Blog Archive

Saturday, January 31, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭৪

[পূর্বকথা –গন্ধর্ব অর্জুনকে বিভিন্ন কাহিনীর মধ্য দিয়ে বোঝালেন তাদেরও একজন পুরোহিত প্রয়োজন সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য......তারই কথা মত পাণ্ডবরা দেবল ঋষির কনিষ্ঠ ভাই ধৌম্যকে পৌরোহিত্যে বরণ করে নিলেন এবং পাঞ্চালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

দ্রৌপদীর স্ব্য়ম্বরঃ- 
 

পাঞ্চাল নগরে পঞ্চপান্ডব এক কুম্ভকারের গৃহে অতিথিরূপে আশ্রয় নিলেন। তারা ব্রাহ্মণের বেশে থাকেন ও ভিক্ষা করেন। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যায়। 

এদিকে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ কন্যার স্বয়ম্বরের অদ্ভূত আয়োজন করতে থাকেন। যখন দ্রৌপদী সুন্দরীর জন্ম হল অগ্নি থেকে তখনই দ্রুপদ ঠিক করে ফেলেছিলেন এই কন্যার যোগ্য বর হবেন বীর ধনঞ্জয় অর্জুন। কিন্তু জতুগৃহে পঞ্চপান্ডবের মৃত্যুর সংবাদ পেলে দ্রুপদ তা বিশ্বাস করেন নি। তিনি বহুদেশে পঞ্চপান্ডবদের খোঁজার জন্য দূত পাঠান। কিন্তু কোন খবর না পেলে চিন্তিত হন। শেষে অনেক চিন্তা করে এমন এক ধনুক তৈরী করান যা কেউ কখনও দেখে নি। তিনি শূণ্যে একটি যন্ত্র স্থাপন করে তার উপরে লক্ষ্য বস্তুটি রাখলেন। পঞ্চশরসহ সেই ধনুকটি সভায় রাখলেন। 
এই ধনুঃশরে ঐ যন্ত্র রন্ধ্রপথ দিয়ে যে লক্ষ্যভেদ করবে তার সাথেই কন্যার বিবাহ হবে- রাজা এমন ঘোষণা করলেন। 
সেই মত সর্বত্র রাজাদের নিমন্ত্রণ করা হল। সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত সকল রাজ্যের রাজারা আমন্ত্রণ পেয়ে সসৈন্য পাঞ্চালে উপস্থিত হলেন। এত রথ, অশ্ব, পদাতিক এল যে গুণে শেষ করা যায় না। চারদিকে বিবিধ বাজনা বাজতে থাকে, মহা কোলাহল। জল, স্থল, পর্বত, কানন, নদ, নদী পেরিয়ে-দশদিক থেকে সকলে পাঞ্চাল রাজ্যে আসতে থাকে। ধ্বজা, ছাতা, পতাকায় আকাশ ঢেকে গেল। চারদিকে এত মানুষের কলরব যে কিছুই শোনা যায় না। নগরের ঈশান ভাগে অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব দিকে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ এক বিচিত্র মনোহর সভা রচনা করলেন। চারদিকে সুপরিসর মঞ্চ রচিত হল। বিবিধ বসন, মণি, রত্ন দিয়ে তাদের মুড়ে দেওয়া হল। কৈলাস শিখরের মত সুন্দর সুসজ্জিত রাজাদের ঘর তৈরী করা হল। সোনা, রূপা, মণি, মুক্তা, প্রবাল দিয়ে মঞ্চ বেষ্টিত করে যেন সুবর্ণের জাল তৈরী হল। গুবাক(সুপারী) ও কলাগাছ স্থানে স্থানে মঙ্গলসূচক রূপে স্থাপিত হল। উপর নীচ কেটে তাদের সমান করা হল। চারদিকে চন্দন ছড়িয়ে ধুলো নাশ করা হল। সুগন্ধি কুসুম গন্ধে ভ্রমররাও মত্ত হয়ে উঠল। মঞ্চের স্থানে স্থানে বিচিত্র সিংহাসন রাখা হল। বিচিত্র উত্তম শয্যা, বিচিত্র বসন, চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় যা লিখে শেষ করা যায় না। বহুদিন ধরে এসব ধিরে ধিরে সঞ্চয় করা হয়েছিল। আমন্ত্রিত রাজারা মঞ্চের উপর তাদের যথাযোগ্য স্থানে বসলেন। এ যেন আরেক ইন্দ্রের সভা বসল অমর ভুবনে। রাজাদের নানা চিত্র-বিচিত্র বিবিধ বিভূষণ। কানে তাদের কুন্ডল, গলায় মণিমুক্তার হার। মাথায় মুকুট, অঙ্গে নানা অলঙ্কার। সকলেই রূপবন্ত, কুলবন্ত, বলে মহাবলীয়ান, সর্বশাস্ত্রে বিশারদ, সর্ব গুণশালী। এত রাজা এলেন যে সকলের বর্ণনা সম্ভব নয়। সকলে চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে উপস্থিত। 
ধৃতরাষ্ট্রের একশত কুমার সহ দুর্যোধন, দুঃশাসন, ভীষ্ম, দ্রোণ, দ্রোণী অশ্বত্থামা, কর্ণ, কৃপ, সোমদত্ত(বাহ্লীকরাজপুত্র, সম্পর্কে ধৃতরাষ্ট্রের কাকা) কুরুবীররা কোটি কোটি রথ, অশ্ব, পদাতিক নিয়ে এল। এছাড়া- জরাসন্ধ, জয়সেন, শল্য, শল্ব, সুবল পুত্র শকুনি-যিনি গান্ধার(বর্তমান সিন্ধপ্রদেশ, রাওলপিন্ড) রাজপুত্র ও মহাবীর, অংশুমান, চেদিপাল, পশুপাল, শ্বেতশঙ্খ, বিরাট, প্রতিভূতি, পুন্ডরীক, রুক্মাঙ্গদ, রুক্মরথ, রুক্মী, শতভাই কলিঙ্গ, বৃন্দ, অনুবৃন্দ, চিত্রসেন, জয়দ্রুথ, নীলধ্বজ, শ্রীবৎস রাজা সত্রাজিত, চিত্র, উপচিত্র, দূর্বানন্দ, বৃহক্ষত্র, উলূক, জলসন্ধ, ভগদত্ত, চক্রসেন, শূরসেন, চিত্রাঙ্গদ, শুভাঙ্গদ, শিরসিবাহন, ভূরিশ্রবা, সুশর্মা, বাহ্লীক প্রমূখ আরো অনেক বীর এলেন ও যথাযোগ্য স্থানে বসে সভা আলোকিত করলেন। 

 
দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর শুনে ইন্দ্রও উপস্থিত হলেন দেখতে। তাঁর সাথে দেবলোকের যম, কুবের, বরুণ, হুতাশন-অগ্নি সহ তেত্রিশকোটি দেবতা, গন্ধর্ব, চারণ, সিদ্ধ, বিদ্যাধর, ঋষি, অপ্সর, অপ্সরীরা উপস্থিত হলেন। নৃত্য-গীত-বাদ্যে সভা যেন স্বর্গপুরীতে পরিণত হল। স্বয়ং জগন্নাথ গরুড়ারোহণে উপস্থিত হলেন। পান্ডব বিবাহের জন্যেই তাঁর এই আগমন। তাঁর সাথে এলেন তাঁর আত্মীয়েরা-কামদেব(কৃষ্ণ ও রুক্মিণীর পুত্র) , গদ(যাদববীর), শাম্ব(কৃষ্ণ ও জাম্ববতীর পুত্র), চারুদেষ্ণ, সাত্যকি(যাদববীর), সারণ(কৃষ্ণের বৈমাত্রের ভাই, সুভদ্রার সহোদর), বিদুরথ, কৃতবর্মা, উদ্ধব, অক্রুর(কৃষ্ণের সখা), পৃথুঝিল্লী, পিন্ডারক, শঙ্কু, উশীনর। 
খগপতি গরুড়ের সাহায্যে নারায়ণ শূণ্যেই অবস্থান করলেন। নারায়ণ বিষ্ণু স্বয়ং শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন। পাঞ্চজন্য (পঞ্চজন-নামক দৈত্যের অস্থি দ্বারা নির্মিত) শঙ্খনাদে স্বর্গ-মর্ত-পাতাল পূর্ণ হল। পৃথিবীর সকল বাদ্যের শব্দ যেন লুকালো। যত সভ্যরা সভায় বসেছিলেন গোবিন্দকে(কৃষ্ণ) আসতে দেখে সম্ভ্রমে উঠে দাড়ালেন। 
 

ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, সত্যসেন, সত্রাজিত, শল্য, ভূরিশ্রবা, ক্রথ, কৌশিক- সকলে যুক্তকরে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানালেন। দুষ্ট রাজারা তা দেখে হাসল। শিশুপাল, শাল্ব, দন্তবক্র, জরাসন্ধ প্রমুখ দুষ্টচক্র। তারা বলে – কাকে সবাই এত ভক্তিভরে প্রণাম করলে দেবতা কি পশুত্ব ত্যাগ করে কাম জাগ্রত করবে! 
হাততালি দিয়ে শিশুপাল বলে – সবার থেকে ভাল শঙ্খ বাজায় গোপাল। দ্রুপদ তাঁকে বাদ্যকরদের নিয়ে বাজনা বাজাবার জন্যই বরণ করে নিয়ে এসেছেন। 
জরাসন্ধ বলে- ভীষ্ম, তুমিতো জানতাম জ্ঞানবান। তোমার মত জ্ঞানী ব্যক্তি এমন অজ্ঞান হলেন কি করে! সবার মাঝে তুমি কি কান্ড করলে! গোপপুত্রকে কি কখনও ক্ষত্রিয়ের প্রণাম করা সাজে! নন্দগোপের গৃহে এ চিরকাল থেকেছে। গোপেদের অন্নে প্রতিপালিত হয়ে গরুর পাল চরিয়েছে। সর্বজ্ঞ হিসেবে তুমি ভারতখ্যাত, ভীষ্ম! সব জেনে তুমি এমন কান্ড করলে! 

ভীষ্ম বলেন- ওসব বুঝি না। আমি পুরাতন বৃদ্ধ জ্ঞানী মানুষদের মুখে শুনে এসেছি গোপালের চরিত্র বেদের অগোচর। তিনলোকে কে তাঁর সম্পর্কে বলতে পারে! তিনি তাঁর এক লোমকূপে ব্রহ্মান্ড ধারণ করতে পারেন। সেই প্রভূই এই গোপাল অবতাঁর। মায়াভরে মনুষ্যদেহ ধারণ করে এলেন। তাঁর লীলায় পৃথিবীবাসী ধন্য হল। এঁনার নাভি কমল থেকেই স্রষ্টা ব্রহ্মার সৃজন হয়েছিল। এঁনার ললাট বা কপাল থেকে বিধাতার জন্ম, চক্ষু থেকে সূর্যের। এঁনার মনেতে জন্মালেন চন্দ্র, নিশ্বাসে পবন। ব্রহ্মান্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীট থেকে শ্রেষ্ঠ মহীপাল সবার মধ্যেই মায়ারূপে এই গোপালের অবস্থান। হর্তা-কর্তা বিধাতা যিনি তিনিও গোপালের চরণ বন্দনা করেন। পঞ্চমুখে সর্বক্ষণ মহেশ্বর শিব এঁনাকেই প্রণাম জানান। চারি মুন্ডে বিধাতা ব্রহ্মা, সহস্র মুন্ডে শেষনাগ যাকে প্রণাম জানান তাদের কাছে আমি তো সামান্য মনুষ্য মাত্র! হে রাজন, অজ্ঞান হয়ে তুমি এমন কথা বললে। 

ভীষ্মের কথা শুনে বৃহদ্রথের পুত্র তথা মগধরাজ জরাসন্ধ হেসে বলে- ভ্রান্তির বশে তুমি এসব বলছো। যখন এই দুষ্ট আমার জামাতা কংসকে হত্যা করল, কৈ তখন তো এসবের নিদর্শন পেলাম না! এতো তখন আমার ভয়ে মথুরা ত্যাগ করে সিন্ধুতীরে গেল। এ যদি দেব নারায়ণ হন, তবে ভীষ্ম বল কেন আমার ভয়ে পালাল। 

ভীষ্ম বলেন – সে সব কথা আমার জানা আছে। না জেনে আমি কিছুই বলি না। তবে শোন সকল কথা। পূর্বে ছিলে তুমি দৈত্য বিপ্রচিত্তি। কৃষ্ণের হাতে মরলে দিব্যগতি পেতে, তাই তিনি তোমায় মারলেন না। বলরাম না জেনে মারতে চাইলেন। আকাশবাণী শুনে তিনি আর তোমায় প্রাণে মারলেন না। তাঁর কাছে আঠারোবার হেরে যুদ্ধ ত্যাগ করলে। 
এত শুনে জরাসন্ধ ক্রোধে রক্তচক্ষে ভীষ্মকে দেখতে থাকে। 

ভীষ্মও তাঁর ক্রোধ মুখ দেখে বলেন – কি কারণে এত ক্রোধ তোমার, মগধরাজ! যেখানে কৃষ্ণের নিন্দা হয় সেখানে তিলমাত্র থাকার আমার রুচি নেই। আমি এখনই এস্থান ত্যাগ করছি। হয় নিন্দুককে মারি নয় সেস্থান উপেক্ষা করি। এই বলে তিনি সেখান থেকে অন্যস্থানে চলে যান। 
কাশীদাস বিরচিল শুনে পুণ্যবান। 

Tuesday, January 20, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭৩

[পূর্বকথা : শক্ত্রির পুত্র পরাশর পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাইলে পিতামহ বশিষ্ঠ তাকে শান্ত হতে বলে কৃতবীর্য্য-চরিত ও ভৃগুপুত্র ঔর্ব্বের বৃত্তান্ত শোনালে তিনি শান্ত হন কিন্তু পিতৃহন্তা রাক্ষস বধ যজ্ঞ শুরু করেন...রাক্ষসরা মরতে থাকলে পৌলস্ত্যমুনি তাকে শান্ত হতে অনুরোধ করেন...] 

বশিষ্ঠ মুনির ক্ষমাঃ 
 

গন্ধর্ব অর্জুনকে বলেন – হে, পান্ডুর নন্দন! সব পুরাতন কথাই তোমায় বললাম। বশিষ্ঠের ক্ষমার সমান সংসারে কেউ নেই। বিশ্বামিত্র তাঁর শতপুত্র সংহার করল, তবু তাকে সে রাগ দেখায় নি। যমের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বুঝে মুনি তাকে ক্ষমা করে দেন। নৃপতি কল্মাষপাদ, যিনি তাঁর শতপুত্র নাশ করল, তাকেও তিনি আপন ঔরসে পুত্র দান করেন। 

অর্জুন বলেন – কহ কি কারণে বশিষ্ঠ এমন কাজ করলেন। পরের স্ত্রী, তাঁর উপর অধর্মও বটে। 

 
গন্ধর্ব বলেন- শুন তাঁর কারণ। বশিষ্ঠের পুত্র শক্ত্রিমুনির অভিশাপে রাজা কল্মাষপাদ যখন রাক্ষস হয়ে ক্ষুধার জ্বালায় আকুল হয়ে অরণ্যে ঘুরছেন তখন তাঁর এক ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণীর সাথে দেখা হল। রাজাকে রাক্ষসরূপে দেখে তারা পালাল। রাক্ষসরাজা দৌড়ে গিয়ে ব্রাহ্মণকে ধরল। ভয়ে তাঁর যুবতী ব্রাহ্মণী বিলাপ করতে লাগল। 
কাতর স্বরে ব্রাহ্মণী বলল – হে, সৌদাস পুত্র, তুমি পৃথিবীর রাজা। তোমার পূর্বপুরুষরা সকলে ব্রাহ্মণদের শ্রদ্ধা করতেন। তুমি আমার স্বামীকে হত্যা করো না। আমি প্রথমবার ঋতুস্নান করলাম। বংশরক্ষার্থে আমার স্বামীর প্রাণদান করুন। যদি বেশি ক্ষুধার্ত হন তবে আমার স্বামীকে ছেড়ে আমায় ভক্ষণ করুন। 

কিন্তু বাহ্য জ্ঞানশূণ্য রাজা ব্রাহ্মণীর কাতর উক্তি কিছুই শুনতে পেলেন না। বাঘ যেমন পশু শিকার করে ভক্ষণ করে, তেমনি রাক্ষসরূপী রাজা ব্রাহ্মণের ঘাড় ভেঙ্গে রক্তপান করল। 

ব্রাহ্মণের মৃত্যু দেখে ব্রাহ্মণী স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বন থেকে কাঠ কুড়িয়ে এনে আগুন জ্বাললেন। 
অগ্নিকে প্রদক্ষিণ করে রাজাকে ডেকে বলেন – ওরে দুষ্ট, দুরাচার! আমি শাপ দিলাম আমার ঋতুরক্ষার্থে স্বামীকে না পেয়ে যেমন নিরাশ হলাম, তেমনি তুইও নিরাশ হবি। স্ত্রীকে স্পর্শ করলে তোরও অবশ্যই মৃত্যু হবে। এ অভিশাপ কেউ খন্ডন করতে পারবে না। তবে সূর্য্যবংশ রক্ষার্থে উপদেশ দিতে পারি তোর বংশ রক্ষার একমাত্র উপায় কোন ব্রাহ্মণই হবেন। 
এই বলে ব্রাহ্মণী অগ্নি মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। 

বারো বছর রাজা রাক্ষস হয়ে বনে ঘুরে বেড়াল। বশিষ্ঠের সাহায্যে তিনি মুক্ত হলেন। চেতনা ফিরে পেয়ে তিনি দেশে ফিরে গেলেন। 
স্নান, দান, জপ, হোম করে সিংহাসনে বসলেন। স্ত্রী মদয়ন্তীর শয়নকক্ষে গেলেন। স্ত্রী মদয়ন্তী রাজাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন ব্রাহ্মণীর সেই অভিশাপের কথা। রাজাকে রক্ষা করার জন্য তিনি তাকে স্পর্শ না করার অনুরোধ জানালেন। রাণীর কথায় রাজা নিজেকে সংযত করলেন। কিন্তু বংশরক্ষার কথা ভেবে চিন্তিত হলেন। সকলে বশিষ্ঠের স্মরণ নিতে বললে রাজা মুনি বশিষ্ঠের কাছে নিজের মহিষীকে পাঠিয়ে ছিলেন। এভাবে বশিষ্ঠের ঔরসে রাজার সন্তান হল। এভাবে সূর্য্যবংশ রক্ষা করেন বশিষ্ঠ মুনি।

সমস্ত ঘটনা জেনে অর্জুন সন্তুষ্ট হলেন। গন্ধর্বকে অর্জুন বিনয়ের সাথে বলেন – আপনি সব জানেন। আমি ব্যগ্র জানতে যে আমাদের উপযুক্ত পুরোহিত কে আছেন! রাজারা পুরোহিতের তেজে অনেক সঙ্কট থেকেই রক্ষা পান দেখছি। 

 
গন্ধর্ব বলেন – দেবল ঋষির কনিষ্ঠ ভাই ধৌম্য উৎকোচক তীর্থে তপস্যা করছেন। তাঁকেই পৌরোহিত্যে বরণ করতে পারেন। 

শুনে পার্থ প্রসন্ন হলেন। গন্ধর্বরাজাকে তিনি বলেন যা কিছু গন্ধর্বরাজ দান করলেন তা এখন তাঁর কাছেই থাকুক। দরকার মত তিনি চেয়ে নেবেন। গন্ধর্বরাজ খুশি হলেন। তারপর তারা পরস্পরকে সন্মান দেখিয়ে নিজেদের অভীষ্ট স্থানে প্রস্থান করলেন। 

কুন্তীসহ পঞ্চপান্ডব উৎকোচক তীর্থে গিয়ে ধৌম্যকে পুরোহিত রূপে বরণ করলেন। ধৌম্য আনন্দিত হয়ে তাদের আশীর্বাদ করলেন। ধৌম্যকে নিয়ে পান্ডবরা পাঞ্চালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। পথে আরো অনেক ব্রাহ্মণদের সাথে দেখা হল। 
 
ব্রাহ্মণরা প্রশ্ন করেন - তোমরা পাঁচজন কে, কোথা থেকে আসছো, কোথায় বা চলেছো! 
যুধিষ্ঠির বলেন – একচক্রা থেকে পাঁচভাই মাকে নিয়ে যাচ্ছি। 
ব্রাহ্মণরা বলেন – আমাদের সাথে চল পাঞ্চালরাজের কন্যার স্বয়ম্বরে। বহুদিন থেকেই সেখানে ব্রাহ্মণরা আসছেন। সবাই বিজয়ের আশায় বহু ধন দান করছেন। সেই সাথে অদ্ভূত স্বয়ম্বরও দেখা হবে। তোমাদের পাঁচজনকে দেখে যদি পাঞ্চালীর মনে ধরে তাহলে হয়ত কাউকে তিনি বরণও করতে পারেন। তোমরা পাঁচজনেই দেবতুল্য রূপবান, তিনি কাকে পছন্দ করেন সেটাও দেখার। 
এত বলে ব্রাহ্মণরা তাদের সঙ্গে নিয়ে পাঞ্চালনগরে চললেন। 
আদিপর্বের সবচেয়ে উত্তম বশিষ্ঠ উপাখ্যান। 
কাশীরাম দাস কহেন, শুনে পুণ্যবান। 
.................................... 

Saturday, January 10, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭২

[পূর্বকথা : শক্ত্রির পুত্র পরাশর পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাইলে পিতামহ বশিষ্ঠ তাকে শান্ত হতে বলে কৃতবীর্য্য-চরিত ও ভৃগুপুত্র ঔর্ব্বের বৃত্তান্ত শোনান..

পরাশরমুনির যজ্ঞঃ- 
 
এত শুনে পরাশর মুনির ক্রোধ শান্ত হল। কেবল রাক্ষস মারবেন বলে অঙ্গীকার করে বলেন – রাক্ষস আমার তাত(পিতা)কে ভক্ষণ করল। সেই পিতৃবৈরী নিশাচরদের হত্যা করব। পৃথিবীতে রাক্ষসের চিহ্ন রাখব না। 
পরাশর মুনি নিজে এ সঙ্কল্পে এত দৃঢ় ছিলেন যে বশিষ্ঠ মুনিও এতে কিছু করতে পারলেন না। 

পরাশর মুনি রাক্ষসবধ যজ্ঞ শুরু করলেন। সে ছিল এক অদ্ভূত যজ্ঞ। সে যজ্ঞে সব রাক্ষস মরতে শুরু করল। বেদমন্ত্র পড়ে পরাশর অগ্নিতে অঙ্গীকার করতে লাগলেন। রাক্ষস সংহারের। মন্ত্রের আকর্ষণে যত রাক্ষস ছিল পর্বত, নগর, বাগান, গ্রাম, দ্বীপ-দ্বীপান্তরে সেই লক্ষ্য লক্ষ্য কোটি কোটি অর্ব্বুদ অর্ব্বুদে হাহাকার কলরব উঠল। ব্যাকুল হয়ে কেউ উচ্চস্বরে কাঁদে। তাদের ভয়ঙ্কর সব রূপ। কারো সাতটা মুন্ড, কারো আঠারোটা হাত। বিকট দর্শন, সারা দেহে ঘন লোম, পর্বতের মত আকারের জিভ লক্‌লক্‌ করছে, বিপুল উদর, শুক্ল দেহ। কেউ বা পর্বতের কোটরে লোকাতে চেষ্টা করল। কেউ প্রাণ বাঁচাতে বৃক্ষ চেপে ধরল। কেউ বা সমুদ্রে প্রবেশ করল। পাতালে প্রবেশ করে কেউ বা দিগন্তরে যায়। তবু রাক্ষসসত্র যজ্ঞে আবালবৃদ্ধ সকল রাক্ষস দগ্ধ হতে লাগল। দশদিকে হাহাকার কলরব উঠল। প্রলয়কালে যেন সংসার ধ্বংস হচ্ছে। 
 

পরাশরের যজ্ঞে রাক্ষসরা মারা যাচ্ছে শুনে পৌলস্ত্যমুনি সেখানে উপস্থিত হলেন। ইনি ব্রহ্মার পুত্র ও রাক্ষসদের সৃষ্টি কর্তা। সৃষ্টি নাশ হচ্ছে দেখে তিনি চিন্তিত হলেন। যজ্ঞস্থানে উপস্থিত হলে পরাশর পৌলস্ত্যমুনিকে দেখে উঠে এসে আসন পেতে দিলেন। মনে ক্রোধ নিয়ে মুনি আসন গ্রহণ করে পরাশরকে বলেন – হে, শক্ত্রির নন্দন! বড় যশ উপার্জন করছ, রাক্ষস নিধন করে! বেদশাস্ত্রে জ্ঞান হয়েও এমন কর্ম করছ! কোথায় আছে যে পর হিংসা ধর্ম! সংসারে মৃত্যু আছেই, শরীর ধরলে মরতে হবেই। যা হয়েছে শাস্ত্রানুসারেই হয়েছে। শক্ত্রি অল্প দোষে ক্রোধ করে শাপ দিয়ে নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে এনে ছিল। তুমি আমার বংশ নাশ করো না। যারা তোমার পিতার মৃত্যুর বিষয়ে কিছুই জানে না, সেই নির্দোষ রাক্ষসদের মেরে তোমার কি আনন্দ হচ্ছে! যে কাজ করছো তা ব্রাহ্মণ-দ্বিজের নয়। ক্রোধ করে দ্বিজ যদি সংসার বিনাশ করবে, তবে কার শক্তি পৃথিবীকে বাঁচাবে! আমার অনুরোধে, ক্রোধ শান্ত কর। যজ্ঞ শেষ করে বাকি রাক্ষসকুলকে রক্ষা কর। আমার কথা যদি ভাল না লাগে, তো তোমার পিতামহ বশিষ্ঠকে জিজ্ঞেস কর। 

বশিষ্ঠ বলেন – পুলস্ত ঠিক কথাই বলছেন। পূর্বেও বলেছি অকারণে হিংসা করলে পাপ জন্মায়। এসব করে কি আবার পিতাকে ফিরে পাবে! ক্রোধ ত্যাগ কর, হিংসা ছাড়। পুলস্ত্যমুনির বাক্য শোন। 

 
অগ্নি 
এত শুনে পরাশরমুনি যজ্ঞ শেষ করলেন। কিন্তু অগ্নি পূর্ব অঙ্গীকারে নিবৃত্ত হলেন না। আহুতি না পেয়ে অগ্নি বনে প্রবেশ করলেন। আজও তাই মাঝে মাঝে বনে আগুন ধরে যায়। 
.................................... 

Saturday, January 3, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭১

কৃতবীর্য্য-চরিত ও ভৃগুপুত্র ঔর্ব্বের বৃত্তান্তঃ 

মুনি বশিষ্ঠ তাঁর পৌত্র পরাশরের পিতৃহত্যার প্রতিশোধ প্রতিহত করতে পূর্বের এক বৃত্তান্ত বলেন – 
 
পুরাকালে কৃতবীর্য নামে এক রাজা ছিলেন। ভৃগুবংশের ব্রাহ্মণরা তাঁর পুরোহিত ছিলেন। রাজা অনেক যজ্ঞ-ক্রিয়া করতেন এবং তাঁর পুরোহিত ভৃগু বংশীয়দের প্রচুর ধনধান্য দান করতেন। এভাবে সব দান করে রাজা স্বর্গে গেলেন। 

রাজার মৃত্যুর পর তাঁর বংশধর ক্ষত্রিয়দের অর্থাভাব হল। তারা ভার্গবদের ধরে এনে তাদের কাছে ধন ফেরত চাইলেন। ভয়ে ব্রাহ্মণরা অঙ্গীকার করল যার কাছে যত ধন আছে সব দিয়ে দেবেন তারা। ব্রাহ্মণদের ছেড়ে দেওয়া হল। গৃহে এসে ভার্গবরা বিচার করল। রাজ ভয়ে কেউ সব ধন ফেরত দিলেন। কেউ কেউ আবার ধন মাটিতে পুঁতে রাখল। বাকি সব রাজার সামনে রাখা হল। অল্প ধন দেখে রাজা রেগে গেলেন। অনুচরের মাধ্যমে সব জানা গেল। ঘরের ভেতর ব্রাহ্মণরা ধন পুঁতে রেখেছে। সৈন্যরা গিয়ে সব ঘর ঘিরে ফেললো। তারা ঘর খুঁড়ে সব ধন বার করে আনল। 

এত ধন লুকিয়ে রেখেছে দেখে ক্ষত্রিয়দের রাগ হল। রাজা রেগে ভার্গবদের হত্যার নির্দেশ দিলেন। ক্ষুব্ধ ক্ষত্রিয়রা সকল ভার্গব ব্রাহ্মণদের হত্যা করল। বালক, বৃদ্ধ, যুবা যত ছিল, এমন কি দুগ্ধপোষ্য বালকদেরও মারা হল। গর্ভবতী স্ত্রীদের উদর চিরেও ব্রাহ্মণ হত্যা করল দুষ্ট ক্ষত্রিয়রা। ব্রাহ্মণ নগরে হাহাকার পরে গেল। স্ত্রীরা সকলে দেশান্তরি হতে লাগল। 

এক ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণ পত্নী গর্ভবতী ছিলেন। তিনি সন্তান রক্ষার জন্য ঊরুদেশে গর্ভ গোপন করে রাখলেন। ক্ষত্রিয়রা জানতে পেরে সেই গর্ভ নষ্ট করতে এল। মহা ভয়ে ব্রাহ্মণী সেখানেই প্রসব করলেন। দশ সূর্যের সমান তেজী দীপ্তমান পুত্র প্রসূত হল, তাঁর তেজে ক্ষত্রিয়রা অন্ধ হয়ে গেল। কিছু ক্ষত্রিয় ভস্ম হল। ভয়ে ক্ষত্রিয়রা জোড়হাতে ব্রাহ্মণীর স্তব করল। ব্রাহ্মণী পুত্রকে বলে সবার চক্ষুদান করলেন। প্রাণ পেয়ে ক্ষত্রিয়রা পালিয়ে গেল। 

 
পিতৃপিতামহের হত্যার কাহিনী শুনে ভৃগুকুমার মহা ক্রুদ্ধ হলেন - দুষ্ট ক্ষত্রিয়রা অবিচার করে দ্বিজ ব্রাহ্মণদের মারল। বিধাতার এই দুষ্কর্ম জানি। সেজন্য ত্রিভুবন আমি বিনাশ করব। 

এত চিন্তা করে মুনি ঘোর তপস্যা শুরু করলেন। অনাহারে ষাট হাজার বছর তপ করেন। তাঁর তাপে ত্রিভুবন তপ্ত হয়ে উঠল। সকলে হাহাকার করতে লাগল। দেবতারা মিলে যুক্তি করলেন। তাকে নিবারণ করতে তাঁর পিতৃব্যদের পাঠান হল। 
ঔর্ব্ব সর্বলোক বিনাশে উদ্যত দেখে পিতৃগণ এসে বলেন – এত ক্রোধ কেন কর, বৎস! আমাদের জন্য বৃথা দুঃখ করছ। আমাদের মারার শক্তি কারও ছিল না। কর্মের লিখনে কাল উপস্থিত হয়ে ছিল। আমরা স্বর্গারোহণে উৎসুক ছিলাম, কিন্তু আত্মহত্যায় স্বর্গলাভ সম্ভব নয়, সেজন্য স্বেচ্ছায় ক্ষত্রিয়ের হাতে মরেছি। আপন মনে এদের ক্ষমা করে দাও। শম(শান্তি), তপ(তপস্যা) ও ক্ষমা ব্রাহ্মণের ধর্ম। আমরা কেউ তোমার এ ক্রোধ কর্মের সমর্থন করি না। 

পিতৃগণের কথা শুনে ঔর্ব্বমুনি বলেন – আপনারা যা বললেন, তা আমি জানি। আগেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি তপস্যা করে সৃষ্টি ধ্বংস করব। বিশেষ করে ক্ষত্রিয়দের মারব। দুষ্টের দমন না করলে সংসার নষ্ট হবে। দুষ্টলোককে যদি শাস্তি না দেওয়া হয় তবে সমাজের অন্য লোকও সে পথে যায়। ক্ষত্রিয়দের কুকর্মের শেষ নেই। অল্প দোষে এত ব্রাহ্মণ মারল। আমি গর্ভে থাকতে, এত গর্ভবতীদের গর্ভ নষ্ট করল যে, মা আমায় ঊরুতে লুকাল। এসব কথা ভেবে আমার হৃদয় খান খান হয়। এমন দুষ্টদের শাস্তি না দিলে তারা দুষ্টাচার কোনদিন ত্যাগ করবে না। শক্তি থেকেও যদি শাস্তি না দিই তবে কাপুরুষ বলবে সংসারে। সে জন্য আমার ক্রোধ নিবৃত্ত হবার নয়। এদের উচিত শাস্তি দিতে পারলেই আমি শান্ত হব। 

পিতৃগণ পুনরায় ঔর্ব্বমুনিকে বোঝালেন – ক্রোধ নিবৃত্ত করে, মন শান্ত কর। ক্রোধের মত মহাপাপ সংসারে আর কিছু নেই। তপ-জপ-জ্ঞান ক্রোধকে সংহার করে। বিশেষ করে তপস্বীর ক্রোধ চন্ডালের মত। এসব ভেবে আমরা চিন্তিত। তুমি বাপু, এবার ক্রোধ সংবরণ কর। আমরা সবাই তোমার পিতৃগুরুজন। আমাদের বাক্য লঙ্ঘন করো না। ক্রোধ নিবৃত্ত করার শক্তি যদি না পাও, এক উপায় বলছি শোন। ত্রিলোকের প্রাণ জলের মধ্যে। জল বিনা সংসার বাঁচে না। সে কারণে জলের মধ্যে তোমার ক্রোধানল ত্যাগ কর। জলকে হিংসা দিলে, সে হিংসা সবাই পাবে। 

ঔর্ব্ব তখন বলেন – পিতৃগণের বাক্য লঙ্ঘন করব না। 
তিনি সমুদ্রে তাঁর ক্রোধ ত্যাগ করলেন। এখনও সেই মুনির ক্রোধানলের তেজে দ্বাদশ যোজন নিত্য পোড়ে সিন্ধু মাঝে। 

বশিষ্ঠ বলেন – এই হল পূর্বের কাহিনী। এত অপরাধ ক্ষমা করলেন ঔর্ব্বমুনি। 

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers