Blog Archive

Thursday, October 4, 2012

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪২

 
ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর ও পান্ডুর বিবাহঃ 

কুরুবংশে তিন পুত্র ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু ও বিদুরের জন্ম হল। ভীষ্ম তাদের নানা বিদ্যাশিক্ষা দান করলেন। 

ধৃতরাষ্ট্র অসাধারণ বলবান, পান্ডু পরাক্রান্ত ধনুর্ধর এবং বিদুর অদ্বিতীয় ধর্মপরায়ণ হলেন। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ, বিদুর শূদ্রগর্ভজাত- একারণে পান্ডুই রাজপদ পেলেন।

অনেকদিন পর যখন তারা যৌবনপ্রাপ্ত, তখন ভীষ্ম তাদের বিবাহের কারণে চিন্তিত হলেন। 

 
ধৃতরাষ্ট্র

যদুবংশে সুবলরাজের কন্যা গান্ধারী। তিনি ঈশ্বরের আরাধনায় বর পান একশত পুত্রের জননী হবেন। এ সংবাদ শুনে ভীষ্ম দূত পাঠালেন। কুরুবংশের সন্তান ধৃতরাষ্ট্রের জন্য তার কন্যা প্রার্থনা করলেন।শুনে গান্ধাররাজ ভাবলেন কুরুকূল মহাবংশ, কেবল পাত্র অন্ধ। কিন্তু কন্যা না দিলে ভীষ্ম ক্রোধীত হবেন- এই ভেবে তিনি এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন। 
বিবাহের আয়োজন চললো। হাতি ঘোড়া, রথ, রত্ন সকল সাজান হল। দাসদাসী, গরু, মহিষ- সে বিশাল আয়োজন চললো। গান্ধারীর ভাই শকুনির সঙ্গে অনেক ব্রাহ্মণও গেল। গান্ধারী শুনলেন স্বামী অন্ধ। নিজ কর্মফল ভেবে তিনি শুক্ল পট্টবস্ত্রে নিজের চোখ দুটি বেঁধে ফেললেন। এভাবে পতিকে অতিক্রম না করে, তার পথ অনুসরণ করে গান্ধারী পতিব্রতা রূপে জগৎ বিখ্যাত হলেন।
 
নন্দলাল বসুর আঁকা- গান্ধারী

শকুনি হস্তিনানগরে এসে বোনকে ধৃতরাষ্ট্রের হাতে অর্পন করলেন। নানা অলঙ্কার দান করলেন। হস্তী, অশ্ব, রথ, রত্নও প্রদান করলেন এবং নিজের দেশে ফিরলেন।

 
পান্ডু 

জ্যৈষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ দিয়ে ভীষ্ম পান্ডুর জন্য চিন্তিত হলেন। শূর নামে এক যাদবরাজ ছিলেন –যিনি বসুদেবের পিতা ও কৃষ্ণের পিতামহ। তার কন্যা পৃথা। কুন্তিভোজ রাজা শূরের বন্ধু/মিত্র ছিলেন এবং পৃথাকে খুব স্নেহ করতেন। কুন্তীভোজকে নিঃসন্তান ও দুখী দেখে শূর নিজ কন্যাকে দান করলেন। কন্যার নাম হল কুন্তী। 

কুন্তী পূর্ণবয়স্কা হলে কুন্তীভোজ তাকে অতিথি শুশ্রূষায় নিয়োগ করলেন। পিতৃ আজ্ঞা পেয়ে কুন্তী অতিথিদের পূজা করেন, তাদের সেবাযত্ন করেন।

এসময়ে দুর্বাসা মুনি তার অতিথি হয়ে এলেন। কুন্তী নিজ হাতে তার পায়ে ফুল দিলেন, ধুয়ে দিলেন। রত্নময় সজ্জায় শয়ন করালেন। মিষ্টান্ন, পক্কান্ন দিয়ে ভোজন করালেন। কন্যা সর্বদা মুনির সামনে করযোড়ে থাকেন। তার সেবায় দুর্বাসা তুষ্ট হলেন এবং কুন্তীকে একটি মন্ত্র শিখিয়ে বললেন, এই মন্ত্র দ্বারা তুমি যে যে দেবতার স্মরণ করবেন তাঁদের প্রসাদে তোমার পুত্রলাভ হবে। মন্ত্রদান করে মুনি প্রস্থান করলেন।
 

এইরূপ আশ্চর্য বর পেয়ে কুন্তী আনন্দিত হলেন। তিনি মন্ত্র জপ করে দিনমনি তথা সূর্যকে স্মরণ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সূর্য তার সামনে উপস্থিত হলেন। সূর্যকে দেখে কুন্তী ভয় পেলেন। করযোড়ে তাঁকে বললেন দুর্বাসার মন্ত্রের পরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি দেব দিনকরকে স্মরণ করে ফেলেছিলেন। বামা জাতির দোষ ভেবে তিনি যেন কুন্তীকে ক্ষমা করে দেন।

সূর্য বললেন মুনির বচন যেমন সত্য, তেমনি তার আগমনও সত্য এবং তা বৃথা হতে পারে না। প্রথমমন্ত্র পেয়ে কুন্তী সূর্যকে ডেকেছেন, তাকে ভজনা না করলে মন্ত্র ব্যর্থ হবে।

পৃথা বললেন তিনি শৈশব বয়স্ক, কোন ভুল কাজ করলে অপযশ রটবে। 

দিনকর বলেন ভয় মনে এনো না, আমার কারণে তোমার কোন দোষ হবে না এ ভুবনে। আমাদের মিলনে তুমি পুত্র লাভ করবে এবং কুমারীই থাকবে। 

অনেক প্রবোধ দিয়ে সূর্য বর দিয়ে গেলেন এবং পৃথাকে ভজনা করে তার সাথে শৃঙ্গার করলেন। তার বীর্য্যে পৃথার গর্ভে এক সন্তান এলো, যিনি জন্ম থেকেই অক্ষয় কবচ পেলেন, কানে তার সোনার কুন্ডল। পুত্রকে দেখে পৃথা বিস্মিত হলেন। এই অপরূপ পুত্র লোকখ্যাত হবে ভেবে চিন্তিত হলেন। তার দোষে কুলে কলঙ্ক পড়বে। এসব কথা ভেবে পৃথা পুত্রকে কোলে নিয়ে তাম্রকুন্ডে করে জলে ভাসিয়ে দিলেন। 
 

সূতবংশীয় অধিরথ প্রতিদিন যমুনায় স্নান করতেন। তাম্রকুন্ড ভেসে যাচ্ছে দেখে তিনি তা তুলে এনে ভিতরে অপূর্ব সুন্দর কুমার দেখে আনন্দের সঙ্গে তাকে গৃহে নিয়ে গেলেন। তাঁর পরমাসুন্দরী স্ত্রী রাধা অপুত্রক ছিলেন-তারা বহুযত্নে পুত্রকে পালন করতে লাগলেন। 

 
কর্ণ 

পুত্রের নাম হল বসুসেন। দিনে দিনে পুত্র চন্দ্রের মত বাড়তে লাগলেন। সর্বশাস্ত্রে বিশারদ হয়ে তিনি মহাবীর হলেন। বসুসেন সূর্যের আরাধনা করতেন। জিতেন্দ্রিয় এই মহাবীর ব্রতে অনুরত, ব্রাহ্মণকে দান করেন, যিনি যা চান তাই দান করেন। কেউ প্রাণ চায় না তাই যেন তিনি প্রাণে বেঁচে আছেন। তাকে দেখে পুত্রের কারণে ইন্দ্র ব্রাহ্মণের বেশে এসে কুন্ডল কবচ প্রার্থনা করেন। বীর নিজ অঙ্গ কেটে তা ছদ্মবেশী ইন্দ্রকে দান করেন। ইন্দ্রও তাঁকে শক্তিঅস্ত্র দান করে বললেন-যার উপর তুমি এই অস্ত্র ক্ষেপণ করবে সে মরবে, কিন্তু একজন নিহত হলেই অস্ত্রটি আমার কাছে ফিরে আসবে। কবচ কেটে দেওয়ার জন্য বসুসেন কর্ণ ও বৈকর্তন নামে জগৎ বিখ্যাত হন। 

 
কুন্তী ও পান্ডু

ভোজের কন্যা পৃথা পিত্রালয়ে থাকেন। যৌবনপ্রাপ্ত হলে তার স্বয়ম্বর করা হয়। সকল রাজাদের নিমন্ত্রণ করা হল। সকলের মাঝে পান্ডু ইন্দ্রের মত অবস্থান করলেন। তার শোভা যেন গ্রহের মধ্যে সূর্যের- তার কাছে সকল নৃপবর তুচ্ছ হয়ে গেল। পৃথা পান্ডুকে দেখে আনন্দিত হলেন এবং তাকেই বরণ করলেন। ভোজরাজ তাকে সন্মানিত করলেন। নানা রত্নে সাজিয়ে কন্যাকে দান করলেন। সকল রাজা যে যার দেশে গমন করলেন। কুন্তীকে নিয়ে পান্ডু নিজ দেশে এলেন। ইন্দ্রের কোলে যেমন পুলোমা নন্দিনী পৌলমী/শচী, রজনীপতি সূর্যের কোলে যেমন শোভিত রোহিনী- তেমনি পান্ডু ও কুন্তীকে দেখে হস্তিনানগর হরষিত হল। আনন্দের নগরজুরে নাচ গান অনুষ্ঠান হল।

 
মাদ্রী 

কিছু সময় পর ভীষ্ম বিচার করে দেখলেন বংশবৃদ্ধির জন্য পান্ডুর আবার বিবাহ দেওয়া প্রয়োজন। তিনি শুনলেন মদ্রদেশে শল্য নামে এক রাজা আছেন যার পরমাসুন্দরী এক ভগিনী আছে। বার্তা পেয়ে ভীষ্ম সেখানে উপস্থিত হলেন। 
শল্যরাজ ভীষ্মের যথাযথ সেবা করলেন এবং তার আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। ভীষ্ম তাকে বললেন শল্য বিখ্যাত রাজা তাই তিনি তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চান এবং সে কারণে তার ভগিণীর সাথে পান্ডুর বিবাহ দিতে চান। 
শুনে শল্যরাজ হেসে জানালেন তাদের কুলের ধর্ম আছে কন্যাকে দিয়ে পণ নিতে হয়। তিনি এসব চান না। কিন্তু কুলধর্ম রক্ষা না করলে পাপ। 
ভীষ্ম বললেন কুলাচার পালন করা কর্তব্য। 
তিনি সাতকুম্ভ পূর্ণ করে অমূল্য রতন, কাঞ্চন, অশ্ব, রথ, গজ, বিচিত্র বসন প্রমুখ দান করলেন। 

ধন পেয়ে শল্যরাজ প্রীত হয়ে নানা রত্নে ভগিণী মাদ্রীকে সাজিয়ে ভীষ্মের সম্মুখে আনলেন। মাদ্রীকে নিয়ে ভীষ্ম নিজদেশে উপস্থিত হলেন এবং পান্ডুর সাথে মাদ্রীর বিবাহ দিলেন। মাদ্রীর রূপ দেখে পান্ডু আনন্দিত হলেন। তিনি দুই স্ত্রী নিয়ে সুখি ছিলেন, দুজনকেই সমান সন্মান করতেন। 

এসময় তিনি দিগবিজয়ের প্রতিজ্ঞা করেন। পদাতিক, রথাশ্ব, গজ, চতুরঙ্গ নিয়ে তিনি পশ্চিমদিকে যাত্রা করলেন। দশার্ণ দেশের রাজা, মগধের মদ্ররথ রাজা, মিথিলারাজ কশীচন্ড- প্রমুখকে যুদ্ধে পরাজিত করলেন। রাজারা মিলিত হয়ে তার বিরুদ্ধে যু্দ্ধ ঘোষণা করলেন, তথাপি পরাজিত হয়ে রণে ভঙ্গ দিলেন। 
পান্ডু প্রচুর রাজকর নিয়ে দেশে ফিরলেন। তার যশে নগর পূর্ণ হল। ভীষ্ম পান্ডুর প্রতি প্রীত হলেন, তার মস্তক চুম্বন করলেন এবং অনেক আশির্বাদ দিলেন। 
পান্ডু সকলকে প্রণাম জানিয়ে সকল সম্পদ ধৃতরাষ্ট্রকে অর্পণ করলেন। ধৃতরাষ্ট্রও তাকে সন্মানিত করলেন। পান্ডুকে অনেক দান করলেন। অশ্বমেধ যজ্ঞ করালেন, হস্তী, হয় তথা ঘোড়া, গরু এবং প্রচুর অর্থ ও ভূমি দান করলেন। ধৃতরাষ্ট্রের হাতে রাজ্যের অধিকার অর্পণ করে পান্ডু বনে মৃগয়া করতে গেলেন। কুন্তী ও মাদ্রীকে নিয়ে পান্ডু বনে বনে আনন্দে বাস করেন যেন হস্তিনানগরেই অবস্থান করছেন।

 
বিদুর 

এবার ভীষ্ম বিদুরের বিবাহের কথা চিন্তা করলেন। তিনি দেবকরাজার কন্যাকে বিদুরের সাথে বিবাহ দিলেন। দেবকরাজের কন্যার নাম পরাশরী, রূপে তিনি স্বর্গের বিদ্যাধরীদের হার মানান। মহাধর্মশীল বিদুরের থেকে পরাশরীর গর্ভে যে পুত্ররা জন্মালেন তারা পিতার মতন অতি নম্র, ধীর, অসামান্য গুণশালী, ধর্মে সুস্থির।

কুরুবংশের বৃদ্ধির কথা যে জন শুনে তার বংশবৃদ্ধি হয় ব্যাসের বচনে। 
.......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers