[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে
সক্ষম হলেন ......মায়ের বচনানুসারে দ্রৌপদীকে পাঁচভাই বিবাহ করতে
চান...দ্রুপদরাজ যখন তার কন্যার বিবাহ নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত....দেবতারা এসে
বল্লেন পঞ্চপান্ডবের জন্যেই কৃষ্ণার জন্ম....রাজা দ্রুপদ বিবাহে সম্মত
হলেন ....পঞ্চ পান্ডবের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ হল ...]
পান্ডবদিগের বিবাহ-বার্তা শ্রবণ করিয়া দুর্য্যোধনাদির মন্ত্রণাঃ
ধৃতরাষ্ট্র পান্ডবদের বিবাহ সংবাদ পাওয়ার তিনদিন পর ভগ্নমনে দুর্যোধন দেশে ফিরলেন। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে যাওয়ার সময় সে দশ অক্ষৌহিনী সৈন্য নিয়ে গেছিল। পঞ্চ অক্ষৌহিনী নিয়ে সে বহুকষ্টে দেশে ফিরল। কারো রথের ধ্বজা কাটা গেল, কারো পা কাটা পরেছে, কারোবা নাক, ঠোঁট। কারো মুখেই কথা নেই, শরীর অতি ম্লান। চামর, ছাতা, বাণ কোন কিছুরই চিহ্ন নেই।
দেশে ফিরে দুর্যোধন পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে প্রণাম জানাল। পিতা আশীর্বাদ করে জিজ্ঞেস করল –বল পুত্র, যুধিষ্ঠিরের সাথে তোমার দেখা হল! বিবাহ কি বহু সাড়ম্বরে সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন করলে! কি ভাবে তোমার পান্ডবদের সাথে দেখা হল, তুমি কি পঞ্চপান্ডবদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছো!
পিতার প্রশ্ন শুনে দুর্যোধন চমকে উঠল। ধিরে ধিরে সে বুঝতে পারল সেই ব্রাহ্মণরাই ছদ্মবেশী পান্ডবকুমার।
কর্ণ রেগে বলে ওঠে –মহারাজ কি কথা বলছেন! আমার পরম শত্রু পঞ্চপান্ডব। পরিচয় পেলে তাদের প্রাণে মেরে ফেলতাম। ব্রাহ্মণের ছন্মবেশ ধরেছিল। ব্রাহ্মণ হত্যা পাপ বলে তখন ক্ষমা করেছিলাম। প্রকৃত পরিচয় জানলে, পান্ডুপুত্র রূপে চিনতে পারলে অবশ্যই তখন তাদের প্রাণ নিতাম। এখন আপনার কাছে প্রকৃত পরিচয় জানতে পারলাম।
দুর্যোধন বলে –কি ভাবে জানবো যে এখনও পঞ্চপান্ডব বেঁচে আছে। ধিক্ ধিক্ পুরোচন! ভাল হয়েছে সে বেটা পুড়ে মরেছে। এখন যে লজ্জায় মরতে ইচ্ছে করছে। এখন কি করি! শিয়রে শত্রু শমনের(যমের) মত দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি। এখনই যদি একটা উপায় না বার করা যায়, তবে পরে আরো বড় অনর্থ হবে দেখতে পাচ্ছি। এখনই দ্রুপদরাজার কাছে গোপনে লোক পাঠাও। পাঞ্চালরাজকে বল আমার অর্ধেক রাজ্য তিনি ভোগ করুন। ধৃষ্টদ্যুম্নকেও আমাদের সখা করে নেব। কেবল আমার পরম শত্রু পান্ডবদের তিনি হত্যা করুন।
নয়ত কিছু সুন্দরী রূপসী নারী পান্ডবদের জন্য পাঠাও। পান্ডবরা তাদের সাথে বসবাস করুক, দ্রৌপদীর অনাদর হোক। তখন দ্রুপদরাজা ক্রোধিত হয়ে তাদের হত্যা করবে। নয়ত কোন বুদ্ধিমান ব্রাহ্মণকে সেখানে পাঠাও যে পাঁচভায়ের মধ্যে ভেদ ঘটাবে। একবার পঞ্চপান্ডবদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হলে কেউ তাদের বাঁচাতে পারবে না।
নয়ত আমাদের অন্তপুরেরই কেউ একজন গিয়ে পান্ডবদের সামনে পূর্ব শোকে কেঁদে পরুক। তবে তাকে পঞ্চপান্ডব বিশ্বাস করতে শুরু করবে। তখন সে বিষ দিয়ে বৃকোদর ভীমকে হত্যা করবে। ভীম বিনা পান্ডবরা অনাথ হয়ে যাবে। কর্ণের সাথে যুদ্ধে অর্জুন সহজে হেরে যাবে।
দুর্যোধনের কথা শুনে কর্ণ বলে –কোন কথাই তোমার আমার মনে ধরল না। দ্রুপদরাজাকে তুমি ধনের লোভ দেখাচ্ছ। যান পঞ্চপান্ডবকে পেলে ত্রৈলোক্যের কেউই তাদের ছারতে চায় না। একে তারা জামাই। তার উপর এমন বীর ও শক্তিশালী। এখন কি আর দ্রুপদ আগের মত আর দুর্বল রইলেন!
কুটিল ব্রাহ্মণের দ্বারাও আর কিছু করা সম্ভব নয়, পঞ্চভায়ের দেখ একই নারী স্ত্রী হল।
এখানে যখন ছিল তখনইবা কে ভীমকে মারতে পেরেছিল। তাকে মারা অসম্ভব। বিষ দেওয়া হয়েছিল, নানা রকম ভাবে তাদের যন্ত্রণাও দিয়েছিলে। এমন কি শেষে জতুগৃহে পুড়িয়েও মারলে। এত তো চেষ্টা করলে, সবই বিফল হয়ে এখন আমাদের অসহায় অবস্থা। অন্যদিকে পান্ডবদের এখন অনেক সহায় হয়েছে। পুরনারী তাদের কি ক্ষতি করবে! তারা কখনই পর স্ত্রীর দিকে দৃষ্টিপাত মাত্র করে না। তুমি যা যা বলতে তাতে পান্ডবদের কাবু করা অসম্ভব।
একমাত্র যুদ্ধের মাধ্যমেই তাদের পরাজিত করা যাবে। রাত্রে গিয়ে পাঞ্চালনগর ঘিরে ফেলতে হবে। কৃষ্ণ যেন কোন ক্রমে না জানতে পারেন। অন্য রাজারাও যেন টের না পায়। তারপর সপুত্র দ্রুপদসহ পান্ডবদের মারতে হবে।
কর্ণের কথা শুনে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ‘সাধু, সাধু’ রবে তার প্রশংসা করতে করতে বলে -তোমার এ পরামর্শই সবচেয়ে ভাল। এখনই ভীষ্ম, বিদুর, দ্রোণকে ডাকতে পাঠাও। তাদের কি মত একবার যেনে নিই। এই বলে সকলকে শীঘ্র ডাকতে নির্দেশ দিলেন।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম কহেন সাধু সদা করেন পান।
..................
ভীষ্ম, দ্রোণ এবং বিদুরের যুক্তি-উক্তিঃ
রাজার আদেশে সকল মন্ত্রী ও সভাসদরা উপস্থিত হলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামা, বাহ্লীক(মহারাজ শান্তুনুর বড়ভাই), সোমদত্ত(বাহ্লীকপুত্র), ভূরিশ্রবা(সোমদত্তের পুত্র) প্রমুখ-এরা কুলে-শীলে-বুদ্ধি-বলে খ্যাত।
ধৃতরাষ্ট্র বলেন –হে জ্যেষ্ঠতাত, শুনছি যে কুন্তীসহ পান্ডবরা নাকি বেঁচে আছে! এতদিন তারা কোথায়, কি কারণে লুকিয়ে ছিল আমি তার কোন কারণ বুঝছি না। মনেহচ্ছে আমার উপর তাদের কোন আক্রোশ আছে তাই পাঞ্চালদেশে গুপ্তবেশে রয়েছে। কিন্তু আমি তো কারো প্রতি কোন অন্যায় করিনি। এমন কি তারা আমায় কিছু না জানিয়ে বিবাহও করে নিল। এখন আমার কি কর্তব্য তোমরা বলে দাও।
শুনে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম বলেন –পান্ডবরা তোমায় পুত্রের অধিক সেবা করত, সন্মান করত। তুমিও তাদের ভালবাসতে। কি কারণে, কোন বুদ্ধিতে হঠাৎ তুমি তাদের বারণাবতে পাঠালে বুঝলাম না। সেখানে পুরোচন কি করল জানা নেই। তবে সবাই রটাল জতুগৃহে তারা সকলে মারা গেছে।
ত্রিভুবনে আমার অকীর্তি রটল। সবাই বলল ভীষ্ম থাকতে এমন ঘটনাও ঘটল। যবে থেকে জতুগৃহ দাহ হল তবে থেকে আমি কারো চোখে চোখ দিয়ে তাকাতে পারি না। আজ যখন জানছি মায়ের সাথে পান্ডুরপুত্ররা বেঁচে আছে, সে তো আমাদের সৌভাগ্যের খবর। আমাদের উপর থেকে সব অপযশ, অধর্ম তবে উঠে গেল।
তোমার ধর্মবুদ্ধি উদয় হোক। এখন তোমার প্রথম কাজই হল পান্ডুপুত্রদের সাথে মিলিত হওয়া। এ কেবল আমার কথা নয়, সকলেই তা মনে করেন। আমার কাছে তুমি ও পান্ডু দু’জনেই সমান স্নেহের নৃপতি। কুন্তী ও গান্ধারীও সমান। তেমনি যুধিষ্ঠির ও দূর্যোধনকেও সমান মানি। এদের সাথে ভেদাভেদ করা উচিত নয় রাজন। তাই পান্ডুপুত্রদের সাথে দ্বন্দ্ব কিসের কারণ।
এদের পিতা পান্ডু ছিলেন পৃথিবীর রাজা। এই সৈন্য, রাজ্য, ধন-দৌলত, প্রজা সবই তো তার। সে বেঁচে থাকলে এদের কি ত্যাগ করতেন। তোমার ভালর জন্যই বলছি অর্ধেক রাজ্য তাদের দিয়ে পান্ডবদের বশে রাখ। তাতেই পৃথিবীতে তোমার যশ হবে।
কীর্ত্তি রাখ নরপতি, কীর্ত্তিই বড় ধন। অভাজনরা হত কীর্ত্তি নিয়ে জীয়ন্তে মরণ লাভ করে। কীর্ত্তিই ধরণীতে থেকে যায়। এতে তোমার সকল পূর্বদোষও খন্ডিত হবে।
ভীষ্মের বচনের শেষে গুরু দ্রোণ বলেন –তুমি সর্ব গুণবান, নিজের হিতাহিত বিচার কর। সব মন্ত্রীরা যখন এখানেই আছেন তখন সবার সামনেই বলতে চাই। শুনুন হে ক্ষত্রিয়গণ আমার বিচার হচ্ছে ধর্ম, অর্থ, যশ সবার কল্যাণের জন্য। মহামতি গঙ্গাপুত্রও তাই বললেন। এখনই রাজা একজন প্রিয়ংবদ(মধুরভাষী) পাঠান পাঞ্চাল দেশে। সে বিবাহের সামগ্রী নানা অলঙ্কার দ্রব্য নিয়ে মঙ্গল বাজনা বাজিয়ে যাক।
অনেক অলঙ্কার দ্রৌপদীকে পাঠান, নানা রত্নে পঞ্চভাইকে তুষুন। মা কুন্তীকেও পুনঃপুন সান্তনা দিয়ে পূর্বের দুঃখের কথা ভেবে দুঃখী হতে নিষেধ করবে।
দ্রুপদ রাজার জন্যেও বহুধন ভেট করবে। তার পুত্ররাও সব দেখবে।
এমন কোন সুশীল সত্যবাদীকে পাঠাতে হবে যাতে পান্ডবদের সাথে তোমার বিবাদ উপস্থিত না হয়।
দ্রোণ ও ভীষ্মের এত কথা শুনে ক্রোধে বৈকর্ত্তন(কর্ণ) বলে ওঠে –ভাল মন্ত্রীদের আনা হয়েছে মন্ত্রণা করতে। এরা সবাই শত্রুর অংশে খ্যাত এ সংসারে। মুখে সুহৃদ কিন্তু অন্তরে বৈরীতা এদের কথা থেকেই অনুমান করা যায়।
পান্ডবদের অংশ দেওয়া মানেই নিজের বিপদ ডাকা। রাজা হয়ে যে নিজেরটা না বুঝে নেয় সে দুষ্ট মন্ত্রীদের মন্ত্রণায় সবংশে মরে।
কর্ণের বচন শুনে ক্রোধে ভরদ্বাজকুমার দ্রোণ বলেন –ওরে দুষ্ট শুনি তোর কি বিচার! সবার সাথে সব সময় কলহ করতে চাও। যমের বাড়ি যাওয়ার খুব ইচ্ছা দেখি। তোমার বীরত্ব জানা আছে। পাঞ্চালরাজ্যে সবাই তা দেখে এসেছি। লক্ষ রাজা নিয়ে অর্জুনকে ঘিরে ধরলে, শেষে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচলে। সেই তাদের সাথে আবার কলহ করার ইচ্ছে! তোমার মত নির্লজ্জ সংসারে আর দেখি নি। আমি এমতে সায় দিচ্ছি না, এতে মহা কুলক্ষয় হবে, সবাই মরবে।
এতসব শুনে মহামতি বিদুর বলেন –কি হেতু মহারাজ চুপ করে আছেন! আপনি কি এখনও নিজের ভালটা বুঝবেন না। ভীষ্ম, দ্রোণের মত সুহৃদ আর কে আপনার আছে! এদের সমান গুণি কে জগতে আছেন। এঁনারা বিচারে অমরগুরু, তেজে আখন্ডল(ইন্দ্র), ধর্মেতে সাক্ষাৎ ধর্ম- ত্রিভুবন খ্যাত, শীলতায় যেন রঘুনাথ। ভীষ্ম কখনই তোমার অহিত ভাবেন না। তোমার হিতের কথা সর্ব লোকে তিনি ঘোষণা করেন। এই দুই গুরুর বাক্য ঠেলে আপনি দুষ্ট অধোগামী হচ্ছেন! কেন আপনি চুপ করে আছেন!
ভীষ্ম ও দ্রোণ যা বললেন সবার তাই মত। সেই মত না করতে চাইলে কি করার ইচ্ছে সেটা বলুন। মনে হচ্ছে আপনি কলহের পথ নিতে চান। কিন্তু অর্জুনের হাত থেকে কে আপনাকে বাঁচাবে। এই কর্ণ, না সসৈন্য দুর্যোধন! পাঞ্চালে এক লক্ষ নরপতি তার বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু পার্থ একাই সকলকে জয় করেছিল। বৃকোদর ভীমের কীর্তির কথাও শুনে থাকবেন। অস্ত্রহীন বৃক্ষ নিয়ে রণে প্রবেশ করে এক লক্ষ রাজার সৈন্যদের নাশ করে। যে রাজারা হেরে গেছেন তারা পঞ্চপান্ডবের বশ্যতা মানবে। তারাই আজ পান্ডবদের সহায় হবে। আর এখন পঞ্চপান্ডব স্বঅস্ত্রেও যুদ্ধ করতে পারবে।
তাদের সহায় আছেন বিশ্বপতি নারায়ণ কৃষ্ণ, ফলে দ্বারাবতীর যদুরাও তাদের পক্ষে যাবে। মামাতোভাই বলভদ্রের বিক্রম সহায় হবে। শ্বশুর দ্রুপদসহ তার পুত্রদের ও সাহায্য পাবে। আর এখন আপনার রথীদের অবস্থা আপনি জানেন।
এভাবে বুঝতে পারছেন সব কিছুই পান্ডবদের সহায় হবে। তাই দ্বন্দ্ব ইচ্ছা যে করছেন তা কার ভরসায়।
আর একটা বার্তা আপনার জানা নেই, রাজন! রাজ্যবাসীরা যুক্তি করছে পান্ডুপুত্র বেঁচে আছেন শুনে তাদের প্রাণের বাসনা যুধিষ্ঠির রাজা হয়। তাই রাজা এই শিশুদের কথা না শুনে আমাদের কথা শুনুন, আমরা অনেক বিচার করেই আপনার সপক্ষে কথা বলছি। জতুগৃহ পুড়িয়ে সবাই অন্তরে অন্তরে আজ লজ্জিত হয়ে পুর দোষটা পুরোচনের উপর চাপাচ্ছে। এলজ্জা ঘোচাতে হলে প্রিয়বাক্য বলে পান্ডুপুত্রদের হস্তিনায় নিয়ে আসুন। এতে জগতে কিছুটা মান বাড়বে।
বিদুরের সকল কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র বলেন – বিদুর যা বললে, আমার মনে ধরেছে। পান্ডবদের এ অবস্থায় প্রবোধে এমন কাউকে পাচ্ছি না, তুমিই যাও তাদের কাছে।
অন্ধ রাজার একথা শুনে সভাজনরা খুশি হল।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী, কাশীদাস কহিছে শ্রবণে ভবে তরি।
...................................
পান্ডবদিগের বিবাহ-বার্তা শ্রবণ করিয়া দুর্য্যোধনাদির মন্ত্রণাঃ
ধৃতরাষ্ট্র পান্ডবদের বিবাহ সংবাদ পাওয়ার তিনদিন পর ভগ্নমনে দুর্যোধন দেশে ফিরলেন। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে যাওয়ার সময় সে দশ অক্ষৌহিনী সৈন্য নিয়ে গেছিল। পঞ্চ অক্ষৌহিনী নিয়ে সে বহুকষ্টে দেশে ফিরল। কারো রথের ধ্বজা কাটা গেল, কারো পা কাটা পরেছে, কারোবা নাক, ঠোঁট। কারো মুখেই কথা নেই, শরীর অতি ম্লান। চামর, ছাতা, বাণ কোন কিছুরই চিহ্ন নেই।
দেশে ফিরে দুর্যোধন পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে প্রণাম জানাল। পিতা আশীর্বাদ করে জিজ্ঞেস করল –বল পুত্র, যুধিষ্ঠিরের সাথে তোমার দেখা হল! বিবাহ কি বহু সাড়ম্বরে সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন করলে! কি ভাবে তোমার পান্ডবদের সাথে দেখা হল, তুমি কি পঞ্চপান্ডবদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছো!
পিতার প্রশ্ন শুনে দুর্যোধন চমকে উঠল। ধিরে ধিরে সে বুঝতে পারল সেই ব্রাহ্মণরাই ছদ্মবেশী পান্ডবকুমার।
কর্ণ রেগে বলে ওঠে –মহারাজ কি কথা বলছেন! আমার পরম শত্রু পঞ্চপান্ডব। পরিচয় পেলে তাদের প্রাণে মেরে ফেলতাম। ব্রাহ্মণের ছন্মবেশ ধরেছিল। ব্রাহ্মণ হত্যা পাপ বলে তখন ক্ষমা করেছিলাম। প্রকৃত পরিচয় জানলে, পান্ডুপুত্র রূপে চিনতে পারলে অবশ্যই তখন তাদের প্রাণ নিতাম। এখন আপনার কাছে প্রকৃত পরিচয় জানতে পারলাম।
দুর্যোধন বলে –কি ভাবে জানবো যে এখনও পঞ্চপান্ডব বেঁচে আছে। ধিক্ ধিক্ পুরোচন! ভাল হয়েছে সে বেটা পুড়ে মরেছে। এখন যে লজ্জায় মরতে ইচ্ছে করছে। এখন কি করি! শিয়রে শত্রু শমনের(যমের) মত দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি। এখনই যদি একটা উপায় না বার করা যায়, তবে পরে আরো বড় অনর্থ হবে দেখতে পাচ্ছি। এখনই দ্রুপদরাজার কাছে গোপনে লোক পাঠাও। পাঞ্চালরাজকে বল আমার অর্ধেক রাজ্য তিনি ভোগ করুন। ধৃষ্টদ্যুম্নকেও আমাদের সখা করে নেব। কেবল আমার পরম শত্রু পান্ডবদের তিনি হত্যা করুন।
নয়ত কিছু সুন্দরী রূপসী নারী পান্ডবদের জন্য পাঠাও। পান্ডবরা তাদের সাথে বসবাস করুক, দ্রৌপদীর অনাদর হোক। তখন দ্রুপদরাজা ক্রোধিত হয়ে তাদের হত্যা করবে। নয়ত কোন বুদ্ধিমান ব্রাহ্মণকে সেখানে পাঠাও যে পাঁচভায়ের মধ্যে ভেদ ঘটাবে। একবার পঞ্চপান্ডবদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হলে কেউ তাদের বাঁচাতে পারবে না।
নয়ত আমাদের অন্তপুরেরই কেউ একজন গিয়ে পান্ডবদের সামনে পূর্ব শোকে কেঁদে পরুক। তবে তাকে পঞ্চপান্ডব বিশ্বাস করতে শুরু করবে। তখন সে বিষ দিয়ে বৃকোদর ভীমকে হত্যা করবে। ভীম বিনা পান্ডবরা অনাথ হয়ে যাবে। কর্ণের সাথে যুদ্ধে অর্জুন সহজে হেরে যাবে।
দুর্যোধনের কথা শুনে কর্ণ বলে –কোন কথাই তোমার আমার মনে ধরল না। দ্রুপদরাজাকে তুমি ধনের লোভ দেখাচ্ছ। যান পঞ্চপান্ডবকে পেলে ত্রৈলোক্যের কেউই তাদের ছারতে চায় না। একে তারা জামাই। তার উপর এমন বীর ও শক্তিশালী। এখন কি আর দ্রুপদ আগের মত আর দুর্বল রইলেন!
কুটিল ব্রাহ্মণের দ্বারাও আর কিছু করা সম্ভব নয়, পঞ্চভায়ের দেখ একই নারী স্ত্রী হল।
এখানে যখন ছিল তখনইবা কে ভীমকে মারতে পেরেছিল। তাকে মারা অসম্ভব। বিষ দেওয়া হয়েছিল, নানা রকম ভাবে তাদের যন্ত্রণাও দিয়েছিলে। এমন কি শেষে জতুগৃহে পুড়িয়েও মারলে। এত তো চেষ্টা করলে, সবই বিফল হয়ে এখন আমাদের অসহায় অবস্থা। অন্যদিকে পান্ডবদের এখন অনেক সহায় হয়েছে। পুরনারী তাদের কি ক্ষতি করবে! তারা কখনই পর স্ত্রীর দিকে দৃষ্টিপাত মাত্র করে না। তুমি যা যা বলতে তাতে পান্ডবদের কাবু করা অসম্ভব।
একমাত্র যুদ্ধের মাধ্যমেই তাদের পরাজিত করা যাবে। রাত্রে গিয়ে পাঞ্চালনগর ঘিরে ফেলতে হবে। কৃষ্ণ যেন কোন ক্রমে না জানতে পারেন। অন্য রাজারাও যেন টের না পায়। তারপর সপুত্র দ্রুপদসহ পান্ডবদের মারতে হবে।
কর্ণের কথা শুনে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ‘সাধু, সাধু’ রবে তার প্রশংসা করতে করতে বলে -তোমার এ পরামর্শই সবচেয়ে ভাল। এখনই ভীষ্ম, বিদুর, দ্রোণকে ডাকতে পাঠাও। তাদের কি মত একবার যেনে নিই। এই বলে সকলকে শীঘ্র ডাকতে নির্দেশ দিলেন।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম কহেন সাধু সদা করেন পান।
..................
ভীষ্ম, দ্রোণ এবং বিদুরের যুক্তি-উক্তিঃ
রাজার আদেশে সকল মন্ত্রী ও সভাসদরা উপস্থিত হলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামা, বাহ্লীক(মহারাজ শান্তুনুর বড়ভাই), সোমদত্ত(বাহ্লীকপুত্র), ভূরিশ্রবা(সোমদত্তের পুত্র) প্রমুখ-এরা কুলে-শীলে-বুদ্ধি-বলে খ্যাত।
ধৃতরাষ্ট্র বলেন –হে জ্যেষ্ঠতাত, শুনছি যে কুন্তীসহ পান্ডবরা নাকি বেঁচে আছে! এতদিন তারা কোথায়, কি কারণে লুকিয়ে ছিল আমি তার কোন কারণ বুঝছি না। মনেহচ্ছে আমার উপর তাদের কোন আক্রোশ আছে তাই পাঞ্চালদেশে গুপ্তবেশে রয়েছে। কিন্তু আমি তো কারো প্রতি কোন অন্যায় করিনি। এমন কি তারা আমায় কিছু না জানিয়ে বিবাহও করে নিল। এখন আমার কি কর্তব্য তোমরা বলে দাও।
শুনে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম বলেন –পান্ডবরা তোমায় পুত্রের অধিক সেবা করত, সন্মান করত। তুমিও তাদের ভালবাসতে। কি কারণে, কোন বুদ্ধিতে হঠাৎ তুমি তাদের বারণাবতে পাঠালে বুঝলাম না। সেখানে পুরোচন কি করল জানা নেই। তবে সবাই রটাল জতুগৃহে তারা সকলে মারা গেছে।
ত্রিভুবনে আমার অকীর্তি রটল। সবাই বলল ভীষ্ম থাকতে এমন ঘটনাও ঘটল। যবে থেকে জতুগৃহ দাহ হল তবে থেকে আমি কারো চোখে চোখ দিয়ে তাকাতে পারি না। আজ যখন জানছি মায়ের সাথে পান্ডুরপুত্ররা বেঁচে আছে, সে তো আমাদের সৌভাগ্যের খবর। আমাদের উপর থেকে সব অপযশ, অধর্ম তবে উঠে গেল।
তোমার ধর্মবুদ্ধি উদয় হোক। এখন তোমার প্রথম কাজই হল পান্ডুপুত্রদের সাথে মিলিত হওয়া। এ কেবল আমার কথা নয়, সকলেই তা মনে করেন। আমার কাছে তুমি ও পান্ডু দু’জনেই সমান স্নেহের নৃপতি। কুন্তী ও গান্ধারীও সমান। তেমনি যুধিষ্ঠির ও দূর্যোধনকেও সমান মানি। এদের সাথে ভেদাভেদ করা উচিত নয় রাজন। তাই পান্ডুপুত্রদের সাথে দ্বন্দ্ব কিসের কারণ।
এদের পিতা পান্ডু ছিলেন পৃথিবীর রাজা। এই সৈন্য, রাজ্য, ধন-দৌলত, প্রজা সবই তো তার। সে বেঁচে থাকলে এদের কি ত্যাগ করতেন। তোমার ভালর জন্যই বলছি অর্ধেক রাজ্য তাদের দিয়ে পান্ডবদের বশে রাখ। তাতেই পৃথিবীতে তোমার যশ হবে।
কীর্ত্তি রাখ নরপতি, কীর্ত্তিই বড় ধন। অভাজনরা হত কীর্ত্তি নিয়ে জীয়ন্তে মরণ লাভ করে। কীর্ত্তিই ধরণীতে থেকে যায়। এতে তোমার সকল পূর্বদোষও খন্ডিত হবে।
ভীষ্মের বচনের শেষে গুরু দ্রোণ বলেন –তুমি সর্ব গুণবান, নিজের হিতাহিত বিচার কর। সব মন্ত্রীরা যখন এখানেই আছেন তখন সবার সামনেই বলতে চাই। শুনুন হে ক্ষত্রিয়গণ আমার বিচার হচ্ছে ধর্ম, অর্থ, যশ সবার কল্যাণের জন্য। মহামতি গঙ্গাপুত্রও তাই বললেন। এখনই রাজা একজন প্রিয়ংবদ(মধুরভাষী) পাঠান পাঞ্চাল দেশে। সে বিবাহের সামগ্রী নানা অলঙ্কার দ্রব্য নিয়ে মঙ্গল বাজনা বাজিয়ে যাক।
অনেক অলঙ্কার দ্রৌপদীকে পাঠান, নানা রত্নে পঞ্চভাইকে তুষুন। মা কুন্তীকেও পুনঃপুন সান্তনা দিয়ে পূর্বের দুঃখের কথা ভেবে দুঃখী হতে নিষেধ করবে।
দ্রুপদ রাজার জন্যেও বহুধন ভেট করবে। তার পুত্ররাও সব দেখবে।
এমন কোন সুশীল সত্যবাদীকে পাঠাতে হবে যাতে পান্ডবদের সাথে তোমার বিবাদ উপস্থিত না হয়।
দ্রোণ ও ভীষ্মের এত কথা শুনে ক্রোধে বৈকর্ত্তন(কর্ণ) বলে ওঠে –ভাল মন্ত্রীদের আনা হয়েছে মন্ত্রণা করতে। এরা সবাই শত্রুর অংশে খ্যাত এ সংসারে। মুখে সুহৃদ কিন্তু অন্তরে বৈরীতা এদের কথা থেকেই অনুমান করা যায়।
পান্ডবদের অংশ দেওয়া মানেই নিজের বিপদ ডাকা। রাজা হয়ে যে নিজেরটা না বুঝে নেয় সে দুষ্ট মন্ত্রীদের মন্ত্রণায় সবংশে মরে।
কর্ণের বচন শুনে ক্রোধে ভরদ্বাজকুমার দ্রোণ বলেন –ওরে দুষ্ট শুনি তোর কি বিচার! সবার সাথে সব সময় কলহ করতে চাও। যমের বাড়ি যাওয়ার খুব ইচ্ছা দেখি। তোমার বীরত্ব জানা আছে। পাঞ্চালরাজ্যে সবাই তা দেখে এসেছি। লক্ষ রাজা নিয়ে অর্জুনকে ঘিরে ধরলে, শেষে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচলে। সেই তাদের সাথে আবার কলহ করার ইচ্ছে! তোমার মত নির্লজ্জ সংসারে আর দেখি নি। আমি এমতে সায় দিচ্ছি না, এতে মহা কুলক্ষয় হবে, সবাই মরবে।
এতসব শুনে মহামতি বিদুর বলেন –কি হেতু মহারাজ চুপ করে আছেন! আপনি কি এখনও নিজের ভালটা বুঝবেন না। ভীষ্ম, দ্রোণের মত সুহৃদ আর কে আপনার আছে! এদের সমান গুণি কে জগতে আছেন। এঁনারা বিচারে অমরগুরু, তেজে আখন্ডল(ইন্দ্র), ধর্মেতে সাক্ষাৎ ধর্ম- ত্রিভুবন খ্যাত, শীলতায় যেন রঘুনাথ। ভীষ্ম কখনই তোমার অহিত ভাবেন না। তোমার হিতের কথা সর্ব লোকে তিনি ঘোষণা করেন। এই দুই গুরুর বাক্য ঠেলে আপনি দুষ্ট অধোগামী হচ্ছেন! কেন আপনি চুপ করে আছেন!
ভীষ্ম ও দ্রোণ যা বললেন সবার তাই মত। সেই মত না করতে চাইলে কি করার ইচ্ছে সেটা বলুন। মনে হচ্ছে আপনি কলহের পথ নিতে চান। কিন্তু অর্জুনের হাত থেকে কে আপনাকে বাঁচাবে। এই কর্ণ, না সসৈন্য দুর্যোধন! পাঞ্চালে এক লক্ষ নরপতি তার বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু পার্থ একাই সকলকে জয় করেছিল। বৃকোদর ভীমের কীর্তির কথাও শুনে থাকবেন। অস্ত্রহীন বৃক্ষ নিয়ে রণে প্রবেশ করে এক লক্ষ রাজার সৈন্যদের নাশ করে। যে রাজারা হেরে গেছেন তারা পঞ্চপান্ডবের বশ্যতা মানবে। তারাই আজ পান্ডবদের সহায় হবে। আর এখন পঞ্চপান্ডব স্বঅস্ত্রেও যুদ্ধ করতে পারবে।
তাদের সহায় আছেন বিশ্বপতি নারায়ণ কৃষ্ণ, ফলে দ্বারাবতীর যদুরাও তাদের পক্ষে যাবে। মামাতোভাই বলভদ্রের বিক্রম সহায় হবে। শ্বশুর দ্রুপদসহ তার পুত্রদের ও সাহায্য পাবে। আর এখন আপনার রথীদের অবস্থা আপনি জানেন।
এভাবে বুঝতে পারছেন সব কিছুই পান্ডবদের সহায় হবে। তাই দ্বন্দ্ব ইচ্ছা যে করছেন তা কার ভরসায়।
আর একটা বার্তা আপনার জানা নেই, রাজন! রাজ্যবাসীরা যুক্তি করছে পান্ডুপুত্র বেঁচে আছেন শুনে তাদের প্রাণের বাসনা যুধিষ্ঠির রাজা হয়। তাই রাজা এই শিশুদের কথা না শুনে আমাদের কথা শুনুন, আমরা অনেক বিচার করেই আপনার সপক্ষে কথা বলছি। জতুগৃহ পুড়িয়ে সবাই অন্তরে অন্তরে আজ লজ্জিত হয়ে পুর দোষটা পুরোচনের উপর চাপাচ্ছে। এলজ্জা ঘোচাতে হলে প্রিয়বাক্য বলে পান্ডুপুত্রদের হস্তিনায় নিয়ে আসুন। এতে জগতে কিছুটা মান বাড়বে।
বিদুরের সকল কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র বলেন – বিদুর যা বললে, আমার মনে ধরেছে। পান্ডবদের এ অবস্থায় প্রবোধে এমন কাউকে পাচ্ছি না, তুমিই যাও তাদের কাছে।
অন্ধ রাজার একথা শুনে সভাজনরা খুশি হল।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী, কাশীদাস কহিছে শ্রবণে ভবে তরি।
...................................