Blog Archive

Sunday, January 31, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২২

[পূর্বকথা - সুভদ্রাকে নিয়ে অর্জ্জুন ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরলেন..তাদের সন্তান হল-অভিমন্যু ....এছাড়া দ্রৌপদীরও পাঁচপুত্র হল পঞ্চপাণ্ডব থেকে –প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক ও শ্রুতসেন........—আদিপর্ব সমাপ্ত—

সভাপর্বঃ



মহাভারত শ্রবণের ফলশ্রুতিঃ 

কাশিরাম দাস মহানন্দে এই বেদার্ণব(বেদ-সমুদ্র) মন্থন করে জগতজনকে আনন্দ দান করেন। ত্রৈলোক্যে এর মহিমার সমান কমই আছে। মহামুনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস মূল মহাভারত-চন্দ্রিমা অতি যত্নে রচনা করেছিলেন। জগৎ সংসারে যা ঘটে তাই এখানে পাওয়া যায়। বহু দান-ধ্যান করে, বহু শ্রম করে যে পুণ্য মেলে তার অধিক ফল মহাভারত শ্রবণে মেলে। মহাভারত তুল্য আর কিছু এ ত্রিভুবনে নেই।

ময়দানব-কর্ত্তৄক সভা-নির্ম্মাণঃ



জন্মেজয় পুনরায় বৈশম্পায়নের কাছে ময়দানব, কৃষ্ণ ও অর্জুনের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। 

মুনি বলেন –অগ্নি সত্য পালনের বিবরণ শুনে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পরম আনন্দিত হলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের অনেক ধেনু ও স্বর্ণ দান করলেন। সেই সাথে ময়দানবকেও অনেক সম্মান দেখালেন। 

তৃতীয়পান্ডব অর্জুনের এই মহাকীর্তি সংসারে রাষ্ট্র হলে রিপুরা(শত্রুরা)ও চমৎকৃত হল। এভাবে পঞ্চপাণ্ডব মহাসুখে সর্বদা যজ্ঞ-দান-ধ্যান-মহোৎসবে রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। 

মুনি বলেন –হে পরীক্ষিত নন্দন এবার মহাভারতের সভাপর্বের বিচিত্র কথা শুনুন। 
[পান্ডু+কুন্তী=অর্জুন+সুভদ্রা=অভিমন্যু+উত্তরা=পরীক্ষিত+মদ্রাবতী=জন্মেজয়+বপুষ্টমা] 

অগ্নির হাত থেকে ময়দানব রক্ষা পেয়ে কৃতার্থ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও পার্থের সামনে যোড়হাতে বিনয়ের সাথে বলেন –সুদর্শনচক্রকে তিনলোক ভয় পায়। সেই চক্রের হাত থেকে আমায় উদ্ধার করলেন। আবার প্রচন্ড অগ্নির হাত থেকেও আমায় বাঁচালেন। আজ থেকে আমার প্রাণ আপনাদের কাছে বিক্রীত হল। আমি আপনাদের জন্য কি করতে পারি আজ্ঞা করুন। আমার হৃদয় ব্যাকুল কিছু করার জন্য। 

অর্জুন বলেন –হে দানব ঈশ্বর! আপনি চিরদিন আমার বন্ধু থাকুন। এই আমার মনের ইচ্ছের, আমার আর কিছু চাই না। 

ময় বলেন –যতক্ষণ না আপনার জন্য কিছু করতে পারছি ততক্ষণ আমার মন শান্ত হবে না। আমি দানবকুল শ্রেষ্ঠ, দানবকুলের বিশ্বকর্মা। আপনি যা আজ্ঞা করবেন আমি তাই করে দেব আপনার জন্য। 

পার্থ বলেন –আমি কিছুই চাই না। আপনি দেব দামোদর কৃষ্ণের জন্য কিছু করে তাকে প্রীত করুন। 

এবার কৃষ্ণের সামনে যোড়হাতে গিয়ে তাঁর মনের ইচ্ছে জানতে চাইলেন। 
অনেক চিন্তা করে কৃষ্ণ বলেন –তুমি এমন এক দিব্য সভা নির্মাণ কর যা আগে কেউ দেখে নি। সুরাসুরও যা দেখে অবাক হবে। 

কৃষ্ণের আদেশে ময় খুশি হয়ে দ্রুত সভা নির্মাণ করতে চললেন। তিনি কনক নিরমিত এক বিচিত্র সভা নির্মাণ করতে লাগলেন। সে যেন এক নানা গুণযুক্ত এক দেবস্থান। যা চারদিকে দশ সহস্র ক্রোশ বিস্তৃত। সুরাসুর, নাগ, নর কেউই এমন আগে দেখে নি। 

এই বিচিত্র সভা রচনা করে ময় কৃষ্ণকে জানালেন। যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণ, পার্থ সবাই সভা দেখে চমৎকৃত হলেন এবং ময়দানবের অনেক প্রশংসা করলেন। শুভক্ষণে মহোৎসবে ব্রাহ্মণদের পায়সান্ন ভোজন করিয়ে নানা রত্ন-রজত-কাঞ্চন দান করে পাণ্ডবরা সপরিবারে সভায় প্রবেশ করলেন। 
বেশ কিছুদিন কৃষ্ণও তাদের সাথে থাকলেন। পরে দ্বারকায় পিতার কাছে তার যেতে ইচ্ছে করল। তিনি পিতৃস্বসা(পিসি) কুন্তীর কাছে বিদায় দিতে গেলেন। ভোজকন্যা তাকে স্নেহালিঙ্গন করলেন। ভগিনী সুভদ্রার সাথে দেখা করলেন। সুভদ্রা কাঁদতে লাগলেন। 
বোনের চোখে জল দেখে রুক্মিণীকান্ত-কৃষ্ণ ভগিনীকে প্রবোধ দেন, বলেন –শাশুড়ির সেবা করবে। দ্রৌপদীকে সর্বদা সম্মান জানাবে। 
সুভদ্রা কাঁদতে কাঁদতে দাদাকে বিদায় জানালেন। 

এরপর গদাধর কৃষ্ণ দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বলেন –ভগিনী সুভদ্রা আমার প্রাণের অধিক। আপনি তাকে সর্বদা স্নেহ করবেন এই আশা রাখি। 

এরপর তিনি ধৌম্য পুরোহিতকে নিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে উপস্থিত হয়ে নমস্কার করে বলেন –আজ্ঞা করুন, এবার নিজ গৃহে যাই। শুনে ধর্মপুত্র বিষন্ন হলেন, সজল নয়নে কৃষ্ণকে বিদায়ালিঙ্গন করেন। ভীমার্জুনের সাথে কৃষ্ণ কোলাকুলি করেন। মাদ্রীপুত্রেরা এগিয়ে এসে কৃষ্ণকে প্রণাম জানান। 
নক্ষত্র গণনা করে বেদ-বিধি মত শুভক্ষণ দেখে ব্রাহ্মণরা মঙ্গলধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকেন। সারথি দারুক গরুড়ধ্বজ সাজিয়ে গোবিন্দের সামনে রথ নিয়ে উপস্থিত হল। 

যাঁর নাম নিয়ে সবাই যাত্রা শুরু করে, তিনিই আজ চারদিক শুভ করে যাত্রা শুরু করলেন। 
কৃষ্ণকে এগিয়ে দিতে স্নেহবশে পঞ্চপাণ্ডবও খগপতিধ্বজে উঠে বসলেন। দারুক রথ চালাল। 

কয়েক যোজন যাওয়ার পর শ্রীপতি কৃষ্ণ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের হাত ধরে অনুরোধ করেন –হে মহারাজ! এবার নিজ গৃহে ফিরে যান। আমাকে সর্বদা দয়া করে হৃদয়ে রাখবেন। 

কৃষ্ণ সজল নয়নে পার্থকে আলিঙ্গন করেন। অনেক কষ্টে পঞ্চপাণ্ডবকে কৃষ্ণ ফেরালেন। তাদের আত্মা, মন সবই কৃষ্ণের সাথে গেল, কেবল দেহই রইল। বিরস বদনে তারা সভায় ফিরলেন। 
এভাবে দ্বারকা-রমণ কৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরলেন। 

এদিকে ময়দানব নিজ কর্মে খুশি হলেন না। তিনি ধনঞ্জয়ের কাছে এসে বলেন –আমার মনের মত সভা এখনও সম্পূর্ণ হয় নি। আপনি আজ্ঞা করুন আমি মৈনাক পর্বতে যেতে চাই। কৈলাস পর্বতের উত্তরে হিমালয়ের কাছে দানবরাজ বৃষপর্বা সেখানে বসতি স্থাপন করেন। তার সভা আমি পূর্বে নির্মাণ করেছি। সেখানে নানা রত্ন মনি মাণিক্য সঞ্চিত রয়েছে। ত্রিলোকের যত দিব্য রত্ন ছিল সব দিয়ে সে গৃহ পূর্ণ হয়ে আছে। কৌমোদকী গদার[বিষ্ণুর গদা, কুমোদক-বিষ্ণু] সমতুল্য যে গদাটি আছে সেটি বীর বৃকোদর ভীমের যোগ্য। আপনার হাতের গান্ডীব ধনুকের সমান সে গদা, যা বিন্দুসরোবর মাঝে আছে। এছাড়া বরুণ(জলদেবতা)দেবকে হারিয়ে বৃষপর্বা দৈত্যেশ্বর দেবদত্ত শঙ্খ পেয়েছিলেন, যা অতি মনোহর। তার শব্দ শুনে রিপুরা(শত্রুরা) নিজ দর্প ত্যাগ করে। সে শঙ্খ এনে আমি আপনার হাতে সমর্পণ করতে চাই। এ সবই সেই বিন্দুসরোবর মাঝে আছে। আজ্ঞা করুন এখনই গিয়ে সব আপনার জন্য আনি। 

অর্জুন বলেন –আপনার যখন মন চাইছে, আপনি তাই করুন। 

আজ্ঞা পেয়ে দানবরাজ ময় কৈলাসের উত্তরে মৈনাকের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ভাগীরথী(গঙ্গা)র জন্য রাজা ভগীরথ এখানেই তপস্যা করেন বহুকাল। নরনারায়ণ, শিব, যম, পুরন্দর ইন্দ্রও এখানে যজ্ঞ করে গেছেন। এখানেই স্রষ্টা ব্রহ্মা বসে সৃষ্টির কল্পনা করেছিলেন। সেই পবিত্রস্থানে ময়দানব পৌছালেন। তিনি দেবদত্ত শঙ্খ, গদা ও বর্ণনাতীত ধন রত্ন নিয়ে ফিরে এলেন। ভীমকে গদা ও অর্জুনকে গদা উপহার দিলেন। ভীমার্জুন অতি প্রীত হলেন। 
এরপর ময় সভা সাজাতে লাগলেন। কনক-বৈদুর্য্যমণি(নীলকান্তমণি), মুক্তা, প্রবাল, মরকত(সবুজ পান্না), স্ফটিক, রজত চালচিত্র, স্ফটিকের স্তম্ভ তাতে মণি হীরার কাজ, প্রতি কক্ষে মণিমুক্তার ঝার, বসবার স্থানগুলিও রত্ন দিয়ে সাজান হল। বেদীগুলি বিচিত্র সাজে উঠল। চারদিক নানা জাতের ফুলফলের বৃক্ষে সাজান হল। ভ্রমররা মকরন্দ(পুষ্পমধু) লোভে চারদিকে গুনগুন করতে লাগল। এভাবে ময়দানব ত্রিলোক বিখ্যাত দিব্য মণিময় সভা নির্মাণ করলেন, যার দীপ্তিতে চন্দ্রসূর্যের প্রভাও পরাস্ত হল। বিজ্ঞলোকজন অনেক বিচার করেও তার কোন খুঁত পেল না। 

একমাসে এই সভা রচনা করে ময় কুন্তীপুত্রদের কাছে তা নিবেদন করলেন। সভা দেখে রাজা যুধিষ্ঠির অত্যন্ত খুশি হয়ে সকলকে তা দেখাতে আনলেন। এমন সভা দেখে পাঁচভাই আনন্দের সাগরে ভাসতে লাগলেন। ঘি, মধু মিশ্রিত পায়স, ফলমূল, বরাহ ও হরিণের মাংস, তিল মিশ্রিত অন্ন প্রভৃতি বিবিধ ভোজ্য দিয়ে দশ লক্ষ ব্রাহ্মণের ভোজন করান হল। ভোজনান্তে দ্বিজরা পরম উল্লাসে স্বস্তি ধ্বনি তুলে আশীর্বাদ করতে লাগল। অনেক মুনিরা এলেন এবং ধর্মপুত্রের প্রতি প্রীত হয়ে সভাতেই রয়ে গেলেন। 
এরা হলেন-অসিত, দেবল, সত্য, সর্পমালী ঋষি, মহাশিরা, অর্বাবসু, সুমিত্র তপস্বী, মৈত্রেয়, শুনক, বলি, সুমন্ত, জৈমিনি, পৈল, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, জাতুকর্ণ, শিখাবান, পৈঙ্গ, অপ্সু-হৌম্য, কৌশিক, মান্তব্য, মার্কণ্ডেয়, বক, ধৌম্য, জঙ্ঘাবন্ধু, রৈভ্য, কোপবেগ, পরাশর, পারিজাত, সত্যপাল, শাণ্ডিল্য শ্রেষ্ঠ, গালব, কৌন্ডিন্য, সনাতন, বভ্রুমালী, বরাহ, সাবর্ণ, ভৃগু, কালাপ, ত্রৈবলি প্রমুখ অনেক ঋষি, যাদের নাম বলে শেষ করা যায় না। এঁরা সবাই সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয়। 
এঁনারা যুধিষ্ঠিরের সভায় পুরান ও ধর্মকথা নিয়ে নানা আলোচনায় ব্যস্ত থাকেন। 

পৃথিবীর মুখ্য যত ক্ষত্রিয় রাজা, তারাও এই অপূর্ব সভা দেখতে এলেন-মুক্তকেতু, বিবর্দ্ধন, কুন্তী, উগ্রসেন, সুধর্মা, সুকর্মা, কৃতবর্মা, জয়সেন, অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধের অধিপতি, সুমিত্র, সুমনা, ভোজ, সুশর্মা, বসুদান, চেকিতান, কেতুমান, জয়ন্ত, সুষেণ, মৎস্যরাজ, ভীষ্মক, কৈকয়, শিশুপাল, সুমিত্র, যবনপতি, শল্য, বৃষ্ণি, ভোজ, যদুবংশীয় সকল কুমার প্রমুখ অনেক রাজা, গুণে শেষ হয় না। 

অনেকে অর্জুনের কাছে অস্ত্রশিক্ষার জন্য জিতেন্দ্রিয় হয়ে সর্বক্ষণ সেখানে অনুশীলনে রত হল। 
গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন তার অপ্সর কিন্নরদের নিয়ে নৃত্যগীত বাদ্যরসে পাণ্ডবদের সেবা করতে লাগলেন। 

সব দেখে মনে হয় যেন বিরিঞ্চি ব্রহ্মাকে ইন্দ্রাদি দেবতারা সেবা করছেন। 

এভাবে পঞ্চপাণ্ডব মনের সুখে সভাকার্য সম্পাদন করতে থাকেন। 
......................................

Monday, January 25, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২১

[পূর্বকথা কৃষ্ণ ও অর্জুন সপরিবারে যমুনার তীরে বেড়াতে গেলেন....ব্রাহ্মণবেশী অগ্নিদেব এসে তাদের খান্ডব বন দহনের অনুরোধ করলেন...কৃষ্ণ ও অর্জুন অগ্নিকে সর্ব প্রকার সাহায্যের আশ্বাস দেন...... কৃষ্ণ ও অর্জুনের কৃপায় ময়দানব ও পাঁচটি প্রাণী রক্ষা পায়..তারা হল তক্ষকরাজের পুত্র অশ্বসেন ও মন্দপাল ঋষির চারটি শার্ঙ্গক (সারস জাতিয় পক্ষি!) সন্তান-জরিতারি, সারিসৃক্ক, দ্রোণ ও স্তম্ভমিত্র....] 

সুভদ্রার সহিত অর্জ্জুনের ইন্দ্রপ্রস্থে গমনঃ


দ্রৌপদী ও সুভদ্রা 

এরপর অর্জুন কৃষ্ণের সাথে প্রভাসতীর্থে(দ্বারকার কাছে শ্রীকৃষ্ণের স্মৃতি বিজড়িত স্থান-অপর নাম সোমনাথ) ফিরলেন। কিছুকাল দ্বারকায়ও অবস্থান করলেন। দেখতে দেখতে বারো বছর শেষ হল। 

অর্জুন এবার সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে গেলেন। 
প্রথমেই ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম জানালেন। যুধিষ্ঠির আনন্দে তার শিরে হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। 
পার্থ মাতা কুন্তী ও ভীমকে প্রণাম জানালেন। নকুল-সহদেব প্রণাম জানালে তাদের আশীর্বাদ করলেন। 

এবার দ্রৌপদীর সাথে দেখা করতে পার্থ অন্তপুরে গেলেন। পার্থকে দেখে দ্রৌপদী অসম্ভব কষ্ট পেলেন। অতি ক্রোধে তিনি অধোমুখে বসে রইলেন। 

অনেকক্ষণ নিরবে থেকে পার্থ বলেন –হে প্রিয়ে, কি কারণে আমার প্রতি তোমার এত ক্রোধ! আমার কোন দোষে তুমি এত কষ্ট পাচ্ছ! বার বছর পর আমাদের দেখা হচ্ছে। কি কারণে তুমি এত রেগে আছ কিছুই বুঝতে পারছি না। 

দ্রৌপদী বলেন –হে পার্থ, আমাকে আর দগ্ধ করবেন না। আপনি এখান থেকে গেলে আমার মন স্থির হবে। আমাকে আপনার আর কি প্রয়োজন! যেখানে যাদবী সুভদ্রা আছেন সেখানেই আপনি যান। নতুনকে পেয়ে পুরাতনকে অবহেলা করলেন। নতুন স্ত্রী পেয়ে আমাকেতো সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন! 

শুনে লজ্জিত হয়ে পার্থ বলেন –হে দেবী! তুমি এটা উচিত কথা বললে না। তোমাকে ছাড়া সংসারে আমার আপন আর কেউ নেই। লক্ষ স্ত্রী এলেও সবার উপরে তোমার স্থান। আমরা পঞ্চভাই সম্পূর্ণরূপে তোমার অনুগত। সুভদ্রার উপর মিছে রাগ রেখ না। 

অর্জুন এভাবে দ্রৌপদীকে বোঝতে লাগলেন। অর্জুনের সকল কথা শুনে দ্রৌপদী খুশি হলেন। তারা আবার আনন্দে আলাপ করতে লাগলেন। 

কিছুদিন পর বলরাম ও নারায়ণ নানা রত্ন ও অনেক দাসী নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন। ছোট বোনের যৌতুক হিসেবে অশ্ব, হাতি, গাই, বলদ প্রভৃতি আনলেন। 
কৃষ্ণকে দেখে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির খুব খুশি হলেন। দুজনে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে শিরোঘ্রাণ নিলেন। সবাই আনন্দে আলাপ করতে লাগলেন। 
কিছুদিন থেকে বলভদ্র কৃষ্ণকে ইন্দ্রপ্রস্থে রেখে দ্বারকায় ফিরে গেলেন। 
এসময় সুভদ্রা গর্ভবতী হলেন। নির্দিষ্ট সময় তিনি পরম সুন্দর এক পুত্র সন্তান জন্ম দিলেন। দ্বিতীয় চন্দ্রের মত তার অঙ্গের জ্যোতি। রূপে শিশু ভুবন আলো করল। রূপে বীর্যে সে পিতার সমান হল। দ্বিজরা বিচার করে তার নামকরণ করতে বসলেন। ভয়শূন্য নির্ভীক সুন্দর শরীর, ক্রোধপর মন্যুমান অতিশয় বীর সে কারণে মান হল – অভিমন্যু। এঁনার গুণের কথা ধিরে ধিরে প্রকাশ হবে। 

দ্রৌপদীরও পাঁচপুত্র হল পঞ্চপাণ্ডব থেকে। সবাই রূপে গুণে পিতাদের সমান হল। দ্বিজরা তাদের নামকরণ করলেন। 
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের পুত্রের নাম হল –প্রতিবিন্ধ্য।
বৃকোদর পুত্র –সুতসোম। 
অর্জুন পুত্র –শ্রুতকর্মা। 
নকুল পুত্র –শতানীক এবং সহদেব পুত্র –শ্রুতসেন। 
সন্তানের মুখ দেখে সকলে আনন্দিত হলেন। 

মহাভারত শ্রবণ করলে সকল বিপদ দুর হয়। দুঃখ-শোক নাশ হয়, সম্পদ বাড়ে। 
কাশীরাম দাস কহেন, শুন সারোদ্ধার (গূঢ় মর্ম নিরূপণ), ইহা বিনা সংসারেতে সুখ নাহি আর।

আদিপর্ব সমাপ্ত—
......................................

Monday, January 18, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২০

[পূর্বকথা - কৃষ্ণ ও অর্জুন সপরিবারে যমুনার তীরে বেড়াতে গেলেন....ব্রাহ্মণবেশী অগ্নিদেব এসে তাদের খান্ডব বন দহনের অনুরোধ করলেন...কৃষ্ণ ও অর্জুন অগ্নিকে সর্ব প্রকার সাহায্যের আশ্বাস দেন.. দেবরাজ ইন্দ্র অন্যান্য দেবতাদের নিয়ে খান্ডব বন রক্ষার চেষ্টা করেন...পশু, পাখি, দানব, রক্ষ, যক্ষ সকলের মিলিত চেষ্টায়ও অগ্নিকে নেভাতে পারে না.... কৃষ্ণ ও অর্জুনের কৃপায় ময়দানব ও পাঁচটি প্রাণী রক্ষা পায়...] 



মন্দপাল ঋষির উপাখ্যানঃ 

রাজা জন্মেজয় এবার বৈশম্পায়ন মুনিকে জিজ্ঞেস করেন –হে মুনিবর, আমায় বলুন কোন ছয়জন অগ্নির গ্রাস থেকে রক্ষা পেল। আপনি তক্ষকরাজের পুত্র নাগ/ভুজঙ্গ অশ্বসেন ও ময় দানবের কথা বলেছেন। বাকি চারজন সম্পর্কেও বলুন। 

মুনি বলেন –মহারাজ, তবে শুনুন সেই পুরানো কথা আপনাকে বলি। 
মন্দপাল নামে এক মহা তপস্বী রাজা ছিলেন। তিনি যেমন ধার্মিক, তপস্বী তেমনি জিতেন্দ্রিয় মহাবীর। অনেক তপস্যা করে তিনি শরীর ত্যাগ করে স্বর্গে গেলেন। স্বর্গে সকলে মহানন্দে থাকেন কিন্তু মন্দপালের মনে সুখ নেই। স্বর্গে এসেও মনে আনন্দ না থাকার কারণ তিনি খুজে পেলেন না। 
তখন স্বর্গবাসী দেবতাদের তার কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা সব বিচার করে বলেন –ক্ষিতি অতি পবিত্র স্থান। সেখানে যা যা কর্ম করবে সব কিছুর ফল পেতে হবে। তুমি পৃথিবীতে অনেক ভাল কাজ করেছ সন্দেহ নেই, কিন্তু সন্তানপালন করলে না। বহু দানধ্যান পুণ্য করেও সন্তান না থাকায় আজ স্বর্গে এসেও নরকের দুঃখ পাচ্ছ। আর তো কোন কারণ দেখি না, সন্তান থাকলেই তোমার স্বর্গসুখ ভোগ সম্ভব। 

একথা শুনে মন্দপাল চিন্তিত হলেন। অনেক ভেবে তিনি ঠিক করলেন আবার পৃথিবীতে জন্মে সন্তান পালন করে দ্রুত স্বর্গে ফিরে আসবেন। কোন যোনিতে/জাতিতে জন্মালে দ্রুত মুক্তি সম্ভব অনেক ভেবে পক্ষি যোনিই মুক্তির পথ বুঝে দেবদেহ ত্যাগ করে শার্ঙ্গক (সারস জাতিয় পক্ষি!) রূপে সংসারে জন্মালেন। তার শার্ঙ্গিকা স্ত্রী জরিতার সঙ্গে খান্ডববনে সংসার করে চারটি ডিম উৎপন্ন করলেন। 

খান্ডব দহনের সময় তিনি বনে ছিলেন না, কিন্তু ধ্যানের মাধ্যমে আসন্ন বিপদের কথা জেনে তিনি পক্ষহীন শিশুদের জন্য চিন্তিত হয়ে অগ্নির স্তব শুরু করলেন –হে অগ্নিদেব! আপনি ধাতা, আপনিই আমার ইন্দ্র, বৃহস্পতি! আপনাতেই সকলের অবস্থান। আপনার ক্রোধের হাত থেকে কারো রক্ষা নেই। সমস্ত সংসার আপনি তিল মাত্রে ভস্ম করতে পারেন। আজ এই ব্রাহ্মণকে কৃপাদান করুন। আমার চারটি পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা দিন। 

দ্বিজের স্তুতিতে অগ্নি খুশি হয়ে অভয়দান করলেন। শুনে মন্দপাল আনন্দিত হয়ে বলেন – খান্ডব বনে ভয়ঙ্কর আগুন লেগেছে। সেখানে আমার স্ত্রী চারপুত্রকে নিয়ে বিপদে আছে। পুত্রদের এখনও পক্ষ/ডানা হয়নি। এসব ভেবে আমি চিন্তিত।

অগ্নি বলেন –তাদের আমি রক্ষা করব। এদিকে খান্ডববনে পর্বতপ্রমাণ অগ্নির রূপদেখে প্রাণভয়ে শঙ্কিতা স্ত্রী জরিতা পুত্রদের অনুরোধ করেন গর্তে প্রবেশের জন্য। 
জরিতা বলেন –আমার শরীরে এখন আর বল নেই যে তোমাদের সকলকে নিয়ে উড়ে পালাবো। গর্তে প্রবেশ করে পুত্ররা প্রাণরক্ষা কর। 

কিন্তু গর্তে বিকটবদনের মুষা/ইঁদুর থাকায় পুত্ররা ভয়ে প্রবেশ করতে চাইল না। 

তারা বলে –গর্তে একে অন্ধকার তার উপর সাপ-ইঁদুরের ভয়। আমাদের কপালে যা আছে তা হবেই। বাইরে থেকে পুড়ে মড়লে বুঝব সর্ব পাপ থেকে মুক্তি পেলাম। আমরা আমাদের কর্মফল ভোগ করব। মাতা, আপনি অন্য স্থানে গিয়ে প্রাণ বাঁচান। 

শার্ঙ্গিকা জরিতা মধুর বচনে অনেক বোঝালেন কিন্তু পুত্ররা গর্তে প্রবেশ করল না, তারা বলে – মাতা তর্ক করছেন কেন! আমাদের সাথে এখন আর আপনার কি সম্বন্ধ! মায়ামোহে পড়ে বৃথা নিজের জীবন বিপদে ফেলছেন। প্রাণে বাঁচলে আমাদের মত অনেক সন্তান আবার আপনার হবে। দেখুন আগুন এগিয়ে আসছে, আপনি এখনই উড়ে পালান। প্রাণ থাকলে আবার আমরা মিলিত হব। 

পুত্রদের অনুরোধ শুনে প্রাণ ভয়ে ভীতা শার্ঙ্গিকা উড়ে পালালেন। কিন্তু অগ্নি এসে তাকে ভস্ম করল। প্রচন্ড অনল/অগ্নি, তার উপর মহাবায়ু বইতে শুরু করল, পর্বতাকারে জীবজন্তু পুরে মরতে লাগল। 
তা দেখে কাতর হয়ে মন্দপাল ও জরিতার চারপুত্র জরিতারি, সারিসৃক্ক, দ্রোণ ও স্তম্ভমিত্র অগ্নি স্তব শুরু করে বলে – হে অগ্নিদেব আপনিই দেব লোকপাল, সর্ব লোকের গতি। আমরা পক্ষিশিশু, আমাদের এখনও ডানা হয়নি। আপনার এই রূপের সামনে নিজেদের রক্ষার কোন পথ পা্চ্ছি না। এই সঙ্কটকালে কাছে পিতামাতাও নেই। আপনিই এই অনাথদের রক্ষা করুন, প্রভু! 

চার শিশুর এমন স্তুতি শুনে অগ্নি সন্তুষ্ট হয়ে বলেন –হে মন্দপালের পুত্ররা, তোমাদের কোন ভয় নেই। আগেই তোমাদের পিতাকে আমি অভয় দিয়েছি। তোমরা আজ যা চাইবে তাই আমি দেব, বল কি চাও! 

শিশুরা বলে –হে নাথ, কৃপা যদি করলেন তবে বলি-এখানে অনেক দুষ্ট মার্জার/বিড়াল আছে যারা আমাদের খেতে আসে, তাদের আপনি ভস্ম করে দিন। 

হেসে অগ্নি ‘তথাস্তু’ বলেন। এভাবে চারটি শিশুকে ছেড়ে সর্বভুক অগ্নি ব্রহ্মার বচনে খান্ডব দহন করলেন। 
কৃষ্ণার্জুনের সামনে দেবতারাও হার মানলেন খান্ডব রক্ষায়। 
সব দেখে শুনে দেব পুরন্দর ইন্দ্র দেবতাদের নিয়ে আকাশে কৃষ্ণার্জুনকে ডেকে বলেন –আপনারা একত্রে মিলে আজ যা করলেন তা দেবতাদেরও অসাধ্য। আপনাদের পরাক্রম দেখ আমি আনন্দিত হয়েছি। আপনারা মনোমত বর প্রার্থনা করুন। 

অর্জুন বলেন –হে সুরেশ্বর পুরন্দর আপনার দিব্য অস্ত্র ও তূর্ণ আমায় দান করুন। 

ইন্দ্র বলেন –সব অস্ত্র তোমায় দেব যখন তপোবলে শিবকে তুষ্ট করবে। 

শ্রীকৃষ্ণ হাতজোড় করে বলেন –হে দেবরাজ! আমায় বর দিন যেন কোনদিন অর্জুনের সাথে আমার বিচ্ছেদ না হয়। 

আনন্দিত মনে ইন্দ্র আশীর্বাদ করে স্বর্গে গেলেন। কৃষ্ণার্জুনও নিজস্থানে ফিরলেন। 

মহাভারতের এই গোবিন্দের লীলারস ও পান্ডব চরিত্রের পুণ্যকথা শুনলে মানুষ পবিত্র হয়। 
ব্যাসদেব রচিত এই সুন্দর মহাভারত শুনলে নর পাপহীন হয়। 
কাশীরাম দাস পয়ার ছন্দে তা লিখেছেন, সমস্ত সংসার যা সহজেই শ্রবণ করে আনন্দ পায়।
......................................

Sunday, January 10, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৯

[পূর্বকথা কৃষ্ণ ও অর্জুন সপরিবারে যমুনার তীরে বেড়াতে গেলেন....ব্রাহ্মণবেশী অগ্নিদেব এসে তাদের খান্ডব বন দহনের অনুরোধ করলেন...কৃষ্ণ ও অর্জুন অগ্নিকে সর্ব প্রকার সাহায্যের আশ্বাস দেন.....] 



ইন্দ্রাদি দেবতার সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধ ও ময়দানবাদির পরিত্রাণঃ 

অতি ক্রোধে পুরন্দর ইন্দ্র তাঁর ঐরাবতের উপর চড়ে বসলেন। হাতে তাঁর বজ্র। মাথায় ছাতা শোভা পায়। রাগে তাঁর সহস্রলোচন রক্তবর্ণের হল। 

সবাইকে তিনি আজ্ঞা দেন –সকল দেবগণ এখনই নিজেদের প্রহরণ(অস্ত্র) নিয়ে আমার সাথে আসুন। কাদের এত সাহস আমার খান্ডব অরণ্য পোড়ায়, দেখি! আজ যে এই হোম করছে-তাকে ও তাঁর সহায় জনদের বিনাশ করব। 
এই বলে বজ্রপাণি ইন্দ্র তাঁর পরিবার উচ্চৈশ্রবা, ঐরাবত, চার মেঘ ও চৌষট্টি মেঘিনী নিয়ে চললেন। 

যক্ষ-যিনি ধনের দেবতা, তিনি তাঁর ভয়ঙ্কর গদা নিয়ে ইন্দ্রকে অনুসরণ করলেন। 
মৃত্যুর দেবতা –যম, তাঁর মহিষের পিঠে দন্ডহাতে সহচরদের নিয়ে চললেন। 
নিজ নিজ যানে করে সব গ্রহ, অষ্ট বসু, অশ্বিনীকুমাররা চললেন। 
পবন(বায়ু)দেব ধনুক হাতে মৃগে(হরিণ) আরোহণ করে ইন্দ্রের সাথে এগিয়ে গেলেন। 
মকরধ্বজ কন্দর্প, জলের দেবতা বরুণ বাম করে পাশ(জাল বিশেষ) অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চললেন। 
শিখীর(ময়ূর) পিঠে চড়ে শক্তিধর ষড়ানন কার্তিক চললেন খান্ডব বন রক্ষা করতে। 
এইভাবে তেত্রিশ কোটি দেবতা খান্ডব অরণ্য রক্ষা করতে চললেন। 

গরুড়পাখি সঙ্গে লক্ষ লক্ষ পক্ষী নিয়ে নিজের জ্ঞাতিদের রক্ষার জন্য এলেন। 
অনন্ত নাগও তাঁর সাথিদের নিয়ে চললেন। তক্ষক তাঁর শত ফণার সেনা নিয়ে চলল। তাদের বিষ বৃষ্টিতে পৃথিবী পূর্ণ হল। 
এভাবে যক্ষ, রক্ষ, ভূত, দানব সবাই নিজেদের সেনা নিয়ে নানা অস্ত্রে সেজে চলল। এভাবে সকলে আকাশ জুড়ে আবির্ভূত হল। 

তখন দেব পুরন্দর ইন্দ্র জলধরকে আজ্ঞা দিলেন –বৃষ্টি করে এই অনল(আগুন) নেভান। 

আজ্ঞা মাত্র অতিবেগে বরুণদেব মেঘ ফাটিয়ে মুষলধারে জল ঢালতে লাগলেন। সে যেন প্রলয়কালের বৃষ্টি শুরু হল, মনে হল সৃষ্টি যেন তাতেই ডুবে যাবে। আকাশও যেন জলে ডুববে। এত বজ্রপাত ও মেঘ ডাকল যে তিনলোক ভয় পেতে লাগল। 

সব দেখে পার্থ মহাবল বৃষ্টি যাতে বনের উপর না পরে তার জন্য শোষক বায়ু-অস্ত্র ছাড়লেন। বেগে সেই অস্ত্র শূণ্যে উঠে সব জল শোষণ করল ও বায়ু সকল মেঘ উড়াল। 
মেঘের পরাজয় দেখে সকল দেবতা ক্রোধিত হলেন। শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের উপর বজ্র হানলেন দেবরাজ ইন্দ্র। 
কিন্তু বজ্র রণস্থানে নর-নারায়ণকে চিনতে পেরে তাকে আঘাত না করে পুনরায় ইন্দ্রের হাতে চলে এলেন। 

অস্ত্র ব্যর্থ হচ্ছে দেখে দেবরাজ যেমন লজ্জা পেলেন তেমনি আরো ক্রোধি হয়ে মন্দর পর্বত উপড়ে আনলেন। 
মন্দর গিরিবর হুহুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে আসতে লাগলেন, শব্দ শুনে মনে হল যেন স্বর্গ ছিঁড়ে পরল। 

ইন্দ্রপুত্র অর্জুন-যিনি ভরদ্বাজপুত্র দ্রোণের শিষ্য, তিনি তাঁর দিব্য শিক্ষার বলে অজেয় গান্ডীব ধনুক দিয়ে শীঘ্র বাণ ছেরে মন্দর পর্বত খান্‌ খান্‌ করেন। পর্বত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেণুর মত চূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পরল। 

পর্বত চূর্ণ হতে দেখে জম্ভভেদী(ইন্দ্র - জম্ভা অসুরের হত্যাকারী) চমকে উঠলেন। তিনি ক্রোধে নানা অস্ত্র বর্ষণ শুরু করলেন। 
এভাবে দেবতারা হুতাশন অগ্নিকে নেভানোর জন্য অনেক চেষ্টা করতে লাগলেন। 
বায়ু, অগ্নি, ভিন্দিপাল(প্রাচীন ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষ), ইন্দ্রজাল, ব্রহ্মজাল, পরশু মুদ্গর, শেল, শূল, চক্রবাণ, জাঠাজাঠি(লৌহযষ্টি), অর্ধচন্দ্র, তোমর(যুদ্ধাস্ত্র), ত্রিশূল, তবল(কুড়ুল), শাবল, সাঙ্গি, ক্ষুরপা, টাঙ্গি, বেণব, কুঠার, পট্টিশ, ভল্ল, শেল, শব্দভেদী, কুন্ড, খড়্গ, রিপুচ্ছেদী, সূচীমুখ খট্বাঙ্গ(মুগুর বিশেষ) প্রভৃতি কোটি কোটি অস্ত্র নিক্ষেপ করা হল। 
বৃষ্টির মত এত সব অস্ত্র ইন্দ্র নিক্ষেপ করতে থাকেন, অন্য দিকে ধনঞ্জয় সব নিবারণ করতে থাকেন। 
আগুনে পতঙ্গ পরে যেমন মুহূর্তে ভস্ম হয় সেভাবেই পার্থ সব নষ্ট করতে থাকেন। এভাবে অগ্নিকে রক্ষা করেন নর-নারায়ণ। পার্থ মহারণে নিযুক্ত থাকেন। একাই তিনি সবার সাথে লড়তে থাকেন। 

অর্জুন সুরাসুর কারো বিপক্ষেই ভয় পাচ্ছেন না দেখে দেবরাজ বিস্মিত হলেন পার্থের বীরত্ব দেখে। দেবতাদের দুরাবস্থা দেখে মহাবীর গরুড় ক্রোধে গর্জন করতে করতে তেড়ে এলেন। বজ্রের মত দাঁত ও নখ নিয়ে মুখ বিস্তার করে পার্থকে তিনি গিলতে গেলেন। আকাশে গরুড়পাখিকে তেড়ে আসতে দেখে পার্থ ব্রহ্মশির নামে দিব্য অস্ত্র তুলে নিলেন। এটি তিনি পূর্বে গুরুর কাছ থেকে পান। এই ব্রহ্মশির অস্ত্রে চারদিক অগ্নিময় হল। গরুড় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তিনি তার পক্ষীকুলকে নিয়ে যুদ্ধে ভঙ্গ দিয়ে পালালেন। 

তখন নাগরা ক্রোধে পার্থকে আক্রমণ করল। তারা সহস্র ফণা বিস্তার করে, নিশ্বাসে সমীরণ(বায়ু) বহিয়ে এগিয়ে আসল। তাদের গর্জনে সকলের কানে তালা লেগে গেল। তারা দশশত বক্রমুখ দিয়ে অবিরত বিষ ছড়াতে লাগল, যেন কর্কটের মেঘমালা। ফাল্গুনি-অর্জুন ফণী দেখে তার গান্ডীব ধনুকে টান দিলেন। তিনি পিপীলিকা(পিপঁড়ে) বাণ মারলেন। নানাবর্ণের নানারূপের পিপড়ে/পিপীলিকারা গিয়ে ভুজঙ্গ/সাপদের ঘিরে ধরে। পার্থ এবার শিখী নামের দিব্য শর মারেন। লক্ষ লক্ষ ময়ূর এসে উড়ে উড়ে নাগদের খন্ড খন্ড করতে থাকে। চারদিকে রক্তমাংসের বৃষ্টি হতে থাকে। এত অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ফণিরাও রণে ভঙ্গ দিয়ে পালায়। 

এবার এগিয়ে আসে যক্ষের দল। কোটি কোটি যক্ষ ভয়ঙ্কর গদা হাতে, ধনুঃশর টঙ্কার দিয়ে যুদ্ধ করতে এল। তারা ভয়ঙ্কর সিংহনাদ ছেড়ে নানাবর্ণের অস্ত্র বর্ষণ করে মুহূর্তে চারদিক অন্ধকার করে ফেলল। সূর্যের মুখ ঢেকে গেল। মনে হল অমাবস্যার রাত নেমেছে। শরজালে সংসার ঢেকে গেল। 
কিন্তু পার্থও কম যান না। তিনিও প্রতি অস্ত্রের বিপক্ষে আর এক অস্ত্র হেনে দৃষ্টি মাত্র সব সংহার করেন। অস্ত্র ব্যর্থ হচ্ছে দেখে যক্ষরা কুপিত হল। রাগে ঠোঁট কামড়ে গদা হাতে ধনেশ্বর যক্ষরা তেড়ে আসে। 
পার্থ এবার এমন বজ্রশর হানলেন যা যক্ষদের বুকে আঘাত করল। সকলের হাত থেকে গদা খসে পরল। যক্ষরা চিন্তিত হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাল। যক্ষরাজ এভাবে পরাজিত হয়ে লজ্জা পেয়ে সপরিবারে যুদ্ধস্থান ত্যাগ করলেন। 

এরপর ধনঞ্জয় দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলেন। ক্রমে অরুণ, বরুণ, যমের সাথে যুদ্ধ হল। সব দেবতাদের একই রকম দুর্গতি হল। সত্য, আদি চার যুগে এমন যুদ্ধ কখনও হয়নি, হবেওনা এমন অনুপম সুর(দেবতা) ও নরের যুদ্ধ। দেবতারা বহু পরিশ্রম করেও যখন এই যুদ্ধে কিছুই করতে পারলেন না।

হুতাগ্নির ভুক্‌/খিদে নির্বাণ হচ্ছে না, এদিকে বহু জ্ঞাতির বধ দেখে ক্রোধে রাক্ষস, দানব, প্রেত, ভূত, অপ্সরী, কিন্নরী, বিদ্যাধর মহারোল কোলাহল করতে করতে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে ধেয়ে আসতে লাগল। 
পিশাচ সৈন্যদল ভয়ঙ্কর, তাদের মুখ থেকে উল্কার মত অগ্নি ঝরে। সকলে বিভিন্ন আয়ুধ(অস্ত্র), ভয়ঙ্কর গদা নিয়ে, কেউ বা পর্বত, বড় বড় পাষাণ নিয়ে তেড়ে আসে। লাখ লাখ বৃক্ষ নিয়ে তারা মার মার রব তোলে। কেউ বা বয়ান/মুখ বিস্তার করে ধেয়ে আসে। 

দানব সৈন্যদের ধেয়ে আসতে দেখে মুরারি কৃষ্ণ পাঞ্চজন্য বাজিয়ে সুদর্শন চক্র হাতে তুলে নেন। চোখের নিমেষে দানবদের তিনি মারলেন। 
ধনঞ্জয় পার্থও বাণ মেরে রাক্ষস-পিশাচদের মেরে অগ্নিকে তর্পণ করলেন। 
এই সাংঘাতিক যুদ্ধ দেখে বাকিরা ভয়ে যুদ্ধে ভঙ্গ দিয়ে পালাল। 
এভাবে বারবার সুরাসুর-নাগদের সাথে অবিরাম যুদ্ধ চলল। 

এই খান্ডব বনের মাঝে পন্নগ(সাপ)রাজ তক্ষক বাস করতেন। তিনি ইন্দ্রের সখা ছিলেন। সে সময় তক্ষকরাজ কুরুক্ষেত্রে গেছিলেন। কিন্তু গৃহে ভার্যা, পুত্র, আত্মীয়স্বজন ছিল। হঠাৎ বনে আগুন লাগায় ফণিপ্রিয়া প্রমাদ গণলেন। পুত্রকে কোলে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে বুঝলেন আজ আর রক্ষা নেই। 
তখন পুত্র অশ্বসেনকে কেঁদে তিনি বলেন –পুত্র, কোন উপায় দেখছি না। আমার কথা শোন, পুত্র! আমার উদরে প্রবেশ কর। আমাকে হত্যা করলেও তুমি বেঁচে যাবে। মায়ের কথা মত অশ্বসেন মার উদরে প্রবেশ করল। তক্ষক গৃহিণী বায়ুতে উড়ে পালানোর চেষ্টা করলেন। অন্তরীক্ষে উড়ে কেউ পালাচ্ছে দেখে পার্থ-ফাল্গুনি এক অস্ত্রে তার মুন্ড কাটলেন, পুচ্ছ তিন খন্ডে ছেদ করলেন। নাগিণী মাটিতে লুটিয়ে পরলেন। অশ্বসেন সেই সুযোগে উড়ে পালাল, পার্থ দেখতে পেলেন না। ইন্দ্র বন্ধুর পরিবারের বিপদ বুঝে মায়াজাল বিস্তার করে বন্ধুর সন্তানকে রক্ষা করলেন। 
তা দেখে পার্থ মহাক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্রের সাথে আবার যুদ্ধ শুরু করলেন। শরজালে মেদিনী(পৃথিবী) ছাইল। ইন্দ্রার্জুনের এই মহারণে ত্রিভুবন চমকিত হল। 

হঠাৎ সে সময় আকাশ থেকে শূন্যবাণী হল –আপনারা এ যুদ্ধ বন্ধ করুন। হে দেবরাজ নিজেকে সম্বরণ করুন। সমগ্র ব্রহ্মান্ডে এই নর-নারায়ণকে যুদ্ধে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। হে শতক্রতু(ইন্দ্র) কেন এই যুদ্ধ করছেন! এতে পরিশ্রান্তও হবেন, অপমানিতও হতে হবে। আপনার সখা কশ্যপকুমার তক্ষকরাজ এখানে নেই, তিনি কুরুক্ষেত্রে নিরাপদে আছেন। 

আকাশবাণী শুনে ইন্দ্র ও অন্য দেবতারা যুদ্ধে বিরত হলেন। সুরপতি ইন্দ্র স্বর্গে ফিরে গেলেন। 
নাগরা ভোগবতীতে (পাতালস্থ গঙ্গা) স্থান পেল। বাকিরা যে যার স্থানে ফিরে গেল। 
নিষ্কন্টক হয়ে হুতাশন অগ্নি আনন্দে খান্ডব বন দহন করেন। 
নানাবর্ণের পশুরা পুড়তে থাকে। ভক্ষ্য-ভক্ষক এক সাথে অবস্থান করে, কেউ কাউকে আক্রমণ করে না, সকলে প্রাণভয়ে ডাক ছারতে থাকে। কুঞ্জর(হাতি) কেশরী(সিংহ) কোলে, মৃগ(হরিণ)-ব্যাঘ্র(বাঘ) এক স্থলে, মূষিক(ইঁদুর)- মার্জার(বিড়াল) সাথে বসে মৃত্যুর অপেক্ষা করে। একত্র মণ্ডূক(ব্যাঙ), নাগ, শার্দূল(বাঘ)-মহিষ বসে বৃষ্টির অপেক্ষা করতে থাকে। আগুনের তাপ যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বড় বড় বৃক্ষকেও ভক্ষণ করতে থাকে। ভাল্লুক, নকুল(বেজি/নেউল), শিবার(শিয়াল) মত ছোট প্রাণীরা গর্তে প্রবেশ করে প্রাণে বাঁচতে চায়। অনেকে জলে ঝাঁপিয়ে প্রাণে বাঁচতে চায়। পাখিরা আকাশে উড়ে পালায়। কিন্তু কোথাও কেউ ত্রাণ পায় না। হুতাশন সবার প্রাণ নেন। কৃষ্ণার্জুনও তাকে সাহায্য করেন। 

এদিকে ময় নামে এক দানব যে কিনা নমুচি দানবের ভাই – তক্ষকধামে লুকিয়ে ছিল। অগ্নিকে পিছনে দেখে ভয়ে সে পালাতে পালাতে দেব দামোদর-কৃষ্ণের সামনে এসে পরে। দানব দেখে হরি দেবতাদের অরি(শত্রু) বুঝে সুদর্শন চক্র ছাড়লেন। 

পিছনে সুদর্শন ও অগ্নিকে নিয়ে ময়দানব প্রাণভয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে অর্জুনের কাছে যায়। কাতর কন্ঠে প্রার্থনা করে বলে – রক্ষা করুন হে কুন্তীপুত্র, ধনঞ্জয়! আপনি ত্রৈলোক্য বিজয়ী বীর! আমি ক্ষুদ্র প্রাণী! আমার পিছনে সুদর্শনচক্র ও যমদূত অগ্নি। আমি তো ক্ষুদ্র মীন(মাছ) এই নক্র(কুমীর)-দের সামনে! আমায় আপনি রক্ষা করুন। 

পিছন থেকে এই কাতরধ্বনি শুনে অর্জুন বলে ওঠেন – কে ভয়ে আমার স্মরণ নিলে! তোমার কোন ভয় নেই। 

অর্জুনের অভয়বাণী শুনে কৃষ্ণ সুদর্শনচক্র ফিরিয়ে নিলেন। হুতাশন অগ্নিও ময়দানবকে ছেরে দিলেন। এভাবে ময়দানব রক্ষা পেয়ে গেল। 

কিন্তু খান্ডববন সর্বভক্ষা অগ্নির উদরে গেল। মনের ইচ্ছে পূর্ণ হতে অগ্নির রোগও সেরে গেল। কৃষ্ণার্জুনের সাহায্যে তার সঙ্কল্প সম্পূর্ণ হল। বিস্তৃত খান্ডববন নানাবর্ণের বৃক্ষ ও নানাজাতের ঔষধি বৃক্ষে পূর্ণ ছিল। এভাবে সব পশু, পাখি, নাগ, রাক্ষস, দানব, রক্ষ আদি সকলকে নিয়ে খান্ডববাসী ভস্মরাশিতে পরিণত হল। কেবল ছয়টি প্রাণী বেঁচে গেল। 

এই আদিপর্ব বেদব্যাস রচনা করে গেছেন, পাঁচালী প্রবন্ধে গীত আকারে কাশীদাস দেব রচনা করলেন। 
......................................

Sunday, January 3, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৮

[পূর্বকথা পার্থের সাথে সুভদ্রার বিবাহ সুসম্পন্ন হল ....কিছুদিন পর কৃষ্ণ ও অর্জুন সপরিবারে যমুনার তীরে বেড়াতে গেলেন....ব্রাহ্মণবেশী অগ্নিদেব এসে তাদের খান্ডব বন দহনের অনুরোধ করলেন....] 


নর-নারায়ণ

খান্ডব-বন দহনঃ -

খান্ডব দহন সম্ভব নয় দেখে ক্রোধি অগ্নি পুনরায় ব্রহ্মার কাছে গেলেন। অগ্নি বিরিঞ্চি ব্রহ্মা কাছে গিয়ে বিস্মিত হয়ে জানালেন তাঁর পক্ষে খান্ডব দহন সম্ভব হচ্ছে না। 

প্রজাপতি ব্রহ্মা মুহূর্তে চিন্তা করে বলেন –ভয় পাবেন না অগ্নি, মতি স্থির করুন। আর তো কোন উপায় দেখছি না। কিছুদিন এখানে বিশ্রাম করুন। এর উপায় একটা বার করছি। সাবধানে শুনুন। 
নর-নারায়ণ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন। তাদের সাহায্য পেলে আপনি খান্ডব দহন করতে পারবেন। 

ব্রহ্মার বচন শুনে অগ্নি বহুদিন রোগ নিয়েও শান্ত, স্থির রইলেন। দ্বাপর যুগের শেষে নর-নারায়ণ অবতার রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। তখন অগ্নি পুনরায় ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ব্রহ্মার আজ্ঞা পেয়ে দেব হুতাশন অগ্নি দ্রুত নর-নারায়ণ অর্জুন-কৃষ্ণের কাছে হাজির হলেন। অগ্নির সব কথা শুনে পার্থ সম্মত হলেন। 

আশ্বাস পেয়ে অগ্নি বলেন –খান্ডববন দগ্ধ করা খুবই কঠিন কাজ। সে বনের রক্ষক দেব পুরন্দর ইন্দ্র। তিনি সদা সতর্ক। 

অর্জুন বলেন–আমি তাকে ভয় পাই না। বহু ইন্দ্র আসলেও আজ আমি জয়ী হব। তবে এখানে আমার যোগ্য ধনুর্বাণ সঙ্গে নেই। ইন্দ্রের সাথে যুদ্ধের জন্য অস্ত্রের প্রয়োজন। তাঁর সাথে যোগ্য রথ ও তুরঙ্গ(অশ্ব)ও দরকার। দেবরাজ ইন্দ্রকে যুদ্ধে সকলে সাহায্য করবেন। আমায় সাহায্যের সামান্য অস্ত্রও সঙ্গে নেই। 
শ্রীকৃষ্ণের বাহুবল সহ্য করার ক্ষমতাও কারো হবে না। কিন্তু তিনিও এখানে বিহার করতে এসেছেন, তাই সঙ্গে সুদর্শন চক্র আনেন নি। আপনি আমাদের অস্ত্রের ব্যবস্থা করে দিন। আমরা অবশ্যই খান্ডববন দহনে আপনার সাহায্য করব। 

তখন হুতাশন অগ্নি অনেক চিন্তা করে ধ্যানে সখা বরুণকে(জলদেবতা) স্মরণ করলেন। অগ্নির ডাকে জলেশ্বর বরুণ উপস্থিত হলেন। 

বৈশ্বানর(অগ্নি) বরুণকে বলেন –সখা উপকার করুন। আপনার গৃহে চন্দ্রের দেওয়া যে রথ, অক্ষয় যুগল তূণ, গান্ডীব ধনুক(গন্ডারের মেরুদন্ডে তৈরী) আছে তা যদি দেন তবে আমার দুঃখ ঘোচে। 

শুনে বরুণ সব অগ্নিকে এনে দিলেন। এমনকি নিজের পাশও(বরুণদেবের অস্ত্র, দড়ি বিশেষ) দান করলেন। 
এভাবে সুরাসুরের পূজিত গান্ডীব মহাধনু, কপিধ্বজ রথ যা চন্দ্র-ভানুর জ্যোতিযুক্ত, যাতে শুক্লবর্ণের চারটি অশ্ব নিয়োজিত হল। 
অক্ষয় যুগল তূণ অস্ত্ররূপে শোভা পেল। 

শ্রীকৃষ্ণকে স্তব করে তাকে কৌমোদকী গদা ও সুন্দর একটি চক্র দান করে অগ্নিদেব বলেন –এই দুই দিব্য অস্ত্র সংসারে অতুলনীয়। আপনার হাতেই এ দুটি সুন্দর শোভা পায়। 

এরপর পার্থ ও কৃষ্ণ নিজেদের রথে উঠলেন। গোবিন্দের গরুড়ধ্বজ ওবং পার্থের কপিধ্বজ রথ। 
শতেক যোজন বিস্তৃত খান্ডব বন। পার্থ ও কৃষ্ণ বনের দুই প্রান্তে থেকে পাহারা দিতে থাকেন। 
অগ্নিদেব নির্ভয় হয়ে বন দহন করেন। সেই আগুন পর্বতের আকার রূপ নেয়। প্রলয়ের মেঘ যেন গর্জন শুরু করল। 
নানাবিধ বৃক্ষ চড়চড় করে পুড়তে থাকে। নানাজাতের পশু, পাখি, নাগরা পুড়তে থাকে। প্রাণ ভয়ে কেউ বন থেকে পালাতে গেলে তাদের কেটে আগুনে ফেলা হল। আনন্দ মনে হুতাশন অগ্নি সব ভক্ষণ করতে থাকেন। এভাবে অরণ্যের মধ্যে অনেক যক্ষ, রক্ষ, কিন্নর, দানব, বিদ্যাধর পুড়ে মরল। 
প্রাণভয়ে কেউ স্ত্রী-পুত্রকে শেষবারের মত আলিঙ্গন করে আকুল হয়ে রোদন করল। কেউবা দ্রুত জলে ঝাঁপ দিল। কিন্তু জলজন্তুর সাথেই দ্রুত ভস্ম হল অগ্নির তেজে। জলে এভাবে পুড়ে মরল শফরী(পুঁটিমাছ/ ছোটমাছ), কচ্ছপ প্রভৃতি। 
বনেতে পুড়ল বনবাসী সবাই। সিংহ, ভাল্লুক, বরাহ(শুকর), মৃগ, মহিষ, শার্দূল(বাঘ), খড়্গী(গন্ডার) এত পুড়ে মরল যে লিখে শেষ করা যায় না। অসংখ্য কুঞ্জর(হাতি) পুড়ল দীর্ঘ দীর্ঘ দন্ড নিয়ে। জম্বুক(শৃগাল/শেয়াল), শশক(খরগোশ), নকুল(নেউল/বেজি) এত মরল যে বলে শেষ হয় না। 
নানাজাতের নাগ গর্জন করে আগুনে পরল। পঞ্চদশ ফণা তুলেও কেউ কেউ বাঁচার চেষ্টা করল। 
নানাবর্ণের বড় বড় পাখিরাও পুড়ে মরতে লাগল। কেউ পবনতেজে উড়ে পালাতে গেলে অর্জুন তাকে কেটে অগ্নিতে ফেলল। 
আকুল হয়ে সব জীব কলরব শুরু করল, যেন অর্ণব(সমুদ্র) উথলে উঠছে। অগ্নি আনন্দে পর্বত আকার রূপ ধারণ করে আকাশে উঠে গেল। 

স্বর্গবাসী দেবতারাও সেই আগুনের ভয়ে পালাতে লাগলেন। ভয়ে সবাই ইন্দ্রের শরণ নিলেন। 
সকলে দেবরাজকে খান্ডব দহনের কথা জানালেন –আপনার পালিত খান্ডববন হুতাশন অগ্নি দগ্ধ করছেন। অগ্নির সাথে দুজন মানুষও আছে, যারা তাকে সাহায্য করছে। 

সব শুনে দেবরাজ ইন্দ্র রেগে গেলেন। তিনি দেব সমাজকে নিয়ে তাদের উচিত শিক্ষা দিতে চললেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।


নর-নারায়ণ
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers