

কাশী রাজকন্যা বপুষ্টমার সঙ্গে তার বিবাহ হল। রাজকন্যা অনেক রত্ন সঙ্গে আনলেন।

জন্মেজয় তার স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন। এক পত্নী ছাড়া তার এখন আর অন্য কিছুতে মন নেই-উর্বশীর সঙ্গে যেন বুধের নন্দন!

নাগেদের চরিত্র এবং কাশ্যপের কর্ম। পরীক্ষিতের স্বর্গবাস এবং জন্মেজয়ের জন্ম-এসব রহস্যকথা শুনে যারা। তাদের বংশবৃদ্ধি, ধনবৃদ্ধি এবং হরিপদে চিরদিন মন থাকে। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস বলেন –এ অংশ শুনলে স্ববাঞ্ছিত ফল পাওয়া যায়, সর্ব পাপ মুক্ত হয়ে পুণ্যের প্রকাশ ঘটে।
..........................................

Wednesday, July 14, 2010

শুভ রথযাত্রা


রথযাত্রার ইতিহাসঃ
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর অনেকদিন কেটে গেছে। শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকায়। একদিন তিনি গাছের উপর পা ঝুলিয়ে বসে ছিলেন। তাঁর রাঙা চরণকে টিয়া পাখি ভেবে ভুল করে বাণ মেরে বসল এক শবর। নাম তার জরা। বাণের আঘাতেই অবশেষে প্রাণ হারালেন কৃষ্ণ।

অপঘাতে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর খবর পেয়ে অর্জুন ছুটে এলেন দ্বারকায়। দেহ সৎকারের সময় অর্জুন দেখলেন, গোটা দেহটা পুড়লেও সখার নাভিদেশ তো পুড়ছে না! তখনই হল দৈববাণী, ‘ইনিই সেই পরমব্রহ্ম। অর্জুন, এঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করো। সমুদ্রেই ওঁর অনন্তশয়ন।’

অর্জুন তাই করলেন। ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল পরমব্রহ্ম সেই নাভি। আর তাকে লক্ষ করে সমুদ্রের তীর ধরে ছুটে চলল অনার্য সেই শবর - জরা। শেষ অবধি তার বাণেই মৃত্যু হল ভগবানের!

দ্বারকা থেকে পুরি পর্যন্ত ছুটে চলা। অবশেষে এখানেই ঠাকুরকে স্বপ্ন দেখল সে, ‘কাল ভোরে আমাকে তুলে নে। এখন থেকে তোর বংশধর, শবরদের হাতেই পুজো নেব আমি’। তখন থেকে নীলমাধবরূপে তিনি পূজিত হতে থাকলেন শবরদের কাছে। সময়টা দ্বাপর যুগ।

এরপর এলো কলি যুগ। কলিঙ্গের রাজা তখন ইন্দ্রদ্যুম্ন দেব। তিনি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। সেই উদ্দেশ্যে তিনি গড়ে তুললেন একটি মন্দির, শ্রীক্ষেত্রে। এখন আমরা তাকে চিনি জগন্নাথধাম রূপে। কিন্তু মন্দিরে বিগ্রহ নেই! রাজসভায় একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি জানতে পারলেন নীলমাধবের কথা। ইনি নাকি বিষ্ণুরই এক রূপ। অমনি চারদিকে লোক পাঠালেন রাজা। এঁদের প্রত্যেকেই ধার্মিক ব্রাহ্মণতনয়। বাকিরা খালি হাতে ফিরে এলেও, ফিরলেন না একজন – বিদ্যাপতি। তিনি জঙ্গলের মধ্যে পথ হারালে তাঁকে উদ্ধার করলেন সুন্দরী শবর কন্যা ললিতা। নিয়ে এলেন তাদের বাড়ি। ললিতা শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা। ললিতার প্রেমে পড়লেন বিদ্যাপতি। বিয়ে হল দুজনের।

বিয়ের পর বিদ্যাপতি আবিষ্কার করলেন রোজ সকালেই শবররাজ কয়েক ঘণ্টার জন্য কোথাও উধাও হয়ে যান, আবার ফিরে আসেন। কোথায় যান বিশ্ববসু! স্ত্রীকে প্রশ্ন করতে বিদ্যাপতি জানতে পারলেন জঙ্গলের মধ্যে একটি গোপন জায়গায় নীলমাধবের পূজো করতে যান শবররাজ বিশ্ববসু।
নীলমাধবের সন্ধান যখন পাওয়া গেছে, তখন আর ছাড়ার নয়। অমনি বিদ্যাপতি বায়না ধরলেন, তিনিও দর্শন করবেন নীলমাধবকে। বিশ্ববসু প্রথমে রাজি না হলেও, অবশেষে মত দিলেন। তবে শর্তসাপেক্ষে। বিগ্রহ পর্যন্ত চোখ বেঁধে যেতে হবে বিদ্যাপতিকে। জামাতা হলেও বিদ্যাপতিকে কোন ভাবে নীলমাধবের সন্ধান দিতে রাজি ছিলেন না বিশ্ববসু।
বিদ্যাপতিও ছাড়ার পাত্র নন। চোখ বাঁধা অবস্থায় যাওয়ার সময় তিনি গোটা পথটায় সরষের দানা ছড়াতে ছড়াতে গেলেন।

যথাস্থানে পৌঁছে যখন তিনি দর্শন পেলেন নীলমাধবের, তখন তাঁর প্রাণ আনন্দে ভরে উঠল। বনের মধ্যে পূজোর ফুল কুড়িয়ে এনে বিশ্ববসু যখন পূজোয় বসলেন, অমনি দৈববাণী হল, ‘এতদিন আমি দীন-দুঃখীর পূজো নিয়েছি, এবার আমি মহাউপাচারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পূজো নিতে চাই।’

ভীষণ রেগে গেলেন শবররাজ। ইষ্টদেবতাকে হারাবার দুঃখে বন্দী করলেন বিদ্যাপতিকে। কিন্তু কন্যা ললিতার বারবার কাকুতি মিনতিতে বাধ্য হলেন জামাতাকে মুক্ত করতে। বিদ্যাপতিও সঙ্গে সঙ্গে এই খবর পৌঁছে দিলেন রাজার কাছে।

ইন্দ্রদ্যুম্ন মহানন্দে জঙ্গলের মধ্যে সেই গুহার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন ঠাকুরকে সাড়ম্বরে রাজপ্রাসাদে আনতে।
কিন্তু একি, নীলমাধব কোথায়! আটক হলেন শবররাজ। তখন দৈববাণী হল যে সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে কাঠ। সেই থেকেই বানাতে হবে বিগ্রহ। হাজার হাজার হাতি, ঘোড়া, সেপাইসাস্ত্রী, লোকলস্কর নিয়েও সমুদ্র থেকে তোলা গেল না সেই কাঠ।
শেষে কাঠের একদিক ধরলেন শবররাজ আর একদিক ব্রাহ্মণপুত্র বিদ্যাপতি। জগন্নাথের কাছে ব্রাহ্মণ-শবর কোনও ভেদাভেদ নেই যে!

মহারাজ তাঁর কারিগরদের লাগালেন মূর্তি গড়তে। কিন্তু সেই কাঠ এমনই পাথরের মত শক্ত যে ছেনি, হাতুড়ি সবই যায় ভেঙে। তা হলে উপায়! মূর্তি গড়বে কে!

মহারাজের আকুলতা দেখে বৃদ্ধের বেশে এবার হাজির হলেন স্বয়ং জগন্নাথ। তিনিই গড়বেন মূর্তি। তবে শর্ত একটাই। একুশদিন আগে তিনি নিজে দরজা না খুললে কেউ যেন তাঁর ঘরে না আসে।

শুরু হল কাজ। ইন্দ্রদ্যুম্নের রাণি গুন্ডিচা রোজই রুদ্ধ দুয়ারে কান পেতে শোনেন কাঠ কাটার ঠক্‌ ঠক্‌ শব্দ।
চোদ্দদিন পর হঠাৎ রাণি দেখলেন রুদ্ধদ্বার কক্ষ নিস্তব্ধ। কী হল! কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে রাণি মহারাজকে জানাতেই ইন্দ্রদ্যুম্ন খুলে ফেললেন কক্ষের দরজা।

ভেতরে দেখেন বৃদ্ধ কারিগর উধাও, পড়ে আছে তিনটি অসমাপ্ত মূর্তি। তাদের হাত, পা কিছুই গড়া হয় নি।
গর্হিত অপরাধ করে ফেলেছেন ভেবে দুঃখে ভেঙে পড়লেন রাজা। তখন তাঁকে স্বপ্ন দিয়ে জগন্নাথ বললেন যে এমনটা আগে থেকেই পুনর্নির্ধারিত ছিল। তিনি এই রূপেই পূজিত হতে চান। সেই থেকেই শ্রী জগন্নাথদেবের মূর্তি ওভাবেই পূজিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।

জগন্নাথের প্রধান উৎসব হল রথযাত্রা। আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথদেব বোন সুভদ্রা ও দাদা বলরাম বা বলভদ্রকে নিয়ে রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুন্ডিচার বাড়ি যান। সেখান থেকে সাতদিন পরে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। এই যাওয়াটাকেই জগন্নাথের মাসির বাড়ি যাওয়া বলে।

রথের দিন তিনটি রথ পর পর যাত্রা করে মাসির বাড়ি। প্রথমে যাবেন বলরামের রথ, তারপর সুভদ্রা এবং সবশেষে মহাপ্রভু জগন্নাথের রথ। রথে চড়ে এই গমন ও প্রত্যাগমনকে (সোজা)রথ এবং উল্টোরথ বলে।

বাংলায় রথযাত্রা সংস্কৃতির সম্ভবত সূচনা হয়েছিল শ্রীচৈতন্যদেবের নীলাচল অর্থাৎ পুরী যাওয়ার পর। চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন। যাত্রা শব্দের অর্থ গমন। তাই জগন্নাথের রথযাত্রা এবং উল্টোরথ হিন্দু-বাঙালিদের কোনও কাজ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সূচনার পবিত্রদিন হিসেবে গণ্য করা হয়। বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব দূর্গাপূজোর সূচনাও হয় এই রথ কিংবা উল্টোরথের দিন।

পুরীর রথযাত্রার কিছু তথ্যঃ
জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার রথ। তিনজনের রথ তিন রকমের হয়।

জগন্নাথের রথের নাম ‘নন্দীঘোষ’। উচ্চতা ৪৫ফুট। রথের গায়ে হলুদ এবং সোনালি রং। চলার জন্য এই রথে রয়েছে সাত ফুট ব্যাসের ১৬টি চাকা। রথের সারথির নাম মিতালি।

লাল ও সবুজ রঙের বলরামের রথ ‘তালধ্বজ’। উচ্চতায় জগন্নাথের তুলনায় এক ফুট ছোট। রথে ছ’ফুট ব্যাসের চোদ্দটি চাকা থাকে। সারথি সাত্যকি।

সুভদ্রার রথ ‘দর্পদলন’। উচ্চতা ৪৩ফুট। রথের রঙ লাল এবং কালো। চাকা বারোটি, প্রত্যেকটির ব্যাস পাঁচ ফুট। এই রথের সারথি স্বয়ং অর্জুন।

প্রতিটি রথেই সাতজন করে পার্শ্বদেবী অধিষ্ঠিত। সেই সঙ্গে দু’জন করে দ্বারপাল, একজন করে সারথি এবং একজন করে ধ্বজাদেবতা।

বাংলাতেও অনেক জায়গায় সাড়ম্বরে রথযাত্রা পালিত হয়।
যেমন- ইস্কনের রথ, মাহেশের রথযাত্রা।
১৮৭৫ সালের মাহেশের রথযাত্রাটির ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য আছে। সেবার রথের মেলায় হারিয়ে যায় একটি ছোট্ট মেয়ে। তার খোঁজে অন্যদের সাথে যোগ দেন তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই ঘটনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি লেখেন ‘রাধারাণি’ উপন্যাস।

ইংরেজি অভিধানে একটি শব্দ আছে ‘juggernaut’। যার মানে অতিকায় কোনও বস্তু বা শক্তি যা সমস্ত কিছুকে চূর্ণ করে এগিয়ে যায়। এই শব্দটির উৎসই হল ‘জগন্নাথ’।

Sunday, July 11, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১


পরীক্ষিতের ব্রহ্মশাপঃ
এরপর সৌতি বললেন- অনেক বছর পর পান্ডু বংশে পরীক্ষিত নামে রাজা জন্মালেন। যিনি মহা পূণ্যবান এবং যার সূর্যের মত প্রতাপ। কৃপাচার্যের শিক্ষায় তিনি সকল শাস্ত্র আয়ত্ত করেন।


সর্বগুণ যুক্ত রাজা ছিলেন সত্যব্রত। অনেকদিন ধরে তিনি বনে বনে মৃগয়া করছিলেন। একদিন এক হরিণকে বাণ মারলেন। হরিণটি পালিয়ে গেল, রাজা তার পিছু নিলেন। পরীক্ষিতের বাণে কেউ বাঁচে না, তবু দৈবের বলে হরিণটি হারিয়ে গেল।

রাজা বনের অনেক গভীরে ঢুকে পড়লেন। তার প্রচন্ড জল তেষ্টা পেল। শেষে তিনি এক গোচারণভূমিতে উপস্থিত হলেন এবং দেখলেন বাছুররা দুধ পান করছে। আর তাদের মুখ থেকে যে ফেনা বের হচ্ছে তা পান করছেন একজন ঋষি।

ঋষিকে দেখে রাজা কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি কোন বাণবিদ্ধ মৃগ দেখেছেন কিনা। তিনি নিজের পরিচয়ও দিলেন এবং ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কথা বললেন। মৌণ ঋষি কোন উত্তর দিলেন না। রাজা তবু বারবার হরিণটি কোন পথে গেছে তা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।


রাজা জানতেন না ঋষি মৌনব্রত করছেন, ফলে উত্তর না পেয়ে তিনি রেগে গেলেন। একে তিনি রাজা, তার উপর অতিথি! রাজা ঋষিকে দুষ্ট প্রতিপন্ন করলেন এবং রেগে একটি মৃত সাপ ধনুকের সামনে দিয়ে তুলে ঋষির গলায় পরিয়ে দিলেন। শেষে রাজা ঘোড়ায় চেপে হস্তিনানগরে ফিরে গেলেন।

ঋষির এক ব্রাহ্মণ পুত্র ছিলো, তাঁর নাম শৃঙ্গী। তার বন্ধু কৃশ তাকে বললো -তুমি কিসের গর্ব কর! বনে গিয়ে দেখ রাজা তোমার পিতার সাথে কি ব্যবহার করেছেন!

বনে এসে শৃঙ্গী দেখে বাবার গলায় মৃত সাপের মালা। এই দেখে সে রেগে গেল এবং হাতে জল নিয়ে রাজাকে শাপ দিল –আজ থেকে সাতদিনের মধ্যে রাজা পরীক্ষিত তক্ষক সাপের কামড়ে মারা যাবে।

পুত্রের এই শাপ শুনে ঋষির মনে দুঃখ হল। মৌনভঙ্গের পর তিনি অনুতাপ করতে লাগলেন। সন্তানকে রাগের মাথায় শাপ দেওয়ার জন্য শাসন করলেন।

তিনি বললেন -রাজাকে শাপ দেওয়া অনুচিত। তিনি প্রজাপালন করেন। তিনি ব্রাহ্মণদের যজ্ঞে সাহায্য করেন। দুষ্ট, দৈত্য, চোর ও ভয় দুর হয় রাজার হস্তক্ষেপে। রাজ্য রক্ষার জন্যই বিধাতা রাজাকে সৃষ্টি করেছেন। রাজা বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ অর্থাৎ শ্রোত্রিয়, তাকে শাপ দেওয়া পাপ।
তাছাড়া পরীক্ষিত অন্য রাজাদের মত নন। তিনি পিতামহের মতনই স্বধর্মে পন্ডিত। আমি মৌনব্রতে আছি তা রাজা জানতেন না। সে সময় তিনি ক্ষুধার্তও ছিলেন, তাই ভুল করে ফেলেছেন। তাছাড়া তিনি আমাদের অতিথি। আমিই অতিথিসেবা করিনি। এই বলে তিনি হাহাকার করতে লাগলেন এবং পুত্রকে দুঃখ ভুলে ক্ষমা করে দিতে বললেন।

এত শুনে শৃঙ্গী বললেন –আমার কথা সহজ়ে খন্ডন হবে না। যা বলে ফেলেছি তা ফলবেই।

এত শুনে ঋষি চিন্তিত হলেন এবং যখন বুঝলেন অভিশাপ আর খন্ডিত হবে না, তখন তার শিষ্য গৌরমুখকে রাজার কাছে সব জানিয়ে আসতে বললেন।

হস্তিনাপুরে গৌরমুখ পরীক্ষিতের সাথে দেখা করতে গেলেন। রাজা তার পা ধুইয়ে দিলেন। তারপর কোথা থেকে, কি কারণে এসেছেন জানতে চাইলেন।

গৌরমুখ বললেন –রাজা মন দিয়ে শুন। মৃগয়া করতে তুমি বনে গেছিলে এবং এক ঋষির গলায় মৃত সাপ জড়িয়ে এলে। তা দেখে তার পুত্র ক্রোধিত হয় এবং তোমায় শাপ দেয়। তার পিতা তখন তা জানতেন না। পরে সব শুনে খুবই দুঃখিত হন এবং আমায় তোমার কাছে পাঠান। পুত্রকে অনেক বুঝিয়েও তিনি শাপমোচন করতে পারেন নি। সাতদিনের মধ্যেই তোমার তক্ষকের কামড়ে মৃত্যু হবে। এর একটা উপায় এখন থেকেই কর।

সব শুনে রাজা বজ্রাহত হলেন এবং নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বললেন –হিংসা করে আমি কি পাপই না করলাম! মৃত্যুর চিন্তা আমি আর করি না। সেই ঋষি ও তার পুত্রকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। তিনি যে মৌনব্রতে ছিলেন তা আমি জানতাম না। তবে যে শাস্তি আমার হল তা আমি নেব। আপনি ঋষিকে আমার প্রণাম জানাবেন। দৈবের বাক্য খন্ডন করা সম্ভব নয়। এত সব বলে গৌরমুখকে তিনি বিদায় সম্ভাষণ জানালেন।

সব মন্ত্রীরা এসে সব শুনে আলোচনা শুরু করলো। কি উপায়ে তাদের রাজাকে বাঁচান যায়। তারা ঠিক করলেন একটি উঁচু মঞ্চে করা যাক। সেখানে রাজাকে ঘিরে সব মন্ত্রীরা পাহারায় বসবেন। সাপ থেকে তাকে দুরে রাখার চেষ্টা হল। বেদজ্ঞ পন্ডিতদের এনে রাজা তার চারদিকে রাখলেন এবং দানধ্যান করে ও হরির নামগান শুনতে লাগলেন।

তক্ষকনাগ
..........................................

Wednesday, July 7, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত – ১০

নাগ-রাজার তপস্যা:

শেষনাগ, বাদামী গুহা, কর্ণাটক

এবার শৌনকাদি মুনিরা সৌতির কাছে কদ্রু এবং তাঁর এক সহস্র পুত্র সম্পর্কে জানতে চাইলেন।

সৌতি তখন বললেন –নাগেদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং শ্রেষ্ঠ হলেন শেষনাগ। তারপর বাসুকি, ঐরাবত, তক্ষক, কর্কট, সিংহ-আঁখি, বামন, কলিয়, এলাপত্র, মহোদর, কুন্ডর, অনীল, নীল, বৃত্ত, অকর্কর, মনিনাগ, আপূরণ, আর্য্যক, উগ্রক, সুরামুখ, দধিমুখ, কলস, পোতক, কৌরব্য, কুটর, আপ্ত, কম্বল, তিত্তিরি-আরো অনেক!

সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন জ্যেষ্ঠ শেষ বিষধর। তিনি জিতেন্দ্রিয়, সুপন্ডিত এবং ধর্মে তৎপর। ভাইদের অসৎ ব্যবহার এবং মায়ের অন্যায় শাপদানে ব্যথিত হয়ে সকলকে ত্যাগ করে তিনি নানা তীর্থে তপস্যা করতে গেলেন। হিমালয়ে আশ্রম করে শেষ সেখানে কঠিন তপস্যা করেন।

তার তপস্যায় প্রজাপতি তুষ্ট হলেন। ব্রহ্মা তাকে বর দিতে চাইলেন। শেষ তার দুঃখের কথা অর্থাৎ দুষ্ট ভাইদের কথা, সৎ ভাই গরুড়ের কথা, গরুড়ের বীরত্ব-সব জানিয়ে ব্রহ্মার কাছে এই বর প্রার্থনা করলেন যে দুষ্ট ভাইদের সংস্রবে যেন তাকে আসতে না হয় এবং তপস্যা করেই যেন তার প্রাণ যায়। ব্রহ্মা তাকে আশির্বাদ করলেন এবং পৃথিবী ধারণে অনুরোধ করলেন।

ব্রহ্মার আদেশে শেষনাগ পৃথিবীকে ধারণ করলেন এবং ব্রহ্মার সাহায্যেই তার গরুড়ের সাথে বন্ধুত্ব হল। ব্রহ্মার আজ্ঞায় শেষ পাতালে প্রবেশ করে পৃথিবীকে ধারণ করলেন। তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাকে নাগরাজ করলেন।

নাগলোক এবং দেবলোকে সকলে তাকে পূজা করতে লাগল। শেষে তিনি ব্রহ্মার আজ্ঞায় সব ভাইদের ত্যাগ করে পাতালেই অবস্থান করতে লাগলেন।

নাগ পঞ্চমীতে পূজিত নাগ দেবতারাঃ অনন্ত নাগ, শেষ নাগ, বাসুকি, পদ্মনাভ, শঙ্খপলা, কালিয়া, তক্ষক, কম্বাল এবং মহাপদ্ম

শেষ চলে যেতে বাসুকি চিন্তিত হলেন। মায়ের শাপে তিনিও দুঃখিত ছিলেন।
তিনি সব ভাইদের ডেকে বললেন –মায়ের শাপ থেকে নিষ্কৃতি নেই। পিতার শাপের প্রতিকার থাকলেও মায়ের শাপের হাত থেকে রক্ষা নেই। মা যখন রেগে শাপ দিলেন, পিতা এবং পিতামহও তাকে স্বীকার করলেন। জন্মেজয়ের যজ্ঞে অবশ্যই সবাই সংহার হবে। এখন থেকেই তার প্রতিকারের চেষ্টা করতে হবে।

এত কথা শুনে এক এক ভাই এক এক রকম পরামর্শ দিতে থাকল।

একজন বললে-আমি ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মেজয়ের কাছে যজ্ঞ ভিক্ষা চাইবো।

আর এক নাগ বললে-আমি রাজমন্ত্রী হয়ে রাজাকে যজ্ঞই করতে দেব না।

কেউ বা বললে-কে যজ্ঞ করবে! যজ্ঞের হোতাকেই মেরে ফেলবো।

কেউ বলে উঠল–সব ব্রাহ্মণদের খাব, তা হলে ব্রাহ্মণ ছাড়া আর যজ্ঞ হবে না।

কেউ আবার বললো-ব্রাহ্মণকে রাগিয়ে লাভ নেই। লোকে বিপদে পড়লে তাদের দান করে। তারা তুষ্ট থাকলে সবাই রক্ষা পায়।

কোন নাগ আবার বললো সে জলধর হয়ে যজ্ঞ নিভিয়ে দেবে।

কেউ বা বললো সব যজ্ঞের শষ্য চুরি করবে।

আবার কেউ পরামর্শ করলো-সব নাগ বেড়ার মত যজ্ঞস্থান ঘিরে রাখবে এবং যে কাছে আসবে তাকেই ভক্ষণ করবে। এতে রাজা ভয় পেয়ে যজ্ঞ বন্ধ করে দেবে।

কিন্তু বাসুকির এসবে মন ভরল না।
তিনি বললেন –দৈব শক্তি নিবারণ ক্ষমতা আমাদের নেই। অবশ্যই সাপের বংশ ধ্বংস হবে।

এলাপত্র নামে এক নাগ সব শুনে বললেন –মায়ের বচন কখনও লঙ্ঘণ করা যায় না। সব যুক্তিই অকারণ। মায়ের বচন আর দৈবের লিখন, খন্ডিত হয় না। যজ্ঞ অবশ্যই হবে। পান্ডুবংশে জন্মেজয়ের জন্ম হবে। তার যজ্ঞ বন্ধ করার শক্তি কারো নেই। একটাই উপায় আছে, সবাই ব্রহ্মার কথা মন দিয়ে শুন।

যখন মা সন্তানদের অভিশাপ দিলেন তখন দেবতারা ব্রহ্মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন মা কি তাঁর সন্তানদের এমন শাপ দিতে পারেন!

ব্রহ্মা তখন তাদের মন দিয়ে শুনতে বলেন। সর্পরা সকলের ক্ষতি করছে। তাদের শেষ না করলে বিষে সংসার ভরে যাবে। তবে যে নাগ ধর্মে অনুগত হবে, তারাই জন্মেজয়ের যজ্ঞে রক্ষা পারে। তার একটা উপায় আছে।

যখন দেবাসুর সমুদ্রমন্থন করলো, বাসুকি তখন মন্থন দড়ি হলেন। দেবতারা তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মাকে বললেন বাসুকি সমুদ্রমন্থনে সাহায্য করেছেন। মার ভয়ে বাসুকি ভীত তার এই ভয় যেন দুর হয়।
ব্রহ্মা বলেন বোন জরৎকারীর সন্তানই তাদের রক্ষা করবে।

মনসা/জরৎকারী ও পুত্র আস্তিক

যাযাবর বংশে জরৎকারু নামে এক জ্ঞানী জন্মগ্রহণ করবেন। তার বিবাহ হবে জরৎকারীর সাথে। জরৎকারী বাসুকী অর্থাৎ নাগেদের বোন। তার গর্ভে জন্মাবে আস্তিক নামে এক পুত্র। সেই আস্তিকই নাগদের রক্ষা করবে।
এই একমাত্র পথ। এছাড়া নাগেদের আর কোন পথ নেই। বোন জরৎকারীর বিবাহ যাযাবর জরৎকারুর সাথে দিলে তবেই সবাই নিস্তার পাবে।

এলাপত্রের একথা শ্রবণ করে সকলে সাধুবাদ দিতে লাগল।

সব শুনে বাসুকি আনন্দিত হলেন এবং জরৎকারুকে খোঁজার জন্য চর নিযুক্ত করলেন।
চরদের আদেশ দিলেন –তোমরা লুকিয়ে থাকবে এবং জরৎকারুকে দেখলেই আমাকে খবর দেবে।

এভাবে বাসুকি তার বোনকে জরৎকারুকে দান করতে প্রস্তুত হতে লাগলেন।
………………………

Thursday, July 1, 2010

বিষ্ণু দশ অবতার রূপে :


বিষ্ণুর অবতার: মৎস(মাছ), কুর্ম(কচ্ছপ), বরাহ, নৃসিংহ(নর-সিংহ), বামন, পরশুরাম(পরশু অর্থাৎ কুঠার সহ রাম), রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, কল্কি।

১) মৎস্য (মাছ) হিন্দু পুরাণে বিষ্ণুর প্রথম অবতার।মাছের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ। মৎস্যের উর্ধ্বশরীর চতুর্ভূজ বিষ্ণুর এবং নিম্নাঙ্গ একটি মাছের।

মৎস্য পুরাণ অনুসারে, প্রাগৈতিহাসিক দ্রাবিড় রাজ্যের বিষ্ণুভক্ত রাজা সত্যব্রত (যিনি পরে মনু নামে পরিচিত হন) একদিন নদীর জলে হাত ধুচ্ছিলেন। এমন সময় একটি ছোটো মাছ তাঁর হাতে চলে আসে এবং তাঁর কাছে প্রাণভিক্ষা চায়। তিনি মাছটিকে একটি পাত্রে রাখেন। কিন্তু মাছটি ক্রমশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে। তিনি সেটিকে প্রথমে একটি পুষ্করিণীতে, পরে নদীতে এবং শেষে সমুদ্রে ছেড়ে দেন। কিন্তু কোনো ফল হয় না। সেটি এতটাই বৃদ্ধি পায় যে সকল আধারই পূর্ণ হয়ে যায়। শেষে মাছটি বিষ্ণুর রূপে আত্মপ্রকাশ করে সত্যব্রতকে জানান যে সাত দিনের মধ্যে প্রলয় সংঘটিত হবে এবং সকল জীবের বিনাশ ঘটবে। তাই সত্যব্রতকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে সকল প্রকার ঔষধি, সকল প্রকার বীজ, সপ্তর্ষি, বাসুকি নাগ ও অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে নিতে।

প্রলয় সংঘটিত হলে মৎস্যরূপী বিষ্ণু পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুসারে পুনরায় আবির্ভূত হন। তিনি সত্যব্রতকে একটি নৌকায় আরোহণ করতে বলেন এবং তাঁর শিঙে বাসুকি নাগকে নৌকার কাছি হিসেবে বাঁধতে বলেন।
..................
২)কূর্ম অবতারে বিষ্ণু কচ্ছপের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ হন।
কূর্ম অবতারে বিষ্ণু ক্ষীরোদসাগরে সমুদ্র মন্থনের সময় মন্দর পর্বতকে নিজের পিঠে ধারণ করেন। এভাবে বিষ্ণু, মন্দর পর্বত ও বাসুকি নাগের সাহায্যে সমুদ্র মন্থন সংঘটিত হয়।
..................
৩)বরাহ অবতারে শূকরের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ হন।
বরাহ অবতারে দেখা যায় রাক্ষস হিরণ্যাক্ষ পৃথিবীর উপর নানা রকম অত্যাচার করলে পৃথিবী বিষ্ণুর কাছে রাক্ষসের হাত থেকে রক্ষা পেতে চান। বরাহ বা বন্য শুকরের রূপ ধরে বিষ্ণু হিরণ্যাক্ষের সাথে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করে জয় লাভ করেন। এই বরাহ অবতারে পৃথিবীর সাথে বিষ্ণুর বিবাহ হয়।
........................
৪)নৃসিংহের অবতারে বিষ্ণু সত্যযুগে অবতীর্ণ হন।

ভাগবত পুরাণ-এ বর্ণিত নৃসিংহের কাহিনিটি: নৃসিংহের পূর্ববর্তী অবতার বরাহ হিরণ্যাক্ষ নামে এক রাক্ষসকে বধ করেন। হিরণ্যাক্ষের ভাই হিরণ্যকশিপু এই কারণে প্রবল বিষ্ণুবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। দাদার হত্যার প্রতিশোধ মানসে তিনি বিষ্ণুকে হত্যা করার পথ খুঁজতে থাকেন। তিনি মনে করেন, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা এই জাতীয় প্রবল ক্ষমতা প্রদানে সক্ষম। তিনি বহু বছর ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করেন। ব্রহ্মাও হিরণ্যকশিপুর তপস্যায় সন্তুষ্ট হন।
তিনি হিরণ্যকশিপুর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাঁকে বর দিতে চান। হিরণ্যকশিপু বলেন:
হে প্রভু, হে শ্রেষ্ঠ বরদাতা, আপনি যদি আমাকে সত্যই বর দিতে চান, তবে এমন বর দিন যে বরে আপনার সৃষ্ট কোনো জীবের হস্তে আমার মৃত্যু ঘটবে না।
আমাকে এমন বর দিন যে বরে আমার বাসস্থানের অন্দরে বা বাহিরে আমার মৃত্যু ঘটবে না; দিবসে বা রাত্রিতে, ভূমিতে বা আকাশে আমার মৃত্যু হবে না।
আমাকে এমন বর দিন যে বরে শস্ত্রাঘাতে, মনুষ্য বা পশুর হাতে আমার মৃত্যু হবে না।
আমাকে এমন বর দিন যে বরে কোনো জীবিত বা মৃত সত্তার হাতে আমার মৃত্যু হবে না; কোনো উপদেবতা, দৈত্য বা পাতালের মহানাগ আমাকে হত্যা করতে পারবে না; যুদ্ধক্ষেত্রে আপনাকে কেউই হত্যা করতে পারে না; তাই আপনার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
আমাকেও বর দিন যাতে আমারও কোনো প্রতিযোগী না থাকে।
এমন বর দিন যাতে সকল জীবসত্তা ও প্রভুত্বকারী দেবতার উপর আমার একাধিপত্য স্থাপিত হয় এবং আমাকে সেই পদমর্যাদার উপযুক্ত সকল গৌরব প্রদান করুন।
এছাড়া আমাকে তপস্যা ও যোগসাধনার প্রাপ্তব্য সকল সিদ্ধাই প্রদান করুন, যা কোনোদিনও আমাকে ত্যাগ করবে না।'

হিরণ্যকশিপু যখন মন্দার পর্বতে তপস্যা করছিলেন, তখন ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবগণ তাঁর প্রাসাদ আক্রমণ করেন।
দেবর্ষি নারদ হিরণ্যকশিপুর স্ত্রী কায়াদুকে রক্ষা করেন। দেবর্ষি দেবগণের নিকট কায়াদুকে ‘পাপহীনা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। নারদ কায়াদুকে নিজ আশ্রমে নিয়ে যান। সেখানে কায়াদু প্রহ্লাদ নামে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন।

নারদ প্রহ্লাদকে শিক্ষিত করে তোলেন। নারদের প্রভাবে প্রহ্লাদ হয়ে ওঠেন পরম বিষ্ণুভক্ত। এতে তাঁর পিতা হিরণ্যকশিপু অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন।

ক্রমে প্রহ্লাদের বিষ্ণুভক্তিতে হিরণ্যকশিপু এতটাই ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হন যে তিনি নিজ পুত্রকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন।

কিন্তু যতবারই তিনি বালক প্রহ্লাদকে বধ করতে যান, ততবারই বিষ্ণুর মায়াবলে প্রহ্লাদের প্রাণ রক্ষা পায়।

হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে বলেন তাঁকে ত্রিভুবনের অধিপতি রূপে স্বীকার করে নিতে। প্রহ্লাদ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন একমাত্র বিষ্ণুই এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ প্রভু। ক্রুদ্ধ হিরণ্যকশিপু তখন একটি স্তম্ভ দেখিয়ে প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করেন যে ‘তার বিষ্ণু’ সেখানেও আছেন কিনা।

প্রহ্লাদ উত্তর দিলেন, তিনি এই স্তম্ভে আছেন, এমনকি ক্ষুদ্রতম যষ্টিটিতেও আছেন।

হিরণ্যকশিপু ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে গদার আঘাতে স্তম্ভটি ভেঙে ফেলেন।
তখনই সেই ভগ্ন স্তম্ভ থেকে প্রহ্লাদের সাহায্যার্থে নৃসিংহের মূর্তিতে আবির্ভূত হন বিষ্ণু। ব্রহ্মার বর যাতে বিফল না হয়, অথচ হিরণ্যকশিপুকেও হত্যা করা যায়, সেই কারণেই বিষ্ণু নরসিংহের বেশ ধারণ করেন: হিরণ্যকশিপু দেবতা, মানব বা পশুর মধ্য নন, তাই নৃসিংহ পরিপূর্ণ দেবতা, মানব বা পশু নন; হিরণ্যকশিপুকে দিবসে বা রাত্রিতে বধ করা যাবে না, তাই নৃসিংহ দিন ও রাত্রির সন্ধিস্থল গোধূলি সময়ে তাঁকে বধ করেন; হিরণ্যকশিপু ভূমিতে বা আকাশে কোনো শস্ত্রাঘাতে বধ্য নন, তাই নৃসিংহ তাঁকে নিজ জঙ্ঘার উপর স্থাপন করে নখরাঘাতে হত্যা করেন; হিরণ্যকশিপু নিজ গৃহ বা গৃহের বাইরে বধ্য ছিলেন না, তাই নৃসিংহ তাঁকে বধ করেন তাঁরই গৃহদ্বারে।

ভাগবত পুরাণ-এ আরও বলা হয়েছে:
হিরণ্যকশিপুকে বধ করার পর সকল দেবতাই নৃসিংহদেবের ক্রোধ নিবারণে ব্যর্থ হন। নৃসিংহকে শান্ত করতে শিব প্রথমে বীরভদ্রকে প্রেরণ করেন। বীরভদ্র ব্যর্থ হল। বিফল হন স্বয়ং শিবও।(বীরভদ্র ব্যর্থ হলে শিব স্বয়ং মনুষ্য-সিংহ-পক্ষী রূপী শরভের রূপ ধারণ করেন। এই কাহিনির শেষভাগে বলা হয়েছে, শরভ কর্তৃক বদ্ধ হয়ে বিষ্ণু শিবের ভক্তে পরিণত হন। )
সকল দেবগণ তখন তাঁর পত্নী লক্ষ্মীকে ডাকেন; কিন্তু লক্ষ্মীও স্বামীর ক্রোধ নিবারণে অক্ষম হন।

তখন ব্রহ্মার অনুরোধে প্রহ্লাদ এগিয়ে আসেন। ভক্ত প্রহ্লাদের স্তবগানে অবশেষে নৃসিংহদেব শান্ত হন। প্রত্যাবর্তনের পূর্বে নৃসিংহদেব প্রহ্লাদকে রাজা করে দেন।
.....................
৫)বামনের রূপে বিষ্ণু ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ হন।
বামনঅবতারঃ অদিতি ও কশ্যপের পুত্র বামন। তিনি দ্বাদশ আদিত্যের অন্যতম। ইনি ইন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা রূপেও পরিচিত।
পরাক্রমী রাক্ষসরাজ বালি, যিনি প্রহ্লাদের নাতি-যোড় করে ইন্দ্রের অমরাবতী হরণ করলে বিষ্ণু বামন অবতারে আবির্ভূত হন। রাজা বালি গুরু শুক্রাচার্যের সাহায্যে অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু করলেন।

খর্বাকার বামন হাতে বাঁশের ছত্র নিয়ে অতিথি হয়ে সেখানে আমন্ত্রিত হলেন। বামন রাজার কাছে তিনপদ জমি প্রার্থনা করলেন। গুরু শুক্রাচার্যের নিষেধ সত্তেও ছোট বালক ভেবে রাজা তা দিতে অঙ্গিকার করেন।

তখন বিষ্ণু স্বরূপে এসে একপদে পৃথিবী, অপরপদে আকাশ অধিকার করেন। তিনি তৃতীয়পদ কোথায় রাখবেন রাজাকে প্রশ্ন করলে রাজা বালি সমস্ত বুঝতে পারেন এবং বিষ্ণুর সামনে নিজের মস্তক নত করে সেখানে বামনরূপী বিষ্ণুর তৃতীয় চরণ রাখার অনুরোধ করেন।
...............
৬)পরশুরাম, পরশু অর্থাৎ কুঠারধারী রামের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ হলেন বিষ্ণু।

পরশুরাম অবতারঃ আদিকালে জলের মধ্যেই ঘটেছিল প্রথম প্রাণের সঞ্চার। জলচর প্রাণীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ তত্কালীন প্রাণিজগতে ঈশ্বরের উপস্থিতি তাই মত্স্যরূপেই ছিল স্বাভাবিক।
ক্রমে ক্রমে স্থলভাগেও প্রাণীর অস্তিত্ব প্রসারিত হলো। সৃষ্টি হলো উভয়চর প্রাণীর। ঈশ্বর পৃথিবীতে এলেন কুর্ম হয়ে।

প্রাণিজগতে জলের তুলনায় স্থলভাগের প্রাধান্য ও বৈচিত্র্য বাড়তে লাগল। ঈশ্বর এলেন স্থলচর প্রাণী বরাহ হয়ে।

স্থলচর প্রাণিকুলে পশুত্ব ভেদ করে ধীরে ধীরে ঘটতে থাকল মনুষ্যত্বের স্ফুরণ। সৃষ্টির এই অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে স্রষ্টা তখন নৃসিংহ। অর্ধেক নর অর্ধেক পশু।

তারপর এলো ক্ষুদে মানুষের যুগ। বামন অবতার জানিয়ে দিলেন ত্রিভুবনে মানুষের পদস্পর্শ ঘটার দিন আগত।

এভাবেই বিবর্তনের পঞ্চম ধারা অতিক্রম করে বিষ্ণু এলেন পূর্ণাঙ্গ মানুষরূপে।

তিনিই পরশুরাম। এরই মধ্যে প্রাণিজগতে স্বাভাবিক মানুষের আবির্ভাবই শুধু ঘটেনি, মানবজাতি সত্যযুগ অতিক্রম করে এসেছে। ঘর বেঁধেছে, সংসার করতে শিখেছে, শিখেছে সমাজ গড়তে, রাজ্য চালাতে, আত্মরক্ষা করতে এবং আক্রমণ চালাতে। পরশুরামের হাতে তাই হরধনু।

পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায়, ত্রেতাযুগের সূচনাকালে মগধ রাজ্যে ভাগীরথীর উপনদী কৌশিকীর তীর ঘেঁষে এক সমৃদ্ধ নগরী ছিল, যার নাম ভোজকোট।
এই নগরীতে গাধি নামে চন্দ্রবংশীয় একজন রাজা ছিলেন। গাধির ছিল এক ছেলে ও এক মেয়ে।
গাধিপুত্র বিশ্বামিত্র পরবর্তী সময়ে সাধনা বলে মহর্ষি হয়ে জগত আলোকিত করেন। ক্ষত্রীয়কুলে জন্ম হলেও মহর্ষির স্বীকৃতিলাভের জন্য বশিষ্ঠ মুনির সঙ্গে বিশ্বামিত্রের দ্বন্দ্ব পৌরাণিক কাহিনীর এক চমত্কার সংযোজন।

সেই দ্বন্দ্বে বশিষ্ঠ মুনি ছিলেন অটল এবং নির্বিকার। দ্বন্দ্ব চলাকালীন ধীরে ধীরে বিশ্বামিত্রের মধ্যে ক্ষত্রীয় সুলভ ক্রোধের প্রশমন এবং ব্রহ্মতেজের স্ফুরণ ঘটে।

বিশ্বামিত্রের বোন সত্যবতী ছিলেন অসামান্য রূপসী। সত্যবতী বয়ঃপ্রাপ্ত হলে ভৃগুবংশীয় এক ব্রাহ্মণ সন্তান রিচিকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পরে রিচিক মুনির ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে জমদগ্নি নামে এক পুত্রের জন্ম হয়।

এই ঋষি জমদগ্নিই হচ্ছেন পরশুরামের বাবা। ঋষি জমদগ্নির পাঁচ পুত্রসন্তানদের মধ্যে প্রথম সন্তানের নাম রুষন্নন্ত, দ্বিতীয় পুত্রের নাম সুষেণ, তৃতীয় পুত্রের নাম বসু, চতুর্থ পুত্রের নাম বিশ্বাসুর, পরশুরাম ছিলেন সবার ছোট; অর্থাত্ পঞ্চম পুত্র।

একদিন পরশুরামের মা রেণুকাদেবী জল আনতে গঙ্গার তীরে যান। সেখানে পদ্মমালী (মতান্তরে চিত্ররথ) নামক গন্ধর্বরাজ স্ত্রীসহ জলবিহার করছিলেন (মতান্তরে অপ্সরীগণসহ)।

পদ্মমালীর রূপ এবং তাদের সমবেত জলবিহারের দৃশ্য রেণুকাদেবীকে এমনভাবে মোহিত করে যে, তিনি তন্ময় হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন।

অন্যদিকে ঋষি জমদগ্নির হোমবেলা পেরিয়ে যাচ্ছে সেদিকে তার মোটেও খেয়াল নেই। সম্বিত ফিরে রেণুকাদেবী কলস ভরে ঋষি জমদগ্নির সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ান।

তপোবলে ঋষি জমদগ্নি সবকিছু জানতে পেরে রেগে গিয়ে ছেলেদের মাতৃহত্যার আদেশ দেন।
প্রথম চার ছেলে মাকে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান।

কিন্তু পরশুরাম পিতার আদেশে মা এবং আদেশ পালন না করা ভাইদের কুঠার দিয়ে হত্যা করেন।

পরবর্তীকালে পিতা খুশি হয়ে বর দিতে চাইলে তিনি মা এবং ভাইদের প্রাণ ফিরে চান। তাতেই রাজি হন ঋষি জমদগ্নি।

কিন্তু মাতৃহত্যার পাপে পরশুরামের হাতে কুঠার লেগেই রইল। শত চেষ্টা করেও সে কুঠার খসাতে পারলেন না তিনি। পিতার কাছে জিজ্ঞাসা করলেন তার পাপ মুক্তির উপায়ের কথা।
পিতা বললেন, তুমি মাতৃহত্যা ও স্ত্রীলোক হত্যা—এই দুই পাপে আক্রান্ত হয়েছ, তাই তোমাকে তীর্থে তীর্থে ঘুরতে হবে, যে তীর্থের জলের স্পর্শে তোমার হাতের কুঠার খসে যাবে;
মনে রাখবে সেই তীর্থই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম তীর্থস্থান।

পিতার কথা মতো পরশুরাম তীর্থে তীর্থে ঘুরতে লাগলেন। শেষে ভারতবর্ষের সব তীর্থ ঘুরে ব্রহ্মকুণ্ডের পুণ্য জলে স্নান করে তাঁর হাতের কুঠার খসে গেল।

পরশুরাম মনে মনে ভাবলেন, এই পুণ্য বারিধারা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে মানুষ খুব উপকৃত হবে।

তাই তিনি হাতের খসে যাওয়া কুঠারকে লাঙ্গলে রূপান্তর করে পাথর কেটে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে মর্ত্যলোকের সমভূমিতে সেই জলধারা নিয়ে আসেন।
লাঙ্গল দিয়ে সমভূমির বুক চিরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন তিনি।
ক্রমাগত ভূমি কর্ষণজনিত শ্রমে পরশুরাম ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার অন্তর্গত সোনারগাঁওয়ে এসে তিনি লাঙ্গল চালানো বন্ধ করেন। এ জন্য এ স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্দ।
এরপর এ জলধারা কোমল মাটির বুকচিরে ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিশেছে। পরবর্তীকালে এই মিলিত ধারা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে।
.....................

৭)রাম অবতারে অযোধ্যার রাজপুত্রের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ হলেন বিষ্ণু।

রামচন্দ্র প্রাচীন ভারতের কিংবদন্তী রাজা। হিন্দু ধর্মে রামকে বিষ্ণু দেবতার সপ্তম অবতার হিসেবে গণ্য করা হয়।

রাম দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রচলিত হিন্দুধর্মের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র ও দেবতাগুলির একটি।
রামের চরিত্রের সবচেয়ে ব্যাপক বিবরণ পাওয়া যায় রামায়ণ নামের মহাকাব্যে।
অযোধ্যার রাজা দশরথ ও তাঁর স্ত্রী কৌশল্যার ঘরে প্রথম সন্তান হিসেবে রামের জন্ম হয়। হিন্দুধর্মে রামকে পুরুষোত্তম মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। রামের স্ত্রী হলেন সীতা। সীতাকে হিন্দুরা লক্ষ্মী দেবীর একজন অবতার ও ত্রুটিহীনা নারীর রূপায়ন হিসেবে গণ্য করে।
..............................
৮)কৃষ্ণ অবতারঃ দ্বাপরযুগে ভ্রাতা বলরামের সঙ্গে অবতীর্ণ হলেন বিষ্ণু।

হিন্দুধর্মানুসারে, কৃষ্ণ বিষ্ণুর অষ্টম অবতার। তাঁকে স্বয়ং ভগবান এবং বিষ্ণুর পূর্ণাবতারও মনে করা হয়।

গীতায় বলা হয়েছে যে, অধর্ম ও দুর্জনের বিনাশ এবং ধর্ম ও সজ্জনের রক্ষার জন্য তিনি যুগে যুগে পৃথিবীতে আগমন করেন। তাঁর এই আগমন ঘটে কখনও মনুষ্যরূপে, কখনও বা মনুষ্যেতর প্রাণিরূপে এবং একেই বলা হয় অবতার।

কৃষ্ণের প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় বৈদিক সাহিত্যে। ঋগ্বেদে একাধিকবার কৃষ্ণের উল্লেখ আছে। কৃষ্ণকে দেবকীপুত্র বলা হয়েছে। মহাভারত , বিভিন্ন পুরাণ , শ্রীমদ্ভাগবত এবং বৈষ্ণবকাব্যে যে কৃষ্ণের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তাঁর আবির্ভাব দ্বাপর যুগে।

প্রচলিত ঐতিহ্য অনুসারে মাতুল কংসের কারাগারে ভাদ্রমাসের অষ্টমী তিথিতে কৃষ্ণের জন্ম। তাঁর জন্মসূত্রে এ দিনটি প্রতিবছর জন্মাষ্টমী নামে পালিত হয়।
...........................
৯)বুদ্ধ, কলিযুগে অবতীর্ণ হন।

বুদ্ধ অবতারে বিষ্ণু অসুরী শক্তির বিনাশ ঘটানোর জন্য আবির্ভূত হন। ইনিই গৌতম বুদ্ধ-বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা।
.....................

১০) দশম অবতার হচ্ছে কল্কি। তিনি এখনও অবতীর্ণ হননি।হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, কলিযুগের অন্তে তাঁর আবির্ভাব ঘটবে।

কল্কি অবতারঃ কল্কি বিষ্ণুর ভবিষ্যৎ অবতার মানা হয়। পুরাণকথা অনুসারে কলিযুগ পাপে পূর্ণ হলে বিষ্ণু দুষ্টের দমনের জন্য কল্কি অবতারে আবির্ভূত হবেন। কল্কি অবতার কলিযুগ অবসানের জন্য হবে। যখন কলিযুগে মানুষ ধর্মপথ ত্যাগ করবে তখন ইনি প্রকাশ পাবেন।

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৯

ইন্দ্রের প্রতি বাল্যখিল্যাদির অভিসম্পাত:

ইন্দ্র

মুনিরা আবার জিজ্ঞাসা করেন -বল সূত-নন্দন, ইন্দ্রের কি কারণে পাপ হল! কশ্যপমুনি ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের একজন। তার পুত্রের পাখি হওয়ার কারণই বা কি!
সৌতি তখন মুনিদের আবার কাহিনী বর্ণনা শুরু করলেন।

পূর্বে কশ্যপমুনি একবার যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। অনেক মুনি, ঋষি এবং দেবতারা তাঁকে সাহায্য করেন।
ইন্দ্র যজ্ঞের জন্য পর্বত প্রমাণ কাঠ বন থেকে নিয়ে আসেন। ফেরার পথে তিনি দেখেন আঙ্গুলী সমান বাল্যখিল্য মুনিরা পলাশের পাতা মাথায় দিয়ে ধিরে ধিরে যাচ্ছেন। একটি গরু রাস্তা দিয়ে যাওয়ার ফলে যে গর্ত তার ক্ষুরে সৃষ্টি হয় তা মুনিরা পার হতে পারছেন না। দেখে ইন্দ্র তাঁদের উপহাস করলেন।
তাতে বাল্যখিল্যমুনিরা রেগে গিয়ে বললেন –মত্ত দুরাচার! তুমি অহঙ্কারে আমাদের চিনতে পারছ না!

তাঁরা ইন্দ্রকে জব্দ করার জন্য ইন্দ্রের চেয়েও শক্তিশালী বীরের আবির্ভাবের জন্য যজ্ঞ শুরু করলেন। ইন্দ্র ভয় পেয়ে ব্রহ্মা এবং কশ্যপমুনিকে তুষ্ট করলেন।

ব্রহ্মার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বাল্যখিল্য মুনিরা অনেক দুর এগিয়েও যজ্ঞ বন্ধ করলেন।

বাল্যখিল্য মুনিরা বললেন –এতদুর এগিয়েও সব পন্ড হবে!

কশ্যপ মুনি বললেন –তা কেন! এর ফলে পক্ষীন্দ্র অর্থাৎ পক্ষীদের রাজা জন্মাবেন এবং সেই ত্রিভুবন জয় করবেন।

মুনিরা ইন্দ্রকে শান্তনা দিয়ে বললেন আর কখনও কাউকে উপহাস করো না, অহঙ্কারও করো না, ব্রাহ্মণের ক্রোধ থেকে কারো নিস্তার নেই। এরপর তারা বিদায় সম্ভাষণ জানান।

কশ্যপমুনি তার স্ত্রী বিনতাকে বলেন ব্রত সফলরূপে শুনলে তার গর্ভে খগেন্দ্র অর্থাৎ পক্ষীরাজ জন্মাবেন। শুনে বিনতা খুশি হলেন। এভাবে কশ্যপের পুত্র হলেন গরুড়।



যখন গরুড় স্বর্গে গেলেন, তার ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে সকলে ভয় পেলেন। সকল দেবতা তাদের সকল অস্ত্র গরুড়ের উপর প্রয়োগ করলেন। কামরূপী অর্থাৎ ইচ্ছানুযায়ী গরুড় তার আকৃতি পরিবর্তন করে দেবতাদের আচরণে হাসতে লাগলেন। যত অস্ত্র তার উপর ফেলা হতে লাগলো, ততোই গরুড়ের তেজ বাড়তে লাগলো। মেঘের মত গর্জন করতে লাগলেন গরুড়।
তিনি ভাবলেন ইন্দ্র ও অন্য দেবতারা তার শক্তির পরিচয় বুঝতে না পেরেই তাঁর বিরোধীতা করছেন। এই ভেবে তিনি তাঁর পাখনার ঝাপ্‌টায় ইন্দ্রপুরী ধুলায় ভরালেন। ইন্দ্রপুরী লন্ডভন্ড হতে লাগলো।
ইন্দ্রও পবনকে ধুলা উড়ানোর আজ্ঞা করলেন। সকল দেবতা গরুড়কে আবার বাঁধতে চাইলেন।

এতসব দেখে গরুড় রেগে উঠলেন এবং আক্রমণ শুরু করলেন। কারো হাত ভাঙ্গল, কারো বা পা। সকলের মাথা ফেটে রক্তগঙ্গা! কারো বা হাড় ভেঙ্গে গেল। সকলে পালাতে চেষ্টা করলেন। পশ্চিমে রবি পালালেন। অশ্বিনীকুমাররা উত্তরে পালালেন।
সকল দেবতা কেবল অমৃতের জোরেই বেঁচে গেলেন এবং বার বার এসে যুদ্ধ করতে লাগলেন। কামরূপী গরুড় শেষে জ্বলন্ত আগুনে পরিণত হলেন। প্রলঙ্কারীরূপে সকলকে জ্বালাতে লাগলেন। আর সহ্য করতে না পেরে দেবতারা হার মানলেন।


তখন গরুড় চন্দ্রলোকে এলেন। চন্দ্রের চারপাশে তিনি অগ্নিকে দেখলেন। শেষে এক উপায় বার করলেন। সোনার বর্ণ হয়ে ভিতরে প্রবেশ করে অগ্নি পার হলেন। গরুড় দেখলেন অতি সূক্ষ্ম এক রন্দ্র। তার মধ্যে দিয়ে কামরূপী প্রবেশ করে অমৃত নিয়ে আনন্দে তা পাখায় নিয়ে নিমেষে চলে গেলেন।

তার মহাকায়রূপে যেতে ইচ্ছে করল। তার এই রূপ দেখে বিষ্ণু রেগে গেলেন। তাদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হল। বিষ্ণু চার হাতে যুদ্ধ করলেন। গরুড় তার পাখনা ও নখের সাহায্যে যুদ্ধ করলেন। শেষে গরুড়ের বীরত্বে বিষ্ণু খুশি হলেন এবং বর দিতে চাইলেন।

গরুড় প্রার্থনা করলেন তিনি বিষ্ণুর থেকেও উচ্চস্থানে অধিষ্ঠান করতে চান। তিনি আরো বললেন, এই সংসারে তিনি অজর, অমর ও অপরাজিত হতে চান। বিষ্ণু তাকে সেইরূপ বরই দিলেন।

হৃষ্টচিত্তে গরুড়ও বিষ্ণুকে বর দিতে চাইলেন। এবার বিষ্ণু তাকে নিজের বাহনরূপে প্রার্থণা করলেন। গরুড় তাকে সেই বরই প্রদান করলেন।


এভাবে দু’জনে দু’জনকে বর দিলেন। গরুড় বিষ্ণুর বাহন হলেন এবং বিষ্ণুর বরে তাঁর উচ্চস্থানে অর্থাৎ বিষ্ণুর রথের উপর আসনগ্রহণ করেন।

এরপর তীব্রবেগে গরুড় ফিরে চললেন। ইন্দ্র তাকে দেখে রেগে বজ্র মারলেন।
হেসে গরুড় বলেন –বজ্র ব্যর্থ হলে ইন্দ্রকে লজ্জা পেতে হবে!
তাই তিনি নিজের দেহের একটি পালক ইন্দ্রকে উপহার দেন। তার আচরণে ইন্দ্র বিস্ময়াপন্ন হন এবং গরুড়ের সাথে বন্ধুত্ব করতে চান।

ইন্দ্র বলেন –গরুড়ের তেজ দেখে তিনলোক ভয় পায়।

গরুড় লাজুক হেসে জানালেন তিনি সাগর এবং পৃথিবীকে এক ডানায় এবং অন্য ডানায় ইন্দ্রের অমর–নগরী নিয়ে উড়ে যেতে পারেন।
এভাবে একশ বছর উড়লেও তার কোন কষ্ট হবে না।

ইন্দ্র বললেন –তা সত্যই বটে!
তিনি অনুরোধ করলেন গরুড় দয়া করে অমৃত ফিরিয়ে দিক।

গরুড় তখন ইন্দ্রকে তাঁর মার দাসীরূপের দুঃখের কাহিনী জানালেন।

ইন্দ্র তাকে বললেন সর্পদের অমর করে কোন লাভ নেই। তারা সংসারের ক্ষয় করে। গরুড়ের যে শত্রু, ইন্দ্রেরও সে শত্রু। শত্রুকে তিনি অমৃত দান করতে পারেন না।

কিন্তু গরুড়ও মায়ের কাছে অমৃত দানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ!

শেষে ঠিক হল গরুড় সর্পদের অমৃত দেবেন এবং মাকে মুক্ত করবেন। সুযোগ বুঝে ইন্দ্র অমৃতভান্ডার লুকিয়ে ফেলবেন। এ পরিকল্পনায় দুই বন্ধুই খুশি হলেন।

ইন্দ্র গরুড়কে বর দিতে চাইলে গরুড় সাপদের খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করতে চাইলেন। ইন্দ্র তাকে সেই বর দিলেন। এবং ছায়ারূপে গরুড়ের সাথে চলতে লাগলেন।
আসলে ইন্দ্র সম্পূর্ণরূপে গরুড়কে বিশ্বাস করলেন না যে সে অমৃত ফিরিয়ে দেবে।

যা হোক্‌! গরুড় নাগলোকে গিয়ে সর্পদের ডেকে অমৃত তাদের হাতে তুলে দিলেন এবং মাকে দাসীত্ব থেকে মুক্ত করলেন।



গরুড় সর্পদের বললেন –যাও তোমরা স্নান করে এসে শুচি হয়ে অমৃত পান কর। ঐ দেখ সুধা কুশের উপর রাখা আছে। এই বলে গরুড় মাকে নিয়ে চলে গেলেন।

সকল নাগ স্নানের উদ্দেশ্যে গেলে ইন্দ্র সুধাভান্ড নিয়ে পালালেন। স্নান করে এসে নাগেরা সুধা দেখতে না পেয়ে হাহাকার করতে লাগল। তারা জানতে পারল ইন্দ্র তা নিয়ে গেছেন। সবাই তখন দৌড়ে সেই কুশ চাটতে লাগল। এভাবে চাটতে চাটতে তাদের জিভ চিরে গেল। সেই থেকে সাপেদের জিভ চেরা। অন্যদিকে সুধার স্পর্শে কুশ চিরদিনের জন্য পবিত্র হয়ে গেল।

গরুড়ের বিক্রম আর বিনতার দাসীত্ব মোচন, নাগেদের নৈরাশ্য, ইন্দ্রের অমৃত হরণ - এসব রহস্যের কথা যে জন শ্রবণ করবেন তার আয়ু এবং যশ বৃদ্ধি হবে দিনে দিনে। পুত্রার্থীর পুত্র হবে, ধনার্থীর ধন – যার উপর প্রসন্ন হন বিনতা নন্দন।

..............................

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৮

সুধা আনিতে গরুড়ের স্বর্গে গমন:


গরুড় দাদাকে সূর্যের রথের সারথী করে মাকে মুক্ত করার জন্য স্বর্গে সুধা আনতে গেলেন।

এর পূর্বে ক্ষীরসিন্ধুর মাঝে দুঃখী মার সাথে দেখা করতে গেলে কদ্রু বিনতাকে রম্য-দ্বীপে কাঁধে করে নিয়ে যেতে বলেন।
বিনতা নিলেন কদ্রুকে, গরুড় নিলেন শতপুত্রকে। গরুড় সূর্যলোক দিয়ে গেলে বহু নাগ মারা যায়। কদ্রু ইন্দ্রের স্মরণে গেলেন। ইন্দ্র সকল জলধরকে মেঘে আকাশ ঢেকে দিতে বললেন। প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হলে নাগেরা সূর্যের তেজ থেকে বাঁচল। অপূ্র্ব সুন্দর রম্য দ্বীপে শেষ পর্যন্ত নাগেরা পৌছাল। নাগেরা গরুড়কে আবার পিঠে করে আর এক দ্বীপে নিয়ে যেতে বলল।
গরুড় মার কাছে গিয়ে সে কথা জানাল।
বিনতা বললেন –তুমি দাসীপুত্র, তাই তাদের আজ্ঞা শুনতে হবে।

বিনতার দাসী হওয়ার কারণ শুনে গরুড়ের ক্রোধ হল। কদ্রুর কাছে সে জানতে চাইল কি ভাবে তার মাকে দাসীবৃত্তি থেকে মুক্ত করা যাবে। কদ্রু স্বর্গের অমৃত নিয়ে আসতে বললেন।

সুধা আনার আগে গরুড়ের খিদে পেল। মা তাকে সমুদ্রে গিয়ে নিশাচরদের খেতে আজ্ঞা দিলেন। এও বললেন সেখানে এক ব্রাহ্মণ আছেন, তাকে যেন না খায়। কারণ অগ্নি, সূর্য, বিষ-এর প্রতিকার আছে। কিন্তু ব্রাহ্মণের ক্রোধের থেকে নিস্তার নেই।
গরুড় জিজ্ঞাসা করলেন কি ভাবে ব্রাহ্মণকে চিনবেন!
বিনতা বললেন যাকে খেতে কষ্ট হবে সেই বুঝবে ব্রাহ্মণ।

বিনতার আশীর্বাদ নিয়ে গরুড় সুধা আনতে চললেন। চারপাশ কেঁপে উঠল। খিদের জ্বালায় গরুড় এক নিশ্বাসে সব মুখে পুড়লেন। কিন্তু পেটে জ্বালা শুরু হলে মার কথা মনে পড়ল এবং ব্রাহ্মণকে উদর থেকে বের হয়ে আসতে অনুরোধ করলেন। ব্রাহ্মণ তার ব্রাহ্মনীকে নিয়ে বের হলে গরুড় আবার স্বর্গের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

পথে পিতা কশ্যপের সাথে দেখা হলে তিনি পিতাকে খাদ্যের সন্ধান দিতে বললেন। কশ্যপ বললেন দেব-নরের বিখ্যাত এক সরোবর আছে সেখানে হাতি ও কচ্ছপের যুদ্ধ হচ্ছে, তার বৃত্তান্ত আগে শুন।
.............................................

গজ-কুর্ম্মের বিবরণ:

বিভাবসু ও সুপ্রতীক দুই ভাই। এরা মুনিপুত্র এবং মহাধনী। শত্রুরা হিংসা করে তাদের মধ্যে কলহ লাগাল। সম্পত্তির জন্য তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল।

সুপ্রতীক, ছোটভাই, সে সম্পত্তির সমান ভাগ দাবি করতে লাগল। এভাবে বারবার বিভাবসুকে সম্পত্তি নিয়ে বিরক্ত করলে বিভাবসু রাগ করে ভাইকে শাপ দিল, হস্তী হয়ে সুপ্রতীক বনে বনে ঘুরে বেড়াবে। সুপ্রতীকও দাদাকে শাপ দিল, সে কচ্ছপ হয়ে জলে বাস করবে।

শত্রুর কথায় দু’ভাই বিবাদ করে সংসার নষ্ট করল।
শেষ পর্যন্ত একজন বনে আর একজন জলে গিয়ে বাস করতে লাগল। কখনও সামনাসামনি হলেই তারা যুদ্ধে মেতে উঠত।

কশ্যপ গরুড়কে বললেন তাদের গিয়ে ভক্ষণ করতে। এতে পৃথিবীর মঙ্গল হবে। পিতার আজ্ঞা পেয়ে খগরায় সেই স্থানের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
আকাশপথে দেখলেন গজ ও কুর্ম্মের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তিনি দুজনকে নখে ধরে উড়ে গেলেন এবং কোথায় বসে খাবেন তা ভাবতে লাগলেন।

এ সময় শত যোজন বিস্তৃত রৌহীণবৃক্ষ তাকে আমন্ত্রণ জানালেন তার ডালে বসার জন্য। ডালে বসলে ভারে ডাল ভেঙে গেল।



সেই ডালে বালখিল্য মুনিরা অধোমুখে জপ করছিলেন। তা দেখে গরুড় ভয় পেলেন। ডাল মাটিতে পড়লে মুনিদের মৃত্যু হবে, এই ভয়ে সে ঠোঁটে ডাল ও দুই নখে গজ ও কুর্ম নিয়ে উড়তে থাকলেন।

এভাবে বহুদিন গরুড় উড়তে লাগলেন। পিতা কশ্যপ গন্ধমাদন পর্বত থেকে গরুড়ের দুর্দশা দেখে মুনিদের স্তব শুরু করলেন। ছয় সহস্র মুনি সন্তুষ্ট হয়ে হিমগিরি পর্বতের দিকে গমন করলেন।

খগেশ্বর পিতার আজ্ঞায় সেই ডাল জীবজন্তুহীন পর্বতে ফেলে সেখানেই গজ-কুর্ম ভক্ষণ করলেন।

এরপর সুধা আনতে স্বর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
তার পাখার ঝাপ্‌টায় পর্বত উড়ল, সূর্য অন্ধকারে ঢেকে গেল, মেঘ-বৃষ্টি শুরু হল।

এসব দেখে ইন্দ্র বৃহস্পতিকে এই অশান্তির কারণ জানতে চাইলেন।

বৃহস্পতি বললেন –তোমার পূর্বের পাপের জন্য গরুড় এখানে আসছেন। সে সুধা স্বর্গ থেকে অবশ্যই নিয়ে যাবে। এত শুনে ইন্দ্র রেগে গেলেন। তিনি সকল দেবতাদের যুদ্ধে প্রস্তুত হতে বললেন।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers