Blog Archive

Thursday, May 10, 2012

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪০

ধৃতরাষ্ট্রাদির উৎপত্তিঃ 

দেবব্রত ভীষ্ম সত্যবতীকে আরো বলেন -– জননী, আপনার বিচারে যে জন শ্রেষ্ঠ তাকে ডেকে আনুন। মন্ত্রী, পুরোহিতদের নিয়ে বিচার করুন। কারণ ভারতবংশের ভাগ্য এতে জড়িত। 


সত্যবতী বলেন –পুত্র ভীষ্ম ধর্মাচারী, তোমার বাক্য বেদ তুল্য। 
তিনি ধিরে ধিরে তার পিতৃগৃহের পূর্ব কাহিনী সকল বলেন। 
কিভাবে মহাতেজা পরাশরমুনির সাহায্যে তিনি দুর্গন্ধা থেকে সুগন্ধি হলেন। যমুনায় মুনি তপোবলে কুজ্ঝটীকা সৃষ্টি করে দ্বীপ নির্মাণ করেন এবং সেখানে ভয়ে তিনি তার বশীভূতা হন। তাদের এক পুত্রের জন্ম হয়। দ্বীপে জন্ম তাই তার নাম দ্বৈপায়ন। তিনিই বেদের চার ভাগ করেন। কৃষ্ণ অঙ্গের জন্য তাকে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস বলা হয়। 
জন্মমাত্র পুত্র তপোবনে যান এবং জননীকে বলে যান তাকে আহ্বান করলেই তিনি উপস্থিত হবেন। কন্যাকালে সত্যবতী ব্যাসকে পেয়েছিলেন। এখন ভীষ্ম যদি সম্মত হন তা হলে তিনি পুত্র ব্যাসকেই আহ্বান করবেন।

ভীষ্ম নিশ্চিন্ত হয়ে মাকে বলেন –আমরা দুজনে তাকে অনুরোধ করবো। কারণ কূলরক্ষার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কর্ম আর নেই। 

ভীষ্মের সম্মতিতে সত্যবতী ব্যাসকে স্মরণ করলেন। তিনি তখন নানা শাস্ত্রধর্ম দেবস্থানে কথন করছিলেন। 
মায়ের ডাকে তিনি উৎকন্ঠীত হলেন। সেই মুহূর্তে মাতার সম্মুখে উপস্থিত হলেন। 

ভীষ্ম নানা উপাচারে তাঁর পূজা করলেন। 

সত্যবতী পুত্রকে আলিঙ্গন করে রোদন করতে লাগলেন। তার স্তনদুগ্ধ ক্ষরিত হল। 

মায়ের রোদন দেখে ব্যাস বিস্মিত হলেন। কমন্ডুল থেকে জল মুখে দিলেন এবং মায়ের ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা কর লেন। 
মাকে তিনি আজ্ঞা করতে বললেন এবং কথা দিলেন তিনি সাধ্যমত তা পালনের চেষ্টা করবেন। 

সত্যবতী তখন তার দুঃখের কাহিনী বললেন। শিশুপুত্রদের রেখে স্বামী স্বর্গে গেলেন। গন্ধর্ব তার জৈষ্ঠপুত্রকে হত্যা করল। ছোটটিকে ভীষ্ম পালন করছিলেন। কাশীরাজের দু’কন্যার সাথে তার বিবাহও দেওয়া হল। কিন্তু বংশবিস্তার না করেই সে নবীন বয়সে মারা গেল। এখন কুরুকূল অস্তমিত হতে চলেছে। 

একমাত্র তার প্রথম সন্তান ব্যাসই তা রক্ষা করতে পারেন। 
পিতামাতার থেকেই সন্তানের উৎপত্তি। ব্যাসও যেমন তার পুত্র ভীষ্মও তার সন্তান। এখন দুইপুত্র মিলে কূলরক্ষার উপায় ঠিক করুন। কারণ তার কারণেই ভীষ্ম সত্য অঙ্গিকারে বদ্ধ। তাই কেবল ব্যাসের উপরেই সব নির্ভর করছে। 
ব্যাস সকল কথা শুনে বলেন মায়ের আজ্ঞার পালন তিনি করবেন। 

সত্যবতী বলেন তার ভ্রাতৃজায়ারা রূপে চপলা, তাদেরই ব্যাস আপন ঔরস দান করুন। 

ব্যাস বলেন ধর্মে এর প্রতিকার আছে। মায়ের বাক্য তিনি পালন করবেন এতে কূলও রক্ষা পাবে। 

তিনি অনুরোধ করেন পুত্রবধূরা যেন একবছর ধরে ব্রত পালন করেন এবং দান, যজ্ঞ, হোম করে পবিত্র হন। তবেই তিনি তাদের স্পর্ষ করতে পারবেন। এবং সন্তানও হবে পরাক্রমবীর। 

কিন্তু সত্যবতী বলেন পুত্র বিলম্ব সম্ভব নয়। নষ্ট, দুষ্ট, চোরের উপদ্রপে অরাজকতা শুরু হয়েছে। 

মায়ের কথায় ব্যাস চিন্তিত হয়ে বলেন তার ভয়ঙ্কর মূর্তি কন্যারা সহ্য করতে পারবে! যদি তাকে বধূরা গ্রহণ করতে পারেন তবে সুপুত্র উৎপন্ন হবে। 

সব শুনে সত্যবতী অম্বিকার কাছে গেলেন এবং মধুর বচনে তাকে বোঝালেন কূল রক্ষার্থে সে ভাসুরকে গ্রহণ করুক। সত্যবতী স্নেহ করে নানাবিধ কুসুমে শয্যা নির্মান করে দিলেন। 


অর্ধরাত্রে ব্যাস গৃহে প্রবেশ করলেন। কৃষ্ণবর্ণ, অঙ্গ সুপিঙ্গল, মাথায় জটাভার, ভয়ঙ্কর মূর্তি, যেন ভৈরব! 
তাকে দেখে রাণী ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলেন। দেখে ব্যাস বিস্মিত হলেন। 
পরদিন প্রভাতে সত্যবতী পুত্রের কাছে এলেন। ব্যাস স্নান করে উপস্থিত হলেন। 

সত্যবতীকে ব্যাস জানালেন তিনি মায়ের আদেশ পালন করেছেন। মহাবলবন্ত পুত্র জন্মগ্রহণ করবে। কিন্তু কেবল জননীর দোষে সে অন্ধ হবে। পুত্র শতপুত্রের জনক হবে এই আশির্বাদও দিলেন।

কিন্তু সত্যবতী দুঃখীত হলেন কারণ কুরুকূলে অন্ধ রাজা সুশোভন নয়। আর এক পুত্রের জন্ম দিতে অনুরোধ করলেন।
ব্যাস কথা দিয়ে গেলেন।
দশমাস পর ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম হল এবং মুনির কথা মত সে জন্মান্ধ হল। 

পরে যখন অম্বালিকা ঋতুস্নান করলেন তখন সত্যবতী পুনরায় ব্যাসকে আহ্বান জানালেন। 
পূর্ব ভয়ে অম্বালিকা চোখ বন্ধ করলেন না কিন্তু শরীর পান্ডুবর্ণ হল। 
পরে ব্যাস সত্যবতীকে জানালেন তাকে দেখে বধূ পান্ডুবর্ণ হলেন তাই পুত্র হবে পান্ডুবর্ণ। 

এত বলে ব্যাস চলে যাচ্ছেন তখন সত্যবতী আবার পুত্রকে অনুরোধ করলেন আরেক গন্ধর্ব সমান পুত্রের জন্য। 
ব্যাস পুনরায় সম্মত হয়ে নিজস্থানে ফিরে গেলেন। 
বছর ঘুরতেই অপূর্ব গঠনরূপের পুত্র জন্মাল কিন্তু তার শরীর পান্ডুর।


পুনরায় মায়ের স্মরণে ব্যাস উপস্থিত হলেন। এবার ভয়ে অম্বালিকা আর ব্যাসের কাছে গেলেন না। এক পরমা সুন্দরী সেবিকাকে রাণি সাজিয়ে পাঠালেন। নবীন যৌবনা শূদ্র যুবতি শ্রদ্ধা ভক্তি ভরে মুনিকে প্রণাম করলেন। সন্তুষ্ট হয়ে মুনি বললেন তার গর্ভে ধর্মের মত পুত্র জন্মাবেন। নরের মধ্যে তিনি পরম পন্ডিত হবেন। বর দিয়ে ব্যাস ফিরে গেলেন আশ্রমে। 

মুনির বরে শূদ্রানীর গর্ভে ধর্ম নিজে এসে জন্মগ্রহণ করলেন।

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৩৯

ক্ষত্রিয় বংশের উৎপত্তিঃ
 

ভীষ্ম চিন্তিত সত্যবতীকে আরো বলেন ব্রাহ্মণের মাধ্যমে ক্ষত্রিয় বংশের উৎপত্তির আরো কাহিনী আছে।

বিখ্যাত ঋষি ছিলেন উতথ্য। তার কনিষ্ঠ হলেন দেবগুরু বৃহস্পতি। মমতা ছিলেন উতথ্যের স্ত্রী। 


 

যুবতী মমতাকে কামে পীড়িত বৃহস্পতি রমণে আহ্বান জানান। মমতা বলেন তার গর্ভে বৃহস্পতিরই ভ্রাতার সন্তান আছে, তার পক্ষে বীর বৃহস্পতির সন্তান ধারণ সম্ভব নয়। 



তবু বৃহস্পতি তাকে কামনা করলেন। মমতা তাকে বোঝালেন গর্ভের সন্তান পরম পন্ডিত। গর্ভেই সে ষড়ঙ্গ বেদ অধ্যয়ন করেছে। তার পক্ষে একই সঙ্গে দুই বীর সন্তান ধারণ সম্ভব নয়। 



কিন্তু কামে অন্ধ বৃহস্পতি নিষেধ না শুনে শৃঙ্গার করলেন। উতথ্য-নন্দন গর্ভে ছিলেন তিনি বৃহস্পতিকে ডেকে বললেন তিনি অনুচিত কর্ম করেছেন তাই তার বীর্য্য এস্থানে থাকবে না। কামে পীড়িত বৃহস্পতি গর্ভস্থ সন্তানের বাক্য অগ্রাহ্য করে রমণে উদ্যত হলেন। তখন উতথ্যকুমার যুগল চরণে রেতদ্বার রুদ্ধ করলেন। বৃহস্পতির বীর্য ভূমিতে পতিত হল, গর্ভের স্থান পেল না। এতে বৃহস্পতি ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দিলেন উতথ্য-নন্দন জন্মান্ধ হবেন। 


এই উতথ্য-নন্দন দীর্ঘতমা সৌরভি বংশে অধ্যয়ন করেন। গোধর্ম পাঠ করে গরুর আচার করেন যাকে পায় তাকে ধরে শৃঙ্গার করে। তার কর্ম দেখে ঋষিরা তাকে ত্যাগ করেন, কেউ তাকে সন্মান করে না, সকলে অবহেলা করে। স্ত্রী প্রদ্বেষীও পূর্বের মত তাকে সমাদর করে না। দীর্ঘতমা স্ত্রীকে অনাদরের কারণ জিজ্ঞাসা করলে স্ত্রী বলেন স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করা। জন্মান্ধ ব্রাহ্মণ তাকে সুখ দিতে পারেন নি। এখন তিনি ব্রাহ্মণের সন্তানদের আর পালন করতে পারছেন না। ব্রাহ্মণের উচিত নিজের সন্তানদের পালন করার মত ক্ষমতা অর্জন করা। তিনি যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবেন। 
 

দীর্ঘতমা স্ত্রীর এত কথা শুনে রেগে গিয়ে বললেন –বিপুল অর্থ দিচ্ছি তা গ্রহণ কর এবং পুরুষের মত বাক্য বলা বন্ধ কর। 
 

তিনি আরো শাপ দিলেন, অর্থ লিপ্সার জন্য তার ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম হবে। 
স্ত্রী বলেন –অর্থ অনর্থের মূল। তিনি অর্থ চান না এবং ব্রাহ্মণ ও তার পুত্রদের তিনি আর সেবা করতে পারবেন না। 

এতো শুনে দীর্ঘতমা বলেন -আজ থেকে নারীজাতি যতদিন জীবিত থাকবে তারা পতির অধিন হবে। পতিবাক্যের অবহেলা করবেনা, জন্মে ও মরণে পতিকে অনুসরণ করবে। পতি ভিন্ন অন্য পুরুষের কথা ভাবলে তার নরক গমন হবে। পতি ছাড়া নারীর গতি নেই। সংসারে পতিহীনা নারী সকল সুখ থেকে বঞ্চিত হবে। এসব নিয়ম যে লঙ্ঘন করবে তার অপযশে ভুবন পূর্ণ হবে। 
 

এতকথা শুনে দীর্ঘতমার স্ত্রী ক্রুদ্ধ হলেন এবং পুত্রদের বললেন এই পাতকীকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে। পুত্ররা মায়ের বাক্যে পিতাকে বেঁধে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিল। 

 
ভেলায় ভেসে ব্রাহ্মণ অনেক দূর ভেসে গেল। দৈবক্রমে মহাবীর বলিরাজ তাকে দেখতে পেলেন এবং উদ্ধার করলেন। ব্রাহ্মণের কাছে সকল কথা শুনে বলিরাজা তাকে গ্রহণ করলেন এবং তপোবলে বলির বংশবিস্তার করতে বললেন। দৈত্যরাজের একথায় ব্রাহ্মণ রাজি হলেন। 

রাজা বলি রাণী সুদেষ্ণাকে ডেকে বললেন –এই ব্রাহ্মণের সেবা কর, এর থেকেই বংশ বৃদ্ধি হবে। 
 

কিন্তু সুদেষ্ণা অন্ধ দীর্ঘতমাকে অবহেলা করলেন। তিনি শূদ্র দাসীকে সেবায় নিযুক্ত করলেন। দাসীর গর্ভে দীর্ঘতমার সন্তান হল। তারা চার বেদ ও ষড়শাস্ত্র অধ্যয়ন করল। এসময় রাজা বলি এসে দীর্ঘতমাকে জিজ্ঞেস করলেন এরা তার পুত্র কিনা। 

দীর্ঘতমা বলেন -এরা আমার সন্তান, দাসী গর্ভজাত। তোমার স্ত্রী আমায় অবহেলা করে কাছে আসে নি।

 

রাজা বলি অন্তপুরে গিয়ে রাণী সুদেষ্ণাকে তার সকল কথা বললেন। তখন সুদেষ্ণা দীর্ঘতমার সেবায় রত হলেন। এভাবে রাজা বলির বংশবৃদ্ধি হল। তাদের তিন পুত্র-অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ। এরা পরমবীর হলেন। পরে এরা যথাক্রমে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গের রাজা হলেন। এভাবে ব্রাহ্মণের সাহায্যে ক্ষত্রিয়ের উৎপত্তি হল। 

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers