Blog Archive

Saturday, May 28, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২৯

[পূর্বকথা - পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ........কৃষ্ণ প্রথমে জরাসন্ধ বধের কথা বলেন ....ভীমার্জুনকে সাথে নিয়ে কৃষ্ণ গিরিব্রজে রওনা দেন ..ভীম যুদ্ধে জরাসন্ধকে বধ করেন



অর্জ্জুনের দ্বিগ্বিজয় যাত্রাঃ 

কৃতাঞ্জলি করে মহাবলী পার্থ অর্জুন রাজা যুধিষ্ঠিরকে বলেন –মহারাজ, আজ্ঞা করুন রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করি। 
অতুল কার্মুক(ধনুক), গান্ডীব ধনুক, অক্ষয় তূণ, কপিধ্বজ রথ, দেব দত্তাম্বুজ(অম্বুজ-পদ্ম), সুচারু তুরঙ্গম(ঘোড়া) বল নিয়ে আমরা রাজকোষের ধনবৃদ্ধি করব। অগম্য পথে উত্তরে গিয়ে আমি সকল রাজ্য জয় করব, সব রাজাদের বশ্যতা আদায় করব। 

অর্জুনের কথা শুনে যুধিষ্ঠির তাকে স্নেহালিঙ্গনে সম্মতি জানালেন। 
শুভক্ষণ দেখে ব্রাহ্মণদের মঙ্গলবচনের মাধ্যমে কৃষ্ণ-মাধবের স্মরণ নিয়ে যাত্রার আয়োজন হল। রথ, গজ, বাজী(অশ্ব), সেনারা সেজে উঠল। 
উত্তরে অর্জুন গেলেন, পূর্বে ভীম, পশ্চিমে নকুল এবং কনিষ্ঠ ভাই সহদেব দক্ষিণ বিজয়ে বেরলেন। 

অর্জুনের সেনা শ্বেত, পীত(হলুদ) নানাবর্ণে সেজে, বিবিধ বাজনা বাজিয়ে এগোতে থাকে। শঙ্খনাদ, হাতির গর্জন এবং বিবিন্ন শব্দে ক্ষিতি কেঁপে কেঁপে উঠল। 
অর্জুন প্রথমে কুলিন্দ দেশে প্রবেশ করে অনায়াসে তাদের জয় করলেন। 
কালকূট(বিপদসঙ্কুল) বর্ত্ম(পথ) পেরিয়ে সহজেই আনর্ত দেশের রাজাকে জয় করলেন। 
শাকল সুদ্বীপ, প্রতিবিন্ধ্য রাজ্যও অনায়াসে জয় করলেন। 
এরপর প্রাগ্‌জ্যোতিষ রাজ্যে এলেন।এই রাজ্যের রাজা ভগদত্ত ভুবন বিখ্যাত। তার অগণিত সেনা-যারা কিরাত(ব্যাধ) কাননবাসী। এই বন্য সৈনিকদের অসীম ধৈয্য। তাদের হাতে ধনুক, গুঞ্জহারের(কুঁচফলের) মালায় সজ্জিত, উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা, শরীরে বৃক্ষলতা বেষ্টিত। তারা পরম হরষে যুদ্ধ করতে লাগল। এভাবে উভয় পক্ষের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ হল। 
ভগদত্ত রাজা পুরন্দরাত্মজ(ইন্দ্রপুত্র) অর্জুনের সাথে সামনাসামনি যুদ্ধ করলেন। নানা অস্ত্রে, ধনুকে তারা তাদের সকল শিক্ষা প্রয়োগ করতে লাগলেন। মারুত(বাতাস), অনল(অগ্নি), সূর্য, বসু, জল-বিবিধ মন্ত্র শিক্ষা প্রয়োগ হল। আটদিন ক্রমাগত বিশ্রাম না নিয়ে উপবাসে দুই বীর যুদ্ধ করতে লাগলেন। 
শেষে ভগদত্ত হেসে অর্জুনকে বলেন – হে মহামত্তবীর এবার রণে নিবর্ত হও। তুমি আমার সখা পুরুহূতের(ইন্দ্রের) যোগ্য পুত্র। তোমার শক্তি সম্পর্কে ধারনা ছিল না। এতদিনে তোমার যোগ্যতা জেনে খুশি হচ্ছি। কিসের কারণে তুমি এই যুদ্ধ করছ! কি চাও দয়া করে আমায় বল। 

অর্জুন বিনয়ের সাথে বলেন –ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কুরুকুলের রাজা হলেন। তিনি রাজসূয় ক্রতু(যজ্ঞ) করতে চান। আপনি যদি আমার উপর প্রীত হন তবে দয়া করে কিছু করদান করুন। 

প্রাগ্‌জ্যোতিষের ভগদত্ত রাজা আনন্দ মনে বহু ধন দিয়ে অর্জুনের পূজা করলেন। 

এরপর অর্জুন আবার আরো উত্তরে দিগ্বিজয়ে বেরলেন। বিভিন্ন পর্বতে শত শত রাজাদের হারিয়ে তাদের বশ্যতা নিলেন। কেউ আনন্দে ধন দিলেন, কেউবা সংগ্রাম করল। 
উলূক(ইন্দ্র)পুত্রের সঙ্গে বৃহন্ত নৃপের অনেক যুদ্ধ হল। 
মোদাপুরে দেবকসুদাম বহু ধন দান করল। 
পৌরব পর্বতের রাজা সেনাবিন্দু অর্জুনের হাতে রত্নসিন্ধু তুলে দিল। 
লোহিতদেশের মহাবল রাজা অর্জুনের অনেক পূজা করলেন। 
ত্রিগর্তের রাজাকে অনায়াসে জয় করা গেল। 
সিংহপুরের সিংহরাজ বশ্যতা জানাল। 
বাহ্লীক, দরদ জয় হল। 
রাজা কোকনদ, যিনি কামগিরির মাঝে বাস করেন, তার রাজ্যটি অপূর্ব সুন্দর। অশেষ ঘোটক(ঘোড়া), শুক্ল(সাদা) ময়ূর আনন্দে সারা দেশে ঘোরে। এই রাজাও অর্জুনকে আনন্দিত করলেন।
নৃপতি জীবন অর্জুনের সাথে মহারণ করলেন। শেষে হেরে পার্থের ভজনা করতে লাগলেন। এখান থেকেও পার্থ নানা বর্ণের রাশি রাশি ধনরত্ন পেলেন। 
এভাবে একে একে সব দেশ জয় করে অর্জুন হেমন্তগিরিতে উঠলেন। সেখানেও অভেলে গন্ধর্ব দানবপুরী জয় করলেন। 

কৈলাস পর্বতে কুবেরের বাসস্থান, সেখানে কোটি কোটি যক্ষ রক্ষের বাস। সেখানেও যুদ্ধ হল। শেষে কিরীটীর(অর্জুনের) জয় হল। ইন্দ্রের কুমার ইন্দ্রের সমান যুদ্ধ করে বহু যক্ষ মারতে লাগলেন। তারা ভয়ে পালিয়ে কুবেরের কাছে এসে বলে দেশে শত্রুর আক্রমণ ঘটেছে। শুনে বৈশ্রবণ(বিশ্রবা মুনির পুত্র-কুবের) বহু ধন নিয়ে পান্ডুপুত্রকে উপহার দিয়ে স্নেহের সাথে বিদায় জানালেন। 

হাটক নগর, সেখানের গুহ্যকনিবাসীদের জয় করে অনেক ধন আহোরণ হল। 
এভাবে বহু ধন রত্ন নিয়ে অর্জুন আনন্দ মনে আরো এগোতে লাগলেন। 
মানসসরোবর দেখে পার্থ খুব সুখী হলেন। এই অমরনগরী কোটি কোটি শশিমুখী অপ্সরা কিন্নরী পূর্ণ। জিতেন্দ্রিয় ধীর পার্থ মহাবীর কারো পানে দৃষ্টি দেন না। সেই সরোবরে বহু ঋষি বাস করতেন, তারা অর্জুনকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। সেখান থেকে কৌতুহল নিয়ে পার্থ আরো উত্তরে দ্রুত যেতে থাকলেন। সকল স্থানে তেজময় মার্তণ্ডের(সূর্যের) মত ঘুরে পার্থ ভারত জয় করতে লাগলেন। 

আরো উত্তরে তিনি হরিবর্ষ নামে এক স্থানে এলেন। তাকে দেখে দ্বারপালরা লৌহদণ্ড নিয়ে তেড়ে এলো। জীবন্ত মানুষ দেখে তারা বিস্মিত হয়ে অর্জুনকে বলে –তোমার দেখছি খুব সাহস! মানব শরীরে এখানে উপস্থিত হয়েছ! এর আগে এমন কখনও দেখিনি। এবার নিজেকে নিবৃত কর। এস্থান কেউ জয় করতে পারে না। এই উত্তরপুর কুরুর নগর-এখানে কি কারণে এসেছ! এখানে তো কাউকে দেখতে পাবে না, জীবন্ত এখানে কেউ থাকে না, কার সাথে তুমি যুদ্ধ করবে! 

কুন্তীপুত্র পার্থ দ্বারীদের বলেন –ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয় শ্রেষ্ঠ। আমি তার কিঙ্কর দাস মাত্র। তোমাদের লঙ্ঘন করে আমি পুরীতে প্রবেশ করব না, কথা দিচ্ছি। তবে তোমরা আমায় কিছু কর প্রদান কর। 
একথা শুনে দ্বারপালরা বহু রত্ন এনে ধনঞ্জয়ের হাতে তুলে দিল। ধন পেয়ে পার্থ সানন্দ হৃদয়ে দক্ষিণে মুখ ফেরালেন। 
ফেরার পথেও বহু মহীপালকে জয় করে কর আদায় করলেন। 

শেষে বহু বাদ্য বাজিয়ে চতুরঙ্গে নিজ নগরে প্রত্যাবর্তন করলেন। তিনি বহু মণি, মরকত, কনক, রজত, মুক্তা, প্রবাল রাশি, বিবিধ বসন, গো আদি বাহন ও বহু দাসদাসী সঙ্গে আনলেন। জয় জয় শব্দে, শঙ্খের নিনাদে পার্থ ইন্দ্রপ্রস্থে প্রবেশ করলেন। 

ইন্দ্রের আত্মজ পার্থ সজ্জা পরিবর্তন করে ধর্মপুত্রের সামনে উপস্থিত হলেন। মাটিতে দণ্ডবৎ হয়ে করজোড়ে যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম জানালেন। ধিরে ধিরে তার অভিযানের সব কথা যুধিষ্ঠির শুনতে লাগলেন। 

সব শেষে অর্জুন বলেন –উত্তরদিকের সকল নৃপ আপনার বশ্যতা মেনে নিয়েছেন। সকলে কর প্রদান করেছেন, দেখুন নৃপবর! 

আনন্দে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে আলিঙ্গন করলেন। অনেক ভাবে ভাইকে তুষ্ট করলেন। পার্থ যা যা এনেছিলেন সব রাজকোষে সঞ্চিত রেখে নিজ নিবাসে ফিরে গেলেন।
......................................

Sunday, May 22, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২৮

[পূর্বকথা - পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ....যুধিষ্ঠির পরামর্শের জন্য কৃষ্ণকে আহ্বান জানালেন....কৃষ্ণ প্রথমে জরাসন্ধ বধের কথা বলেন ....ভীমার্জুনকে সাথে নিয়ে কৃষ্ণ রওনা দেন .. তারা ছদ্মবেশে গিরিব্রজে প্রবেশ করে জরাসন্ধকে যুদ্ধে আহ্বান জানান.] 



জরাসন্ধের সহিত ভীমের যুদ্ধঃ 

মগধরাজ জরাসন্ধের সাথে ভীমসেনের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ শুরু হল।
তাদের দেখে মনে হল যেন গজরাজ-নক্র(কুমীর) যুদ্ধ করছে। 
বৃত্তাসুর-শক্রের(দেবরাজ ইন্দ্রের) যুদ্ধের কথা মনে পরে অথবা রাম-রাবণের যুদ্ধের কথা। 
প্রথমে তারা গদা যুদ্ধ শুরু করল। কর্কশ বচনে, ভৎসনা করতে করতে উভয়ে উভয়ের উপর রাগে মত্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। 

জরাসন্ধ বলে –ওরে পান্ডব, কোন খান্ডব বন থেকে মগধে এসেছিস মৃত্যুর টানে! নিয়তিই তোকে টেনে এনেছে, দেখ তোর কি করি! 

শুনে গর্জন করতে করতে ভীম বলেন –তোমাকেই শমনের(যমের) মনে পরেছে। তার দূত হয়ে আমি এলাম তোমায় হত্যা করতে। 

ক্রোধে বৃকোদর কদলীপাতার মত থর থর করে কাঁপতে থাকেন। দুজনে দ্রুত পরস্পরকে ঘুরে নিয়ে করাঘাত শুরু করে। 
তাদের সাংঘাতিক গর্জনে সকলের কানে তালা লেগে গেল। দাঁত কড়মড় করে, নিশ্বাসে ঝড় তুলে তারা লড়তে লাগল। করে কর, পায়ে পা জড়িয়ে তারা পরস্পরকে টানতে থাকে। কখনও বা দৌড়ে এসে মাথা দিয়ে গুঁতো মারে, বুকে আঘাত করে। তাদের লাল চোখ, সারা শরীর দিয়ে যেন আগুন ছুটছে, নয়নানলে যেন দুজনে দুজনকে দহন করে। কখনও বা বজ্রমুষ্টিতে, উরুতে, কোমড়ে আঘাত হেনে ভূমিতে জড়াজড়ি করে গড়াগড়ি দেয়। তাদের শরীরের ঘর্মে রণাঙ্গন ভিজে যায়, তবু সেই ধুলোকাদা মেখে তারা মল্লযুদ্ধ করতে থাকে। দুজনেই আঘাত পায়, রক্তে দেহ ভেসে যেতে থাকে। রাগে লম্ফঝম্ফ করে কাঁপতে কাঁপতে তবু তারা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তাদের পায়ের চাপে ভূমি কাঁপতে থাকে। 
পুনরায় গদাযুদ্ধ শুরু হয়। গদার প্রহার হৃদয়ে, শিরে, পিঠে, বাহুতে পরতে থাকে। সকলে দেখে গদার আঘাতে অগ্নি ঝরে, কেউ কারো চেয়ে যেন ঊন(কম) নয়। দুজনে দুজনকে মাটিতে আছড়ে ফেলে আবার লাফিয়ে ওঠে। যেন দুই বারণ(হাতি) বারুণী(মদ) পান করে পর্বত মাঝে যুঝছে। বা দুই বৃষভ(ষাঁড়) সুরভি(স্বর্গের কামধেনু) লোভে গোষ্ঠে যুদ্ধ করছে। 
কার্তিক মাসের প্রথমদিন এ যুদ্ধ শুরু হয়। অহর্নিশি অবিরাম দুজনে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এভাবে চতুর্দশ দিন কেটে গেল। 

কাশীদাস বলেন এভাবে তারা কেবল বায়ু পান করে অবিশ্রাম যুদ্ধ করতে থাকল।
....................................



জরাসন্ধ-বধ ও রাজগণের কারামোচনঃ 

অহর্নিশি চোদ্দদিন ক্রমাগত একভাবে যুদ্ধ করে চললেন ভীমসেন ও মগধরাজ জরাসন্ধ। অনাহারে, বিশ্রামহীন অবস্থায় লড়তে লড়তে বৃহদ্রথ কুমার জরাসন্ধ দুর্বল হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। অঙ্গ অচল হল, ধিরে ধিরে তার জ্ঞান লোপ পেল। তবু সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। 
পবনপুত্র ভীম মহাপরাক্রমী। তিনি এত যুদ্ধ করেও কোন কষ্ট বোধ করলেন না। 

কৃষ্ণ ভীমকে ডেকে বলেন –কি দেখছ! এই সুযোগে শত্রুকে সংহার কর! 

কৃষ্ণের কথা শুনে বৃকোদর ভীম ক্রোধের সাথে জরাসন্ধকে দুই পায়ে ভূমিতে ফেললেন। তারপর দুহাতে জরাসন্ধের দুই পা ধরে চক্রাকারে চারদিকে ঘোরাতে থাকেন। শতবার এভাবে ঘুড়িয়ে তাকে ছুঁড়ে ফেলে তার বুকে মহাবলে চেপে বসেন। জরাসন্ধের কন্ঠ জানু দিয়ে চেপে বুকে বজ্রমুষ্টি মারতে থাকেন। সেই গুরু গর্জনে ধরা কাঁপতে শুরু করে। রাজ্যের লোক সেই কম্পনে মৃতপ্রায় বোধ করল, ভয়ে তারা এমন চিৎকার করে যে কেউ কারো কথা বোঝে না। ভয়ে গর্ভবতী নারীর গর্ভ খসে। হাতি, ঘোড়া প্রমুখ জীবজন্তু দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। বৃকোদর ভীম সর্বশক্তি দিয়ে জরাসন্ধকে হত্যার চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু সফল হন না। 

আশ্চর্য হয়ে তিনি কৃষ্ণকে বলেন –আমি সর্বশক্তি দিয়ে একে হত্যার চেষ্টা করছি, কিন্তু এর দেখছি মরণ নেই! 

যদুরায় কৃষ্ণ ভীমকে কাছে ডেকে বলেন –পূর্বে জরা একে সন্ধি করেছিল। সেই পথেই একে হত্যা করতে হবে। 

এই বলে শ্রীনাথ কৃষ্ণ একটি তৃণ দুই করে ধরে চিরে দেখালেন। সমগ্র বিষয়টি বুঝে কুন্তীপুত্র ভীম হৃষ্ট মনে পুনরায় গর্জন করতে করতে জরাসন্ধের দিকে ধেয়ে যান। সিংহ যেমন মৃগকে অবহেলায় মারে, তেমনি বজ্রমুষ্টির প্রহারে জরাসন্ধকে মাটিতে ফেলে। জরাসন্ধের এক পা নিজের একপায়ে চেপে ধরে অন্য পা হাত দিয়ে হুঙ্কার মেরে টান দেন বৃকোদর। মাঝখান থেকে চিরে জরাসন্ধকে দু’টুকরো করা হল। এভাবে জন্মকালের রূপ ফিরে পেয়ে জরাসন্ধ প্রাণ হারায়। 

জরাসন্ধ নিহত হলে নারায়ণ কৃষ্ণ হরষিত হলেন। আনন্দে তিন বীর পরস্পরকে আলিঙ্গন করেন। মগধরাজের মৃত্যু সংবাদে নগরবাসী ভয় পেল। 
জরাসন্ধের পুত্র সহদেব প্রচন্ড ভয় পেয়ে পাত্রমিত্র নিয়ে কম্পিত কলেবরে গোবিন্দের চরণে এসে করজোড়ে স্তব করে বলে –হে প্রভু, আপনার মহিমা অপার। আপনিই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, আদ্যাশক্তি, বৈশ্বানর(অগ্নি)। আপনিই আমার কাছে চন্দ্র, সূর্য, জলেশ্বর, বায়ু, শক্তি-বল, চরাচর। আমি অতি মূঢমতি(নির্বোধ)। চারিবেদ আপনার সঠিক স্বরূপ বর্ণনায় অক্ষম, আমার সেখানে কি বা সাধ্য! আমায় রক্ষা করুন, আশ্রয় দিন। 
এইভাবে জরাসন্ধের পুত্র সহদেব শ্রীকৃষ্ণের বহু স্তুতি করলে গদাধর ঈষৎ হেসে অভয় আশ্বাস দেন। তিনি সহদেবকে মগধের সিংহাসনে বসিয়ে বন্দিশালা থেকে সকল রাজাকে মুক্ত করেন। সকল রাজাদের নানা রত্ন, বসনভূষণ দেওয়া হল।

বন্দিরাজারা মুক্ত হয়ে কৃষ্ণকে প্রণাম করে বলে –সদয় হৃদয় আপনার, আপনি সেবকরঞ্জন। 
দুর্বলের বল, আপনি গৌরব ভঞ্জন। 
অনাথের আপনি নাথ। 
আপনিই হিংসকের অরি(শত্রু)। ধর্মের পালন হেতু আজ আপনি মর্তে অবতীর্ণ। 
আপনার গুণ বেদেরও অগোচর। কে আপনাকে বর্ণনা করবে! 
শিব শঙ্করও আপনাকে যোগধ্যানে সকল সময় ধরতে পারেন না। 
জরাসন্ধ আমাদের যত দুঃখ দিয়েছিল সব তা দূর হল আপনাকে দর্শন করে। আপনার অভয় পঙ্কজপদ দর্শন করে আজ নয়ন সার্থক হল। তার উপর আপনার মুখ নিসৃত অমৃত ভাষ্য শ্রবণে কর্ণ ধন্য হল। জরাসন্ধ আজই আমাদের বলি দিত, আপনার কৃপায় আমরা উদ্ধার পেলাম। আমরা ধন্য, প্রভু! আপনি আজ্ঞা করুন আমরা আপনার জন্য কি করতে পারি। 

গোবিন্দ সহাস্যে বলেন –আপনারা সকলে নিজ নিজ রাজ্যে গমন করুন। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করবেন, আপনারা দয়া করে তাকে সাহায্য করবেন। 
একথা শুনে সকল রাজারা অঙ্গীকার করে কৃষ্ণকে প্রণাম করে যে যার দেশে ফিরে গেল। 

কৃষ্ণ-নারায়ণ জরাসন্ধের দিব্যরথ এনে ভীমার্জুনের সাথে তাতে আরোহণ করলেন। অপূর্ব সুন্দর সে রথটি পূর্বে পুরন্দর ইন্দ্রের ছিল। তিনি এটিতে চড়ে ঊনশত বার দানব দলন করেন। এই রথের ধ্বজা যোজন দুর থেকেও দেখা যায়। ইন্দ্রের থেকে এই রথটি বৃহদ্রথের পিতা মগধরাজ উপরিচর বসু উপহার পান। পরে সেটি বৃহদ্রথ ও তারপর জরাসন্ধের হয়। সে রথে তিন বীর আরোহণ করেন। 

গোবিন্দ গরুড়কে স্মরণ করেন। খগরাজ এসে সে রথের ধ্বজায় বসার অনুমতি নিলেন। কৃষ্ণ স্বয়ং সে রথের সারথী হয়ে শঙ্খনাদ করে শীঘ্র ইন্দপ্রস্থে উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠিরকে নমস্কার করে গোবিন্দ সকল ঘটনা জানালেন। 
আনন্দে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গোবিন্দের পুজা-স্তব করলেন। 
জরাসন্ধের রথ ও আরো অনেক অমূল্য রত্ন রাজা যুধিষ্ঠির হৃষ্ট মনে কৃষ্ণকে উপহার দিলেন। সেই রথে আরোহণ করে দেব দামোদর সকলের মেলানি(বিদায়কালীন সম্ভাষণ) নিয়ে দ্বারকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। 

মহাভারতের এই পবিত্র পুণ্যকথা-গোবিন্দের লীলা, রথ, পান্ডব কথা। 
সভাপর্বের সুধারস জরাসন্ধ বধে, কাশীরাম দাস কহেন আশ্রয় নিয়ে গোবিন্দের পদে। 
......................................

Monday, May 16, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২৭

[পূর্বকথা পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ....যুধিষ্ঠির পরামর্শের জন্য কৃষ্ণকে আহ্বান জানালেন....কৃষ্ণ প্রথমে জরাসন্ধ বধের কথা বলেন ....ভীমার্জুনকে সাথে নিয়ে কৃষ্ণ রওনা দেন ...]. 



ভীমার্জ্জুনকে লইয়া শ্রীকৃষ্ণের গিরিব্রজে প্রবেশঃ 

কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন স্নাতক[যে শিষ্য গুরুগৃহে বিদ্যা শিক্ষান্তে ব্রহ্মচর্য সমাপ্তিসূচক স্নান করে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করে] ব্রাহ্মণের বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। 
পদ্মসর, কালকূট পর্বত লঙ্ঘন করে গণ্ডকী, শর্করাবর্ত, অযোধ্যার সরযূ নদীর বিষম সঙ্কট কাটিয়ে, মিথিলা নগর ছেড়ে ভাগীরথী, সরস্বতী, যমুনা নদী পার হয়ে আরো পূর্বদিকে তিনজনে এগোতে লাগলেন। এভাবে অনেকদিন পর তারা মগধ রাজ্যে প্রবেশ করলেন। 
চৈত্যরথ প্রমুখ পাঁচটি গিরিবরের মধ্যস্থলে গিরিব্রজ রাজপুরী অবস্থিত। সেটি অতি মনোরম স্থান। ধন, ধান্য, গো, মহিষে শোভিত নগর। 

ভীমার্জুনকে মহামতি কৃষ্ণ বলেন –এই পাঁচ গিরিবরের মাঝে জরাসন্ধের নগর। এই পাঁচ গিরিবরও সাংঘাতিক। শত্রু দেখলেই এরা নিজ দ্বার রুদ্ধ করে। আর এক আশ্চর্য আছে এই দুয়ারে। এদের মাঝে তিনটি ভেরী[ঢাক বা রণবাদ্য বিশেষ] হঠাৎ বেজে উঠে সেনাদের সজাগ করে দেয়। 
এছাড়া শত্রুব্যাপী ও অর্বুদ নামে দুই ভয়ঙ্কর নাগের ভয়ে শত্রুরা এ নগরে প্রবেশের সাহস পায় না। 
নগরের দ্বারগুলি সব সময় মহারথীরা পাহারা দিচ্ছে। এমন নগরে প্রবেশের কোন উপায় বার করতে হবে। 

অর্জুন বলেন –ভেরীর দিকটা আমি সামলে নেব। 
ভীম বলেন –আমি পর্বতের ভার নিলাম। 
কৃষ্ণ বলেন –আমি দুই নাগকে দেখে নেব। 

এভাবে তারা ঠিক করলেন নগরদ্বার দিয়ে তারা প্রবেশ করবেন না। তারা পর্বতারোহণ করবেন ঠিক করলেন। 

কৃষ্ণ নাগদের পরাস্ত করার জন্য খগপতি গরুড়কে স্মরণ করলেন। ভুজঙ্গ-রিপু খগপতি এসে কৃষ্ণকে প্রণাম করে সব শুনে ত্রিভুবন কাঁপান গর্জন করলেন। সেই ডাক শুনে দুই ভুজঙ্গ ভয়ে পাতালে প্রবেশ করল। 
কৃষ্ণের মেলানি[বিদায় সম্ভাষণ] নিয়ে গরুড় ফিরে গেলেন। 

অর্জুন এক শব্দভেদী বাণ মেরে তিনটি ভেরী একসাথে নষ্ট করলেন। 
চৈত্যগিরি চূড়ায় আরোহণ করা মাত্র শত্রু দেখে গিরিবর প্রচন্ড গর্জন শুরু করল। ভীম গিরিশৃঙ্গ উপড়ে বজ্রমুষ্টির আঘাতে তাকে অচল করে ফেললেন। এভাবে তারা পর্বত লঙ্ঘন করে নগরে প্রবেশ করলেন। 

দেবপুরী সমান সুন্দর এই জরাসন্ধের দেশ। হাট, বাজার, নগর, চত্বর অতি মনোহর। নগরের ভিতর নানা পসরা বসেছে। সুগন্ধি, কুসুম, মাল্য দেখে বলপ্রয়োগ করে তিনজনে তা কেড়ে ভূষণসজ্জা করলেন। 
পূর্বদিকের দ্বার লঙ্ঘন করে তারা অনায়াসে অন্তপুরে প্রবেশ করতে লাগলেন। ব্রাহ্মণদের অবাধ দ্বার, তাদেরও দ্বারী ব্রাহ্মণ ভাবল। আরো তিনটি দ্বার পেরিয়ে যেখানে মহীপাল জরাসন্ধ বিরাজ করছে সেখানে তারা উপস্থিত হলেন। 

জরাসন্ধ যজ্ঞ দীক্ষা নিয়ে যজ্ঞে তৎপর, আজ সে ব্রতধারী উপবাসী। কেবল ব্রাহ্মণদের সাথেই দেখা করছে। বিনা আহ্বানে অন্যদের সেথায় প্রবেশ নিষেধ। তিনজন ব্রাহ্মণকে দেখে রাজা উঠে এসে জোড়হাতে প্রণাম করে অভ্যর্থনা জানায়। বসার জন্য কনক আসন দেওয়া হয়। ‘স্বস্তি, স্বস্তি’-বলে তিনজন আসন গ্রহণ করেন। 
জরাসন্ধ এবার তিনজনকে ভাল করে নিরীক্ষণ করে। শাল বৃক্ষ কোঁড়া অঙ্গের বরণ, আজানুলম্বিত ভুজঙ্গ(সাপ) আকার বাহু। প্রত্যেকের শরীরে অস্ত্রচিহ্ন বিদ্যমান। 
নানান কুসুমের ছদ্মবেশে এরা এসেছেন বুঝে জরাসন্ধ নিন্দা করে বলে ওঠে –সুগন্ধি চন্দন মালা পরে দেখছি ব্রতধারী ব্রাহ্মণ সাজা হয়েছে! এতো সাংঘাতিক অনাচার! সবাই জানে ব্রাহ্মণরা এভাবে গলায় মালা দেয় না। পরিধানও বিচিত্র করা হয়েছে! ব্রাহ্মণই যদি হবে তাহলে দেহে এত অস্ত্রের ক্ষত চিহ্ন কেন! সত্যি করে বল তোমরা কে, কোন জাতের, কি কারণে এখানে আসা হয়েছে! ব্রাহ্মণ ছাড়া কারো প্রবেশানুমতি নেই, তাই চোরের মত আমার কাছে এলে! চৈত্যগিরিশৃঙ্গ ভেঙ্গে যে প্রবেশ করেছ, বুঝতেই পারছি। রাজদ্রোহের পাপ ভয় নেই! কি কারণে, কি ভিক্ষা করতে আসা হল শুনি! 

এত কথা শুনে কৃষ্ণ বলেন –পুষ্পমাল্য সদা লক্ষ্মীর আশ্রয়, তার প্রিয় কর্ম সকলে করতে চায়। দ্বার পথে আসিনি বলে এত কথা শোনাচ্ছ। শত্রুগৃহে আমরা দ্বার পথে প্রবেশ করি না। 

জরাসন্ধ বলে – তোমরা আমার শত্রু হলে কবে! হিংসা না পেয়েও যারা আগ বারিয়ে হিংসা করতে আসে তাদের সমান পাপী সংসারে নেই। তোমাদের শত্রু কিভাবে হলাম, শুনি! 

গোবিন্দ বলেন –তুমি বিপরীত কথা বলছ। জগতে তোমার নিন্দার শেষ নেই। পৃথিবীর সকল রাজাকে তুমি বেঁধে এনে পশুর মত অত্যাচার করছ। শুনছি তাদের মহাদেবের সামনে বলি দেবে। এমন কাজ কোন সুহৃদ করে কক্ষনো! এমন কেউ শুনেছে যে জ্ঞাতির বলি দিতে চায়! তুমিই তো অধর্ম করতে চলেছ। আমি ধর্মের রক্ষক, আপদ ভঞ্জক। আমি কখনও জ্ঞাতি হিংসা দেখতে পারি না। 
ত্রয়োবিংশ অক্ষৌহিণী নিয়ে অষ্টাদশবার হেরে পালিয়েছিলে আমার কাছ থেকে-আমি সেই বসুদেব নন্দন কৃষ্ণ। এঁরা দুজন পান্ডুপুত্র ভীমার্জুন। 
নিজের ভাল চাইলে আমার কথা মত এখনি সব রাজাদের মুক্ত করে দাও। না হলে আমার সাথে যুদ্ধ কর। 

শ্রীকৃষ্ণের বচন শুনে জরাসন্ধ জ্বলে ওঠে –হে কৃষ্ণ, তুমিই পূর্বের কথা ভুলেছ। তুমিই যুদ্ধস্থল থেকে শৃগালের মত পালিয়েছিলে। আমার ভয়ে নিজস্থান ত্যাগ করে সমুদ্রে আশ্রয় নিয়েছ। কক্ষনো তো আর নিজদেশ মথুরাতেও যেতে পারলে না। এখন কোন সাহসে আমার নগরে প্রবেশ করলে, তাই ভাবছি। 
আবার দর্প করে হুকুম হচ্ছে, সব রাজাদের ছাড়তে হবে! আমি এদের নিজ বাহুবলে জয় করে বেঁধে এনেছি। আমার সঙ্কল্প দেব ত্রিলোচনের কাছে এদের বলি দেব। তাতে কার কি বলার আছে শুনি! 
হে গোপসুত তোমার কি একটুও লজ্জা নেই! পূর্বের সব কথা ভুলে বসেছো! তুমি আমার সাথে যুদ্ধ করবে! তোমার মত ক্ষুদ্র প্রাণীর সাথে আমি লড়তে চাই না। তার চেয়ে ভীমার্জুনকে আমার ভাল লেগেছে। কিন্তু এদের অল্প বয়স, এদের সাথে যুদ্ধ করলে আমার অযশ হবে। এদের মারলেও পৌরুষ ঘোষিত হবে না, আর হারলে তো অযশ হবে। এখন সব বালকরা পালাও দেখি! আর সাহস দেখাতে হবে না। 

ভীমার্জুনের উদ্দেশ্যে জরাসন্ধ বলে –এই গোপালের কথায় তোমরা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে উদ্যত হলে! যেনে রাখ এই জরাসন্ধ কৃতান্তেরও(যমেরও) যম। 

জরাসন্ধের এত কথা শুনে বীর বৃকোদর ভীমের অধরোষ্ঠ ক্রোধে কাঁপতে থাকে। 

গোবিন্দ বলেন –হে জরাসন্ধ বৃথা বড়াই করো না। তোমার সমান কেউ নেই। তাই বুঝি তুমি হীনবল রাজাদের অকারণে মারতে চাও! এর ফল তুমি পাবে। এখন দর্প দুর কর। আমার সাথে লড়তে না চাও, এদের দুজনের থেকে একজনকে বেছে নিতে পার। এদের বালক ভেব না। লড়তে গেলেই বুঝবে এদের শক্তি। 

জরাসন্ধ বলে –তোমাদের যদি এতই মরণের ইচ্ছা, তবে আমি আর কি করি! ঠিক আছে আমিও লড়তে রাজি আছি। এখন কি ভাবে যুদ্ধ করতে চাও শুনি! 

সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ বলেন –বিধির নিয়ম ও ক্ষত্রিয় ধর্মে আছে সৈন্যে-সৈন্যে, রথে-রথে কিংবা ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে লড়াই। সেই মত একক যুদ্ধ কর, যার সাথে মন চায়। 

এই শুনে ভুজবলে মত্ত অহঙ্কারী বৃহদ্রথ কুমার জরাসন্ধ বলে –অর্জুনকে তো সহজ বালক বিশেষ মনে হচ্ছে। হীনবলের সাথে যুদ্ধ করে সুখ নেই। কোমল বালক প্রায় বৃকোদরকে আমার মনে ধরেছে। এই ভীমের সাথেই আমি লড়ব। 

এই বলে মগধ রাজ জরাসন্ধ উঠে দাঁড়াল। দুটি গদা আনার আদেশ হল। জরাসন্ধ একটি নিজে নিয়ে অন্যটি ভীমকে দিল। নগরের বাইরে রঙ্গভূমিতে সকলে এসে উপস্থিত হল। 

এই যুদ্ধের কথা শুনে সমগ্র নগর কৌতূহলে ছুটে এলো। 

এভাবে কৃষ্ণ কৌতুক দেখতে চললেন। তিনি দুই বীরকে যুদ্ধে লাগিয়ে দিলেন। 
ভীম ও জরাসন্ধের অপূর্ব সংগ্রাম শুরু হল। 

সে সব বিস্তারিত ছন্দে যমকে বলা হবে। 
সভাপর্বে সুধারস জরাসন্ধ বধে, কাশীদাস দেব কহেন গোবিন্দের পদে।
......................................

Tuesday, May 10, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২৬

[পূর্বকথা -একদিন নারদমুনি ইন্দ্রপ্রস্থের সভায় উপস্থিত হলেন এবং নানা উপদেশ দিয়ে লোকপালদের সভা-বর্ণনা করলেন এবং সব শেষে জানালেন পান্ডুর মনের ইচ্ছে পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে যেন স্থান করে দেয়....যুধিষ্ঠির পরামর্শের জন্য কৃষ্ণকে আহ্বান জানালেন....কৃষ্ণ প্রথমে জরাসন্ধ বধের কথা বলেন ] 



জরাসন্ধের জন্ম বৃত্তান্তঃ 

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলেন –হে নারায়ণ, বলুন শুনি জরাসন্ধ নাম হল কেন তার! কি ভাবেই বা সে এত বলবান হয়ে উঠল! তোমাকে হিংসা করেও সে রক্ষা পাচ্ছে কি ভাবে! 

কৃষ্ণ গোবিন্দ বলেন –শুনুন তবে সে সব কাহিনী। 
মগধের রাজা ছিলেন বৃহদ্রথ। তিনি অগণিত সৈন্য, সামন্ত, গজ, বাজী(ঘোড়া), রথের অধিকারী। তেজে তিনি সূর্যের সমান, ক্রোধে যেন যম আর ধনে যক্ষপতির সমান। রূপে কামদেব আর ক্ষমা গুণে ক্ষিতি ধরিত্রী। 
কাশীরাজের দুই কন্যার সাথে তার বিবাহ হয়। পুত্র কামনা করে রাজা পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেন। কিন্তু যৌবনকাল গেল কোন পুত্র হল না। তখন নিজেকে ধিক্কার দিয়ে তিনি রাজ্য ত্যাগ করে স্ত্রীদের নিয়ে বনবাসে গেলেন। 
গৌতমমুনির পুত্র চণ্ডকৌশিক ঋষি, যিনি পরম তপস্বী সর্বদা বনে বাস করেন। বহু দেশ ভ্রমণ করে একদিন বৃক্ষতলে রাজা ঋষির দেখা পেলেন। স্ত্রীদের নিয়ে তিনি পরম ভক্তিভরে মুনির পূজা করলেন। 
খুশি হয়ে মুনি জিজ্ঞাসা করেন –রাজা, কোথায় চলেছেন! 
রাজা বৃহদ্রথ করজোড়ে বলেন –আমার দুঃখের কথা কি বলব! রাজা হয়ে বহু সৎ কর্ম করেছি। প্রজাদের সন্তানের মত পালন করলাম। কিন্তু পুত্রহীন হয়ে ধন-জনে আর মন নেই আমার। চারদিক শূন্য দেখছি। তাই রাজ্য ত্যাগ করে বনে বাস করছি। এখন ভাবছি সন্ন্যাস নিয়ে তপস্যা করব। 
রাজার কথা শুনে গৌতমনন্দন চন্ডকৌশিক চিন্তিত হয়ে ধ্যানে বসলেন। সে সময় দৈবের প্রভাবে সেই আমগাছ থেকে একটি আম মাটিতে পড়ল। আমটি তুলে ঋষি সেটি হৃদয়ে ধারণ করলেন। 
পরে আনন্দিত মনে আমটি রাজার হাতে তুলে দিয়ে বলেন –এই ফলটি আপনার প্রধান ভার্যাকে খেতে বলবেন। গুণবান পুত্র তার উদরে জন্মাবে। এবার আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে, নিজ রাজ্যে ফিরে যান। 
মুনির বাক্যে রাজা খুশি হয়ে রাজ্যে ফিরে এলেন। আমটি স্ত্রীদের হাতে দিলে দুই বোন সেটিকে দুভাগে ভাগ করে খেলেন। এক সময় দুই রাণীই গর্ভবতী হলেন। তারা একসাথে পুত্র প্রসব করলেন। দুইজনে আনন্দে পুত্রের মুখ দেখতে চাইলেন। 


এক চক্ষু, নাসা, কর্ণ, একপদ, এক হাত-অর্ধেক অর্ধেক অঙ্গ দেখে রাণীরা বিস্মিত হলেন। বুকে কিল মেরে তারা হাহাকার করে উঠলেন-দশ মাস গর্ভব্যথা বৃথা বহন করলাম! পুত্র দর্শন করে তারা যেমন নিরাশ হলেন, তেমনি ঘৃণা পেলেন। দাসীদের আজ্ঞা দিলেন সন্তানদের ফেলে দেওয়ার জন্য। দাসীরা সন্তান দুটি আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিল। 
সে সময় সেখানে জরা নামে এক রাক্ষসী উপস্থিত হল। সে সদা শোণিত(রক্ত) মাংস আহার করত। তার দ্বারাই সংসারে গর্ভপাত শাসিত হত। রাজগৃহে গর্ভপাত শুনে সে এসেছে। অর্ধ অর্ধ অঙ্গ দেখে সে বিস্মিত হয়ে দুইহাতে দুই অংশ তুলে নারাচারা করে দেখতে থাকল। হঠাৎ দুই অঙ্গ একত্র হয়ে শিশুটি মুখে হাত ভরে উঙা উঙা রবে চিৎকার করে কান্না জুড়ল।


আশ্চর্য হয়ে জরা ভাবে একে খেয়ে পেট ভরবে না, কিন্তু রাজাকে ফেরত দিলে তিনি আনন্দিত হবেন। এই ভেবে শিশুটিকে কোলে নিতেই শিশু মেঘ গর্জনে নিস্বন(শব্দ) করতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে জরা নিশাচরী নারী মূর্তি ধারণ করে রাজার কাছে গিয়ে তার কোলে পুত্রকে তুলে দিল এবং সকল কথা জানাল। 
পুত্রকে ফিরে পেয়ে রাজা বৃহদ্রথ উল্লাসিত হলেন। তিনি জরাকে জিজ্ঞেস করেন –কে তুমি, কোথায় তোমার বাস, কিবা নাম তোমার। কার কন্যা, কার স্ত্রী, কোথায় থাকা হয়! আমার প্রতি তোমার এত স্নেহ! এমন খুশি ত্রিভুবনে এর আগে আমায় কেউ দিতে পারে নি। 
রাজার কথা শুনে নিশাচরী বলে –সৃষ্টি অধিকারী আমার নাম গৃহদেবী দিয়েছিলেন। দানব বিনাশের ফলে আমার সৃজন হল। আমি সবার ঘরেই বাস করি। আমাকে সপুত্রা নবযৌবনা করে যে জন গৃহের ভিত্তিতে এঁকে রাখে তার ঘর ধন-ধান্য-জায়া-সুতে সর্বদা পরিপূর্ণ হবে। আপনার গৃহেও রাজন আমি নিত্য পূজা পাই। তাই তোমার এ পুত্রকে আমি রক্ষা করলাম। আমার এই উদর সমুদ্র শোষণ করতে পারে। সুমেরু সদৃশ মাংস খেয়েও আশ মেটে না। তবে তোমার গৃহ পূজায় আমি বশিভূত তাই তোমার ঔরস রক্ষা করলাম। 
এই বলে রাক্ষসী নিজ স্থানে ফিরে গেল। 
পুত্র ফিরে পেয়ে রাজা আনন্দিত হলেন। জাত কর্ম বিধিমত করা হল। ব্রাহ্মণরা অনুমান করে পুত্রের নামকরণ করল – জরা একে সন্ধি করেছে তাই পুত্রের নাম হল জরাসন্ধ। 
জরাসন্ধ শুক্লপক্ষের চাঁদের মত অবিরাম বাড়তে লাগল। পুত্র যৌবনপ্রাপ্ত হলে বৃহদ্রথ পুত্রের হাতে রাজ্যভার দিয়ে স্ত্রীদের নিয়ে ব্রহ্মচারী হলেন। 
মহাবলী জরাসন্ধ নিজ বাহুবলে ভূমণ্ডল শাসন করতে লাগল। তার দুই দুর্ধর্ষ সেনাপতি হংস ও ডিম্বক তার সহায়। এই তিনজন ধিরে ধিরে সংসারে অজেয় হয়ে উঠল। তার উপর তার জামাই হল কংস রাজা। আমার হাতে ভোজপতি যখন হত হলেন সেখান থেকেই বার্হদ্রথ জরাসন্ধ গদা প্রহার করল। শত যোজন পার হয়ে সে গদা হঠাৎ এসে মথুরায় আঘাত করে মথুরায় সাংঘাতিক ভূমিকম্প করে। এরপরও আঠারোবার ত্রয়োদশ অক্ষৌহিণী সাজিয়ে সপরিবারে জরাসন্ধ মথুরা আক্রমণ করে। 


হংস সেনাপতি মহাবীর বলভদ্রের হাতে প্রচন্ড আঘাত পেলে চারদিকে হংসের মৃত্যুর খবর ছড়ায়। ভাই ডিম্বক ভায়ের মৃত্যুর শোক সামলাতে না পেরে যমুনায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। কিন্তু হংস তখন জরাসন্ধের সাথে বসে পরামর্শ করছিল। ভায়ের আত্মহত্যার খবর শুনে সে দৌড়ে গেল এবং সেও যমুনার জলে ঝাঁপ দিয়ে মারা গেল। এভাবে জরাসন্ধের প্রধান দুই হাত হংস ও ডিম্বকের মৃত্যু হয়েছে।
এখন আছে কেবল অত্যাচারী জরাসন্ধ। অনেক চিন্তা করে তার সাথে লড়তে হবে। মল্লযুদ্ধ ছাড়া তাকে হত্যা করা সম্ভব নয়। একমাত্র বৃকোদর ভীমের পক্ষেই তা সম্ভব। আমার মনের ইচ্ছে যদি আপনারা মানেন তবে বলি ভীমার্জুনকে আমার সাথে দিন। 

কৃষ্ণের কথা শুনে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির স্নেহনয়নে ভীমার্জুনকে একদৃষ্টে দেখতে থাকেন। তিনি উপলব্ধি করলেন তার দুই ভাই কৃষ্ণের সাথে হৃষ্টচিত্তে যেতে চায়। তখন তিনি মধুর বাক্যে কৃষ্ণকে বলেন –আপনি কেন অনুনয় করছেন, যদুরায়! আপনি ছাড়া পাণ্ডবদের কে আর আছে! আজ পান্ডববন্ধু রূপে আপনি ত্রিভুবন খ্যাত। আপনার নাম নিলে ত্রিজগতে আর ভয় থাকে না। আপনি যার সহায় তার আর কি ভয় থাকতে পারে! 
এই বলে তিনি দুইভায়ের হাত গোবিন্দের করে সমর্পণ করলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃতের ধার, কাশীরাম দাস কহেন রচিয়া পয়ার। 
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers