Blog Archive

Thursday, August 26, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ২২


দেব-দানবাদির ভূতলে জন্মগ্রহণঃ

মুনি বলেন –শোন, যেমন হল এই সৃষ্টি সংঘটন।

ব্রহ্মার মানস পুত্র হলেন সাতজন। এই সাত থেকেই ত্রিভুবনের জন্ম।

১)মরীচি ব্রহ্মার পুত্র। মরীচি পুত্র কশ্যপ মহামুনি।

দক্ষ প্রজাপতি তার তেরোটি কন্যা খুশি হয়ে কশ্যপকে দান করেন। এই

দক্ষ কন্যারা হলেন- অদিতি, কপিলা, দনু, কদ্রু, মুনি, ক্রোধা, দনায়ু, সিংহিকা, কালা, দিতি, প্রধা, বিম্বা ও বিনতা।

এই তেরোজনের গর্ভে যারা জন্মালেন তারা হলেন-

অদিতির গর্ভেঃ দ্বাদশ আদিত্য - এরা হলেন- ধাতা, মিত্র, অংশ, ভগ, বরুণ, অর্য্যমা, ত্বষ্টা, বিষ্ণু, বিবস্বান্‌, পূষা, শত্রুনামা এবং সবিতা। এই সবিতা হলেন দশম পুত্র। যার কিরণেই দিবস প্রকাশ পায়।

দিতির গর্ভেঃ হিরণ্যকশিপু। ইনি দেবতাদের পরম শত্রু, প্রতাপে দুর্জয়। হিরণ্যকশিপুর পাঁচটি সন্তান।

প্রধান প্রহ্লাদ, ইনি ত্রৈলোক্য পাবন(ত্রিলোক পবিত্রকারী)। তাঁর তিন পুত্র মহাধনুর্দ্ধর বিরোচন, কুম্ভ আর নিকুম্ভ সুন্দর।
বিরোচনের পুত্র বলি। তার পুত্র বাণবীর মহাকাল। যিনি শিবের কিঙ্কর।

দনুর গর্ভেঃ মনে করা হয় চল্লিশজন দৈত্য। বিপ্রচিত্তি, সম্বর, পুলোনা, অশ্বপতি -এরকম বহু নামে এরা খ্যাত। এদের অসংখ্য পুত্র-পৌত্র। যারা স্বর্গ-মর্ত-পাতাল কাঁপিয়ে রাখে।

সিংহিকার গর্ভেঃ চারজন জন্মায়। এরা ক্রুরকর্মা নামে খ্যাত। এদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ রাহু। বিষ্ণুর চক্রে এর দুটি অঙ্গ।

দনায়ুরও চার পুত্র। এরা হলেন- বিক্ষর, বল, বীর ও বৃত্র।

কালার সন্তান হল – ক্রোধ, বিনাশক। এরাও দেবতাদের অবধ্য।

বিনতার ছয় পুত্র। অরুণ, আরুণি, তাক্ষ্যারিষ্ট নেমি, আর, গরুড়, বারুণি। সর্বশ্রেষ্ঠ গরুড় কৃষ্ণের বাহন। এই পক্ষিশ্রেষ্ঠ পন্নগ তথা সর্পনাশন।

কদ্রুর সন্তানরা হল সহস্র অনন্ত নাগ।

বিম্বার কন্যা হল। এরা অনুরম্ভা, আকারাদি প্রমুখ। এদের মধ্যে যারা প্রধান তারা বিশ্ব বিদিতা-অলম্বুষা, মিশ্রকেশী, রম্ভা, তিলোত্তমা, সুবাহু, সুরতা আদিলোক অনুপমা।

কপিলার পুত্র- হাহা, হূহূ। এরা গন্ধর্বের(স্বর্গের গায়ক) রাজা। এদের সবাই পূজা করে।
ব্রাহ্মণও কপিলার গর্ভে জন্মায়। এদের মহিমাগুণ সংসার বিখ্যাত।

ক্রোধার গর্ভে জন্মায়- চিত্ররথ, অপ্সর, কিন্নর এবং কাশ্যপ, কপিল।

মুনির গর্ভে ষোড়শ কুমারের জন্ম। মৌনেয় গন্ধর্ব নামে এরা ত্রিসংসার খ্যাত।

২)বশিষ্ঠ-ব্রহ্মা পুত্র। ইনি সূর্যবংশের কুলগুরু।

৩)অঙ্গিরা- ব্রহ্মা পুত্র। তার তিন পুত্র। বৃহস্পতি, উতথ্য ও সম্বর্ত্ত্য।

৪)পুলস্ত্যমুনির পুত্র –সর্বগুণাধার বিশ্বশ্রবা।
কুবেরাদি যক্ষ যত তার পুত্র-রাক্ষস রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ।

৫)পুলহ মহামুনি- ব্রহ্মা পুত্র।

৬)অত্রির পুত্র হল অনেক ব্রাহ্মণ।

৭)ক্রতুর পুত্র হল যজ্ঞের কারণে।

এই সাত মুনিই হলেন সপ্তর্ষি।

এছাড়া ব্রহ্মার মনু নামে আর এক সন্তান জগৎ বিখ্যাত।
মনুর সন্তানরাই হলেন মানব।
মনুর স্ত্রী শতরূপা।
তাদের সন্তান উত্তানপাদ। উত্তানপাদের দুই স্ত্রী।
প্রথমা হলেন ধর্মের কন্যা সুনীতি। এনার পুত্র ধ্রুব। ইনিই ধ্রুবতারা রূপে উত্তরাকাশে বিরাজ করেন।

উত্তানপাদের দ্বিতীয় স্ত্রী সুরুচি, এর পুত্র হলেন উত্তম।

ব্রহ্মার দক্ষিণাঙ্গুষ্ঠে দক্ষ প্রজাপতি এবং বামাঙ্গুষ্ঠে পঞ্চাশটি কন্যার জন্ম হল।

ব্রহ্মার দক্ষিণহস্তে ধর্মের জন্ম।
দক্ষের দশটি কন্যার সাথে ধর্মের বিবাহ হয়। কন্যারা হলেন-কীর্ত্তি, লক্ষ্মী, ধৃতি, মেধা, পুষ্টি, শ্রদ্ধা, ক্রিয়া, বুদ্ধি, লজ্জা ও মতি।

ধর্মের তিন পুত্র – শম, হর্ষ ও কাম। এরা সর্বঘটে স্থিত।

কামের স্ত্রী রতি। হর্ষের স্ত্রী নন্দা। শমের স্ত্রী প্রাপ্তি।

দক্ষ তার আরো সাতাশটি কন্যাকে চন্দ্রের সাথে বিবাহ দেন।

দক্ষ এককন্যা বসুর আট পুত্র অষ্টবসু নামে বিখ্যাত।
এরা হলেন- ভব, ধ্রুব, সোম, বিষ্ণু, অনিল, অনল, প্রত্যুষ, প্রভব।
বসুরা হল দেব হুতাশন(হোমাগ্নি)।

বিশ্বকর্মাও বসু পুত্র। মৃগ, সিংহ, ব্যাঘ্র প্রভৃতি এর সন্তান।


এবার মুনি পূর্বে কে কি ছিল তা বলতে শুরু করলেন।

দানব প্রধান বিপ্রচিত্তি - জরাসন্ধ নামে মগধের রাজা হলেন।

দিতির কুমার হিরণ্যকশিপু - শিশুপাল নামে জন্মালেন।

সংহ্লাদ - শল্য রূপে জন্মাল।

বাষ্কল – ভগদত্ত নামে এলেন।

কালনেমি – কংস রূপে মথুরায় এলো।

গরিষ্ঠ - উগ্রসেন নামে জন্মাল।

দীর্ঘজিহ্বা দৈত্য কাশীরাজ হল।

মণিমাণ হল বৃত্রাসুর মহাতেজা।

কালকেতু যক্ষ – যে মৎস্যদেশে ছিল, সে হরিদশ্ব হল, ভীষ্মক ও রুক্মী ঔরসে।

কীচক, কলিঙ্গ, বৃষসেন মহাবলে কালকেতুগণ এসে জন্মাল ভূতলে।

বৃহস্পতির অংশে হলেন দ্রোণ।

বশিষ্টের শাপে বসুরা গঙ্গার পুত্র রূপ নিলেন।
এদের মধ্যে প্রভব ভূতলে ভীষ্ম রূপে জন্মালেন।

রুদ্র তথা শিবের অংশে কৃপাচার্য অজয়, অমর।

বসু অংশে সাত্বিক(সাধু) দ্রুপদ রাজার জন্ম।

কৃতবর্মা বিরাট গন্ধর্ব অংশে জন্ম।

ধর্মের অংশে বিদুরের জন্ম।

সুবাহু গন্ধর্ব জন্মাল ধৃতরাষ্ট্র হয়ে।

কুন্তী, মাদ্রী ও গান্ধারীও সুবাহুর অংশে জন্ম।

ধর্ম অংশে জন্মালেন যুধিষ্ঠির রাজা।

বায়ু অংশে জন্ম নিলেন ভীম মহাতেজা।

দেবরাজ ইন্দ্রের অংশে জন্ম হল ধনঞ্জইয়ের।

অশ্বিনীকুমারদের থেকে মাদ্রী গর্ভে নকুল ও সহদেবের।

চন্দ্র এসে হলেন অভিমন্যু মহাবীর।

কাম থেকে প্রদ্যুম্ন বিখ্যাত যদুবীর।

বসুদেবকে দয়া করে দয়াময় হরি তথা কৃষ্ণ তাঁর গৃহে জন্মালেন গোলক পরিহরি।
এই হরি অংশেই জন্ম হল রোহিনীপুত্র বলরামের।

এসময় দ্রুপদের কূলে জন্ম নিলেন দ্রৌপদী।

কলি নিজে আসলেন দুর্যোধন রূপে।

পৌলস্ত্যের অংশে জন্মাল বাকি কৌরবরা।

ধৃতরাষ্ট্রের একশটি পুত্র হল।

জ্যেষ্ঠ দুর্যোধন যুযুৎসু পারদর্শী।
দুঃশাসন, দুঃসহ, দুঃশীল, প্রথম দূর্ম্মুখ, বিবিংশতি, বিকর্ণ, শ্রীজলসন্ধ, সুলোচন, বিন্দ, অনুবিন্দ, শ্রীদুর্দ্ধষ, সুবাহুক, দুষ্প্রধর্ষ, দুর্ম্মর্ষণ, দ্বিতীয় দুর্ম্মুখ, দুষ্কর্ণ, চিত্রকর্ণ, উপচিত্র, চিত্রাক্ষ, চারু, চিত্রাঙ্গদ, দূর্ম্মদ, অনন্তর, অদ্ভূত, দুষ্প্রহর্ষ, বিবিৎসু, বিকট, শম, ঊর্ণনাভ, পদ্মনাভ, নন্দ, উপনন্দ-সেনাপতি, সুষেণ, কুন্তীর, মহোদর, চিত্রবাহু, চিত্রবর্ম্মাধীর, সুবর্ম্মা, দুর্ব্বিরোচন, অয়োবাহুবীর, মহাবাহু, চিত্রচাপ, সুকুন্ডল, ভীমবেগ, বলাকী, ভীমবল, শ্রীভীমবিক্রম, উগ্রায়ুধ, ভীমশর, কনকায়ূ, দৃঢায়ুধ, দৃঢবর্ম্মা, দৃঢক্ষেত্র, সোমকীর্ত্তি, অনুদর, জরাসন্ধ, দৃঢসন্ধ, সত্যসন্ধ, সহস্রবাক্‌, উগ্রশ্রবা, উগ্রসেন-সেনানী দুর্জয়াপরাজিত, পন্ডিতক, বিশালাক্ষ, দুরাধর, দৃঢহস্ত, সুহস্তক, বাতবেগ, সুবর্চ্চা, আদিত্যকেতু, বহ্বাশী, নাগদত্ত, নিষঙ্গী, জানহ, কবচী, দন্ডী, দন্ডধার, ধনুর্গ্রহ, উগ্রতপা, ভীমরথ, বীরবাহু, অলোলুপ, রৌদ্রকর্মা, দৃঢরথ, অনাধৃষ্য, কুন্ডভেদী, বীরাবী, তৎপর, সত্যব্রত, নামধেয়, অভয়, জ্ঞেয়, সুদীর্ঘলোচন, দীর্ঘবাহু, অনন্তর, মহাবাহু, ব্যুঢোরু, কনকাঙ্গদ, কুন্ডজ, চিত্রক, মহারথ- এই হল শত সহোদর।

বৈশ্যা-পুত্র যুযুৎসু হল শতোপরি আরেক ভ্রাতা।

এই একশ এক ভাই-এর এক মাত্র বোন হলেন দুঃশলা সুন্দরী। এই দুঃশলার বিবাহ হয় জয়দ্রুথের সাথে।
..........................................

Sunday, August 22, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ২১


মহর্ষি বৈশম্পায়ন প্রমুখাৎ মহারাজ জন্মেজয়ের "শ্রীমহাভারতকথা" – শ্রবণারম্ভঃ
মহারাজ জন্মেজয় বিনয়ের সঙ্গে মুনিকে কাছে পেয়ে সেই পূণ্য কথা শুনতে চাইলেন।

জগৎ বিখ্যাত বৈশম্পায়ন মুনি ভারতকাহিনী বর্ণনা শুরু করলেন।

প্রথমে তিনি গুরু ব্যাসদেবকে স্মরণ করলেন, যিনি এই ভারতকাহিনী রচনা করেছেন।

এই ভারতকাহিনী শ্রবণ করলে অশেষ পাপ খন্ডিত হয়। সকল যজ্ঞের ফল পাওয়া যায়।

রাজা শুনলে সর্বত্র জয় লাভ হয়। ব্রাহ্মণ হয়ে শুনলে নরকের ভয় দুর হয়। বৈশ্য ও শুদ্র শুনলে, তাদের সকল দুঃখ দুর হয়।
অপুত্রক শুনলে পুত্রমুখ দর্শন পায়।
রাজভয়, শত্রুভয়, পথিভয়, সকল ব্যাধি ও দুর্গতি এই ভারত কথনে খন্ডিত হয়।
মর্তের মানুষ এর শ্রবণে স্বর্গ সুখ লাভ করে। ইহলোকে যশ পায়, অন্তে স্বর্গে যায়। ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ পেতে সক্ষম হয়।

শুদ্ধ মনে যে এই ব্যাসদেবের রচনা শোনে সে অশেষ সুখ লাভ করে। এতে নানা ধর্মের সুবিচিত্র চিত্র-উপাখ্যান অঙ্কিত হয়েছে।

.....................
ভগবানের পরশুরাম অবতারঃ

পৃথিবীতে ক্ষত্রিয়দের শক্তি বর্ধিত হলে তারা কদাচার শুরু করলো।
এই অনাচার বিষ্ণু সহ্য করতে পারলেন না। তিনি ভৃগুবংশে জন্মগ্রহণ করলেন। করে(হাতে) কুঠার নিয়ে জমদগ্নির এই কুমার(পরশুরাম) তিন সপ্তবার (একুশবার) পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রা করলেন। ক্ষত্রিয়ের দুগ্ধ শিশুদেরও হত্যা করলেন। এরপর ব্রাহ্মণের হাতে রাজ্য দিয়ে তিনি তপোবনে গেলেন।


ক্ষত্রিয় নারীরা ব্রাহ্মণের গৃহে আশ্রয় পেলেন।
ব্রাহ্মণদের দ্বারা রাজকার্য সম্ভব হল না। ফলে ক্ষেত্রজ সন্তানের জন্ম হল। এই ক্ষত্রিয় সন্তানরা নিষ্পাপ ও ধার্মিক হলেন। ধর্মে মতি থাকায় বংশবিস্তার ঘটল।

এভাবে ধর্মকে আশ্রয় করে ক্ষত্রিয়রা রাজকর্ম তথা প্রজাপালন করলেন। নিজ নিজ বৃত্তিতে সবাই সুখি হলেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র -যে যার কর্মে প্রবৃত্ত হলেন। পাপের প্রসঙ্গ দুর হল। সাগর পর্যন্ত পৃথিবী নরে পূর্ণ হল। স্বর্গের বৈভব যেন ক্ষিতি তথা মর্তে–পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হল।
মর্তের রাজারা দ্বিতীয় দেবরাজ হলেন।

এদিকে যত দৈত্য-দানব স্বর্গ থেকে বিতারিত হয়ে পৃথিবীর সুখ–স্বাচ্ছন্দ দেখে ভোগের কারণে মনুষ্য জন্ম নিতে শুরু করল। তারা পুনরায় পৃথিবীতে হিংসা আনল।

এই দানবদের ভার ধরা আর সহ্য করতে না পেরে বিষাদ বদনে ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হলেন। পৃথিবীর ক্রন্দনে ব্রহ্মা চিন্তিত হলেন। তাকে সান্তনা জানালেন।
বললেন –তোমার জন্য আমি সব দেবতাদের নররূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের আজ্ঞা দেব।

পৃথিবীকে সান্তনা দিয়ে তিনি দেবতাদের নিয়ে পদ্মযোনি বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হলেন। অসুরদের অত্যাচারে পৃথিবী ভারাক্রান্ত। হরি বিনা আর কেউ তাদের সংহার করতে পারে না। সকলে বিষ্ণুর স্তুতি করলেন। প্রজাপতি উর্দ্ধবাহু করে নারায়ণকে কৃপা করতে বললেন।

ব্রহ্মার অনুরোধে লক্ষ্মীপতি অবতার রূপে জন্মগ্রহণে সম্মত হলেন। আশ্বাস দিলেন অবনী তথা পৃথিবীর ভার তিনি লাঘব করবেন।
তিনিও দেবতাদের নিজ অংশ নিয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে বললেন। এই আকাশবাণী পেয়ে প্রজাপতি সকল দেবগণকে কার্যে নিযুক্ত হতে বললেন।
এভাবে পৃথিবীতে এক সাথে দেবতা, দানব ও মানব একত্র হল।

এত কথা শুনে জন্মেজয় মুনিকে কোনজন কি রূপে জন্মগ্রহণ করলেন তা জানতে চাইলেন।
........................................

Wednesday, August 18, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ২০

জন্মেজয়ের অশ্বমেধ যজ্ঞঃ
অশ্বমেধ যজ্ঞ
রাজা জন্মেজয় বলেন –অকারণে এত কিছু করলাম। কোটি কোটি অহিংস সাপকে মারলাম। এ পাপের নরক গমন থেকে দেখছি আর নিস্তার নেই!
মুনি তুমিই বল এ পাপ থেকে কি ভাবে মুক্তি পাব। পূর্বে আমার পূর্বপুরুষরা অশ্বমেধ যজ্ঞ করে সব পাপ মুক্ত হন। আমিও তাদের মত সেই যজ্ঞ করবো।

শুনে ব্যাসমুনি তাকে বারণ করেন। রাজা কারণ জানতে চাইলেন।
রাজা বলেন –পিতা পিতামহ যা করেছেন আমিও তা করতে পারি, তুমি আমায় অক্ষম মনে করো না!

মুনি বলেন –তুমি সব কর, কিন্তু অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে যেও না। কলিযুগে এ যজ্ঞ করা উচিত নয়। মাংসশ্রাদ্ধ, সন্যাস, গোমেধ, অশ্বমেধ কলিযুগে পুত্র থেকে দেবর সকলের নিষেধ।

কিন্তু রাজা বললেন –আমি অবশ্যই এই যজ্ঞ করবো। পৃথিবীর কেউ আমায় আটকাতে পারবে না।

মুনি বলেন –তুমি করতে পার কিন্তু বেদে যা বারণ তা আমি অনুমতি দিতে পারি না। এই বলে মুনি সেখান থেকে চলে গেলেন।
রাজা যজ্ঞের আয়োজন শুরু করলেন। সেনাপতিরা যজ্ঞের অশ্ব নিয়োগ

করল। ঘোড়াটিকে বহু দেশদেশান্তরে ঘোরান হল। সারা বছর পৃথিবী ভ্রমণ করে সব রাজাদের জয় করা হল। সেই সঙ্গে পৃথিবীর সকল ব্রাহ্মণ এবং মুনিদের যজ্ঞে আমন্ত্রণও করা হল।


রাণী বপুষ্টমা ও রাজা জন্মেজয় নিষ্ঠার সঙ্গে সারা বছর অসিপত্র-ব্রত পালন করলেন। চৈত্র পূর্ণিমায় ব্রত সাঙ্গ হলে অশ্বকে কেটে রাজা তাকে যজ্ঞের আগুনে ফেললেন। ব্রাহ্মণরা বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে আকাশ বাতাস ভরালেন।

স্বর্গ থেকে দেবতারা এই যজ্ঞ দেখে অবাক হলেন।
দেবরাজ ইন্দ্র কলিযুগে অশ্বমেধ যজ্ঞ পূর্ণ হচ্ছে দেখে বেদনিন্দার ভয়ে কম্পিত হলেন।
যজ্ঞ পন্ড করারা উদ্দেশ্যে ইন্দ্র মায়াবলে অশ্বের কাটামুন্ডে প্রবেশ করে সভার তুরঙ্গের মৃত মুন্ডের নৃত্য শুরু করলেন।


তা দেখে সকলে বিস্মিত হলেন। সভায় রাজা, রাণী এই মুন্ডনৃত্য দেখে লজ্জিত হলেন। সকলে মাথা নত করলেন।
সভায় এক বালক ব্রাহ্মণপুত্র মুন্ড নৃত্য দেখে হেসে উঠল। সেই নিষ্পাপ বালক অদ্ভূত কান্ড দেখে আনন্দে তালি মেরে মেরে খল খল রবে হাসতে লাগল।
তা দেখে রাজা প্রচন্ড রেগে উঠলেন। তার সামনে একটি খড়গ পড়েছিল। তিনি ক্রোধে তা তুলে বালকের উপরে আঘাত করলেন। বালক দু’টুকরো হয়ে গেল।

চারদিকে হাহাকার পড়ে গেল। যজ্ঞ পন্ড হল। ব্রাহ্মণরা যজ্ঞ স্থান থেকে পালাতে শুরু করলেন।
ব্রাহ্মণ হত্যাকারী মহাপাপী রাজাকে দর্শন করাও পাপ, তার যতদুর পর্যন্ত রাজত্ব ততদুর ব্রাহ্মণরা আর বসবাস করবেন না।
অশ্বমেধ যজ্ঞের নাম করে শেষ পর্যন্ত রাজা জন্মেজয় ব্রাহ্মণের মাংস খেতে চান – এই রব চারদিকে উঠল। ব্রাহ্মণরা যজ্ঞের সকল উপাচার ফেলে যজ্ঞস্থান ত্যাগ করলেন।

ব্রাহ্মণ হত্যাকারীর মুখ দেখা অনুচিত তাই সব রাজারাও চলে গেলেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সকলে চলে গেলেন।

সভার মাঝে রাজা একা নত শিরে রয়ে গেলেন।
...........................
ব্যাসের পুনরাগমন ও জন্মেজয়ের প্রতি ভারত শ্রবণের উপদেশঃ
শ্রী বেদব্যাস মুনি

শ্রী বেদব্যাস মুনি হলেন সর্বজ্ঞ এবং অন্তর্যামী। তার গুণ বর্নণাতীত। সত্যবতীর পুত্র ব্যাসমুনির অমৃত মিশ্রিত বাণীতে ত্রিভূবন পূর্ণ। সকল পাপী তার সাহায্যেই ভব সংসারে রক্ষা পায়। অগ্নিশিখার মত সোনার বর্ণের জটা, পরিধানে কৃষ্ণসার হরিণের চামড়া। তিনি অম্বরজয়ী, ভারত তার কক্ষে অবস্থিত। তাকে ঘিরে আছেন লক্ষ লক্ষ মুনি।

এই সহৃদয় অন্তরযামী জন্মেজয়ের কষ্টের সমব্যথী হয়ে তার কাছে এলেন।
ব্যাসমুনিকে দেখে রাজা আরো লজ্জিত হলেন।
মুনি তাকে অভিমান ত্যাগ করতে বললেন। তার কথা না শুনেই এই পরিনতি হল।
রাজা ব্যাসকে কাছে পেয়ে তার পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইলেন। তার সাবধান বানী না শোনার জন্য ক্ষমা চাইলেন এবং এই নরক-সিন্ধু থেকে তাকে উদ্ধারের পথ দেখাতে বললেন।
তিনি দুঃখ করে আরো জানালেন, সকলে তাকে ত্যাগ করেছে। ব্রাহ্মণ, ভাই, মন্ত্রী, সকলে।
কেবল ব্যাসদেবই স্নেহ করে তার কাছে এলেন। আজ তিনিই রাজাকে পথ দেখান।

মুনি বলেন –চিন্তা করে কি হবে, রাজন। সব পাপ দুর হবে যদি এক লক্ষ শ্লোকে রচিত মহাভারত শুদ্ধ মনে একবার শ্রবণ কর।
কৃষ্ণবর্ণের চন্দ্রাতপ বেঁধে তার তলায় মহাভারতের অমৃতকথা শ্রবণ কর। একদিন তোমার কৃষ্ণবর্ণ গিয়ে শুক্লপক্ষ অবশ্যই উদয় হবে।
তোমারই পিতা-পিতামহদের অপূর্ব কথা এখানে গ্রথিত, এসব শুনলেই পাপ খন্ডাবে।

ব্যাস মুনির কথায় রাজা স্বস্তি পেলেন। তিনি মুনিকে প্রণাম করে অনুরোধ করলেন তাকে মহাভারত শোনানোর জন্য। তিনি ও তার পূর্ব পুরুষদের কথা জানতে উৎসুক। তারা কি কারণে যুদ্ধ করে নিহত হলেন।

জন্মেজয় বললেন –আপনি থাকাতেও তারা কেন বিবাদ করে ধ্বংস হলেন!

মুনি বলেন –মহাভারতের কথার বিস্তার বিশাল। তার এত অবসর নেই। তবে মুনি শ্রেষ্ঠ তার শিষ্য শ্রী বৈশম্পায়নের কাছে রাজা মহাভারতের কাহিনী শ্রবণ করতে পারেন।

রাজা তাতে সম্মত হলে ব্যাসদেব শিষ্যকে মহাভারত কথনের অনুমতি দিয়ে চলে গেলেন।


রাজা কৃষ্ণবর্ণের চন্দ্রাতপ নির্মাণ করে মন্ত্রীদের এবং চারবর্ণের শ্রেষ্ঠ নাগরিকদের নিয়ে পূজার্চনা করে ভক্তিভরে সেই চন্দ্রাতপের নিচে মহাভারত শ্রবণে উপনিত হলেন।
..........................................

Tuesday, August 17, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৯

জন্মেজয়ের ধর্ম্মহিংসাঃ
সৌতি বলেন –


রাজা জন্মেজয় সব পাত্রমিত্রদের ডেকে বিলাপ করে বললেন –আমার হৃদয়ে যে হিংসা তা এখনও দুর হল না। আমি অনেক ভেবে দেখলাম, ব্রাহ্মণই আমার আসল শত্রু।

আমার পিতা ধর্মশীল ব্যক্তি। বিনা অপরাধে তাকে শাপ দেওয়া হল। আবার পিতার হত্যাকারীকে যখন বধ করতে গেলাম তখনও এসে এই ব্রাহ্মণই বাধা দিল।
প্রথমে ব্রাহ্মণ শাপ দিয়ে পিতা পরীক্ষিতকে মারল। আবার দুষ্ট তক্ষককেও রক্ষা করল। ব্রাহ্মণের এই কুরীতি আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার শরীর রাগে জ্বলছে। এখন মনে হচ্ছে সব ব্রাহ্মণদেরই আমি মারবো।
আগেই কার্তবীর্য ব্রাহ্মণ ধ্বংস করেছিলেন, উদর চিরে মেরেছিলেন ভৃগুবংশ। তার মত আমিও ব্রাহ্মণ সংহার করবো-এই আমি প্রতিজ্ঞা করলাম।

রাজার কথা শুনে সকলে স্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ কোন কথা বলল না।
রাজা তাদের এই নিরবতার কারণ জিজ্ঞেস করলেন।


মন্ত্রীরা বলল –রাজা কথাটা শুনেই আমাদের ভয়ে মুখ দিয়ে কথা বেরচ্ছে না। কেউই ব্রাহ্মণ হত্যার সপক্ষে যুক্তি দেবে না। তুমি যে কার্তবীর্যের ব্রাহ্মণ হত্যার কথা বললে তার শাস্তিও পৃথিবী বিখ্যাত। সেই ভৃগুবংশে রাম জন্মান এবং ক্ষত্রিয়ের রক্তে পৃথিবীকে পবিত্র করেন। ক্ষত্রিয় যখন পৃথিবীতে আর ছিল না তখন ব্রাহ্মণের ঔরসেই আবার ক্ষত্রিয়ের জন্ম হয়। তাদের কথায় সৃষ্টি ও পালনকার্য চলে। তাদের অভিশাপে ক্ষণকালেই সব ধ্বংস হয়। অগ্নি, সূর্য, কালসাপের প্রতিকার আছে কিন্তু ব্রাহ্মণের শাপের কোন নিস্তার নেই।

তবে, একটি উপায় আছে। সেই উপায়ে ব্রাহ্মণের তেজ ভাঙ্গা যেতে পারে। কুশের স্পর্শে ব্রাহ্মণরা পবিত্র হন। কুশ ছাড়া তাদের কোন কাজ সম্ভব নয়। কুশের অভাবে ব্রাহ্মণের তেজ ক্ষীণ হবে। তারপর তাদের পিছনে লাগা যাবে।

রাজা বললেন –ঠিক আছে, এই উপায়েই ব্রাহ্মণদের বিনাশ করবো। এই বলে রাজা দূতদের ডেকে পাঠালেন এবং আজ্ঞা দিলেন সব খননকারদের ধরে আনতে। খননকারদের নির্দেশ দিলেন পৃথিবীর সব কুশ খুঁড়ে ফেল।
কিন্তু মন্ত্রীরা সে কার্যে বাধা দিলেন। কারণ সেই কুশ আবার সংসারে অশান্তির সৃষ্টি করতে পারে। তাই কুশ খনন না করে তার মূলে ঘি, দুধ, মধু, গুড় দিলে পিপঁড়ে আসবে, তারাই কুশের সর্বনাশ করবে। আবার কেউ সন্দেহও করবে না!

শুনে রাজা খুশি হয়ে সেই আজ্ঞাই দিলেন। পৃথিবীর সব কুশ নিধনে অনুচরদের যাত্রা শুরু হল।

ব্রাহ্মণের পদধুলি মস্তকে নিয়ে গদাধরের অগ্রজ কাশীরাম এ সকল কথা শুনালেন।
..............................
জন্মেজয়ের নিকট ব্যাসের আগমনঃ

ব্যাসমুনি

কুশের অভাবে ব্রাহ্মণরা চিন্তিত হলেন। সকলে আলোচনায় বসলেন। সব শুনে ব্যাস রাজার সাথে দেখা করতে চললেন।

ব্যাসকে দেখে জন্মেজয় খুশি হলেন। তার পা ধুয়ে, সেবা যত্ন করে পূজা করলেন।

ব্যাসমুনি খুশি হয়ে রাজাকে আশির্বাদ করলেন এবং মধুর হেসে জিজ্ঞাসা করলেন –বদরিকাশ্রমে শুনলাম তুমি ব্রাহ্মণদের উপর রেগে আছ, এর কারণ কি!
তুমি পন্ডিত তবু কেন এমন কাজ করছ! এই ব্রাহ্মণের ক্রোধেই যদু বংশ ধ্বংস হল, সগররাজের বংশ উচ্ছন্নে যায়, চাঁদ কলঙ্কিত হন, সাগর লবণাক্ত হন, আগুন সর্বভুক হলেন, ইন্দ্র ভগাঙ্গ হন। তোমার পূর্বপুরুষরা এদের সেবা করেই পৃথিবী জয় করতে পেরেছিলেন। তাদের উপর তোমার এত হিংসা হল কেন!

সব শুনে রাজা বলেন –বিনা অপরাধে ব্রাহ্মণের জন্যই পিতার মৃত্যু হল। আবার পিতার শত্রুকে হত্যা করতে চাইলে সেই ব্রাহ্মণই বাধা দিল। এজন্য ব্রাহ্মণ আমার শত্রু।

ব্যাস বলেন –ধৈর্য ধর রাজন, ক্রোধে ধর্ম নষ্ট করা উচিত কাজ নয়। ব্রাহ্মণদের অকারণে তুমি রাগাচ্ছ। ভবিষ্যৎ কখনও খন্ডন করা যায় না। তোমার পিতার যখন জন্ম হয় তখনই সকল গণৎকাররা বিচার করে দেখেন সাপের কামড়েই তার মৃত্যু হবে। আমার কথা শোন, পিতার জন্য দুঃখ করো না। দৈব্যের বচন কেউ খন্ডন করতে পারে না। শুধু শুধু ব্রাহ্মণদের বিরোধী হয়ো না।

ব্যাসের মুখে এত কথা শুনে রাজা কুশ নিধন বন্ধের নির্দেশ দিলেন।
..........................................

Sunday, August 8, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৮

যজ্ঞস্থানে আস্তীকের গমনঃ

বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে আস্তীক জন্মেজয়ের প্রশংসা করলেন।
বললেন –চন্দ্রবংশ ধন্য, এমন অলঙ্কৃত পুত্র পেয়ে। ক্ষত্রিয়দের মধ্যেও এরূপ তেজ সব সময় দেখা যায় না।
অনেক দেখেছি, শুনেছি–কত যজ্ঞ হয়েছে, কিন্তু কারো সাথে এই যজ্ঞের তুলনা হয় না। ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ, চন্দ্র–আরো অনেকেই যত যজ্ঞ করেছেন–পান্ডবপতি যুধিষ্ঠির, মহামতি কৃষ্ণ, রাজা যযাতি, সূর্যবংশীয় পবনরাজ, দক্ষিণার সাগর দাশরথি অর্থাৎ রাম। সূর্যবংশীয় প্রথম রাজা ইক্ষ্বাকু যিনি বৈবস্বত মনুর পুত্র, রাজা শিবি শিখিধ্বজ/কার্তিক-এরা অনেক যজ্ঞ করেছেন। কেউ কুড়ি, কেউ তিরিশ, কেউ ষাট, কেউ বা শত-কারো যজ্ঞ সমান নয়।
ব্যাসঋষি পুত্রসহ শিষ্যদের নিয়ে সভায় এলেন যজ্ঞের কারণে। অগ্নি যজ্ঞের ঘি গ্রহণ করেন। এসবই চারদিকে ঘুরে শেখা যায়।
ধন্য শ্রী জন্মেজয় – তার মত আর কেউ হবে না। ভূমন্ডলে তার তুল্য কেউ নেই।
তিনি ধার্মীক যুধিষ্ঠির, ধনুর্বেদে রাম এবং কীর্তিতে ভগীরথের সমান। তেজে সূর্যের প্রভা, রূপে কামদেব, ব্রতীচারণে ভীষ্মের সমান।
ধর্মেতে বাল্মীকি মুনি, ক্ষমাতেও বশিষ্ট অবশ্যই হবেন! সম্পদে তো পবন!


আস্তীকের এত কথা শুনে খুশি হয়ে জন্মেজয় মন্ত্রীদের বললেন –বালক ব্রাহ্মণ-পুত্র আস্তীক পরিণত জ্ঞানীদের মত পুরাতন সকলের কথা বললে। সে যা চাইবে আমি তাকে তাই দেব। এই বালকের সকল আশা আমি পূরণ করবো। তিনি আস্তীককে শিশু ভেবে তাকে তার মনের ইচ্ছা জানাতে বললেন।

রাজার কথা শুনে যজ্ঞের হোতারা বলে উঠলেন এখনও দানের সময় উপস্থিত হয় নি। তার পিতার শত্রু তক্ষকও এখনও যজ্ঞের আগুনে ভস্ম হয় নি।

শুনে রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন –কি কারণে তক্ষককে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছো!
ইন্দ্র
ব্রাহ্মণেরা বললেন –তক্ষকের দারুণ ফণা। সে এখন ইন্দ্রের শরণে আছে।

শুনে রাজা রাগে নিজের ঠোঁট কামড়ান।
সব ব্রাহ্মণদের বলেন –ইন্দ্র আমার শত্রুকে আশ্রয় দিলেন! তক্ষকের সাথে তাকেও এই অগ্নিকুন্ডে আনো।

রাজার আজ্ঞা পেয়ে সকলে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করলেন।
মন্ত্রের তেজে ইন্দ্র নাগরাজকে সঙ্গে নিয়ে আকাশে দেখা দিলেন। অপ্সরা-অপ্সর সকলে বাদ্যগীত শুরু করলে তারাও মন্ত্রপাশে আবদ্ধ হলেন।
........................

আস্তীক কর্ত্তৃক সর্পযজ্ঞ নিবারণঃ

আকাশে নাচ–গান শুনে যজ্ঞের হোতারা প্রমাদ গণল। রাজার ক্রোধে কি কাজ করা হল! আজ নিশ্চয়ই দেবরাজ ইন্দ্রের সর্বনাশ হবে! এত ভেবে হোতারা ঠিক করলেন ইন্দ্রকে ছেড়ে কেবল তক্ষককে যজ্ঞকুন্ডে ডাকা হোক।

তক্ষক ইন্দ্রের কাছে প্রাণভিক্ষা করে কেঁদে পড়লো। কিন্তু মন্ত্রের তেজে ইন্দ্রকে ছেড়ে তক্ষক যজ্ঞকুন্ডের দিকে যাত্রা শুরু করলো। তর্জন-গর্জন করতে করতে তক্ষক আসতে লাগলো। তার গর্জনে আকাশ পূর্ণ হল। শেষে সে অবশ হয়ে পড়ল।

মাতুল অগ্নিতে পড়ছে দেখে আস্তীক মহাকাশেই তাকে ‘তিষ্ঠ, তিষ্ঠ’ বলে স্থির করালেন। তক্ষক মহাকাশে আস্তীকের মন্ত্রবলে স্থির হল কিন্তু ব্রাহ্মণ মন্ত্রে ভয়ে কাঁপতে লাগলো।

আস্তীক রাজা জন্মেজয়কে কৃপা করতে বললেন। তিনি যা চাইবেন রাজা তাই দেবেন, এ প্রতিজ্ঞাও জন্মেজয় করেছেন।

জন্মেজয় আস্তীককে বললেন –হে ব্রাহ্মণ পুত্র, তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। আমি আমার পিতার হত্যাকারী, আমার শ্ত্রুকে বধ করে তোমার ইচ্ছাপূরণ করবো।

আস্তীক বলেন –তুমি যদি তক্ষককেই মেরে ফেলবে, তবে আর আমার ইচ্ছা কি ভাবে পূরণ করবে!

রাজা বলেন –তুমি তক্ষক ছাড়া যা চাইবে তাই পাবে।

কিন্তু অনড় আস্তিক বলেন –আমি তাকে ছাড়া আর কিছুই চাই না, রাজন!

রাজা জন্মেজয় তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন -তক্ষক আমার শত্রু, আমার পিতার হত্যাকারী, তার জন্যই এত সাপ ধ্বংস হল-তাকে আমি হত্যা করবোই। তুমি বাধা দিও না। তুমি অন্য যা কিছু চাও সব দেবো।

আস্তীক বলেন –রাজা, তুমি সুপন্ডিত। তোমায় আমি আর কি বুঝাবো! তোমার পিতার আয়ু শেষ হয়েছিল, তাই যম তাকে গ্রহণ করেন। তুমি তক্ষককে শুধু শুধু অপরাধী করছো এবং অসংখ্য নাগদের তার সাথে শাস্তি দিচ্ছ। এই সভা দেখছি ইন্দ্রের দ্বিতীয় সভার মত কেউই জীব হত্যায় বাধা দিচ্ছে না!

আস্তীকের কথা শুনে সকলে রাজাকে বোঝাতে শুরু করলো।

ব্যাসদেব রাজাকে ডেকে বললেন –তুমি ব্রাহ্মণপুত্রের কথা শোন। এই যজ্ঞ বন্ধ কর। বালককে তুমি অসুখী করো না।
সঙ্গে সঙ্গে ‘নিবৃত্ত, নিবৃত্ত’ বলে চারদিক থেকে রব উঠল। শেষ পর্যন্ত রাজা সর্প যজ্ঞ বন্ধ করলেন।

রাজা জন্মেজয় আস্তীককে অনেক উপাচারে পূজা করলেন। ব্রাহ্মণরা অনেক দান পেয়ে খুশি মনে নিজ নিজ দেশে ফিরে গেলেন।
আস্তীকের বিদায় সম্ভাষণ কালে রাজা বললেন অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় যেন তিনি আসেন।

আস্তীক নিজ গৃহে ফিরে মা এবং মাতুলদের সকল কথা জানালেন। সব শুনে নাগরাজ বাসুকি স্বস্থি পেলেন। নাগলোকে উৎসব শুরু হল। নাগলোকে যত নাগ ছিল সকলে বহু রত্ন দিয়ে আস্তীকের পূজা শুরু করলো।

সকলে তাকে আশির্বাদ করে বললো –তুমি আমাদের পুনর্জন্ম দিলে, তুমি আমাদের কাছে বর চাও।

আস্তীক বললেন –তোমরা সবাই যদি বর দিতে চাও তাহলে সকলের সামনেই বলি, প্রতি সন্ধ্যায় যে আমার নাম করবে তার নাগেদের থেকে আর ভয় পেতে হবে না, আমার কাহিনী যে শ্রবণ করবে বা আমার চরিত্র যে অনুসরণ করবে তার নাগদের থেকে কোন অনিষ্ঠ হবে না। যে এই নিয়মের বাইরে যাবে তার সর্বনাশ হবে, মৃত্যু তার অবশম্ভাবী। তার মাথা শিরীষ ফলের মত সাপের বিষে ফাটবে।

সাপরা আস্তীককে সেই বরই দিল। কেউ যদি আস্তীকের নাম স্মরণ করেন তবে সর্পরা তার কাছে যাবে না – এই প্রতিজ্ঞাও করলো।
..........................................

Tuesday, August 3, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৭

জন্মেজয়ের সর্প যজ্ঞের মন্ত্রণাঃ
মন্ত্রীরা রাজা জন্মেজয়কে বললেন –তোমার পিতা পরীক্ষিত পান্ডবদের সমান ছিলেন। তিনি মৃগয়া করতে গিয়ে একটি হরিণকে বাণ মারেন, হরিণটি পালায়। তাকে খুঁজতে খুঁজতে গভীর বনে রাজা পরীক্ষিত ক্ষুদাতৃষ্ণায় কাতর হন। এক মৌণ মুনির কাছে হরিণ সম্পর্কে জানতেও চান। উত্তর না পেলে রাগে তার গলায় মৃত সাপ ঝুলিয়ে আসেন। মুনির পুত্র শৃঙ্গী সে কথা জানতে পেরে রাজাকে সাতদিনের মধ্যে তক্ষকের কামড়ে মৃত্যু হবে-এই শাপ দেন। পুত্রের শাপে দুঃখিত মুনি দূত পাঠান রাজার কাছে।

এরপর, পরবর্তী সাত দিনের কথা মন্ত্রীরা জন্মেজয়কে জানালেন। কাশ্যপ মানে এক মুনি সাপের কামড় থেকে রাজা পরীক্ষিতকে বাঁচাতে আসছিলেন। পথে তক্ষকের সাথে তার দেখা হয়। তক্ষকের কামড়ে মৃত বৃক্ষ কাশ্যপ জীবন্ত করে তোলেন। কিন্তু তক্ষকের চালাকিতে এবং তার মাথার মনি পেয়ে দরিদ্র কাশ্যপ গৃহে ফিরে যায়। শেষে কপট তক্ষক এসে রাজাকে দংশন করে।

এত শুনে জন্মেজয় বললেন –কাশ্যপমুনির সাথে যে তক্ষকের দেখা হল, সে কথা সবাই জানল কি ভাবে!
মন্ত্রী বলেন –যে বৃক্ষ তক্ষকের দংশনে ভস্ম হয়, সেই বৃক্ষে এক কাঠুরে কাঠ কাটার জন্য ওঠে। ফলে সেও ভস্ম হয়। পরে কাশ্যপ-মন্ত্রে সে বৃক্ষের সাথে প্রাণ ফিরে পায় এবং সকলকে ঘটনাটি জানায়।

সব শুনে জন্মেজয় উত্তেজিত হয়ে হাত কচলাতে থাকেন এবং পিতার জন্য দুঃখে কাঁদতে থাকেন।
রাজা বলেন –কাশ্যপ মুনির আশ্চর্য ক্ষমতা, তিনি অবশ্যই পিতাকে বাঁচাতে পারতেন। তক্ষক ব্রাহ্মণের কথায় পিতাকে দংশায়, এটা সত্য ধর্ম। কিন্তু কোন কারণে সে কাশ্যপকে ফেরায়! আজ থেকে সে আমার শত্রু। কারণ লোকে ধন দিয়ে পরের উপকার করে। কিন্তু সে ধন দিয়ে আমার পিতার হত্যা করেছে।

উতঙ্ক যে কাজ করতে চায় সে কাজে জন্মেজয়ও সাহায্য করবেন স্থির হয়।
জন্মেজয় প্রতিজ্ঞা করলেন তার শত্রু নাগকুলের তিনি ধ্বংস করবেন।
এরপর সব ব্রাহ্মণ এবং পুরোহিতদের ডেকে নাগবংশ ধ্বংসের উপায় স্থির হতে থাকে। শেষে ঠিক হয় যে ভাবে রাজা পরীক্ষিত বিষের আগুনে জ্বলে মারা গেছেন, তেমনি নাগদেরও অগ্নিতে পোড়ান হবে।

সকলে সম্মত হয়ে রাজাকে বললেন –তুমি চন্দ্রবংশীয় রাজা। তোমার নামে পুরাণে মন্ত্র আছে। তুমিই সর্পসংহার যজ্ঞ করতে পার।

রাজা আনন্দিত হয়ে যজ্ঞের অনুমতি দিলেন। মন্ত্রীরা যজ্ঞের আয়োজন করতে লাগল। দেশ দেশান্তর থেকে যজ্ঞের সামগ্রী আনা হল। জোতিষী বিচক্ষণ ছিলেন।
তিনি রাজাকে বললেন –ভবিষ্যৎ দেখে বোঝা যাচ্ছে যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে না। এক ব্রাহ্মণ এতে বাধা দেবে।

শুনে রাজা জন্মেজয় নির্দেশ দিলেন –যজ্ঞকালে যজ্ঞস্থানে বাইরের কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
...........................

জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞঃ

যজ্ঞে অভিলাষে রাজা জন্মেজয় রাশি রাশি ঘি, বস্ত্র, যব, ধান, কাঠ আনালেন। যজ্ঞের হোতা হলেন চন্ডভার্গব নামে এক মুনি। এছাড়া, অনেক সদাচার ব্রাহ্মণও এলেন।
আলাদা ভাবে এলেন – নারদ, ব্যাস, মারকন্ড, পিঙ্গল, উদ্দালক, শৌনক প্রমুখ।

ব্রাহ্মণরা বেদ মন্ত্র উচ্চারণ করে যজ্ঞের আগুন জ্বাললেন এবং নাগদের নাম করে যজ্ঞাহুতি দিতে লাগলেন।
আগুনের শিখা লক্‌লক্‌ করে আরো উর্দ্ধে উঠতে লাগলো, পর্বত বলে ভ্রম হতে লাগলো।
আকাশে মেঘ যেন নাগবৃষ্টি শুরু করল।
নগরে নগরে হাহাকার শুরু হল। প্রলয় সমুদ্র শব্দে সকলে উচ্চ স্বরে কাঁদতে লাগলো।

আপন ইচ্ছায় সকলে আকাশে উঠে নানা বর্ণের নাগ অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিতে লাগলো। কেউ অশ্বের মত, কেউ বা উট বা হাতির মত আকৃতি যুক্ত। কারো বর্ণ কালো, কারো বা হলুদ, কেউ আবার সাদা। সকলে জলের মধ্যে, কোঠরে বা গর্তে প্রবেশের চেষ্টা করে, কিন্তু মন্ত্রের টানে যজ্ঞের অগ্নিকুন্ডেই এসে পড়ে। কারো একশ, দু’শ, পাঁচশ মাথা। পর্বতের মত বিপুল শরীর। মাথায় কেউ বা ল্যাজ জড়িয়ে, কেউ বা জিভ নাচায়, কেউ আবার কাতর হয়ে গড়াগড়ি যায়। হতাশায় কেউ বা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করতে করতে সকলে যজ্ঞকুন্ডে এসে পড়ে। চারদিক দুর্গন্ধে ভরে যায়। সকলে সম্পূরণ ঘটনা দেখে শুনে অবাক হয়।

যখন জন্মেজয় নাগকুল ধ্বংসের প্রতিজ্ঞা করলেন, তখন তক্ষক গিয়ে ইন্দ্রের কাছে আশ্রয় নিল। সকল কথা সে ইন্দ্রকে জানিয়ে আশ্রয় প্রার্থণা করল। ইন্দ্র তাকে অভয় দিলেন। তক্ষক নির্ভয়ে ইন্দ্রের কাছে রয়ে গেলেন।
এদিকে সব নাগেরা যজ্ঞে ধ্বংস হতে লাগল। এত সর্প নিধনে সর্পরাজ বাসুকি চিন্তিত হলেন।

তিনি চিন্তিত মনে বোন জরৎকারীর কাছে এসে বললেন –মায়ের শাপ শেষ পর্যন্ত সত্যি হল। সকল নাগকুল উচ্ছন্নে গেল। তোমার পুত্র আস্তীককে বাকি নাগদের রক্ষা করতে বল। আমার মনে হচ্ছে আমিও হয়ত রক্ষা পাব না!

এত শুনে জরৎকারী দুঃখিত হলেন।
তিনি পুত্র আস্তীককে ডেকে বললেন –মায়ের শাপে আমার ভাইদের এই দুর্দশা। আর সে কারণেই তোমার পিতা আমায় পেলেন। আমার ভাইরা তোমার মাতুল হন। আজ তুমিই তাদের একমাত্র রক্ষা করতে পার।

আস্তীক বললেন –মাতা, তুমি কি কারণে কাঁদছ! তুমি যে আজ্ঞা দেবে, তাই আমি পালন করবো।

জরৎকারী তখন সকল ঘটনা আস্তীককে জানালেন।
শেষে অনুরোধ করে বললেন –জন্মেজয়ের যজ্ঞে সব ভাইরা মারা যাচ্ছেন। তুমি তাদের এক্ষুনি রক্ষা কর।

আস্তীক মাকে বললেন –তুমি চিন্তা কর না, আমি মাতুলকুলকে রক্ষা করবো। মাতুল বাসুকিকে তুমি নির্ভয় হতে বল। আমি এক্ষুনি তাদের রক্ষায় যাত্রা করছি।

আস্তীক জন্মেজয়ের যজ্ঞস্থানে উপস্থিত হলেন। কিন্তু দ্বারী তাকে প্রবেশ করতে দিল না।
তখন ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে আস্তীক বললেন –ব্রাহ্মণের পথ তুমি কোন সাহসে রোধ কর!

তার তেজ দেখে দ্বারী ভয় পেয়ে পথ ছেড়ে দিয়ে তাকে প্রণাম করল।

আস্তীক গিয়ে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন। তার উচ্চ বেদমন্ত্রে যজ্ঞস্থল ধ্বনিত হল। সভার সকল ব্রাহ্মণদের তিনি প্রণাম জানালেন এবং রাজাকে আশির্বাদ দিলেন।
..........................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers