Blog Archive

Sunday, July 19, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৯৬

[পূর্বকথা - ইন্দ্রপ্রস্থে কৃষ্ণের সহায়তায় পঞ্চপাণ্ডবরা অবস্থান করতে লাগলেন... নারদমুনি এসে সুন্দ-উপসুন্দের কাহিনী বলে পঞ্চপান্ডবদের মধ্যে দ্রৌপদীকে নিয়ে একটি নিয়ম স্থাপন করলেন...এভাবে দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব সুখে বাস করতে লাগলো... একদিন অর্জুন বাধ্য হলেন যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদী একসাথে অবস্থান কালে গৃহে প্রবেশ করায়...তিনি নিজেই বারো বছরের বনবাসে যান... উলুপী ও চিত্রাঙ্গদার সাথে তার বিবাহ হয়...]

অর্জুনের বনবাসঃ




এরপর পার্থ দক্ষিণ সাগরের দিকে যাত্রা করলেন। সব তীর্থে তিনি পুণ্যস্নান ও দান করলেন।
এভাবে ঘুরতে ঘুরতে অর্জুন লক্ষ্য করলেন পঞ্চতীর্থ নামে একস্থানকে মুনিরা এড়িয়ে চলছেন। বিস্মিত হয়ে পার্থ এর কারণ জিজ্ঞেস করেন।
মুনিরা বলেন –এই পঞ্চতীর্থ পুণ্যস্থান। কিন্তু কুম্ভীরের ভয়ে কেউ এর পানি স্পর্শ করে না।
শুনে অর্জুন সেখানে স্নান করতে চললেন, সকলে তাকে নিষেধ করতে লাগল। অর্জুন সৌভদ্র নামের তীর্থে প্রবেশ করে নিসঙ্কোচে স্নান করতে লাগলেন। স্নানের শব্দ শুনে এক বিরাট কুম্ভীরিণী দ্রুত এসে তার পা চেপে ধরল। বল প্রয়োগ করে অর্জুন তাকে কূলে টেনে তুলতেই সে এক অপরূপা সুন্দরীতে রূপান্তরিত হল।
অবাক হয়ে অর্জুন তাকে জিজ্ঞেস করেন –তুমি কে, কি কারণে কুম্ভীরের শরীরে এখানে বাস করছিলে।

কন্যা বলে –আমি অপ্সরী, আমার নাম বর্গা। কুবেরের প্রিয়া। আমরা পাঁচ কুমারী সুবেশা হয়ে ধনেশ্বরের(কুবের) সাথে ঘুরি। পথে একদিন এক ব্রাহ্মণকে তপ করতে দেখি। চন্দ্র-সূর্যের সমান মহা তেজ সেই তপস্বীর। তার তপস্যা ভঙ্গ করতে আমরা তার স্থানে গিয়ে নৃত্যগীত শুরু করি। কিন্তু তিনি এতটুকু বিচলিত না হয়ে বিরক্ত বোধ করে আমাদের অভিশাপ দেন, আমাদের বহু বছর গ্রাহরূপে(জলচর হিংস্র প্রাণী/কুম্ভীর) থাকতে হবে। আমরা করযোড়ে কেঁদে তার বহু স্তুতি করলে তিনি অবধ্য অবলা যেনে করুণা করে বলেন গ্রাহরূপে তীর্থে থাকবে। কোনদিন কোন মানুষ যদি টেনে কূলে তলে তবে মুক্তি পাবে।
তার কথা শুনে আমরা বিমনা হয়ে ঘরে ফেরার সময় নারদমুনির সাথে দেখা হলে তিনি সব শুনে বলেন এই পঞ্চতীর্থে গ্রাহরূপে পাঁচজনে থাক। ধনঞ্জয় তীর্থ করতে আসলে তিনিই তোমাদের মুক্তি দেবেন।
সে কথা আজ সত্য হল। আমি আজ মুক্তি পেলাম। আপনি দয়া করে আমার চার সখীকেও উদ্ধার করুন।

দয়াবান পার্থ অপর চারতীর্থ –পৌলম, অগস্ত্য, কারন্ধম ও ভারদ্বাজ থেকে অন্য অপ্সরীদেরও মুক্তি দিলেন।
এভাবে বহু তীর্থ ঘুরে পার্থ পুনরায় মণিপুরে আসেন। চিত্রাঙ্গদার সাথে তার পুনরায় মিলন হয়। চিত্রাঙ্গদার গর্ভে তার এক পুত্র জন্মায়, তার নাম রাখেন শ্রী বভ্রুবাহন। সেই পুত্রকে বহুদিন লালন করে তাকে সে রাজ্যে স্থাপন করে পার্থ পুনরায় তীর্থ ভ্রমণে বার হলেন। গোকর্ণাদি তীর্থে স্নান করে ক্রমে পশ্চিমে প্রভাস তীর্থে এলেন।


এসংবাদ দ্বারকায় গোবিন্দ শুনে শীঘ্র সেখানে এসে পার্থকে আলিঙ্গন করলেন। দেবকী নন্দন অর্জুনকে নিয়ে রৈবতক পর্বতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। গোবিন্দের আদেশে যদুরা পূর্বেই রৈবতক পর্বতে যাত্রা করেছিল।
অতিশয় মনোরম সে গিরিপর্বত। নানা জাতির বৃক্ষে, পুষ্প ও ফলে শোভিত, নানা জাতির পশু পাখি আনন্দে ক্রীড়া করছে দেখে সকল যদুরা সুখী হল।
কৃষ্ণের নির্দেশে দ্বারকাবাসী রৈবতক পর্বতে মহোৎসবের আয়োজন করল। বাল-বৃদ্ধ-যুবা আর সকল নরনারীরা নানা বাদ্যে নৃত্য-গীতে মত্ত হল। সকল তরুবৃক্ষ নানা রত্নে সাজান হল। শ্বেত, পীত(হলুদ), রক্ত, নীলবর্ণের বসনে সেজে উঠল। শ্বেত ও কৃষ্ণ চামর রাখা হল চার ডালে। প্রবাল-মুক্তার ঝারি বাঁধা হল।

উগ্রসেন(কংসের পিতা), বসুদেব(কৃষ্ণের পিতা), অক্রূর(কৃষ্ণের সখা), উদ্ধব(কৃষ্ণের সখা), জয়সেন(জম্বুকাশ্মীরের উত্তর সীমায় অবস্থিত কেকয়রাজ্যের রাজা যিনি বসুদেবের বোন রাধাদেবীর স্বামী, এদের পুত্র ভিন্দ দুর্যোধনের মিত্র), প্রদ্যুম্ন(রুক্মিণীর পুত্র), কামদেব(কৃষ্ণপুত্র), বলভদ্র, চারুদেষ্ণ(রুক্মিণীর পুত্র), সাত্যকি(কৃষ্ণের অনুচর, শিনির পুত্র ও সত্যকের পুত্র), সারণ(কৃষ্ণের বৈমাত্রের ভাই, সুভদ্রার সহোদর), গদ(যদুবীর), উপগদ, দারুক(কৃষ্ণের সারথি), প্রমুখ বীররা এবং ঝিল্লি উপঝিল্লি সমেত সপ্তবংশনারীরা উদ্যানে ভ্রমণ করতে থাকেন। দৈবকী(কৃষ্ণের মা), রোহিণী(বলরামের মা), ভদ্রা(কৃষ্ণের স্ত্রী), বিদর্ভরাজ ভীষ্মক কন্যা রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, নগ্নজিতা, কালিন্দী, লক্ষণা, মিত্রবৃন্দা প্রমুখ কৃষ্ণের পত্নীরা রত্নালঙ্কারে ভূষিতা হয়ে এলেন।
শোণিতপুরের রাজা বাণদৈত্যের কন্যা ঊষা(কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের স্ত্রী), চন্দ্রাবতী, ভদ্রাবতী এবং কৃষ্ণের ষোলসহস্র রমণীরা(নরকাসুর দ্বারা অপহৃত কন্যারা) সকলে রৈবতক পর্বতে বিহার করছিলেন। সে সময় ইন্দ্রপুত্র অর্জুনের আগমনবার্তা পেয়ে সকলে তাকে অভ্যর্থনা করতে গেল।

কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয় অর্জুন এক রথে আরোহণ করে আসছিলেন। তাদের যেন আলাদা করে চেনার উপায় নেই। দুজনেই নীলঘন বর্ণ, অরুণ অধর(ঠোঁট), মাথায় কিরীট(মুকুট), গলায় কুন্ডল হার শোভা পাচ্ছে, পীতাম্বর(হলুদ) বস্ত্রধারী কেউ কৃষ্ণকে অর্জুন ভাবে, কেউবা অর্জুনকে কৃষ্ণ। দুজনের যুগল মূর্তি দেখে নরনারী সকলে বিস্মিত হল।
তখন বীর ধনঞ্জয় রথ থেকে নেমে শ্রীবসুদেবের পদধূলি নিলেন। বসুদেব তার শিরে চুম্বন করে আলিঙ্গন করলেন। অর্জুনকে বসিয়ে সকল বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। অর্জুন সকল কথা জানালেন। নারদের নিয়ম প্রবর্তন এবং তা লঙ্ঘন করায় তীর্থে ভ্রমণের কাহিনী।

বসুদেব সব শুনে বলেন –এখন এখানেই বসবাস কর, যতদিন না বার বছর শেষ হয়।
বলভদ্র, উগ্রসেন, সত্যক, সাত্যকী সকলে এসে অর্জুনকে সম্ভাষণ করে রৈবতক পর্বতে নিয়ে চলল। সকল যদু নারীরাও এসে সম্ভাষে। সবাই অর্ঘ দিয়ে কল্যাণবার্তা জানিয়ে পরম আনন্দে শুভেচ্ছা জানায়। অর্জুন মামার গৃহে মামীস্থানীয়াদের প্রণাম জানাতে থাকেন।

সে সময় বসুদেবের কন্যা যুবতী সুভদ্রা-যিনি সর্বরূপগুণে সম্পূর্ণা সেখানে উপস্থিত হন। বিচিত্র কবরী(খোঁপা) ভারে সুচাঁচর(কোঁকড়ান) চুল তার। দেখে মনে হয় মেঘেতে সঞ্চরে যেন কুরুবক ফুল(ঝিন্টী বা ঝাঁটি ফুল)। তার গন্ধে যেন মকরন্দ(পুষ্পমধু) ত্যাগ করে অলিকুল(ভ্রমর)। কানের সুন্দর কুন্ডল দুই গালকেও মণ্ডিত করেছে। তিলফুলের মত নাক, চাঁদের মত মুখ। তার চাহনির কটাক্ষে মুনিরাও মন ভোলে। কুচযুগ সম পূগ(সুপারি), মধ্যদেশ মৃগ ঈশ(ঈর্ষা ধরায়), জঘন(কোমর) নর্তকীর মত। চরণের অঙ্গুল দেখেও মুগ্ধ হতে হয়। নিতম্ব কুঞ্জরকুম্ভ(হস্তিনীর মত) বিপুল। যুঁই, যুথি, মালতি, বকুলের মালায় সজ্জিতা।



তাকে দেখে অর্জুন গোবিন্দকে জিজ্ঞেস করেন –হে সখা, এই সুন্দরী কন্যা কে! এই অবিবাহিতা কন্যা আমার মন অধিকার করেছেন।

শুনে শ্রীমধুসূদন বলেন –ইনি বসুদেবের কন্যা, আমার ভগিনী। সারণের সহোদরা, এঁর নাম সুভদ্রা। যোগ্য বর না মেলায় এঁর এখনও বিবাহ হয়নি।
শুনে অর্জুন অত্যন্ত লজ্জিত হলেন।
অর্জুনের সতৃষ্ণ চাহনিতে সুভদ্রার মনও অতি চঞ্চল হল, তিনি হঠাৎ মুর্চ্ছিত হলেন। সত্যভামা ও অন্যান্য নারীরা তাকে সুস্থ করে এর কারণ জিজ্ঞেস করতে থাকে।

সুভদ্রা বলেন –দেবী, আমায় ধরুন। পায়ে আমার কাঁটা ফুটেছে। শুনে সত্যভামা তার পা তুলে দেখলেন কাঁটা ফোটেনি।

সত্যভামা জিজ্ঞেস করেন –কেন মিথ্যা বলছ বোন, কাঁটা তো তোমার পায়ে ফোটেনি!

নিভৃতে সুভদ্রা বলেন –কি বলব সখি! যে কাঁটা ফুটল তা কারো পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। অর্জুনের নয়নের চাহনি তীক্ষ্ণশরের মত আজ আমার অঙ্গে ফুটে আমারে জরজর করে তুলেছে। আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখ কম্প দিয়ে জ্বর আসছে। প্রাণ ছটফট করে বেরিয়ে যেতে চাইছে। আমায় ছাড় সত্যভামা, আমি আর পারছি না।
বলে সুভদ্রা অর্জুনকে আবার দেখতে লাগলেন।

সত্যভামা বলেন –ভদ্রা, লজ্জার মাথা খেলে নাকি! নিষ্কলঙ্ক কুলে দেখছি কলঙ্ক দিবে! পিতা বসুদেব, ভাই রাম-নারায়ণ, তিনলোকে সবাই তাদের পূজা করে। এদের লজ্জা দিতে চাও! এক পুরুষকে দেখে প্রাণ ধরে রাখতে পারছ না! রাজকুলে কি আর অনূঢা কন্যা নেই! দেখতো কে পরপুরুষে মন ভুলেছে! তোমার চেয়ে নির্লজ্জ সংসারে আর কেউ নেই। ধৈর্য ধরে ঘরে চল। অন্য কেউ যেন এসব কিছু না শোনে।

সত্যভামার নিষ্ঠুর কথা শুনে সুভদ্রার চক্ষে জল বহে।
তিনি বলে ওঠেন –ধিক্‌ ধিক্‌! নারী হয়ে জন্মে ব্যর্থ হল জীবন। পরের বশে এ তনু বিরহ অনলে দগ্ধ হচ্ছে।

সত্যভামা বলেন –নারীজাতির নিন্দা কেন কর। দেখ নারীরূপেই পৃথিবী সংসার ধারণ করছেন। স্ত্রীজাতির মাধ্যমেই সৃষ্টির সৃজন হল। তিনিই শক্তিরূপে সবার জীবন রক্ষা করেন। সকল মঙ্গলকর্মে স্ত্রী আগে থাকেন। লক্ষ্মী আগে বসেন, পিছনে নারায়ণ। শঙ্করের আগে ভবানীর নাম উচ্চারিত হয়। রাম-সীতা কেউ বলে না, সকলে সীতা-রাম উচ্চারণ করে। গৃহিণী থাকলে তবেই লোকে তাকে গৃহী বলে। সংসারে নারী বিনা কেউ রয় না। স্ত্রীর থেকেই সবার উৎপত্তি। স্ত্রী বিনা কার শক্তি আছে বংশ বিস্তার করে।

সুভদ্রা বলেন –সত্য কথাই সব বললে। কিন্তু পুরুষ বিনাও তো জীবন বিফল।

সত্যভামা বলেন –তুমি উতলা হয়ো না। স্থির হও আমি কথা দিচ্ছি তোমার বিবাহ দেব। সে পুরুষ উত্তম বংশজ, বলিষ্ঠ, পণ্ডিত, পরম সুন্দর হবে-তোমার মনের মত।

সুভদ্রা বলেন –তোমার কথা আমি শুনছি না। তোমার সামনে এখনই আমি প্রাণ ত্যাগ করব। কৌরববংশীয় যে বলবান পান্ডব সেই ধনঞ্জয়কে ছাড়া আমি বাঁচব না। আজি যদি ধনঞ্জয়কে আমায় না দেবে তো আমার বধের পাপ তোমারই লাগবে।

সত্যভামা বলেন –দেবী, আমি এক্ষুনি চললাম। আজ রজনীতেই পার্থের সঙ্গে তোমার মিলন ঘটাব।

সত্যভামার মুখে তার মনের কথা শুনে সুভদ্রা হরষিত চিত্তে তার সাথে চললেন।
...................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers