Blog Archive

Tuesday, June 23, 2009

সাদালো

একটা ছোট্ট কুকুর রাস্তায় পরে আছে। নির্মলা ভোরবেলা দুধ আনতে গিয়ে দেখল। কুকুরটার গায়ের রঙটা বেশ সুন্দর, সাদার উপর কালো ছোপ ছোপ। নির্মলা কুকুরছানাটাকে বাড়ি নিয়ে এলো। নাম দিলো ‘সাদালো’। সাদার উপর কালো ছোপ কিনা-তাই! সাদালোকে নিয়ে বাড়ি ঢুকবার সময় নির্মলার একটু ভয় হচ্ছিল। বাবা-মা-ঠাম্মা কি বলে! বুবুন যদিও খুশি হবে -তা নির্মলা জানে। বুবুন নির্মলার ছোট ভাই। এই সবে হাঁটতে শিখেছে। নির্মলা ওর চেয়ে অনেক বড়। নির্মলা এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। প্রথম ক’দিন সাদালোকে নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিল নির্মলা। ক্লাস করতে করতে খালি সাদালোর কথা মনে আসে। বাড়ি ফেরার সময় মনে হয় সাদালো বাড়িতে নেই, পালিয়ে গেছে। ঠাম্মাও প্রথম ক’দিন রাগ করেছে। মাও বেশ খাপ্পা ছিল। কিন্তু ওদের পিছনে ঘুর২ করে সাদালো সবার মন জয় করে নিয়েছে। যদিও সবচেয়ে বেশি সে নির্মলাকেই ভালবাসে, নির্মলা তা জানে। সাদালো বাড়ির হাওয়া বুঝে গেছে। বাবাও এখন আর বেশি রাগ করে না। বুবুনের তো খুব মজা – ওর একজন সঙ্গী হল। মা-ঠাম্মা তাও ভয়ে২ থাকে সাদালো যদি কামড়ে দেয়! নির্মলা জানে সাদালো কক্ষন ভালো ছেলেদের কামড়াবে না।
আজ প্রায় আট মাস হল সাদালো এ বাড়িতে এসেছে। পাড়ার বন্ধুরাও সাদালোকে চেনে। পাড়ার কুকুরগুলোও সাদালোকে ভয় পায়। আজ নির্মলার মনটা ভিষণ খারাপ। মার কাছে বকুনি মার দু’টোই খেয়েছে। সাদালো তাই ঠাঁয় নির্মলার পাশে বসে। আজ সকালে নির্মলা এক শালিক দেখেছিল। সঙ্গে২ চোখ সরিয়ে আরেকটাকে খুঁজেছে, কিন্তু দেখতে পায়নি। আজ ভয়ে২ দিন শুরু হল। কি দুঃখ কপালে আছে কে জানে! স্কুলের পড়া ঠিক ভাবে হয়েছে তো! ইংলিশ কবিতার শেষ দু’লাইন একটু আটকে যাচ্ছে। ছায়াদি যদি দাঁড় করিয়ে রাখে? কি লজ্জা! কিন্তু স্কুল যাবার আগেই এই কান্ড!আজ আর স্কুলে যাওয়া হবে না, বুঝে গেছে নির্মলা। এখনই আটটা বেজে গেছে। মাও স্নানে যেতে বলছেনা। কি করবে নির্মলা! তাই মনের দুঃখে এখন সে সাদালোর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আজ এক-শালিক দেখার পর মুখ ধুয়ে ভয়ে২ দুধ আনতে গেছে। সেখানে নগেন জেঠুর কাছে মিথ্যে বকুনি খেল, তাও কিছু বলেনি নির্মলা। চুপচাপ বাড়ি এলো। বুবুন তখন ঘুম থেকে ওঠেনি। নির্মলা স্কুলের বই নিয়ে বসল। হ্যাংলা সাদালো তখন বাবাকে তোয়াজ করছে। বাবা কিনা চা খাচ্ছে! একটু বিস্কুটের টুকরো পাবে। বাঃ বাঃ কি হ্যাংলারে! ‘আমিতো এক্ষুনি পাউরুটি দিলাম! তাতেও পেট ভরেনা!’ হঠা্ৎ কি মনে হল, নির্মলা গেল বুবুনকে ঘুম থেকে ওঠাতে, মা স্নানে গেছে। ‘বুবুনসোনা, ছোট্টভাইটি ওঠো! পড়তে বসবে না! ক-খ-গ-ঘ; A-B-C-D পড়বে না! ওঠো সোনা!’ ‘ও বাবাঃ, কি ঘুমরে! উঠতেই চায়না!’ নির্মলা বুবুনকে কোলে নিল। হঠাৎ তার ভাইয়াকে খুব আদর করতে ইচ্ছে হল। ঠিক বাবার মত আদর করবে। বাবা কি সুন্দর ভাইকে উপরের দিকে ছুড়ে দিয়ে আবার কোলে নিয়ে আসে – ঠিক সেই ভাবে। ভাইয়াও কি সুন্দর হাসে! এই তো ‘এক-দু-ই-তি-ই-ন...’ নির্মলা ভাইয়াকে উপরে ছুরে দিল। বুবুন হক্‌চকিয়ে গেছে, সদ্য ঘুম ভাঙ্গল কিনা! ওমা!সাদালো আবার চেচাঁয় কেন? ওঘরে তো ছিলি! বিস্কুট খাওইয়া হল! এই দেখ্‌, বুবুন কেমন উপরে উঠে যাচ্ছে, আবার আমার কোলে চলে আসবে। হেইয়ো! ‘আয়, আয়, কোলে আয়!’ ওমা, কি হবে বুবুন হাত-পা ছোড়ে যে! ওমা!পড়ছে, পড়ছে, নির্মলার হাত কাঁপছে কেন? একি বুবুন কোলে এলোনা, মাটিতে পড়ছে যে! সাদালো আবার কি করে! বুবুন যে খুব কাঁদছে। নির্মলার ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! বুবুন চুপ্‌ করে গেছে। সাদালো ওকে চাটছে। ভুক্‌-ভুক্‌ করে ডাকছে। বাবা কি বলছে! নির্মলা কিছু শুনতে পাচ্ছে না। কান-দু’টো ভোঁ ভোঁ করছে। ঐ তো বাবা ছুটে আসছে। ঠাম্মার বাতের ব্যথা, তবু ঠুক্‌-ঠুক্‌ করে আওয়াজ হচ্ছে। আর কি? এ ঘরেই আসা হচ্ছে। বাবা বুবুনকে কোলে তুলেছে। ঐ খাটে শোয়াচ্ছে। বাবার মুখটা ভয়ে কালো হয়ে গেছে। সাদালো চুপ করে সব দেখছে। বাবা নির্মলাকে কিছু বলছে না। ঠাম্মা ঘরে ঢুকেছে। ও বাবাঃ ঠাম্মা যে চিৎকার শুরু করে দিল! মা ঐ বাতরুম থেকে তাড়াতাড়ি বেরচ্ছে, দৌড়ে আসছে। এখন কি হবে! মা নির্মলাকে খুব বক্‌বে? বুবুনের কি হল? ঠাকুর! বাবা কোথায় যাচ্ছে? সাদালোও বাবার পিছনে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। মা এখনও বুঝতে পারেনি কি হয়েছে। ঠাম্মা বলছে। এম্মা! কি মিথ্যে কথা, নির্মলা ইচ্ছে করে ভাইয়াকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলেছে! তাও কি হয়! মা তো জানে নির্মলা বুবুনকে কত্তো ভালোবাসে! মা বুবুনের চোখে-মুখে জল ছিঁটিয়ে দিচ্ছে। ঐত্তো বুবুন কাসছে! হে ঠাকুর! তুমি খুব খু-ব ভাল! নির্মলার কথা রেখেছ, বুবুনের কিছু হয়নি। মা এবার নির্মলার দিকে আসছে। আসুক, মারুক – নির্মলার আর ভয় নেই। বুবুনের কিচ্ছু হয়নি। ঠাম্মা বুবুনকে দেখছে। ‘উঃ, লাগে যে!’ মা নির্মলার গালে চড় মারল। এই চুলের মুঠি ধরেছে! উফঃ, কি মারে রে বাবা! নির্মলা কেঁদে ফেলবে যে! “এ্যাঃ এ্যাঃ! আমি কি ইচ্ছে করে বুবুনকে ফেলেছি! আমি তো আদর করছিলাম। বাবার মত বুবুনকে লুফছিলাম।” “এ্যাঃ এ্যাঃ! সাদালো তো কামড়ায় নি! কিছু করেনি। ওতো আমাকেই বকছিল! আমিই শুনিনি। ঐ তো এখন বাবার সাথে ডাক্তার ডাকতে গেল। মাগো! আর কক্ষনো এমন করব না! এবারের মত মাফ কর!” বুবুন খুব কাঁদছে। মা নির্মলাকে ছেড়ে বুবুনের কাছে গেল। এবার ঠাম্মা নির্মলার কান মুলে দিল। নির্মলা এত অত্যাচার সহ্য করবে কেন! সেও আস্তে করে ঠাম্মাকে ঠেলে দিল। ঠাম্মা আবার চ্যাঁচাতে শুরু করল। মা আবার নির্মলাকে মারতে আসছে। ঐ তো বাবা ডাক্তারবাবুকে নিয়ে এসে গেছে। মা আর ঠাম্মা আবার বুবুনের কাছে গিয়ে বসল। নির্মলাও আস্তে আস্তে বুবুনের মাথার কাছে গিয়ে দাড়াল। ডাক্তারবাবু বুবুনকে দেখছে। বাবা বুবুনকে সুস্থ দেখে নিশ্চিন্ত হল। ঠাম্মা বকর্‌ বকর্‌ করে যাচ্ছে। নির্মলার প্রাণের ভেতর যে কি হচ্ছে তা কেউ বোঝে না। নির্মলা ভাবচ্ছে মা হয়ত কিছুটা বুঝবে। সাদালো কোথায়? বাবাকে তো এখন জিঞ্জেস করা যায় না! ওমাঃ, সাদালো বুবুনের লাল টুক্‌টুকে মারুতিটা মুখে নিয়ে এসেছে। বুবুন খেলনাটা অন্নপ্রাশণে পেয়েছে। ওর খুব প্রিয়। বুবুনের তেমন কিছু হয়নি বোধ হয়। ডাক্তারবাবু বললেন ভয় পেয়ে বুবুন অঞ্জান হয়ে গেছিল। ঐ তো সাদালোর কাছ থেকে লাল মারুতি নিয়েছে। ডাক্তারবাবু নির্মলাকে আদর করে বললেন –‘এরকম আর কোরনা। ভাইকে নিয়ে কখন লোফালুফি করে! নির্মলাতো খুব ভাল মেয়ে!’ এরা কেউ নির্মলার মনের কথা বুঝবে না। তবে আর কক্ষণ সে এমন আদরও ভাইয়াকে করবে না। নির্মলা ভাবছে ‘বুবুনের সাথে হাঁটি-হাঁটি করব, দৌড়াব, তবু বাবার মত আদর! - আর না!’ ওমাঃ, সাদালো আবার নির্মলার পায়ে মুখ ঘষছে। যেন বলতে চাইছে –“এই ঠিক, এই ঠিক।” সাদালো ঠিক নির্মলাকে বোঝে। নির্মলা কিনা ওকে তুলে এনেছে! ঐ দেখ বুবুনও আবার ‘দিদিভাই’ বলে ডাকছে। নির্মলা বুবুনকে জড়িয়ে ধরল, হামি খেল। বাবা ডাক্তারবাবুকে পৌছাতে গেছে। ঠাম্মা বুবুন কি খাবে তাই জিঞ্জেস করতে পিছন২ গেল। মা ঐ এগিয়ে আসছে। নির্মলার ভয় করছে। মা এগিয়ে এসে নির্মলাকে জড়িয়ে ধরল। মার চোখে জল। নির্মলার চোখেও জল এসে যাচ্ছে। দুঃষ্টু সাদালো মার দিকে তাকিয়ে ভুক্‌ ভুক্‌ করছে, আর লেজ নারছে। যেন বলছে-‘কাঁদছ কেন?’ বুবুন অবাক হয়ে মা আর দিদিকে দেখছে। মা বুবুন আর নির্মলাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে, চুমু খাছে। সাদালো মার পায়ে মুখ ঘষছে। ঐ তো বাবা আর ঠাম্মাও ঘরে ঢুকছে। নির্মলা ভাবল-“যাক্‌, এক-শালিক দেখলে কি হবে! ভাগ্যিস সাদালো ছিল-তাই আজকের মত ফাঁড়াটা কেটে গেল!”

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers