Blog Archive

Wednesday, May 14, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৫৬

ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে রাজপুত্রগণের অস্ত্রশিক্ষার পরীক্ষাঃ 
 

সকল শিষ্য যখন স্ব স্ব বিদ্যায় প্রখর হয়ে উঠলেন তখন দ্রোণ অন্ধ নৃপতি ধৃতরাষ্ট্রের সভায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। ভীষ্ম, কৃপাচার্য এবং অন্যান্য সকল ক্ষত্রিয়দের সামনে ভরদ্বাজ পুত্র নিবেদন করলেন সকল কুমার বিদ্যায় প্রখর হয়ে উঠেছেন। তাদের বিদ্যার পরীক্ষা নেওয়া হোক। শুনে ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত খুশি হলেন এবং বিদুরকে ডেকে আজ্ঞা দিলেন পরীক্ষা স্থল নির্মাণের। রাজ আজ্ঞা পেয়ে দ্রোণের নির্দেশে বিদুর রঙ্গভূমির সজ্জা শুরু করলেন। 

একটি প্রশস্থ স্থান তার চারদিক সমতল, রঙ্গভূমি তার ভিতর রচনা করা হল। চারদিকে উঁচু গৃহ নির্মিত হল, সেগুলি নানা রত্নে সাজান হল। রাজাদের বসার জন্য বিচিত্র পালঙ্ক শয্যা রাখা হল। রাজনারীদের জন্য আলাদা স্থান নির্মাণ করা হল। জলের জন্য সুকোমল মঞ্চ নির্মাণ হল। এভাবে রঙ্গভূমি তৈরী করে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন। 

শুভদিনে সকলে চললেন। কৃপাচার্য, ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম সকলে এলেন। বাহ্লীক পুত্র সোমদত্তকে নিয়ে চললেন। আরো অনেক রাজপুরুষরা এলেন। 

সুবলরাজার কন্যা গান্ধারী, কুন্তী এবং আর অন্তঃপুরনারীরাও এলেন। রথে, গজে, অশ্বপৃষ্ঠে, মঞ্চের উপর সকলে বসলেন রাজপুত্রদের শিক্ষার নিদর্শন করতে। 
 
আচার্য দ্রোণ

নানা বাদ্য বাজতে লাগল। যেন প্রলয়কালে সিন্ধু কল্লোলিত হয়ে উঠল, কানে তালা লাগার মত অবস্থা হল। এই সময় আচার্য দ্রোণ মঞ্চে উপস্থিত হলেন। মনে হল যেন তারাদের মাঝে চন্দ্রের উদয় হল। সাদা বস্ত্র পরিধান করে, শুক্ল কেশে, শুক্ল পুষ্পের মালা গলায় দিয়ে তিনি উপস্থিত হলেন। 

পুত্রদের নিয়ে গুরু সভা মাঝে উপস্থিত হলেন। শুক্লবাস পরিহিত দ্রোণ সর্বাঙ্গে শুক্ল মলয়জ অর্থাৎ শ্বেত চন্দন লেপন করেছেন। 


যুধিষ্ঠির

দ্রোণ সকলের প্রথমে যুধিষ্ঠিরকে মঞ্চে আসতে আজ্ঞা করলেন। সভায় প্রবেশ করলেন যুধিষ্ঠির। বিকশিত পদ্মের মত নির্মল শরীর। ধনুকে টঙ্কার দিয়ে শর স্থাপন করলেন। ধনুর গুণের মহাশব্দে লোকে ভয় পেল। যুধিষ্ঠির এক অস্ত্রে বহু অস্ত্র সৃজন করলেন। বায়ু সংক্রান্ত, অগ্নি সদৃশ্য বহু অস্ত্রের চমৎকারিত্ব দেখে সকলে ধন্য ধন্য করে প্রশংসা করলেন। সকলে মানলেন তার মত বীর কেউ নেই। দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে আসন গ্রহণ করতে বললেন। 


ভীম ও দুর্যোধন 

এরপর দ্রোণ ভীম ও দুর্যোধনকে মঞ্চে আসতে নির্দেশ দিলেন। গদা হাতে দুই বীর উপস্থিত হলেন। মল্লবীরদের মত বেশ পরিধান করে, শরীরে মাটি লেপলেন দু’জনে। মাথায় মুকুট ধারণ করলেন দুই বীর। দেখে মনে হল যেন দুটি পর্বতের চূড়া। গদা হাতে ভীম ও দুর্যোধন দু’জনে দু’জনকে প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন। তাদের হুঙ্কারের শব্দে সকলের কানে তালা লেগে গেল। মনে হল দুই মত্ত হস্তি পরস্পরকে শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে। চরণে চরণে, মুন্ডে মুন্ডে দু’জনে আঘাত করতে লাগলেন। তাদের ভয়ঙ্কররূপ দেখে সকলে আতঙ্কিত হলেন। ধিরে ধিরে সভা দু’ভাগে ভাগ হতে থাকে। কেউ বলে বীর বৃকোদর মহাবলীয়ান। কেউবা বলেন ভীমের থেকেও বীর কুরুবীর। দু’দলের এই কথা কাটাকাটিতে দর্শকাসনেও গন্ডোগোল শুরু হল। ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তী তিনজনে বিদুরের সাথে কথা বললেন। তাদের অন্তরের আবেদন বুঝে দ্রোণ ভীম ও দুর্যোধনকে আসন গ্রহণ করতে নির্দেশ দিলেন। 

 
অর্জুন 

ভীম ও দুর্যোধন নিবৃত্ত হলে দ্রোণ মঞ্চে অর্জুনকে আসতে আজ্ঞা দিলেন। ধনঞ্জয় ধনুঃশর হাতে উপস্থিত হলেন। নতুন মেঘের মত প্রায় তার অঙ্গের বর্ণ। পূর্ণচন্দ্রের মত তার মুখ, পদ্মের মত তার দুই চক্ষু। তাকে দেখে সভাজন সকলে মোহিত হলেন। কেউ জয়ধ্বনি করলেন কুন্তীর পুত্র এলেন বলে। কেউবা পান্ডুপুত্র মধ্যম পান্ডব বলেন। কেউবা বলেন এই পুত্রই কুরুশ্রেষ্ঠ এবং শত্রুদের কাছে যম স্বরূপ। সকলে এক বাক্যে মেনে নেন এই কুমারই বীর ধর্মশীল এবং সাধু ব্যক্তি হবেন। এর সমান বীর্য্যবান ভূমন্ডলে আর কেউ নেই। এমন কথাবার্তা চলতে চলতে হঠাৎ সকলে ধন্য ধন্য রব করে উঠলো।


কুন্তীদেবী

শব্দ শুনে ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে জিজ্ঞেস করলেন কি কারণে এই জয়ধ্বনি। বিদুর বলেন, রাজা অর্জুন উপস্থিত হওয়াতে সভাসদ সকলে তার গুণ প্রশংসা করছেন। ধৃতরাষ্ট্রও নিজেকে ধন্য মনে করলেন কুরুবংশে এরূপ পুত্র আগমনের বার্তা শুনে। তিনি কুন্তীকেও ধন্যবাদ জানালেন এরূপ সুলক্ষণযুক্ত পুত্রের জননী হওয়ার জন্য। কুন্তীদেবী শুনে আনন্দিত হলেন। তার চক্ষু সজল হল, স্নেহানন্দে স্তন থেকে দুগ্ধ ক্ষরিত হল। 


এভাবে পার্থ মহাবীর সভা মাঝে উপস্থিত হলেন। ধনুকে টঙ্কার দিয়ে তার বীরত্বের সূচনা করলেন। 

অনল অস্ত্র মারতেই অগ্নি বর্ষণ হল। সেই অগ্নি উপরে উঠে স্পর্ষ করল আকাশ। দেখে সকলে বিস্মিত হলেন। সকলে দেখলেন চতুরদিক অগ্নিময় হয়ে উঠেছে। 


এরপর অর্জুন বরুণ বাণ মারলেন। অগ্নিবর্ষণ বন্ধ হয়ে জলধারা শুরু হল। 
আবার বায়ু অস্ত্রে সেই জলবর্ষণ বন্ধ করলেন। 
আকাশ অস্ত্রে আবার সেই বায়ুতে আবরণ দিলেন। 
পর্বত অস্ত্রে তিনি গিরিবর সৃজন করলেন। 
বজ্রশরে সেই গিরি চূর্ণ করলেন। 
ভূমি অস্ত্রে ভূমন্ডল সৃজন করলেন। 
সিন্ধু অস্ত্রে সব কিছু জলে পূর্ণ করলেন। 
অন্তর্দ্ধান অস্ত্র মেরে নিজে লুকিয়ে গেলেন। কোথায় আছেন পার্থ তা কেউ খুঁজে পেল না। কখনও বা তাকে রথে, কখনওবা ভূমিতে দেখা গেল। বেদের বাজির মত তিনি চতুর্দিকে ঘুরতে লাগলেন। 

এভাবে অর্জুন তার নানা বিদ্যা প্রদর্শন করলেন। সকলে তাকে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। সকল বিদ্যা দেখিয়ে অর্জুন বাহ্বাস্ফোটে(তাল ঠোকার শব্দ) বজ্রের ধ্বনি নির্গত করলেন। সে শব্দে সকলের কর্ণে তালা লেগে গেল। শেষে গুরু দ্রোণের কাছে গিয়ে কৃতাজ্ঞলি করলেন।
....................................

Thursday, May 1, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৫৫

 
দ্রোণের নিকট অর্জুনের প্রতিজ্ঞা এবং পান্ডব ও ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের অস্ত্রশিক্ষাঃ 

দ্রোণ সকল রাজপুত্রদের ডেকে একান্তে বসলেন। তিনি বলেন -সবাইকে আমি অস্ত্রশিক্ষা দেব এবং শিক্ষার পর আমার বাক্য সকলকে পালন করতে হবে। 
দ্রোণ আরো বলেন, তার যা মনোবাঞ্ছা তা শিষ্যদের পূরণ করতে হবে। তিনি শিষ্যদের সত্যবচন করতে বলেন। 

কিন্তু তার বাক্য শুনে সকল শিষ্য মৌন রইল। তখন অর্জুন এগিয়ে এসে বললেন, সে সত্যবচন করছেন দ্রোণের সকল আজ্ঞা তিনি পালন করবেন। 
অর্জুনের বচনে দ্রোণ আনন্দিত হলেন। অর্জুনকে আলিঙ্গন করে তার মস্তক চুম্বন করলেন। 
একান্তে দ্রোণ অর্জুনকে অঙ্গিকার করেন -তার মত শিষ্য আর কাউকে করবেন না। 

এভাবে দ্রোণ সকল শিষ্যদের নানা অস্ত্রশিক্ষা দান শুরু করেন। তার শিক্ষাদানের সংবাদ ধিরে ধিরে রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে পরে। সকল রাজপুত্ররা তার কাছে শিক্ষা লাভের আশায় আসতে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৃষ্ণি বংশ, যদু বংশ, অনু, ভোজ আরো রাজারা তাদের পুত্রদের পাঠালেন। কর্ণ মহাবীর অধিরথের পুত্র কিন্তু সে দুর্যোধনের অনুগত হওয়ায় দ্রোণের কাছে শিক্ষার সুযোগ পেল। এভাবে দ্রোণের প্রচুর শিষ্য হল এবং তারা সর্বদা শিক্ষা লাভে ব্যস্ত রইল। 

দ্রোণ শিষ্যদের নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতেন যে নিজের পুত্রকে শিক্ষাদানের সুযোগ পেলেন না। তাই কপটতা করে তিনি সকল শিষ্যদের কমন্ডলু ভরে গঙ্গাজল আনতে পাঠাতেন এবং সেই অবসরে পুত্রকে শিক্ষাদান করতেন। এসকল বৃত্তান্ত কেবল অর্জুন জানলো। তিনি বরুণ নামে এক অস্ত্র ধনুকে দিয়ে সকল কমন্ডলু জলে ডুবিয়ে রাখলেন। সকল শিষ্য জল আনতে গেল সেই সময় ব্যবধানে অশ্বত্থামা ও অর্জুন অধ্যয়ন করত। অর্জুনের এতটুকু অবসর নেই, সকল সময় তার হাতে ধনুঃশর। সকল সময় গুরুর আজ্ঞা পালন করেন। বিনয় বচনে তার স্তুতি করেন। পার্থের এই সৌজন্যে দ্রোণ প্রীত হয়ে তাকে অপ্রমিত বিদ্যা দান করলেন। 

একদিন দ্রোণের কাছে এক নিষাদ বালক শিক্ষার জন্য উপস্থিত হল। দ্রোণকে প্রণাম করে জানাল সে হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য। যোড়হাত করে বিনয় বচনে সে দ্রোণের শিষ্যত্ব প্রার্থণা করল। কিন্তু দ্রোণ নীচজাতির পুত্র বলে শিক্ষাদান করতে চাইলেন না। অনেক অনুনয়-বিনয়েও দ্রোণ রাজি হলেন না। 
দ্রোণের মুখে নিষ্ঠুর বাক্য শুনে দন্ডবৎ করে একলব্য অরণ্যে প্রবেশ করলেন। নিষাদের বেশ ত্যাগ করে ব্রহ্মচারী হয়ে, জটাবল্ক পরিধান করে ফলমূলাহার শুরু করলেন। মৃত্তিকার এক দ্রোণ মূর্তি রচনা করে তা নানা পুষ্প দিয়ে পূজা করতেন। নিরন্তর তীরধনুক হাতে একলব্য ধিরে ধিরে নিজেই সর্বমন্ত্র, অস্ত্রজ্ঞান লাভ করলেন।

কিছুকাল পর কৌরবরা সে অরণ্যে মৃগয়া করতে গেল। কেউ রথে, কেউবা গজে, কেউবা ঘোড়ায় চেপে এলো, সঙ্গে তাদের অনুচরেরাও চললো। সকলে মহাবনে মৃগয়া করতে প্রবেশ করল। এসময় পান্ডবের এক অনুচর, যার সাথে তার পোষা কুকুরটি যাচ্ছিল। যেখানে একলব্য মৃত্তিকার দ্রোণকে যোড়হাতে পূজা করছিলেন সে স্থানে কুকুরটি উপস্থিত হয়ে একলব্যকে দেখে ডাকতে শুরু করল। কুকুরটি ব্রহ্মচারীর চারপাশে ঘুরতে লাগলো। এভাবে একলব্যের ধ্যান ভঙ্গ হল। ক্রোধে তিনি কুকুরের মুখে সপ্তবান মারলেন। অদ্ভূত ব্যাপার ঘটল। কুকুরটি মরল না, কোন আঘাতও লাগল না, কিন্তু কুকুরটি আর ডাকতে পারল না। কুকুরটি নিঃশব্দে সপ্তবান মুখে অনুচরের পিছে পিছে চলল। অনেক্ষণ পর সকলে কুকুরটিকে লক্ষ্য করল। 

এই অদ্ভূত ঘটনায় সকলে আশ্চর্য হল এবং কে এমন অসাধ্য সাধন করল তা অনুচরটিকে জিজ্ঞেস করল। কারো এবিদ্যা আয়ত্তে নেই দেখে তারা লজ্জিত হল এবং যে করেছে তার খোঁজে বের হল। অনুচরটি সেই ব্রহ্মচারী একলব্যের কাছে তাদের নিয়ে উপস্থিত হল। সকলে দেখল ধনুঃশর হাতে একলব্য বসে আছে। সকলে তার পরিচয় এবং তার শিক্ষা গুরুর নাম জানতে চাইল। 

একলব্য নিজের পরিচয় দিলেন ও জানালেন তার গুরু দ্রোনাচার্য। শুনে সকলে অবাক হল এবং অর্জুন অত্যন্ত চিন্তান্বিত হলেন। সকলে মৃগয়া ছেড়ে দ্রোণের কাছে উপস্থিত হল। সকল ঘটনা তাকে জানান হল। 

অর্জুন বিরস বদনে দ্রোণকে বলেন, তার সঙ্গে গুরুদেব কেন ছলনা করলেন। পূর্বেই তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন সকল বিদ্যা তাকেই শেখাবেন। অথচ তাকে ছলনা করে পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য বিদ্যা তিনি শেষে এক নিষাদকুমারকে শেখালেন। 

অর্জুনের বাক্যে দ্রোণ অবাক হলেন এবং কিছুক্ষণ চিন্তা করে অর্জুনকে সেই বালকের কাছে নিয়ে যেতে বললেন। একলব্যের উদ্দেশ্যে দ্রোণ ও অর্জুন বের হলেন। 

দ্রোণকে দেখে একলব্য দুর থেকেই মাটিতে লুটিয়ে প্রণাম জানালেন। কৃতাঞ্জলি হয়ে গুরুর সামনে এসে নিষাদপুত্র একলব্য মধুর কন্ঠে জিজ্ঞাস করেন -গুরু কোন প্রয়োজনে তার কাছে এসেছেন। 

দ্রোণ বলেন যদি একলব্য সত্যই তার শিষ্য হন তা হলে আজ তাকে গুরুদক্ষিণা দিতে হবে। 

একলব্য বলেন তিনি আজ ধন্য হলেন, গুরু তার কাছে এলেন। আজ গুরু যা চাইবেন তাই তিনি তাকে দান করবেন। কেবল গুরু আজ্ঞা করুন তিনি কি চান। 

দ্রোণ বলেন –সত্যি যদি তুমি আমায় খুশি দেখতে চাও তা হলে তোমার দক্ষিণ হাতের বৃদ্ধ বা বুড়ো অঙ্গুলিটি গুরুদক্ষিণা দাও।


বলার সঙ্গে সঙ্গে একলব্য গোটা অঙ্গুলিটি গুরুকে কেটে দান করলেন।
দ্রোণ ও ধনঞ্জয় তুষ্ট হল। অর্জুন জানল গুরু তার প্রতিই কেবল সদয়।
একলব্যের এরূপ কঠোর কর্ম দেখে দুজনেই তার প্রচুর প্রশংসা করে দেশে ফিরে গেলেন।

একদিন দ্রোণ শিষ্যদের বিদ্যা পরীক্ষা করতে চাইলেন। কাঠের একটি পাখি নির্মাণ করে তা বৃক্ষের উপর রেখে দিলেন। একে একে সকল শিষ্যকে ডাকলেন। 

সবার প্রথমে যুধিষ্ঠির উপস্থিত হলেন। তার হাতে দ্রোণ তীর-ধনুক দিলেন। বৃক্ষের উপর পাখি দেখিয়ে তাকে লক্ষ্য করে ধনুক তাক করতে বললেন এবং নির্দেশ দিলেন যখন দ্রোণ বলবেন তখনই পাখিটির শির কাটতে হবে। যুধিষ্ঠির ধনুঃশর জুড়লেন এবং ভাস(মোরগ বা শকুন) পক্ষীর দিকে দৃষ্টি স্থির করলেন। 

দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করলেন – কি কি এখন তুমি দেখতে পাচ্ছ।

ধর্মপুত্র বলেন – বৃক্ষের উপর পক্ষি দেখছি আর ভূমির উপর দ্রোণগুরু ও সহোদরদের দেখতে পাচ্ছি।
তার উত্তর শুনে দ্রোণ তাকে ভৎসনা করে ধনুক কেড়ে নিলেন।

দুর্যোধনরা শতভাই, এমনকি বৃকোদর ভীম -সকলে একে একে এলেন, তীরধনুক তুললেন এবং সকলেই ধর্মপুত্রের মত একই কথা বললেন। দ্রোণ সকলের উপর অত্যন্ত রুষ্ঠ হলেন। 


শেষে ধনুঃশর অর্জুনের হাতে দিয়ে বৃক্ষে পক্ষী দেখিয়ে বললেন তার আদেশের সাথে সাথে নিঃশব্দে পাখির শির কাটতে। গুরুবাক্য শুনে অর্জুন পাখির প্রতি দৃষ্টি স্থির করলেন তীর ধনুক নিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ পর দ্রোণ জিজ্ঞেস করেন অর্জুন কি কি দেখতে পাচ্ছেন। 

অর্জুন বলেন তিনি কেবল বৃক্ষের উপর এক পক্ষী দেখতে পাচ্ছেন আর কিছু না।

হৃষ্ট হয়ে দ্রোণ পুনরায় প্রশ্ন করেন ভাস-পক্ষীর কোন কোন অঙ্গ দেখতে পাচ্ছেন।

অর্জুন বলেন – ভাস আর দেখতে পাচ্ছেন না, কেবল মুন্ড আর তার দুই চক্ষু।
দ্রোণ বলেন -অস্ত্রে পক্ষির শির কাট।
বাক্য নির্গত হওয়ার সাথে সাথে পার্থ পক্ষীর শির কাটেন।
দ্রোণ তা দেখে আনন্দিত হয়ে পার্থকে আলিঙ্গন করে পুনঃ পুনঃ তাকে চুম্বন করেন। অরজুনের এত প্রশংসা করতে দেখে অন্য সকল শিষ্য অবাক হয়। 

আবার একদিন দ্রোণ শিষ্যদের নিয়ে গঙ্গাস্নানে গেলেন। শিষ্যরা তটে বসেছিল, তিনি জলে নামতেই এক বিরাট, বিকট কুমীর তাকে ধরল। নিজ শক্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি শিষ্যদের ডাকতে লাগলেন। চিৎকার করে তাকে উদ্ধার করতে বললেন। সকল শিষ্য তাদের অস্ত্র আনতে গেল। 

সবার অলক্ষ্যে ফাল্গুনী/অর্জুন পঞ্চবাণ মারলেন। কুমীরের শরীর খন্ড খন্ড হয়ে গেল। কুমীরের মৃতদেহ জলে ভেসে উঠল। দ্রোণ জল থেকে উঠে এসে অর্জুনকে আলিঙ্গন করে চুম্বন দিয়ে তুষলেন বারবার। 

অর্জুনের উপর সন্তুষ্ট হয়ে দ্রোণ তাকে ব্রহ্মশির নামে এক অস্ত্র উপহার দিলেন। 
অস্ত্র দিয়ে গুরু বলেন -এ অস্ত্র কেবল দেবতা ও রাক্ষসের উপর ব্যবহার করবে। কখনও মানুষের উপর প্রয়োগ করবে না। 

দ্রোণগুরু অর্জুনকে এত সন্মান দিচ্ছেন দেখে দুর্যোধন রেগে গেল। 

এভাবে দ্রোণ শিষ্যদের নানা বিদ্যা শিক্ষা দিলেন অতি যত্নে। যুধিষ্ঠির রথ আরোহণে দৃঢ় হলেন। গদায় কুশল হলেন ভীম ও দুর্যোধন। নকুল অশ্বে এবং সহদেব কুস্তিতে। এভাবে সবাই বিদ্যাবন্ত হলেন। 
ইন্দ্রের নন্দন অর্জুন তারই মত বীর। সকল বিদ্যায় পারদর্শি। রথ, গজ, অশ্ব, ভূমি সর্বত্র তিনি সাবলিল। ধনু, খড়্গ, গদা সবেতেই শ্রেষ্ঠ।
....................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers