Blog Archive

Saturday, June 17, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৭

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করেন.....ভীষ্মের পরামর্শে যুধিষ্ঠির সকলের শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের পূজা করতে গেলে চেদিরাজ শিশুপাল তীব্র প্রতিবাদ করে কৃষ্ণ নিন্দা করতে লাগল .....ভীষ্ম শিশুপালের জন্মকথা সবাইকে বলেন... কৃষ্ণ শিশুপালের মাকে তার একশত অন্যায় ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দেন . ....... শিশুপাল কৃষ্ণকে অপমান শুরু করলে কৃষ্ণ সুদর্শন চক্রে তার প্রাণ হরণ করেন .... সকল রাজারা নিজ দেশে ফিরলেও দুর্যোধন থেকে যায় ও পাণ্ডবদের হিংসা করতে থাকে ......] 



পাশা খেলিবার মন্ত্রণাঃ

রাজা জন্মেজয় বলেন – কহ মুনিবর শুনি কি ভাবে পাশাখেলা অনর্থ আনল। পিতামহ পিতামহী যে কারণে এত দুঃখ পেলেন সেই খেলা কে কে নিবৃত্ত করতে চাইল, আর কেই বা প্রবর্ত্তিল(রত/নিযুক্ত)। যে পাশাখেলা থেকে বিখ্যাত ভারত-সমর(যুদ্ধ) হল সেই ক্রীড়াসভায় কে কে উপস্থিত ছিল। 

মুনি বলেন – শুনুন পরীক্ষিত পুত্র ক্ষত্তার(বিদুর) বাক্য শুনে অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র চিন্তিত হলেন। তিনিও মনে মনে দৃঢ় ভাবে জানলেন কাজটি সঠিক হচ্ছে না। 
চিন্তিত রাজা পুত্র দুর্যোধনকে একান্তে ডেকে বলেন – হে পুত্র তুমি এ পাশা খেল না। বিদুর এ খেলা সুনজরে দেখছে না। সুবুদ্ধি বিদুর কখনো আমার অহিত চায় না যেন। তার বাক্য না শুনলে পরে কষ্ট পেতে হবে। দেবতাদের রাজহিতে দেব পুরোহিত যেমন বৃহস্পতি, তেমনি ক্ষত্তা আমার হিতাকাঙ্ক্ষী নিশ্চিত ভাবে যেন। ক্ষত্তা বিদুরের মন্ত্রণা গুরুর অধিক মেন। বিচক্ষণ ক্ষত্তা কুরুবংশের শুভাকাঙ্ক্ষী। সুরকুলে(দেবকুলে) বৃহস্পতির যে স্থান, বৃষ্ণিকুলে(যদুবংশে) সুবুদ্ধি জ্ঞানদাতা উদ্ধবের যে স্থান, কুরুকুলে ক্ষত্তা বিদুরেরও সে স্থান। তার মতে পাশাখেলা অনর্থ ঘটাবে। এই দ্যূতক্রীড়ার মাধ্যমে ভেদাভেদ শুরু হবে। 
হে পুত্র, ভাতৃভেদ সর্বনাশ আনবে-বিদুরের এ বাক্য শুনে আমার মনে আশঙ্কা হচ্ছে। পুত্র, পিতামাতাকে যদি মান্য কর তবে আমার কথা শোন, এ পাশা খেলা বর্জন কর। 
পুত্র তুমিও পণ্ডিত, কি কারণে তবে পান্ডুর পুত্রদের হিংসা করছ! কুরুকুলে যুধিষ্ঠির জ্যেষ্ঠ এবং সকল দিকদিয়ে শ্রেষ্ঠ। এই হস্তিনানগর কুরুকুলের রাজধানী। যুধিষ্ঠির এখানে থাকতে তুমি তাকে যা দিলে যেটুকু দিলে তাই নিয়ে তারা পাঁচ ভাই সন্তুষ্ট হয়ে গেল। এখন তো পুত্র তোমার বৈভব ইন্দ্রের সমান। নরযোনিতে জন্মে কার এত সম্পদ সম্ভব! তাও কিসের জন্য তোমার এত অনুশোচনা, কিসের জন্য উদ্বিঘ্ন! 

দুর্যোধন বলে –পিতা আমি সমর্থ পুরুষ। শত্রুকে দেখিয়ে অহঙ্কার যদি না করি তবে কাপুরুষ গণ্য হব। বিশেষ করে আমার বন্ধুদের আপনি চেনেন। আমার যে সম্পদের কথা আপনি বললেন এমন বহুজনের আছে। কিন্তু আজ কুন্তীপুত্রদের লক্ষ্মী যেন দীপ্ত হুতাশন(আগুন)। তা দেখেও আমি যে এখনও প্রাণে বেঁচে আছি এতেই আমি ধন্য। 
হে পিতা, পৃথিবী জুড়ে আজ পাণ্ডবদের যশ কীর্তন হচ্ছে। সকল রাজা আজ তাদের বশে। যদু, ভোজ, অন্ধক, কুক্কুর, অঙ্গ, কারস্কর, বৃষ্ণি-এই সাতটি বিখ্যাত বংশ তাদের মিত্র সঙ্গ। যুধিষ্ঠিরের কথামত কৃষ্ণ সদা খেটে চলেছেন। সমস্ত ভূপতি রাজারা করপুটে তাকে কর দিচ্ছে। আর পান্ডবরাও ইচ্ছে করে সব ধন সম্পদ আমার কাছে রাখতে দিল। পিতা যে সব রত্নের নামও কখনো শুনিনি, সে সবও দেখে এলাম যুধিষ্ঠিরের পুরীতে। নানাবর্ণের নানা রত্নের সে সব সম্পদ কোনটা গিরিপর্বতে, কোনটা বা সিন্ধু মধ্যে উৎপন্ন। তাদের সবার কথা বলে শেষ করা যায় না। ধরার মধ্যে, বৃক্ষের মধ্যে, জীবের অঙ্গেতে যত রত্ন আছে আজ সব তা যুধিষ্ঠিরের ভান্ডারে জমা হচ্ছে। লোমজ(লোমজাতীয়), পট্টজ(রেশমাদি), চীর(গাছের ছাল) বিবিধ বসন, গজদন্ত বিরচিত দিব্য সিংহাসন; হস্তী, অশ্ব, উট, গাধা, মেষ আর অজা(ছাগল) নানাবর্ণের এনে দিল নানা দেশীয় রাজা। 
শ্যামলা তরুণী, দিব্যরূপা দীর্ঘকেশী সহস্র দাসী নানাবর্ণে ভূষিতা হয়ে ঘুরছে, দেখতে দেখতে আমার মনে ভ্রম হল। সেই সুযোগে পাণ্ডবরা আমার অপমান করল। 
মায়া সভার মধ্যে আমি কিছু দেখতে পাইনি, সবই স্ফটিকের বেদী মনে হয়েছে। জল ভেবে বসন গোটাতে দেখে সভার সকলে হেসে উঠল। সেখান থেকে কিছু দুরেই ছিল জলাশয়, তাকে স্ফটিক ভাবায় সবস্ত্র মহাশব্দে সেখানে পড়লাম। চারদিকে লোক হাসতে লাগল। তাদের সাথে ভীম, ধনঞ্জয় অর্জুন, অন্যদিকে দ্রৌপদীও পুরনারীদের নিয়ে হাসছিল। এভাবে সবাই আমায় উপহাস করল। শেষে যুধিষ্ঠির কিঙ্করদের(কাজের লোক) দিয়ে বাপী(দীঘি) থেকে তুলে অন্য বস্ত্র পরাল। 
হে পিতা এত অপমান কে সহ্য করে! আরও কত শুনতে চান, আপনি! এরা ইচ্ছে করে স্থানে স্থানে স্ফটিকের প্রাচীর নির্মাণ করেছে। দ্বার ভেবে বেরতে গিয়ে এত জোর মাথায় আঘাত লাগল যে মাটিতে উল্টে পরে গেলাম। মাদ্রীর দুই পুত্র দ্রুত এসে আমায় তুলে খুব দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। আমার হাত ধরে দুয়ার দেখিয়ে দিল। এসব অপমান পিতা আর সহ্য হয় না। আমি এই হীন পাণ্ডবদের এত অপমান আর সহ্য করব না। হয় তাদের লক্ষ্মী কেড়ে নেব নয় প্রাণ দেব। 

ধৃতরাষ্ট্র বলেন – পুত্র হিংসা বড় পাপ। হিংসক জনের পুত্র জন্মে বড় কষ্ট নিয়ে। অহিংসক পান্ডবদের হিংসা কর না। একটু শান্ত হয়ে ধৈয্য ধরে থাক দেখবে প্রশংসা পাবে। তাদের মত যদি যজ্ঞ করতে চাও বল। আমি এখনই সকল রাজাদের নিমন্ত্রণ পত্র পাঠাচ্ছি। আমাকে সকল নৃপ সম্মান করেন। তারা আরও অধিক রত্ন আমাদের পাঠাবেন। আমার এ কথা শোন। 
হে পুত্র, অসৎ মার্গে গেলে তোমার সাথে পুর সংসার রসাতলে যাবে। স্বধর্মে থেকে যে সদা মনকে সন্তুষ্ট রাখে সেই পরের দ্রব্য দেখে হিংসা পরিত্যাগ করতে পারে। পরোপকারীরা স্বকর্মে সব সময় উদ্যোগী থাকে তাই দুঃখ তাদের স্পর্শ করে না, সদা সুখে থাকে। আর পান্ডু পুত্রদের পর ভাবছ কেন, তারা তোমার আপন। তাদের কখন হিংসা দ্বেষ কর না। 

দুর্যোধন বলে –পিতা আমি প্রজ্ঞাবান(তত্ত্বজ্ঞানী) নই। আমি অত শাস্ত্রের কথা বুঝি না। চাটু কি যানে পিষ্টকের(পিঠে) স্বাদ। আমি যানি শুধু শত্রুকে কখনো বিশ্বাস করা যায় না। যেমন নমুচি দানবের সহস্রলোচন ইন্দ্রকে করা উচিত হয় নি। এক পিতার থেকেই তাদের উৎপত্তি। বহুকাল তারা একসাথে খুশি ছিল। তবু ইন্দ্র তাকে সংহার করে। এভাবে নিষ্কণ্টক হয়ে অদিতিকুমার সব একাই ভোগ করতে থাকে। এভাবে সামান্য শত্রুকেও নাশ করতে হবে। মূলস্থ বল্মীক(উই) যেমন পুর তরুকে গ্রাস করে। জ্ঞাতি মধ্যে যে জন ধনে জনে বলবান ক্ষত্র মধ্যে তাকেই প্রধান শত্রু মানি। আপনি সব যেনেও আমাকে বঞ্চিত করতে চান। বুঝেছি পিতা আপনি আমার নিধন চান। 

পুত্রস্নেহে অন্ধ রাজা অনেক বোঝাতে চেয়েও পারলেন না। শেষে বিদুরকে ডেকে বলেন – তুমি দ্রুত গিয়ে যুধিষ্ঠিরদের নিয়ে এস। 

বিদুর বলেন –রাজা এটা ঠিক হচ্ছে না। কুলের নাশ হবে ভেবে আমি শঙ্কিত হচ্ছি। 

অন্ধ রাজা বলেন –হে বিদুর, আমার আর কিছু করার নেই। এ সংসার যেন দৈবের বশ, আমিও তার অধিন। 

বিদুর রাজাজ্ঞা অবহেলা করতে পারলেন না। রথে চড়ে ইন্দ্রপ্রস্থের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলেন। বিদুরের আগমনে পাণ্ডবরা খুশি হলেন। যথা নিয়মে তাকে আহ্বান জানান হল। 

যুধিষ্ঠির বলেন – হে তাত, কি সমাচার আছে বলুন। আপনাকে অন্যমনস্ক ও চিন্তিত লাগছে কেন! 

বিদুর বলেন –রাজা ধৃতরাষ্ট্র আপনাদের হস্তিনাপুরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি যা বলি মন দিয়ে শুনুন। সেখানে আপনাদের সভার সমান সভা নির্মাণ হচ্ছে। সে সভা দেখার জন্য এ আমন্ত্রণ। সেখানে দ্যূত আদি ক্রীড়ারও আয়োজন হচ্ছে। সে সব কারণেই আমাকে পাঠান হয়েছে। 

যুধিষ্ঠির বলেন –দ্যূত ক্রীড়া সব অনর্থের মুল। জ্ঞানভ্রষ্টরা এই খেলায় মাতে। তবু আমি এ আমন্ত্রণ শিরধার্য করছি। আমায় কি করতে হবে আজ্ঞা দিন, তাত! 

বিদুর বলেন – রাজা আপনি ঠিক বলেছেন পাশা অনর্থের মূল। এই খেলা কুল ভ্রষ্ট করে। অন্ধ রাজাকে অনেক বলেও বোঝানো গেল না। তবু তিনি আমায় পাঠালেন। হে রাজন, আপনি যথেষ্ঠ বুদ্ধিমান, ভেবে চিন্তে যা শ্রেয় মনে করেন করুন। আপনার ইচ্ছে না হলে সেখানে গিয়ে কাজ নেই। 

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলেন – হে কুরুপতি আজ্ঞা দিন। গুরু আজ্ঞা ভঙ্গ করলে নরকে যেতে হবে। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম আপনি যানেন তাত। দ্যূতে বা যুদ্ধে কেউ আহ্বান যানালে পিছনর স্থান নেই। আমিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কেউ যুদ্ধে বা দ্যূতে আহ্বান জানালে তাকে ফিরাব না। 
এই বলে যুধিষ্ঠির ভাইদের নিয়ে দ্রৌপদীকে সব জানাতে গেলেন। 

দৈব যেমন মানুষকে বেধে ঘোরায় তেমনি ক্ষত্রা দ্রৌপদী সহ পাঁচভাই হস্তিনাপুরে পৌছালেন। সভায় ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, সোমদত্ত সহ অন্তপুরের গান্ধারী ও সকলকে তারা একে একে সম্ভাষণ করেন। 
সে রাতে পঞ্চপাণ্ডব সুখে হস্তিনাপুরে কাটালেন।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers