Blog Archive

Sunday, August 9, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৯৯

[পূর্বকথা - অর্জুন বারো বছরের বনবাস কালে প্রভাস তীর্থে এলে গোবিন্দ তাকে দ্বারকায় নিয়ে আসেন..সেখানে সুভদ্রাকে দেখে অর্জুনের ভাল লাগে, সুভদ্রাও অর্জুনের প্রেমে পাগল হন এবং সত্যভামাকে তার মনের কথা জানান... সত্যভামা অর্জুনকে সুভদ্রা বিবাহের কথা বলেন...কথা প্রসঙ্গে পারিজাত হরণের কথা ওঠে...নারদ পারিজাতপুষ্প কৃষ্ণকে দিলে তিনি তা স্ত্রী রুক্মিণীকে পরিয়ে দেন... সে কথা শুনে সত্যভামার অভিমান হয়...] 


সত্যভামার মানভঞ্জনঃ 

এদিকে সত্যভামা মাটিতে পরে আছেন মুক্তকেশ ধূলায় ধূসর, বসন ভূষণ নয়ন জলে ভিজে গেছে। দেখে মনে হয় যেন চন্দ্রমা মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছেন। চারদিকে সখিরা ব্যজনী(তালপাখা) ধরে, সুগন্ধিতে চরণ ধুইয়ে দিচ্ছে। সঘন নিশ্বাস ফেলছেন দেবী সত্যভামা। 

তার এমন করুণ অবস্থা দেখে কৃষ্ণ অশ্রু জল গোপন করতে পারলেন না। সখিদের হাত থেকে নিজেই ব্যজনী নিয়ে ধিরে ধিরে বাতাস করতে লাগলেন। 
গোবিন্দের উপস্থিতিতে সত্যভামার গৃহ উজ্জ্বল হল যেন ষড়ঋতুকে নিয়ে কামদেব এলেন। গোবিন্দের অঙ্গের সৌরভে গৃহ আমোদিত হল। সহস্র অলি ভোঁ ভোঁ রবে ধেয়ে এল। 
অচেতন সত্যভামা চেতনা পেলেন, সৌরভে জানলেন কৃষ্ণ এসেছেন। তিনি উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। ক্রোধে চোখ মেলে তাকালেন না। তিনি সখিদের বলেন –কে আমার অঙ্গ হুতাশন(আগুন) প্রায় দগ্ধ করছে! রুক্মিণীর বান্ধবের কি আগমন ঘটেছে! 
এই বলে শিরে কঙ্কণের আঘাত করতে থাকেন। জগন্নাথ দুই হাতে তার হাত ধরে ফেললেন। 
দুঃখ করে কৃষ্ণ বলেন –কেন রুক্মিণী পতি বলছ হে প্রাণপ্রিয়া সত্যভামা! চোখ মেলে দেখ। আমি কি অপরাধ করেছি, তুমিই বল। কেন তুমি এত কষ্ট পাচ্ছ! 
এই বলে কৃষ্ণ সত্যভামাকে তুলে ধরে বসালেন। নিজের বস্ত্র দিয়ে দেবীর মুখ মুছিয়ে দিলেন। 


গোবিন্দের এত বিনয় বাক্য শুনে সত্যভামা কাঁদতে কাঁদতে আধ আধ বাণীতে বলেন – তোমার মুখে সুধা, হৃদয়ে নিষ্ঠুর। এখন জেনেছি তুমি কত বড় ক্রূর। পারিজাত পুষ্পরাজির অতুল সুবাস শুনেছি। আমাকে নিরাশ করে সেটি তুমি রুক্মিণীকে দিলে! কে এত অপমান সহ্য করতে পারে! আজই আমি তোমার সামনে প্রাণ ত্যাগ করব। 

গোবিন্দ বলেন –প্রিয়ে, বিলাপ ত্যাগ কর। পারিজাতের জন্য তুমি এত দুঃখ করছ! একটি ফুলের জন্য তোমার এত ক্রোধ! ঠিক আছে আমি তোমার জন্য পুষ্প সহ গাছই এনে দেব। 

শুনে সত্যভামা দেবী উল্লাসিত হলেন। চোখ মেলে হেসে কৃষ্ণের সাথে কথা বলেন। নিজে উঠে যদুনাথকে আসনে বসান, কৃষ্ণের চরণ সুগন্ধি জলে ধুইয়ে দেন। পরম সুখে কৃষ্ণকে ভোজন করিয়ে তাম্বুল(সাজা পান) দেন, বাম পাশে বসেন। রত্নময় পালঙ্কে দুজন শয়ন করে আনন্দে রজনী কাটান। 

প্রভাতে উঠে কৃষ্ণ যখন স্নান করছেন তখন সেখানে ঢেঁকিযানে নারদ মুনি উপস্থিত হলেন। 
কলহ বিদ্যায় বিজ্ঞ, দ্বন্দ্বপ্রিয় ঋষি গদগদ ভাষ্যে কৃষ্ণকে বলেন –কি আর বলবো, খুবই লজ্জা হচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্র যে সব কথা বললেন! তিনি দেবতাদের ডেকে বলেন –শুনুন, শুনুন অদ্ভূত কথা। নারদ এলেন গোপালের দূত হয়ে। দেবতাদের দুর্লভ পারিজাত পুষ্পরাজি মানুষের জন্য চাইতে। এমন অনুরোধে তার লজ্জা হল না! গোপালের এত অহংকার! পূর্বের সব কথা সে হয়ত ভুলেছে। কংসের ভয়ে তো নন্দের গৃহে লুকিয়ে ছিল। প্রতিদিন গোরুদের সেবা করত, গোপেদের অন্ন খেত। একদিন চুরি করে ননী খেতে হাত বেঁধে নন্দের ঘরণী(যশোদা) খুব মারল। পরে বৃষ(বৎসাসুর), অশ্ব(কেশী), সর্প(অঘাসুর, কালিয়), বক(বকাসুর) মেরে দেখছি খুব অহংকার হয়েছে! এদিকে জরাসন্ধের ভয়ে তো সমুদ্রে গিয়ে লুকিয়েছিল। এমনজনেরও পারিজাত পুষ্পের সাধ হয়েছে। আবার ভয় দেখিয়েছে না দিলে নাকি বিপদ আছে! এমন কটুকথা কি আমি সহ্য করতে পারি! কিন্তু কি করি দূত আর কেউ নন স্বয়ং নারদ মুনি। যান যান নারদ আমার সামনে আর দাড়িয়ে থাকবেন না। গিয়ে বলুন তার যা খুশি করতে পারে। 

নারদের মুখে এত কথা শুনে কৃষ্ণ রাগে চোখ লাল করে বলেন –মত্ত ইন্দ্র নিজেই নিজের মহত্ব লঘু করলেন। আজ তার অহংকার চূর্ণ করব। আপনিও স্বচক্ষে তা দেখতে চলুন। সে নিজে সব ভুলে গেছে। গোকুল থেকে তাকে দুর করেছিলাম। সাতদিন ধরে যত পরাক্রম দেখাবার দেখিয়েছিল তবু গোপকুলের পূজা নিতে সক্ষম হননি (গোবর্ধনপর্ব)। সুরপুরে থেকে দেখছি তার খুব অহংকার! এখন উচ্চকুলে তার নিবাস-অমরাবতীতে তার আধিপত্য। আবার ঐরাবতে চড়ে, বজ্র অস্ত্র ধরে সে অহং আরো বেড়েছে। আবার সহস্র লোচনও তার গৌরব। তবে আজ তার সব মত্ততা দূর করব। সুরপুর থেকে তাকে ভূমিতলে ফেলবো। প্রহারে ভাঙ্গব গজরাজ কুম্ভ স্থলে। অব্যর্থ মুনির(দধীচি মুনি) অস্থি সেই তার বজ্র। আজ তা ব্যর্থ করে দেবতাদের সমাজে তাকে হাসাব। বন ভেঙ্গে পারিজাত আনব সমূলে। 
দেখি শচীনাথ(ইন্দ্র=শচীর স্বামী) কেমন ভাবে তা রক্ষা করেন। 

এই বলে গোবিন্দ খগেশ্বরকে(গরুড়) স্মরণ করেন। খগরাজ এসে যোড়হাতে দাঁড়ান। 
কৃষ্ণ বলেন –ইন্দ্রের নগরে যাব, এখানে পারিজাত তরুবর নিয়ে আসব। 

গরুড় বলেন –প্রভু আপনি কেন যাবেন! আজ্ঞা দিলে আমি নিজে গিয়ে নন্দনবন থেকে পুষ্পসহ পারিজাত নিয়ে আসব। 

গোবিন্দ বলেন –যানি এ তোমার কাছে সামান্য কর্ম। কিন্তু আমি স্বয়ং গিয়ে তাকে শিক্ষা দেব। 

এই বলে গোবিন্দ প্রহরণ(অস্ত্র) নিলেন-কৌমদকী গদা(কুমোদক-বিষ্ণু), খড়্গ, সুদর্শন চক্র। তার সারঙ্গ ধনুকে গুণ চড়ালেন এবং গরুড়ের কাছে তার অক্ষয় তূণ রাখতে দিলেন। 
কিরীট(মুকুট), কুন্ডল দিয়ে বেশভূষা করলেন। যেন মেঘেতে শোভিত মিহির(সূর্য) মণ্ডল। কন্ঠে তার গজ মুক্তার হার, ঝিকিমিকি করে যেন বিদ্যুৎ আকার। বক্ষস্থলে কৌস্তভ রত্ন শোভা দিল যা দেখে মনে হয় যেন কোটি মনোভব(কামদেব) মূর্চ্ছা যাবেন। অঙ্গদ বলয়(বালা) ও কেয়ূর ভূষণ(বাজু) পরে পীতবর্ণের(হলুদ) বসন এঁটে বেঁধে নেন। সর্বাঙ্গে চন্দন কস্তুরি লেপন করে কাঁকালে(কোমড়ে) খড়্গ ছুরি বেঁধে নিলেন। 

কৃষ্ণ যখন গরুড়ে আরূঢ় হলেন তখন সত্যভামা বলে ওঠেন –আমিও আপনার সাথে যাব। ইন্দ্রের পুরী দেখব, ইন্দ্রানীকেও দেখব। কেমন করে ব্জ্রপাণি আপনার সাথে যুদ্ধ করেন দেখব। 


শুনে জগন্নাথ হরি তাকে নিজের বাম দিকে বসালেন। 
তারপর সাত্যকি আর পুত্র কামদেবকে ডেকে বলেন –আমার সাথে চল। ইন্দ্রের সাথে কি মজা করি দেখবে। 

কৃষ্ণের আজ্ঞা পেয়ে তারাও গরুড়ে আরোহণ করলেন। এভাবে চারজন যুদ্ধ দেখতে চললেন। 

সে সময় বলভদ্র সহ অন্য যাদবরা বলল –আমরাও তোমার সাথে যেতে চাই। 

গোবিন্দ বলেন –আপনারা দ্বারকায় থেকে রাজ্য রক্ষা করুন। শূণ্য জেনে দুষ্টরা আক্রমণ করতে পারে। 

এত বলে সবাইকে প্রবোধ দিয়ে কৃষ্ণ গরুড়কে চলার আজ্ঞা দিলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান। 
...................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers