Blog Archive

Saturday, June 14, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৫৮

দ্রোণাচার্য্যের দক্ষিণা প্রার্থনাঃ 


কিছুদিন পর দ্রোণাচার্য শিষ্যদের কাছে তার গুরুদক্ষিণা প্রার্থনা করলেন।

দ্রোণ বললেন- হে, অর্জুন! দুর্যোধন! ধনরত্নের আমার কোন প্রয়োজন নেই। বিখ্যাত পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে যুদ্ধে হারিয়ে আমার সামনে বেঁধে আন – এই হবে আমার দক্ষিণা।

শিক্ষাগ্রহণের পূর্বে কুন্তীর পুত্ররা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন গুরু যা চাইবেন তাই দেবেন। তারা পূর্ব সত্য পালনে ব্রতী হলেন। 
গুরুর এই বাক্যে যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধনও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। সৈন্যদের প্রস্তুত হতে আদেশ দিলেন। রথ, হাতি, ঘোড়া, পদাতিক সকলের মধ্যে সাজসাজ রব উঠল। রাজকুমাররা দ্রোণকে সঙ্গে নিয়ে সসৈন্য পাঞ্চাল রাজ্য আক্রমণ করলেন। 
পাঞ্চাল রাজ দ্রূপদও তাঁর ভাইদের সাথে কৌরবদের প্রতি আক্রমণ করলেন। 

দুর্যোধনদের দর্প দেখে অর্জুন গুরুকে বলেন- এরা দ্রুপদকে বন্দী করতে পারবে না। ওরা আগে নিজেদের বিক্রম দেখাক তারপরে আমি যুদ্ধে নামব। এই বলে তিনি নগর থেকে অর্ধ ক্রোশ দূরে ভাইদের সাথে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

দ্রুপদের বাণবর্ষণে দুর্যোধনরা ব্যতিব্যস্ত হলেন। তাদের সৈন্যদের উপর নগরবাসী বালক বৃদ্ধ সকলে মুষল (মুগুর/গদা) ও যষ্টি(লাঠি) বর্ষণ করতে লাগল। কৌরবদের আর্তরব শুনে যুধিষ্ঠির যুদ্ধে যাওয়া উচিত মনে করলেন। সৈন্যদের প্রস্তুত হতে দেখে অর্জুন এক রথে চরে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। 
তিনি দু’হাত জোড় করে যুধিষ্ঠিরকে বলেন – আমি থাকতে আপনি যুদ্ধে যাবেন কেন, প্রভু! আমার দ্বারা যদি কর্ম সাধন সম্ভব না হয় তবে অন্য কাউকে এ দায়িত্ব দেবেন। 
এত বলেই অর্জুন দ্রুত পাঞ্চাল নগরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ভীমও তাঁকে অনুসরণ করলেন। 

দ্রুপদরাজ অর্জুনের আগমনের কারণ জানতে পারলেন এবং সৈন্যদের আবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে আজ্ঞা দিলেন। তিনি চিন্তিতও হলেন কেন অর্জুন হঠাৎ এভাবে এলেন এই ভেবে। রাজা তার মন্ত্রীকে অর্জুনের কাছে পাঠালেন। মন্ত্রী অর্জুনের কাছে করযোড়ে উপস্থিত হলেন এবং তিনি কি কারণে আগমন করেছেন জানতে চাইলেন। দ্রুপদরাজের প্রতিনিধি হয়ে তিনি অর্জুনের জন্য কি কাজ করতে পারেন জানতে চাইলেন এবং বিশেষ রূপে দ্রুপদ রাজার আশ্রয়ে অতিথি হতে আমন্ত্রণ জানালেন। 
অর্জুন বললেন তিনি সকল অতিথির পূজাই নেবেন যদি রাজা এসে তার সাথে যুদ্ধ করেন। তিনি সসৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে এসে যদি অর্জুনের সাথে যুদ্ধ না করেন তবে পাঞ্চালের ক্ষতি হবে এও জানালেন।
মন্ত্রী রাজার কাছে অর্জুনের সকল কথা জানালে দ্রুপদরাজ ক্রোধে কাঁপতে লাগলেন। ক্ষত্রিয় হয়ে এ বাক্য শুনে কেউই স্থির থাকতে পারে না। তিনি চতুরঙ্গে সেজে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। এত অশ্ব, গজ ও রথ এল যে তা গণনা করা গেল না। তিনি সসৈন্য গিয়ে পান্ডুপুত্র অর্জুনকে ঘিরে ফেললেন। সে সময় অর্জুন বিষণ্ণ মনে একা বসেছিলেন। চারদিক থেকে সৈন্যরা অস্ত্র বর্ষণ শুরু করলে তার চেতনা হল। তিনি আকর্ণ টেনে ধনুর্গুণে টঙ্কার ধ্বনি দিলেন। গুরু দ্রোণের চরণ স্মরণ করে যে শর নিক্ষেপ করলেন তাতে মুহুর্তে সূর্যের মুখ ঢেকে গেল। চারদিকে নতুন আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষণ শুরু হল। প্রবল বেগে সৈন্যদের উপর পরতে লাগল। ভীমও যমের মত গদা হাতে ধাবিত হলেন পাঞ্চালরাজের সৈন্যদের দিকে এবং অশ্ব, রথ সব ধ্বংস করতে লাগলেন। সারথিরা পালাল, রথী বা যোদ্ধারা কাটা পড়ল। হাতির দাঁত ভাঙ্গল-তাতে সে পালাল। ঘোড়ায় চড়ে যে বীর এলেন সে কাটা পড়লে অশ্বও পালাল। হাত কাটা গেলে পদাতিকরাও পালাল। যারা পালাল তারাই প্রাণে বাঁচল। বাকি সৈন্য যুদ্ধে প্রাণ দিল। অর্জুনের সাথে দ্রুপদ ও তার ভাই সত্যজিতের ভীষণ যুদ্ধ হল। অর্জুনের শরাঘাতে সত্যজিতের অশ্ব ও সারথি বিনষ্ট হলে সত্যজিত পালালেন। তখন অর্জুন দ্রুপদের ধনু ও রথধ্বজ ছিন্ন এবং অশ্ব ও সারথিকে শরবিদ্ধ করে খড়্গ হাতে লাফ দিয়ে তার রথে উঠলেন। সৈন্যদের দুর্দশা দেখে দ্রুপদও ভয়ে পলায়ন করতে লাগলেন। পিছন থেকে অর্জুন তাকে অভয় দিলেন। অর্জুন কথা দিলেন রাজা তার সাথে যুদ্ধ করলে তার প্রাণ অর্জুন নেবেন না। কিন্তু প্রাণ ভয়ে যদি তিনি পালাতে চান তা হলে অর্জুনের হাত থেকে তার আজ আর মুক্তি নেই। অর্জুনের কথায় রাজা সম্মত হলেন। তিনি অর্জুনের সাথে দারুন যুদ্ধ শুরু করলেন। মন্ত্র পরে অর্জুন যে দিব্য অস্ত্র ছাড়লেন তাতে রাজার ধনুক কাটা গেল। রাজা চিন্তিতত হলেন। অর্জুন রাজাকে দুহাতে ধরে নিজের রথে উঠিয়ে নিজ রাজ্যের উদ্দেশ্যে গমন করলেন এবং ভীমকে বললেন দ্রুপদরাজা কুরুবীরদের আত্মীয়, আর তার সৈন্য বধ করবেন না, আসুন আমরা গুরুদক্ষিণা দেব।

সে সময় পথে দুর্যোধনের সাথে দেখা হল। চতুরঙ্গে(হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতি) দল বেঁধে দুর্যোধন আসছিলেন। দুর্যোধন দ্রুপদকে অর্জুনের রথে দেখে বিরক্ত হলেন এবং এটা ঠিক হয়নি জানালেন। কারণ দ্রোণ দ্রুপদকে বেঁধে তার সামনে আনতে বলেছিলেন। এত বলে দুর্যোধন নিজেই রথে উঠে দ্রুপদের হাত-পা বাঁধলেন। রাজার চুল ধরে পথে হাঁটিয়ে তাকে দ্রোণের সম্মুখে এনে ফেললেন। দ্রোণের চরণে গিয়ে দ্রূপদ পতিত হলেন। 


দ্রুপদ

দ্রুপদকে দেখে দ্রোণ বললেন – হে রাজা তোমার সৈন্য, প্রজা, দন্ড, ছাতা সব কোথায় গেল! 
তিনি উপহাস্য করে দ্রুপদকে অভয় দান করলেন। বললেন –আমি জাতে ব্রাহ্মণ, আমার ক্রোধ ক্ষনিকের। বিশেষ করে বাল্যের বন্ধুর প্রতি। হে বন্ধু, পূর্বের কথা তোমার স্মরণ হয়! সেবককে আজ্ঞা দিয়েছিলে একটি ভোজনের। আজ আমরা সমান হলাম। এবার তুমিও আমায় রাজা বলতে পার। বাল্যকালে তুমি যে অঙ্গীকার করেছিলে রাজা হলে আমায় অর্ধেক রাজ্য দেবে – সে বচন তুমি পালন করনি। কিন্তু আজ তোমার সেই রাজ্য সম্পূর্ণরূপে আমার শাসনে। তুমি তোমার সত্য পালন করনি, কিন্তু আমি পালন করব। তুমি বাল্যকালে আমার সঙ্গে খেলেছিলে, সেজন্য তোমার প্রতি আমার এখনও স্নেহ আছে। অরাজা রাজার সখা হতে পারেনা। তাই তোমাকে আমি আমার অর্ধেক রাজ্য দিলাম, গঙ্গার দক্ষিণে চরমন্বতী নদী পর্যন্ত তুমি রাজত্ব কর। গঙ্গার উত্তরতটের রাজ্য পুরটাই আমার হল। অর্ধেক অর্ধেক রাজ্য দুজনেরই সমান হল। যদি ইচ্ছে কর তবে আমাকে সখা মনে করতে পার।
দ্রোণ দ্রুপদকে মুক্ত করে দিলেন এবং সখারূপে আহ্বান জানালেন।
দ্রুপদ বলেন, শক্তিমান মহাত্মার পক্ষে এমন আচরণ আশ্চর্য নয়, আমি প্রীত হয়েছি, আপনার চিরস্থায়ী প্রণয় কামনা করি। 

মুক্ত হয়ে দ্রুপদ নিজ রাজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন কিন্তু ক্ষত্রিয়েরা সহজে ক্ষমা করে না। শেষ পর্যন্ত তিনি অভিমানে রাজ্যে গেলেন না। ভাগীরথী নদী তীরে মাকন্দীনগরে থেকে গেলেন। সেখানে থেকে তিনি দুঃখের সাথে চিন্তা করতে লাগলেন কি ভাবে দ্রোণকে পরাজিত করবেন। কুরুকুলের বীররা যার শিষ্য তাকে সহজে পরাজিত করা যাবে না। শক্তিতে যে তিনি দ্রোণের সমান নন একথা সব সময় তার মাথায় ঘুরতে লাগলো। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের দুষ্টমতি পুত্র দুর্যোধন তাকে সভার মাঝে বেঁধে নিয়ে গেল-একথাও তিনি ভুলতে পারলেন না। ব্রাহ্মণের মন্ত্র ছাড়া যজ্ঞ সম্ভব নয় একথা তিনি জানেন। ব্রাহ্মণ দ্রোণকে ও দুর্যোধনকে বধ করার উদ্দেশ্যে তিনি ব্রাহ্মণদের নিয়ে যজ্ঞ শুরু করলেন। 
এভাবে ভাগীরথীর দক্ষিণদিকের রাজা হলেন দ্রুপদ ও অহিচ্ছত্রা নামে গঙ্গার উত্তরের রাজ্যের ঈশ্বর হলেন দ্রোণাচার্য। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, এক মনে শুনলে বাড়ে দিব্য জ্ঞান।
....................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers