Blog Archive

Monday, December 23, 2013

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪৯

পান্ডুরাজার মৃত্যুঃ 
 
সুখে পুত্রদের নিয়ে পান্ডুরাজা বসবাস করছিলেন। 

এসময় ঋতুরাজ বসন্ত উপস্থিত হলেন। বন বসন্তে শোভিত হল। নানা বৃক্ষ পুষ্পে শোভিত হল-পলাশ, চাঁপা, আম, অশোক, কেশব, পারিভদ্র, কেতকী, করবী প্রভৃতি। আনন্দিত মনে পান্ডু গহন নিকুঞ্জবনে ভ্রমণ করেন। 
কুন্তী পাঁচ পুত্র নিয়ে নিজ স্থানে থাকেন। 
রাজা মাদ্রীকে নিয়ে অরণ্যে প্রবেশ করলেন। 
মাদ্রী যে রাজার সাথে আছেন সে কথা কুন্তী জানতেন না। 

বসন্তকালে যুবতী স্ত্রীকে নিয়ে রাজা বিহারে এলেন - মদন মেতে উঠল। মদনের শরে রাজা অবশ হলেন। ঘন ঘন মাদ্রীর রূপ সৌন্দর্য দর্শণ করতে লাগলেন। 

 

বিকশিত পদ্মের মত মাদ্রীর সুচারু দেহ সৌষ্টব। পদ্মের মত টানা টানা সুন্দর চক্ষু যেন কর্ণকে স্পর্শ করে। ডালিম ফলের মত তার দুই স্তন। বিপুল নিতম্বের ভারে গমন তার মন্থর। সব সময় মধুর কথনে যেন সুধা বর্ষণ করেন। তাকে দেখে পান্ডুর রতিক্ষুধা জাগল। কামে অবশ রাজা মুনির কথা ভুলে গেলেন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি রাজা হারালেন। মাদ্রীর সাথে শৃঙ্গার করতে চাইলেন।

মাদ্রী তাকে বাধা দিতে চাইলেন, অতি উচ্চ স্বরে হাহাকার করতে লাগলেন। রাজার আচরণের জন্য মাদ্রী তাকে ভৎসনা করতে থাকেন। মৃগরূপী ঋষির অভিশাপের কথা স্মরণ করালেন। 



কিন্তু কামরসে আচ্ছন্ন পান্ডু মাদ্রীর কোন কথাই শুনতে চাইলেন না। 
কালের কথা কেউই খন্ডন করতে পারে না, পরম পন্ডিতের বুদ্ধিও কাল সংহার করেন। পান্ডুও সকল কথা বিস্মৃত হলেন। পত্নীর নিষেধ অগ্রাহ্য করে সংযম হারিয়ে তাঁকে সবলে গ্রহণ করলেন। 

ঋষিশাপে মৃত্যু সেথায় উপস্থিত হলেন। পান্ডুরাজাকে শরীর ত্যাগ করতে দেখে মাদ্রী সুন্দরী হাহাকার করে উঠলেন।

এদিকে মাদ্রীসহ পান্ডুকে না দেখতে পেয়ে কুন্তী মনে মনে আতঙ্কিত হলেন। অনেক বেলা হয়ে গেল তবু তারা ফিরছেন না দেখে কুন্তী পুত্রদের নিয়ে তাদের খুঁজতে বেরলেন। 

অনেক দুর যেতে হঠাৎ মাদ্রীর কান্না ও হাহাকার শুনতে পেলেন। দ্রুত সেথায় গিয়ে দেখেন মাদ্রী কাঁদছেন এবং তার কোলে পান্ডু পরে আছেন। হঠাৎ যেন মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ল। কুন্তী জ্ঞান হারালেন। জ্ঞান ফিরলে তিনি কেঁদে মাদ্রীকে বললেন- কি কাজ করলে মাদ্রী, নিজ দোষে স্বামী হত্যা করলে। চিরকাল এ কারণে তিনি কষ্ট পাবে। 

মাদ্রী কেন একা রাজার সাথে এলেন, কেন তাকে নিবৃত্ত করলেন না, কেন পুত্রদের আনলেন না-তা হলে রাজার মৃত্যু হত না। মদনে মেতে মাদ্রী স্বামীকে হারালেন। মৃগঋষির শাপ ভুলে একা স্বামীর সাথে বনে এসেছেন। কুন্তী রাজাকে সর্বদা সাবধানে রক্ষা করতেন। আজ বিজনস্থানে মাদ্রী রাজাকে লোভিত করলেন। মাদ্রী নিজের সাথে কুন্তীরও পরম সর্বনাশ করলেন। 

মাদ্রী বলেন- দেবী আমি বার বার তাকে বারণ করেছি। তুমি মিথ্যাই আমার নিন্দা করছ। দৈবের লিখন কারো খন্ডাবার সাধ্য নেই, তাই রাজা আমার কথা শুনলেন না এবং মৃত্যু বরণ করলেন। 

কুন্তী বলেন ভাগ্যকে খন্ডন করা যায় না যখন তখন তিনি যা বলেন মাদ্রী তাই শুনুক। মাদ্রী তার থেকে ভাগ্যবতী, কারণ তিনি রাজাকে হৃষ্ট দেখেছেন। তিনি জ্যেষ্ঠা ধর্মপত্নী, সে কারণে তিনি সহমৃতা হবেন এবং মাদ্রী পাঁচপুত্রকে পালন করবেন।

মাদ্রী বলেন তিনি রাজাকে না দেখতে পেলে বাঁচবেন না। কুন্তীর সাথে দেখা করার জন্যই তিনি প্রাণত্যাগ করেন নি। তাঁর যৌবনে রাজা এখনও তৃপ্ত হন নি, তার সাথে রমণকালে রাজার মৃত্যু হল, তাই রাজাকে তিনি ত্যাগ করতে পারবেন না। এছাড়া তিনিও রাজার থেকে তৃপ্ত হননি, অতএব তিনিই পতিকে অনুসরণ করবেন।
তার একমাত্র নিবেদন কুন্তী যেন তার দুই সন্তানকেও নিজের সন্তানের মত পালন করেন, কোন ভেদ না রাখেন। পিতা-মাতা বিনা সন্তান অনাথ। কুন্তীই আজ থেকে তাদের পিতা-মাতা-বন্ধু। এই বলে মাদ্রী কুন্তীর কাছে বিদায়ের আজ্ঞা নিয়ে রাজার শবকে নিবিড় ভাবে আলিঙ্গন করে প্রাণত্যাগ করলেন।
 
......................................

Wednesday, November 13, 2013

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪৮

নকুল ও সহদেবের জন্মঃ 

 

একদিন পান্ডুকে একান্তে দেখে মাদ্রী তার কাছে গিয়ে বললেন – কুরুবংশে সম্প্রতি তিনজন বধূ। ইতিমধ্যে দুজন পুত্রবতী হয়েছেন। শোনা যাচ্ছে গান্ধারীর একশত পুত্র হয়েছে। নিজ চক্ষে দেখছি কুন্তী তিনপুত্রের জননী। আমিই অভাগী তাই এই সুখ থেকে বঞ্চিত হলাম। পান্ডু যদি কুন্তীকে বলেন, তিনি অনুগ্রহ করলে তিনিও মা হতে পারেন। সতীন কুন্তীকে তিনি নিজে ভয়ে বলতে পারেন না, কিন্তু স্বামীর বাক্য কুন্তী অন্যথা করতে পারবেন না। 

মাদ্রীর কথা শুনে পান্ডু বলেন তারও এই কথাই মনে এসেছিল, কিন্তু মাদ্রী কি মনে করেন তাই বলতে পারেন নি। মাদ্রী তার ধর্মপত্নী, তিনি সম্মত থাকলে পান্ডু অবশ্যই কুন্তীকে জানাবেন।

পান্ডু কুন্তীর কাছে গিয়ে একান্তে বলেন-কুলের কল্যাণে ইন্দ্রত্ব পেয়েও ইন্দ্র নিত্য যজ্ঞ করেন। যশের কারণে ও শাস্ত্রানুসারে বেদে-তপে শ্রেষ্ঠ হন ব্রাহ্মণ। তবুও তারা গুরুর সেবা করেন। 

পান্ডু কুন্তীকে বোঝান কুন্তীই মাদ্রীকে উদ্ধার করতে পারেন। মাদ্রীর বংশ রক্ষা পেলে তারও পুত্রকামনা পূর্ণ হয়। 

এত শুনে কুন্তী পান্ডুকে বলেন তার আজ্ঞায় কুন্তী মাদ্রীকে একবার মাত্র মন্ত্রদান করবেন। 

 

মাদ্রীকে ডেকে কুন্তী তার মনের কথা জানান।

মাদ্রি চিন্তা করে দেখেন একবার মন্ত্র পেয়ে অধিক সন্তান তিনি কি ভাবে পেতে পারেন! অনেক ভেবে দেখেন দেবতাদের মধ্যে অশ্বিনীকুমাররা যমজ। তাই তিনি অশ্বিনীকুমার যুগলকে স্মরণ করলেন। মন্ত্রের প্রভাবে তারা মাদ্রীর কাছে এলেন। এভাবে মাদ্রী যমজ সন্তানের মা হলেন। সন্তানদের জন্মের পর আকাশবানী হল- রূপেগুণে তারা শোভা বর্ধন করবেন। 


এভাবে পান্ডুর পাঁচটি পুত্র হল। পর্বতবাসী ঋষিরা এসে তাদের নামকরণ করলেন। জ্যেষ্ঠ হওয়ায় নাম হল ‘যুধিষ্ঠির’।

ভয়ঙ্কর মূর্তির জন্য নাম হল বীর পুত্রের ‘ভীম’।

তৃতীয়জনের নাম রাখা হল ‘অর্জুন’।


মাদ্রীর পুত্রদের নাম হল যথাক্রমে ‘নকুল’ ও ‘সহদেব’। 
 

এভাবে পাঁচপুত্র সিংহের মত বিক্রমের সাথে পর্বতে বাড়তে লাগলেন। শতশৃঙ্গ পর্বত তাদের উপস্থিতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পান্ডু পঞ্চপুত্রদের দেখে আনন্দিত হন। কুন্তি-মাদ্রীও খুশি হন। তারা তিনজন পঞ্চপুত্রদের ক্ষণের জন্যেও চোখের আড়াল করেননা।

এভাবে পাঁচপুত্রকে তারা যখন পালন করছেন, তখন একদিন পান্ডু কুন্তীকে বললেন –সন্তান সুখের তুল্য সুখ সংসারে আর নেই। সকল সুখ ম্রীয়মান হয় সন্তানসুখ বিনা। রাজ্যবন্ত, ধনবন্ত, বিদ্যাবন্ত জন সন্তান বিনা অকারণ হয়ে পরেন। সন্তানসুখ ইহকালে সুখদায়ী, লোকের মাঝে গৌরবদায়ী এবং পরকালে নিস্তারক, পরমপাপীদেরও উদ্ধারক। 

ধৃতরাষ্ট্র পরম ভাগ্যবান, শোনা যাচ্ছে তার শতপুত্র হয়েছে। সে কারণে পান্ডু কুন্তীকে অনুরোধ করছেন তিনি পুনরায় মাদ্রীকে আর একবার মন্ত্র দিন, আবার পান্ডু সন্তানসুখ পান। 

শুনে কুন্তী জোড়হাতে বলেন, এরূপ আজ্ঞা রাজা যেন না করেন। কারণ, মাদ্রী পরম কপটী। একবার মন্ত্র পেয়ে সে যমজ সন্তান কামনা করেছে। 
মাদ্রীর কারণে কুন্তি ভয় পান। তিনি রাজাকে কৃতাঞ্জলি নিবেদন করেন- মাদ্রীর কারণে তাকে যেন আর কিছু অনুরোধ না করেন। 

কুন্তীর কথা শুনে পান্ডু চুপ করে গেলেন এবং মনে মনে সন্তানবাঞ্ছা ত্যাগ করলেন।

পান্ডবের জন্মকথা অপূর্ব কথন, যারা শুনবে তারাই স্ববাঞ্ছিত ফল পাবে। ব্যাসদেবের বাক্যে কোন সংশয় নেই, সে কথাই পাঁচালী আকারে কাশীরামদাস বলেছেন।

Tuesday, September 17, 2013

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪৭

যুধিষ্ঠারাদির জন্মঃ

যম বা ধর্মদেব

মুনি বলেন -গান্ধারী যখন এক বছর গর্ভধারণ করলেন সেই সময় কুন্তী দূর্বাসার দেওয়া মন্ত্র জপ করে ধর্মকে আহ্বান জানালেন। সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম কুন্তীর কাছে এলেন। ধর্মের সঙ্গে সঙ্গমের ফলে কুন্তী গর্ভবতী হলেন। পরম সুন্দর এক পুত্র প্রসব করলেন সতী কুন্তী। ইন্দ্র-চন্দ্র সমান তার কান্তি, তেজ সূর্যের মত। তার আগমনে শতশৃঙ্গ পর্বত উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দিন দুই প্রহরে পূণ্য তিথিতে, অতি শুভক্ষণে কুন্তীর পুত্র জন্মাল। সে সময় আকাশ থেকে দৈববাণী হল- সকল ধার্মিক শ্রেষ্ঠ এই পুত্র সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয়। ইনি হবেন মহারাজা। জগতের লোক তাকে পূজা করবে। 

যুধিষ্ঠির

এত শুনে পান্ডু কুন্তীকে ডেকে বললেন –আকাশবাণী বলে দেবতারা জানালেন ধার্মিক, সুবুদ্ধি, শান্ত হবে এ নন্দন। কিন্তু ক্ষত্রিয়দের মধ্যে বলিষ্ঠকেই শ্রেষ্ঠ বলা হয়। ধার্মিক ব্রাহ্মণদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়। সে কারণে রাণী পুনরায় অন্য কোন দেবতার স্মরণ কর যাতে বলবান পুত্র হয়।


পবনদেব

রাজার কথায় কুন্তী চিন্তিত হলেন। দেবতাদের মধ্যে বলিষ্ঠ হলেন পবন। মন্ত্র জপে কুন্তী বায়ুকে স্মরণ করলেন। সাথে সাথে পবন সেখানে উপস্থিত হলেন। তাদের মিলনে যে পুত্র জন্মাল, জন্মমাত্র তার বিক্রমে জগত কেঁপে উঠল। 
পুত্র প্রসব করে কুন্তী তাকে কোলে নিতে গেলেন। কিন্তু পর্বতের মত ভারি সদ্যজাতকে নারাতে পারলেন না। অনেক কষ্টে মাটি থেকে তুললেন, কিন্তু সহ্য করতে নাপেরে হাত খুলে গেল। পর্বতে পুত্র পরতেই পর্বত কেঁপে উঠল। শিলা, বৃক্ষ, গিরি, শৃঙ্গ চূর্ণ হল। বালকের চিৎকারের শব্দে বনবাসী জীবেরা আতঙ্কিত হল। বাঘ, সিংহ, মহিষাদি যত পশু ছিল, সবাই ভয়ে অন্য বলে চলে গেল।

বালক ভীম

এ সময় আবার দৈববাণী হল– কুন্তী ও পান্ডু এই তোমাদের পুত্র। যত বলিষ্ঠ আছে পৃথিবীতে সবার থেকে এই শ্রেষ্ঠ মহাবলধর-নির্দয়, নিষ্ঠুর এই দুষ্টজন রিপু, অস্ত্রেতে অভেদ তার বজ্রসম বপু। 

সব দেখে শুনে পান্ডু বিস্মিত হলেন। কুন্তীও এই পুত্রকে দেখে আশ্চর্য মানলেন। 
 
ভীম

এভাবে দুই পুত্রের জন্ম হল। একজন ধার্মিক, অন্যজন নির্দয়। 

পান্ডু কুন্তীকে পুনরায় অনুরোধ করলেন সর্বগুণযুক্ত এক পুত্রের জন্য।
কুন্তী বলেন- কি ভাবে তা হবে! কোন দেবতাকে আরাধনা করলে তার স্বামীর ইছা পূর্ণ হবে।
পান্ডু তখন মুনিদের জিজ্ঞাসা করলেন এমন সর্বগুণযুক্ত কোন দেবতাকে আরাধনা করলে তিনি তেমন পুত্র পাবেন। 

মুনিরা বলে –সর্বগুণযুক্ত হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। তার সেবা করলে রাজার কামনা পূর্ণ হবে। মুনিরা আরো জানালেন ইন্দ্র বিনা তপস্যায় তুষ্ট হবেন না। তাই পান্ডুকে তার তপস্যা করতে হবে। 
 
ইন্দ্রদেব

এত শুনে পান্ডু উর্দ্ধবাহু, একপদে দাঁড়িয়ে সারা বছর বায়ু সেবন করে ইন্দ্রের তপস্যা করলেন। তপে সন্তুষ্ট হয়ে বাসব/ইন্দ্র সেখানে উপস্থিত হলেন। 
পান্ডুকে তিনি বর প্রার্থনা করতে বললেন। তার সর্বগুণসম্পন্ন পুত্র হবে আশির্বাদ করলেন। বর দিয়ে ইন্দ্র অন্তর্ধান হলেন।

তপস্যা শেষ করে পান্ডু কুন্তীর কাছে গিয়ে আনন্দের সঙ্গে জানালেন তুষ্ট হয়ে পুরন্দর/ইন্দ্র তাকে বর দিয়েছেন স্ববাঞ্ছিত ফল রাজা পাবেন, সর্বগুণ সম্পন্ন পুত্র তার হবে। তপস্যা করে পান্ডু ইন্দ্রকে প্রসন্ন করেছেন, এখন কুন্তী তাকে মুনিমন্ত্রে স্মরণ করুন।

স্বামীর আজ্ঞায় কুন্তী ইন্দ্রকে স্মরণ করলেন। দেবরাজ উপস্থিত হলেন। সঙ্গম করে ইন্দ্র বর দিলেন তার ঔরসে তার সমান পুত্র হবে। 

পুত্রের জন্মমাত্র দৈববাণী হল- সুরাসুরে এই পুত্র হবেন মহাবীর। অদিতির যেমন নারায়ণ, তেমনি কুন্তীর এই নন্দন। পরাক্রমে সে হবে কার্ত্তবীর্য্যার্জ্জুন। তিনলোকে বিখ্যাত হবে পুত্রের গুণ। পৃথিবীর লক্ষ্য রাজাকে বাহুবলে জয় করে যুধিষ্ঠিরকে পৃথিবীর রাজারূপে অভিষেক করবে। ভাইদের নিয়ে তিনবার অশ্বমেধ করবে। ভৃগুরামের মত ধনুর্ভেদ শিখবে। দিব্যমন্ত্রে, দিব্যঅস্ত্রে পারদর্শি হবে। পৃথিবীর এমন কিছু নেই যা এই পুত্রের জ্ঞাতব্য নয়। পিতৃলোককে এই পুত্রই উদ্ধার করবে। খান্ডব দহন করে এ বৈশ্বানর অগ্নিকে তুষ্ট করবে। 

যখন আকাশ থেকে এই দৈববাণি হচ্ছে তখন অমর/দেবতা, কিন্নর সবাই এলেন পুত্র দর্শন করতে। ইন্দ্রসহ সকল দেবতারা-চন্দ্র, সূর্য, পবন, শমন, হুতাশন, গন্ধর্ব, কিন্নর, সিদ্ধ ঋষিগণ, যত অপ্সরা, অপ্সর, একাদশ রুদ্র, ঊনপঞ্চাশ পবন, অশ্বিনীকুমারা আর বিশ্বাবসুগণ, যত অমররা এলেন, মহাকলোবর শুরু হল শূণ্যে। দক্ষ, আদি প্রজাপতিরাও এলেন। দেবাঙ্গনারা নৃত্য-গীত করলেন, গন্ধর্বরা গান করলেন, বিদ্যাধরীরা নাচলেন, ঝাঁকে ঝাঁকে পুষ্পবৃষ্টি হল। দেবতারা, ঋষিরা আশির্বাদ করলেন।
 
অর্জুন 

সব দেখে পান্ডু ও কুন্তী আনন্দিত হলেন। সকল দুঃখ তাদের নাশ হল পুত্রের গুণ শুনে। 

অনেকদিন পর একদিন পান্ডু একান্তে কুন্তীকে ধিরে ধিরে বললেন তার পুত্রকামনা এখনও পূর্ণ হয়নি। যদিও কুন্তীকে পুনরায় বলাও অন্যায়। কারণ চতুর্থ পুরুষে নারী হয় স্বৈরিণী এবং পঞ্চম পুরুষ হলে তাকে বারাঙ্গনা বলা চলে। তাই রাজা যদিও কুন্তীকে আর বলতে পারেন না পুত্রের জন্য, তবু তার পুত্র কামনা মনে থেকেই গেল।

Monday, July 29, 2013

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪৬

 

পুত্রোৎপাদনে কুন্তীর প্রতি পান্ডুর অনুমতিঃ 

চিন্তিত পান্ডু কুন্তীকে বলেন দেবতার দ্বারা পুত্র হবে একথা ঋষিরা বলেছেন। মৃগ-ঋষির শাপে আমার আর পুত্র উৎপাদন সম্ভব নয়-এখন কুন্তী চিন্তা করে দেখুন কি উপায় করা যায়। তবেই পিতৃঋণ মুক্ত হওয়া সম্ভব। এছাড়া পূর্বে শাস্ত্রে এমন ঘটনা অনেক আছে। নিজ সন্তান উৎপাদন করলে ভালই, না হলে কোন জন তাতে সাহায্য করতে পারেন। মূল্য দিয়েও পোষ্য পুত্র নেওয়া সম্ভব। আবার পুত্রহীনকে কেউ কন্যা দান করে তার পুত্রের মাধ্যমেও পুত্রবান হওয়া যায়। অথবা স্বামীর আজ্ঞা নিয়ে কেউ নিজের সদৃশ বা উচ্চস্থানে অবস্থিত ব্যক্তির সাহায্যে পুত্রবান হয়। পূর্বে ব্রহ্মার বচনে এমন হয়েছে। সেই মতে রাজা আজ্ঞা করছেন কুন্তী তার বংশের রক্ষা করুন।

কুন্তী একথায় ক্রুদ্ধ হলেন, এমন কুৎসিত বাক্য বলার জন্য ধিক্কার জানালেন। তিনি ধর্মপত্নী, তিনি রাজন ছাড়া আর কাউকে এ নয়নে রাখতে পারেন না। তাছাড়া শ্রেষ্ঠের মাধ্যমে পুত্র উৎপাদন হলেও পৃথিবীতে পান্ডুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ তার কাছে কেউ নেই। 

পূর্বে শোনা গেছে মুনিরা বলেছেন- পৌরব-নন্দন ব্যুষিতাশ্ব নামে এক রাজা ছিলেন। রাজা ধর্মে তৎপর, যজ্ঞ করে দেবতাদের তুষ্ট করলেন। তার দক্ষিণায় মত্ত হল ব্রাহ্মণরা। বাহুবলে রাজা সব কিছু জিতলেন। রাজার পরমা সুন্দরী ভার্য্যা ছিলেন-ভদ্রা। রাজাকে রাণী বহু সেবা করেন সন্তান কামনা করে। কিন্তু কামুক রাজা সঙ্গমে ব্যাধিযুক্ত হন এবং যক্ষারোগে তার মৃত্যু হয়। 

ভদ্রা শোকে মুহ্যমান হন। স্বামী ছাড়া স্ত্রীর প্রাণের কোন মূল্য নেই। ঘর শ্মশান, সকলের গঞ্জনা এবং বিবিধ যন্ত্রণা পেতে হয়। লোকে অনাদর করে। মানুষের মধ্যে স্বামী-সন্তানহীনা নারীকে গনণা করা হয় না- এসব বলতে বলতে ভদ্রা উচ্চস্বরে বিলাপ করতে থাকেন। 

এসময় শব তাকে ডেকে বলেন- ভদ্রা তুমি কেঁদনা। আমার মাধ্যমেই তোমার সন্তান উৎপাদন হবে। শবের বচনে ভদ্রা আস্বস্থ হলেন এবং গৃহে বহু যত্নে শবকে রাখলেন। ঋতুযোগে ভদ্রা শবের সাথে সঙ্গম করলেন। এভাবে তিনি সাতটি সন্তান গর্ভে ধারণ করেন। শব স্বামীর মাধ্যমে ভদ্রা এভাবে সন্তানের জন্ম দেন। মুনিরা যেহেতু বলেছেন, রাজাও সে ভাবেই কুন্তীকে সন্তান দান করবেন –এই কুন্তীর ইচ্ছা। 

পান্ডু বলেন- মানুষের পক্ষে এরূপ অসম্ভব। দৈববলে শব থেকে সন্তানের উদ্ভব- কিন্তু তার এমন শক্তি নেই। 

এবার পান্ডু বলেন- বহু পূর্বে বর্তমান নিয়ম ছিল না। যার যখন যাকে ইচ্ছে তার সাথে মিলিত হতে পারত। ব্রহ্মার নিয়মে স্ত্রীরা ইচ্ছে মত যার কাছে মন চাইত যেতে পারত। কিন্তু নিয়ম করলেন এক ঋষিপুত্র, তার কথা রাজা শোনালেন। 


উদ্দালক নামে এক মহাতপোধন ছিলেন। শ্বেতকেতু নামে তার এক পুত্র ছিল। পিতা ও মাতার সাথে পুত্র খেলছিল। সে সময় এক মুনি সেখানে আসেন। কামাতুর মুনি তার মাকে কামনা করেন। স্বামী পুত্রকে কোলে করে অন্যস্থানে চলে যান। 

বিস্ময়ের সাথে শিশু পিতার মুখপানে চান এবং ক্রুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞাসা করেন এই দুরাচার কে এবং তার জননীকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে। 

শুনে পিতা পুত্রকে শান্ত হতে বলেন। পুরাণে নির্দেশ আছে যার যাকে ইচ্ছে শৃঙ্গারে আমন্ত্রণ করতে পারে-এতে কোন দোষ নেই। 

শুনে পুত্র আরো ক্রুদ্ধ হলেন। এমন কুৎসিত নিয়ম সৃষ্টির জেনে প্রজাপতির উপর কুপিত হলেন। 

তখন তিনি নিয়ম করলেন, পিতাকে বললেন –আজ আমি পরম তপস্বী নিয়ম করছি, নিজ নিজ স্বামী ও স্ত্রী ত্যাগ করে যে জন পর নারী ও পর স্বামীর প্রতি গমন করবে সংসারে সে সকল পাপের পাপী হবে এবং নরক থেকে সে কখনও পার পাবে না। স্ত্রী হয়ে যে স্বামীর বচন না শুনে, স্বামীর বংশ রক্ষা না করে, অবজ্ঞায় স্বামী কার্য্যে অনাদর করে তবে সে নারী চিরকাল নরকে মজবে। 
এইভাবে মুনিপুত্র নিয়ম সৃষ্টি করলেন। ফলে পূর্বের মত পরিবর্তিত হল। 

রাজা আরো পূর্বকথা কুন্তীকে শোনালেন- সূর্যবংশে ছিলেন সৌদাস রাজন। তার মদয়ন্তী নামে রাণী ছিলেন পরমা সুন্দরী। কিন্তু দুজনে সন্তান বিরহে সর্বদা দুখী থাকতেন। রাজা বশিষ্ট মুনির সেবায় রাণীকে নিযুক্ত করেন এবং মুনির ঔরসে তার শ্রেষ্ঠ পুত্র হয়।

রাজা আরো জানালেন তাদের উৎপত্তিও ব্যাসমুনির সাহায্যে, পিতার মৃত্যুর পর হয়েছে। বংশের কারণে এমন পূর্বে অনেকবার হয়েছে। এতে রাণীকে বিস্মিত হতে বারণ করলেন। 

সেই কারণে রাজা আজ রাণীর কাছে প্রার্থণা করছেন তার সন্তান উৎপাদন যেহেতু সম্ভব নয়, কুন্তী আজ নিজেই এর উপায় স্থির করুন। 

রাজার কাতরবাক্য শুনে কুন্তীভোজের কন্যা তার পূর্বকথা পান্ডুকে বললেন। বাল্যকালে তিনি যখন অতিথি সেবায় নিযুক্ত ছিলেন তখন হঠাৎ দুর্বাসা মুনি উপস্থিত হলে তাকে সেবা করে সন্তুষ্ট করেন কুন্তী। তার সেবায় সদয় হয়ে মুনি তাকে এক মন্ত্র দান করেন। এই মন্ত্রবলে তিনি যে দেবতাকে আহ্বান জানাবেন, তিনিই উপস্থিত হবেন এবং যে বর চাইবেন তাই পাবেন। এই আশির্বাদ দিয়ে মুনি দেশান্তরে যান। এখন রাজা আজ্ঞা করলে কুন্তী দেবস্থানে পুত্র কামনা করতে পারেন। রাজাই বলেদিন কোন দেবতাকে তিনি আহ্বান জানাবেন। 

পান্ডু রাজা সব শুনে সুখি হন এবং বলেন আর চিন্তার কোন কারণ নেই। হোম-যজ্ঞ-পূজা করেও যাদের বহু ক্লেশে পাওয়া যায় না, তাদের রাণী এত সহজে পেতে পারেন! রাণীর দেরি করা উচিত নয়। 
দেবতাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ হলেন ধর্ম। সব পাপ মুক্ত হয় তার আশ্রয়ে। সেই ধর্ম দেবতাকেই রাণী আহ্বান জানান -এই তিনি চান। 
ধর্মবন্ত, মহাবলবন্ত ও সর্বগুণাধার পুত্র হবে –এই ভেবে পান্ডু কুন্তীকে নির্দেশ দিলেন নিয়ম মেনে ধর্মকে স্মরণ কর। 
তার ব্যাকুলতা দেখে কুন্তী স্বামীর নির্দেশ পালন করলেন। 
স্বামীকে প্রদক্ষিণ করে নমস্কার করলেন।
.......................................

Wednesday, June 12, 2013

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪৫

মৃগরূপী ঋষিকুমারের প্রতি পান্ডুর শরাঘাত ও শতশৃঙ্গ পর্ব্বতে স্থিতি :


পান্ডু 

পান্ডু বনে দুই ভার্যা ও কিছু অনুচর নিয়ে বাস করছিলেন।
রাজা মৃগ অন্বেষণে পাহাড়, পর্বত, মহাবনে ঘোরেন। তার আগমনবার্তা শুনে সিংহ, বাঘ, হাতি, গন্ডার, ভল্লুক, শূকর-সকল প্রাণী বনান্তরে চলে যায়। এ সময় একদিন পান্ডু দেখলেন অনেক হরিণীর দলের মাঝে একটি হরিণ অবস্থান করছে। 

প্রকৃতপক্ষে কিন্দম নামে এক ঋষিকুমার মৃগের রূপ ধরে মৃগীর সাথে শৃঙ্গার করছিলেন। এদিকে পান্ডু মৃগ দেখে শর নিক্ষেপ করলেন। তীক্ষ্ণ শর ঋষিকে ভেদ করল, তিনি মাটিতে পরে ছট্‌ফট্‌ করতে লাগলেন। 


মৃগরূপী ঋষিকুমারের প্রতি পান্ডুর শরাঘাত
পান্ডুর উদ্দ্যেশ্যে তিনি চিৎকার করে বললেন – ধার্মিক হয়ে রাজা তুমি একি ভুল করলে! পরম শত্রুকেও কেউ হিংসা করে রমণের সময় হত্যা করে না। 
পান্ডু বলেন- মৃগ হত্যা ধর্মে আছে, এটি ক্ষত্রিয়ের আচার।
ঋষিকুমার বলেন – মৃগবধ ধর্মে আছে, কিন্তু রমণের সময় বিরোধ করা মহাপাপ কর্ম। কুরুবংশে জন্মে, রতিরসে জ্ঞাত হয়েও রাজা পাপাচার করলেন। তার পাপে সংসার পাপে মজবে।

ঋষি তখন নিজ পরিচয় দিলেন। ঋষিকুমার তিনি, তপের কারণে সকল ত্যাগ করে বনে বাস করেন। মৃগ রূপ ধরে তিনি যখন স্ত্রী-রমণ করছেন সে সময় রাজা তাকে হত্যা করলেন। যেহেতু ব্রাহ্মণ বলে রাজা তাকে চিনতে পারেন নি, তাই ব্রাহ্মণ হত্যার পাপ তার লাগবে না, মৃগ হত্যার দায়ও তার নেই, কিন্তু মৈথুন সময় জীব হত্যার পাপ তার লাগল। 

তাই ঋষি শাপ দিলেন- তিনি যেমন অশুচি দেহে যমালয় যাচ্ছেন, তেমনি রাজাও মৈথুন-সময় মৃত্যুবরণ করবেন, স্বর্গে যাওয়ার শক্তি তারও থাকবে না। তার বাক্য মিথ্যা হওয়ার নয়- এত বাক্য বলতে বলতে ঋষিকুমার প্রাণ ত্যাগ করলেন।

পান্ডু বিষণ্ণ বদনে শোকে আকুল হলেন। মৃত ঋষিকে প্রদক্ষিণ করলেন এবং ভার্যাদের নিয়ে বন্ধুশোকের মত বিলাপ করলেন।
রাজা নিজের নিন্দা শুরু করলেন। কেন তিনি এত বড় কুলে জন্মালেন, তার পাপে কুল পাপে নিমজ্জিত হল। তার মনে পরল তার পিতাও অনাচার করেছিলেন, কামে মত্ত থাকায় অল্পকালে তার মৃত্যু হয়। তার সন্তান বলে তিনিও দুষ্ট, দুরাচার। ধর্ম ভোলার সাজা হল-মৃগরূপী ঋষি হত্যার পাপে মগ্ন হলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন সংসার-বিষয় ত্যাগ করে তপস্যায় নিজেকে মগ্ন রাখবেন। 

আরো জানালেন তিনি একা পৃথিবী ভ্রমণ করবেন এবং সকল ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। কুন্তী ও মাদ্রীকে হস্তিনানগরে ফিরে যেতে বললেন। সেখানে ভীষ্ম জ্যৈষ্ঠতাত, (কোশল রাজকন্যা)কৈশল্যা জননী অম্বালিকা, সত্যবতী আই, অন্ধ নৃপমনি ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর প্রমূখ সুহৃদরা আছেন।

কিন্তু কুন্তী ও মাদ্রী হস্তিনানগরে ফিরতে রাজি হলেন না। তারা কাঁদতে কাঁদতে করুন বচনে অসম্মতি জানালেন এবং সকল স্বর্ণালঙ্কার ত্যাগ করে পতিকেই অনুসরণ করবেন জানালেন। তারাও প্রতিজ্ঞা করলেন ফলাহার গ্রহণ করবেন, পতির পথানুসারে তপস্যা করবেন এবং ইন্দ্রিয়কে দমন করবেন-ধর্মেও আছে সন্ন্যাসীরা পত্নীদের সঙ্গে বাস করতে পারেন। পান্ডু যদি তাদের ত্যাগ করেন তবে তারা এক্ষুনি রাজার সামনে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করবেন। তাদের ব্যাকুল চিত্তের এই আবেদন শুনে রাজা চিন্তিত হলেন, জানালেন অরণ্যে অশেষ ক্লেশ পেতে হবে, গাছের বাকল বসন হবে, সব আভরণ ত্যাগ করে শিরে জটা ধারণ করতে হবে। লোভ, মোহ, কাম, ক্রোধ, অহঙ্কার ত্যাগ করতে হবে। 

রাজার আজ্ঞা শুনে দুই রাণী সকল নির্দেশ সঙ্গে সঙ্গে পালন করলেন। দেখে পান্ডুর হৃদয় ব্যাকুল হল। তিনি নিজেও সব কিছু ত্যাগ করে দান করে দিলেন। অনুচরেদের হস্তিনানগরে ফিরে যেতে বললেন এবং এখানকার সকল ঘটনা গুরুজনদের জানিয়ে মায়েদের ক্রন্দন প্রবোধতে নির্দেশ দিলেন। অনুচরেরা হাহাকার করতে করতে নগরে ফিরল। শোকে সমগ্র নগর স্তব্ধ হল। ধৃতরাষ্ট্র ভাতৃ-দুঃখে ভূমিতে লুটিয়ে পরলেন।

পান্ডু প্রথমে চৈত্ররথ নামে এক বনে উপস্থিত হন, কিন্তু সেখানে গন্ধর্ব ও অপ্সরারা বিহার করছিলেন। তাই তারা বহু নদ, নদী, দেশ পার হয়ে যান নৈমিষ কাননে। হিমালয় আরোহণ করে তারা তিনজন শ্রী গন্ধমাদন পৌঁছলেন। সেখানে ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবরে পূণ্যস্নান করে শতশৃঙ্গ পর্বতে আরোহণ করলেন। এখানে অনেক ঋষি-তপস্বীরা অবস্থান করতেন, পান্ডু এস্থান দর্শন করে সন্তুষ্ট হলেন এবং সেখানে তপস্যা শুরু করলেন। তিনজন সেখানে ঘোর তপস্যা করলেন। ফলমূল আহার করতেন, ধিরে ধিরে তিনজন অস্থিচর্মসার হলেন। ঋষিরা দেখে অবাক হলেন। তাদের তপ সিদ্ধ হল। সেখান থেকে তারা ঋষিদের প্রণাম করে অতি উচ্চ পর্বতে আরোহণ শুরু করলেন স্বর্গের উদ্দেশ্যে। স্বর্গ-যাত্রাপথে তারা দেবতাদের স্থান দর্শন করলেন। নানা রত্নের বিচিত্র যান দেখলেন। গঙ্গার মাঝে প্রবল তরঙ্গের মধ্যে দেবকন্যাদের ক্রীড়ারঙ্গ করতে দেখলেন। এভাবে নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যখন তারা যাত্রা করছেন তখন কিছু ঋষি তাদের ডাকলেন এবং তারা কারা, কেন, কোথায় যাচ্ছেন প্রশ্ন করলেন। 

পান্ডু তখন নিজ পরিচয় জানালেন। ঋষিরা জানালেন সংসারে মানুষ চার ঋণ নিয়ে অবস্থান করে। সেই চার ঋণ মুক্ত না হলে স্বর্গে যেতে পারে না। যজ্ঞ করলে দেবঋণ মুক্ত হবে, ব্রতাচারে মুনিদের তুষবে। পিতৃঋণ মুক্ত হবে পিতৃপিন্ড দিয়ে। মনুষ্য-ঋণ মুক্ত হবে অতিথি সেবা করে। 

পান্ডু বলেন তিনি তিনস্থানে ঋণমুক্ত, কিন্তু নিজ কুকর্মের জন্য পিতৃ-ঋণ মুক্ত হতে পারলেন না। তাই এ শরীর তিনি ত্যাগ করবেন। 

ঋষিরা বলেন -রাজা পন্ডিত সুজন, ধার্মিক ও সর্বশাস্ত্রে বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান। পুত্রহীন মানুষ কখনও স্বর্গে স্থান পান না। দ্বারপালরা দ্বাররক্ষা করছেন, পুত্রহীন জনকে তারা প্রবেশের অনুমতি দেবেন না। সুতরাং রাজা বৃথাই সেখানে যাচ্ছেন। 
ঋষিবাক্য রাজা অবধান করুন। মর্তে জন্মালে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। মহাপূণ্যের ফলে মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। সেই মানব পৃথিবীতে বহুদান করে, বহু জপ–তপ করে সংসারে অবস্থান করে। তবু সন্তানহীন হলে কেউ স্বর্গে যেতে পারে না-বেদের বিচারে এই নীতি শাস্ত্রে আছে। স্বর্গে যত দেবসিদ্ধ ঋষি আছেন সকলে মর্তে সন্তান জন্মগ্রহণের পরই স্বর্গবাসী হয়েছেন। 

এত শুনে চিন্তিত পান্ডু তাদের পরামর্শ চাইলেন। ঋষিরা রাজাকে সে স্থানে অবস্থান করতে বললেন এবং আরো জানালেন তারা দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন দেবতার বরে পান্ডুর মহা বীর্য্যবন্ত পুত্র হবে।

ঋষির আজ্ঞায় পান্ডু শতশৃঙ্গ পর্বতে সস্ত্রীক বসবাস  করলেন।

 .....................................

Tuesday, April 2, 2013

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪৪

দুর্য্যোধনকে পরিত্যাগ করিতে বিদুরের মন্ত্রণা ও দুঃশলার জন্ম–বিবরণঃ

বিদুর রাজাকে বললেন এই পুত্রের জন্মের সাথে সাথে চারদিকে অমঙ্গল দেখা দিয়েছে। এর প্রায়শ্চিত্ত এই যে পুত্রটিকে পরিত্যাগ করা উচিত। এই পুত্র কুলের কলঙ্ক হবে, একে পালন করলে রাজাকে অশেষ দুঃখ পেতে হবে। নিজের কুলের মঙ্গল যদি রাজা চান তবে এক পুত্র বিনা নিরানব্বই পুত্রেই রাজাকে সন্তুষ্ট হতে হবে। এই কুলাঙ্গার শিশুটি আসলে অধর্মেরই রূপ। কুলের কারণেই রাজার এই একজনকে ত্যাগ করা উচিত। গ্রামের কারণে রাজা কুল ত্যাগ করেন, জনপদের হিতের কারণে রাজা গ্রাম ত্যাগ করেন। এমনকি নিজেকে রাখতে রাজা পৃথিবীকেও ত্যাগ করেন। এরূপ নীতিশাস্ত্রেও পূর্বে অনেকবার হয়েছে। রাজা বংশরক্ষার্থে জ্যৈষ্ঠ পুত্রকে হত্যা করুন।
 

কিন্তু পুত্রস্নেহে অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের কথা অমান্য করলেন। এভাবে রাজার একশত পুত্র ও একটি কন্যা জন্মাল।

এতকথা শুনে জন্মেজয় প্রশ্ন করলেন, ব্যাসের কথানুসারে রাজার শতপুত্র হল, কিন্তু কন্যাটি কি কারণে জন্মাল!

মুনি বলেন শুন কন্যার জন্মের কারণ।

ব্যাসদেব যখন মাংসপিন্ডটি খন্ডন করছিলেন তখন সুবলকন্যা, সতী-পতিব্রতা গান্ধারীর মনে কন্যাপ্রেম জাগ্রত হল। তিনি কায়মনোবাক্যে একটি কন্যা প্রার্থনা করলেন।
 
পতিব্রতা, দানশীলা, পবিত্র স্ত্রীর কামনার জোড়ে মাংসপিন্ডটি একশত এক খন্ডে খন্ডিত হল। 

দেখে ব্যাসদেব গান্ধারীকে বললেন-মুনির বচন কখনও মিথ্যা হয় না। তার বচনে রাণী শতপুত্রের জননী হলেন। কিন্তু পবিত্র রাণীর মনের জোড়ে একটি কন্যার জন্ম দিলেন। 

 

সব শুনে রাণীও হরষিত হলেন। এভাবে রাণী শতপুত্র ও একটি কন্যার জননী হলেন। কন্যার নাম রাখা হল দুঃশলা।

ধৃতরাষ্ট্রের অন্যা নামে আরেক স্ত্রী ছিলেন। তিনি বৈশ্যের কন্যা। অন্যা ধৃতরাষ্ট্রের অনেক সেবা করেন। তারও একটি পুত্র জন্মায়। তার নাম যুযুৎসু। 

 
যুযুৎসু

ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা একত্রে বড় হতে থাকেন। যৌবনপ্রাপ্ত হলে সকল কুমার রাজার কন্যাদের বিবাহ করেন। রাজা দুঃশলাকে জয়দ্রথের সাথে বিবাহ দেন। 

এভাবে বৈশম্পায়ন কৌরবদের জন্মকথা রাজা জন্মেজয়কে শোনান।
.....................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers