Blog Archive

Sunday, November 30, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৯

 

বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠ বিরোধ: 

অর্জুন বিস্মিত হয়ে বিশ্বামিত্র ও বশিষ্ঠ মুনির অদ্ভূত কলহের কারণ জানতে চাইলেন। 

গন্ধর্ব তখন সে সব পুরানো কথা বললেন- ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্ঠ, অরুন্ধতির পতি এবং ইক্ষাকুকুলের পুরোহিত। 
 
অন্যদিকে কান্যকুব্জ দেশে কুশিকের পুত্র হলেন গাধি, তার পুত্র বিশ্বামিত্র ছিলেন সর্ব গুণ সম্পন্ন। বেদ, বিদ্যা, বুদ্ধিতে ভুবন বিখ্যাত। 
 
একদিন তিনি সসৈন্য মৃগয়া করতে মহাবনে প্রবেশ করলেন। মৃগয়ায় শ্রান্ত রাজা ক্ষুদা-পিপাসায় পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে বশিষ্ঠের আশ্রমে উপস্থিত হলেন। মনোহর স্থান দেখে রাজা খুশি হলেন। রাজাকে দেখে মুনি অতিথি সৎকারে মন দিলেন। রাজার সৈনিকদের পরিশ্রান্ত দেখে তিনি তার কামধেনু নন্দিনীকে ডেকে বললেন– দেখ রাজার সৈন্যরা আমার অতিথি। যে যা চায় তাই দিয়ে তাকে তুষ্ট কোরো। 
 
বশিষ্ঠ মুনির আজ্ঞা পেয়ে সুরভী সংসারে যা অদ্ভূত তেমন কর্ম করল। হুঙ্কার দিয়ে নানা দ্রব্য আনলেন চর্ব্য-চষ্য-লেহ্য-পেয় নানা রত্ন ধন। বস্ত্র, অলঙ্কার, মালা, কুসুম, চন্দন, বিচিত্র পালঙ্ক আর বসার আসন। যে যা চাইতে লাগলো, তাই পেলো। সকল সৈন্য আনন্দিত হল। 
 
দরিদ্র মুনির এমন বিস্ময় কর্ম দেখে গাধির পুত্র বিশ্বামিত্র অবাক হলেন। বশিষ্ঠের কাছে গিয়ে বলেন– আমি আপনাকে এক কোটি গরু দান করবো, যাদের খুর সোনায় মন্ডিত করে দেব। তার পরিবর্তে এই ধেনু আমায় দিন। অথবা আপনি যদি চান আমি রাজ্যও দিতে রাজি আছি। হস্তী, অশ্ব, পদাতিক যত সৈন্য সব আপনাকে দেব এই ধেনুর পরিবর্তে। 

বশিষ্ঠ বলেন– আমি কামধেনু দান করব না। এটি দেবতা ও অতিথিদের জন্য আমার কাছে আছে। 

রাজা বলেন– মুনি, তুমি জাতে ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণদের এমন জিনিষের প্রয়োজন হয় না। এ কেবল রাজার ঘরেই সাজে। একে বনে নিয়ে তুমি কি করবে। নিজের ইচ্ছেতে ধেনু দান না করলে, যেন আমি বল প্রয়োগ করে ছলে-বলে-কৌশলে একে অধিকার করবো। 

বশিষ্ঠ বলেন- তুমি তোমার দেশে শ্রেষ্ঠ, তাও সৈন্য সামন্ত নিয়ে। যা ইচ্ছে তুমি করে দেখ। আমি তপস্বী- আমার আর কি শক্তি! 
 
শুনে বিশ্বামিত্র সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন – কামধেনু সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চল। 
শুনে সৈন্যরা কামধেনুর গলায় দড়ি বেঁধে পিছনে বাড়ী মেরে মেরে নিয়ে চললো। প্রচন্ড মার খেয়েও কামধেনু নড়ল না। সজলাক্ষে ব্যাকুল ভাবে মুনির মুখের পানে চেয়ে রইলো। 
মুনি বলেন – নন্দিনী, আমার কাছে তুমি কি চাও। আমার সামনে তোমার এত কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। আমি সামান্য তপস্বী ব্রাহ্মণ, আমি আর কিবা করতে পারি তোমার জন্য। রাজা বল প্রয়োগ করে তোমায় নিয়ে যেতে চায়। 
সে সময় রাজার সৈন্যরা কামধেনুর সন্তান ছোট্ট বাছুরটিকে ধরে গলায় দড়ি বেঁধে আগে আগে টেনে নিয়ে চললো। সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে কামধেনু নন্দিনী ডাক ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মুনিকে বলে – ভগবান, বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের কশাঘাতে অনাথা আমি ও আমার সন্তান বিলাপ করছি। আপনি তা উপেক্ষা করছেন কেন! আমি কি করবো আজ্ঞা করুন। 
মুনি দুঃখিত হয়ে বলেন – ক্ষত্রিয়ের বল তেজ, ব্রাহ্মণের বল ক্ষমা। কল্যাণী, আমি তোমায় ত্যাগ করিনি। নিজের শক্তিবলে যদি থাকতে পার, তবে আমার কাছেই থাক, এর বেশি আর কি বলবো। 
 
মুনির মুখে একথা শোনা মাত্র পয়স্বিনী(দুগ্ধবতী গাভী) কামধেনু ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করল। ঊর্দ্ধমুখে গাভী হাম্বা রবে ডাক ছেরে শরীর বাড়াতে লাগল এবং বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের তাড়াতে লাগলো। তার বিভিন্ন অঙ্গ থেকে নানাজাতির সৈন্য লাখে লাখে বের হল। পুচ্ছ থেকে পহ্লব নামে জাতি নানা অস্ত্র হাতে তেড়ে এল। মূত্রে জন্ম হল বহু ব্যাধের। দুই পাশ থেকে জন্ম নিল কিরাত ও যবন। মুখের ফেণা থেকেও অনেক সৈন্যের জন্ম হল। চারি পা হতে নানাজাতির ম্লেচ্ছরা জন্ম নিল। সকলে নানা ধরনের অস্ত্র নিয়ে বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের তাড়া করল। দুই দলের সৈন্যদের প্রচন্ড যুদ্ধ হল। বিশ্বামিত্রের একজন সৈন্যের বিরুদ্ধে মুনির পাঁচজন সৈন্য হল। সহ্য করতে না পেরে বিশ্বামিত্রের সৈন্যরা রণে ভঙ্গ দিল। রাজার সামনেই তারা পালাতে লাগল। অনেক সৈন্য রক্তের নদীতে আহত হয়ে পরে রইল। এভাবে মুনির সৈন্য রাজার সৈন্যদের পিছনে পিছনে দৌড়ে তাদের বিতাড়িত করল। মুনির সৈন্য বিশ্বামিত্রকেও বনের বাইরে পাঠিয়ে মুনিকে এসে প্রণাম করল। 

বিশ্বামিত্র সব দেখে শুনে বড়ই অপমানিত বোধ করলেন। এমন অদ্ভূত ঘটনা দেখে তিনি মনে মনে আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হয়ে বলেন – ক্ষত্রিয় বলকে ধিক্‌! ব্রহ্মতেজই বল। সব দেখে বুঝেছি তপস্যাই পরম বল। সামান্য বিবাদে একটি ব্রাহ্মণ তপস্বীকে পরাজিত করতে পারলাম না, এ জন্মের আর কোন প্রয়োজন দেখি না। তপস্যা করে আমিও ব্রাহ্মণ হব, না হলে প্রাণত্যাগ করব। এসব ভেবে তিনি সব সৈন্যদের দেশে পাঠিয়ে গহন বনে তপস্যা করতে গেলেন। 
 
বিশ্বামিত্রের সেই তপস্যা ছিল সাঙ্ঘাতিক। তার তপে ত্রিভুবন তপ্ত হয়ে উঠল। গ্রীষ্মকালে রাজা চারদিকে হোমাগ্নি জ্বেলে তার মাঝে ঊর্দ্ধপদে তপস্যা করেন। নাকে, মুখে রক্ত বহে ভয়ঙ্কর দেখালো। ধিরে ধিরে রাজা অস্থি-চর্মসার হয়ে ওঠেন। আহার কেবল পবন(বাতাস)। বর্ষাকালে উন্মুক্ত স্থানে যোগাসনে বসেন। ঘোর বৃষ্টিবাদলের মাঝে তিনি অচেতন হয়ে তপস্যায় রত। শীতকালে হীনবস্ত্র নিরাশ্রয়ে থাকেন। এই ভাবে সহস্র বছর তিনি তপস্যা করলেন। তাঁর তপে ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে বর দিতে এলেন। 

ব্রহ্মা বলেন- বর প্রার্থনা কর, গাধির নন্দন, বিশ্বামিত্র! 
বিশ্বামিত্র যোড় হাতে বলেন- আমায় ব্রাহ্মণ করে দিন। 
বিরিঞ্চি(ব্রহ্মা) বলেন – ক্ষত্রিয়কুলে তোমার জন্ম। তুমি কি ভাবে ব্রাহ্মণ হবে! এতো দুস্কর কর্ম! অন্য যে কোন বর প্রার্থনা কর। 
বিশ্বামিত্র ক্ষুদ্ধ হয়ে বলেন – অন্য আর কিছুর প্রয়োজন নেই। 
ব্রহ্মা বলেন – পরের জন্মে তুমি ব্রাহ্মণই হবে। এখন যা চাও প্রার্থনা করে নাও। 
বিশ্বামিত্র বলেন- আমি অন্য কিছু চাই না। ব্রাহ্মণত্ব দান করুন না হয় প্রাণ নিন। 
এত কথা শুনে বিধাতা(ব্রহ্মা) সে স্থান ত্যাগ করলেন। 

গাধি পুত্র বিশ্বামিত্র পুনরায় তপস্যা শুরু করলেন। ঊর্দ্ধবাহু, ঊর্দ্ধমুখ করে এক পায়ের আঙ্গুলে দাঁড়িয়ে থাকেন। তপ করতে করতে তিনি শুষ্ক কাঠের মত হয়ে গেলেন। কেবল হাড়ের খাঁচায় প্রাণটা রয়ে গেল। তাঁর এই প্রচন্ড তপস্যার তেজে তিনলোক তপ্ত হতে লাগলো। ইন্দ্রাদি সকল দেবতারা ভয় পেলেন। এত সহ্য করতে না পেরে ব্রহ্মা আবার এসে বিশ্বামিত্রকে মিনতি করলেন বর চাওয়ার জন্য। 
 
বিশ্বামিত্র বলেন –আমি আগেই বলেছি আমি কি চাই। বর দিতে চাইলে আমাকে ব্রাহ্মণ কর। 
এবার ব্রহ্মা এড়িয়ে যেতে পারলেন না। তিনি নিজের উত্তরীয় বিশ্বামিত্রের গলায় পরিয়ে দিলেন। এভাবে ব্রহ্মা বর প্রদান করে ব্রহ্মলোকে ফিরে গেলেন। 
.................................... 

Saturday, November 15, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৮


তপতী সংবরণোপাখ্যানঃ
গন্ধর্ব বলেন– আপনি জীবন দিলেন, তার পরিবর্তে আমি চাক্ষুষী বিদ্যা দিচ্ছি। আমি জানি আপনার জন্মকথা, আপনি তপতীর গর্ভে জন্ম নিয়েছেন। আপনাকে পুরুষক্রমে ভাল ভাবে জানি। দ্রোণের মত গুরুর প্রিয় শিষ্য জেনেও আপনাদের পথ রোধ করলাম রাত্রে। তারও বিশেষ কারণ ছিল। সে সময় আমি স্ত্রীদের নিয়ে ক্রীড়ায় রত ছিলাম। স্ত্রীসঙ্গ ক্রীড়াকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। সে কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে আপনাদের রোধ করি। আপনারা জিতেন্দ্রিয় ধার্মিক, সে কারণে আমার বিরুদ্ধে জয়লাভ করলেন। আপনার আগ্নেয়অস্ত্র এবং চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব আমাকে দিন।

অর্জুন গন্ধর্বের প্রার্থনা অনুসারে চাক্ষুসীবিদ্যা ও অশ্ব নিলেন এবং আগ্নেয়াস্ত্র দান করে বন্ধু হলেন।
তিনি আবার প্রশ্ন করলেন– রাত্রে আমাদের এভাবে পথ আগলে আপনি কি বুঝাতে চাইলেন !

গন্ধর্ব বলেন– আপনাদের অগ্নিহোত্র(প্রত্যহ যজ্ঞকারী ব্রাহ্মণের করণীয় হোম) নেই। ব্রাহ্মণকে সঙ্গে নিয়েও চলেন না। সে জন্যেও আমি পথ রোধ করেছিলাম। হে, তাপত্য! কল্যাণপ্রাপ্তির জন্য পুরোহিত নিয়োগ করা কর্তব্য। পুরোহিত না থাকলে কোনও রাজা কেবল বীরত্ব বা আভিজাত্যের প্রভাবে রাজ্য জয় করতে পারেন না। ব্রাহ্মণকে পুরোভাগে রাখলে চিরকাল রাজ্যপালন করা যায়।

অর্জুন বলেন– আপনি আমাকে বারংবার তাপত্য বলছেন কেন! তপতী কে! আমরা তো কৌন্তেয়।

গন্ধর্ব বলেন– তবে শুনুন কেন আপনাদের তাপত্য বলে ডেকেছি। নিজেদের পূর্ববংশের কথা মন দিয়ে শুনুন।

যিনি নিজ তেজে সমস্ত আকাশ ব্যাপ্ত করে থাকেন সেই সূর্যদেবের এক কন্যা ছিলেন তপতী। ইনি সাবিত্রীর কনিষ্ঠা। রূপে, গুণে তপতী ছিলেন অতুলনীয়া। সূর্যদেব তার উপযুক্ত পাত্র খুঁজে পেলেন না। কন্যার কারণে তিনি চিন্তিত ছিলেন। সে সময় আপনাদের পূর্বতন পূর্বপুরুষ কুরুবংশীয় সংবরণ রাজা, যিনি প্রতিদিন উদয়কালে সূর্যের আরাধনা করতেন। তিনি ধার্মিক, রূপবান ও বিখ্যাত বংশের রাজা- সে জন্য সূর্য তাকেই কন্যা তপতীকে দিতে ইচ্ছে করলেন।

সূর্যদেব

একদিন সংবরণ মৃগয়া করতে গিয়ে একা একা অশ্বের পিঠে চড়ে বহু বনে বনে ভ্রমণ করলেন। পথশ্রমে ক্লান্ত অশ্বটি জলের অভাবে প্রাণ হারাল। অশ্বহীন রাজা পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করতে লাগলেন। দিক নির্ণয় করতে পর্বতের উপর উঠলেন। সেখানে এক অপরূপা সুন্দরী কন্যাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। কন্যার রূপের তেজে যেন পর্বত দীপ্ত হচ্ছিল। রাজা খুব খুশি হলেন। নিজেকে ভাগ্যবান ভাবলেন এমন কন্যার দর্শন পেয়ে। রাজার মনে হল এই কন্যার সমান পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তিনি পুতুলের মত স্থির চিত্তে কন্যাকে দর্শন করতে লাগলেন।

অনেক্ষণ পর কামে পীড়িত রাজা কন্যার কাছে গিয়ে মৃদু মধুর কন্ঠে বলেন– হে মন্মথমোহিনী, এই নির্জন বনে তুমি একা কি করছো! পদ্মের মত কোমল তোমার পদ যুগল। তার উপর স্থাপিত তোমার কদলীবৃক্ষের ন্যায় সুপুষ্ট ও সুন্দর ঊরু যুগল। নিতম্ব ঘটের মত সুন্দর, কোমরটি সরু, চক্ষু দুটি ছুড়ির মত আঘাত হানে, তার উপর কামচাপা ভুরু, কামপূর্ণ অতুল যুগল স্তন। সাপের মত বাহু দুটি কোমরের পাশে সরলভাবে অবস্থিত। নিখুঁত তোমার অঙ্গ দেখে রত্নালঙ্কার পরাতে মন চায়। তুমি কে, দেবী! দেবকন্যা, অপ্সরী, নাগিনী, মানবী নাকি কিন্নরী! এই চোখে কত দেখলাম, কানে কত শুনলাম- কিন্তু এমন অপরূপার কথা কেউ জানে না। কে তুমি, কার কন্যা। দয়া করে আমাকে বল। কি কারণে এই পর্বতে একা আছো! চাতক পাখির মত আমার কান তোমার মধুর ভাষণ শুনতে আগ্রহী। আমায় কিছু বলে তৃপ্ত কর।
এভাবে রাজা নানা ভাবে কন্যাকে বিনয় দেখালেন।

কিন্তু কন্যা কিছু না বলেই অদৃশ্য হলেন। মেঘের মধ্যে যেমন বিদ্যুৎ লুকায়, কন্যাও কোথায় লুকালো! রাজা উন্মাদের মত চারদিকে কন্যাকে খুঁজতে থাকেন। তাকে দেখতে না পেয়ে রাজা অচেতন হয়ে পরে গেলেন। এভাবে রাজা সংবরণ মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন।

অন্তরীক্ষ থেকে সেই কন্যা-তপতী রাজা সংবরণের এ অবস্থা দেখে দুঃখিত হলেন। রাজার কাছে এসে বলেন– নৃপ শ্রেষ্ঠ, উঠুন! মোহগ্রস্থ হবেন না। নিজের ঘরে ফিরে যান।

সংবরণ অস্পষ্ট বাক্যে অনুনয় করে বলেন– সুন্দরী, তুমি আমাকে ভজনা কর, নয়ত আমি প্রাণ ত্যাগ করবো। তুমি প্রসন্ন হও। আমি তোমার অনুগত ভক্ত। আমার প্রতি দয়া হলে আমায় আলিঙ্গন করে আমার প্রাণ রাখ।

কন্যা বলেন– রাজা তা হয় না। আমার পিতার কাছে আমার জন্য প্রার্থনা করুন। আমার পরিচয় দিচ্ছি। আমি সূর্যকন্যা তপতী। আপনি সূর্যের আরাধনা করে তাকে প্রীত করুন। তিনি আমাকে আপনার হাতে অর্পন করলে তবেই আমায় নিজের করে পাওয়া সম্ভব।

এত বলে তপতী অদৃশ্য হলেন। সংবরন রাজা আবার মুর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। অমাত্য ও অনুচরেরা অনেক খুঁজে রাজাকে দেখতে পেলেন এবং তার মাথায় পদ্মসুরভিত শীতল জল ঢালতে লাগলেন। রাজা জ্ঞান পেয়ে চতুরদিকে তপতীকে খুঁজতে লাগলেন। সৈন্যসামন্ত দেখে কিছু বললেন না। এক বৃদ্ধ মন্ত্রীকে সঙ্গে রেখে সকলকে রাজ্যে ফেরত পাঠালেন।
এরপর রাজা সূর্যের উদ্দেশ্যে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। এক পায়ে অধোমুখে উপবাসে সূর্যের উদ্দেশ্যে একচিত্তে তপস্যা করতে লাগলেন।
শেষে অনেক ভেবে পুরোহিত বশিষ্ঠ মুনিকে স্মরণ করলেন। বশিষ্ঠ মুনি রাজার সামনে উপস্থিত হলেন।

তিনি যোগবলে সমস্ত জেনে কিছুক্ষণ সংবরণের সঙ্গে কথা বলে উর্ধ্বে চলে গেলেন। দ্বিতীয় সূর্যের মত তার তেজ। সূর্য কৃতাঞ্জলি করে তাকে প্রণাম করলেন। কি প্রয়োজনে মুনি তার কাছে এসেছেন জানতে চাইলেন।
মুনিও সূর্যদেবকে প্রণাম করে জানালেন- আপনার তপতী নামের কন্যাকে আমি মহারাজ সংবরণের জন্য প্রার্থনা করছি। তিনি রূপে, গুণে ভুবন বিখ্যাত। তিনি আপনারও অনুগত।

সূর্যদেব খুশি হয়ে সম্মত জানিয়ে বলেন– মুনিদের মধ্যে আপনি প্রধান, ক্ষত্রিয়ের মধ্যে সংবরণ রাজ শ্রেষ্ঠ এবং কন্যাদের মধ্যে তপতীর সমান কেউ নেই। তিন স্থানের তিন শ্রেষ্ঠ!

মুনি শ্রেষ্ঠের বচন তিনি ফেলবেন না। এত বলে কন্যা তপতীকে মুনির হাতে সমর্পণ করলেন। কন্যাকে নিয়ে মুনি রাজা সংবরণের কাছে এলেন। তপতীকে দেখে রাজা তপ ত্যাগ করলেন। যোড়হাতে রাজা বশিষ্ঠ মুনির যপ করেন। ঋষি তপতী ও সংবরণের বিবাহ দেন। পরে বশিষ্ঠ মুনি নিজের আশ্রমে ফিরে যান। মুনির আজ্ঞা নিয়ে রাজা সেই মহাবনে সুখে বাস করতে লাগলেন। রাজার সাথে যে বৃদ্ধ মন্ত্রী ছিলেন তাকে রাজা রাজ্যভার দিয়ে দেশে পাঠালেন। পর্বতের উপর রাজা স্ত্রীর সাথে বারো বছর আনন্দে কাটালেন।

সেই বারো বছর রাজ্যে এক বিন্দু বৃষ্টি হল না। বৃক্ষ, শষ্য সব পুড়ে ভস্ম হল। ঘোড়া, পাখি সব মরে গেল। রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। চারদিকে চুরি, ডাকাতি শুরু হল। স্থাবর, অস্থাবর ও প্রজা ক্ষয় পেতে লাগল। মানুষ শবের মত হতে লাগল। হীনশক্তি হয়ে স্থানে স্থানে পরে রইল। চারদিকে হাহাকার রব শুরু হল। প্রমাদ গুণে মানুষ দেশান্তরি হতে লাগলো।
রাজ্যের এত কষ্টের কথা রাজা কিছুই জানলেন না। বশিষ্ঠ মুনি সে সময় দেশে এসে রাজ্যভঙ্গ হচ্ছে দেখে চিন্তিত হলেন। রাজাকে আনতে তিনি পর্বতে গেলেন।

সব জেনে রাজা সংবরণের অনুতাপ হল। তপতীকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। রাজ্যে ফিরে তিনি যজ্ঞ করলেন। ইন্দ্রদেব সুখি হয়ে বৃষ্টি দান করলেন। পুনরায় ভূমিতে শস্য ফললো। পূর্বের মত সংবরণ রাজ্যকে প্রাণবন্ত করে তুললেন।


এ সময় তপতী গর্ভবতী হলেন। তপতীর পুত্র হলেন শ্রষ্ঠ কুরু। কুরুর খ্যাতি অবিসংবাদিত(সর্বসম্মত)। সে জন্যই তার কুলের নাম হল কুরুবংশ।
পুরোহিত বশিষ্ঠ মুনির সাহায্যেই রাজা সংবরণ ধর্ম, অর্থ, কাম পেলেন।
হে অর্জুন, এই তপতীর গর্ভজাত কুরুর বংশধর হলেন আপনারা পাঁচভাই। সে কারণে আমি আপনাদের তাপত্য সম্বোধন করেছিলাম।

বংশের পূর্বকথা শুনে অর্জুন হরষিত হলেন। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন– রাজা সংবরণকে রক্ষা করলেন যে শ্রেষ্ঠ পুরোহিত বশিষ্ঠ মুনি, তার সম্পর্কে কিছু বলুন।

গন্ধর্ব বলেন- বশিষ্ঠ মুনি বিখ্যাত তার তপস্যার জন্য। তার গুণ, কাজ বর্ণনাতিত। তিনি কাম ও ক্রোধকে জয় করতে পেরেছিলেন। বিশ্বামিত্র বহুবার তাকে বিরক্ত করলেও বশিষ্ঠ তাকে কিছু বলেননি। ইক্ষ্বাকু(বৈবস্বত মনুর পুত্র, সূর্যবংশীয় প্রথম রাজা) বংশের রাজা এঁনার বুদ্ধিবলেই নিষ্কন্টক বৈভব ভোগ করেন ভূমন্ডলে।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।
....................................

Saturday, November 1, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৭

অর্জ্জুন-অঙ্গারপর্ণ সংবাদঃ

ব্যাসদেব পঞ্চপান্ডবকে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের অদ্ভূত আয়োজনের কথা শোনান। দ্রুপদরাজের আমন্ত্রণে বহু রাজরাজেশ্বর এসেছেন পাঞ্চালনগরে। রাজা অদ্ভূত এক লক্ষ্য রচনা করেছেন, সেই লক্ষ্যভেদ শক্তি কারও নেই। অর্জুন গিয়ে সেই লক্ষ্য সভা মাঝে ভেদ করবেন। এভাবে পাঞ্চালকন্যা প্রাপ্ত হবে। মুনি তাদের শীঘ্র পাঞ্চাল যেতে বললেন এবং নিজস্থানে ফিরে গেলেন।

মা কুন্তীদেবীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করলেন। দিনরাত্রি তারা পথ চললেন। নানা দেশ, নদ-নদী, গ্রাম পেরলেন। বিশ্রাম নেওয়ার সময় তাদের নেই। ঘোর রজণীতেও ধনঞ্জয় অর্জুন আগে আগে মশাল ধরে পথ দেখিয়ে চলেন। কয়েকদিন চলার পর তারা সন্ধ্যায় গঙ্গাতীরে পৌছলেন। সেখানে স্ত্রীসহ এক গন্ধর্ব বিহার করছিলেন।

পান্ডবদের শব্দ শুনে তাদের ডেকে তিনি বলেন – মানুষ হয়েও দেখি তোমাদের খুব অহঙ্কার! প্র্য়াগগঙ্গার মাঝে আমার বাস। প্রাতঃসন্ধ্যার পূর্বকাল পর্যন্ত সমস্ত রাত্রি যক্ষ-গন্ধর্ব -রাক্ষসদের, অবশিষ্ট কাল মানুষের। রাত্রিতে কোন মানুষ, এমন কি সসৈন্য নৃপতিও যদি জলের কাছে আসে তবে ব্রহ্মজ্ঞরা নিন্দা করেন। আমি কুবেরের সখা গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ এই বন আমার, তোমরা এখান থেকে দূরে চলে যাও।

গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ

অর্জুন বলেন– সমুদ্র, হিমালয় পার্শ্বে এবং এই গঙ্গায় দিনে, রাত্রিতে বা সন্ধ্যায় কারও আসতে বাঁধা নেই। তোমার কথায় কেন আমরা গঙ্গার পবিত্র জল স্পর্শ করব না!

তখন অঙ্গারপর্ণ পান্ডবদের উদ্দেশ্যে অনেকগুলি বাণ ছুঁড়লেন। অর্জুন তার মশাল ও ঢাল ঘুরিয়ে সমস্ত বাণ নিরস্ত করে দ্রোণের থেকে পাওয়া প্রদীপ্ত আগ্নেয় অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। গন্ধর্বরাজের রথ পুড়ে গেল। তিনি রণে ভঙ্গ দিয়ে পালালেন। অর্জুন তাকে তাড়া করে তার চুলের মুঠি ধরলেন।

স্বামীর ঘোর বিপদ বুঝে গন্ধর্বের স্ত্রী কুম্ভীলসী যুধিষ্ঠিরের পায়ে পরে স্বামীর হয়ে ক্ষমা চাইলেন। তিনি বলেন- সাধু শ্রেষ্ঠ তুমি ধর্ম অবতার। তোমার আশ্রয়ে সবার দুঃখমোচন হয়। এই পরম সঙ্কটে আমাদের উদ্ধার কর। সহস্র সতীনের সাথে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দাও।

নারীর শোকাশ্রু দেখে যুধিষ্ঠিরের মন আদ্র হল। তিনি অর্জুনকে গন্ধর্বরাজকে ছেড়ে দিতে আজ্ঞা দিলেন। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে অর্জুন তাকে ছেড়ে দিলেন।

যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে অর্জুন অঙ্গারপর্ণকে ছেড়ে দিলেন

গন্ধর্বরাজ জোড় হাতে বিনয়ের সাথে বলেন– আমায় আপনি প্রাণদান করলেন, আমিও আপনাকে কিছু দিতে চাই। অদ্ভূত চাক্ষুসী বিদ্যা আমি আপনাকে দান করতে চাই। আপনি ত্রিলোকের যা কিছু দেখতে ইচ্ছা করবেন, এই বিদ্যা বলে তাতে দেখতে পাবেন। মনু এ বিদ্যা চন্দ্রকে দিয়েছিলেন। পরে তিনি তা আমায় দান করেন। আজ তা আমি আপনাদের দেব। এছাড়া আপনাদের প্রতি ভাইকে একশত দিব্যবর্ণ বেগবান গন্ধর্বদেশীয় অশ্ব দিচ্ছি, এরা প্রভূর ইচ্ছানুসারে উপস্থিত হয়। পূর্বে ইন্দ্র বেত্রাসুরে বজ্র দিয়ে প্রহার করেছিলেন। অসুরের মুন্ডে বজ্র শতখান হল। স্থানে স্থানে সেই বজ্রকে নিয়োগ করা হল। সবার শ্রেষ্ঠ বজ্র ব্রাহ্মণের বচন। শূদ্ররা কাজ করে, বজ্র তাদের সেবা করে। বৈশ্যরা দান করেন- বজ্র তাদের ও বলে। ক্ষত্রিয় হয়ে আপনার সেই শক্তির বজ্রে আমার রথ আজ দগ্ধ হল। সে কারণে আপনাকে এই অশ্বদান করবো।
অর্জুন বলেন– গন্ধর্ব, আপনার প্রাণ সংশয়ে ভীত হয়ে যা আমাকে দিতে চাইছেন, তা নিতে আমার প্রবৃত্ত হচ্ছে না।

.....................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers