Blog Archive

Monday, December 24, 2012

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪৩


গান্ধারীর শত সন্তান প্রসবঃ

মুনি বলেন পূর্ব পুরুষদের আরো কথা শুন।

সুবল-সুতা গান্ধারীর পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্যাসমুনি তাকে বর দেন মহাবলবান স্বামীর মতই তার একশত পুত্র হবে।  আনন্দিত গান্ধারী কিছুকালের মধ্যে গর্ভবতী হলেন। কিন্তু দশমাস পেরিয়ে গেলেও সন্তান প্রসব হয় না দেখে চিন্তিত হলেন। এ সময় হঠাৎ তিনি শুনলেন কুন্তীর পুত্র হয়েছে। এ খবরে তিনি মূর্চ্ছা  যান।



যার পুত্র প্রথম জন্মাবে সেই কুরুকূলের রাজা হবে-কুন্তী ভাগ্যবতী তার পুত্র-সন্তানেরা সবার পুজো পাবে, আমি অভাগিনী, পরম পাপিনী-এ আমার কর্মফল। দুবছর হয়েগেল কিছুই জন্মালো না পরিশ্রমই সার হল-এসব ভেবে গান্ধারী ঠিক করলেন গর্ভ বিনাশ করবেন।



লোহার মুগুর নিজের পেটে মারলেন। গর্ভপাত হল-এসব কথা ধৃতরাষ্ট্র কিছুই জানতে পারলেন না। গান্ধারী হাত, পা, মুন্ডহীন এক মাংসপিন্ড প্রসব করলেন। ঘৃণায় রাণী দাসীকে ডেকে তা ফেলে আসতে বললেন।

সব অবধান করে মুনি দ্বৈপায়ন বেদব্যাস সেখানে উপস্থিত হলেন।ক্রোধ ভরে তিনি রাণীকে বললেন, তিনি উচিত কর্ম করছেন না, প্রকৃত ধর্ম জানা সত্ত্বেও তিনি অধর্মের কাজ করছেন। হিংসার মত মহাক্লেশ ও অধর্ম আর নেই, হিংসায় মানুষ নিজেই নিজেকে শেষ করে।




নিজ ভুল বুঝে গান্ধারী লজ্জিত হলেন এবং ক্ষমা চাইলেন। তিনি আরো বললেন মুনির বরদান পূর্ণ হল না দেখে তিনি বিস্মিত। মুনি তাকে শতপুত্রের জননী হওয়ার আশির্বাদ দেন, অথচ দুবছর মহাক্লেশ সহ্য করেও কেবল মাংসপিন্ডেরই জন্ম হল।

মুনি সান্তনা দিয়ে বললেন তার বচন কখনও খন্ডন হতে পারে না। দুঃখ ত্যাগ করে রাণী তার বাক্য শুনুন, তাহলেই তার ইচ্ছাপূর্ণ হবে। তিনি আজ্ঞা দেন শতকুন্ড ঘৃতে পূর্ণ করে, মাংসপিন্ডটি জলে সিঞ্চন করে যে খন্ড হবে তা কুন্ডে করে রাখতে হবে।

এরপর মুনি নিজে মাংসপিন্ডটি কোলে নিয়ে তা জলে ডুবান। শীতল জলে সিঞ্চিতে সিঞ্চিতে মাংসপিন্ডটি শতখন্ডে ভাগ হয়ে যায়।অঙ্গুলীর তুল্য ছোট ছোট খন্ডগুলি শত কুন্ডে স্থাপন করা হল। 


এরপর  মুনি গান্ধারীকে বললেন, রানী উতলা না হয়ে এই শতকুন্ড যত্ন করে রাখ, তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে। তিনি রাজাকেও এ সংবাদ দিতে বললেন। এরপর হিমালয়বাসী ঋষি আপন স্থানে গমন করলেন।

কিছুকাল পর দুর্য্যোধনের জন্ম হল। ভীম যেদিন জন্মালেন দুর্য্যোধনেরও সেদিন জন্ম হল। যখন দুর্য্যোধনের জন্ম হল ময়ূরেরা কেকা রবে ডেকে উঠল, শকুনেরাও কেঁদে উঠল। দুর্য্যোধনের ডাকের সঙ্গে শকুনের ডাকের মিল দেখে সকলে চমকে উঠল। কুকুর, শেয়াল পালে পালে ডাকতে শুরু করল, কাকের উপদ্রপে নগর পূর্ণ হল। চারিদিকে তপ্ত বায়ুপ্রবাহ শুরু হল, মনে হল তাপে দশদিক পুড়ে যাচ্ছে। সূর্যদেব যেন রাগে আগুন বর্ষণ করছেন। পর্বত যেন ঝনঝন করে ভেঙে পরছে। 


-এসব অমঙ্গলের চিহ্ন দেখে কৌরবপতি ধৃতরাষ্ট্র চিন্তিত হলেন। ভীষ্ম, বিদুর সকলকে শীঘ্র আসতে আহ্বান জানালেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পান্ডু পুত্রই বংশের জ্যৈষ্ঠ কুমার, সেই রাজা হবে এতে সন্দেহ নেই, এ সংবাদে আমি সুখি। কিন্তু আমার পুত্রের জন্মমাত্র চারদিকে অমঙ্গল ধ্বনি উঠছে-এখন আমার কি কর্তব্য আপনারাই বলে দিন।

রাজার সকল কথা শুনে বিদুর তার মত রাজাকে জানালেন।

ভারতের এই গান যারা শুনবেন তাদের যম ভয় খন্ড হবে।

Thursday, October 4, 2012

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪২

 
ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর ও পান্ডুর বিবাহঃ 

কুরুবংশে তিন পুত্র ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু ও বিদুরের জন্ম হল। ভীষ্ম তাদের নানা বিদ্যাশিক্ষা দান করলেন। 

ধৃতরাষ্ট্র অসাধারণ বলবান, পান্ডু পরাক্রান্ত ধনুর্ধর এবং বিদুর অদ্বিতীয় ধর্মপরায়ণ হলেন। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ, বিদুর শূদ্রগর্ভজাত- একারণে পান্ডুই রাজপদ পেলেন।

অনেকদিন পর যখন তারা যৌবনপ্রাপ্ত, তখন ভীষ্ম তাদের বিবাহের কারণে চিন্তিত হলেন। 

 
ধৃতরাষ্ট্র

যদুবংশে সুবলরাজের কন্যা গান্ধারী। তিনি ঈশ্বরের আরাধনায় বর পান একশত পুত্রের জননী হবেন। এ সংবাদ শুনে ভীষ্ম দূত পাঠালেন। কুরুবংশের সন্তান ধৃতরাষ্ট্রের জন্য তার কন্যা প্রার্থনা করলেন।শুনে গান্ধাররাজ ভাবলেন কুরুকূল মহাবংশ, কেবল পাত্র অন্ধ। কিন্তু কন্যা না দিলে ভীষ্ম ক্রোধীত হবেন- এই ভেবে তিনি এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন। 
বিবাহের আয়োজন চললো। হাতি ঘোড়া, রথ, রত্ন সকল সাজান হল। দাসদাসী, গরু, মহিষ- সে বিশাল আয়োজন চললো। গান্ধারীর ভাই শকুনির সঙ্গে অনেক ব্রাহ্মণও গেল। গান্ধারী শুনলেন স্বামী অন্ধ। নিজ কর্মফল ভেবে তিনি শুক্ল পট্টবস্ত্রে নিজের চোখ দুটি বেঁধে ফেললেন। এভাবে পতিকে অতিক্রম না করে, তার পথ অনুসরণ করে গান্ধারী পতিব্রতা রূপে জগৎ বিখ্যাত হলেন।
 
নন্দলাল বসুর আঁকা- গান্ধারী

শকুনি হস্তিনানগরে এসে বোনকে ধৃতরাষ্ট্রের হাতে অর্পন করলেন। নানা অলঙ্কার দান করলেন। হস্তী, অশ্ব, রথ, রত্নও প্রদান করলেন এবং নিজের দেশে ফিরলেন।

 
পান্ডু 

জ্যৈষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ দিয়ে ভীষ্ম পান্ডুর জন্য চিন্তিত হলেন। শূর নামে এক যাদবরাজ ছিলেন –যিনি বসুদেবের পিতা ও কৃষ্ণের পিতামহ। তার কন্যা পৃথা। কুন্তিভোজ রাজা শূরের বন্ধু/মিত্র ছিলেন এবং পৃথাকে খুব স্নেহ করতেন। কুন্তীভোজকে নিঃসন্তান ও দুখী দেখে শূর নিজ কন্যাকে দান করলেন। কন্যার নাম হল কুন্তী। 

কুন্তী পূর্ণবয়স্কা হলে কুন্তীভোজ তাকে অতিথি শুশ্রূষায় নিয়োগ করলেন। পিতৃ আজ্ঞা পেয়ে কুন্তী অতিথিদের পূজা করেন, তাদের সেবাযত্ন করেন।

এসময়ে দুর্বাসা মুনি তার অতিথি হয়ে এলেন। কুন্তী নিজ হাতে তার পায়ে ফুল দিলেন, ধুয়ে দিলেন। রত্নময় সজ্জায় শয়ন করালেন। মিষ্টান্ন, পক্কান্ন দিয়ে ভোজন করালেন। কন্যা সর্বদা মুনির সামনে করযোড়ে থাকেন। তার সেবায় দুর্বাসা তুষ্ট হলেন এবং কুন্তীকে একটি মন্ত্র শিখিয়ে বললেন, এই মন্ত্র দ্বারা তুমি যে যে দেবতার স্মরণ করবেন তাঁদের প্রসাদে তোমার পুত্রলাভ হবে। মন্ত্রদান করে মুনি প্রস্থান করলেন।
 

এইরূপ আশ্চর্য বর পেয়ে কুন্তী আনন্দিত হলেন। তিনি মন্ত্র জপ করে দিনমনি তথা সূর্যকে স্মরণ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সূর্য তার সামনে উপস্থিত হলেন। সূর্যকে দেখে কুন্তী ভয় পেলেন। করযোড়ে তাঁকে বললেন দুর্বাসার মন্ত্রের পরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি দেব দিনকরকে স্মরণ করে ফেলেছিলেন। বামা জাতির দোষ ভেবে তিনি যেন কুন্তীকে ক্ষমা করে দেন।

সূর্য বললেন মুনির বচন যেমন সত্য, তেমনি তার আগমনও সত্য এবং তা বৃথা হতে পারে না। প্রথমমন্ত্র পেয়ে কুন্তী সূর্যকে ডেকেছেন, তাকে ভজনা না করলে মন্ত্র ব্যর্থ হবে।

পৃথা বললেন তিনি শৈশব বয়স্ক, কোন ভুল কাজ করলে অপযশ রটবে। 

দিনকর বলেন ভয় মনে এনো না, আমার কারণে তোমার কোন দোষ হবে না এ ভুবনে। আমাদের মিলনে তুমি পুত্র লাভ করবে এবং কুমারীই থাকবে। 

অনেক প্রবোধ দিয়ে সূর্য বর দিয়ে গেলেন এবং পৃথাকে ভজনা করে তার সাথে শৃঙ্গার করলেন। তার বীর্য্যে পৃথার গর্ভে এক সন্তান এলো, যিনি জন্ম থেকেই অক্ষয় কবচ পেলেন, কানে তার সোনার কুন্ডল। পুত্রকে দেখে পৃথা বিস্মিত হলেন। এই অপরূপ পুত্র লোকখ্যাত হবে ভেবে চিন্তিত হলেন। তার দোষে কুলে কলঙ্ক পড়বে। এসব কথা ভেবে পৃথা পুত্রকে কোলে নিয়ে তাম্রকুন্ডে করে জলে ভাসিয়ে দিলেন। 
 

সূতবংশীয় অধিরথ প্রতিদিন যমুনায় স্নান করতেন। তাম্রকুন্ড ভেসে যাচ্ছে দেখে তিনি তা তুলে এনে ভিতরে অপূর্ব সুন্দর কুমার দেখে আনন্দের সঙ্গে তাকে গৃহে নিয়ে গেলেন। তাঁর পরমাসুন্দরী স্ত্রী রাধা অপুত্রক ছিলেন-তারা বহুযত্নে পুত্রকে পালন করতে লাগলেন। 

 
কর্ণ 

পুত্রের নাম হল বসুসেন। দিনে দিনে পুত্র চন্দ্রের মত বাড়তে লাগলেন। সর্বশাস্ত্রে বিশারদ হয়ে তিনি মহাবীর হলেন। বসুসেন সূর্যের আরাধনা করতেন। জিতেন্দ্রিয় এই মহাবীর ব্রতে অনুরত, ব্রাহ্মণকে দান করেন, যিনি যা চান তাই দান করেন। কেউ প্রাণ চায় না তাই যেন তিনি প্রাণে বেঁচে আছেন। তাকে দেখে পুত্রের কারণে ইন্দ্র ব্রাহ্মণের বেশে এসে কুন্ডল কবচ প্রার্থনা করেন। বীর নিজ অঙ্গ কেটে তা ছদ্মবেশী ইন্দ্রকে দান করেন। ইন্দ্রও তাঁকে শক্তিঅস্ত্র দান করে বললেন-যার উপর তুমি এই অস্ত্র ক্ষেপণ করবে সে মরবে, কিন্তু একজন নিহত হলেই অস্ত্রটি আমার কাছে ফিরে আসবে। কবচ কেটে দেওয়ার জন্য বসুসেন কর্ণ ও বৈকর্তন নামে জগৎ বিখ্যাত হন। 

 
কুন্তী ও পান্ডু

ভোজের কন্যা পৃথা পিত্রালয়ে থাকেন। যৌবনপ্রাপ্ত হলে তার স্বয়ম্বর করা হয়। সকল রাজাদের নিমন্ত্রণ করা হল। সকলের মাঝে পান্ডু ইন্দ্রের মত অবস্থান করলেন। তার শোভা যেন গ্রহের মধ্যে সূর্যের- তার কাছে সকল নৃপবর তুচ্ছ হয়ে গেল। পৃথা পান্ডুকে দেখে আনন্দিত হলেন এবং তাকেই বরণ করলেন। ভোজরাজ তাকে সন্মানিত করলেন। নানা রত্নে সাজিয়ে কন্যাকে দান করলেন। সকল রাজা যে যার দেশে গমন করলেন। কুন্তীকে নিয়ে পান্ডু নিজ দেশে এলেন। ইন্দ্রের কোলে যেমন পুলোমা নন্দিনী পৌলমী/শচী, রজনীপতি সূর্যের কোলে যেমন শোভিত রোহিনী- তেমনি পান্ডু ও কুন্তীকে দেখে হস্তিনানগর হরষিত হল। আনন্দের নগরজুরে নাচ গান অনুষ্ঠান হল।

 
মাদ্রী 

কিছু সময় পর ভীষ্ম বিচার করে দেখলেন বংশবৃদ্ধির জন্য পান্ডুর আবার বিবাহ দেওয়া প্রয়োজন। তিনি শুনলেন মদ্রদেশে শল্য নামে এক রাজা আছেন যার পরমাসুন্দরী এক ভগিনী আছে। বার্তা পেয়ে ভীষ্ম সেখানে উপস্থিত হলেন। 
শল্যরাজ ভীষ্মের যথাযথ সেবা করলেন এবং তার আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। ভীষ্ম তাকে বললেন শল্য বিখ্যাত রাজা তাই তিনি তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চান এবং সে কারণে তার ভগিণীর সাথে পান্ডুর বিবাহ দিতে চান। 
শুনে শল্যরাজ হেসে জানালেন তাদের কুলের ধর্ম আছে কন্যাকে দিয়ে পণ নিতে হয়। তিনি এসব চান না। কিন্তু কুলধর্ম রক্ষা না করলে পাপ। 
ভীষ্ম বললেন কুলাচার পালন করা কর্তব্য। 
তিনি সাতকুম্ভ পূর্ণ করে অমূল্য রতন, কাঞ্চন, অশ্ব, রথ, গজ, বিচিত্র বসন প্রমুখ দান করলেন। 

ধন পেয়ে শল্যরাজ প্রীত হয়ে নানা রত্নে ভগিণী মাদ্রীকে সাজিয়ে ভীষ্মের সম্মুখে আনলেন। মাদ্রীকে নিয়ে ভীষ্ম নিজদেশে উপস্থিত হলেন এবং পান্ডুর সাথে মাদ্রীর বিবাহ দিলেন। মাদ্রীর রূপ দেখে পান্ডু আনন্দিত হলেন। তিনি দুই স্ত্রী নিয়ে সুখি ছিলেন, দুজনকেই সমান সন্মান করতেন। 

এসময় তিনি দিগবিজয়ের প্রতিজ্ঞা করেন। পদাতিক, রথাশ্ব, গজ, চতুরঙ্গ নিয়ে তিনি পশ্চিমদিকে যাত্রা করলেন। দশার্ণ দেশের রাজা, মগধের মদ্ররথ রাজা, মিথিলারাজ কশীচন্ড- প্রমুখকে যুদ্ধে পরাজিত করলেন। রাজারা মিলিত হয়ে তার বিরুদ্ধে যু্দ্ধ ঘোষণা করলেন, তথাপি পরাজিত হয়ে রণে ভঙ্গ দিলেন। 
পান্ডু প্রচুর রাজকর নিয়ে দেশে ফিরলেন। তার যশে নগর পূর্ণ হল। ভীষ্ম পান্ডুর প্রতি প্রীত হলেন, তার মস্তক চুম্বন করলেন এবং অনেক আশির্বাদ দিলেন। 
পান্ডু সকলকে প্রণাম জানিয়ে সকল সম্পদ ধৃতরাষ্ট্রকে অর্পণ করলেন। ধৃতরাষ্ট্রও তাকে সন্মানিত করলেন। পান্ডুকে অনেক দান করলেন। অশ্বমেধ যজ্ঞ করালেন, হস্তী, হয় তথা ঘোড়া, গরু এবং প্রচুর অর্থ ও ভূমি দান করলেন। ধৃতরাষ্ট্রের হাতে রাজ্যের অধিকার অর্পণ করে পান্ডু বনে মৃগয়া করতে গেলেন। কুন্তী ও মাদ্রীকে নিয়ে পান্ডু বনে বনে আনন্দে বাস করেন যেন হস্তিনানগরেই অবস্থান করছেন।

 
বিদুর 

এবার ভীষ্ম বিদুরের বিবাহের কথা চিন্তা করলেন। তিনি দেবকরাজার কন্যাকে বিদুরের সাথে বিবাহ দিলেন। দেবকরাজের কন্যার নাম পরাশরী, রূপে তিনি স্বর্গের বিদ্যাধরীদের হার মানান। মহাধর্মশীল বিদুরের থেকে পরাশরীর গর্ভে যে পুত্ররা জন্মালেন তারা পিতার মতন অতি নম্র, ধীর, অসামান্য গুণশালী, ধর্মে সুস্থির।

কুরুবংশের বৃদ্ধির কথা যে জন শুনে তার বংশবৃদ্ধি হয় ব্যাসের বচনে। 
.......................................

Thursday, August 2, 2012

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪১

বিদুরের জন্ম কাহিনী:

 

জন্মেজয় মুনিকে প্রশ্ন করলেন যম কি কারণে জন্ম নিলেন।

মুনি বলেন মান্ডব্য নামে এক মুনি ছিলেন। এই সত্যবন্ত, ধর্মশীল মুনি বহুকাল উর্দ্ধবাহু মৌনব্রত, উপবাসী থেকে বৃক্ষমূলে বসে তপস্যা করছিলেন। 

একদিন নগরে চুরি করে কিছু চোর পালাচ্ছিল। নগররক্ষকও তাদের পিছু নেয়। চোরেরা মুনির আশ্রমে প্রবেশ করে সেখানে অপহৃত ধন লুকিয়ে রাখল। রক্ষীরা আশ্রমে এসে মুনিকে প্রশ্ন করলে মৌনব্রতী মান্ডব্য উত্তর দিলেন না। তারা চোরদের খুজঁতে খুজঁতে আশ্রমে প্রবেশ করল এবং চোরদের ধরল। রাজচররা বিচার করল মুনি সব জেনে ইচ্ছে করে বলেন নি, তাই তাকেও চোরেদের সাথে বন্দি করা হল। 

রাজাকে জানানো হল চোরদের ধরা হয়েছে। রাজার আদেশে সকলকে শূলে চড়ানো হল। কিন্তু তপস্যার প্রভাবে মান্ডব্য বেঁচে রইলেন। 

একদল মুনি তাকে সে অবস্থায় দেখে চিন্তিত হলেন এবং শূলমুক্ত করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সফল হলেন না। তাঁকে সকলে প্রশ্ন করলেন কি পাপে তার এ শাস্তি! মান্ডব্য বললেন হয়ত তিনি বহুপাপ করেছিলেন, কি পাপে এমন হল সঠিক জানেন না।

 
মান্ডব্যমুনি

রাজা মুনিদের আগমনবার্তার কথা শুনে ভয় পেলেন এবং মুনির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। রাজা মুনির অনেক স্তব করলেন। মুনি তার উপর প্রসন্ন হলেন। 

রাজা তাকে শূল থেকে নামালেন কিন্তু শূলমুক্ত করতে পারলেন না। দেখে সকলে অবাক হলেন। বাইরে যতটা শূল ছিল কেটে বাদ দেওয়া হল। কিছু অংশ ভিতরেই থেকে গেল। যদিও মুনির কোন দুঃখ ছিল না, তিনি সদা প্রসন্ন। মান্ডব্য সেই অবস্থাতেই নানা দেশে ঘোরেন ও তপস্যা করেন। মুনিগর্ভ শূলযুক্ত দেখে সকলে অবাক হয় এবং তার নাম দেয় অনী(শূলের অগ্রভাগ)মান্ডব্য। 

একদিন মুনি ভাবলেন কি পাপে তার এই শাস্তি জানা দরকার। তিনি ধর্মের কছে উপস্থিত হলেন এবং সকল কথা জানিয়ে কোন কর্মের দন্ড তিনি ভোগ করছেন জানতে চাইলেন। 

 
ধর্মরাজ

ধর্ম বললেন মুনি যখন বালক ছিলেন তখন খেলাচ্ছলে একটি ক্ষুদ্র পতঙ্গের পুচ্ছদেশে কাশতৃণ প্রবিষ্ট করেছিলেন, তারই উচিত শিক্ষা তিনি পেলেন। বেদে আছে যা করবে তার ফলও ভোগ করতে হবে।

একথা শুনে মুনি রেগে গেলেন। বললেন আপনি লঘু পাপে গুরুদন্ড দিলেন। তখন তিনি বালক, প্রকৃতজ্ঞান হয়নি। এভাবে চললে সমস্ত সংসার রসাতলে যাবে। 

তিনি ধর্মকে শাপ দিলেন তার শূদ্রঘরে জন্ম হবে। আরো বললেন পাঁচ বছর(কোথাও বারো বা চোদ্দ বছর)বয়সের মধ্যে কেউ দোষ করলে তা পাপ বলে গণ্য হবে না। এই বলে মুনি আশ্রমে চলে গেলেন। 

তাঁর এই অভিশাপের ফলেই ধর্ম বিদুর রূপে শূদ্রগর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন। পরম পন্ডিত, বুদ্ধি ধর্মের মত – যেন সাক্ষাৎ যম অবতার।

Thursday, May 10, 2012

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪০

ধৃতরাষ্ট্রাদির উৎপত্তিঃ 

দেবব্রত ভীষ্ম সত্যবতীকে আরো বলেন -– জননী, আপনার বিচারে যে জন শ্রেষ্ঠ তাকে ডেকে আনুন। মন্ত্রী, পুরোহিতদের নিয়ে বিচার করুন। কারণ ভারতবংশের ভাগ্য এতে জড়িত। 


সত্যবতী বলেন –পুত্র ভীষ্ম ধর্মাচারী, তোমার বাক্য বেদ তুল্য। 
তিনি ধিরে ধিরে তার পিতৃগৃহের পূর্ব কাহিনী সকল বলেন। 
কিভাবে মহাতেজা পরাশরমুনির সাহায্যে তিনি দুর্গন্ধা থেকে সুগন্ধি হলেন। যমুনায় মুনি তপোবলে কুজ্ঝটীকা সৃষ্টি করে দ্বীপ নির্মাণ করেন এবং সেখানে ভয়ে তিনি তার বশীভূতা হন। তাদের এক পুত্রের জন্ম হয়। দ্বীপে জন্ম তাই তার নাম দ্বৈপায়ন। তিনিই বেদের চার ভাগ করেন। কৃষ্ণ অঙ্গের জন্য তাকে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস বলা হয়। 
জন্মমাত্র পুত্র তপোবনে যান এবং জননীকে বলে যান তাকে আহ্বান করলেই তিনি উপস্থিত হবেন। কন্যাকালে সত্যবতী ব্যাসকে পেয়েছিলেন। এখন ভীষ্ম যদি সম্মত হন তা হলে তিনি পুত্র ব্যাসকেই আহ্বান করবেন।

ভীষ্ম নিশ্চিন্ত হয়ে মাকে বলেন –আমরা দুজনে তাকে অনুরোধ করবো। কারণ কূলরক্ষার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কর্ম আর নেই। 

ভীষ্মের সম্মতিতে সত্যবতী ব্যাসকে স্মরণ করলেন। তিনি তখন নানা শাস্ত্রধর্ম দেবস্থানে কথন করছিলেন। 
মায়ের ডাকে তিনি উৎকন্ঠীত হলেন। সেই মুহূর্তে মাতার সম্মুখে উপস্থিত হলেন। 

ভীষ্ম নানা উপাচারে তাঁর পূজা করলেন। 

সত্যবতী পুত্রকে আলিঙ্গন করে রোদন করতে লাগলেন। তার স্তনদুগ্ধ ক্ষরিত হল। 

মায়ের রোদন দেখে ব্যাস বিস্মিত হলেন। কমন্ডুল থেকে জল মুখে দিলেন এবং মায়ের ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা কর লেন। 
মাকে তিনি আজ্ঞা করতে বললেন এবং কথা দিলেন তিনি সাধ্যমত তা পালনের চেষ্টা করবেন। 

সত্যবতী তখন তার দুঃখের কাহিনী বললেন। শিশুপুত্রদের রেখে স্বামী স্বর্গে গেলেন। গন্ধর্ব তার জৈষ্ঠপুত্রকে হত্যা করল। ছোটটিকে ভীষ্ম পালন করছিলেন। কাশীরাজের দু’কন্যার সাথে তার বিবাহও দেওয়া হল। কিন্তু বংশবিস্তার না করেই সে নবীন বয়সে মারা গেল। এখন কুরুকূল অস্তমিত হতে চলেছে। 

একমাত্র তার প্রথম সন্তান ব্যাসই তা রক্ষা করতে পারেন। 
পিতামাতার থেকেই সন্তানের উৎপত্তি। ব্যাসও যেমন তার পুত্র ভীষ্মও তার সন্তান। এখন দুইপুত্র মিলে কূলরক্ষার উপায় ঠিক করুন। কারণ তার কারণেই ভীষ্ম সত্য অঙ্গিকারে বদ্ধ। তাই কেবল ব্যাসের উপরেই সব নির্ভর করছে। 
ব্যাস সকল কথা শুনে বলেন মায়ের আজ্ঞার পালন তিনি করবেন। 

সত্যবতী বলেন তার ভ্রাতৃজায়ারা রূপে চপলা, তাদেরই ব্যাস আপন ঔরস দান করুন। 

ব্যাস বলেন ধর্মে এর প্রতিকার আছে। মায়ের বাক্য তিনি পালন করবেন এতে কূলও রক্ষা পাবে। 

তিনি অনুরোধ করেন পুত্রবধূরা যেন একবছর ধরে ব্রত পালন করেন এবং দান, যজ্ঞ, হোম করে পবিত্র হন। তবেই তিনি তাদের স্পর্ষ করতে পারবেন। এবং সন্তানও হবে পরাক্রমবীর। 

কিন্তু সত্যবতী বলেন পুত্র বিলম্ব সম্ভব নয়। নষ্ট, দুষ্ট, চোরের উপদ্রপে অরাজকতা শুরু হয়েছে। 

মায়ের কথায় ব্যাস চিন্তিত হয়ে বলেন তার ভয়ঙ্কর মূর্তি কন্যারা সহ্য করতে পারবে! যদি তাকে বধূরা গ্রহণ করতে পারেন তবে সুপুত্র উৎপন্ন হবে। 

সব শুনে সত্যবতী অম্বিকার কাছে গেলেন এবং মধুর বচনে তাকে বোঝালেন কূল রক্ষার্থে সে ভাসুরকে গ্রহণ করুক। সত্যবতী স্নেহ করে নানাবিধ কুসুমে শয্যা নির্মান করে দিলেন। 


অর্ধরাত্রে ব্যাস গৃহে প্রবেশ করলেন। কৃষ্ণবর্ণ, অঙ্গ সুপিঙ্গল, মাথায় জটাভার, ভয়ঙ্কর মূর্তি, যেন ভৈরব! 
তাকে দেখে রাণী ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলেন। দেখে ব্যাস বিস্মিত হলেন। 
পরদিন প্রভাতে সত্যবতী পুত্রের কাছে এলেন। ব্যাস স্নান করে উপস্থিত হলেন। 

সত্যবতীকে ব্যাস জানালেন তিনি মায়ের আদেশ পালন করেছেন। মহাবলবন্ত পুত্র জন্মগ্রহণ করবে। কিন্তু কেবল জননীর দোষে সে অন্ধ হবে। পুত্র শতপুত্রের জনক হবে এই আশির্বাদও দিলেন।

কিন্তু সত্যবতী দুঃখীত হলেন কারণ কুরুকূলে অন্ধ রাজা সুশোভন নয়। আর এক পুত্রের জন্ম দিতে অনুরোধ করলেন।
ব্যাস কথা দিয়ে গেলেন।
দশমাস পর ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম হল এবং মুনির কথা মত সে জন্মান্ধ হল। 

পরে যখন অম্বালিকা ঋতুস্নান করলেন তখন সত্যবতী পুনরায় ব্যাসকে আহ্বান জানালেন। 
পূর্ব ভয়ে অম্বালিকা চোখ বন্ধ করলেন না কিন্তু শরীর পান্ডুবর্ণ হল। 
পরে ব্যাস সত্যবতীকে জানালেন তাকে দেখে বধূ পান্ডুবর্ণ হলেন তাই পুত্র হবে পান্ডুবর্ণ। 

এত বলে ব্যাস চলে যাচ্ছেন তখন সত্যবতী আবার পুত্রকে অনুরোধ করলেন আরেক গন্ধর্ব সমান পুত্রের জন্য। 
ব্যাস পুনরায় সম্মত হয়ে নিজস্থানে ফিরে গেলেন। 
বছর ঘুরতেই অপূর্ব গঠনরূপের পুত্র জন্মাল কিন্তু তার শরীর পান্ডুর।


পুনরায় মায়ের স্মরণে ব্যাস উপস্থিত হলেন। এবার ভয়ে অম্বালিকা আর ব্যাসের কাছে গেলেন না। এক পরমা সুন্দরী সেবিকাকে রাণি সাজিয়ে পাঠালেন। নবীন যৌবনা শূদ্র যুবতি শ্রদ্ধা ভক্তি ভরে মুনিকে প্রণাম করলেন। সন্তুষ্ট হয়ে মুনি বললেন তার গর্ভে ধর্মের মত পুত্র জন্মাবেন। নরের মধ্যে তিনি পরম পন্ডিত হবেন। বর দিয়ে ব্যাস ফিরে গেলেন আশ্রমে। 

মুনির বরে শূদ্রানীর গর্ভে ধর্ম নিজে এসে জন্মগ্রহণ করলেন।

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৩৯

ক্ষত্রিয় বংশের উৎপত্তিঃ
 

ভীষ্ম চিন্তিত সত্যবতীকে আরো বলেন ব্রাহ্মণের মাধ্যমে ক্ষত্রিয় বংশের উৎপত্তির আরো কাহিনী আছে।

বিখ্যাত ঋষি ছিলেন উতথ্য। তার কনিষ্ঠ হলেন দেবগুরু বৃহস্পতি। মমতা ছিলেন উতথ্যের স্ত্রী। 


 

যুবতী মমতাকে কামে পীড়িত বৃহস্পতি রমণে আহ্বান জানান। মমতা বলেন তার গর্ভে বৃহস্পতিরই ভ্রাতার সন্তান আছে, তার পক্ষে বীর বৃহস্পতির সন্তান ধারণ সম্ভব নয়। 



তবু বৃহস্পতি তাকে কামনা করলেন। মমতা তাকে বোঝালেন গর্ভের সন্তান পরম পন্ডিত। গর্ভেই সে ষড়ঙ্গ বেদ অধ্যয়ন করেছে। তার পক্ষে একই সঙ্গে দুই বীর সন্তান ধারণ সম্ভব নয়। 



কিন্তু কামে অন্ধ বৃহস্পতি নিষেধ না শুনে শৃঙ্গার করলেন। উতথ্য-নন্দন গর্ভে ছিলেন তিনি বৃহস্পতিকে ডেকে বললেন তিনি অনুচিত কর্ম করেছেন তাই তার বীর্য্য এস্থানে থাকবে না। কামে পীড়িত বৃহস্পতি গর্ভস্থ সন্তানের বাক্য অগ্রাহ্য করে রমণে উদ্যত হলেন। তখন উতথ্যকুমার যুগল চরণে রেতদ্বার রুদ্ধ করলেন। বৃহস্পতির বীর্য ভূমিতে পতিত হল, গর্ভের স্থান পেল না। এতে বৃহস্পতি ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দিলেন উতথ্য-নন্দন জন্মান্ধ হবেন। 


এই উতথ্য-নন্দন দীর্ঘতমা সৌরভি বংশে অধ্যয়ন করেন। গোধর্ম পাঠ করে গরুর আচার করেন যাকে পায় তাকে ধরে শৃঙ্গার করে। তার কর্ম দেখে ঋষিরা তাকে ত্যাগ করেন, কেউ তাকে সন্মান করে না, সকলে অবহেলা করে। স্ত্রী প্রদ্বেষীও পূর্বের মত তাকে সমাদর করে না। দীর্ঘতমা স্ত্রীকে অনাদরের কারণ জিজ্ঞাসা করলে স্ত্রী বলেন স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করা। জন্মান্ধ ব্রাহ্মণ তাকে সুখ দিতে পারেন নি। এখন তিনি ব্রাহ্মণের সন্তানদের আর পালন করতে পারছেন না। ব্রাহ্মণের উচিত নিজের সন্তানদের পালন করার মত ক্ষমতা অর্জন করা। তিনি যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবেন। 
 

দীর্ঘতমা স্ত্রীর এত কথা শুনে রেগে গিয়ে বললেন –বিপুল অর্থ দিচ্ছি তা গ্রহণ কর এবং পুরুষের মত বাক্য বলা বন্ধ কর। 
 

তিনি আরো শাপ দিলেন, অর্থ লিপ্সার জন্য তার ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম হবে। 
স্ত্রী বলেন –অর্থ অনর্থের মূল। তিনি অর্থ চান না এবং ব্রাহ্মণ ও তার পুত্রদের তিনি আর সেবা করতে পারবেন না। 

এতো শুনে দীর্ঘতমা বলেন -আজ থেকে নারীজাতি যতদিন জীবিত থাকবে তারা পতির অধিন হবে। পতিবাক্যের অবহেলা করবেনা, জন্মে ও মরণে পতিকে অনুসরণ করবে। পতি ভিন্ন অন্য পুরুষের কথা ভাবলে তার নরক গমন হবে। পতি ছাড়া নারীর গতি নেই। সংসারে পতিহীনা নারী সকল সুখ থেকে বঞ্চিত হবে। এসব নিয়ম যে লঙ্ঘন করবে তার অপযশে ভুবন পূর্ণ হবে। 
 

এতকথা শুনে দীর্ঘতমার স্ত্রী ক্রুদ্ধ হলেন এবং পুত্রদের বললেন এই পাতকীকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে। পুত্ররা মায়ের বাক্যে পিতাকে বেঁধে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিল। 

 
ভেলায় ভেসে ব্রাহ্মণ অনেক দূর ভেসে গেল। দৈবক্রমে মহাবীর বলিরাজ তাকে দেখতে পেলেন এবং উদ্ধার করলেন। ব্রাহ্মণের কাছে সকল কথা শুনে বলিরাজা তাকে গ্রহণ করলেন এবং তপোবলে বলির বংশবিস্তার করতে বললেন। দৈত্যরাজের একথায় ব্রাহ্মণ রাজি হলেন। 

রাজা বলি রাণী সুদেষ্ণাকে ডেকে বললেন –এই ব্রাহ্মণের সেবা কর, এর থেকেই বংশ বৃদ্ধি হবে। 
 

কিন্তু সুদেষ্ণা অন্ধ দীর্ঘতমাকে অবহেলা করলেন। তিনি শূদ্র দাসীকে সেবায় নিযুক্ত করলেন। দাসীর গর্ভে দীর্ঘতমার সন্তান হল। তারা চার বেদ ও ষড়শাস্ত্র অধ্যয়ন করল। এসময় রাজা বলি এসে দীর্ঘতমাকে জিজ্ঞেস করলেন এরা তার পুত্র কিনা। 

দীর্ঘতমা বলেন -এরা আমার সন্তান, দাসী গর্ভজাত। তোমার স্ত্রী আমায় অবহেলা করে কাছে আসে নি।

 

রাজা বলি অন্তপুরে গিয়ে রাণী সুদেষ্ণাকে তার সকল কথা বললেন। তখন সুদেষ্ণা দীর্ঘতমার সেবায় রত হলেন। এভাবে রাজা বলির বংশবৃদ্ধি হল। তাদের তিন পুত্র-অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ। এরা পরমবীর হলেন। পরে এরা যথাক্রমে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গের রাজা হলেন। এভাবে ব্রাহ্মণের সাহায্যে ক্ষত্রিয়ের উৎপত্তি হল। 

Wednesday, February 8, 2012

মা

নতুন বছরে সবাইকে জানাই প্রীতি ও শুভেচ্ছা।

আজ আপনাদের আমার মার কথা জানাব।

আমার মাকে আমি খুব ভালবাসি। সবাই তাদের মাকে খুব ভালবাসে!...তবে সবার মত আমি আমার মাকে আমার কাছে পাই না। আমার মা আমাদের থেকে দুরে থাকেন। তাকে ফিরে পাওয়াটা আমাদের উভয়ের কাছে ঈশ্বরের অসীম আশীর্বাদ।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জেনে এসেছি আমাদের মা নেই-মারা গেছেন। তবে খুব ছোটবেলার কথা ভাবলে স্বপ্নের মত দেখতাম একজনকে যার বয়স্‌কাট চুল, হালকা শাড়ির আঁচল উড়ছে, হিলতোলা জুতো- যা আমার চারপাশের কাকি-পিসিদের সাথে একদম মিলতো না। আমি জানতাম স্বপ্নই। আরো মনে পরত- কাঁচের ঘর, বেতের আসবাব, ছোট্ট কাঠের সিংহাসনের সামনে আমি আর একটি বাচ্চা মেয়ের কোলে বসে -‘ ওম্‌ জয় জগদীশ হরে’ গান গাওয়া হচ্ছে, সুন্দর ধূপের গন্ধ।

একটু বড় হতে পিসির কাছে মাঝে মাঝে শুনতাম আমাদের পাপা নিয়ে আসে যখন, আমরা তখন ছোট্ট পুতুলের মত। দমদম বিমানবন্দরে সবাই নিতে যায়। পাপার কোলে তোয়ালে মোরা ভাই আর একটি কাজের ছেলের কোলে ছোট্ট আমি। 

আসতে আসতে জানতে পারি আমার মা বাঙালি ছিলেন না। পাপা আমাদের নিয়ে আসেন। একটু বড় হতে আর একজন মা আসেন।


এভাবে চলছিল। হঠাৎ একদিন সকালে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। আমি আর ভাই শুয়ে আছি বেল বাজতে উঠে দেখতে গেলাম কে। দেখি বাইরে একটি বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে, আর একজন মহিলা হিন্দীতে জানতে চাইছেন পাপা আছে কিনা। আমার তাকে দেখে কি একটা শিহরন লাগলো। চট্‌ করে ঘরে এসে বাপ্পাকে তুলে বললাম বাইরে কারা যেন এসেছেন।

জানলাম সেই মহিলা আমার মাস্‌তুতো দিদি। তিনি তার স্বামীর সাথে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছেন। আমরা সবাই খুব অবাক হয়ে গেছি। দিদি সেটা বুঝতে পেরে খুব ধিরে ধিরে আমাদের সব বলতে লাগলেন। তারা মিজোরাম থেকে এসেছেন। তার স্বামী অফিসের কাজে কলকাতায় এসেছিলেন। এর আগেও কয়েকবার এসে আমাদের খোঁজা হয়। এবার ঠিকানা পাওয়া গেছে। জামাইবাবু শুরু থেকেই একটা মুভি ক্যামেরা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

আমরা সেদিন জানতে পারি আমাদের মা বেঁচে আছেন। পনেরো বছর অসুস্থ ছিলেন। 

তার কাছ থেকে টুকরো টুকরো কথা জুরে জামাইবাবু আমাদের খুঁজে বার করেছেন। তার সখই হল পরিবারের যারা দুরে ছরিয়ে গেছে তাদের খোঁজ় করা। দিদি জামাইবাবু আমাদের নিয়ে একটু ঘুরে আসতে চাইলেন। পাপার অনুমতি পাওয়া গেল। সারাদিন আমরা দিদি, জামাইবাবু ও তাদের ছেলে মেয়েদের সাথে আনন্দে কাটালাম। 

সেদিন আমার মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসছিল!...আমার মা আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। বাড়ির সবার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। আমাদের তার কাছে যেতে বললেন।

পাপা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে আমাদের আঙ্কেল মানে মেসো আমাদের মার কাছে নিয়ে যান। বিমানবন্দরে যখন নামি তখন আঙ্কেল দেখান কত মানুষ আমাদের নিতে এসেছেন। বেরিয়ে প্রথমেই মাকে দেখি। সবাই ঘিরে আছে আমাদের – কেউই কথা খুঁজে পাই না। গাড়ি গাড়ি করে এত লোক এসেছেন। সবাই মাকে অনেক কিছু বলছেন।

আমরা গাড়ি করে পাহাড়ী পথে রওনা দিলাম। এর আগে অনেক পাহাড় দেখেছি কিন্তু এই সবুজ পাহাড়গুলোকে দেখে মন যে কি আনন্দে ভরে উঠছিল কি বলবো। এরা যেন আমার কত আপন, অথচ কত দুরে ছিলাম আমরা, আজ যেন আমদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে চায়।

আমার মা ও আমাদের আদর করত। আমার খুব লজ্জা লাগতো। মা আমায় জিজ্ঞেস করতো কত কথা। কষ্ট হয় কিনা, কেউ বকে কিনা-আরো কত কি!...আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে মাথায় এত চুল কম কেন। একটু কোথাও কাটা দেখলে আঁতকে ওঠে, বলে কে মেরেছে! আমার কি যে আনন্দ হয়! কিন্তু প্রকাশ করতে পারি না। লজ্জা লাগে। আমার ভাই কিন্তু একদম উল্টো। ও দিব্যি মার কোলে মাথা রেখে সারাদিন ঘুমায়। মা সারাদিন ওর মাথায় বিলি কাটে। আমাদের এক দিদি আছে। যে সরকারী চাকরি করে। একটু গম্ভীর প্রকৃতির, খুব সুন্দরী। সেই আমার স্বপ্নে আসত। তার সাথেও বাপ্পার খুব বন্ধুত্ব। দিদি আর বাপ্পা গাড়ি করে ঘুরে বেড়ায়। আমি মার সাথে থাকি। 

একুশদিন মত আমি মাকে কাছে পাই। সেই একুশটি দিন যেন সোনায় মোড়া। প্রতিদিন গির্জা থেকে ফাদাররা আসতেন, প্রার্থনা হত। আঙ্কেল পাঞ্জাবী, তিনি একটি শিব মন্দির করেছেন সেখানেও পুজো হল। কত দুর দুর থেকে আত্মীয়রা দেখা করতে আসতেন। আমারা চারজন তাদের বাড়ি ঘুরতে যেতাম। দিদি খুব জোরে গাড়ি চালাতো।

আমি ছোট থেকে একটু বেশি ভুগী, পাপা সারাদিন আমায় ফোন করত শরীর ভাল আছে কিনা জানতে। মা তাই চিন্তায় থাকতো। আমি সেভাবে কিছু চাইতাম না। কিন্তু একটু কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে সেটা করা চাই। ওখানে সন্ধ্যেবেলায় রাতের খাওয়া হয়ে যায়। তারপর খিদে পেলে ফল খাও। একদিন রাতে কি একটা খুঁজছি, ঘরে নেই-মা সঙ্গে সঙ্গে সেটা আনতে হন্তদন্ত হয়ে মাসির বাড়ি ছুটলো, শত অনুরোধ করেও আটকান গেল না। পাহাড়ি পথ, এত রাত! সামান্য একটা জিনিস মুখ ফুটে চাইতে কেউ এভাবে আমার জন্য করতে পারে, ভাবতে পারিনি! এমন স্নেহ তো কোনদিন পাই নি! পাপার স্নেহ অন্য রকম। পাপা অনেক করতেন কিন্তু মা কি যেন সেদিন বুঝলাম।

আসার সময় মা প্রচন্ড কান্নাকাটি করতেন। বাজে আবহাওয়ার জন্য দু’বার বাড়ি ফিরে যাই-মায়ের সে কি আনন্দ!

আমার মাকে আমি খুব মিস্‌ করি। কিন্তু সেখানে গিয়ে থেকে যাওয়া এখন আর সম্ভব নয়। মাও এখানের পরিবেশে মানাতে পারবেন না। 
তাতে কি, আমি জানি মা আমার সাথে সব সময় আছেন। মা আজও সকালে আমাদের জন্য প্রার্থনা করলেন। 

মহান প্রভুর কাছে আমার প্রার্থনা মাকে আমার খুব ভাল রেখো ......একদিন আমরা সবাই যেন এক সাথে থাকতে পারি.. 

উৎসর্গ : সকল মাকে

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers