Blog Archive

Sunday, January 15, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৩৬

[পূর্বকথা পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ......অর্জুন, ভীম নকুল ও সহদেব সে কারণে দ্বিগ্বিজয় যাত্রা করেন.....যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... চারদিকে দূতদের আমন্ত্রণের জন্য পাঠান শুরু হল...... মুনিরা হোম যজ্ঞের আয়োজন শুরু করেন......দেবগণকে নিমন্ত্রণ করতে অর্জ্জুন যাত্রা করেন ......] 



বাসুকি-নিমন্ত্রণে পাতালে পার্থের যাত্রাঃ 

অর্জুনকে দেব নারায়ণ জিজ্ঞাসা করেন –বল, কাকে কাকে নিমন্ত্রণ করে এলে! 
শুনে অর্জুন এত নাম বললেন যে লিখলে একটি বই হয়ে যাবে। তিনি জানালেন কুবেরাদি সকল দেবতাদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। সকল বৃত্তান্ত তিনি বিস্তারিত বললেন। 

গোবিন্দ বলেন –এবার তুমি পাতালে গিয়ে শেষনাগকে নিমন্ত্রণ করে এস। স্বর্গে যেমন দেবরাজ ইন্দ্র, পাতালে তেমনি শেষনাগ বাসুকি। তুমি ছাড়া কারো সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। বাসুকি এলেই যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে। বিলম্ব না করে সখা এখনই যাত্রা কর। 

কৃষ্ণের আজ্ঞায় পার্থ সঙ্গে সঙ্গে দিব্যরথে পাতালে গেলেন। 
নাগের আলয়ে গিয়ে দেখেন চারদিকে ফণী বেষ্টিত হয়ে শেষনাগ অবস্থান করছেন। দশ শত ফণা মস্তকের উপর, তিনশত ফণায় শোভিত চরাচর। কূর্মের(কচ্ছপ) পিঠে উপবিষ্ট রতন বেষ্টিত। 

পার্থ হৃষ্ট মনে জোড়হাতে প্রণাম জানিয়ে বলেন –রাজসূয় যজ্ঞের কারণে আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে এলাম, রাজন! সুরলোকের সকল দেবতারা উপস্থিত হবেন। ব্রহ্মা-শিব-ইন্দ্র আদি যত দিকপাল যজ্ঞে অধিষ্ঠান হবেন। আপনি এলে এ যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে। দয়া করে আপনি আসুন। 

শেষনাগ হেসে বলেন –শুনুন ধনঞ্জয়, এ যজ্ঞে গোবিন্দ উপস্থিত, তিনিই কর্তা। তার দর্শনে সকল যজ্ঞের ফল মেলে। কৃষ্ণ যেখানে আছেন সেখানে ব্রহ্মা-মহেশ আসবেনই। অকারণেই আমাকে নিমন্ত্রণ করতে এলেন। আপনি গিয়ে কৃষ্ণের অর্চনা ভাল ভাবে করুন, তাতেই সাফল্য মিলবে। অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে কত শত প্রাণী বিদ্যমান। কত ব্রহ্মা, শিব, ইন্দ্র, শেষনাগ-এই সব শাখাপাত্রকে তুষ্ট করা সম্ভব যদি মূলে জল সিঞ্চন করেন। 

অর্জুন বলেন –হে দেব, যা বললেন তা বেদেও প্রমাণিত। এসবই তার মায়া। তবু জেনে শুনে সবাই মায়া ধন্ধে পরে। 

নাগরাজ বলেন –আপনি কিছু না জেনেই আমায় নিতে এলেন। আমি আমার মস্তকে ক্ষিতির ভার ধারণ করি। আমি গেলে যজ্ঞের স্থানই বা কে ধরে রাখবে! 

অর্জুন বলেন –কৃষ্ণ আমায় আপনার কাছে পাঠালেন। আপনি গেলে তবেই এ যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে। ক্ষিতিভারের কারণ আপনি যদি না যেতে পারেন তবে আমার অনুরোধ, আপনি দয়া করে যজ্ঞে যান, আমি এই পৃথিবীর ভার ধারণ করছি। 

একথা শুনে বিস্মিত হয়ে বিষধর হেসে বলেন –পৃথিবী ধারণ করতে আপনি স্বীকার করছেন! তবে এই নিন আমি ছাড়ছি, আপনি সত্য পালন করুন। 

এত শুনে ধনঞ্জয় হাতে গান্ডীব ধনুক নিয়ে করজোড়ে গান্ডীবদাতা শিবকে স্মরণ করেন, ভক্তিভাবে কৃষ্ণকে প্রণাম জানান এবং গুরু দ্রোণের পদ বন্দনা করে তূণ থেকে অদ্ভুত স্তম্ভন(কন্দর্পের পঞ্চবাণের অন্যতম) অস্ত্র নিয়ে গান্ডীবে যুড়ে সেই অস্ত্রে ক্ষিতিকে ধারণ করলেন। 

তা দেখে সকল নাগেরা ধন্য ধন্য করল। তখন শেষনাগ সকল নাগদের নিয়ে দ্রুত যজ্ঞস্থলের দিকে যাত্রা করলেন। 
বাসুকি, আনিল, তক্ষক, কৌরব্য, নহুষ, কর্কট, ধৃতরাষ্ট্র, জরদ্গব, কোপন, কালীয়, ত্রিকপূর্ণ, ধনঞ্জয়, অজ্যক, উগ্রক, নীল, শঙ্খমুখ, শঙ্খপিন্ড, বক্রদন্ত, কলিচূড়, পিঙ্গচক্ষু আরো শত শত দুষ্ট রুষ্ট সর্প তাদের পুত্র-পৌত্র নিয়ে চলল। 
লক্ষ লক্ষ সাপ দেখে সকলে অশক্য(অসাধ্য) মানল। কারো পাঁচ, কারো সাত মাথা, কারো বা ছয়-সাতশত, কেউবা সহস্র মস্তক, কারো আকার পর্বতের মত। এভাবে ফণিরাজ সপরিবারে চললেন। 

এদিকে সুরেন্দ্রালয়ে দেবতাদের সমাজও সেজে উঠল। দেবরাজ ইন্দ্র ঐরাবতে আরোহণ করলেন। বজ্র তার হাতের শোভা বাড়ায়। মাতলি(ইন্দ্রের সারথি) মাথার উপর ছত্র ধরেন। অষ্টবসু, নবগ্রহ, অশ্বিনীকুমার, দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র, ঊনপঞ্চাশ বায়ু, সাতাশ হুতাশন-যজ্ঞ, যন্ত্র, পুরোধা, দক্ষিণা, দন্ড, ক্ষণ, যোগ, তিথি, করণ নিয়ে, নক্ষত্র, রাশিগণ, চারি মেঘ, বিদ্যুৎ, সঙ্গে সৈন্যসামন্ত, গন্ধর্ব, কিন্নর, সকল অপ্সর, অপ্সরী, দেবঋষি ব্রহ্মা সঙ্গে বিস্তর ঋষিদের নিয়ে চললেন। 
বশিষ্ঠ, পৌলস্ত্য, ভৃগু, পুলহ, অঙ্গিরা, পরাশর, ক্রতু, দক্ষ, লোমশ, সুধীরা, অসিত, দেবল, কুন্ড, শুক, সনাতন, মার্কণ্ড, ধ্রূব, জয়ন্ত, কোপন প্রমুখ যত ঋষিরা ইন্দ্রপ্রস্থে থাকতেন তারা লাখে লাখে দলে দলে ইন্দ্রের সাথে যজ্ঞস্থলে চললেন। 

পুষ্পরথে ধনের ঈশ্বর কুবের চড়লেন। তার সাথে চলল যক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নর, চিত্ররথ, তুম্বুরু, অঙ্গিরা, বিশ্বাবসু, মহেন্দ্র, মাতঙ্গ, ফলকর্ণ, ফলোদক, চিত্রক, লোত্রক প্রমুখ কতশত গুহ্যক(কুবেরের যক্ষ অনুচর) যে চলল বলে শেষ করা যায় না। 
ঘৃতাচী, উর্বশী, চিত্রা, রম্ভা, চিত্রসেনী, চারুনেত্রা, মিশ্রকেশী, বুদ্বুদা, মোহিনী, চিত্ররেখা, অলম্বুষা, সুরভি, সমাচী, পোনিকা, কদম্বা, অর্মা, শূদ্রা, রুচি, শুচি-লক্ষ লক্ষ বিদ্যাধরীরাও নৃত্য গীত করতে করতে আহ্লাদে কুবেরের সাথে চলল। 

যজ্ঞ দেখতে সব মহীধর পর্বতরাও চলল-হিমাদ্রি, কৈলাস, শ্বেত, নীল গিরিবর, কালগিরি, হেমকূট, মন্দর, মৈনাক, চিত্রগিরি, রামগিরি, গোবর্দ্ধন শাখ, চিত্রকূট, বিন্ধ্য, গন্ধমাদন, সুবল, ঋষ্যশৃঙ্গ, শতশৃঙ্গ, মহেন্দ্র, ধবল, রৈবতক, মুনিশিল গিরি, কামগিরি, খন্ডগিরি, নীলগিরি-এমন লক্ষ লক্ষ গিরিরা দেবরূপ ধরে যক্ষরাজের সঙ্গে যজ্ঞ দেখতে চলল। 

বরুণদেব নিজের অমাত্যদের সঙ্গে চললেন। সপ্ত সিন্ধু ও যত সরিৎ(নদী) মূর্তিমন্ত হলেন-গঙ্গা, সরস্বতী, শোণ, সূর্যকন্যা যমুনা-তাপ্তী, চিত্রপালা, প্রেতা, বৈতরণী, পুণ্যযুতা, চন্দ্রভাগা, গোদাবরী, সরযূ, লোহিতা, দেবনদী, মহানদী, মদাশ্বী, সবিতা, ভৈরবী, ভারবীনদী, ভদ্রা, বসুমতী, মেঘবতী, গোমতী, সৌবতী, নর্মদা, অজয়, ব্রাহ্মী, ব্রহ্মপুত্র, কংস, তমুল, কমল–বিষ কোলামুখ বংশ, গন্ডকী, ফল্গু, সিন্ধু, করতোয়া, স্বর্ণরেখা, পদ্মাবতী, শত লোকত্রয়া, ঝুমঝুমি, কালিন্দী, দামোদর, গিরিপুরী, সিন্ধুকা, কাবেরী-প্রমুখ অনেক নদনদী, সরোবর, বাপী(দীঘি), হ্রদ, তড়াগাদি দেহ ধারণ করে বরুনের সাথে যজ্ঞ দেখতে চলল। 

মহিষ বাহনে চড়ে প্রেত মহীপতি যম চললেন। পিতৃগণ, দূতগণ দন্ড মৃত্যুপাশ নিয়ে আকাশ যুড়ে আসতে লাগল। 

এভাবে দ্বাপর যুগে অদ্ভূত যজ্ঞ শুরু হল। এমন আগে কখনও অবনীতে(পৃথিবী) হয়নি। কত যে রাজারা এলেন লিখে শেষ করা যায় না। যযাতি, নহুষ, রঘু, মান্ধাতা, দিলীপ, সগর, ভগীরথ, দশরথ, কৃতবীর্য, কার্তবীর্য, ভরত, সুরথ প্রমুখ অনেক চন্দ্র ও সূর্যবংশীয় রাজারা অংশগ্রহণ করলেন। 
এর আগেও অনেকে রাজসূয় অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছেন। তারা যে দেবতার আরাধনা করতেন তাকেই নিয়ে আসতেন। কিন্তু এই যজ্ঞে সকলের আমন্ত্রণ। 

মহেশ এলেন পার্বতীকে সঙ্গে নিয়ে। তারা অলক্ষ্যে থেকে সকল দিক লক্ষ্য রাখেন। শিবের দক্ষিণ হাতে ত্রিশূল, শির শোভে জটা ভারে। দাড়ি চরণ স্পর্শে, বাম করে তাল। সদাশিব যতদুর যজ্ঞস্থল সেই অঞ্চলের সবার প্রতি দৃষ্টি রাখেন। পার্বতী অন্নদারূপে যজ্ঞস্থানে সকলকে ছায়ারূপে থেকে তোষণ করেন। যার যা মনোবাঞ্ছা তাই যোগাতে থাকেন। 

অশ্ব আরোহণ করে খর-করবাল(খড়্গ/তরবারি) হাতে ঊনকোটি দৈত্য নিয়ে আসে ক্ষেত্রপাল। ময়দানব শতকোটি দৈত্য নিয়ে আসেন। বিনতা-তনয় গরুড় ছয়পুত্র নিয়ে এলেন। 

এভাবে দেব, দৈত্য, নাগ-সবাই যজ্ঞে অংশগ্রহণ করলেন। 

স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা হংসে আরোহণ করে এলেন। অন্তরীক্ষে থেকেই চতুর্মুখ ব্রহ্মা যজ্ঞ দেখলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers