Blog Archive

Monday, January 18, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২০

[পূর্বকথা - কৃষ্ণ ও অর্জুন সপরিবারে যমুনার তীরে বেড়াতে গেলেন....ব্রাহ্মণবেশী অগ্নিদেব এসে তাদের খান্ডব বন দহনের অনুরোধ করলেন...কৃষ্ণ ও অর্জুন অগ্নিকে সর্ব প্রকার সাহায্যের আশ্বাস দেন.. দেবরাজ ইন্দ্র অন্যান্য দেবতাদের নিয়ে খান্ডব বন রক্ষার চেষ্টা করেন...পশু, পাখি, দানব, রক্ষ, যক্ষ সকলের মিলিত চেষ্টায়ও অগ্নিকে নেভাতে পারে না.... কৃষ্ণ ও অর্জুনের কৃপায় ময়দানব ও পাঁচটি প্রাণী রক্ষা পায়...] 



মন্দপাল ঋষির উপাখ্যানঃ 

রাজা জন্মেজয় এবার বৈশম্পায়ন মুনিকে জিজ্ঞেস করেন –হে মুনিবর, আমায় বলুন কোন ছয়জন অগ্নির গ্রাস থেকে রক্ষা পেল। আপনি তক্ষকরাজের পুত্র নাগ/ভুজঙ্গ অশ্বসেন ও ময় দানবের কথা বলেছেন। বাকি চারজন সম্পর্কেও বলুন। 

মুনি বলেন –মহারাজ, তবে শুনুন সেই পুরানো কথা আপনাকে বলি। 
মন্দপাল নামে এক মহা তপস্বী রাজা ছিলেন। তিনি যেমন ধার্মিক, তপস্বী তেমনি জিতেন্দ্রিয় মহাবীর। অনেক তপস্যা করে তিনি শরীর ত্যাগ করে স্বর্গে গেলেন। স্বর্গে সকলে মহানন্দে থাকেন কিন্তু মন্দপালের মনে সুখ নেই। স্বর্গে এসেও মনে আনন্দ না থাকার কারণ তিনি খুজে পেলেন না। 
তখন স্বর্গবাসী দেবতাদের তার কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা সব বিচার করে বলেন –ক্ষিতি অতি পবিত্র স্থান। সেখানে যা যা কর্ম করবে সব কিছুর ফল পেতে হবে। তুমি পৃথিবীতে অনেক ভাল কাজ করেছ সন্দেহ নেই, কিন্তু সন্তানপালন করলে না। বহু দানধ্যান পুণ্য করেও সন্তান না থাকায় আজ স্বর্গে এসেও নরকের দুঃখ পাচ্ছ। আর তো কোন কারণ দেখি না, সন্তান থাকলেই তোমার স্বর্গসুখ ভোগ সম্ভব। 

একথা শুনে মন্দপাল চিন্তিত হলেন। অনেক ভেবে তিনি ঠিক করলেন আবার পৃথিবীতে জন্মে সন্তান পালন করে দ্রুত স্বর্গে ফিরে আসবেন। কোন যোনিতে/জাতিতে জন্মালে দ্রুত মুক্তি সম্ভব অনেক ভেবে পক্ষি যোনিই মুক্তির পথ বুঝে দেবদেহ ত্যাগ করে শার্ঙ্গক (সারস জাতিয় পক্ষি!) রূপে সংসারে জন্মালেন। তার শার্ঙ্গিকা স্ত্রী জরিতার সঙ্গে খান্ডববনে সংসার করে চারটি ডিম উৎপন্ন করলেন। 

খান্ডব দহনের সময় তিনি বনে ছিলেন না, কিন্তু ধ্যানের মাধ্যমে আসন্ন বিপদের কথা জেনে তিনি পক্ষহীন শিশুদের জন্য চিন্তিত হয়ে অগ্নির স্তব শুরু করলেন –হে অগ্নিদেব! আপনি ধাতা, আপনিই আমার ইন্দ্র, বৃহস্পতি! আপনাতেই সকলের অবস্থান। আপনার ক্রোধের হাত থেকে কারো রক্ষা নেই। সমস্ত সংসার আপনি তিল মাত্রে ভস্ম করতে পারেন। আজ এই ব্রাহ্মণকে কৃপাদান করুন। আমার চারটি পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা দিন। 

দ্বিজের স্তুতিতে অগ্নি খুশি হয়ে অভয়দান করলেন। শুনে মন্দপাল আনন্দিত হয়ে বলেন – খান্ডব বনে ভয়ঙ্কর আগুন লেগেছে। সেখানে আমার স্ত্রী চারপুত্রকে নিয়ে বিপদে আছে। পুত্রদের এখনও পক্ষ/ডানা হয়নি। এসব ভেবে আমি চিন্তিত।

অগ্নি বলেন –তাদের আমি রক্ষা করব। এদিকে খান্ডববনে পর্বতপ্রমাণ অগ্নির রূপদেখে প্রাণভয়ে শঙ্কিতা স্ত্রী জরিতা পুত্রদের অনুরোধ করেন গর্তে প্রবেশের জন্য। 
জরিতা বলেন –আমার শরীরে এখন আর বল নেই যে তোমাদের সকলকে নিয়ে উড়ে পালাবো। গর্তে প্রবেশ করে পুত্ররা প্রাণরক্ষা কর। 

কিন্তু গর্তে বিকটবদনের মুষা/ইঁদুর থাকায় পুত্ররা ভয়ে প্রবেশ করতে চাইল না। 

তারা বলে –গর্তে একে অন্ধকার তার উপর সাপ-ইঁদুরের ভয়। আমাদের কপালে যা আছে তা হবেই। বাইরে থেকে পুড়ে মড়লে বুঝব সর্ব পাপ থেকে মুক্তি পেলাম। আমরা আমাদের কর্মফল ভোগ করব। মাতা, আপনি অন্য স্থানে গিয়ে প্রাণ বাঁচান। 

শার্ঙ্গিকা জরিতা মধুর বচনে অনেক বোঝালেন কিন্তু পুত্ররা গর্তে প্রবেশ করল না, তারা বলে – মাতা তর্ক করছেন কেন! আমাদের সাথে এখন আর আপনার কি সম্বন্ধ! মায়ামোহে পড়ে বৃথা নিজের জীবন বিপদে ফেলছেন। প্রাণে বাঁচলে আমাদের মত অনেক সন্তান আবার আপনার হবে। দেখুন আগুন এগিয়ে আসছে, আপনি এখনই উড়ে পালান। প্রাণ থাকলে আবার আমরা মিলিত হব। 

পুত্রদের অনুরোধ শুনে প্রাণ ভয়ে ভীতা শার্ঙ্গিকা উড়ে পালালেন। কিন্তু অগ্নি এসে তাকে ভস্ম করল। প্রচন্ড অনল/অগ্নি, তার উপর মহাবায়ু বইতে শুরু করল, পর্বতাকারে জীবজন্তু পুরে মরতে লাগল। 
তা দেখে কাতর হয়ে মন্দপাল ও জরিতার চারপুত্র জরিতারি, সারিসৃক্ক, দ্রোণ ও স্তম্ভমিত্র অগ্নি স্তব শুরু করে বলে – হে অগ্নিদেব আপনিই দেব লোকপাল, সর্ব লোকের গতি। আমরা পক্ষিশিশু, আমাদের এখনও ডানা হয়নি। আপনার এই রূপের সামনে নিজেদের রক্ষার কোন পথ পা্চ্ছি না। এই সঙ্কটকালে কাছে পিতামাতাও নেই। আপনিই এই অনাথদের রক্ষা করুন, প্রভু! 

চার শিশুর এমন স্তুতি শুনে অগ্নি সন্তুষ্ট হয়ে বলেন –হে মন্দপালের পুত্ররা, তোমাদের কোন ভয় নেই। আগেই তোমাদের পিতাকে আমি অভয় দিয়েছি। তোমরা আজ যা চাইবে তাই আমি দেব, বল কি চাও! 

শিশুরা বলে –হে নাথ, কৃপা যদি করলেন তবে বলি-এখানে অনেক দুষ্ট মার্জার/বিড়াল আছে যারা আমাদের খেতে আসে, তাদের আপনি ভস্ম করে দিন। 

হেসে অগ্নি ‘তথাস্তু’ বলেন। এভাবে চারটি শিশুকে ছেড়ে সর্বভুক অগ্নি ব্রহ্মার বচনে খান্ডব দহন করলেন। 
কৃষ্ণার্জুনের সামনে দেবতারাও হার মানলেন খান্ডব রক্ষায়। 
সব দেখে শুনে দেব পুরন্দর ইন্দ্র দেবতাদের নিয়ে আকাশে কৃষ্ণার্জুনকে ডেকে বলেন –আপনারা একত্রে মিলে আজ যা করলেন তা দেবতাদেরও অসাধ্য। আপনাদের পরাক্রম দেখ আমি আনন্দিত হয়েছি। আপনারা মনোমত বর প্রার্থনা করুন। 

অর্জুন বলেন –হে সুরেশ্বর পুরন্দর আপনার দিব্য অস্ত্র ও তূর্ণ আমায় দান করুন। 

ইন্দ্র বলেন –সব অস্ত্র তোমায় দেব যখন তপোবলে শিবকে তুষ্ট করবে। 

শ্রীকৃষ্ণ হাতজোড় করে বলেন –হে দেবরাজ! আমায় বর দিন যেন কোনদিন অর্জুনের সাথে আমার বিচ্ছেদ না হয়। 

আনন্দিত মনে ইন্দ্র আশীর্বাদ করে স্বর্গে গেলেন। কৃষ্ণার্জুনও নিজস্থানে ফিরলেন। 

মহাভারতের এই গোবিন্দের লীলারস ও পান্ডব চরিত্রের পুণ্যকথা শুনলে মানুষ পবিত্র হয়। 
ব্যাসদেব রচিত এই সুন্দর মহাভারত শুনলে নর পাপহীন হয়। 
কাশীরাম দাস পয়ার ছন্দে তা লিখেছেন, সমস্ত সংসার যা সহজেই শ্রবণ করে আনন্দ পায়।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers