Blog Archive

Monday, June 29, 2009

ছোট্ট একটি ঘাস ফুলের কথা

আমি একটা ছোট্ট ঘাস ফুল। আমায় দেখতে কেমন? তা আমি কি ভাবে বলি! তবে আমি ছোট্ট-এই ট্টুকুনি। আমার বন্ধুরা – তোমরা চেননা তাদের! তারা হল – সূর্যশিশির, দুর্ব্বা, শেয়ালকাঁটা- এরা বলে, আমায় দেখতে খুব মিষ্টি। হবেও বা! আমি কি জানি! আমার মা আমায় খুব ভালবাসে। সব সময় আগলে রাখে ঐ দুষ্টু মানুষের ছেলে, গরু, ছাগলের হাত থেকে। ওদের দেখলে আমার ভীষণ ভয় করে। এই বুঝি মারিয়ে দেয় বা চিবিয়ে খায়। তবে আমি খুব সুখী। এই বসন্তে আমার জন্ম। প্রথমেতো ক’দিন কুড়ি ছিলাম, সে সময় কি উত্তেজনা! পৃথিবীটা কেমন? ঘাস কি? মানুষ, গরু, ছাগল-এরা কারা? কত মনে প্রশ্ন! হাওয়া জিনিষটাই বা কেমন? কি সুন্দর বাতাস গায়ে লাগে, তাই কি হাওয়া! তাকে দেখতে কেমন? মনে তখন কত প্রশ্ন সব সময় জাগছে! এখন আমি অ-নে-ক জানি। জানি যে হাওয়াই আমাদের বন্ধু। মাটির তলায় জল থাকে। শিকড় দিয়ে মা তা টেনে আনে পাতায়, তারপর সেখানে হাওয়া থেকে প্রাণ বায়ু নিয়ে রান্না হয়। সেই খাওয়ার খেয়ে আমরা সকলে বাচিঁ। সূর্য আমাদের দেবতা। তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাকান যায় না। তিনি যতক্ষণ থাকেন, ততক্ষণ শান্তি ও স্বস্তি। তখন আমরা সব বন্ধুরা গল্প করতে২, হাসতে২, একে অপরের গায়ে ঢলে ঢলে পরি। কত যে আমাদের কথা থাকে, সে তোমাদের বলে শেষ করতে পারব না। ওই দেখনা একটা মানুষের ছানা কেমন হাত-পা ছুড়ে কাঁদছে -দেখে তো আমাদের পেটে খিল ধরে যাবার জোগার! ওরা না ভারি দুষ্টু! শুধু২ আমাদের নখ দিয়ে ছেড়ে। আমি তো তখন খুব ভয়ে থাকি। সেদিন তো একজন কলমিকে টেনে ছিড়ল! কলমি কত কাঁদল, ওর মার কি চিৎকার! আমাদের মারাও কাঁদল। আমি, সূর্যশিশির তো ভয়ে নীল হয়ে গেছি। উফঃ কি কষ্ট করেই না কলমিকে ওরা মারল! মানুষ এমনিই নিষ্ঠুর। তবে আমাদের মধ্যে শিয়ালকাঁটা খুব ওস্তাদ। ওকে সবাই সমঝে চলে। সকলে বলতে আবার তোমরা আমাকে বুঝ না! এই যে শিয়ালকাঁটাটিকে দেখছ! ওতো আমায় খুব তোয়াজ করে। কত মিষ্টি২ কথা বলে! আমায় একটুও বকে না। যদিও আমি ওর থেকে একটু দূরে দুরেই থাকি। মা বলেছে তো, তাই। ওর গায়ে যে বড়২ কাঁটা! এমনিতে ও খুব ভাল। কিন্তু কি করি? ওর কাঁটা যে সাংঘাতিক, ছুলেই এক্কেবারে অক্কা! যান তো, এজন্য ওর মনে খুব দুঃখ। আমরা বন্ধুরা যখন হাসাহাসি করি, তখন ও-ও আমাদের সঙ্গে থাকে, কিন্তু ও নিজেই একটু দূরে২ থাকে। ও জানে ওর সংস্পর্ষে আমাদের আঘাত লাগবে। আমি তো ওকে বোঝাই! এর জন্য দুঃখ কর কেন? এটা তো তোমার আত্মরক্ষার উপায়! আমাদের দেখ সকলে দুঃখ দেয়, তবু তুমি আমাদের সর্দার। তোমাকে দুষ্টুরা ভয় পায়।
সূর্যশিশির আছে না! ওর সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব। কিন্তু কি হয়! ও বড় নোংরা। কি করে যান! লুকিয়ে২ মাংস খায়। আমি যদিও ঠিক জানিনা কি ভাবে তা ও জোগার করে। তবে একদিন দেখি কি, ভোরের দিকে খুব মুখ নারছে। ওই মানুষদের পান চেবানোর মত। আমি জিজ্ঞেস করি-‘কি খাস, ভাই!’ ওতো প্রথমে খুব হকচকিয়ে গেছে। কিছুতেই বলে না! খালি কথা ঘোরায়! খুব ঢঙি কিনা! ঢঙ খুব জানে! সে যাক্‌ গে, তারপর কি হল শোন। মাকে গিয়েতো কথাটা বললাম। মা বললে –‘চুপ চুপ, ও সব ঘেন্নার কথা বলিস নে, আমরা উদ্ভিদ জাত! আমাদের কি মাংস সরাসরি খেতে আছে! কিন্তু পাশে দেখ, সূর্যশিশিরদের! কেমন মশা, মাছি গপ্‌ গপ্‌ করে ধরে আর গেলে! মাগো ঘেন্নায় মরে যাই! দিলিতো মেজাজটা সকালেই খারাপ করে!’ আমি তো মার রাগ দেখে দূরে সরে আসি। সে দিন তো আমি সূর্যশিশিরের সাথে কথাই বলিনি! শেষে বিকেলে শিশিরের সে কি কান্না! তখন কি আর ভাব না করে পারি! আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
ওদিকে দেখনা, দুব্বাদের অবস্থা। ওনা খুব নিরিহ। সব সময় ভয়ে২ থাকে। যা আমরা বলি তাই শোনে। আমাদের মধ্যে ওদের দুঃখ-কষ্টই সবচেয়ে বেশি। ওই বড়২ গরু-ছাগলরা নাকি দুব্বা খেতে খুব ভালবাসে। দুব্বাদের নাকি ওরা আচারের মত খায়। ভেবে দেখ, কি রুচি! মানুষরাও কম নাকি! ওরা হচ্ছে সবচেয়ে পাজি। ঘ্যাঁচ২ করে দুব্বাদের ছিঁড়বে আর ডলে২ কাটা-ছেড়ায় লাগাবে, এতে নাকি ওদের রোগ সারবে।
আমার আরেক নতুন বন্ধু হয়েছে। নাম শুনবে? খুব মজার নাম –পাথরকুঁচি। হিঃ হিঃ, ভাবছ পাথর কুঁচো২ হয়ে আমাদের সঙ্গে ভাব করছে! তা নয়, তা নয়। পাথরকুঁচি এক রকম মাথা-মোটা গাছ। মানে, মাথা-মোটা তোমাদের লুকিয়ে২ বললাম। আসলে ওদের পাতাগুলো ভিষণ মোটা২। ঐ হেংলু গরুগুলোও খাবে না। তবে ছাগলদের কথা বলা যায় না। ওরা কেমন যেন! পেট মোটা, কালো২, আবার সব কেমন চ্যাটাস্‌-চ্যাটাস্‌ করে খায়। তা, পাথরকুঁচিদের কথা বলছিলাম। মা বলে অনেক দিন আগে একটা লোক নাকি এখানে ওদের ফেলে যায়। সে ছিল আজকের পাথরকুঁচির বাবার বাবা। সে তখন খুব অসুস্থ। মায়েরা সব আত্মীয়েরা মিলে তাকে বাঁচায়। তা, পাথরকুঁচিরা খুব কৃতজ্ঞ। ওরা সব সময় সে দিনের কথা স্মরণ করে। ওরা আগে নিজেদের একা, বিদেশি মনে করত। এখনতো আমি পাথরকুঁচি ফুলদের খুব ভালবাসি। ওরানা, একটা ডালে অনেকে এক সাথে ফোটে। ঐ লম্বা-সরু একটা ডাল, তাতে কত ফুল! একটা, দুটো, তিনটে......কুড়িটা পর্যন্ত ফোটে! কি সুন্দর ঘন্টার মত দেখতে! রঙটাও খুব সুন্দর। কেমন কমলা-লাল। সূর্য ডুব্বার সময় আকাশের রঙ যেমন হয়।
দেখ! একজনের কথা বলতে তো ভুলেই যাচ্ছি -লজ্জাবতী- চেহারাটা ভারী মিষ্টি! আমার সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। ও কিন্তু ভীষণ লজ্জা পায়! একেবারে কনে বৌ-এর মত। একটু ছুঁলেই লজ্জা-সরমে ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। আবার দেখ কান্ড, তার কাছে সহজে কাউকে ঘেঁসতেও দেয় না। শরীরে ইয়া বড়২ কাঁটা লাগিয়ে রাখে।
এরা ছাড়াও এই বসন্তে আমার অনেক বড়২ ফুলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। দোপাটি, বেলি, নয়নতারা-আরো কত! বেলির গায়ে কি সুন্দর গন্ধ! আমি আরো অনেক-কে চিনি। গোলাপ, পদ্ম, চন্দ্রমল্লিকা, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, গ্যাদা- আরো অনেক। এরা যদিও আমার চেয়ে অনেক বড়, অনেক সুন্দরী। গোলাপের নাকি খুব অহংকার! সুন্দরী বলে, তার গায়েও নাকি আত্মরক্ষার জন্য অনেক কাঁটা আছে। তবে যাই বল, মার মুখে শুনেছি, পদ্ম হল ফুলের রাণী! যেমন রূপ, তেমনি মিষ্টি গুণ! খুব খারাপ পরিবেশে, প্রচন্ড কষ্টে সে বড় হয়েছে। তার ব্যবহারও নাকি খুব মোলায়েম। স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী তার উপর অধিষ্ঠান করেন। পদ্মের কি সৌভাগ্য! গন্ধরাজ তার গন্ধের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু দেখতে নাকি তেমন কিছু নয়! আমি রজনীগন্ধাকে দেখেছি। কেমন সুন্দর ছিম্‌ছাম চেহারা। গন্ধটাও বেশ হালকা আর স্নিগ্ধ। চন্দ্রমল্লিকারো নাকি ভারি বাহার। এরা ছাড়াও কত সুন্দর২ ফুল আছে এই পৃথিবীতে। এত ফুল একসঙ্গে, এক জায়গায়, সবাই মিলে যদি ফুটি-কি ভালই না লাগবে! তাই না? আমার তেমনি খুব ইচ্ছে হয়।
আমি মার কাছে আরো শুনেছি, অন্য অনেক জায়গায় নাকি কাঁটা গাছেও সুন্দর২ ফুল ফোটে। তাদের ভারি কষ্ট। সেখানে নাকি জলের ভারি অভাব। চারদিকে খালি বালি আর বালি। বালি কি তা’তাড়ি গরম হয়! আহাঃ ওদের না জানি কত কষ্ট করতে হয়! বালি যদিও রাতে আবার ঠান্ডা হয়ে যায়। তবু মাটি সব চেয়ে সুখের। মাটিতে আমার মত ফুল ছাড়াও আরো অনেকে থাকে। আমি দেখি লম্বা২ সব প্রাণী কি সুন্দর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যায়। ওদের নাকি কেঁচো বলে। ইস্‌, আমিও যদি ওদের মত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে পারতাম, তবে কি মজাই না হত! প্রথমেই যেতাম ঐ দুরের দীঘিটায়। সেখানে নাকি জলটা টল্‌টল্‌ করে। ঐ ভোরে আমার গায়ে যেমন হিমের ফোঁটাটা হিরের মত জ্বল-জ্বল করে, তেমনি। ভাবা যায়! সেখানে নাকি এ রকম লক্ষ২, কোটি২ হিমের ফোঁটারা থাকে। হিমের ফোঁটা এত ঠান্ডা! ভোরে ওর স্পর্ষে আমার মন এত পবিত্র, এত কোমল হয়ে যায়, কি বলব! ওই দিঘীতে তেমন হিমের ফোঁটারা বাস করে!
দিঘী দেখে তারপর যেতাম বনে। সেখানে অনেক উঁচু২ গাছ আছে। উঁচু গাছ বলতে এখানে ঐ আম গাছটাই আছে। ও কেমন যেন, দাদু-দাদু, খুব গম্ভীর! বনের গাছ নাকি ওর চেয়েও উঁচু! শুনেছি তারা এ-ত-ও বড় যে আকাশকেই ঢেকে দেয়! ব্যাপারটা তোমরা ভাব! এই সুন্দর নীল আকাশ! তাকে নাকি মাথা তুলে দেখাই যাবে না! আহাঃ তারা বোধ হয় আকাশকেও ছুঁতে পারে। তার সাথে কি কথাও বলে? আমিও বলি, তবে মনে মনে। আকাশ কত উঁচুতে, সে কি আমার কথা কিছু শোনে, বোঝে! তবে আমার একজন বন্ধু হয়েছে। সে ঐ উঁচু আকাশে উড়ে যায়। দেখতে আমার ভীষণ ভাললাগে। কে বলতো? তার নাম –প্রজাপতি। আমি ওর মাধ্যমে কত খবর আকাশের কাছে পাঠাই! ঐ হাল্‌কা মেঘগূলোও নাকি প্রজাপতিকে ছুঁয়ে যায়। ভাব একবার! যদিও এজন্য ওকে অনেক উঁচুতে উঠতে হয়। একবার আমার অনুরোধে ও ঐ উপরে উঠে গেল। শেষ পর্যন্ত তো আমি দেখতেই পেলাম না! ছোট হতে২ একদম হাপিস্‌! তারপর? তারপর কি হল – সে কি দেখি! প্রজাপতি ডিগবাজি খেতে২ নিচে নামছে। নেমেই মার পায়ের কাছে থুপ্‌ করে পড়ল। কি হাপাচ্ছে! দেখে তো আমি ভয়ই পেয়ে গেছিলাম! সব শুনে মা আমাকে কি বক্‌লে! তারপর পাতা থেকে টুপ্‌ করে একফোঁটা জল প্রজাপতির মুখে দিল। তখন সে শান্ত হল। আমার জন্য দেখত কি কষ্টটাই না তাকে পেতে হল! আমার খুব লজ্জাও হচ্ছিল, দুঃখও হচ্ছিল। তারপর শোন না, সুস্থ হয়ে প্রজাপতি কি বলল! বলল যে আকাশ মেঘকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছে সে আমায় ভালবাসে, আমাদের সকলকে সে ভালবাসে। তাই না তার বুকে সূর্য ওঠে! মেঘ ভাসে! বৃষ্টি হয়! ঐ বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে দিয়েই আমরা আকাশের ভালবাসা উপলব্ধি করি। আমাকে মা, আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি, প্রজাপতি, শিয়ালকাঁটা, সব ফুলেরা – সকলে খুব ভালবাসে। আমিও সক্কলকে খুব ভালবাসি। ভিষণ ভালবাসি এই পৃথিবীকে। এখান থেকে যেতে চাই না। তবু যানি একদিন চলে যাব। সকলে এরা কাঁদবে। মা কাঁদবে। কিন্তু এও জানি আবার আমি ফিরে আসব। এই মায়ের কোলে, এই ভাবেই। আবার তোমাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হবে। তখন হয়তো ঐ গরু, ছাগলছানা- সকলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হবে। তারাও আমায় ভালবাসবে! মানুষের সাথেও ভাব হবে। তারাও আমায় আদর করবে! তাই না! তোমরা কি বল!

Saturday, June 27, 2009

জন্মদিনে চিড়িয়াখানায়

মনু আজ চিড়িয়াখানায় যাবে। তাই খুব ব্যস্ত। মা কেবল বলছে চারটি বাজতে এখন ঢের দেরি। কিন্তু মনু কি তা শোনে! সে এখনি জামা-কাপড় পরে তৈরী। কিন্তু বাবাটা যে কি! এখনি দু’টো বেজে গেল, কখন যে আসবে তার ঠিক নেই! মনু বার২ করে বলে দিয়েছে দু’টোর মধ্যে দোকান বন্ধ করে চলে আসতে, তাও আসে না! বাবা আসবে, খাবে, তৈরী হবে...তারপর না যাওয়া! উফ্‌, মনু যে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। টিম্পিকেও তৈরী থাকতে বলেছে। টিম্পি, মনু, রুমা আর তপু বাবার সাথে চিড়িয়াখানায় যাবে। আজ মনুর জন্মদিন। চিড়িয়াখানা থেকে ঘুরে এসে সন্ধেবেলা সে কেক কাটবে। আজ সকাল থেকে মনু পড়তেই বসেনি, তার জন্য কেউ বকেও নি। ঘুম থেকে উঠেই আজ সে দাদু, দিদা, বাবা, মাকে প্রণাম করেছে। দিদু সকালেই একটা সুন্দর পেন তাকে দিয়েছে। মনু এখনও পেনসিলেই লেখে, তবে আজ পেনে লিখে দেখবে। কিন্তু এখনও বাবা আসেনা কেন? যাবে নাকি একবার তপুর বাড়ি! মা কি ছাড়বে? আজ মা একটুও বকেনি তাকে। ঐ সাইকেলে আওয়াজ হল, বাবা এলো। আঃ কি মজা! মনু দৌড়ে গেল বাবার কাছে। বাবা কি যেন একটা মাকে দিয়ে দিল। মনু ঠিক দেখে নিয়েছে। নিশ্চয়ই এটা তার! খুব ইচ্ছে করছে বাবা কি এনেছে দেখতে। কিন্তু নাঃ, সন্ধেবেলা যখন পাবে তখনই দেখবে মনু। ‘ও বাবা, তাড়াতাড়ি তৈরী হও! দেখ তিনটে বাজে। কখন বেরবে?’ বাবা হেসে খেতে বসলেন। মনুকেও কাছে টেনে নিলেন।
এখন ঠিক চারটে বাজে। মনু, টিম্পি, তপু আর রুমা বাবার সাথে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। আজ ট্যাক্সি করে সবাই চিড়িয়াখানা যাবে। মনু আর ওর বন্ধুদের খুব মজা। বাবা ঐ ট্যাক্সি ডাকছে। সকলে ট্যাক্সিতে উঠল। বাবা সামনে। পিছনে বন্ধুদের সাথে মনু। একটা জানলার দিকে মনু, আজ তার জন্মদিন। আর একটাতে টিম্পি, কারণ সে সব চেয়ে বড় কিনা! তাই এ ব্যবস্থা। ট্যাক্সিকাকু দরজা দুটো লক্‌ করে দিল। এবার তারা সোজা চিড়িয়াখানায়! ‘ট্যাক্সিকাকু, খুব জোড়ে ট্যাক্সি চালাবে কিন্তু!’ রুমা বলে উঠল। তপুরাও হ্যাঁ২ করে উঠল। রাস্তার গাড়িগুলো পাশ দিয়ে সাঁ-সাঁ করে সরে যাচ্ছে।
এখন মনুরা চিড়িয়াখানায়। ওরা বাঘের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে। উঃ, কি গন্ধরে বাবা, টেঁকাই দায়!-ভাবল মনু। বাঘটার দিকে তাকিয়ে মনুর খুব কষ্ট হল। আহা, আজ মনুর জন্মদিন, আজ তো সকলের খুশি থাকা উচিত। অথচ দেখ বাঘটার কি কষ্ট! একটা খাঁচায় ওকে পুরে সবাই মজা দেখছে। চোখ দু’টো ওর কি করুন! মনু ভাবছে-‘আমি যদি এরকম একটা ছোট্ট খাঁচায় বন্ধ থাকতাম দিন-রাত! তপু, রুমাদের সাথে খেলতে পারতাম না, কোথাও যেতে পারতাম না, গল্পের বই পড়তে পেতাম না-উঃ, কি কষ্টটাই না হত! আহা, না জানি বাঘটারও কত কষ্ট! দুঃখে ও কেমন করে হাই তুলছে দেখ! ওর তো কিছুই করার নেই। তাই অমন দুঃখ দুঃখ মুখ করে আমায় দেখছে। ওর বোধ হয় ওর মা-বাবা-দিদা-দাদু-বন্ধুদের কথা মনে পরছে।’ রুমা বলল-‘এই মনু কি এত দেখছিস? অত কাছে যাস না, বাঘদাদা খেয়ে ফেলবে যে! আয় ও দিকে যাই বাঁদর দেখব।’ ওরা সবাই বাঁদরের খাঁচার দিকে চলল। বাবা সবার হাতে পপ্‌কনের প্যাকেট দিয়েছে। ওই তো বাঁদরের খাঁচা। আরেঃ, এখানে অনেক বাঁদর এক সাথে থাকে। এমা, একটা আবার কট্‌টুকুনি! মার কোলে বসে আছে। ওর নাম কি? এরা তো দেখে মনে হচ্ছে বেশ সুখি। আহা, বাড়ির সকলে এক সাথে আচ্ছে কিনা! তাই দুঃখটাও একটু কম। ঐ দেখ একটা বাঁদর কি সুন্দর কলা খাচ্ছে। ইসঃ, এটা আবার দাঁত খেঁচায়! এ নিশ্চয়ই ভিষণ দুষ্টু। টিম্পি পাখি দেখবে বলে বায়না ধরল। একটু দূরে ময়ূরের খাঁচা। বাবার পাশে একজন কি সুন্দর ময়ূরকে খাওয়াচ্ছে! মনুরও ইচ্ছে হল ময়ূরকে খাওয়াবে। সে ময়ূরকে নিজের পপকন থেকে একটা২ করে খাঁচার জালে ধরছে আর ময়ূরটা কি সুন্দর টেনে নিচ্ছে। তপু নিজেরটা সব খেয়ে নিয়ে এখন হা করে দেখছে। পাশেই রাজহাঁসের খাঁচা। প্যাঁক২ করে ডাকছে। ‘কি বিচ্ছিরি ডাকেরে বাবা!’- রুমা বলল। টিম্পি অমনি বলে উঠল-‘কোথায় বিচ্ছিরি!’ মনু ওদের ও খাওয়াতে গেল। বাবা বলল-‘ওরা কিন্তু কামড়ে দেয়’। কিন্তু আজতো মনুর জন্মদিন আজ কি কখন কেউ মনুকে কামড়ায়! আহা, ওদের কি খিদেই না পেয়েছে! তপু হঠাৎ বলে উঠল ও খরগোস দেখবে। বাবা আবার একজনকে জিজ্ঞেস করে তাদের খরগোসদের কাছে নিয়ে এলো। একটা ছোট্ট খরগোস ঠিক মনুর কাছে এসে দু’পায়ে উঠে দাঁড়াল। যেন মনুকে বলছে-‘মনু, জন্মদিনে আমায় খাওয়াবে না!’ মনু অমনি বাবার কাছে আরেকটা প্যাকেট চেয়ে আনল। বাবা বলল ‘আর কেন! চল সবাই বাইরে গিয়ে খাব।’ কিন্তু মনু কি ঐ ছোট্ট খরগোস বন্ধুকে না খাইয়ে যেতে পারে! আহাঃ, ওর পাশে একটা কানা খরগোস। ওর ও বোধ হয় খিদে পেয়েছে। ওরে, বাবাঃ সব খরগোস দেখছি মনুর কাছ থেকেই খাবে ঠিক করেছে। মনুর খুব ভাল লাগছে। আজ ওর কত বন্ধু হয়ে গেল। রুমা, টিম্পি, তপু-এমন কি বাবাও খরগোসদের খাওয়াছে।
দেখতে২ সন্ধে হয়ে এলো, এবার বাড়ি ফিরতে হবে। চিড়িয়াখানার এত বন্ধুদের ছেরে চলে যেতে হবে ভেবে মনুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। দিনটা যদি আরো বড় হত! আরো ঘোরা যেত, আরো কত জনের সাথে বন্ধুত্ব হত! বাড়িতে যদিও মা, দাদু, দিদা-মনুর জন্য আপেক্ষা করছে। বাইরের ঘরটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সাজান হয়ে গেছে! নাঃ, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতেই হবে। চিড়িয়াখানা থেকে বের হওয়ার সময় মনু সব পশু বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল-‘আবার আমি তোমাদের কাছে ফিরে আসব।’ ওরা সকলে নতুন বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসল।

Thursday, June 25, 2009

একটা মজার ঘটনা

ছোটবেলার একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল।
তখন আমরা খুব ছোট। আমি বোধহয় ক্লাস টুতে আর আমার পিঠোপিঠি ভাই আর খুড়তুতো বোন-নার্সারী আর ওয়ানে পড়ে। আমাদের ছাদে ঠাকুর ঘর ছিল। সেখানে সব পূজো হত। বড়রা করত। একবার কোন ভাবে একটা পুরানো কাঠের সিংহাসন বাতিল করা হয়। সেটা আমরা দখল করি এবং নিচে নামিয়ে আনি। সেখানে আমাদের মনের মত একটা ক্যালেন্ডারের কৃষ্ণ ঠাকুরের ছবি কেটে পিজবোর্ডে লাগিয়ে, তিন জনে কৃষ্ণ ঠাকুরকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করি। ঠাকুর ঘরে যেমন ভাবে ঠাকুরকে প্রসাদ দেওয়া হত, আমরাও তার ব্যবস্থা করি। কিন্তু ঠাকুর ঘর থেকে নকুলদানা বা বাতাসা আনা সম্ভব নয়, অনেক উঁচু তাকে রাখা থাকে। তাই আমরা নিজেদের ভাগ থেকেই কৃষ্ণ ঠাকুরকে ক্যাডবেরি, জেমস্‌, লজেন্স- এসব দিতে থাকি।
এরপরেই চ মৎকার শুরু হয়। ছোট থেকেই দেখে আসছি ঠাকুর ঘরে ঠাকুর প্রসাদ খান না। পিঁপড়ে ধরে, পরে আমরা প্রসাদ পাই। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার! আমাদের কৃষ্ণ ঠাকুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের ক্যাডবেরি, জেমস্‌, লজেন্স- এসব প্রসাদ খাচ্ছেন! আমরা আনন্দে আটখানা হয়ে ব্যাপারটা জনে জনে বলতে থাকি। এবং ঠাকুর যে বড়দের দেওয়া প্রসাদ না খেয়ে আমাদের দেওয়া প্রসাদ খাচ্ছেন – এই ভেবে প্রচন্ড গর্ব বোধ করতে থাকি। আমরা ছেলেমানুষ বলে হয়ত বড়রা অতটা গা করেনি। কিন্তু আমাদের চেয়ে কিছু বড় আত্মীয় এক-দিদি একথা শুনে খুবই কৌতুহলী হয় এবং আমাদের নিয়েই কৃষ্ণ ঠাকুর কি করে প্রসাদ খান তা দেখতে সেখানে ঘাপ্‌টি মেরে বসে থাকে। শেষে দেখা যায় একটি ছোট্ট নেংটি ইদুঁর কিছু পরে নাচতে নাচতে এসে কুট্‌ কুট্‌ করে আমাদের দেওয়া প্রসাদ খাচ্ছে। ঘটনাটা দেখার পর আমাদের মুখ শুকিয়ে আম্‌সি হয়ে যায়। তবুও হার মানা যায় না! তাই আমরা মনে মনে কিছুটা মর্মাহত হলেও এর এই ব্যাখ্যা করি যে কৃষ্ণ ঠাকুর সব যানতে পেরে গেছিলেন, তাই ইদুঁরের রূপ নিয়ে আসেন। এই ব্যাখ্যা দিয়েই আমরা সেখান থেকে গম্ভীর মুখে প্রস্থান করি। -যদিও এটাও ঠিক যে সেই ইদুঁরের ভিতরও ঈশ্বর ছিলেন। তিনিই আমাদের প্রসাদ খেয়ে এত আনন্দ সে সময় দিয়েছিলেন।

Tuesday, June 23, 2009

সাদালো

একটা ছোট্ট কুকুর রাস্তায় পরে আছে। নির্মলা ভোরবেলা দুধ আনতে গিয়ে দেখল। কুকুরটার গায়ের রঙটা বেশ সুন্দর, সাদার উপর কালো ছোপ ছোপ। নির্মলা কুকুরছানাটাকে বাড়ি নিয়ে এলো। নাম দিলো ‘সাদালো’। সাদার উপর কালো ছোপ কিনা-তাই! সাদালোকে নিয়ে বাড়ি ঢুকবার সময় নির্মলার একটু ভয় হচ্ছিল। বাবা-মা-ঠাম্মা কি বলে! বুবুন যদিও খুশি হবে -তা নির্মলা জানে। বুবুন নির্মলার ছোট ভাই। এই সবে হাঁটতে শিখেছে। নির্মলা ওর চেয়ে অনেক বড়। নির্মলা এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। প্রথম ক’দিন সাদালোকে নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিল নির্মলা। ক্লাস করতে করতে খালি সাদালোর কথা মনে আসে। বাড়ি ফেরার সময় মনে হয় সাদালো বাড়িতে নেই, পালিয়ে গেছে। ঠাম্মাও প্রথম ক’দিন রাগ করেছে। মাও বেশ খাপ্পা ছিল। কিন্তু ওদের পিছনে ঘুর২ করে সাদালো সবার মন জয় করে নিয়েছে। যদিও সবচেয়ে বেশি সে নির্মলাকেই ভালবাসে, নির্মলা তা জানে। সাদালো বাড়ির হাওয়া বুঝে গেছে। বাবাও এখন আর বেশি রাগ করে না। বুবুনের তো খুব মজা – ওর একজন সঙ্গী হল। মা-ঠাম্মা তাও ভয়ে২ থাকে সাদালো যদি কামড়ে দেয়! নির্মলা জানে সাদালো কক্ষন ভালো ছেলেদের কামড়াবে না।
আজ প্রায় আট মাস হল সাদালো এ বাড়িতে এসেছে। পাড়ার বন্ধুরাও সাদালোকে চেনে। পাড়ার কুকুরগুলোও সাদালোকে ভয় পায়। আজ নির্মলার মনটা ভিষণ খারাপ। মার কাছে বকুনি মার দু’টোই খেয়েছে। সাদালো তাই ঠাঁয় নির্মলার পাশে বসে। আজ সকালে নির্মলা এক শালিক দেখেছিল। সঙ্গে২ চোখ সরিয়ে আরেকটাকে খুঁজেছে, কিন্তু দেখতে পায়নি। আজ ভয়ে২ দিন শুরু হল। কি দুঃখ কপালে আছে কে জানে! স্কুলের পড়া ঠিক ভাবে হয়েছে তো! ইংলিশ কবিতার শেষ দু’লাইন একটু আটকে যাচ্ছে। ছায়াদি যদি দাঁড় করিয়ে রাখে? কি লজ্জা! কিন্তু স্কুল যাবার আগেই এই কান্ড!আজ আর স্কুলে যাওয়া হবে না, বুঝে গেছে নির্মলা। এখনই আটটা বেজে গেছে। মাও স্নানে যেতে বলছেনা। কি করবে নির্মলা! তাই মনের দুঃখে এখন সে সাদালোর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আজ এক-শালিক দেখার পর মুখ ধুয়ে ভয়ে২ দুধ আনতে গেছে। সেখানে নগেন জেঠুর কাছে মিথ্যে বকুনি খেল, তাও কিছু বলেনি নির্মলা। চুপচাপ বাড়ি এলো। বুবুন তখন ঘুম থেকে ওঠেনি। নির্মলা স্কুলের বই নিয়ে বসল। হ্যাংলা সাদালো তখন বাবাকে তোয়াজ করছে। বাবা কিনা চা খাচ্ছে! একটু বিস্কুটের টুকরো পাবে। বাঃ বাঃ কি হ্যাংলারে! ‘আমিতো এক্ষুনি পাউরুটি দিলাম! তাতেও পেট ভরেনা!’ হঠা্ৎ কি মনে হল, নির্মলা গেল বুবুনকে ঘুম থেকে ওঠাতে, মা স্নানে গেছে। ‘বুবুনসোনা, ছোট্টভাইটি ওঠো! পড়তে বসবে না! ক-খ-গ-ঘ; A-B-C-D পড়বে না! ওঠো সোনা!’ ‘ও বাবাঃ, কি ঘুমরে! উঠতেই চায়না!’ নির্মলা বুবুনকে কোলে নিল। হঠাৎ তার ভাইয়াকে খুব আদর করতে ইচ্ছে হল। ঠিক বাবার মত আদর করবে। বাবা কি সুন্দর ভাইকে উপরের দিকে ছুড়ে দিয়ে আবার কোলে নিয়ে আসে – ঠিক সেই ভাবে। ভাইয়াও কি সুন্দর হাসে! এই তো ‘এক-দু-ই-তি-ই-ন...’ নির্মলা ভাইয়াকে উপরে ছুরে দিল। বুবুন হক্‌চকিয়ে গেছে, সদ্য ঘুম ভাঙ্গল কিনা! ওমা!সাদালো আবার চেচাঁয় কেন? ওঘরে তো ছিলি! বিস্কুট খাওইয়া হল! এই দেখ্‌, বুবুন কেমন উপরে উঠে যাচ্ছে, আবার আমার কোলে চলে আসবে। হেইয়ো! ‘আয়, আয়, কোলে আয়!’ ওমা, কি হবে বুবুন হাত-পা ছোড়ে যে! ওমা!পড়ছে, পড়ছে, নির্মলার হাত কাঁপছে কেন? একি বুবুন কোলে এলোনা, মাটিতে পড়ছে যে! সাদালো আবার কি করে! বুবুন যে খুব কাঁদছে। নির্মলার ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! বুবুন চুপ্‌ করে গেছে। সাদালো ওকে চাটছে। ভুক্‌-ভুক্‌ করে ডাকছে। বাবা কি বলছে! নির্মলা কিছু শুনতে পাচ্ছে না। কান-দু’টো ভোঁ ভোঁ করছে। ঐ তো বাবা ছুটে আসছে। ঠাম্মার বাতের ব্যথা, তবু ঠুক্‌-ঠুক্‌ করে আওয়াজ হচ্ছে। আর কি? এ ঘরেই আসা হচ্ছে। বাবা বুবুনকে কোলে তুলেছে। ঐ খাটে শোয়াচ্ছে। বাবার মুখটা ভয়ে কালো হয়ে গেছে। সাদালো চুপ করে সব দেখছে। বাবা নির্মলাকে কিছু বলছে না। ঠাম্মা ঘরে ঢুকেছে। ও বাবাঃ ঠাম্মা যে চিৎকার শুরু করে দিল! মা ঐ বাতরুম থেকে তাড়াতাড়ি বেরচ্ছে, দৌড়ে আসছে। এখন কি হবে! মা নির্মলাকে খুব বক্‌বে? বুবুনের কি হল? ঠাকুর! বাবা কোথায় যাচ্ছে? সাদালোও বাবার পিছনে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। মা এখনও বুঝতে পারেনি কি হয়েছে। ঠাম্মা বলছে। এম্মা! কি মিথ্যে কথা, নির্মলা ইচ্ছে করে ভাইয়াকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলেছে! তাও কি হয়! মা তো জানে নির্মলা বুবুনকে কত্তো ভালোবাসে! মা বুবুনের চোখে-মুখে জল ছিঁটিয়ে দিচ্ছে। ঐত্তো বুবুন কাসছে! হে ঠাকুর! তুমি খুব খু-ব ভাল! নির্মলার কথা রেখেছ, বুবুনের কিছু হয়নি। মা এবার নির্মলার দিকে আসছে। আসুক, মারুক – নির্মলার আর ভয় নেই। বুবুনের কিচ্ছু হয়নি। ঠাম্মা বুবুনকে দেখছে। ‘উঃ, লাগে যে!’ মা নির্মলার গালে চড় মারল। এই চুলের মুঠি ধরেছে! উফঃ, কি মারে রে বাবা! নির্মলা কেঁদে ফেলবে যে! “এ্যাঃ এ্যাঃ! আমি কি ইচ্ছে করে বুবুনকে ফেলেছি! আমি তো আদর করছিলাম। বাবার মত বুবুনকে লুফছিলাম।” “এ্যাঃ এ্যাঃ! সাদালো তো কামড়ায় নি! কিছু করেনি। ওতো আমাকেই বকছিল! আমিই শুনিনি। ঐ তো এখন বাবার সাথে ডাক্তার ডাকতে গেল। মাগো! আর কক্ষনো এমন করব না! এবারের মত মাফ কর!” বুবুন খুব কাঁদছে। মা নির্মলাকে ছেড়ে বুবুনের কাছে গেল। এবার ঠাম্মা নির্মলার কান মুলে দিল। নির্মলা এত অত্যাচার সহ্য করবে কেন! সেও আস্তে করে ঠাম্মাকে ঠেলে দিল। ঠাম্মা আবার চ্যাঁচাতে শুরু করল। মা আবার নির্মলাকে মারতে আসছে। ঐ তো বাবা ডাক্তারবাবুকে নিয়ে এসে গেছে। মা আর ঠাম্মা আবার বুবুনের কাছে গিয়ে বসল। নির্মলাও আস্তে আস্তে বুবুনের মাথার কাছে গিয়ে দাড়াল। ডাক্তারবাবু বুবুনকে দেখছে। বাবা বুবুনকে সুস্থ দেখে নিশ্চিন্ত হল। ঠাম্মা বকর্‌ বকর্‌ করে যাচ্ছে। নির্মলার প্রাণের ভেতর যে কি হচ্ছে তা কেউ বোঝে না। নির্মলা ভাবচ্ছে মা হয়ত কিছুটা বুঝবে। সাদালো কোথায়? বাবাকে তো এখন জিঞ্জেস করা যায় না! ওমাঃ, সাদালো বুবুনের লাল টুক্‌টুকে মারুতিটা মুখে নিয়ে এসেছে। বুবুন খেলনাটা অন্নপ্রাশণে পেয়েছে। ওর খুব প্রিয়। বুবুনের তেমন কিছু হয়নি বোধ হয়। ডাক্তারবাবু বললেন ভয় পেয়ে বুবুন অঞ্জান হয়ে গেছিল। ঐ তো সাদালোর কাছ থেকে লাল মারুতি নিয়েছে। ডাক্তারবাবু নির্মলাকে আদর করে বললেন –‘এরকম আর কোরনা। ভাইকে নিয়ে কখন লোফালুফি করে! নির্মলাতো খুব ভাল মেয়ে!’ এরা কেউ নির্মলার মনের কথা বুঝবে না। তবে আর কক্ষণ সে এমন আদরও ভাইয়াকে করবে না। নির্মলা ভাবছে ‘বুবুনের সাথে হাঁটি-হাঁটি করব, দৌড়াব, তবু বাবার মত আদর! - আর না!’ ওমাঃ, সাদালো আবার নির্মলার পায়ে মুখ ঘষছে। যেন বলতে চাইছে –“এই ঠিক, এই ঠিক।” সাদালো ঠিক নির্মলাকে বোঝে। নির্মলা কিনা ওকে তুলে এনেছে! ঐ দেখ বুবুনও আবার ‘দিদিভাই’ বলে ডাকছে। নির্মলা বুবুনকে জড়িয়ে ধরল, হামি খেল। বাবা ডাক্তারবাবুকে পৌছাতে গেছে। ঠাম্মা বুবুন কি খাবে তাই জিঞ্জেস করতে পিছন২ গেল। মা ঐ এগিয়ে আসছে। নির্মলার ভয় করছে। মা এগিয়ে এসে নির্মলাকে জড়িয়ে ধরল। মার চোখে জল। নির্মলার চোখেও জল এসে যাচ্ছে। দুঃষ্টু সাদালো মার দিকে তাকিয়ে ভুক্‌ ভুক্‌ করছে, আর লেজ নারছে। যেন বলছে-‘কাঁদছ কেন?’ বুবুন অবাক হয়ে মা আর দিদিকে দেখছে। মা বুবুন আর নির্মলাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে, চুমু খাছে। সাদালো মার পায়ে মুখ ঘষছে। ঐ তো বাবা আর ঠাম্মাও ঘরে ঢুকছে। নির্মলা ভাবল-“যাক্‌, এক-শালিক দেখলে কি হবে! ভাগ্যিস সাদালো ছিল-তাই আজকের মত ফাঁড়াটা কেটে গেল!”

Monday, June 22, 2009

ভালবাসা

(এলোমেলো মগজের ভাবনা......)
ভালবাসা কি? সে কি কেবল দুঃখ দেয়? না – সুখও দেয়? কিন্তু সেই সুখে কি শান্তি আসে? যাকে ভালবাসি – তাকে সব সময় কেন কাছে পেতে চাই? সে ধরা দেবে না জেনে খুশিও হই। ভালবাসা কিন্তু সবসময় স্থীতি চায় না। ভালবাসায় দুঃখ পেলেও তা কেন মনকে অদ্ভুত আনন্দ দেয়? হয়তো সবই কল্পনা – তাই এমন মনে হয়। বাস্তব বড়ই কঠিন। তবু সেখানেও হয়ত ভালবাসাকে অনুভব করা যায়। কিন্তু তবু যেন কেন ভয় হয়! ভালবাসায় রূপের স্থান কোথায়? ভয়ঙ্কর-দর্শ মানুষ ভালবাসতে পারে সবাই এ কথা মানি – কিন্তু তার ভালবাসা ক’জন চায়! আসলে ভালবাসা সোজা নয়! প্রিয়কেও কি সব সময় ভালবাসা যায়! না হলে কি বুঝতে হবে তা আসলে ভাল লাগা! ভালবাসা ধিরে২ অন্তরের গহনে ভাল – বাসাও চেয়ে বসে। তখন! তখন সেই বাসা ধিরে২ সুন্দর নীড় থেকে আধুনিক গৃহের দিকে পা বারায়। তখনই দেখা যায় উপলক্ষের জন্য লক্ষ যেন কবে দুরে সরে গেল – ভালবাসা যেন কোথায় হারিয়ে গেল! তখন আবার প্রিয়কে নিয়ে পথে নেমেই শান্তি। ভালবাসা আসলে কখনও ফুরায় না। দুরত্ব তাকে আপন করায়। আসলে অকৃত্রিম ভালবাসা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবসময় এক।।

দিদা

পাপার পরেই যার কথা ভাবলে মনটা কৃতঞ্জতায় ভরে ওঠে সে হল-দিদা। ঠাকুমাকে আমরা দিদা বলি। ‘দিদা’ বলতেই লালপাড় সাদা শাড়ি পরা, উঁচু কপালে বড় লাল সিঁদুরের টিপ পরা, মাথায় ঘোমটা, ছোট্ট-খাট্ট চেহারার সাধারণ অথচ দরদী এক মানবীর ছবি ভেসে ওঠে।
আত্মীয়দের মুখে, কথা প্রসঙ্গে দিদার ছোটবেলার যে গল্প শুনি তা হল – দিদা ভবানীপুরের মিত্র বাড়ির মেজ মেয়ে। দিদার বাবার ছবি দেখেছি। খুব লম্বা, গোঁফওলা, রাগি মাস্টারমশাই ধরনের চেহারা। দিদারা চার বোন, দুই ভাই। ছোট ভাই হবার পর সম্ভবত দিদার মা মারা যান। ছোট ভায়ের দায়িত্ব দিদার ছিল। মামাদাদু এখনও দিদার প্রসঙ্গে স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠে। দিদা শান্ত, চুপচাপ ধরনের ছিল। ফলে অনেক ঝড়-ঝাপ্‌টা শান্ত ভাবে সহ্য করে গেছে। দাদুর মুখে শোনা- কোন কাজে দাদু দিদাদের পাড়ায় যায়, সে সময় দিদা সিঁড়ি পরিষ্কার করছিল। দাদুর দিদাকে পছন্দ হয়, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে দিদার বাবার কাছে যায়। দাদুকে সে সময় নিজের সংসার করার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়। দিদা সব সময় দাদুর পাশে২ ছিল। আমার স্মৃতিতে দেখি, দাদু শুয়ে আছে, দিদা দাদুর পা টিপছে। দাদু যে বলেছে তা নয়, দিদার ওটা সখের মত ছিল। শেষে দাদু বেশ ভুগে মারা যান। যখন দাদু মারা গেছেন, তখনও দিদা দাদুর পায়ে হাত বুলাচ্ছিল। শুনেছি এখন আমরা যে বাড়িতে আছি এক সময় এখানে শিয়াল ঘুরত। দাদু সবে একটা ঘর তুলেছে, দরজায় মোটা চট ঝুলত। দিদা দিনেরবেলা একা এভাবেই বাচ্চাদের নিয়ে থাকত। একবার চোরও আসে। তবে শুরু থেকেই দাদু-দিদা কুকুর পুষত-দেশি কুকুর, তাই রক্ষা পায়। পিসির মুখে শুনি দিদার একটা কালো কুচ্‌কুচে কুকুর ছিল। শান্ত, কিন্তু প্রচন্ড রাগী। সারাক্ষণ দিদার সাথে২ থাকত। অনেক বয়সে দিদার পায়ের উপর মাথা রেখে মারা যায়। এর অনেক পরে জিমি আসে, তাকে আমরা দেখেছি।
দাদু-দিদার তিন ছেলে, এক মেয়ে। পাপা বড়। দাদু ভিষণ রাগী ছিলেন। সবার একটা করে ডাক্‌ নাম হলেও পাপাকে দাদু ‘বাবি’ আর দিদা ‘তোতন’ ডাকত, তাই মনে হয় পাপা একটু বেশি আদুরে ছিল।
আমার হস্টেল জীবনটাই প্রথম মধুর স্মৃতি। তার আগের স্মৃতি সব বিক্ষিপ্ত ও কিছু কঠোর। তবু সেখানে একমাত্র স্নিগ্ধ ছায়া হল-‘দিদা’। পাপা সারাদিন বাড়ি থাকত না। আমরা ঘুমালে আসত, উঠে দেখতাম কাজে বেরিয়ে গেছে। দাদু হয়ত ভালবাসত, কিন্তু কঠোরতা এত বেশি ছিল যে মধুর স্মৃতি তেমন নেই। দিদা ভোরবেলা খুঁরিয়ে২ আমাকে স্কুলে দিয়ে আসত, দিদার বাত ছিল। বাড়িতে যা থাকত তাই টিফিনে দিয়ে দিত। তখন স্কুলে টিফিনে বন্ধুদের সাথে তা ভাগ করে খেতে লজ্জা লাগত। দাদু বাড়িতে আমাদের পড়াত, আর খুব মারত। বাপ্পাতো বাড়িতে ছোট্ট২ কারণে সারাক্ষণ মার খেত। দাদুর হরেক রকমের লাঠি আর চাবুক পর্যন্ত ছিল! দিদাকে কখন দাদুর উপর কিছু বলতে দেখিনি। শুধু আমি-বাপ্পা প্রচুর মার খেলে দিদা কাঁদতে২ বাতরুমে নিয়ে যেত। কত বিলাপ করতে২ আমাদের তেল মাখাত, চান করাত। কোলের কাছে নিয়ে শুত।
এরপর আমি হস্টেল চলে যাই। শনি-রবি গার্জন ডেট থাকত। পাপা জলপাইগুড়ি চলে গেছে। আমার বাড়ি থেকে খুবই কম কেউ আসত। তবু আমি সেজেগুজে বসে থাকতাম। দূর থেকে দিদাকে খুঁরিয়ে২ আসতে দেখলে মনটা কানায়২ আনন্দে ভরে উঠত। দিদা চিড়ে-মুড়ি-মুরকি-বাতাসা-মিষ্টি এসব আনত। পাপা খুব কম আস্তে পারত। এলে এই বড় পুতুল, বড়২ চিপ্‌সের প্যাকেট, কেক, বিস্কুট এসব আনত। যেহেতু পাপার আসা সম্ভব হতনা, তাই হয়ত দিদা সব সময় আসার চেষ্টা করত। কিন্তু দিদা একা কখন দূরে কোথাও যেত না। তবু আমার জন্য মাঝে মাঝেই একা বাসে করে হস্টেলে চলে আসত। চোখে তেমন ভাল দেখত না। উঁচু করে শাড়ি পরত, বাসে উঠবে বলে। একবার মনে আছে উল্টো শাড়ি পরেই চলে আসে।
এরপর আমি জলপাইগুড়ি চলে যাই। দাদু-দিদা প্রতি বছর কিছু সময় ওখানে কাটাত। তখন দেখেছি দাদু অনেক শান্ত হয়ে গেছে। সে সময় দিদাকে মনে পরে আচার প্রসঙ্গে। দিদা এত্ত ভাল আচার মাখত, কি বলব! লিখতে২ জিভে জল আসছে। কত্‌বেলের আচার –সর্ষের তেল, কাঁচা লঙ্কা, নুন দিয়ে মাখা, অসাধারণ! এছাড়া, কুল, তেঁতুল, লেবুর আচারও বানাত। কলকাতা থেকে শিশি করে নিয়েও যেত। জলপাইগুড়িতে রান্না করতে হত না। কিন্তু কোন কারণে একবার দিদা রান্না করে। কাঁচকলা আমি একদম পছন্দ করি না। কিন্তু দিদা সেই কাঁচকলার কোপ্তা এত সুন্দর রান্না করে যে কি বলব! ইস্‌! পাপার রান্না সম্পর্কে আগের লেখাতে জানানোই হয়নি! একবার পাপাকে মাংস রান্না করতে হয়। আমিই করতাম, কিন্তু খুব দরকারে বন্ধুর বাড়ি যেতে হয়। পাপা বল্ল তুই যা, আমি করব। ফেরার সময় ভাবছি পাপা কি কান্ডই না করে বসে থাকবে! কিন্তু এসে দেখি বড় সুন্দর পাত্রে অপুর্ব মাংস পাপা রান্না করে রেখেছে। আমি আর বাপ্পা সারাদিন তুলে২ খেলাম।
তো, দিদার কথা বলছিলাম। দিদা হয়ত পাপাকে একটূ বেশি প্রশ্রয় দিত। মনে আছে পাপা দিদার পিছু২ কিছু একটা চেয়ে ঘুর২ করে ফিরছে। পরে বাপ্পাটাও পাপার পিছু২ ওমন ঘুরত। দিদা কিন্তু খুব খিঁচ-খিঁচও করত। আবার ভালোও বাসত।
দাদু মারা যাবার পর দিদা খুব একা হয়ে যায়। দিদা আসলে দাদুর ছায়া হয়ে গেছিল। তের বছর বয়সে দিদার বিয়ে হয়। ফলে দাদু যেতে যেন দিদার অস্তিত্বই হারিয়ে যায়। আর জলপাইগুড়ি যেতে চাইত না। শেষে খবর পেতেম সিঁড়ি থেকে, চেয়ার থেকে পড়ে গেছে। পা দুটো বরাবর কম জোরি ছিল। বাততো ছিলই! শেষে কলকাতায় যখন এলাম তখন দিদা পুর শষ্যাশায়ী। শিশুর মত হয়ে যায়। সূপর্ণাদি দেখভাল করত। তার উপর তাও একটু বকাবকি করত। সে যেতে একদম শান্ত, চুপচাপ হয়ে যায়। খুব কম কথা বলত। অনেকদিন একভাবে শুয়ে ছিল। খুব কষ্ট হত দেখে। তখন বোকা ছিলাম, বরাবর ভাবতাম দাদু তেমন হয়ত দিদাকে ভালবাসত না। একদিন কথা প্রসঙ্গে জিঞ্জেসও করলাম। ফোগ্‌লা মুখে দিদা একগাল হেসে ফেলল। দেখে এত ভাল লাগল! নাঃ, দাদু অবশ্যই দিদাকে খুব ভালবাসত। দাদু যেতে দিদা তাই এত একা।
দিদা আমার বরাবর দাদুর আড়ালেই থেকেছে। আজও সবাই বেশি দাদুর কথাই বলে। তবু আমার সাদাসিধে, ছোট্টখাট্ট দিদার কথা খুব মনে পরে। বাপ্পাও দিদাকে খুব ভালবাসে। যখন আমরা শিশু তখন ভিন্ন পরিবেশে কেবল দিদাই আমাদের ডানা দিয়ে আগলেছিল, লুকিয়ে২ অনেক স্নেহ করেছিল। যে কারণে আজও দিদার প্রতি কৃতঞ্জতা বোধ করি।

Sunday, June 21, 2009

আমার পাপা



আজ father’s day – খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার প্রিয় পাপাকে নিয়ে কিচ্ছু লিখি। প্রায় তিন বছর হতে চল্ল পাপা আমার সঙ্গে আর নেই। পাপাকে খুব miss করি। পাপা আমার – শুধু আমার নয় বাপ্পারও সব ছিল-মা-বাবা দু’ই।সুতরাং খুবই স্বাভাবিক আমরা দু’জনেই পাপার ভীষন অভাব বোধ করি। তবু মনে হয় পাপা যেখানে আছে নিশ্চয়ই খুব ভাল আছে।
আমার পাপা ভিষণ আমুদে ছিল। আমি বা বাপ্পা কেউ পাপার মত হইনি। পাপা থাকতে বাড়ি গম্ গম্ করত, সারাক্ষণ হই চই করত। ভোরবেলা উঠে, পূজো করে সারাবাড়ি ধুনো দিত। ধুন তৈরিও একটা উৎসব ছিল। কত রকম জিনিষ এনে হামানদিস্তেতে গুড়োনো হত। বড়২ কৌটতে রাখা হত। সেই ধুনোর গন্ধে তিনতলা পর্যন্ত ম্‌ ম্‌ করত।
পাপা দাদু-দিদার প্রথম ও আদরের সন্তান ছিল। তাই কম বয়সে একটু বেশি দুষ্টু ছিল। প্রায়ই বাড়ি থেকে পালাত। খুব ছোট্টবেলা এক কনভেন্ট স্কুলে পড়ত, দুষ্টুমির জন্য ফাদার বেত দিয়ে মারলে, বেত কেড়ে ছুড়ে স্কুল থেকে পালায়। দাদু ভিষণ রাগি ছিল-ধরলেই আবার মার খাবার ভয়ে ট্রেনে উঠে পরে। পরে ট্রেনের এক ভাল লোকের সাহায্যে বাড়ি আসে। কিছুদিন আগেই মামাদাদু একটা গল্প বলছিল, পাপা যেহেতু প্রথম সন্তান আর ভিষণ দুরন্ত তাই সবাই পাপাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত। ক্লাস এইট-নাইনে পাপা আবার মু্র্শিদাবাদ না কোথায় পালায়। মামাদাদু বলছিল এখন যেমন কম বয়সি ছেলেরা সিনেমা করবে বলে মুম্বাই যায়, পাপা তেমনি প্লাসটিকের ব্যবসা করবে বলে পালায়। পরে দাদু অনেক খোঁজাখুঁজি করে বাড়ি আনে।
পাপার খুব ব্যবসা করার ইছে ছিল। মনে পরে জলপাইগুড়িতে আমাদের পোলট্রি ছিল। প্রায় ১০০০ মুরগি, ধপ্‌ধপে সাদা, এই বড় বড়। ভুলো তখন ছোট্ট। একটা গুন্ডা মুরগি সারা বাড়ি পাহারা দিত আর ভুলোকে তাড়া করে বেরাত। ব্যবসা কেমন চলত মনে নেই-কিন্তু খুব ভাল লাগত, আমরা সবাই সবসময় ডবল ডিমের অমলেট খেতাম। যা রোজগার হত খেয়ে-খাইয়ে সব মনেহয় সমান সমান চলত। এরপর হল মাসরুম চাষ। আমাদের বাড়ি ছিল একতলা, কিন্তু মাসরুমের ঘর হল তিনতলার সমান। কি ঠান্ডা ঘর! কত্তো বেড! একটার উপর একটা, কুড়িটা করে। তখন আমার ক্লাস সেভেন-এইট হবে। এসময় আবার এই বড়২ সাদা ফুলের মত মাশরুম ভাজা করে, পায়েস করে খাওয়া হচ্ছে। ছাদে শুকনো হচ্ছে। হরেক রকম মেশিন এসেছে। প্যাকেট হচ্ছে। যারা আসছে তারা যেমন মাশরুমের পায়েস খাচ্ছে তেমনি প্যাকেটে করে ফ্রি স্যাম্পল নিয়ে যাচ্ছে। কলকাতা থেকে লোক আসছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে ল্যাব হচ্ছে। কিন্তু শেষে সে ব্যবসাও উঠে গেল। তবু জলপাইগুড়িতে পাপা বিভিন্ন experiment করে ভালোই ছিল। কিন্তু কলকাতার অতি আধুনিক, কিছু স্বার্থন্বেষি মানুষের চক্রে পাপা একদম শেষ হয়ে গেল। পাপার সরলতায় তারাও পাপাকে বোকা বানিয়ে হয়ত মজা পেত। কিন্তু পাপা হঠাৎ একদিনেই এমনভাবে চলে গেল যে তারাও ভিষণ অবাক ও চমকে উঠেছিল। পাপা মারা যেতে কত্তো লোক এলো-পাপা খুব সাধাসিধে ভাল মানুষ ছিল সবাই বলে গেল।
জলপাইগুড়িতে পাপা ভোরবেলা উঠে ধুনো দিতে২ খালি আমার নাম ধরে ডেকেই যেত। আমি কিছুতেই ঘুম থেকে উঠতাম না। পাপার কাছে যখন যা চেয়েছি পেয়েছি। পাপা কখন পড়তে বসতেও বলত না। তবু নিজের মত করে পড়তাম। প্রচুর গল্পের বই কিনে দিত। জলপাইগুড়িতে বড় বাড়ি, সামনে-পিছনে অনেক জায়গা, অনেক গাছ ছিল। কত বিড়ালের বাচ্চা তুলে এনেছি। প্রথমটা একটু বকলেও পাপা তাদের খবরও নিত। ভুলোতো পাপা অফিস থেকে এলেই দৌড়ে২ গেটে চলে যেত, আর বড় কাল ছাতাটা মুখে নিয়ে হেলতে-দুলতে আসত। ভুলোকে পাপা খুব ভালবাসত। আমি বুলবুলি পাখি কুরিয়ে আনলাম, পাপা তারও ফড়িং ধরার ব্যবস্থা করে দিল। কলেজ থেকে পরে যাওয়া দাঁড়কাকের বাচ্চা তুলে আনলাম, পাপা তার জন্য ছোট্ট মাছ-মাংস আনত। পাড়ার কালু ছিল মস্তান কুকুর। পাপা হাঁটতে বেরলেই কালু ঘাড় উঁচু করে পাপার পেছন২ হাঁটত।
পাপার প্রাণ ছিল ছোট্ট লুনা। সেই লুনায় করে পাপা আমায় টাউনে পড়াতে নিয়ে যেত। কত্তো দূর বন্ধুর বাড়িও ঘুরতে নিয়ে গেছে। কিন্তু ছোট্ট লুনা গ্রামের আলের উপর উল্টে গেল। সে কি কান্ড! ফেরার সময় আমি রিক্সায়, পাপা কিন্তু লুনা ঠিক-ঠাক করে আবার রাজার মত ফট্‌ ফট্‌ করতে২ বাড়ি এলো।
আমরা হঠাৎ কলকাতা চলে এলাম। ভুলোকে আনার জন্য পাপা বড় পাঞ্জাবী লড়ি নিল-সামনে ভুলোর থাকার ব্যবস্থা হল, পিছনে মালপত্র। সেই ভুলো যখন ১৫ বছর বয়সে কিছুদিন ভুগে মারা গেল, তখন পাপা যা করেছিল তা ভোলার নয়। আমার ১২ বছর বয়সে ভুলো এল-আমরা চিরদিন শহর থেকে দূরে থাকতাম। তার উপর আমি তেমন মিশুকে নই, শান্ত ধরনের। ভুলো, পাপা, বাপ্পাকে নিয়েই যেন আমার পৃথিবী। ভুলো যাবে যানতাম। ভুলো মারা যেতে আমি স্থির হয়ে যাই। কান্নাকাটিও করিনি। গুম মেরে গেছিলাম। পাপা এমনি এত্তো হৈ চৈ করে, কিন্তু সে দিন আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল। কোথায় গাড়ির ব্যবস্থা করে এলো। এত্তো বড় ব্যাগ আর এই বড় সাদা ফুলের রিং নিয়ে এলো। ছোট্ট কাঁচের পশু চিকিৎসালয়ের গাড়ি, পিছনে ভুলো শুয়ে। সামনে ছোট্ট জায়গা-চালক, তার পাশে পাপা, বাড়ি থেকে আমার যাবার দরকার নেই বলা হল। কিন্তু আমি যেতামই, পাপাও বারণ করলনা। কত্তো দূরে, প্রায় ৩ ঘন্টা ওভাবে কষ্ট করে যাওয়া হল। যেখানে গেলাম, সেখানে গিয়ে মনটা শান্ত হল। কোনো এক গ্রাম-বিশাল এলাকা-কত্তো কুকুর সব ছাড়া। অনেক বিড়াল। এমন কি একটা অন্ধ বাঁদরও ছিল। সেখানে ভুলোকে শুইয়ে এলাম। ফেরার সময় আমি ভাবছিলাম, পাপা ভুলোকে আর অবশ্যই আমাকে কত্তো ভালবাসে। এত্তো ছোট্ট গাড়িতে কি কষ্টই না সেদিন অত্তো বড় মানুষটা পেয়েছিল!
আমাদের রেজাল্টের সময় পাপা বেশি ভয়ে থাকত। ভাবত যদি ফেল করি তা’লে হয়ত বাড়ি ছেরে চলেই যাব। আবার ভাল ফল করলে পাড়ার সব বাড়িতে মিষ্টির বড়২ প্যাকেট পাঠাত। মোবাইল হবার পর ঘন্টায়২ পাপা ফোন করত-কি করছি, কি খাছি, জল খেয়েছি কিনা – তখন হাঁফিইয়ে উঠতাম। এখন সে চুপ থাকে।
আমার পাপা আমায় কখন কিছুতে না বলত না। যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। কত্তো যায়গায় ঘুরেছি। কলকাতায় আসার পর দূরে বর্ধমান ইউনিভার্সিটি যাব- প্রতিদিন পাপা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। পাপার সঙ্গে বেরিয়ে মজা হত। পাপা ট্যাক্সি ছাড়া এক পাও নড়ত না। কত্তো ঘুরতাম, কত্তো খেতাম! গ্রামে২ পাপার সাথে ঘুরে মজা। বড়২ পদ্ম পাতায় গরম২ খাবার খাওয়া! খুঁজে২ পুরোনো২ দোকানে সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার খাওয়া পাপার নেশা ছিল।
পাপার গল্প লোকেদের মুখে শুনতে এত্তো ভাললাগে কি বলব! একটা বিয়ে বাড়িতে মামাদাদুর পাশে বসে২ আমি পাপার ছোট্টবেলার দুষ্টুমীর গল্প শুনছিলাম। আবার দিদির কাছে পাপার গল্পও শুনেছি। আমরা তখন খুব ছোট্ট। পাপার তখন নতুন সংসার। মা একটু আদুরে ছিল, পাপাই বাড়ির অনেক কাজ করত। বিকেলে বাইরে টেবিলে পা তুলে পাপা পাইপ টানতে২ আরাম করত-দিদিও পাপার দেখাদেখি অমন করত। দিদি বলে পাপার পাল্লায় পরে দিদিও ছোট্ট থেকে ছেলেদের মত হয়ে গেছে।
আমি যখন খুব ছোট্ট তখন আমার পক্স হয়। জন্মের পরে পরেই। পাপা-মা তখন শহর থেকে অনেক দূরে থাকত। মাসি-মেসো আমাকে প্রথম দেখতে এসেছে। এদিকে পাপা ঘরে দরজা জানলা বন্ধ করে, মশারি টাঙিয়ে, ঘরে ধুনোর ধোঁয়া দিয়ে, মশারির মধ্যে আমাকে কোলে নিয়ে বসে। কিছুতেই আমাকে বাইরে আনবে না, যদি মরে যাই! মা বলে পাপা আমায় সারাদিন এতো কোলে নিয়ে২ ঘুরত যে তাই আমি বেশি বাড়িনি। আমি যখন হষ্টেলে তখন জলপাইগুড়িতে বাপ্পার একটা দুর্ঘটনা ঘটে, সেলাইও করতে হয়। শুনেছি পাপা এত্তো কান্নাকাটি করে যে পাড়ার সবাই জড় হয়। বাপ্পা তখন খুব ছোট্ট- এখনও বলে ও ভেবে অবাক হচ্ছিল পাপা এত কাঁদছে কেন।
কলকাতা আসার পর পাপার সাথে কয়েকবার পুরী যাই। প্রথমবার পুরী গেলাম, পৌঁছতে২ সন্ধে। আমি, পাপা, বাপ্পা বিচে গেলাম। আমার জ্ঞানত সেই প্রথম সমুদ্র দেখা। পাপাও অনেকদিন পর এল। দু’জনের ভিষণ আনন্দ হচ্ছে। বাপ্পাটা বাইরে আরো চুপচাপ। তো, আমি আর পাপা উট দেখে তার পিঠে চরে বসলাম। পাপা আবার উটটাকে দৌড় করাতে বল্ল। উটটা ল্যাগ-ব্যাগে পা নিয়ে দৌড়চ্ছে-সে কি অভিজ্ঞতা! পরদিন সমুদ্রে নেমেও পাপা ছেলেমানুষ হয়ে গেল। একা একাই মাঝ সমুদ্রের দিকে সাঁতার লাগাচ্ছে। পাপা আর বাপ্পা থাকলে এসময় বাপ্পাকেই অভিভাবক হতে হত। পাপা আর আমি ছেলেমানুষের মত যা খুশি করতাম।
আমার সব সময় কেন যানি মনে হয় আমায় শুধু পাপাই ভালবাসে। একবার দুঃখ করে বল্লাম আমারতো অন্নপ্রাশনই করনি। পাপা অবাক হয়ে বল্ল কে বলেছে! আত্মীয়দের মাঝে সে সময় ছিলাম না ঠিকই, তবে যেখানে ছিলাম সেখানেই অন্নপ্রাশন হয়, এবং ৫০০ মুরগি রান্না হয়। শুনে মুরগিগুলোর জন্য কষ্ট হলেও কেন যেন একটু গর্বও হয়।
আজ এত সুন্দর দিনে পাপার কথা বলে খুব ভাল লাগছে। অবশ্যই সবার বাবাই খুব ভাল হয়। তবু আমার পাপা যেন একাধারে আমার বাবা-মা এবং ভীষণ প্রিয় বন্ধুও ছিল। আমার পাপা যেখানেই থাকুক ঈশ্বর যেন তাকে এমনই খুব খুব ভাল রাখেন।।

Saturday, June 20, 2009

মাটি

মৃত্তিকাই-মাটি একথা সবাই জানি। কিন্তু মৃত্তিকা কি?- সেই ‘মা’-টিকে কি আমরা চিনি? আমার আবদার, আমার অত্যাচার সব যে হাসি মুখে মেনে নিচ্ছে তার কথা আমরা ভুলে যাই। তাকে রাখি নিচে -সে থাকে সকলের অবহেলায়। কত শিশুর রাগ তাকে সহ্য করতে হয়। তারই সন্তান তার গাযে কত আঘাত হানে, তাতেই যে তাদের বীরত্ব! তারাই শ্রেষ্ঠ! তবু মার মনে ক্ষোভ নেই। তার সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেকেই যে সে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। তবে তাকে বোঝার মত সন্তানও তার কম নয়। তারা মাকে সুন্দর করার জন্য ব্যস্ত। মা রাগলে তাকে জল দিয়ে শান্ত করে, তাতে মা খুশি হন – ‘মা’টির রূপ তাতে বাড়ে, অঙ্গে শ্যামল স্নিগ্ধ ছায়া পড়ে। মাটির গায়ের গন্ধে দুষ্টু ছেলেও তখন শান্ত, সে মায়ের রূপে মুগ্ধ হয়-তার শান্ত মিষ্টি গান তখন তার সারা দিনের গ্লানি, ক্ষোভ দুর করে দেয়। সে সব কিছু ভুলে ধিরে ধিরে মায়ের ছোট্ট আদুরে ছেলে সেজে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। মাটি তখন সন্তানের শান্ত, পবিত্র রূপ দু’চোখ ভরে দেখে আর তার ভিতর নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করে।

Friday, June 19, 2009

স্বাধীনতা

একটা ছোট্ট বুলবুল, প্রচন্ড ঝড়ে গাছ থেকে - ছোট্ট বাসা থেকে পড়ে গেছে মাটিতে। মাটির ছোট্ট ছোট্ট ঘাসেরা কিন্তু প্রচন্ড ঝড়ের হাত থেকে তাকে বাঁচিয়ে রাখে। পরের দিন সূর্য উঠলে তার খিদে পায় -কিন্তু মা কোথায়? ছোট্ট ঠোঁট ফাঁক করে সে কাঁদে। হ্যাঁ, তার ডাক কেউ শুনেছে। কে ও? মানুষ! - এই এখন তার নতুন মা। ধিরে ধিরে বুলবুলি বড় হয় - তার খুব খিদে, পেট যেন কিছুতেই ভরে না। মাঝে মাঝে দূরে কার যেন চেনা ডাক সে শুনতে পায়। ডানায় তার নতুন শক্তি আসে - ডানা ঝাপটায়। প্রথম নীল আকাশের নিচে নতুন মার কালো টুপির উপর বসে সে গাছপালা চেনে সে। শে্ষ পর্যন্ত তা নেশার মত ঘোর লাগায় – প্রতিদিন তার বাইরে বেরনো চাই-ই-চাই। বন্দি নয় সে, কারণ পায়ে শিকল নেই-তবু যেন সে কিসে আটকে! তার আর ভাল লাগে না এই জীবন। নতুনের ডাক, আপনজনের ডাক তাকে রাতের অন্ধকারে ডুকরে ডুকরে, গুমরে গুমরে কাঁদায়। প্রথম সে ওড়ে – দিনের আলোয়-টলমল করে, এক ডাল থেকে আরেক ডালে। বিপদ আছে – বড় কাঁটায় ভরা কুলগাছ। সবচেয়ে ভয় – বড় বড় কাক আর চিলকে। তবু ভয়কে জয় করতে হবে – তবেই হতে পারবে স্বাধীন। নীল আকাশ তাকে সব সময় টানে। সেখানে যে মা আছে! মার পিছন পিছন অনেক উপরে, নীল সমুদ্রে গা ভাসান – সে যে সব কিছু পাওয়া – মুক্তি – স্বাধীনতা! আজ নীল আর সবুজ হবে তার আশ্রয়। নীলে হবে তার বিচরণ – সবুজে আশ্রয়। আজ সে সবচেয়ে সুখী।
আজ ছোট্ট বুলবুলি – স্বাধীন পাখি।।

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers