Blog Archive

Monday, August 31, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০২

[পূর্বকথা - পারিজাত হরণের কথা...নারদ পারিজাতপুষ্প কৃষ্ণকে দিলে তিনি তা স্ত্রী রুক্মিণীকে পরিয়ে দেন... সে কথা শুনে সত্যভামার অভিমান হয়...তিনি আহার নিদ্রা ত্যাগ করেন, কৃষ্ণ এসে তার মানভঞ্জন করেন এবং পারিজাত বৃক্ষ উপহারের আঙ্গিকার করেন...শ্রীকৃষ্ণের সুরপুরী গমন করেন...শ্রীকৃষ্ণের সাথে ইন্দ্রের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ শুরু হয়...মহাদেবের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণ ইন্দ্রকে সম্মান দেখালে ইন্দ্র পারিজাত কৃষ্ণকে দান করেন ...] 

ইন্দ্রকে লইয়া কৃষ্ণের নিকটে গরুড়ের গমন ও কৃষ্ণের ক্রোধ নিবারণঃ 


শচীর হাসি দেখে সতী সত্যভামার অভিমান হল। 
তিনি গোবিন্দকে করজোড়ে বলেন –তুমি যখন ইন্দ্রের চরণ স্পর্শ করে তাকে প্রণাম করলে তখন শচী হেসে আমায় তা দেখায়। সে যা প্রতিজ্ঞা করেছিল তা সম্পূর্ণ হল। তুমি আমায় বলেছিলে আজ তাদের গর্ব চূর্ণ করবে। কি কারণে তুমি এমন করলে! পারিজাত না পেলে না হয় নাই পেতাম! 

হেসে প্রভু কমললোচন বলেন –সতী একারণে কেন তুমি দুঃখ করছ! তিন ভুবনে যত প্রাণী দেখছ, তাদের থেকে আমি ভিন্ন নই। সবার মাঝেই আমার অবস্থান। আজ আমি নিজেই নিজেকে নমস্কার করলাম না হয়! এতে তোমার লজ্জা হচ্ছে কেন! 

সতী সত্যভামা বলেন –আপনি শচীর প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করলেন, কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞা বিস্মৃত হলেন! আপনিই তো বলেছিলেন সহস্রলোচন ইন্দ্রের গর্ব খর্ব করবেন। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা। বিশেষ করে শচীর হাসি দেখে পর্যন্ত আমার সর্ব অঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে। 

কৃষ্ণ বলেন –আমার প্রতিজ্ঞা স্থির নয়। দেবী, ভক্তদের আমি আমার শরীর দান করেছি। শিবের বাক্য লঙ্ঘন করতে না পেরে ইন্দ্রকে ক্ষমা করলাম। 

সতী বলেন –তার মানে আমি আপনার ভক্ত নই, অভক্ত! সে কারনেই আমার শরীর ক্রোধে দ্বগ্ধ হচ্ছে! 

গোবিন্দ বলেন –দেবী, ক্রোধ ত্যাগ কর। ঠিক আছে এখনি ইন্দ্রকে এনে তোমার চরণে লোটাব। 


সত্যভামাকে আশ্বাস দিয়ে দৈবকীতনয় কৃষ্ণ মৃত্যুঞ্জয় শিবকে ডেকে বলেন –আপনার বচন আমি লঙ্ঘন করতে পারিনি তাই ইন্দ্রকে তখন মান্য করেছি। তবে ইন্দ্রের সাথে আমার কিবা সম্বন্ধ! পৃথিবীতে তো আমি কতবার কত অবতার রূপে এসেছি। 
হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু দুইভাই প্রতাপে সকল ভুবন জয় করেছিল। তাদের বরাহ ও নরসিংহ অবতার রূপে হত্যা করে নিষ্কন্টক স্বর্গের অধিকার দিলাম। 
ধর্মবলে বলিরাজ ত্রিভুবন নিলে আমি দুই পদে ব্রহ্মান্ড ব্যাপিয়ে তাকে বামনাবতারে ছলনা করে পাতালে রাখলাম। পুনরায় নিষ্কন্টক করে স্বর্গ আখন্ডল ইন্দ্রকে দিলাম। 
কুম্ভকর্ণ ছিল রাক্ষসরাজ রাবণের প্রিয়। সে ধার্মিক, সাহসী ও বুদ্ধিবলে ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করে স্বর্গের অধিকার নিতে পারে যেনে ইন্দ্র হিংসা করে দেবী সরস্বতীর সাহায্যে কুম্ভকর্ণকে বিহ্বল করায়। ফলে ব্রহ্মা বর দিতে এলে কুম্ভকর্ণ “ইন্দ্রাসন” এর পরিবর্তে “নিদ্রাসন” চেয়ে বসে। সকলে যানে সে ইন্দ্রের কি অবস্থা করেছিল। তাদেরও আমি রাম অবতারে হত্যা করে নিষ্কন্টক স্বর্গ ইন্দ্রকে দান করি। 
এখন আপনিই বলুন শিব আমার সাথে তার কিসের সম্বন্ধ! তাকে আমার এসব কথা জানাবেন হে সদানন্দ শিব। বলবেন সে যেন ভূমিতে এসে সতীর চরণে লুটিয়ে প্রণাম করে। তবেই আমি তার অপরাধ মার্জনা করব। না হলে এখনই অন্য কাউকে স্বর্গপুরী দান করব। 

মহেশ্বর শিব সব কথা ইন্দ্রকে জানালেন। কিন্তু সব শুনে ইন্দ্র ক্রোধে কাঁপতে লাগলেন। 
শিব কৃষ্ণকে গিয়ে দুঃখের সাথে জানালেন ইন্দ্র তার শর্তে রাজি নন। 

কৃষ্ণ তখন গরুড়কে ডেকে বলেন –হে বীর খগেশ্বর, এখনই পাতাকে গিয়ে বিরোচনের পুত্র বলিকে [হিরণ্যকশিপু->প্রহ্লাদ->বিরোচন->বলি] নিয়ে এস। আজই আমি তাকে স্বর্গের অধিপতি করব। সাধুসেবার গুণে সে আমার ভক্ত। 

একথা শুনে গরুড়, যিনি ইন্দ্রের প্রতি অতিশয় প্রীত, তিনি বন্ধুর কারণে গোবিন্দের চরণে পরে সবিনয়ে বলেন –অদিতিকে(ইন্দ্রের মা) যে সত্য বচন করেছিলেন, তা ভুলে গেলেন, হে চক্রধর! এখন বলিকে স্বর্গের অধিকারী করতে চান! তাকে কেন ডাকছেন, হরি! ইন্দ্রকে কেন ছাড়ছেন! দেখি সে কেমন আপনাকে না মান্য করে! 

এই বলে খগেশ্বর নিজেই স্বর্গে চললেন। 
ইন্দ্রকে গিয়ে গরুড় বলেন –হে পুরন্দর, কেন অজ্ঞানের মত আচরণ করছ! যার জন্য এই সৃষ্টির সৃজন, যিনি তোমাকে এই স্বর্গের অধিকার দিলেন তাঁর আজ্ঞা অবহেলা করছ কেন! দেখেও কি দেখতে পাচ্ছ না! ইন্দ্রপদে এত মজেছ! এস বন্ধু আমি তোমার দোষ ক্ষমা করাব। সতী সত্যভামার চরণতলে তোমায় ফেলব। আমার কথাতেও যদি তুমি না সচেতন হও তবে যেন বলি রাজা এই ইন্দ্রপদ পাবে। তোমার উপর ক্রোধ আরো বারবে। 

খগেন্দ্রের(পাখির রাজা-গরুড়) কথা শুনে মেঘবান ইন্দ্র চিন্তিত হলেন। 
অনুশোচনা করে ইন্দ্র গরুড়কে বলেন –বুঝেছি ভগবান আমার উপর ক্রোধ করেছেন। ত্রৈলোকের নাথ প্রভু দেব নারায়ণ। অজ্ঞান হয়ে তার সাথে যুদ্ধ করেছি। সখা গরুড়, বিশ্বাস করুন আমি না জেনে গোবিন্দের ক্রোধ বাড়িয়ে ফেলেছি। 

খগেশ্বর বলেন –সখা আমার কথা শোন। তুমি আমার সাথে এসে চক্রপাণির ক্রোধ শান্ত কর। এস আমি তোমার দোষ ক্ষমা করাব। নারায়ণের সামনে তোমায় নিয়ে যাব। 


এত বলে গরুড় ইন্দ্রের হাত ধরে তাকে একেবারে সতী সত্যভামার চরণতলে এনে ফেললেন। ভূমিতে পরে সহস্রলোচন ধুলিতে চোখ ধাঁধিয়ে কিছু দেখতে পেলেন না। চারদিকে হাতড়াতে থাকেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পূণ্যবান। 
...................................

Sunday, August 23, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০১

[পূর্বকথা - পারিজাত হরণের কথা...নারদ পারিজাতপুষ্প কৃষ্ণকে দিলে তিনি তা স্ত্রী রুক্মিণীকে পরিয়ে দেন... সে কথা শুনে সত্যভামার অভিমান হয়...তিনি আহার নিদ্রা ত্যাগ করেন, কৃষ্ণ এসে তার মানভঞ্জন করেন এবং পারিজাত বৃক্ষ উপহারের আঙ্গিকার করেন...শ্রীকৃষ্ণের সুরপুরী গমন করেন...শ্রীকৃষ্ণের সাথে ইন্দ্রের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ শুরু হয়...] 



মহাদেবের যুদ্ধস্থলে গমনঃ 

গোবিন্দ ও ইন্দ্রের সেই যুদ্ধের যেন আর শেষ নেই। ভয়ংকর শব্দ শুনে শুনে ত্রিলোকের লোক হতজ্ঞান হতে লাগল। দেখে নারদ মুনি চিন্তিত হয়ে ক্ষীরোদসাগরতীরে কশ্যপ মুনির কাছে দ্রুত গেলেন। 

নারদ কশ্যপ মুনিকে বলেন –মুনি আপনি কি করছেন! আপনার পুত্র দেবরাজ ইন্দ্রের বড়ই বিপদ। অজ্ঞান হয়ে তিনি কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছেন। কৃষ্ণ দয়া করে প্রাণে মারছেন না তাই তাঁর কৃপায় দেবরাজ এখনও বেঁচে আছেন। দেবরাজ তার সব অস্ত্র হেনেছেন। কৃষ্ণ এখনও সংযত আছেন। একবার তিনি সুদর্শন চক্র ছাড়লে ইন্দ্র কিন্তু খন্ড খন্ড হবেন কেউ আটকাতে পারবে না।

শুনে কশ্যপ মুনি চিন্তিত হলেন কি ভাবে এই যুদ্ধ থামাবেন। এঁদের দুজনকে মহাদেব ছাড়া আর কেউ শান্ত করতে পারবে না বুঝে কশ্যপ শিবের স্তুতি শুরু করলেন। কশ্যপের স্তবে তুষ্ট হয়ে ত্রিলোচন হর যুদ্ধ নিবারণ করতে যুদ্ধ স্থানে গেলেন। 


একদিকে খগেন্দ্র-উপেন্দ্র, অন্যদিকে গজেন্দ্র ইন্দ্ররাজ, যোগেন্দ্র-মহাদেব বৃষেন্দ্রারূঢ় হয়ে তাদের মাঝে দাঁড়ালেন। 

শিব কৃষ্ণকে বলেন –হে শ্রীহরি, শান্ত হয়ে একটু শুনুন। আপনার সঙ্গে কি ইন্দ্র পারেন! আপনিই তাকে দেবরাজ করে স্বর্গে স্থাপন করেছেন। এখন তাকে নিগ্রহ করা আপনার উচিত নয়। 

গোবিন্দ বলেন –ইন্দ্র স্বর্গভোগ করেন, করুক। কিন্তু আমায় তো পারিজাত বৃক্ষটি দিতে পারেন! তা উনি দিতে চাইছেন না। তিনি এটি নিজে উপার্জনও করেন নি। ক্ষীরোদসাগর মন্থন করে সুরাসুর সকলে একে তুলেছে। মন্থনের দ্রব্যে সবার ভাগ আছে। 
বিশেষ করে বামনাবতারে আমি বামনরূপে তার পরেই জন্মেছিলাম। স্বর্গের যত সুখ সেই ঐরাবত, উচ্চৈঃশ্রবা সব সে ভোগ করছে। আমি সব কিছু থেকে ব্রাত্য। আমি তো কেবল পারিজাত বৃক্ষটি চেয়েছিলাম। তার কি উচিত হল এর জন্য যুদ্ধ করা! 

গোবিন্দের কথা শুনে দেবপঞ্চানন-শিব ইন্দ্রের কাছে গেলেন। 
ইন্দ্রকে গিরীশ(=গিরি+ঈশ[ঈশ্বর]) শিব বলেন –ইন্দ্র আপনি কি জ্ঞান হারিয়েছেন! জানেন না নারায়ণ পুরুষ-প্রধান! তার সাথে দ্বন্দ্বে আপনার কোন কল্যাণ নেই। আমার কথা শুনুন হে সুরপতি, এ যুদ্ধ বন্ধ করুন। যদুবংশপতি কৃষ্ণ যদি পারিজাত চান তাকে তাই দিয়ে বন্ধুত্ব করুন তার সাথে। 

ইন্দ্র বলেন –হে পশুপতি অবধান করুন! ঐরাবত, উচ্চৈঃশ্রবা প্রভৃতি যত যান, বজ্র, শচী, নন্দনকানন, পারিজাত এসব নিয়েই আমার স্বর্গের ইন্দ্রত্ব, আমার ভূষণ। দেবকীকুমার কৃষ্ণ যদি পারিজাত বৃক্ষ নিয়ে নেন তবে আমার স্বর্গের ইন্দ্রত্ব আর কি রইল! 


মহেশ বলেন –হরি তো অবতাররূপে খর্ব আপনার চেয়ে। বামনরূপে তিনি তোমার কনিষ্ঠ ভাই, অদিতির উদরে তোমার সহোদর। সেই কনিষ্ঠের অধিকারে নারায়ণ আপনার কাছে তার ভাগ চাইছেন। তাকে পুষ্পরাজ দিয়ে এযুদ্ধ শেষ করুন। 

ইন্দ্র বলেন –আপনার বাক্য অমান্য করব না। কৃষ্ণ যদি আমার কনিষ্ঠ ভাই হন তবে জ্যেষ্ঠ ভাইকে যেমন সম্মান করার না করে এমন বলপ্রয়োগ করছেন কেন! এতটুকু মান্য না করে বলে টেনে নিয়ে ভূমণ্ডলে ফেললেন। 


এতশুনে গোবিন্দের দিকে তাকিয়ে শিব বলেন –আমাকে দেখে অন্তত ক্রোধ ত্যাগ করুন, হে যদুনাথ! অজ্ঞান হয়ে দেব সুরপতি ইন্দ্র আপনার সাথে যুদ্ধে মত্ত হয়েছেন। আপনিই তাকে ইন্দ্রত্ব দিয়েছেন। বারবার বিপদে তাকে রক্ষা করেছেন। নিজের অর্জিত বৃক্ষ যদি বিষবৃক্ষ হয় তবু তাকে নিজে হাতে নষ্ট করা সমুচিত নয়। পারিজাত পুষ্প নিয়ে যেতে চান যান। 
কিন্তু ইন্দ্র সম্পর্কে আপনার জ্যেষ্ঠ ভাই, সে সম্মান তাকে আপনার দেওয়া উচিত। আমার অনুরোধ রাখুন। 

নারায়ণ শিব বাক্য স্বীকার করে শিবকে নিয়ে ইন্দ্রস্থানে গেলেন। কৃষ্ণ বিধান মত কনিষ্ঠ হওয়ায় ইন্দ্রকে প্রণাম করলেন। 


হৃষ্ট মনে দেবরাজ ইন্দ্র কৃষ্ণের কোলে পারিজাত বৃক্ষ দান করে বলেন –যতদিন আপনি অবনীমণ্ডলে(পৃথিবীতে) থাকবেন ততদিন এই বৃক্ষ আপনার সাথে থাকবে। তারপর পারিজাত বৃক্ষ পুনরায় স্বর্গপুরে ফিরে আসবে। 
এই বলে দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গে চললেন। 
সত্যভামার দিকে তাকিয়ে ইন্দ্রাণী শচীদেবী হাসলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম কহেন, সাধু সদা তা করেন পান। 
...................................

Sunday, August 16, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০০

[পূর্বকথা - অর্জুন বারো বছরের বনবাস কালে প্রভাস তীর্থে এলে গোবিন্দ তাকে দ্বারকায় নিয়ে আসেন..সেখানে সুভদ্রাকে দেখে অর্জুনের ভাল লাগে...কথা প্রসঙ্গে পারিজাত হরণের কথা ওঠে...নারদ পারিজাতপুষ্প কৃষ্ণকে দিলে তিনি তা স্ত্রী রুক্মিণীকে পরিয়ে দেন... সে কথা শুনে সত্যভামার অভিমান হয়...তিনি আহার নিদ্রা ত্যাগ করেন, কৃষ্ণ এসে তার মানভঞ্জন করেন এবং পারিজাত বৃক্ষ উপহারের আঙ্গিকার করেন...] 


শ্রীকৃষ্ণের সুরপুরী গমনঃ

নারদ কৃষ্ণকে বললেন –হে নারায়ণ, দেবতাদের মাতা অদিতি তার কুন্ডলের কারণে খুবই দুঃখিত। নরকাসুর অমরাবতীর সব দেবতাদের হারিয়ে বলপ্রয়োগ করে অদিতির কুন্ডল হরণ করেছে। পৃথিবীর পুত্র এই নরক দুর্মতি। তাকে না মারলে পুনরায় স্বর্গের বসতি প্রতিষ্ঠা হবে না। 


নরকাসুর হত্যা

শুনে গোবিন্দ নরকাসুরকে হত্যা করতে চললেন। 


নরককে হত্যা করে ষোল হাজার দেব কুমারীকে উদ্ধার করলেন। তারা স্বেচ্ছায় মুরারিকে বিবাহ করল। 


গোবিন্দ মাতা অদিতির কুন্ডল তাকে ফিরিয়ে দিলেন ও অমর নগরে চললেন। 

নন্দনকাননে প্রবেশ করতেই কুসুমরাজ পারিজাতের সৌরভে সকলে আমোদিত হলেন। কৃষ্ণ সাত্যকিকে বৃক্ষটি আনতে বললেন। শুনে সাত্যকি দ্রুত বৃক্ষের কাছে গেলে দেখল বহু রক্ষ তা পাহারা দিচ্ছে। 


তারা অস্ত্র হাতে তেড়ে এলে সাত্যকি তাদের বলে –নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে চাইলে যুদ্ধ না করে দ্রুত ইন্দ্রের কাছে গিয়ে সব জানাও। 

সকলে ইন্দ্রকে গিয়ে বলল –প্রভূ দ্রুত চলুন গরুড়ে করে তিনজন মানুষ এসে পারিজাত বৃক্ষের জন্য নন্দন বন ভাঙ্গছে। 

শুনে ইন্দ্রের মনে পরল গোবিন্দের পারিজাত নিতে আসার কথা ছিল। 
ক্রোধে তিনি থরথর, সহস্র লোচন কালচক্রের মত ঘোরে। নানা অস্ত্রে তিনি সমর সাজ করতে লাগলেন। হাতে বজ্র নিয়ে দেবরাজ যুদ্ধে চললেন। 

শচীদেবী বলেন –আমিও আপনার সাথে যাব, যুদ্ধ দেখব। 
শুনে ইন্দ্র নিজের বামে স্ত্রীকে বসালেন। সঙ্গে সখা জয়দেব ও পুত্র জয়ন্তকে সঙ্গে নিলেন। এভাবে চারজনে গজে করে নারায়ণ যেখানে আছেন সে স্থানে চললেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত লহরী, কাশীদাস কহেন, শুনে তরি ভববারি।
..................


শ্রীকৃষ্ণের সহিত ইন্দ্রের যুদ্ধঃ

কৃষ্ণ ও ইন্দ্রের যুদ্ধ শুরু হল। ছয়জনের অস্ত্রে অস্ত্রে আগুন ঝড়তে লাগল। 

উপেন্দ্রাণী-সত্যভামাকে দেখে ইন্দ্রাণী ক্রোধে বলেন –হে ভারতী, তোমার এত গর্ব যে আমার ভূষণ-পুষ্প হরণ করতে এসেছ! তোমার মর্যাদাবোধ থাকলে নিজে এগিয়ে গিয়ে যেখান থেকে পারিজাত উপড়েছ সেখানে রেখে এস। বামন হয়ে চাঁদ ধরার ইচ্ছে! আজ এমন শিক্ষা দেব যে সব গর্ব ভাঙ্গবে। 

সত্যভামা বলেন –শচী, মিছে গর্ব কর। তোমার ক্ষমতা আমি সব জানি। শাশুড়ির কুন্ডল যখন নরক হরণ করল তখন স্বামী আখণ্ডলকে(ইন্দ্র) বলে তা উদ্ধার করতে পারলে না! সে অসুর তো স্বর্গ লুটেপুটে ছারখার করল, তোমার ভাতার(স্বামী) তো কিছুই রক্ষা করতে পারল না। সেই নরকাসুরের পুরী ভেঙ্গে তাকে হত্যা করে আমার স্বামী হরি তোমার শাশুড়ি অদিতির কুন্ডল উদ্ধার করে আনলেন। এই পারিজাতের পুষ্পে কেবল তোমার একার কি ভাবে অধিকার হয়! সমুদ্র মন্থনে এর জন্ম। তাই এর বিভাগ সমান হবে। আমাদেরও ভাগ দিতে হবে। তুমি কেন একা পারিজাত পুষ্প ভূষণ করবে! দেখি আজ আমি পারিজাত নিয়েই যাব, কিভাবে তুমি রাখতে পার। 

সতী সত্যভামা ও শচীর কোন্দল শুনে মুখে বস্ত্র দিয়ে দেবতারা হাসতে থাকেন। 
আনন্দ লহরীতে নারদ মুনিকে হাসতে দেখে পুরন্দর ইন্দ্র অতিশয় রোষে(রাগে) কাঁপতে থাকেন। 


উপেন্দ্র(কৃষ্ণ) ও ইন্দ্রের স্বর্গে এমন যুদ্ধ দেখে ত্রিভুবন চমৎকৃত হল। স্বর্গে তাদের নানা অস্ত্রের প্রহার পৃথিবীর মধ্যে উড়ে আসে উল্কার আকার। দর্পক(কন্দর্প-কামদেব) ও জয়ন্তের যুদ্ধের তুলনাও দেওয়া যাবে না। শরজালে দুজনে গগন ছাইল। 
সাত্যকি সে সময় পারিজাত বৃক্ষতরু গরুড়ের উপর তুলল। তার সাথে জয়দেবের যুদ্ধ শুরু হল। 
খগেন্দ্র(গরুড়) ও গজেন্দ্রের(ঐরাবত) যুদ্ধও বর্ণনাতীত। তাদের গর্জনে ত্রৈলোক্যজন বধির হল। গজেন্দ্র তার দাঁত দিয়ে গরুড়কে প্রহার করে। গরুড়ও গজেন্দ্রের শুড় নখে বিদ্ধ করেন। গরুড়ের নখাঘাতে গজেন্দ্র অস্থির। তার সর্বাঙ্গ খন্ড খন্ড করে রক্তধারা বহে। গজেন্দ্র আর শূন্যে থাকতে পারল না, অজ্ঞান হয়ে ভূমিতে পরল। সারা শরীর দিয়ে রক্ত বহে, শরীর কাঁপতে থাকে মাতঙ্গরাজের, তিনি পর্বতের উপর গিয়ে পড়লে পর্বত অর্ধেক তলিয়ে গেল। আখন্ডল ইন্দ্র সেই পর্বতের উপর গিয়ে দাঁড়ালেন। 

ইন্দ্র বলেন –কৃষ্ণ তুমি গর্ব করো না। আমি যুদ্ধে ভয় পাইনি কিন্তু আমার বাহন গরুড়ের আঘাতে অস্থির। চল আমরা ভূমিতে নেমে যুদ্ধ করি। 

ইন্দ্রের কথায় কৃষ্ণ হেসে বলেন –তুমি যেখানে বলবে সেখানে গিয়েই আমি যুদ্ধ করতে রাজি। 

পুনরায় যুদ্ধ শুরু হল। ইন্দ্র যত অস্ত্র মারেন, কৃষ্ণ দামোদর সহজেই তা কাটেন। 
সর্ব অস্ত্র ব্যর্থ হচ্ছে দেখে মনে মনে লজ্জা পেয়ে ইন্দ্র অতি ক্রোধে কৃষ্ণের উপর বজ্র প্রহার করলেন। 

গোবিন্দ গরুড়কে বলেন –সুরপতি ইন্দ্র বজ্র অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। সুদর্শন চক্র এক্ষুনি তা তিল তিল করে কাটবে। কিন্তু তাতে মুনি বাক্য ব্যর্থ হবে ভেবে আমার খারাপ লাগছে। তুমি এর উপায় বার কর খগেশ্বর। নিজের একটি পক্ষ বজ্রের উপর ফেল। 


প্রভুর আজ্ঞা পেয়ে গরুড় ঠোঁটে নিজের একটি পালক উপড়ে বজ্রের উপর ফেললেন। বজ্র পক্ষ চূর্ণ করে পুনরায় ইন্দ্রের কাছে ফিরল। একবারই বজ্র ব্যবহার করা যায়। দেখে আখন্ডল অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান। 

Sunday, August 9, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৯৯

[পূর্বকথা - অর্জুন বারো বছরের বনবাস কালে প্রভাস তীর্থে এলে গোবিন্দ তাকে দ্বারকায় নিয়ে আসেন..সেখানে সুভদ্রাকে দেখে অর্জুনের ভাল লাগে, সুভদ্রাও অর্জুনের প্রেমে পাগল হন এবং সত্যভামাকে তার মনের কথা জানান... সত্যভামা অর্জুনকে সুভদ্রা বিবাহের কথা বলেন...কথা প্রসঙ্গে পারিজাত হরণের কথা ওঠে...নারদ পারিজাতপুষ্প কৃষ্ণকে দিলে তিনি তা স্ত্রী রুক্মিণীকে পরিয়ে দেন... সে কথা শুনে সত্যভামার অভিমান হয়...] 


সত্যভামার মানভঞ্জনঃ 

এদিকে সত্যভামা মাটিতে পরে আছেন মুক্তকেশ ধূলায় ধূসর, বসন ভূষণ নয়ন জলে ভিজে গেছে। দেখে মনে হয় যেন চন্দ্রমা মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছেন। চারদিকে সখিরা ব্যজনী(তালপাখা) ধরে, সুগন্ধিতে চরণ ধুইয়ে দিচ্ছে। সঘন নিশ্বাস ফেলছেন দেবী সত্যভামা। 

তার এমন করুণ অবস্থা দেখে কৃষ্ণ অশ্রু জল গোপন করতে পারলেন না। সখিদের হাত থেকে নিজেই ব্যজনী নিয়ে ধিরে ধিরে বাতাস করতে লাগলেন। 
গোবিন্দের উপস্থিতিতে সত্যভামার গৃহ উজ্জ্বল হল যেন ষড়ঋতুকে নিয়ে কামদেব এলেন। গোবিন্দের অঙ্গের সৌরভে গৃহ আমোদিত হল। সহস্র অলি ভোঁ ভোঁ রবে ধেয়ে এল। 
অচেতন সত্যভামা চেতনা পেলেন, সৌরভে জানলেন কৃষ্ণ এসেছেন। তিনি উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। ক্রোধে চোখ মেলে তাকালেন না। তিনি সখিদের বলেন –কে আমার অঙ্গ হুতাশন(আগুন) প্রায় দগ্ধ করছে! রুক্মিণীর বান্ধবের কি আগমন ঘটেছে! 
এই বলে শিরে কঙ্কণের আঘাত করতে থাকেন। জগন্নাথ দুই হাতে তার হাত ধরে ফেললেন। 
দুঃখ করে কৃষ্ণ বলেন –কেন রুক্মিণী পতি বলছ হে প্রাণপ্রিয়া সত্যভামা! চোখ মেলে দেখ। আমি কি অপরাধ করেছি, তুমিই বল। কেন তুমি এত কষ্ট পাচ্ছ! 
এই বলে কৃষ্ণ সত্যভামাকে তুলে ধরে বসালেন। নিজের বস্ত্র দিয়ে দেবীর মুখ মুছিয়ে দিলেন। 


গোবিন্দের এত বিনয় বাক্য শুনে সত্যভামা কাঁদতে কাঁদতে আধ আধ বাণীতে বলেন – তোমার মুখে সুধা, হৃদয়ে নিষ্ঠুর। এখন জেনেছি তুমি কত বড় ক্রূর। পারিজাত পুষ্পরাজির অতুল সুবাস শুনেছি। আমাকে নিরাশ করে সেটি তুমি রুক্মিণীকে দিলে! কে এত অপমান সহ্য করতে পারে! আজই আমি তোমার সামনে প্রাণ ত্যাগ করব। 

গোবিন্দ বলেন –প্রিয়ে, বিলাপ ত্যাগ কর। পারিজাতের জন্য তুমি এত দুঃখ করছ! একটি ফুলের জন্য তোমার এত ক্রোধ! ঠিক আছে আমি তোমার জন্য পুষ্প সহ গাছই এনে দেব। 

শুনে সত্যভামা দেবী উল্লাসিত হলেন। চোখ মেলে হেসে কৃষ্ণের সাথে কথা বলেন। নিজে উঠে যদুনাথকে আসনে বসান, কৃষ্ণের চরণ সুগন্ধি জলে ধুইয়ে দেন। পরম সুখে কৃষ্ণকে ভোজন করিয়ে তাম্বুল(সাজা পান) দেন, বাম পাশে বসেন। রত্নময় পালঙ্কে দুজন শয়ন করে আনন্দে রজনী কাটান। 

প্রভাতে উঠে কৃষ্ণ যখন স্নান করছেন তখন সেখানে ঢেঁকিযানে নারদ মুনি উপস্থিত হলেন। 
কলহ বিদ্যায় বিজ্ঞ, দ্বন্দ্বপ্রিয় ঋষি গদগদ ভাষ্যে কৃষ্ণকে বলেন –কি আর বলবো, খুবই লজ্জা হচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্র যে সব কথা বললেন! তিনি দেবতাদের ডেকে বলেন –শুনুন, শুনুন অদ্ভূত কথা। নারদ এলেন গোপালের দূত হয়ে। দেবতাদের দুর্লভ পারিজাত পুষ্পরাজি মানুষের জন্য চাইতে। এমন অনুরোধে তার লজ্জা হল না! গোপালের এত অহংকার! পূর্বের সব কথা সে হয়ত ভুলেছে। কংসের ভয়ে তো নন্দের গৃহে লুকিয়ে ছিল। প্রতিদিন গোরুদের সেবা করত, গোপেদের অন্ন খেত। একদিন চুরি করে ননী খেতে হাত বেঁধে নন্দের ঘরণী(যশোদা) খুব মারল। পরে বৃষ(বৎসাসুর), অশ্ব(কেশী), সর্প(অঘাসুর, কালিয়), বক(বকাসুর) মেরে দেখছি খুব অহংকার হয়েছে! এদিকে জরাসন্ধের ভয়ে তো সমুদ্রে গিয়ে লুকিয়েছিল। এমনজনেরও পারিজাত পুষ্পের সাধ হয়েছে। আবার ভয় দেখিয়েছে না দিলে নাকি বিপদ আছে! এমন কটুকথা কি আমি সহ্য করতে পারি! কিন্তু কি করি দূত আর কেউ নন স্বয়ং নারদ মুনি। যান যান নারদ আমার সামনে আর দাড়িয়ে থাকবেন না। গিয়ে বলুন তার যা খুশি করতে পারে। 

নারদের মুখে এত কথা শুনে কৃষ্ণ রাগে চোখ লাল করে বলেন –মত্ত ইন্দ্র নিজেই নিজের মহত্ব লঘু করলেন। আজ তার অহংকার চূর্ণ করব। আপনিও স্বচক্ষে তা দেখতে চলুন। সে নিজে সব ভুলে গেছে। গোকুল থেকে তাকে দুর করেছিলাম। সাতদিন ধরে যত পরাক্রম দেখাবার দেখিয়েছিল তবু গোপকুলের পূজা নিতে সক্ষম হননি (গোবর্ধনপর্ব)। সুরপুরে থেকে দেখছি তার খুব অহংকার! এখন উচ্চকুলে তার নিবাস-অমরাবতীতে তার আধিপত্য। আবার ঐরাবতে চড়ে, বজ্র অস্ত্র ধরে সে অহং আরো বেড়েছে। আবার সহস্র লোচনও তার গৌরব। তবে আজ তার সব মত্ততা দূর করব। সুরপুর থেকে তাকে ভূমিতলে ফেলবো। প্রহারে ভাঙ্গব গজরাজ কুম্ভ স্থলে। অব্যর্থ মুনির(দধীচি মুনি) অস্থি সেই তার বজ্র। আজ তা ব্যর্থ করে দেবতাদের সমাজে তাকে হাসাব। বন ভেঙ্গে পারিজাত আনব সমূলে। 
দেখি শচীনাথ(ইন্দ্র=শচীর স্বামী) কেমন ভাবে তা রক্ষা করেন। 

এই বলে গোবিন্দ খগেশ্বরকে(গরুড়) স্মরণ করেন। খগরাজ এসে যোড়হাতে দাঁড়ান। 
কৃষ্ণ বলেন –ইন্দ্রের নগরে যাব, এখানে পারিজাত তরুবর নিয়ে আসব। 

গরুড় বলেন –প্রভু আপনি কেন যাবেন! আজ্ঞা দিলে আমি নিজে গিয়ে নন্দনবন থেকে পুষ্পসহ পারিজাত নিয়ে আসব। 

গোবিন্দ বলেন –যানি এ তোমার কাছে সামান্য কর্ম। কিন্তু আমি স্বয়ং গিয়ে তাকে শিক্ষা দেব। 

এই বলে গোবিন্দ প্রহরণ(অস্ত্র) নিলেন-কৌমদকী গদা(কুমোদক-বিষ্ণু), খড়্গ, সুদর্শন চক্র। তার সারঙ্গ ধনুকে গুণ চড়ালেন এবং গরুড়ের কাছে তার অক্ষয় তূণ রাখতে দিলেন। 
কিরীট(মুকুট), কুন্ডল দিয়ে বেশভূষা করলেন। যেন মেঘেতে শোভিত মিহির(সূর্য) মণ্ডল। কন্ঠে তার গজ মুক্তার হার, ঝিকিমিকি করে যেন বিদ্যুৎ আকার। বক্ষস্থলে কৌস্তভ রত্ন শোভা দিল যা দেখে মনে হয় যেন কোটি মনোভব(কামদেব) মূর্চ্ছা যাবেন। অঙ্গদ বলয়(বালা) ও কেয়ূর ভূষণ(বাজু) পরে পীতবর্ণের(হলুদ) বসন এঁটে বেঁধে নেন। সর্বাঙ্গে চন্দন কস্তুরি লেপন করে কাঁকালে(কোমড়ে) খড়্গ ছুরি বেঁধে নিলেন। 

কৃষ্ণ যখন গরুড়ে আরূঢ় হলেন তখন সত্যভামা বলে ওঠেন –আমিও আপনার সাথে যাব। ইন্দ্রের পুরী দেখব, ইন্দ্রানীকেও দেখব। কেমন করে ব্জ্রপাণি আপনার সাথে যুদ্ধ করেন দেখব। 


শুনে জগন্নাথ হরি তাকে নিজের বাম দিকে বসালেন। 
তারপর সাত্যকি আর পুত্র কামদেবকে ডেকে বলেন –আমার সাথে চল। ইন্দ্রের সাথে কি মজা করি দেখবে। 

কৃষ্ণের আজ্ঞা পেয়ে তারাও গরুড়ে আরোহণ করলেন। এভাবে চারজন যুদ্ধ দেখতে চললেন। 

সে সময় বলভদ্র সহ অন্য যাদবরা বলল –আমরাও তোমার সাথে যেতে চাই। 

গোবিন্দ বলেন –আপনারা দ্বারকায় থেকে রাজ্য রক্ষা করুন। শূণ্য জেনে দুষ্টরা আক্রমণ করতে পারে। 

এত বলে সবাইকে প্রবোধ দিয়ে কৃষ্ণ গরুড়কে চলার আজ্ঞা দিলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান। 
...................................

Sunday, August 2, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৯৮

[পূর্বকথা ইন্দ্রপ্রস্থে দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব সুখে বাস করতে লাগলো... একদিন অর্জুন বাধ্য হলেন যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদী একসাথে অবস্থান কালে গৃহে প্রবেশ করায়...তিনি নিজেই বারো বছরের বনবাসে যান... উলুপী ও চিত্রাঙ্গদার সাথে তার বিবাহ হয়... পরে প্রভাস তীর্থে এলে গোবিন্দ শুনে শীঘ্র সেখানে এসে পার্থকে আলিঙ্গন করলেন এবং দ্বারকায় নিয়ে আসেন..সেখানে সুভদ্রাকে দেখে অর্জুনের ভাল লাগে, সুভদ্রাও অর্জুনের প্রেমে পাগল হন এবং সত্যভামাকে তার মনের কথা জানান... সত্যভামা অর্জুনকে সুভদ্রা বিবাহের কথা বলেন...কথা প্রসঙ্গে পারিজাত হরণের কথা ওঠে...] 

পারিজাত হরণ বৃত্তান্তঃ


রুক্মিণী, কৃষ্ণ, সত্যভামা ও গরুড়

মুনি বলেন –হে, কুরুবংশ চূড়ামণি! শুনুন পারিজাত হরণের অপূর্ব কাহিনী। 
একদিন নারায়ণ রৈবতক পর্বতে বিহার করছিলেন। সে সময় নারদ সেখানে এসে বীণা বাজিয়ে কৃষ্ণের গুণগান করতে লাগলেন। বীণায় একটি পারিজাত পুষ্প বাঁধা ছিল। তিনি সেটি কৃষ্ণের হাতে উপহার দিলেন। 
পরম সুন্দর সে পুষ্প দেবেরও দুর্লভ। বহু যোজন পর্যন্ত তার সৌরভ ছড়িয়ে পরে। দেখে হৃষীকেশ কৃষ্ণ আনন্দিত হলেন। তিনি সেটি স্ত্রী রুক্মিণীকে পরিয়ে দিলেন। একে রুক্মিণীদেবী্ ত্রৈলোক্যমোহিনী, পারিজাত অঙ্গে দিতে তিনি আরো মোহময়ী হয়ে উঠলেন। 


রুক্মিণী, কৃষ্ণ ও নারদ 

নারদ কিছুক্ষণ কথোপকথন করে বিদায় নিলেন। ব্রহ্মার এই পুত্রটি কলহে আনন্দ পান। 
মুনি পথে যেতে যেতে চিন্তা করেন -সত্যভামার কাছে গিয়ে পারিজাতের কথাটা বলি, দেখি সত্রাজিতের কন্যা কি বলে! 
এই ভেবে নারদ দ্রুত দ্বারকায় সত্যভামার গৃহে গেলেন। মুনিকে দেখে সত্যভামা তাকে স্বাগত জানিয়ে পাদ্য অর্ঘ্য করে বসার আসন দিলেন। 

সত্যভামা হেসে বলেন –এতদিন কোথায় ছিলেন, মুনিবর! 

নারদ মুনি করুন মুখে বলেন –আজ ইন্দ্রের নগরে গেছিলাম। তিনি পারিজাত পুষ্প দিয়ে আমার পূজা করেন। সে পুষ্প দেবতাদের কাছেও দুর্লভ, মানুষ তো দেখেই নি। ইদ্র তা গর্ব করে আমায় দিলেন। 
পুষ্প দেখে আমি মনে মনে ভাবলাম ইন্দ্র ছাড়া উপেন্দ্রের(ইন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা/বিষ্ণুর বামনাবতার) কাছেই এ পুষ্প শোভা পায়। সে কারণে পুষ্প এনে কৃষ্ণকে দিলাম। 
পুষ্প দেখে গোবিন্দও আনন্দিত হলেন। তখনই তিনি রুক্মিণীকে ডেকে এনে স্বহস্তে পারিজাত পুষ্প তাকে পরিয়ে দিলেন। সে পুষ্প ধারণ মাত্র ভীষ্মক কন্যা নিজেকে রূপে ত্রৈলোক্য বিজিতা মনে করছেন। 
কিন্তু আমি তো এতদিন জানতাম তুমিই কৃষ্ণের সবচেয়ে প্রিয় প্রেয়সী ছিলে। এখন জানলাম রুক্মিণীই তার প্রিয় পাটরাণী।

মুনির মুখে এত কথা শুনে সত্যভামা পুতুলের মত স্থির হয়ে গেলেন। রাগে তিনি কন্ঠের হার ছিঁড়ে ফেললেন। অঙ্গের সব অলঙ্কার খুলে ফেললেন। খোঁপা খুলে ফুলের মালা ছিড়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে হাহাকার করতে লাগলেন। 

সত্যভামাকে কষ্ট পেতে দেখে নারদ মুনি মনে মনে হেসে আবার রৈবতক পর্বতের দিকে বেগে রওনা দিলেন। 
সেখানে রুক্মিণীর গৃহে কৃষ্ণ তখন ভোজন করছিলেন। সে সময় নারদ সেখানে উপস্থিত হলেন। 

গোবিন্দ বলেন –কহ মুনি, কি সমাচার! পুনরায় কি কারণে এলেন। 

মুনি বলেন –অবধান করুন শ্রীমধুসূদন, আমি দ্বারকায় গেছিলাম। সত্যভামা তখন আপনার কথা জিজ্ঞেস করলেন। কথাপ্রসঙ্গে পারিজাত প্রসঙ্গ এল। কিন্তু এমন হবে সে তো আমি জানতাম না! রুক্মিণীকে পারিজাত পুষ্প দিয়েছেন শুনে সেখানেই তিনি মূর্ছিত হয়ে পরে উচ্চস্বরে হাহাকার শুরু করেছেন। যত বসন ভূষণ ছিল সব ছিড়ে ফেলছেন। হাত দিয়ে কপালে আঘাত করে যাচ্ছেন। সব সখিরা প্রবোধ দিতে গেলে তা না শুনে আরো রেগে দ্বিগুণ হচ্ছেন। ‘প্রাণ যাক্‌, প্রাণ যাক্‌’ বলে ডাক ছারছেন দেখে দ্রুত আপনাকে সব জানাতে এলাম। 

সব শুনে গোবিন্দ বিস্মিত হলেন। কি করবেন ভেবে পেলেন না। 
পারিজাত পুষ্পের জন্যই এই গণ্ডগোল বুঝে তিনি রুক্মিণীকে ডেকে বলেন –আমায় ক্ষমা কর, বিদর্ভি(রুক্মিণী)! তুমি সত্যভামার চরিত্র যান। রাগে সে নিজের প্রাণও নিতে পারে। তাই তোমার পারিজাত পুষ্পটি তুমি সত্যভামার জন্য দাও। 

শুনে রুক্মিণী খুবই দুঃখ পেলেন। 
অধোমুখে গোবিন্দকে বলেন –হে মুরারি! একবার পুষ্পরাজ দিয়ে পুনরায় চেয়ে নিচ্ছ, এমনই দুর্ভাগা আমি! আমায় পুষ্প দিলেন বলে সে হিংসায় জ্বলছে। সে সেই হিংসায় জ্বলে মরুক, আমি পুষ্প দেব না। 

রুক্মিণীর কথায় শ্রীহরি চিন্তিত হয়ে নারদকে জিজ্ঞেস করেন –এর বৃত্তান্ত বল। এই পুষ্প আপনি কোথা থেকে পেলেন। 

নারদ বলেন –স্বর্গে এই পারিজাত বৃক্ষটি আছে। ইন্দ্রের রক্ষকরা এর রক্ষা করছে। এই পারিজাত বৃক্ষের পুষ্পই নন্দন বনকে শোভিত করে। আপনি সহস্রলোচনের(ইন্দ্র) কাছে আরো পুষ্প চেয়ে পাঠান। আপনার নাম শুনে অবশ্যই তিনি দেবেন। 


সাগর মন্থনের ফলে পারিজাতপুষ্প বৃক্ষের উৎপত্তি 

গোবিন্দ বলেন –মুনি আপনি যান সেখানে ইন্দ্রকে গিয়ে বলুন, ক্ষীরোদ সাগর মন্থন করে এই পুষ্প বৃক্ষের উৎপত্তি হয়েছে, একা তিনি কেন তা ভোগ করবেন! আমার ভাগের যতটা আছে তা আমায় দিয়ে দিন। ভাল ভাবে না দিলে কষ্ট আছে জানিয়ে দেবেন। প্রথমে চাইবেন, না দিলে এই কথাগুলো শোনাবেন। 

এই বলে নারায়ণ নারদকে ইন্দ্রের কাছে পাঠালেন এবং নিজে সত্যভামার জন্য দ্বারাবতী রওনা দিলেন। 


পারিজাতপুষ্প

মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী, কাশীরাম কহেন সাধুজন পান করেন কর্ণ ভরে। 
...................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers