[পূর্বকথা - পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ......অর্জুন, ভীম নকুল ও সহদেব সে কারণে দ্বিগ্বিজয় যাত্রা করেন......চারদিকে ধন্য ধন্য ধ্বনি উচ্চারিত হয় ......যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... চারদিকে দূতদের আমন্ত্রণের জন্য পাঠান শুরু হল...... মুনিরা হোম যজ্ঞের আয়োজন শুরু করেন......]
দেবগণকে নিমন্ত্রণ করিতে অর্জ্জুনের যাত্রাঃ
জন্মেজয় বৈশম্পায়ন মুনিকে বলেন –হে মুনিবর, কে কোন দিক থেকে এলো শুনলাম। কত সৈন্য নিয়ে এল এবং পিতামহ যুধিষ্ঠিরকে কে কি ভেট দিলেন সব শুনলাম। কিন্তু পার্থ কিভাবে দেবতাদের নিমন্ত্রণ করতে গেলেন-তা জানতে ইচ্ছে হয়। দেব পশুপতিও কি এসেছিলেন! সব কথা বিস্তারিত বলে মনের ধন্দ ভাঙ্গুন। পিতামহদের কথা আমায় মকরন্দের(পুষ্পমধু) মত টানে।
মুনি বলেন –হে নরপতি, তবে কিছু প্রধান প্রধান কথা শুনুন।
কপিধ্বজ আরোহণ করে পার্থ পবন বেগে অশ্ব ছোটালেন। পর্বতে যত রাজা ছিল সকলকে নিমন্ত্রণ করে তিনি কৈলাস পর্বতে গেলেন। কুবেরের সাথে দেখা করে সকল কথা বললেন –ধর্মপুত্র সকলের আশীর্বাদ নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞ করতে চান।
কুবের বলেন –আমি আপনার আমন্ত্রণ স্বীকার করলাম। আমি নিজের সঙ্গীদের নিয়ে যজ্ঞে অবশ্যই অংশগ্রহণ করব।
কুবেরের কথায় প্রীত হয়ে অর্জুন কৃতাজ্ঞলি করে পুনরায় বলেন –দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে আমন্ত্রণ করতে যেতে চাই। কোন পথে যাব, সঙ্গে যদি কোন জ্ঞাতজনকে দেন-খুবই কৃতজ্ঞ হই।
কুবের তখন গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনকে ডেকে বলেন –আপনি অর্জুনকে পথ দেখিয়ে সুরপতি ইন্দ্রের স্থানে নিয়ে যান।
আজ্ঞা পেয়ে চিত্রসেন কপিধ্বজ রথের সারথি হয়ে অর্জুনকে নিয়ে রওনা হলেন।
কিছুদুর গিয়ে হরের ভবন দেখে পার্থ জানতে চান –এটি কার পুরী!
চিত্রসেন বলেন –এখানে ত্রিপুরারি(ত্রিপুর অসুর হন্তা-শিব) বাস করেন। যজ্ঞের জন্য আপনি ত্রিলোচন শিবকে নিমন্ত্রণ করুন। সর্ব কার্যসিদ্ধি হবে হরের আগমনে।
এত শুনে ধনঞ্জয় রথ থেকে নেমে হরগৌরীর সামনে এসে অনেক স্তুতি করেন।
হর খুশি হয়ে বলেন – বর প্রার্থনা করুন।
অর্জুন বলেন –ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করতে চান। সেখানে যদি আপনারা উপস্থিত হন-আমরা কৃতার্থ হই।
হর-পার্বতী হেসে সম্মতি দেন।
হর বলেন –আমি অবশ্যই যজ্ঞে উপস্থিত হয়ে তা নির্বিঘ্নে যাতে হয় তা দেখব।
পার্বতী বলেন –যজ্ঞপুরী গিয়ে ত্রিভুবনের সকলকে আমার প্রসাদে সুখী করব। আমি সংসারে অন্নপূর্ণা নামে খ্যাত। আমার নাম নিয়ে সূপকাররা অল্প দ্রব্যেই সুতৃপ্ত করবে বহুজনকে। সকল কিছু অক্ষয় অব্যয় হবে, অমৃত সমান। যার যাতে মন প্রীত হয় তাই আমি উপস্থিত করব।
হর পার্বতীর বর পেয়ে ধনঞ্জয় তাদের প্রণাম করে আনন্দ মনে চিত্রসেনের সাথে ইন্দ্রের ভবনে চললেন। পবন রথে চিত্রসেন ক্ষণিকেই ইন্দ্রের সামনে উপস্থিত হলেন। দেবরাজকে পার্থ ভুমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করেন।
ইন্দ্র পার্থকে উঠিয়ে আলিঙ্গন করে নিজ কোলে বসিয়ে বলেন –হে তাত(প্রিয়), কি কাজে এখানে এলে!
অর্জুন বলেন –হে দেব, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের কারণে আপনার কাছে পাঠালেন। সেই যজ্ঞে অধিষ্ঠান করে আপনি ও স্বর্গের সব সুর সিদ্ধ মুনিরা আমাদের ধন্য করুন।
ইন্দ্র বলেন –রাজসূয় যজ্ঞের কথা শুনেই যাব স্থির করেছি। তুমি না আসলেও আমি অবশ্যই যেতাম। এই দেখ আমরা দেবতারা সকলে সেখানে যাওয়ার জন্য সুসজ্জিত হচ্ছি। চার মেঘ, অষ্ট হস্তী, সকল পবন নেওয়া হয়েছে। স্বর্গের সকল দ্রব্য যা পৃথিবীতে দুর্লভ সে সব সাজিয়ে নিচ্ছি সব তোমাদের যজ্ঞের কারণ। আমি এই যজ্ঞেরস্থানে রওনা দিচ্ছি। তুমি নিশ্চিন্ত মনে অন্যদের নিমন্ত্রণ করতে যাও।
ইন্দ্রের মুখের কথা শুনে আনন্দিত মনে পার্থ তাকে প্রণাম জানিয়ে অন্যদিকে গমন করলেন।
পৃথিবীর দক্ষিণে সূর্যের পুত্র যমের ভবন। সেখানেই চিত্রসেন পবন বেগে রথ চালালেন। মুহূর্তে তারা প্রেতপতির ভবনে উপস্থিত হলেন।
অর্জুন যমালয়ে যমদেবকে প্রণাম করলে যমরাজ আশীর্বাদ করে বলেন –হে ইন্দ্রপুত্র অর্জুন! কি কারণে আপনার আগমন! আমি আপনার জন্য কি করতে পারি বলুন।
অর্জুন বলেন –হে দেব, রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেছেন রাজা যুধিষ্ঠির। আপনি সেখানে আপনার সকল সাথীদের নিয়ে উপস্থিত হলে তিনি খুবই খুশি হবেন।
যমরাজ শমন তার আমন্ত্রণ স্বীকার করলেন।
পার্থ পুনরায় জোড়হাতে বলেন –হে রাজন, নারদ মুনি আপনার সভার কথা আমাদের বলেছিলেন। মর্তে যারা মারা যান তারা আপনার ভবনে স্থান পান শুনেছি। এখানে আমাদের পিতা পান্ডূর মনোবাঞ্ছা মেনেই এই রাজসূয় আরম্ভ হচ্ছে। কিন্তু এখানে তো আমার পিতা পিতামহদের দেখছি না, তারা কোথায় আছেন, যদি বলেন ধন্য হই।
হেসে যম বলেন –মৃতজনদের তুমি দেখবে কি করে! জীবন্ত মানুষ ও মৃত মানুষের দেখা হওয়া কখনও সম্ভব নয়।
শুনে পাণ্ডূপুত্র বিস্ময়াপন্ন হলেন। যমের কাছ থেকে মেলানি নিয়ে তিনি বরুণালয়ে চললেন।
পশ্চিম দিকে জলপতির আলয়। সেখানে পৌছে বরুণকে যজ্ঞের বিবরণ দিয়ে তার পুরীর সকলকে আমন্ত্রণ জানান।
বরুণ বলেন –যজ্ঞে আমার সব অনুচরদের নিয়ে অবশ্যই যাব। তবে দৈত্য দানবদেরও যদি নিয়ে যেতে বলেন তবে তাদের গিয়ে নিমন্ত্রণ যানাতে হবে।
বরুণের কথা শুনে ধনঞ্জয় ময়দানবরাজের কাছে গেলেন। ময়কে পার্থ সকল কথা জানালেন। পূর্বে ময়দানবের উপকারের কথা স্বীকার করে তাকে ধন্যবাদ জানালেন। তারপর জোড়হাতে পার্থ বলেন –হে বন্ধু, এখানে যত দৈত্যদানব আছেন সকলকে নিয়ে আমাদের রাজসূয় যজ্ঞে উপস্থিত হলে আমরা ধন্য হব।
শুনে ময়দানব বলেন –বন্ধু, নিশ্চিন্তে আপনি অন্য কাজে যেতে পারেন। আমি অবশ্যই আমার সকল অনুচরকে নিয়ে যজ্ঞে উপস্থিত হব।
শুনে অর্জুন ময়কে আলিঙ্গন করে পৃথিবীর দক্ষিণে লঙ্কাপুরে বিভীষণকে নিমন্ত্রণ করতে গেলেন। পার্থ রথ চালিয়ে লঙ্কাপুরে উপস্থিত হয়ে অবাক হলেন। ইন্দ্র-যমপুরীর সমান সুন্দর নির্মাণ এই রাক্ষসদের লঙ্কাপুরী। পুরী ঘুরে পার্থ খুশি হলেন। আনন্দ মনে রাজা বিভীষণের কাছে গেলেন। সিংহাসনে বসে রাক্ষস-ঈশ্বর বিভীষণ। ইন্দ্রপুত্র পার্থ তাকে প্রণাম করেন।
বিভীষণ বলেন –আপনি কে!
অর্জুন তখন নিজ পরিচয় দিয়ে বলেন –যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ করছেন। যদুবীর শ্রীকৃষ্ণ আপনাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
অর্জুনের মুখে সব কথা শুনে হৃষ্ট মনে তাকে আলিঙ্গন করে বসিয়ে বিভীষণ বলেন –অবশ্যই আপনাদের এই যজ্ঞ দেখতে যাব। আমার সৌভাগ্য আমি নারায়ণের সাক্ষাৎ করতে পারব। আপনার কথা মত পুরীর সকলকে সঙ্গে নিয়ে যাব। আপনি নিজ কাজে নিশ্চিন্ত মনে যান।
বিভীষণকে নিমন্ত্রণ করে অর্জুন নিজ রাজ্য ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এলেন।
অন্যান্য রাজাদের নিমন্ত্রণ করতে অন্য দূতরা গেল। শোনামাত্র রাজারা সকলে আসল।
দূত বাক্য অবহেলা করে যে আসল না অর্জুন তাদের বন্দি করে আনলেন।
সভাপর্ব সুধারস রাজসূয় কথায়, কাশীরাম দাস কহেন সুধাসিন্ধু গাঁথায়।
......................................
[পূর্বকথা - পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ......অর্জুন, ভীম নকুল ও সহদেব সে কারণে দ্বিগ্বিজয় যাত্রা করেন......চারদিকে ধন্য ধন্য ধ্বনি উচ্চারিত হয় ......যুধিষ্ঠিরের ভাইরা, মন্ত্রী, সুহৃদ বন্ধুরা সকলে এবার যজ্ঞ শুরুর অনুরোধ করলেন......যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অপেক্ষা করেন ....কৃষ্ণ অনুমতি দিলে যজ্ঞের আয়োজন হয় ....... চারদিকে দূতদের আমন্ত্রণের জন্য পাঠান শুরু হল......]
রাজসূয়-যজ্ঞ আরম্ভঃ
রাজা যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা পেয়ে মদ্রসুতাসুত সহদেব দূত পাঠিয়ে শিল্পীদের আনলেন। নানা রত্ন তাদের হাতে তুলে দেওয়া হল। কোটি কোটি শিল্পীরা অতি যত্নে চারদিক সাজাতে লাগল।
দেবতাদের মন্দির স্বর্ণ রত্নে নির্মিত হল। হেম(সোনা) রত্ন মুক্তায় চারদিক মণ্ডিত হতে লাগল।
এক এক পুরে শত শত রত্ন নির্মিত কক্ষ নির্মাণ করা হল। তাতে বহুতর ভোজ্য পেয়বস্তু রাখা হল।
প্রতি গৃহ আসন, বসন, শয্যা দিয়ে সুন্দর ভাবে সাজান হল।
বাপী(দীঘি) কূপ সুগন্ধযুক্ত জলে পূর্ণ করা হল। চারদিক সুমিষ্ট গন্ধে আমোদিত হতে লাগল।
কনক(সোনা) রজত(রূপা) পাত্রে ভোজনের ব্যবস্থা করা হল। প্রতি পুরে শত শত দূত নিয়োগ করা হল।
এভাবে লক্ষ লক্ষ গৃহ সহ নগর মনোহর স্থলে রূপান্তরিত হল। সব গৃহের বাইরে নানান ফুল ফলের বৃক্ষ যত্নে রোপিত হল।
ধিরে ধিরে চার জাতির মানুষরা এসে সে সব গৃহে বাস করতে লাগল।
চারদিকের অপূর্ব সুন্দর নির্মাণশৈলী দেখে সকলে মোহিত হতে লাগল।
ইন্দ্রসেন প্রমুখেরা ভোজ্য দ্রব্যের ব্যবস্থা সুসংহত ভাবে করতে লাগল। অষ্টদিক থেকে নিরন্তর দ্রব্যসামগ্রী আসতে লাগল। হাতি, উট, বৃষের লক্ষ লক্ষ শকটে(গাড়ি), এমনকি বড় বড় নৌকায় করে ভক্ষ্য দ্রব্য আনা হতে লাগল। দিন-রাত্রি-সায়ং-প্রাত বিশ্রাম নেই-অনুক্ষণ অবিরাম দ্রব্য আসতে লাগল।
ময়দানবের নির্মিত অপূর্ব সভার বাখান(প্রশংসা) সকল সুরাসুর মুনিরা করতে লাগলেন।
দ্বিজ মুনিরা সবাই দিক্ষা করালেন।
কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস স্বয়ং ব্রহ্মত্ব(ব্রহ্মতুল্য পদ) করলেন। সাগম হলেন ধনঞ্জয় তপোধন। হোতা হলেন পৈল ও অন্যান্য দ্বিজ ব্রাহ্মণরা। এছাড়া আরো বিভিন্ন কাছে অন্যান্য মুনিরা নিয়োজিত হলেন।
ধর্ম নরপতি যুধিষ্ঠির নকুলকে ডেকে বলেন – তুমি হস্তিনানগরে দ্রুত গিয়ে ভীষ্ম, দ্রোণ, জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র, বিদুরদের সঙ্গে নিয়ে এসো। সেই সাথে কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, সুহৃৎ দুর্যোধন, বাহ্লীক(মহারাজ শান্তনুর ছোটভাই, সোমদত্তের পিতা ও ভূরিশ্রবার পিতামহ), সঞ্জয়(ধৃতরাষ্ট্রের সৎ পরামর্শদাতা ও সারথি), ভূরিশ্রবা, সোমদত্ত, কর্ণ, দুঃশাসন ও শত ভাই, জয়দ্রথ(ধৃতরাষ্ট্রের জামাই) এবং গান্ধারীসহ সকল রাজপত্নীদের সাদরে এখানে নিয়ে এসো। এরা সকলেই আমায় স্নেহ করেন।
বড়ভাইয়ের আজ্ঞামত বীর নকুল হস্তিনানগরে উপস্থিত হয়ে রাজসূয় যজ্ঞের সংবাদ দিয়ে সকলকে সেখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। সকলে হৃষ্ট মনে তার সাথে যেতে রাজি হল। কুরুপুরের বাল, বৃদ্ধ, নারী আদি সকলে চলল। হস্তিনানগরের প্রজারা যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সংবাদে খুশি হল।
দ্বিজ, ক্ষত্র, বৈশ্য, শূদ্র-সকল প্রজারা দলে দলে হস্তিনা ছেড়ে যজ্ঞ দেখতে চলল।
হাতি, রথ, অশ্ব, পত্তি(পদাতিক সৈন্য) চতুরঙ্গ দলে কুরুরা নকুলের সাথে ইন্দ্রপ্রস্থে প্রবেশ করল। তাদের দেখে আনন্দিত মনে যুধিষ্ঠির সকলের কুশল সংবাদ নিতে লাগলেন।
ধর্মরাজ নিজে এগিয়ে এসে ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, বাহ্লীক ও অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্রকে নিজের কাছে এনে বসালেন।
পার্থ অর্জুন বিনয়ের সাথে সকলকে বলেন –আপনাদের সাহায্য ছাড়া এতবড় যজ্ঞ সুসম্পন্ন করা সম্ভব নয়। আপনাদের আশীর্বাদ আমাদের সাথে যেন থাকে।
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মকে বলেন –আপনি সর্ব জেষ্ঠ। আপনি সব বুঝে শুনে আমাদের বিধান দিন। কিভাবে কি কাজ হবে আপনার নির্দেশেই আমরা করতে চাই। কাকে কোথায় নিযুক্ত করতে চান আপনি ঠিক করে দিন।
ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরের সাথে অনেক বিচার করে সকলকে কর্মভার ভাগ করে দিলেন।
ভীষ্ম ও দ্রোণ কোন কাজ করা হবে কি হবে না তা স্থির করবেন। দুর্যোধনকে সকল ভান্ডারের ভার দেওয়া হল।
দুঃশাসন পেল ভক্ষ্য ভোজ্যের রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার।
গুরুপুত্র অশ্বত্থামা ব্রাহ্মণদের পূজার ভার পেল।
সঞ্জয় রাজাদের সেবাকাকার্য ভার পেল।
দ্বিজদের দক্ষিণার দায়িত্ব পেলেন কৃপাচার্য।
দানের অধিকারী হলেন কর্ণ।
কৃষ্ণ স্বয়ং সকলের পরিচর্যার ভার নিলেন।
ধৃতরাষ্ট্র, সোমদত্ত, প্রতীকপুত্র বাহ্লীক-এই তিনজন গৃহকর্তা হয়ে সর্বেশ্বর হলেন।
সভার পূর্ব দ্বার রক্ষার ভার নিয়োজিত হল মহারথীদের উপর। সহস্র সহস্র রথী তরবারি নিয়ে প্রস্তুত হল।
মহাবীর ইন্দ্রসেন পূর্ব দ্বারে নিযুক্ত হল।
উত্তর দ্বারে অনিরুদ্ধকে(কৃষ্ণের পৌত্র) নিয়োগ করা হল। ষাট সহস্র যোদ্ধা তার সাথে রইল।
সাত্যকি(কৃষ্ণের ভক্ত, যদুবংশীয় বীর, সত্যকের পুত্র ও শিনির পৌত্র) দক্ষিণ দ্বারের ভার নিলেন। বিশ সহস্র রথী তার সাথে থাকল।
পশ্চিম দ্বারের ভার পেল ধৃতরাষ্ট্রের বীরপুত্রেরা। তাদের সাথে অযুত পরিমাণ রথী যুগল রইল। সকলের হাতে নিগড়(বেড়ি) বেত ও নানা অস্ত্র, সেসব নিয়ে তারা দ্বারে রক্ষণ দেয়।
সকলকে দেখার জন্য বৃকোদর ভীম এক লক্ষ রথীকে নিয়ে নিরন্তর ভ্রমণ করতে লাগলেন।
রাজাদের আগমনবার্তা জ্ঞাত করবার অধিকার পরল দুই মাদ্রীকুমার নকুল ও সহদেবের উপর।
এভাবে সবাইকে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির যজ্ঞ আরম্ভ করলেন।
দূত মুখে নিমন্ত্রণবার্তা পেয়ে সসৈন্য রাজারা যজ্ঞ স্থানে উপস্থিত হতে লাগল। তাদের সাথে তাদের প্রজারা-দ্বিজ, ক্ষত্র, বৈশ্য, শূদ্র সকলে আনন্দ করতে করতে আসতে লাগল। সকল রাজারা পাণ্ডবদের উপর প্রীত হয়ে সঙ্গে নানাবর্ণের বিভিন্ন রত্ন উপহার আনল।
কেউবা পৌরুষ দেখাবার জন্যেও প্রচুর রত্ন মানিক্য সঙ্গে আনল। কেউ কেউ যজ্ঞের কারণে বহু ধন দান করল। হাতি, উট, বৃষের শকট ভর্তি করে, নৌকা ভরে ভরে বৈদূর্য্য মণি, মরকত, নীলা, প্রবাল, মুক্তা, হীরা, প্রচুর সুবর্ণ যেমন এল, তেমনি বিচিত্র বসন, নানাবর্ণের শাল-সেসব নানাবর্ণের কীটের তৈরী, নানা পশুর লোমের অপূর্ব নির্মাণ। হাতি, ঘোড়া, রথ, পত্তি(পদাতিক সৈন্য), গবী অগণিত এল।
চতুর্দোলায় করে দিব্যসুন্দরী নারীরা আসতে লাগল। তাদের তমাল শ্যামল অঙ্গ, কুরঙ্গ(হরিণ) লোচন। সঙ্গে প্রচুর অগুরু চন্দন কাষ্ঠ, কুঙ্কূম, কস্তূরী। তাদের সাথে খাঁচায় করে এলো তাদের নানাবর্ণের পোষা পাখি।
এভাবে পৃথিবীর সব রাজারা দূত মুখে আমন্ত্রণ পেয়ে সপরিবারে আসতে লাগলো।
উত্তরে হিমাদ্রি পর্বত থেকে দক্ষিণে লঙ্কাদেশ, পশ্চিমে সিন্ধু নদী থেকে পূর্বে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পথ দিবানিশি মানুষের ঢল। সকলের গন্তব্য রাজসূয় যজ্ঞ স্থল।
হাতি, ঘোড়া, রথ, পত্তি সঙ্গে নানা বাদ্যযন্ত্র, ধ্বজা, ছত্র, পতাকায় মেদিনী(পৃথিবী) ঢাকল। জল-স্থল, উচ্চ-নীচ ক্ষিতিকে (পৃথিবী) আর দেখাই যায় না। দিবারাত্রি অবিশ্রাম লোকের যাতায়াত চলতে থাকে।
চারদিক থেকে সব রাজা এসে সভার দ্বারে উপস্থিত হলেই ধনঞ্জয় সকলকে সাদরে অভ্যর্থনা করে তাদের গৃহে নিয়ে যান।
তেমনি দিনরাত ধরে আসমুদ্র হিমাদ্রি থেকে কত যে দ্বিজ ব্রাহ্মণ এল গুণে শেষ করা যায় না।
রাজসূয় যজ্ঞের কথা কানে শুনে অনেকেই বিনা আমন্ত্রণে তা দেখতে উপস্থিত হল।
জলবাসী, স্থলবাসী, পর্বতনিবাসী লক্ষ লক্ষ যোগী ও সিদ্ধ ঋষিরাও উপস্থিত হল।
দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা সব ব্রাহ্মণ যোগীদের পূজা করে আসন দেয়।
এক কোটি দ্বিজকে অশ্বত্থামা পূজা করলো অনেক উপহার দিয়ে।
বহু ক্ষত্র, বৈশ্য, শূদ্র উপস্থিত হল। তাদের সেবার ভার দুঃশাসন নিল।
কোটি কোটি সুপকার(পাচক) দিয়ে রন্ধন করিয়ে অন্য বহু সুপকার দিয়ে পরিবেশন করান হতে লাগল।
এমনকি গৃহে গৃহে স্থানে স্থানে গিয়ে সুন্দর ভাবে খাদ্য পরিবেশন করা হতে লাগল।
এই কাজে দুঃশাসন প্রতি মুহূর্তে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে লাগল। তাকে তার অনুচরেরা বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করতে লাগল। পায়স, পিষ্টক, অন্ন, ঘৃত, দুগ্ধ, দধি-এমন পঞ্চাশ ব্যঞ্জন যথাবিধি মত চারি জাতের মানুষজন পৃথক ভাবে সেবা পেতে লাগল।
সুবর্ণ পাত্রে দ্বিজ ও নৃপদের পরিবেশন করা হল। চারিদিকে ‘খাও, খাও’, ‘লও, লও’ ধ্বনি শোনা গেল, আর কোন কথা যেন কেউ বলতে শেখেনি।
এরপর বিচিত্র পালঙ্ক শয্যায় আসন পেতে বসে, কুঙ্কূম-কস্তূরী-মালা গলায় দিয়ে, অগুরু-চন্দন মেখে, কর্পূর-তাম্বুল প্রীত মনে সেবন করতে লাগল। কোথা থেকে কে যে এত কিছু চাওয়া মাত্র উপস্থিত করছে বোঝা গেল না।
এভাবে স্বর্গের ইন্দ্রসহ সকল দেবতারা, পাতালের ভুজঙ্গরাজ, লঙ্কার বিভীষণ –দেব, দৈত্য, দানব, গন্ধর্ব, যক্ষ, রক্ষ, সিদ্ধ, সাধ্য, ভুজঙ্গ, পিশাচ, প্রেতপক্ষ, কিন্নর, বানর, নর যত পৃথিবীতে আছে সবাই দিনরাত যজ্ঞস্থান ঘিরে রইল।
দ্বাপর যুগে এভাবে অবাক করার মত এক যজ্ঞ শুরু হল। এমনটি ক্ষিতি মাঝে আগে আর হয় নি, পরেও আর হবে না।
সময় বুঝে কৃষ্ণ মুনিদের বলেন –রাজ অভিষেক কর্ম শুরু করা হোক!
কৃষ্ণের অনুরোধে মুনিরা অভিষেক শুরু করেন। নানা তীর্থের জল নিয়ে ধৌম্য, দ্বৈপায়ন, অসিত, দেবল, জামদগ্ন্য, পরাশর-আরো অনেক দ্বিজ মুনিরা স্নানমন্ত্র পড়তে থাকেন।
শুভক্ষণ দেখে ব্যাসদেব ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে স্নান করালেন।
অম্লান বসন দিলেন গন্ধর্বরাজ চিত্ররথ(অঙ্গারপর্ণ)।
শিরে ধবল ছত্র সাত্যকি ধরলেন।
চেদিরাজ শিশুপাল পাগড়ি পরাল।
বৃকোদর ও পার্থ ব্যজন(বাতাস) করতে লাগলেন।
দুই মাদ্রীপুত্র নকুল ও সহদেব চামর দুলাতে লাগলেন।
অবন্তীর রাজা বিন্দ-অনুবিন্দ চর্ম পাদুকা দিল।
খড়্গ ছুরি নিয়ে মদ্ররাজ শল্য সামনে দাঁড়ালেন।
চেকিতান(যাদব যোদ্ধা) শর তূণ নিয়ে বামে দাড়াল।
কাশীর ভূপাল ধনুক নিয়ে দক্ষিণে দাঁড়ালেন।
নারদাদি মুনিরা বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন। দ্বিজ ব্রাহ্মণদের স্বস্তি ধ্বনি গগন স্পর্শ করতে লাগল।
গন্ধর্বেরা গীত শুরু করল, অপ্সরারা নৃত্য।
শ্রীহরি পঞ্চজন্য বাজিয়ে চারদিক ধ্বনিত করে তোলেন। সেই শঙ্খের শব্দ গগনভেদ করল। সভার সকলে সেই শব্দে ঢলে পড়ল।
কেবল বাসুদেব, পঞ্চপাণ্ডব, পাঞ্চাল নন্দন ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকি এই আটজন স্বজ্ঞানে রইলেন।
ধর্মপুত্র শেষে সেই শঙ্খনাদের মোহ নিবারণ করলেন।
দ্বৈপায়ন আদি মুনি সহ ধৌম্য রাজপুরোহিত বেদ অনুসারে যুধিষ্ঠিরের অভিষেক করলেন।
সভাপর্বের সুধারস এই রাজসূয় কথায়, কাশীরাম দাস কহেন এই ভারতের গাঁথা।
......................................
[পূর্বকথা - পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ......অর্জুন, ভীম নকুল ও সহদেব সে কারণে দ্বিগ্বিজয় যাত্রা করেন......চারদিকে ধন্য ধন্য ধ্বনি উচ্চারিত হয় ......যুধিষ্ঠিরের ভাইরা, মন্ত্রী, সুহৃদ বন্ধুরা সকলে এবার যজ্ঞ শুরুর অনুরোধ করলেন......যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অপেক্ষা করেন ....কৃষ্ণ অনুমতি দিলে যজ্ঞের আয়োজন হয় ....... ]
রাজসূয়-যজ্ঞ প্রসঙ্গঃ
কৃষ্ণের অনুমতি পেয়ে রাজা যুধিষ্ঠির হৃষ্ট মনে সহদেবকে ডেকে আজ্ঞা করে বলেন –রাজপুরোহিত ধৌম্যের কাছ থেকে জেনে এস রাজসূয় যজ্ঞে কি কি দ্রব্যের প্রয়োজন। সেই মত দ্রব্য সামগ্রী দ্বিগুণ পরিমাণ সংগ্রহ কর। পৃথিবীতে যত রাজা আছেন সকলকে সসৈন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
এছাড়া দ্বিজ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-সকল জাতির মানুষের কাছে আমন্ত্রণের জন্য দ্রুত দূত পাঠানোর ব্যবস্থা কর।
ইন্দ্রসেন(যুধিষ্ঠিরের সারথি), বিশোক(ভীমের সারথি) ও অর্জুন সারথিকে ভক্ষ্য বস্তু সংগ্রহের জন্য নিযুক্ত কর।
ব্রাহ্মণদের প্রিয়কার্য সম্পূর্ণ করার জন্য ভাল ভাল বস্তু কাতারে কাতারে আনার ব্যবস্থা কর।
চর্ব্য, চুষ্য, লেহ্য, পেয়-বহুতর ব্যবস্থা কর। রসে, গন্ধে যেন সকল কিছু মনোহারি হয়।
যখন যে যা চাইবে সঙ্গে সঙ্গে তা যেন পান, তার ব্যবস্থা রেখ। এর জন্য স্থানে স্থানে প্রচুর কর্মচারী নিয়োগ কর।
দ্বিজদের নিমন্ত্রণের জন্য সত্যবতীসুত ব্যাসদেবকে রাজ্যে রাজ্যে নিজ দূত প্রেরণের অনুরোধ কর।
এভাবে সহদেবকে যুধিষ্ঠির নির্দেশ দিলেন।
তারপর পুনরায় কৃষ্ণের কাছে গিয়ে অনুরোধ করে বলেন –হে নারায়ণ! আপনি আজ্ঞা দিন কাদের কাদের নিমন্ত্রণ করা হবে।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন –মহারাজা হরিশচন্দ্র যেমন রাজসূয় যজ্ঞ করেন, তেমন ব্যবস্থা করতে হবে। তার যজ্ঞে পৃথিবীর সকল রাজারা আসেন। আপনিও ত্রিভুবনের সকল লোকদের নিমন্ত্রণের ব্যবস্থা করুন।
ইন্দ্র, যম, বরুণ, কুবের আদি সকল দেবসুর যারা সুরপুরে আছেন তাদের, পাতালে নাগরাজ শেষ বিষধরকেও নিমন্ত্রণ করতে হবে। পৃথিবীর প্রতি রাজরাজেশ্বর যেন আমন্ত্রণ পান।
যুধিষ্ঠির বলেন – হে প্রভু! কোন দূত কোথায় নিমন্ত্রণ করতে যাবেন সেটিও স্থির করে দিন। স্বর্গে দেবতাদের নিমন্ত্রণ করতে যাওয়ার ক্ষমতা সকলের তো নেই!
কৃষ্ণ বলেন –দেবতাদের নিমন্ত্রণের ক্ষমতা কেবল মহারথী পার্থের আছে, সেখানে তিনিই যাবেন। অগ্নিদেবের উপহার দেওয়া কপিধ্বজ রথ যেটি চারটি শ্বেত অশ্বের দ্বারা চালিত সেই রথের অগম্য স্থান ত্রিভুবনে নেই। সে রথ একদিনেই তিনলোক ভ্রমণ করতে পারে। সেই রথে চড়ে পার্থ উত্তর দিকে গিয়ে সকলকে নিমন্ত্রণ করুন।
উত্তরের পর্বতের গভীর কাননে যে রাজারা থাকেন সেখানে মনুষের কি ক্ষমতা পক্ষীরাও প্রবেশ করতে পারে না সেখানে গিয়েও তিনি নিমন্ত্রণ করবেন।
তারপর কৈলাস পর্বতে যেখানে বৈশ্রবণ(বিশ্রবামুনির পুত্র) কুবের থাকেন সেখানে তাকে নিমন্ত্রণ করে তার কাছে মনুষ্য অগম্য স্বর্গে যাওয়ার পথ নির্দেশ নেবেন।
ইন্দ্রসহ ইন্দ্রপুরে যত দেবতারা, দেব-ঋষি, ব্রহ্ম-ঋষি বসেন সকলকে নিমন্ত্রণ করবেন।
তারপর বরুণের পুরী গিয়ে সকলকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে মৃত্যুর অধিকারী যমপুরী যাবেন। সেখানে গিয়ে নিমন্ত্রণ জানালে তবেই ধর্ম এই যজ্ঞে অংশগ্রহণ করবেন।
আর আখন্ডল ইন্দ্র অর্জুনকে স্নেহ করেন। তিনি আমন্ত্রণ পেলেই খুশি মনে যজ্ঞ স্থানে উপস্থিত হবেন। আর ইন্দ্র একবার এলেই সকল এখানে আসবেন।
এভাবে দেবতা, গন্ধর্ব, দৈত্য, সিদ্ধ, সাধ্য ঋষি, পর্বত, সমুদ্র, অন্তরীক্ষবাসীরা সকলে উপস্থিত হবেন।
যেখানে যার সাথে দেখা হবে তাকেই সাদর আমন্ত্রণ যানাতে ভুলবেন না।
লঙ্কায় গিয়ে বিশেষ ভাবে বিভীষণকে বরণ করতে হবে। এই রাক্ষসরাজ পরম বৈষ্ণব। ইনি ধার্মিক, সুমতি ও আমার অনুরক্ত, পরমভক্ত। তিনি যদিও দূতের মাধ্যমে সংবাদ পেলেও উপস্থিত হবেন আমি জানি। তবু তাকে নিজে গিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে আসতে হবে। তিনি রাক্ষসদের মধ্যে ইন্দ্রের সমান। এভাবে সবাইকে নিমন্ত্রণ করুন।
তবে যে সব দুষ্ট নৃপরা নিমন্ত্রণ পেয়েও আসতে চাইবে না, তাদের বেঁধে আনার নির্দেশ দেবেন।
উত্তরে যেমন পার্থ যাবেন তেমনি আরো বাকি তিনদিকেও দূত পাঠান হোক। সকল মহীপালদের কাছে আমন্ত্রণবার্তা পৌছতে হবে।
দেব দামোদরের আজ্ঞা পেয়ে রাজা দ্রুত দূতদের ডেকে তাদের হাতে রাজাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞের বিবরণ লিখে নিমন্ত্রণ জানালেন। এমনকি সে সকল দেশের দ্বিজ, ক্ষত্র, বৈশ্য, শূদ্র যত আছে তাদেরও আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। সকলে নিজেদের রাজ্য থেকে এসে এই রাজসূয় যজ্ঞস্থলে উৎসব দেখবে-এই রাজার মনের ইচ্ছা।
তিনলোকে দূত পাঠিয়ে উত্তরে ইন্দ্রসুত অর্জুন নিজে যাত্রা করলেন।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।
......................................
[পূর্বকথা - পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ......অর্জুন, ভীম ও সহদেব সে কারণে দ্বিগ্বিজয় যাত্রা করেন]
নকুলের দিগ্বিজয়ঃ
পশ্চিমদিকে গেলেন নকুলবীর। সঙ্গে গেল বহু গজ, বাজি(ঘোড়া), রথ, রথী ও পদাতিক। তাদের সিংহনাদ, শঙ্খনাদ, ধনুকের টঙ্কার, রথের নির্ঘোষে(প্রচন্ড শব্দ) সংসার স্তব্ধ হল।
প্রথমে তার সাথে রোহিতক দেশের রাজার যুদ্ধ হল। এই রাজার সমর-সখা হলেন ময়ূরবাহন। ফলে তার সৈন্যবাহিনী শিখী(ময়ূর)পূর্ণ। নকুলের সাথে তাদের অপ্রমিত যুদ্ধ হল, যেন নকুল(নেউল/বেজি)-ভুজঙ্গের(সাপ) যুদ্ধ। নকুল বায়ু অবতার অস্ত্র হানলেন। মহাবজ্রাঘাত শব্দে শিখীরা আতঙ্কিত হল। অনল অস্ত্রে বীর নকুল শিখীদের পাখা পোড়ালেন। ভয়ে শিখীরা রাজাকে একা ফেলে পালাল। রাজাও ভয়ে প্রচুর কর এনে দান করলেন।
সেখান থেকে নকুলবীর মালব, শিরীষ/শৈরীষক, শিবি, বর্বর পুষ্কর প্রভৃতি দেশের রাজাদের জয় করলেন।
পশ্চিম দিগন্তে সিন্ধুনদীকূলে নকুল উপস্থিত হলেন। সরস্বতী তটে যত রাজারা আছে সকলে মাদ্রীপুত্রের বশ্যতা মানল।
খরক, কন্টক আর পঞ্চনদ দেশ জিতে নকুল সৌতিকপুরে প্রবেশ করলেন।
বৃন্দারক, দ্বারপাল নরপতি, প্রতিবিন্ধ্য রাজা প্রমুখদের কাছে দূত পাঠিয়ে কর আদায় হল।
তারপর দ্বারকানগরে দূত গেল। সব শুনে দেবকীপুত্র কৃষ্ণ খুব সুখি হলেন।
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা কৃষ্ণ শিরোধার্য করে শকট(রথ) ভর্তি করে কর পাঠালেন।
এভাবে একে একে বহু দেশ জয় করতে করতে নকুল মাতুলালয় মদ্রদেশে এলেন।শল্য নরপতি সে খবর শুনে ভাগ্নেকে আদর করে এনে বহু উপহার দিলেন। এভাবে সেখান থেকে কর নিয়ে নকুল সমুদ্রতীরে ম্লেচ্ছদেশে গেলেন। সেখানে দারুন দুর্দান্ত সব যবনের বাস। তাদের সবাইকে জয় করে সেখান থেকেও বহু ধন পেলেন। সেখানে যত রাজারা ছিল সকলকে নকুল অনায়াসে জয় করলেন।
এভাবে বহু ধন নিয়ে মহামতি নকুল ইন্দ্রপ্রস্থে প্রত্যাবর্তন করতে লাগলেন। সঙ্গে বহু ধন, মত্ত হাতির দল চলল। ‘জয় জয় বীর’ কোলাহলের মধ্যেই চতুরঙ্গ দল নিয়ে তিনি রাজ্যে প্রবেশ করলেন।
বিভিন্ন দেশ থেকে যত ধন পেয়েছিলেন নকুল সব ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে নিবেদন করলেন।
সব কিছু ভাণ্ডারে সঞ্চিত করে তিনি নিজ আলয়ে বিশ্রাম নিতে গেলেন।
পান্ডব বিজয়-কথা যে যন শুনেন, তার জয় হয়ে থাকে সর্বত্র গমনে।
সভাপর্ব সুধারস বেদব্যাস বিরচিলেন, কাশীরাম দাস তাই কহেন সঙ্গীতের মাধ্যমে।
........................
যুধিষ্ঠিরের রাজ্য-বর্ণনঃ
এভাবে সকল পৃথিবীর সকল রাজারা কর প্রদান করলে ধর্মরায় যুধিষ্ঠির পরমানন্দে যজ্ঞের আয়োজন করতে লাগলেন। এই সত্যপ্রিয় ধর্মের রক্ষক, প্রজা পালক দুষ্ট চোর এবং বৈরী(শত্রু)দের উচিত দন্ড দিতেও পারদর্শী। যজ্ঞ এবং নানা মহোৎসবে দেশ মেতে উঠল। এমন কি সেই সময় অনুসারে জীমূত(মেঘ) বর্ষণ ঘটায়। গবীরাও প্রচুর দুগ্ধ দেয়, শস্য ফলে চতুর্গুণ।
এই স্বপ্নের রাজ্যের মানুষরা যেন প্রতিকুলের রূপই ভুলেছে। ব্যাধিভয়, অগ্নিভয় এই রাজ্য থেকে পালিয়েছে। কারণ ধর্মপুত্র স্বয়ং ধর্মের রূপ নিয়ে রাজ্য শাসন করছেন। ধন্য ধান্যে সংসার পূর্ণ হল। চারদিকে ধন্য ধন্য ধ্বনি উচ্চারিত হতে লাগল। অক্ষয় অব্যয় ধন দেখে সকলে মোহিত হল।
যুধিষ্ঠিরের ভাইরা, মন্ত্রী, সুহৃদ বন্ধুরা সকলে এবার যজ্ঞ শুরুর অনুরোধ করলেন। পৃথিবীর সকল রাজারা এত ধন ও গবী উপহার দিয়েছে যে গুণে শেষ করা সম্ভব নয়। এখন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের অসাধ্য কিছুই নেই। সময়ে কাজ করে নেওয়া উচিত।
এতসব পরামর্শ শুনতে শুনতে রাজা কৃষ্ণের কথা ভাবতে লাগলেন। তখন স্বয়ং কৃষ্ণ সনাতন সেখানে উপস্থিত হলেন।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন শুনেন পুণ্যবান।
.....................
ইন্দ্রপ্রস্থে শ্রীকৃষ্ণের আগমনঃ
শরতের পদ্মের কলির মত অরুণ যুগল নেত্র, শ্রুতিমূলে মকর কুণ্ডল, বিকশিত মুখপদ্ম-যেন কোটি সুধাকর পদ্ম, ওষ্ঠাধর অধর মণ্ডল। তনুটি যেন নীলাম্বুজ(নীলপদ্ম), আজানুলম্বিত ভুজ(হাত)-ইনিই ঘোরতর তিমির বিনাশক কৃষ্ণ।
মস্তকে তার মুকুট শোভে, যেন শত দিবাকর(সূর্য) প্রভা। কনক(সোনা)-বরণ পীতবাস(হলুদবস্ত্র)।
তার যুগলপদ যেন কোকনদ(লালপদ্ম)-যা অখিল ভুবনকে অভয় দেয়, যায় স্মরণে ভবের সকল বিঘ্ন খন্ডিত হয়। যে পদ অহর্নিশ ধ্যান করছেন অজ(অজর অমর) ঈশ(ঈশ্বর), শুকদেব(ব্যাসদেবের ব্রহ্মচারী পুত্র), ধ্রুব(রাজা উত্তানপাদের হরিভক্ত পুত্র), নারদমুনি, প্রহ্লাদ(দানবরাজ হিরণ্যকশিপুর হরিভক্ত পুত্র) প্রমুখ। এই পাদপদ্মেই মোক্ষ মেলে।
যার থেকে সুরনদীর(দেবনদী/গঙ্গা) জন্ম এবং যিনি তিনলোকের পরিত্রাতা। যার পদচিহ্ন পেয়ে অনন্তনাগ অভয় হলেন।
ইনি বক্র, বক, কেশী, কংস, কালীয় সকলের দর্প ধ্বংস করেন।
নিজের ভক্তের ইনি রক্ষক।
পাণ্ডবদের বন্ধু, যিনি নিজরূপে অখিল সৃজন করেন –সেই কৃষ্ণ গরুড়ধ্বজে চড়ে অগণিত অশ্ব-গজ-চতুরঙ্গ-যদুদের নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে উপস্থিত হলেন।
ধর্মরাজের জন্য অনেক রত্ন সঙ্গে আনলেন। তার আগমনে চারদিক আনন্দ মুখর হয়ে উঠল। পাঞ্চজন্য বেজে উঠলেই ইন্দ্রপ্রস্থে সকলে বুঝলেন হরি উপস্থিত হয়েছেন।
কৃষ্ণের আগমন বার্তা পেয়ে যুধিষ্ঠির ব্যস্ত হয়ে ভাইদের ও মন্ত্রীদের কৃষ্ণকে অভ্যর্থনার জন্য পাঠালেন। ভীমপার্থ অনুব্রজি(অভ্যর্থনা) গোবিন্দে ষড়ঙ্গে(ছয় অঙ্গ-মস্তক, দুইহাত, দুইপদ ও কোমর) পূজে রাজপুরীতে নিয়ে চললেন।
ধর্মপুত্রকে দেখে শ্রীকৃষ্ণ দুর থেকেই ভুমিতে লুটিয়ে তাকে প্রণাম জানালেন। অসংখ্য অমূল্য ধন, অশ্ব, গজ, শৃঙ্গী(বৃক্ষ) অগণিত বিতরণ করলেন।
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও আনন্দিত হয়ে কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে বহু পূজা করলেন।
পঞ্চপাণ্ডবদের মাঝে কৃষ্ণ যেন দ্বিজরাজ। সভার সর্বজন দুচোখ ভরে তাদের দেখে।
গোবিন্দের পাশে বসে যুধিষ্ঠির মৃদু ভাষে বিনয়ের সাথে বলেন –আপনার অনুগ্রহে আমি এ ভারতভূমণ্ডল জয় করতে সক্ষম হলাম। আমি না চাইতেই এত সম্পদ পেয়েছি যে রাখার স্থান নেই। আপনার অনুমতি পেলে সব দ্বিজ-ব্রাহ্মণদের দান করতে চাই। আমি স্বর্গ কামনা করি না, কেবল আপনার পদাম্বুজ ভিক্ষা চাই। পিতার আজ্ঞা পালনের জন্য আপনার অনুমতি চাই।
হে প্রভূ, আপনার মুখাম্বুজে শুনতে চাই আমি কিভাবে যজ্ঞের দীক্ষা নেব। আপনি আজ্ঞা দিলে সকল রাজাদের নিমন্ত্রণ পাঠাই।
রাজার বিনয়বাক্য শুনে কোমল গভীর বাণীতে গঙ্গাধর আশ্বাস দিয়ে বলেন –এ জগতে যত রাজা আছেন সকলে আপনার গুণেই আপনার বশে এসেছেন। আমার পরম সৌভাগ্য যে আপনার যজ্ঞ আমিও দেখতে পাব। আপনি নিষ্কণ্টক মনে যজ্ঞ শুরু করুন।
আমায় আপনি আজ্ঞা করুন, আমার দ্বারা যা যা করা সম্ভব তাই আমি করব। আমার সাথে সকল যদুরাও আছেন একাজে। ভাই, মন্ত্রী, বন্ধু যার যা কাজ সেখানে তাদের নিয়োগ করুন।
গোবিন্দের আজ্ঞা পেয়ে ভূপতি যুধিষ্ঠির সানন্দে তাকে কৃতাজ্ঞলি স্তব করে বলেন –আপনি আসতেই আমি বুঝে গেছি আমার মন বাঞ্ছা এবার পূর্ণ হবে। আপনাতেই প্রভূ ভক্তি ঋদ্ধি(সমৃদ্ধি)। হে প্রভূ, ভক্তের মনের বাঞ্ছা সিদ্ধি করুন, আপনিই যে ভক্তজনে কৃপাবান।
কাশীদাস বলেন যদি তরিবে এই ভবনদী ভজনা করুন সাধুজন দেব ভগবানে।
......................................
[পূর্বকথা - পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ......অর্জুন ও ভীম সে কারণে দ্বিগ্বিজয় যাত্রা করেন]
সহদেবের দিগ্বিজয়ঃ
বাম্যদিকে(দক্ষিণদিকে) সহদেব সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হলেন।
প্রথমে তিনি শূরসেন(মথুরার কাছে) রাজ্যে এলেন। সেখানের নরপতি প্রীতিপূর্বক বহু রত্ন প্রদান করলেন।
এরপর সহদেব মৎস্যদেশও জয় করলেন। অধিরাজের মহাবলধর দন্তবক্রের সাথেও সহদেবের সংগ্রাম হল এবং তাকে হারিয়ে বহু কর আদায় করলেন।
এরপর সুকুমার ও সুমিত্র নামে দুই রাজাকেও হারালেন।
নিষাদ রাজাকে হারিয়ে গোশৃঙ্গ জয় করলেন।
শ্রেণীমান রাজাও তার কাছে হেরে গেল।
এরপর সহদেব কুন্তিভোজ রাজ্যে চতুরঙ্গ নিয়ে প্রবেশ করলেন। কুন্তিভোজ রাজা প্রীতমনে সহদেবকে কর প্রদান করেন।
এরপর সহদেব অবন্তী নগরে বিন্দ অনুবিন্দ রাজাকে পরাস্ত করলে নানা ধন ও বহু পূজা পেলেন।
পরে বিদর্ভ নগরে এসে রাজা ভীষ্মকের কাছে দূত পাঠান হল। ভীষ্মক জানতে পারলেন জামাই কৃষ্ণ-গোবিন্দের সখা এঁরা, তাই আনন্দ মনে তিনি সহদেবকে যথোচিত পূজা করে নানা রত্ন প্রদান করলেন।
এরপর কান্তার, কোশলাধিপ, নাটকেয়, হেরম্ব, মারুধ, মুঞ্জগ্রাম, বাতাধিপ, পান্ড্যদেশ জয় করা হল। তারপর কিষ্কিন্ধ্যা প্রদেশে সহদেব প্রবেশ করলেন। সেখানের দুই কপিরাজ(বানররাজ) মৈন্দ ও দ্বিবিদ। তারা শত্রু সৈন্য দেখে প্রচুর বানরসৈন্য নিয়ে বৃক্ষ-শিলা নিয়ে যুদ্ধ শুরু করল। এভাবে বানর-মনুষ্যের মহারণ শুরু হল। সাতদিন ধরে অবিরাম সে যুদ্ধ চলল। রাতেও তা বন্ধ হল না।
শেষে বানররাজরা খুশি হয়ে সহদেবকে বলে –কে তুমি, কি কারণে এখানে এলে!
সহদেব তার সকল কথা জানালেন।
বানররাজরা বলে –এটা কিষ্কিন্ধ্যানগর, মানুষের এত শক্তি নেই যে আমাদের জয় করে। তবে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির যজ্ঞ করবেন। আমরা কর না দিলে সে যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটবে, তাই ধন দিতে সম্মত হচ্ছি। তুমি যত পার নিয়ে যাও।
এই বলে শত শত রত্ন রাজি দান করা হল। যত রত্ন পেলেন সহদেব সব দেশে পাঠিয়ে মাহিষ্মতীপুরে উপস্থিত হলেন।
মাহিষ্মতীপুরীর রাজা হলেন মহাতেজা নীল। তিনি শত্রুর আক্রমণ শুনে মহারণে ধেয়ে এলেন। নীলরাজের সাথে সহদেবের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ হল। হুতাশন অগ্নি স্বয়ং নীলের সেনাপতি। শত্রু দেখে অগ্নি নিজ মূর্তি ধারণ করলেন। ফলে সহদেবের চোখের সামনে দাবদাহে তার সৈন্যরা প্রাণ দিতে লাগল। সব দেখে পান্ডুপুত্র বিস্মিত হলেন।
জন্মেজয় তখন বৈশম্পায়ন মুনিকে জিজ্ঞাসা করেন –সেকি! হুতাশন অগ্নি কিভাবে রাজা নীলের কাছে বাঁধা পরলেন!
মুনি বলেন – নীল রাজা সর্বদা যজ্ঞ করতেন। সর্বদা অগ্নি প্রজ্বলিত থাকতেন। রাজা নীলের সুন্দরী তনয়া সকলের পূর্বে অগ্নি বৈশ্বানরের পূজা করতেন। যতক্ষণ না এই কন্যা পূজা করেন, ততক্ষণ অগ্নি উজ্জ্বল হতেন না। কন্যার বিম্বোষ্ঠ(লাল ঠোঁট), চন্দ্র আনন(মুখ) দেখে অগ্নিদেব কামানলে দগ্ধ হলেন। দ্বিজ মূর্তি ধরে তিনি কন্যার কাছে এসে মধুর বচনে আলাপ করতে লাগলেন।
রাজা নীল তা দেখে ক্রোধে তাকে দন্ড দিতে গেলেন। বৈশ্বানর এবার প্রচন্ড রেগে স্বমূর্তি ধারণ করেন। তাই দেখে রাজা ভয় পেয়ে তার স্তব করতে থাকেন এবং নিজ কন্যাকে অগ্নির হাতে সমর্পণ করেন। সন্তুষ্ট হয়ে অগ্নি রাজাকে বর দিতে চান।
রাজা বলেন –আপনি সর্বদা আমার সদনে থাকুন। শত্রুরা যেন কোনদিন আমায় পরাস্ত না করে, দেখবেন। সন্তুষ্ট হয়ে অগ্নি সেই বর দিয়ে কন্যার সাথে রাজপুরীতেই অবস্থান করতে লাগলেন। যারা এতসব না যেনে মাহিষ্মতীপুরী আক্রমণ করতে এল, তারাই মৃত্যু মুখে পরল। তাই ভয়ে আর কেউ সে মুখ হয় না। নিষ্কন্টক হয়ে রাজা নীল মহানন্দে রাজ্য শাসন করতে থাকেন।
এদিকে অগ্নি যখন সহদেবের সৈন্যদের পুড়িয়ে মারতে লাগলেন, সৈন্যরা ভয়ে পালাতে লাগল। মদ্রসুতাসুত(মদ্রকন্যা মাদ্রীর পুত্র) সহদেব সব দেখে শুনে অবাক হলেন।
অনেক চিন্তা করে তিনি অস্ত্র ত্যাগ করে অগ্নির স্তব শুরু করলেন –হে অগ্নিদেব! সকল দেবতার উৎপত্তি আপনার মাধ্যমে। আপনি পাপহন্তা, সর্ব ঘটে আপনার স্থিতি। রুদ্রগর্ভ, জলোদ্ভব, বায়ুসখা, শিখী, চিত্রভানু, বিভাবসু প্রমুখ আরো কত নামে আপনি খ্যাত। আপনার পিঙ্গ(অগ্নিবর্ণ) আঁখি(চোখ)। আপনাকে আরাধনা করলে দেব পিতৃগণ তুষ্ট হন। সে কারণে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির যজ্ঞের আয়োজন করছেন। নিজের ভক্তের কাজে বিঘ্ন ঘটান কি উচিত কর্ম, প্রভূ! জগতে আপনি সবার হিতের জন্যেই বিখ্যাত। প্রসন্ন হন, প্রভূ!
সহদেবের স্তুতিবাক্যে দেব হুতাশন অগ্নি শান্ত হলেন। সহদেবকে আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন –উঠুন হে কুরু পুত্র! ভয় পাবেন না। এই নীলধ্বজপুর আমার রক্ষণ। সে কারণে আপনার সেনা দহন করলাম। আপনি আমার প্রিয় পাত্র তাই ক্ষমা করলাম। আমি আপনার সাহায্য করব। নীলরাজাকে বলব তিনি আপনার যোগ্য সম্মান করবেন।
অগ্নির কথা মত রাজা নীল সহদেবের পূজা করে প্রচুর ধনরত্ন দান করলেন।
এরপর সহদেব ত্রিপুরের দেশে প্রবেশ করলেন। সে দেশ জয় করে কৌশিক, সুরাষ্ট্র জয় করে ভোজ কটকে প্রবেশ করলেন। কৃষ্ণের শালা রুক্মির সাথে সহদেবের যুদ্ধ হল। রুক্মি যুদ্ধে হেরে বহু রত্ন কর দিল।
তারপর সহদেব শর্পকের দেশে গেলেন দন্ডককাননে। সমুদ্রের তীরে ম্লেচ্ছ কিরাতদের বসতি। খুব সহজেই এদের সকলকে জয় করা গেল।
আরো দক্ষিণে বহু রাক্ষসদের বাস। পান্ডুর এই পুত্র তাদের সংহার করলেন।
সেখান থেকে বীর সহদেব দীর্ঘকর্ণদেশে গেলেন। সেখানের অধিবাসীদের অতি দীর্ঘ দুই কান, শরীর বিবর্ণ। কালমুখ, হ্রস্বমুখ, কোলগিরি প্রভৃতি বহু রাজাদের জিতে বহু ধনরত্ন পেলেন।
তাম্রদ্বীপ, রামগিরি অবহেলায় জয় হল।
এরপর সহদেব কৌতূহল নিয়ে একপদ দেশে গেলেন। সেখানে যত মানুষ বাস করে সকলের একটি মাত্র পা। হাতে তারা ধনুক ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে ব্যাঙের মত লাফিয়ে চলে।
সঞ্জয়ন্তীনগরের ভূপতিকেও জয় করা গেল।
এছাড়া কর্ণাটক, কলিঙ্গ, পান্ড্য, দ্রাবিড়, উষ্ট্র, কেরল, অন্ধ্র-এই আটদেশের বীর রাজা দূত মুখে সহদেবের সংবাদ শুনে কর দিলেন।
আরো দক্ষিণে সেতুবন্ধে সমুদ্রতীরে এসে সহদেব লঙ্কায় বিভীষণের কাছে দূত পাঠালেন। সময় বুঝে রাক্ষসরাজ বহু ধনরত্ন তাকে ভেট করলেন। এই পর্যন্ত গিয়ে মাদ্রীর এই পুত্র নিবর্ত হলেন।
আনন্দ মনে তিনি ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এলেন। ধন রথ সব তিনি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে নিবেদন করলেন।
আনন্দিত মনে তার বিজয়কাহিনী বললেন।
দক্ষিণ ভারতে পাণ্ডবদের জয়ের কথা যে জন শুনেন তার সর্বত্র জয় কাশীদাস ভণেন।
......................................
[পূর্বকথা - পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ......অর্জুন সে কারণে দ্বিগ্বিজয় যাত্রা করেন]
ভীমের দিগ্বিজয়ঃ
বৃকোদর ভীম প্রচুর সৈন্য নিয়ে পূর্বদিকে এগোতে লাগলেন।
এভাবে তিনি পাঞ্চাল নগরে পৌঁছালেন। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ আনন্দিত মনে যুধিষ্ঠিরের জন্য বহু সম্পদ দান করলেন।
এরপর ভীমসেন বিদেহ, গণ্ডকী জয় করলেন।
তারপর দশার্ণ প্রদেশে গেলে সুধর্মা রাজা এসে ভীমের পূজা করলেন। তার উপর প্রীত হয়ে ভীম তাকে তার সেনাবাহিনীর সেনাপতি করলেন।
অশ্বমেধেশ্বর রোচমানকে যুদ্ধে পরাস্ত করা হল।
এই রোচমানকে পরাস্ত করে ভীম দ্রুত পূর্বের দেশগুলি জয় করতে লাগলেন।
পুলিন্দের রাজা সুমিত্রকে জয় করে চেদিরাজ্যে পান্ডববাহিনী প্রবেশ করল। যুধিষ্ঠির ভীমকে যাত্রাকালে বলেছিলেন শিশুপালের সাথে প্রীতি রাখতে। তাই বৃকোদর ভীম শান্তভাবে বার্তা পাঠালেন। সংবাদ পেয়ে শিশুপাল নিজেই দ্রুত উপস্থিত হল। ভীমকে আলিঙ্গন করে সকলের কুশল সংবাদ নিয়ে রাজপ্রাসাদে আদর করে রাখল। তেরদিন সেখানে আদর আপ্যায়নে শিশুপাল ভীমকে খুশি করল এবং সানন্দে বহু রাজকর প্রদান করল।
এরপর ভীম উত্তর কোশলে এলেন। অযোধ্যার রাজা দীর্ঘযজ্ঞ ভীমের সাথে সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে বহু ধন দিল। সেখান থেকে কোশল রাজ্যে এসে বৃহদ্বল রাজাকে কুন্তীপুত্র হারালেন।
মল্লদেশে দূত পাঠাতেই প্রচুর কর আদায় হল।
ভল্লাট দেশের চারদিকে শুক্তিমান গিরি, সে দেশও জয় করা গেল।
সুবাহু নামে কাশীরাজকে পরাজিত করে, সুপার্শ্বের রাজা ক্রথকেও ভীম হারালেন। এই রাজাদের থেকেও প্রচুর রত্ন আদায় হল।
এরপর মৎস্য দেশের রাজাকে জয় করে উত্তরে নিষাদ নগরে ভীম প্রবেশ করলেন। সেখানে শর্মক, বর্মক মহাবীরকে ভীম হারালেন।
মিথিলাপতি জনক বশ্যতা মেনে নিলেন।
অবহেলায় এই সব রাজাদের হারিয়ে ভীম মহাবলী গিরিব্রজে প্রবেশ করলেন। গিরিব্রজে জরাসন্ধের পুত্র সহদেব বহু ধন দিয়ে বৃকোদরের স্তব-পূজা করল।
পুন্ড্রের রাজা বাসুদেবকে হারিয়ে ও কৌশিকী নদীকূলের রাজাদের পরাস্ত করে বহু রত্ন পাওয়া গেল।
বঙ্গদেশে সমুদ্রসেনকে জয় করে কুন্তীসুত ভীম চন্দ্রসেন রাজাকেও পরাজিত করলেন।
আরো যারা সমুদ্রতীরবাসী রাজা, তাদের হারিয়ে দিগন্ত পর্যন্ত ভীমসেন বশ্যতা নিলেন।
এরপর তিনি বহু ধনরত্ন নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরতে লাগলেন।
অগুরু চন্দন, ভোট(ভুটালের) কম্বল, বহু বসন, লক্ষ লক্ষ মাতঙ্গ(হাতি), বাজী(ঘোড়া), কনক, রজত, মুক্তা, মাণিক্য, প্রবাল, তার সাথে নানা জাতের পাল পাল পশু। ভীম সব কিছু গিয়ে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে নিবেদন করলেন।
প্রণাম করে যোড়করে সকল অভিযানের কথা বলতে লাগলেন। আনন্দিত হয়ে ধর্মপুত্র ভীমকে আলিঙ্গন করলেন।
রাজকোষে সকল ধন সমর্পণ করে বৃকোদর নিজ বাসস্থানে গেলেন।
ভীমের এই দিগ্বিজয় বিরচিলেন কাশীরাম দাস।
......................................
[পূর্বকথা - পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ........কৃষ্ণ প্রথমে জরাসন্ধ বধের কথা বলেন ....ভীমার্জুনকে সাথে নিয়ে কৃষ্ণ গিরিব্রজে রওনা দেন ..ভীম যুদ্ধে জরাসন্ধকে বধ করেন]
অর্জ্জুনের দ্বিগ্বিজয় যাত্রাঃ
কৃতাঞ্জলি করে মহাবলী পার্থ অর্জুন রাজা যুধিষ্ঠিরকে বলেন –মহারাজ, আজ্ঞা করুন রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করি।
অতুল কার্মুক(ধনুক), গান্ডীব ধনুক, অক্ষয় তূণ, কপিধ্বজ রথ, দেব দত্তাম্বুজ(অম্বুজ-পদ্ম), সুচারু তুরঙ্গম(ঘোড়া) বল নিয়ে আমরা রাজকোষের ধনবৃদ্ধি করব। অগম্য পথে উত্তরে গিয়ে আমি সকল রাজ্য জয় করব, সব রাজাদের বশ্যতা আদায় করব।
অর্জুনের কথা শুনে যুধিষ্ঠির তাকে স্নেহালিঙ্গনে সম্মতি জানালেন।
শুভক্ষণ দেখে ব্রাহ্মণদের মঙ্গলবচনের মাধ্যমে কৃষ্ণ-মাধবের স্মরণ নিয়ে যাত্রার আয়োজন হল। রথ, গজ, বাজী(অশ্ব), সেনারা সেজে উঠল।
উত্তরে অর্জুন গেলেন, পূর্বে ভীম, পশ্চিমে নকুল এবং কনিষ্ঠ ভাই সহদেব দক্ষিণ বিজয়ে বেরলেন।
অর্জুনের সেনা শ্বেত, পীত(হলুদ) নানাবর্ণে সেজে, বিবিধ বাজনা বাজিয়ে এগোতে থাকে। শঙ্খনাদ, হাতির গর্জন এবং বিবিন্ন শব্দে ক্ষিতি কেঁপে কেঁপে উঠল।
অর্জুন প্রথমে কুলিন্দ দেশে প্রবেশ করে অনায়াসে তাদের জয় করলেন।
কালকূট(বিপদসঙ্কুল) বর্ত্ম(পথ) পেরিয়ে সহজেই আনর্ত দেশের রাজাকে জয় করলেন।
শাকল সুদ্বীপ, প্রতিবিন্ধ্য রাজ্যও অনায়াসে জয় করলেন।
এরপর প্রাগ্জ্যোতিষ রাজ্যে এলেন।এই রাজ্যের রাজা ভগদত্ত ভুবন বিখ্যাত। তার অগণিত সেনা-যারা কিরাত(ব্যাধ) কাননবাসী। এই বন্য সৈনিকদের অসীম ধৈয্য। তাদের হাতে ধনুক, গুঞ্জহারের(কুঁচফলের) মালায় সজ্জিত, উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা, শরীরে বৃক্ষলতা বেষ্টিত। তারা পরম হরষে যুদ্ধ করতে লাগল। এভাবে উভয় পক্ষের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ হল।
ভগদত্ত রাজা পুরন্দরাত্মজ(ইন্দ্রপুত্র) অর্জুনের সাথে সামনাসামনি যুদ্ধ করলেন। নানা অস্ত্রে, ধনুকে তারা তাদের সকল শিক্ষা প্রয়োগ করতে লাগলেন। মারুত(বাতাস), অনল(অগ্নি), সূর্য, বসু, জল-বিবিধ মন্ত্র শিক্ষা প্রয়োগ হল। আটদিন ক্রমাগত বিশ্রাম না নিয়ে উপবাসে দুই বীর যুদ্ধ করতে লাগলেন।
শেষে ভগদত্ত হেসে অর্জুনকে বলেন – হে মহামত্তবীর এবার রণে নিবর্ত হও। তুমি আমার সখা পুরুহূতের(ইন্দ্রের) যোগ্য পুত্র। তোমার শক্তি সম্পর্কে ধারনা ছিল না। এতদিনে তোমার যোগ্যতা জেনে খুশি হচ্ছি। কিসের কারণে তুমি এই যুদ্ধ করছ! কি চাও দয়া করে আমায় বল।
অর্জুন বিনয়ের সাথে বলেন –ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কুরুকুলের রাজা হলেন। তিনি রাজসূয় ক্রতু(যজ্ঞ) করতে চান। আপনি যদি আমার উপর প্রীত হন তবে দয়া করে কিছু করদান করুন।
প্রাগ্জ্যোতিষের ভগদত্ত রাজা আনন্দ মনে বহু ধন দিয়ে অর্জুনের পূজা করলেন।
এরপর অর্জুন আবার আরো উত্তরে দিগ্বিজয়ে বেরলেন। বিভিন্ন পর্বতে শত শত রাজাদের হারিয়ে তাদের বশ্যতা নিলেন। কেউ আনন্দে ধন দিলেন, কেউবা সংগ্রাম করল।
উলূক(ইন্দ্র)পুত্রের সঙ্গে বৃহন্ত নৃপের অনেক যুদ্ধ হল।
মোদাপুরে দেবকসুদাম বহু ধন দান করল।
পৌরব পর্বতের রাজা সেনাবিন্দু অর্জুনের হাতে রত্নসিন্ধু তুলে দিল।
লোহিতদেশের মহাবল রাজা অর্জুনের অনেক পূজা করলেন।
ত্রিগর্তের রাজাকে অনায়াসে জয় করা গেল।
সিংহপুরের সিংহরাজ বশ্যতা জানাল।
বাহ্লীক, দরদ জয় হল।
রাজা কোকনদ, যিনি কামগিরির মাঝে বাস করেন, তার রাজ্যটি অপূর্ব সুন্দর। অশেষ ঘোটক(ঘোড়া), শুক্ল(সাদা) ময়ূর আনন্দে সারা দেশে ঘোরে। এই রাজাও অর্জুনকে আনন্দিত করলেন।
নৃপতি জীবন অর্জুনের সাথে মহারণ করলেন। শেষে হেরে পার্থের ভজনা করতে লাগলেন। এখান থেকেও পার্থ নানা বর্ণের রাশি রাশি ধনরত্ন পেলেন।
এভাবে একে একে সব দেশ জয় করে অর্জুন হেমন্তগিরিতে উঠলেন। সেখানেও অভেলে গন্ধর্ব দানবপুরী জয় করলেন।
কৈলাস পর্বতে কুবেরের বাসস্থান, সেখানে কোটি কোটি যক্ষ রক্ষের বাস। সেখানেও যুদ্ধ হল। শেষে কিরীটীর(অর্জুনের) জয় হল। ইন্দ্রের কুমার ইন্দ্রের সমান যুদ্ধ করে বহু যক্ষ মারতে লাগলেন। তারা ভয়ে পালিয়ে কুবেরের কাছে এসে বলে দেশে শত্রুর আক্রমণ ঘটেছে। শুনে বৈশ্রবণ(বিশ্রবা মুনির পুত্র-কুবের) বহু ধন নিয়ে পান্ডুপুত্রকে উপহার দিয়ে স্নেহের সাথে বিদায় জানালেন।
হাটক নগর, সেখানের গুহ্যকনিবাসীদের জয় করে অনেক ধন আহোরণ হল।
এভাবে বহু ধন রত্ন নিয়ে অর্জুন আনন্দ মনে আরো এগোতে লাগলেন।
মানসসরোবর দেখে পার্থ খুব সুখী হলেন। এই অমরনগরী কোটি কোটি শশিমুখী অপ্সরা কিন্নরী পূর্ণ। জিতেন্দ্রিয় ধীর পার্থ মহাবীর কারো পানে দৃষ্টি দেন না। সেই সরোবরে বহু ঋষি বাস করতেন, তারা অর্জুনকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। সেখান থেকে কৌতুহল নিয়ে পার্থ আরো উত্তরে দ্রুত যেতে থাকলেন। সকল স্থানে তেজময় মার্তণ্ডের(সূর্যের) মত ঘুরে পার্থ ভারত জয় করতে লাগলেন।
আরো উত্তরে তিনি হরিবর্ষ নামে এক স্থানে এলেন। তাকে দেখে দ্বারপালরা লৌহদণ্ড নিয়ে তেড়ে এলো। জীবন্ত মানুষ দেখে তারা বিস্মিত হয়ে অর্জুনকে বলে –তোমার দেখছি খুব সাহস! মানব শরীরে এখানে উপস্থিত হয়েছ! এর আগে এমন কখনও দেখিনি। এবার নিজেকে নিবৃত কর। এস্থান কেউ জয় করতে পারে না। এই উত্তরপুর কুরুর নগর-এখানে কি কারণে এসেছ! এখানে তো কাউকে দেখতে পাবে না, জীবন্ত এখানে কেউ থাকে না, কার সাথে তুমি যুদ্ধ করবে!
কুন্তীপুত্র পার্থ দ্বারীদের বলেন –ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয় শ্রেষ্ঠ। আমি তার কিঙ্কর দাস মাত্র। তোমাদের লঙ্ঘন করে আমি পুরীতে প্রবেশ করব না, কথা দিচ্ছি। তবে তোমরা আমায় কিছু কর প্রদান কর।
একথা শুনে দ্বারপালরা বহু রত্ন এনে ধনঞ্জয়ের হাতে তুলে দিল। ধন পেয়ে পার্থ সানন্দ হৃদয়ে দক্ষিণে মুখ ফেরালেন।
ফেরার পথেও বহু মহীপালকে জয় করে কর আদায় করলেন।
শেষে বহু বাদ্য বাজিয়ে চতুরঙ্গে নিজ নগরে প্রত্যাবর্তন করলেন। তিনি বহু মণি, মরকত, কনক, রজত, মুক্তা, প্রবাল রাশি, বিবিধ বসন, গো আদি বাহন ও বহু দাসদাসী সঙ্গে আনলেন। জয় জয় শব্দে, শঙ্খের নিনাদে পার্থ ইন্দ্রপ্রস্থে প্রবেশ করলেন।
ইন্দ্রের আত্মজ পার্থ সজ্জা পরিবর্তন করে ধর্মপুত্রের সামনে উপস্থিত হলেন। মাটিতে দণ্ডবৎ হয়ে করজোড়ে যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম জানালেন। ধিরে ধিরে তার অভিযানের সব কথা যুধিষ্ঠির শুনতে লাগলেন।
সব শেষে অর্জুন বলেন –উত্তরদিকের সকল নৃপ আপনার বশ্যতা মেনে নিয়েছেন। সকলে কর প্রদান করেছেন, দেখুন নৃপবর!
আনন্দে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে আলিঙ্গন করলেন। অনেক ভাবে ভাইকে তুষ্ট করলেন। পার্থ যা যা এনেছিলেন সব রাজকোষে সঞ্চিত রেখে নিজ নিবাসে ফিরে গেলেন।
......................................