Blog Archive

Saturday, June 17, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৭

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করেন.....ভীষ্মের পরামর্শে যুধিষ্ঠির সকলের শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের পূজা করতে গেলে চেদিরাজ শিশুপাল তীব্র প্রতিবাদ করে কৃষ্ণ নিন্দা করতে লাগল .....ভীষ্ম শিশুপালের জন্মকথা সবাইকে বলেন... কৃষ্ণ শিশুপালের মাকে তার একশত অন্যায় ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দেন . ....... শিশুপাল কৃষ্ণকে অপমান শুরু করলে কৃষ্ণ সুদর্শন চক্রে তার প্রাণ হরণ করেন .... সকল রাজারা নিজ দেশে ফিরলেও দুর্যোধন থেকে যায় ও পাণ্ডবদের হিংসা করতে থাকে ......] 



পাশা খেলিবার মন্ত্রণাঃ

রাজা জন্মেজয় বলেন – কহ মুনিবর শুনি কি ভাবে পাশাখেলা অনর্থ আনল। পিতামহ পিতামহী যে কারণে এত দুঃখ পেলেন সেই খেলা কে কে নিবৃত্ত করতে চাইল, আর কেই বা প্রবর্ত্তিল(রত/নিযুক্ত)। যে পাশাখেলা থেকে বিখ্যাত ভারত-সমর(যুদ্ধ) হল সেই ক্রীড়াসভায় কে কে উপস্থিত ছিল। 

মুনি বলেন – শুনুন পরীক্ষিত পুত্র ক্ষত্তার(বিদুর) বাক্য শুনে অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র চিন্তিত হলেন। তিনিও মনে মনে দৃঢ় ভাবে জানলেন কাজটি সঠিক হচ্ছে না। 
চিন্তিত রাজা পুত্র দুর্যোধনকে একান্তে ডেকে বলেন – হে পুত্র তুমি এ পাশা খেল না। বিদুর এ খেলা সুনজরে দেখছে না। সুবুদ্ধি বিদুর কখনো আমার অহিত চায় না যেন। তার বাক্য না শুনলে পরে কষ্ট পেতে হবে। দেবতাদের রাজহিতে দেব পুরোহিত যেমন বৃহস্পতি, তেমনি ক্ষত্তা আমার হিতাকাঙ্ক্ষী নিশ্চিত ভাবে যেন। ক্ষত্তা বিদুরের মন্ত্রণা গুরুর অধিক মেন। বিচক্ষণ ক্ষত্তা কুরুবংশের শুভাকাঙ্ক্ষী। সুরকুলে(দেবকুলে) বৃহস্পতির যে স্থান, বৃষ্ণিকুলে(যদুবংশে) সুবুদ্ধি জ্ঞানদাতা উদ্ধবের যে স্থান, কুরুকুলে ক্ষত্তা বিদুরেরও সে স্থান। তার মতে পাশাখেলা অনর্থ ঘটাবে। এই দ্যূতক্রীড়ার মাধ্যমে ভেদাভেদ শুরু হবে। 
হে পুত্র, ভাতৃভেদ সর্বনাশ আনবে-বিদুরের এ বাক্য শুনে আমার মনে আশঙ্কা হচ্ছে। পুত্র, পিতামাতাকে যদি মান্য কর তবে আমার কথা শোন, এ পাশা খেলা বর্জন কর। 
পুত্র তুমিও পণ্ডিত, কি কারণে তবে পান্ডুর পুত্রদের হিংসা করছ! কুরুকুলে যুধিষ্ঠির জ্যেষ্ঠ এবং সকল দিকদিয়ে শ্রেষ্ঠ। এই হস্তিনানগর কুরুকুলের রাজধানী। যুধিষ্ঠির এখানে থাকতে তুমি তাকে যা দিলে যেটুকু দিলে তাই নিয়ে তারা পাঁচ ভাই সন্তুষ্ট হয়ে গেল। এখন তো পুত্র তোমার বৈভব ইন্দ্রের সমান। নরযোনিতে জন্মে কার এত সম্পদ সম্ভব! তাও কিসের জন্য তোমার এত অনুশোচনা, কিসের জন্য উদ্বিঘ্ন! 

দুর্যোধন বলে –পিতা আমি সমর্থ পুরুষ। শত্রুকে দেখিয়ে অহঙ্কার যদি না করি তবে কাপুরুষ গণ্য হব। বিশেষ করে আমার বন্ধুদের আপনি চেনেন। আমার যে সম্পদের কথা আপনি বললেন এমন বহুজনের আছে। কিন্তু আজ কুন্তীপুত্রদের লক্ষ্মী যেন দীপ্ত হুতাশন(আগুন)। তা দেখেও আমি যে এখনও প্রাণে বেঁচে আছি এতেই আমি ধন্য। 
হে পিতা, পৃথিবী জুড়ে আজ পাণ্ডবদের যশ কীর্তন হচ্ছে। সকল রাজা আজ তাদের বশে। যদু, ভোজ, অন্ধক, কুক্কুর, অঙ্গ, কারস্কর, বৃষ্ণি-এই সাতটি বিখ্যাত বংশ তাদের মিত্র সঙ্গ। যুধিষ্ঠিরের কথামত কৃষ্ণ সদা খেটে চলেছেন। সমস্ত ভূপতি রাজারা করপুটে তাকে কর দিচ্ছে। আর পান্ডবরাও ইচ্ছে করে সব ধন সম্পদ আমার কাছে রাখতে দিল। পিতা যে সব রত্নের নামও কখনো শুনিনি, সে সবও দেখে এলাম যুধিষ্ঠিরের পুরীতে। নানাবর্ণের নানা রত্নের সে সব সম্পদ কোনটা গিরিপর্বতে, কোনটা বা সিন্ধু মধ্যে উৎপন্ন। তাদের সবার কথা বলে শেষ করা যায় না। ধরার মধ্যে, বৃক্ষের মধ্যে, জীবের অঙ্গেতে যত রত্ন আছে আজ সব তা যুধিষ্ঠিরের ভান্ডারে জমা হচ্ছে। লোমজ(লোমজাতীয়), পট্টজ(রেশমাদি), চীর(গাছের ছাল) বিবিধ বসন, গজদন্ত বিরচিত দিব্য সিংহাসন; হস্তী, অশ্ব, উট, গাধা, মেষ আর অজা(ছাগল) নানাবর্ণের এনে দিল নানা দেশীয় রাজা। 
শ্যামলা তরুণী, দিব্যরূপা দীর্ঘকেশী সহস্র দাসী নানাবর্ণে ভূষিতা হয়ে ঘুরছে, দেখতে দেখতে আমার মনে ভ্রম হল। সেই সুযোগে পাণ্ডবরা আমার অপমান করল। 
মায়া সভার মধ্যে আমি কিছু দেখতে পাইনি, সবই স্ফটিকের বেদী মনে হয়েছে। জল ভেবে বসন গোটাতে দেখে সভার সকলে হেসে উঠল। সেখান থেকে কিছু দুরেই ছিল জলাশয়, তাকে স্ফটিক ভাবায় সবস্ত্র মহাশব্দে সেখানে পড়লাম। চারদিকে লোক হাসতে লাগল। তাদের সাথে ভীম, ধনঞ্জয় অর্জুন, অন্যদিকে দ্রৌপদীও পুরনারীদের নিয়ে হাসছিল। এভাবে সবাই আমায় উপহাস করল। শেষে যুধিষ্ঠির কিঙ্করদের(কাজের লোক) দিয়ে বাপী(দীঘি) থেকে তুলে অন্য বস্ত্র পরাল। 
হে পিতা এত অপমান কে সহ্য করে! আরও কত শুনতে চান, আপনি! এরা ইচ্ছে করে স্থানে স্থানে স্ফটিকের প্রাচীর নির্মাণ করেছে। দ্বার ভেবে বেরতে গিয়ে এত জোর মাথায় আঘাত লাগল যে মাটিতে উল্টে পরে গেলাম। মাদ্রীর দুই পুত্র দ্রুত এসে আমায় তুলে খুব দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। আমার হাত ধরে দুয়ার দেখিয়ে দিল। এসব অপমান পিতা আর সহ্য হয় না। আমি এই হীন পাণ্ডবদের এত অপমান আর সহ্য করব না। হয় তাদের লক্ষ্মী কেড়ে নেব নয় প্রাণ দেব। 

ধৃতরাষ্ট্র বলেন – পুত্র হিংসা বড় পাপ। হিংসক জনের পুত্র জন্মে বড় কষ্ট নিয়ে। অহিংসক পান্ডবদের হিংসা কর না। একটু শান্ত হয়ে ধৈয্য ধরে থাক দেখবে প্রশংসা পাবে। তাদের মত যদি যজ্ঞ করতে চাও বল। আমি এখনই সকল রাজাদের নিমন্ত্রণ পত্র পাঠাচ্ছি। আমাকে সকল নৃপ সম্মান করেন। তারা আরও অধিক রত্ন আমাদের পাঠাবেন। আমার এ কথা শোন। 
হে পুত্র, অসৎ মার্গে গেলে তোমার সাথে পুর সংসার রসাতলে যাবে। স্বধর্মে থেকে যে সদা মনকে সন্তুষ্ট রাখে সেই পরের দ্রব্য দেখে হিংসা পরিত্যাগ করতে পারে। পরোপকারীরা স্বকর্মে সব সময় উদ্যোগী থাকে তাই দুঃখ তাদের স্পর্শ করে না, সদা সুখে থাকে। আর পান্ডু পুত্রদের পর ভাবছ কেন, তারা তোমার আপন। তাদের কখন হিংসা দ্বেষ কর না। 

দুর্যোধন বলে –পিতা আমি প্রজ্ঞাবান(তত্ত্বজ্ঞানী) নই। আমি অত শাস্ত্রের কথা বুঝি না। চাটু কি যানে পিষ্টকের(পিঠে) স্বাদ। আমি যানি শুধু শত্রুকে কখনো বিশ্বাস করা যায় না। যেমন নমুচি দানবের সহস্রলোচন ইন্দ্রকে করা উচিত হয় নি। এক পিতার থেকেই তাদের উৎপত্তি। বহুকাল তারা একসাথে খুশি ছিল। তবু ইন্দ্র তাকে সংহার করে। এভাবে নিষ্কণ্টক হয়ে অদিতিকুমার সব একাই ভোগ করতে থাকে। এভাবে সামান্য শত্রুকেও নাশ করতে হবে। মূলস্থ বল্মীক(উই) যেমন পুর তরুকে গ্রাস করে। জ্ঞাতি মধ্যে যে জন ধনে জনে বলবান ক্ষত্র মধ্যে তাকেই প্রধান শত্রু মানি। আপনি সব যেনেও আমাকে বঞ্চিত করতে চান। বুঝেছি পিতা আপনি আমার নিধন চান। 

পুত্রস্নেহে অন্ধ রাজা অনেক বোঝাতে চেয়েও পারলেন না। শেষে বিদুরকে ডেকে বলেন – তুমি দ্রুত গিয়ে যুধিষ্ঠিরদের নিয়ে এস। 

বিদুর বলেন –রাজা এটা ঠিক হচ্ছে না। কুলের নাশ হবে ভেবে আমি শঙ্কিত হচ্ছি। 

অন্ধ রাজা বলেন –হে বিদুর, আমার আর কিছু করার নেই। এ সংসার যেন দৈবের বশ, আমিও তার অধিন। 

বিদুর রাজাজ্ঞা অবহেলা করতে পারলেন না। রথে চড়ে ইন্দ্রপ্রস্থের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলেন। বিদুরের আগমনে পাণ্ডবরা খুশি হলেন। যথা নিয়মে তাকে আহ্বান জানান হল। 

যুধিষ্ঠির বলেন – হে তাত, কি সমাচার আছে বলুন। আপনাকে অন্যমনস্ক ও চিন্তিত লাগছে কেন! 

বিদুর বলেন –রাজা ধৃতরাষ্ট্র আপনাদের হস্তিনাপুরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি যা বলি মন দিয়ে শুনুন। সেখানে আপনাদের সভার সমান সভা নির্মাণ হচ্ছে। সে সভা দেখার জন্য এ আমন্ত্রণ। সেখানে দ্যূত আদি ক্রীড়ারও আয়োজন হচ্ছে। সে সব কারণেই আমাকে পাঠান হয়েছে। 

যুধিষ্ঠির বলেন –দ্যূত ক্রীড়া সব অনর্থের মুল। জ্ঞানভ্রষ্টরা এই খেলায় মাতে। তবু আমি এ আমন্ত্রণ শিরধার্য করছি। আমায় কি করতে হবে আজ্ঞা দিন, তাত! 

বিদুর বলেন – রাজা আপনি ঠিক বলেছেন পাশা অনর্থের মূল। এই খেলা কুল ভ্রষ্ট করে। অন্ধ রাজাকে অনেক বলেও বোঝানো গেল না। তবু তিনি আমায় পাঠালেন। হে রাজন, আপনি যথেষ্ঠ বুদ্ধিমান, ভেবে চিন্তে যা শ্রেয় মনে করেন করুন। আপনার ইচ্ছে না হলে সেখানে গিয়ে কাজ নেই। 

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলেন – হে কুরুপতি আজ্ঞা দিন। গুরু আজ্ঞা ভঙ্গ করলে নরকে যেতে হবে। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম আপনি যানেন তাত। দ্যূতে বা যুদ্ধে কেউ আহ্বান যানালে পিছনর স্থান নেই। আমিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কেউ যুদ্ধে বা দ্যূতে আহ্বান জানালে তাকে ফিরাব না। 
এই বলে যুধিষ্ঠির ভাইদের নিয়ে দ্রৌপদীকে সব জানাতে গেলেন। 

দৈব যেমন মানুষকে বেধে ঘোরায় তেমনি ক্ষত্রা দ্রৌপদী সহ পাঁচভাই হস্তিনাপুরে পৌছালেন। সভায় ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, সোমদত্ত সহ অন্তপুরের গান্ধারী ও সকলকে তারা একে একে সম্ভাষণ করেন। 
সে রাতে পঞ্চপাণ্ডব সুখে হস্তিনাপুরে কাটালেন।
......................................

Sunday, June 4, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৬

[পূর্বকথা যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... যথাকালে যুধিষ্ঠির যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করলেন.....ভীষ্মের পরামর্শে যুধিষ্ঠির সকলের শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের পূজা করতে গেলে চেদিরাজ শিশুপাল তীব্র প্রতিবাদ করে কৃষ্ণ নিন্দা করতে লাগল .....ভীষ্ম শিশুপালের কৃষ্ণ নিন্দার বিরোধ করলেন .....শিশুপাল ভীষ্মকেও অপমান করতে থাকে.. ... ভীষ্ম শিশুপালের জন্মকথা সবাইকে বলেন... কৃষ্ণ শিশুপালের মাকে তার একশত অন্যায় ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দেন . ....... শিশুপাল কৃষ্ণকে অপমান শুরু করলে কৃষ্ণ সুদর্শন চক্রে তার প্রাণ হরণ করেন ..........] 


দুর্যোধন

যজ্ঞান্তে দুর্যোধনের গৃহে গমনঃ 

রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হলে সকল রাজারা নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন। 

দেব নারায়ণ কৃষ্ণ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে বলেন –রাজা, আজ্ঞা দিন এবার দ্বারকায় ফিরি। আমি সৌভাগ্যবান যে আপনার যজ্ঞ সুসম্পন্ন হল তা চাক্ষুস করতে পারলাম। এবার অপ্রমাদে(ভয়শূণ্য হয়ে) রাজ্য শাসন করুন, প্রজা পালন করুন, সুহৃদ কুটুম্বদের আদর যত্ন করুন। 
এত বলে দেব নারায়ণ ধর্মরাজের সাথে কুন্তীর কাছে উপস্থিত হলেন। 

কুন্তীকে প্রণাম করে কৃষ্ণ বলেন –আপনার পুত্রদের সাম্রাজ্য লাভ সুসম্পন্ন হয়েছে, আজ্ঞা করুন এবার দ্বারকায় যাই। 

কুন্তী বলেন –যাদের উপর অচ্যুত(যিনি নিজের পদ থেকে চ্যুত হন না) কৃষ্ণের কিঞ্চিৎ দয়া আছে তাদের কাছে এ আর এমন কি! 
এই বলে তিনি কৃষ্ণের শির চুম্বন করলেন। হরি কুন্তীর চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করেন। 

এরপর দ্রৌপদী ও সুভদ্রাকে সম্ভাষণ করে একে একে পাঁচ ভাইকে বিদায় আলিঙ্গন জানিয়ে শুভক্ষণে রথে চড়ে দ্বারাবতীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। 
কৃষ্ণের বিচ্ছেদে যুধিষ্ঠির বড়ই ব্যাথিত হলেন। 

ধিরে ধিরে সকলে সে যার দেশে চলে গেল। তবে ইন্দ্রপ্রস্থে রয়ে গেল মামা-ভাগ্নে শকুনি-দুর্যোধন। তাদের বড় সাধ ভাল ভাবে ঘুরে ঘুরে ধর্মরাজের সভা দেখার। দুর্যোধন শকুনির সাথে নিত্য সভার মনোহর দিব্য অনুপম আলোক অবলোকন করে। নানা রত্নে খচিত এযেন দেবতার পুরী। দেখতে দেখতে কুরুরাজ দুর্যোধন বিস্ময়াপন্ন হয়। সকল গৃহ অমূল্য রত্নে মণ্ডিত। এদের এক গৃহের তুল্যও নয় সমগ্র হস্তিনাভুবন। এসব ভেবে ভেবে অন্তরে অন্তরে সে দগ্ধ হতে থাকে। 
এর মধ্যে দৈবের লিখন এক অঘটন ঘটল। মাতুল শকুনির সাথে দুর্যোধন ঘুরছিল। সামনে এক স্ফটিকের বেদী দেখে তাকে সরোবর ভেবে সে জলে নামবে ভেবে পায়ের বসন গুটিয়ে বেদীর কাছে গিয়ে লজ্জিত হয়। দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে এলেও লজ্জা মলিন মুখ থরথর কাঁপতে থাকে। 
এবার স্ফটিকের বাপী(দীঘি) চিনতে না পেরে সবসনে ভুল করে বাপীতে পড়ে। তা দেখে সভার সকলে হাসতে লাগল। তাদের সাথে ভীমসেন, পার্থ, দুই মাদ্রীপুত্রও যোগ দিলেন। 
ধর্মরাজ সঙ্গে সঙ্গে ভাইদের দুর্যোধনকে তোলার নির্দেশ দিলেন। পান্ডুপুত্রেরা দুর্যোধনের সোদক(ভেজা)বস্ত্র ছাড়িয়ে নতুন বস্ত্র পরালেন। ধর্মরাজ যত লোকজন হাসছিল তাদের সকলকে নিবৃত করতে লাগলেন। 

এসব ঘটনায় দুর্যোধন অপমানে অভিমানে লজ্জায় কাঁপতে কাঁপতে সেখান থেকে চলে গেল। ক্রোধান্ধ গান্ধারীকুমার ভুল করে আবার দুয়ার খুঁজে পায় না। সকল স্থানের পাঁচিল স্ফটিকের ভেবে দুর্যোধন দিকে দিকে ফিরতে থাকে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে দেওয়ালে মাথা ঠুকে আবার আছাড় খেল। তা দেখে আবার সকলে হাসতে লাগল।
তা দেখে ধর্মরাজ দ্রুত নকুলকে পাঠান দ্বার দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। নকুল হাত ধরে তুললে অপমানে দুর্যোধনের শরীর কাঁপতে লাগল। কিছুমাত্র সময় নষ্ট না করে সে তখনই যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা নিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে চলল। 

বিমনা দুর্যোধন হেঁট মাথায়, ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে মামা শকুনির সাথে বাড়ি চলল। 

শকুনি অনেক কথা বলে চলল কিন্তু কোন উত্তর না পেয়ে অবাক হয়ে সে ভাগ্নেকে বলে –ভাগ্নে তোমার এমন মলিন বদন কেন, কেনই বা এত সঘন নিশ্বাস ফেলছ! এত চিন্তাই বা কিসের! 

দুর্যোধন বলে –মামা, অপমানে আমার হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে। সমগ্র পৃথিবী আজ পাণ্ডবদের বশে। নিজের চোখে দেখে এলাম একলক্ষ নরপতি তাদের জন্য খাটছে। কুন্তীর পুত্রেরা আজ ইন্দ্রের বৈভব জয় করেছে। কুবের ভান্ডার জিতে নিজেদের ভান্ডার পূর্ণ করেছে। এসব দেখে শুনে আমার দেহ মন গ্রীষ্মের সরোবরের মন শুকিয়ে যাচ্ছে। কুন্তীপুত্রদের কর্মকাণ্ড দেখে আশ্চর্য হতে হয়। নারায়ণ শিশুপালকে বধ করলেন। কোন রাজা একটাও কথা বলল না! অথচ এরাই যুদ্ধ করতে এক হয়েছিল। শিশুপাল মরতেই সকলে লুকিয়ে পড়ল! পাণ্ডবদের তেজে আজ রাজারা ছত্রভঙ্গ। কোন ক্ষত্রিয় এসব সহ্য করবে! তুমিও মামা এদের সব কর্মকাণ্ড দেখে এলে। কত শত শত রত্ন নিয়ে রাজারা দ্বারে দাড়িয়ে, বৈশ্যরাও কর দানের জন্য দণ্ডায়মান। দ্বারে প্রবেশ না করতে পারলেও তারা সব দ্বারে রেখে আসছে। এসব দেখে আমার আর সহ্য হচ্ছে না। অভিমানে আমি শীর্ণ হচ্ছি। ভাই ভেবে এদের মোটেও ক্ষমা করতে পারছি না। এদের দেখলেই আমার অঙ্গ জ্বলে, মামা! চিন্তায় চিন্তায় আমি পাগল হচ্ছি। জলে ডুবি, নাকি আগুনে ঝাঁপাই অথবা বিষ খেয়ে মরে এ জ্বালা মেটাই! আর সহ্য হয় না! বৈরী/শত্রুর সম্পদ হীনলোক যদি দেখে তবে তা সে সহ্য করতে পারে না, নিত্য শোকে পোড়ে। আমিও এমন মানুষ হয়ে শত্রুর বাড়বাড়ন্ত চোখে দেখি কি করে! আজ যুধিষ্ঠিরের বল আমার অধিক, আমি হীনবল। সাগরান্ত ধরা আজ তার অধিন। হে মামা! কি আর বলি, সবই দৈববশ। কি বলি এদের রূপ গুণ, সৌভাগ্য, সাহস। পান্ডুর এই পাঁচ পুত্র বনে জন্মেছিল। যখন হস্তিনাপুরে প্রথম এসে দাঁড়াল-দেখে মনে হল বনবাসী জংলী। পিতৃহীনের দুঃখ এই আমার গৃহে এসেই ঘুচেছিল। কতবার যে কতভাবে এদের মারার চেষ্টা করেছি, কিন্তু হায় আমার দুর্ভাগ্য। পদ্মবনের মত এদের দিনে দিনে শ্রীবৃদ্ধিই হয়ে চলেছে। মামা, দৈবের কারণেই আজ আমরা রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা হীনবল হয়েছি। পৃথার(কুন্তী) পুত্রেরা আজ আমায় দেখে হাসে-এ আমি কি করে সহ্য করি! আমার এসকল কথা তুমি পিতাকে জানিও। আমি আর গৃহে ফিরছি না, আজই পাবকে(আগুনে) প্রবেশ করব। 

দুর্যোধনের এত কথা শুনে শকুনি বলে – হে ভাগ্নে, তোমার ক্রোধ নিবারণ কর। মনে মনেও কখনো যুধিষ্ঠিরকে হিংসা করো না। ধর্মপুত্র সর্বদা তোমার প্রীতি কামনা করেছেন। তোমরা বিচার বিবেচনা করে তাকে যা ভাগ করে দিলে তিনি তাতেই সন্তুষ্ট হয়েছেন। তুমি তো তাদের মারতে কত চেষ্টা করলে। দেখ জতুগৃহ থেকে মুক্ত হয়ে তারা পাঞ্চালে গিয়ে লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে পেলেন। এভাবে দ্রুপদ ও বীর ধৃষ্টদ্যুম্ন তাদের সহায় হল। এভাবে আজ যুধিষ্ঠির রাজ চক্রবর্তী হলেন। সসাগর পৃথিবী আজ তার ছত্রতলে। তারা সব কিছুই পেয়েছে নিজেদের শক্তিতে। 
এতে তুমি কেন দুঃখ পাচ্ছ! তোমার অংশ থেকে তো তারা কিছু নেয়নি। অক্ষয় যুগল তূণ, গান্ডীব ধনুক এসবই তারা পাবক অগ্নিকে তৃপ্ত করে পেয়েছেন। আবার অগ্নির হাত থেকে ময়দানবকে রক্ষা করায় সে এই দিব্য সভা নির্মাণ করে দেয়। নিজেদের পরাক্রমে ক্রতু(যজ্ঞ)রাজ রাজসূয় যজ্ঞ করেছেন। সেই যজ্ঞের তাপ তুমি কেন হৃদয়ে ধারণ করছ! তুমিও এসব নিজের ক্ষমতায় আয়ত্ত কর! 
আমায় বল তুমি কি এসব কর্মে নিজেকে অসমর্থ ভাব! তুমি বলছ তোমার অনুগত, তোমার সহায় কেউ নেই! তবে শোন তোমার সাথে কারা কারা আছে। একশত ভাই তোমার প্রচন্ড মহারথী। এই একশত ভাগ্নের প্রতাপের কথা আমি আর কি বলি! এছাড়া ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্যের মত মহাবীরেরা আছেন। ভূরিশ্রবা, সোমদত্ত-এরাও প্রতাপে মিহির(সূর্য)। জয়দ্রথ, বাহ্লীক, আমরা থাকতে তোমায় বধ করবে পৃথিবীতে কার এত সাহস। তুমিও এবার পৃথিবী শাসন করতে রত্ন সঞ্চয় কর। কোন কাজে নিজেকে হীন ভেব না। 

দুর্যোধন বলে –আগে আমি পাণ্ডবদের জয় করব। এদের জিতলেই সব আমার বশ হবে। 

শকুনি বলে –বাঃ! ভালই বিচার করলে। কিন্তু যুদ্ধ করে কে আর পাণ্ডবদের হারাবে! তাদের সাথে পুত্রসহ দ্রুপদরাজ আছেন, স্বয়ং নারায়ণ তাদের সহায়। ইন্দ্রও আজ পাণ্ডুদের জয় করতে পারবেন না। 
তবে আমার কাছে আর এক বিদ্যা আছে, তার সাহায্যে পাণ্ডবদের জিততে পার। চাও তো সে বিদ্যা তোমায় দিতে পারি। 

দুর্যোধন বলে –হে মামা, যদি তেমন বিদ্যা তোমার জানা থাকে শীঘ্র সে সম্পর্কে বল। বিনা অস্ত্র প্রয়োগ করে কি করে পাণ্ডবদের জয় করতে পারি বল, শুনে আনন্দ লাভ করি। 

শকুনি বলে –শুন দুর্যোধন, পাশা খেলায় ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির নিপুণ নয় তবু তার পাশা খেলার বড় সখ। তুমি যান সংসারে কেউ আমার সাথে পাশা খেলায় জিততে পারে না। ক্ষত্রনীতিতে বলা আছে যুদ্ধে বা দ্যূতে(পাশা খেলায়) কেউ আহ্বান জানালে বিমুখ হতে নেই। যুধিষ্ঠিরকে খেলতে ডাকলে সেও বিমুখ হবে না, ফলে তোমার জয় নিশ্চিত। এখন আমার আগে দ্রুত গিয়ে পিতাকে সব বলে সম্মতি আদায় কর। আমি তাকে এসব বলতে পারব না। 

মামা ভাগ্নে এসব পরামর্শ করতে করতে হস্তিনগরে প্রবেশ করল। ধৃতরাষ্ট্রকে প্রণাম জানালে তিনি আশীর্বাদ করে সকলের কুশল সংবাদ নিতে লাগলেন। কিন্তু দুর্যোধন কোন কথা বলল না। 

সুবলনন্দন শকুনি সব উত্তর দিল –হে রাজন আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র সর্বগুণবান, তার কথাই বলি অবধান করুন। দিন দিন সে ক্ষীণ হয়ে পরছে। দেহ তার জীর্ণ শীর্ণ। পিঙ্গ(অগ্নির মত) শরীর দেখে আজ মনে হয় তা যেন রক্তহীন হয়েছে। বুঝতে পারছিনা তার কিসের এত মনস্তাপ। সঘন নিশ্বাস ফেলে চলেছে, যেন সে দন্ডহত সাপ। 

সব শুনে আকুল হয়ে ধৃতরাষ্ট্র বলেন – পুত্র দুর্যোধন বল কিসের কারণে তোমার অঙ্গ হীনবল হল। শকুনি কি বলল, তুমি শুনলে। তোমার কিসের দুঃখ আমায় বল, আমি যে তোমার কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। কে তোমার শত্রু, কার এত বল! কোন সুখের অভাবে তুমি আজ দুর্বল! ধন-জন-সম্পদে কে আজ তোমার সমান পুত্র! কেইবা তোমার চেয়ে বীর আছে এ বসুধায়! সুন্দর বস্ত্র, সুস্বাদু খাদ্য, সুন্দরী নারী, মনোহর গৃহ সবই তোমায় রত্নে মণ্ডিত করে দিয়েছি। তোমার অসাধ্য তো কিছুই রাখিনি। তবু তুমি পুত্র কেন অনুশোচনা করছ! 

এত শুনে দুর্যোধন বলে –এসব বৈভব যে কুপুরুষজনের সমান তা আমি প্রমাণ করতে পারি। আমার মনস্তাপের কারণ শুনুন পিতা। আমার কঠিন প্রাণ তাই এখনও মরি নি। পিতা শত্রুর সম্পদ এ নয়নে দেখে আমার শরীর পুষ্ট হচ্ছে না, ভোজনেও তৃপ্তি পাচ্ছি না। পাণ্ডবদের সম্পদ-লক্ষ্মী দিন দিন দীপ্ত দিনকরের মত বেড়ে চলেছে, সেই তাপদাহে আমার কলেবর/দেহ দগ্ধ হচ্ছে। পাণ্ডবদের যা সম্পদ দেখে এলাম তার তুল্য কখনো দেখিনি বা শুনিনি। তাদের সে সম্পদ কাহিনী আমি এখন বলতে পারব না। অষ্টাশী সহস্র দ্বিজ নিত্য তাদের গৃহে ভুঞ্জে(ভোজন করে)। সুবর্ণ পাত্রে সে ভোজন দেখে মন মোহিত হয়। পৃথিবীর রাজারা এমন কি বৈশ্যরাও নানা রত্ন নিয়ে পাণ্ডবদের দ্বারে দাড়িয়ে থাকে। শত শত রাজারা এই যজ্ঞে এসেছে। নাজানি কত শত দ্বিজকে ভোজন করিয়েছে। শুনেছি এক লক্ষ দ্বিজ ব্রাহ্মণের ভোজন হলে একবার শঙ্খ বাজে। আমি তো এক লক্ষবার শঙ্খ শুনেছি। মুহুর্মুহু সেই শঙ্খধ্বনি গুণে শেষ হয়না। সেই শঙ্খধ্বনি শুনে আমি চমকে চমকে উঠেছি। ধনসম্পদের বর্ণনা আর কি দেব, পিতা! সব দেখে বিস্মিত হতে হয়। আমি আর বলতে পারছি না পিতা। এর উপায় বার করুন আপনি। পাণ্ডবদের জয় না করে আমার মনে শান্তি নেই। বিনা যুদ্ধে তাদের হারাতে চাই। আপনি আজ্ঞা করুন। পাশাক্রীড়ায় মামা শকুনি পটু, সেই পাশা খেলায় পাণ্ডবদের লক্ষ্মী জয় করতে চাই। 

এত শুনে অন্ধ রাজা বলেন –বিদুরের সাথে তবে পরামর্শ করি। বুদ্ধিদাতা বিদুর মন্ত্রী চূড়ামণি। সে আমার হিতের জন্য অবশ্যই পরামর্শ দেবে। তার বুদ্ধি না নিয়ে আমি অনুমতি দিতে পারি না। 

দুর্যোধন বলে –বিদুরকে একথা বললে সে অবশ্যই আপনাকে নিষেধ করবে। তার কথা শুনলে আমার মরণ আপনি নিশ্চিত করবেন। আমি মরলে আপনি সুখে বিদুরের সাথে পরামর্শ করবেন। 

পুত্রের এত নিষ্ঠুর বচনে অন্ধ রাজা বড়ই দুঃখ পেলেন। 
দুর্যোধনের মন বুঝে তাকে আশ্বাস দিতে রাজা বলেন – তোমরা পাশা খেলার ব্যবস্থা কর। বহু স্তম্ভে বহু রত্নে এক মনোরম সভা নির্মাণ কর। গোটা চারেক দ্বার কর পরিসর। সে সভা নির্মাণ হলে আমায় জানিও। 

এত বলে রাজা পুত্রকে শান্ত করলেন। বিচক্ষণ বিদুর সব জানতে পেরে অন্ধ রাজার কাছে দ্রুত গেলেন। 

বিদুর রাজাকে বলেন – রাজন এ আপনি কি সিদ্ধান্ত নিলেন! শুনে পর্যন্ত আমার চিত্ত অসন্তুষ্ট। রাজন, পুত্রে পুত্রে ভেদাভেদ করা উচিত নয়, এতে সর্বনাশ নিশ্চিত। 

অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র বলেন ¬– আমায় কিছু বলো না। দৈবের লিখন কে খন্ডাতে পারে। তুমি চিন্তা করো না। ভীষ্ম আর আমি ক্রীড়াস্থলে থেকে ন্যায় বিচার করব। সেখানে পুত্রে পুত্রে কখনই দ্বন্ধ হতে দেব না। বিদুর, দৈব যদি প্রতিকূল না হয় তবে কলহ আমাকে দুঃখ দেবে না। বিধাতা সর্ব জগৎ দৈবের বশে রেখেছেন। এখন তুমি দ্রুত ইন্দ্রপ্রস্তে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে এখানে ডেকে আনো। ধর্মরাজকে এসব বিবরণ বিস্তারিত বলতে হবে না। 

এত কথা শুনে ক্ষত্তা(দাসীপুত্র বিদুরের উপাধি)বিষণ্ণ হলেন। 
বিদুর বলেন – রাজা উচিত কথা বললেন না। আজ থেকে জানলাম কূলের সর্বনাশ শুরু হল। 

এত বলে বিষণ্ণ ও ক্ষুব্ধ বিদুর দ্রুত ভীষ্মের কাছে সব জানাতে গেলেন। 

সভা পর্বের সুধারস পাশা অনুবন্ধ(প্রসঙ্গ), কাশীরামদাস কহেন পাঁচালি প্রবন্ধ। 
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers