Blog Archive

Sunday, December 27, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৭

[পূর্বকথা - কৃষ্ণের কথা মত অর্জুন সরস্বতীর তীর থেকে সুভদ্রাকে হরণ করলেন.. এ সংবাদ বলরাম শুনে কৃষ্ণের উপর অভিমান করতে লাগলেন... কৃষ্ণ এসে দাদাকে বোঝালেন সুভদ্রা অর্জুনকেই স্বামী হিসেবে চান..... বলরাম অর্জুনের কাছে বিবাহ প্রস্তাব পাঠালেন ...পার্থের সাথে সুভদ্রার বিবাহ হল .......দুর্যোধন অভিমানে স্বদেশ যাত্রা করল.....] 



খান্ডব-বন দহনঃ 

কিছুদিন পর এক গ্রীষ্মকালে পার্থ ও নারায়ণ যমুনায় বিহার করতে গেলেন। 
রুক্মিণী, সুভদ্রা সহ পরিবারের বহু সদস্যকে নিয়ে যমুনা কূলে সুন্দর ঘর করে বাস করেন। আনন্দে তারা পানাহার করে, ক্রীড়া করে দিন কাটান। 

একদিন ক্রীড়ান্তে দুজনে বসে বিশ্রাম করছিলেন, সে সময় সেখানে হুতাশন অগ্নি এক ব্রাহ্মণের বেশে প্রবেশ করলেন। মাথায় তাঁর ত্রিজটা, নয়ন তাঁর পিঙ্গল রক্তবর্ণ। আগুনের মত উত্তপ্ত শরীর। 
কৃষ্ণার্জুনের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের আশীর্বাদ করে অগ্নিদেব বলেন –হে কৃষ্ণ আপনি যদুকুলের শ্রেষ্ঠ, হে পার্থ আপনি কুরুকুলসার। ত্রিভুবনে আপনাদের সমান আর কাউকে দেখিনা। আপনারা দুজনে মিলে আমার ইচ্ছে পূরণ করুন। আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ আমায় ভোজন করান। 

পার্থ হেসে বলেন –হে পণ্ডিত! কোন ভক্ষ পেলে আপনি তৃপ্ত হবেন বলুন। আপনি যা চাইবেন এখনই তা এনে দিচ্ছি। 

আশ্বাস পেয়ে অগ্নি বলেন –আমি আমার পরিচয় দিচ্ছি শুনুন। আমি অগ্নি। বহুকাল ব্যাধিতে ভুগেছি, অরুচি হয়েছে। আমায় ব্যাধি মুক্ত করুন। 
কাছেই খান্ডব বন আছে। সেটি সকল জীবের আলয়। সেই বন ভক্ষণের জন্য দিন, ধনঞ্জয়! সেখানে সুরাসুর, যক্ষ, রক্ষ, পশু, পাখি যত আছে সব আমায় ভোজন করতে দিন। 

এত শুনে রাজা জন্মেজয় বিস্মিত হয়ে বৈশম্পায়ন মুনিকে জিজ্ঞেস করেন –হে মুনিরাজ, আমার বিস্ময় খন্ডন করুন। 
সে স্থানে ব্যাধিযুক্ত হুতাশন অগ্নি কেন এলেন! কিসের জন্য তিনি খান্ডব দাহন করতে চাইলেন। 

মুনি বলেন –শুনুন নৃপ, পূর্বের কাহিনী। 
সত্যযুগে শ্বেতকি নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি যজ্ঞ ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। নিরন্তর ব্রাহ্মণদের নিয়ে যজ্ঞ করতেন। বহুকাল এভাবে রাজা যজ্ঞ করতে থাকলে দ্বিজরা আর সে কষ্ট সহ্য করতে পারল না। তারা যজ্ঞ ত্যাগ করে চলে যেতে চাইলো। 

রাজা জোড়হাতে বিনয়ের সাথে বলেন –মহর্ষিরা কেন আপনারা যজ্ঞ ছেড়ে যাচ্ছেন! আমি তো পতিত নই, কোন দোষও তো করি নি! 

দ্বিজরা বলে –আপনার কোন দোষ নেই, মহারাজ! কিন্তু এই অপ্রমিত যজ্ঞের কোন শেষ দেখছি না। আমরা আর অগ্নিতাপের ক্লেশ সহ্য করতে পারছি না। নয়ন আমাদের নিরস হয়েছে, অঙ্গ লোমহীন, শরীরের রক্ত শুকুয়ে যাচ্ছে এই অগ্নির সংস্পর্শে। 

দ্বিজদের কথা শুনে রাজা তাদের নানা ভাবে তুষ্ট করে পুনরায় যজ্ঞে আহ্বান জানাতে লাগলেন। 

দ্বিজরা বলে –রাজা, আমাদের অকারণে স্তুতি করছেন, আমাদের দ্বারা আর এ কাজ সম্ভব নয়। এই যজ্ঞ করেন এমন ব্রাহ্মণও দেখছি না। ত্রিদশ(অমর)-ঈশ্বর শিবের সেবা করুন। তিনি ছাড়া আর কারো এ যজ্ঞ করা সম্ভব নয়। 

দ্বিজদের কথা মত রাজা অনেক কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। তাঁর তপস্যায় শিব সন্তুষ্ট হয়ে বর প্রার্থনা করতে বললেন। 

রাজা বলেন –কৃপা যখন করলেন, মহাদেব! তবে শুনুন। আমার যজ্ঞ করে এমন ব্রাহ্মণ নেই। আপনি আমার যজ্ঞের পুরোহিত হন। 

শিব হেসে বলেন –যজ্ঞ করা আমার কাজ নয়, ব্রাহ্মণের কাজ। যজ্ঞফল যা চাও তাই পাবে, প্রার্থনা কর। 

রাজা বিনয়ের সাথে বলেন –যজ্ঞ না করেই তার ফল ভোগ করা সুশোভন নয়। হে ত্রিলোচন! যজ্ঞের উপায় বার করে দিন।

শিব বলেন –তোমার যজ্ঞে এত মন! আমার অংশে জন্মেছেন দুর্বাসা মুনি। তাকে দিয়ে এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ কর। 
পূর্বে যজ্ঞের সামগ্রী সব সংগ্রহ করবে। দুর্বাসার যোগ্য যজ্ঞ বিধান মত করবে। দুর্বাসার মান যেন রক্ষা পায়, লক্ষ্য রেখ। 

শিবের আজ্ঞা পেয়ে রাজা নিজ রাজ্যে গিয়ে যজ্ঞের সামগ্রী সংগ্রহে নিযুক্ত হলেন। বারো বছর ধরে সব সামগ্রী সংগ্রহ করে শিবকে জানালেন। শিব তখন দুর্বাসা মুনিকে এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিলেন। 

শিবের আজ্ঞা পেয়ে দুর্বাসা মুনির মনে রাজার উপর ক্রোধ হল। তিনি ঠিক করলেন রাজার কোন ছিদ্র বার করে তাকে শাপ দেবেন। 

দুর্বাসা মনে মনে ভাবেন –শ্বেতকি রাজনের এত অহংকার যে আমায় যজ্ঞের জন্য আবাহন করল! 

মনে ক্রোধ নিয়ে মুনি যজ্ঞ করতে গেলেন। সঙ্গে দণ্ডধর(যম)ও গেলেন। 
মহাতপোধন দুর্বাসা মুনি সাঙ্ঘাতিক যজ্ঞ শুরু করলেন। মুনি যখন যা চান সঙ্গে সঙ্গে রাজাও তাই যোগাতে থাকেন। শ্বেতকি রাজার যজ্ঞের কথা সংসারে ছড়াতে থাকে। 
দুর্বাসা মুনি মুষলধারে যজ্ঞে আহুতি দিতে লাগলেন। বার বছর ধরে অবিরাম সে যজ্ঞ চলতে থাকে। ত্রিলোকে সকলে এই যজ্ঞের কথা শুনে চমৎকৃত হল। 

সেই যজ্ঞের হবিষ্যি খেয়ে খেয়ে অগ্নির অরুচি হল। ব্যাধিযুক্ত দেহে অগ্নি দুর্বল হলেন। অগ্নিদেব তখন ব্রহ্মার সদনে গিয়ে তাকে তাঁর দুঃখের কথা জানালেন। 

বিরিঞ্চি ব্রহ্মা বলেন –অতি লোভে আপনাকে এ দুঃখ পেতে হচ্ছে। বহু খাদ্য গ্রহণের ফলে আপনার এ ব্যাধি হয়েছে। তবে এ ব্যাধিরও ওসুধ আছে, হুতাশন। খান্ডববনে বহু জীব আছে। যদি আপনার পক্ষে বন দগ্ধ করা সম্ভব হয় তো তাই করে ব্যাধি মুক্ত হন। 

ব্রহ্মার কথা শুনে বেগে অগ্নি খান্ডব বনে চললেন। ক্রুদ্ধ অগ্নি সেখানে গিয়েই প্রচন্ড গর্জন করে জ্বলে উঠলেন। খান্ডববন বহু জীবের বাসস্থান, আগুন দেখে তারা বিস্মিত হল। কোটি কোটি মত্ত হস্তী তাদের হস্তিনীদের সাথে মিলে শুঁড়ে করে জল এনে সে আগুন নেভাল। বড় বড় সব ভয়ঙ্কর সাপরাও তাদের পঞ্চশত, সপ্ত-অষ্টাদশ ফণায় করে জল এনে আগুন নেভাল।

এভাবে যত জীব ছিল সবাই নিজেদের সাধ্যমত সাহায্য করল, মুখে করে জল এনে আগুন নেভালো। অগ্নি অনেক চেষ্টা করেও আর বন দহন করতে পারলেন না। 
......................................

Sunday, December 20, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৬

[পূর্বকথা - কৃষ্ণের কথা মত অর্জুন সরস্বতীর তীর থেকে সুভদ্রাকে হরণ করলেন...যদুবীররা ক্রুদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করল ... সুভদ্রা অর্জুনের সারথি হলেন...যদুবীররা পরাস্ত হতে লাগল ..... এ সংবাদ বলরাম শুনে কৃষ্ণের উপর অভিমান করতে লাগলেন... কৃষ্ণ এসে দাদাকে বোঝালেন সুভদ্রা অর্জুনকেই স্বামী হিসেবে চান..... বলরাম অর্জুনের কাছে বিবাহ প্রস্তাব পাঠালেন ..... ] 



দুর্যোধনের অভিমানে স্বদেশ যাত্রা ও পার্থের সহিত সুভদ্রার বিবাহঃ 

এদিকে রাজা দুর্যোধন সব সৈন্যদের নিয়ে যাদব সৈন্যদের মাঝে গিয়ে পরল। 
সেখানে সব শুনল যে পার্থ ভদ্রাকে হরণ করেছে।

মহাক্রোধে দুর্যোধন গর্জে উঠল –হে কৃপাচার্য, হে পিতামহ, আচার্য বিদুর সবাই দেখুন পান্ডুপুত্রের কান্ড। যে কন্যার জন্য বলরাম আমায় আমন্ত্রণ করলেন, দেখুন তাকেই দুষ্ট হরণ করল! আমাকে সবাই চেনে। আমি এখনই অর্জুনকে হত্যা করব, কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। 

কর্ণ বলে –মহারাজ, আপনি বসে দেখুন, আজ্ঞা দিলেই আমি তাকে বেঁধে আনতে পারি। 

শুনে গান্ধারী নন্দন দুর্যোধন তাকে আজ্ঞা দিল বীর কর্ণও দ্রুত লাল চোখ করে দৌড়াল। 

বৃকোদর ভীম বলেন –কোথায় যাও সূতপুত্র! অদ্ভুত কথা বললে অর্জুনকে তুমি ধরবে। সুরাসুর যক্ষ যাকে যুদ্ধে হারাতে পারে না তাকে ধরতে যেতে লজ্জা করছে না! ওরে মূর্খ দুরাচার, তোমার এত অহঙ্কার! আমার সামনে এমন প্রতিজ্ঞা কর! আমার হাত থেকে বাঁচলে তখন অর্জুনের সাথে যুদ্ধ করতে যেও। 

এই বলে ভীম লাফিয়ে ভূমিতে পরলেন। গদা ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি এগিয়ে আসতে লাগলেন, যেন সাক্ষাৎ দন্ডপাণি(যম)। 

বিদুর বলেন –হে দুর্যোধন, পার্থের সাথে তোমার যুদ্ধের কি প্রয়োজন! তোমাকে আমন্ত্রণ করে যিনি এনেছেন তাঁর কাছে গিয়ে সব জিজ্ঞেস করা উচিত। তিনি যেমন বলবেন তেমন না হয় করা যাবে। এখন পার্থের সাথে কলহ করা উচিত নয়। 

ভীষ্ম ও দ্রোণও তাতে সম্মত হয়ে বলেন –যিনি আমন্ত্রণ করেছেন, তাঁর কাছেই আগে চল। অনেক বোঝানোর পর রাজা দুর্যোধন দ্বারাবতী যেতে সম্মত হল। 

সে সময় সাত্যকি অর্জুনের কাছে উপস্থিত হল। 
পার্থকে ডেকে মধুর বচনে সে বলে –ক্রোধ ত্যাগ করুন ধনঞ্জয়, এরা শিশু এদের উপর আক্রোশের কি দরকার! না বুঝে এরা দোষ করেছে। আপনার সাথে মিথ্যে যুদ্ধ করল। সব শুনে কৃষ্ণ-রাম দুজনেই মন্দ বলেছেন। তাই আমাকে দ্রুত পাঠালেন। আপনাকে নিয়ে যেতে আমি এসেছি। যদুবংশীয়রা ও ভোজবংশীয়রা(দ্বারকা বর্তমানে গুজরাটের অঞ্চল, ভোজ গুজরাটের কচের কাছে দ্বারকার কিছু দূরে অবস্থিত) সকলে একত্রে বসে স্থির করেছেন সুভদ্রাকে আপনার হাতেই সমর্পণ করা হবে। 

সাত্যকির বিনয় বচন শুনে ফাল্গুনি(অর্জুন) শান্ত হলেন ও যুদ্ধ ত্যাগ করলেন। 
সব দেখে শুনে দুর্যোধনের অভিমান হল। সে তখনই সসৈন্য নিজের দেশের উদ্দেশ্যে ফিরে চলল। 

পার্থ তখন দারুককে মুক্ত করে কৃতাঞ্জলি সহকারে সবিনয়ে বলেন –কৃষ্ণ যেমন, আপনিও আমার কাছে তেমনই। আপনার প্রতি অপরাধ করেছি, আমায় ক্ষমা করুন। 

দারুক বলেন –পার্থ আপনি বড় একটি কাজ করলেন। এতো আমার বন্ধন ছিল না। এ আমার ধর্ম রক্ষা করলেন। আপনি আমায় বন্ধি না করলে আজ আমি বলরামকে কি ভাবে মুখ দেখাতাম! আমাকে এই অবস্থাতেই বলরামের কাছে নিয়ে চলুন। না হলে তিনি আমার উপর খুব রাগ করবেন। 

অর্জুন বলেন –তা আর উচিত কর্ম হবে না। আপনাকে বেঁধে নিয়ে গেলে কৃষ্ণ আমার উপর কুপিত হবেন। রাম অবশ্যই আমাদের ক্ষমা করবেন। 

এই বলে তখনই পার্থ দারুককে মুক্ত করলেন। তারপর সব যদুবীররা সন্তুষ্ট হয়ে অর্জুনকে আদর করে দ্বারকায় নিয়ে চলল। 

ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, বিদুর প্রমুখ এবং ভুরিশ্রবা, সোমদত্ত, বাহ্লিক প্রমুখদের নিয়ে সসৈন্য ভীমসেন অর্জুনের আগে আগে চললেন। পিছনে কাম প্রমুখ সকল যাদববীররা চলল। 

দেব নারায়ণ কৃষ্ণ এগিয়ে এসে সকলকে অভ্যর্থনা করলেন। যদুনারীরা উলুধ্বনি দিতে লাগল। 
রত্নময় সিংহাসনে ভদ্রা ও পার্থকে বসিয়ে বেদ অনুসারে তাদের বিবাহ দেওয়া হল। বসুদেব ভদ্রাকে সম্প্রদান করলেন। যদুরা আনন্দ মনে পার্থকে প্রচুর যৌতুক দান করল। 

পুণ্যকথা ভারতের শুনেন পুণ্যবান। পৃথিবীতে এর সমান সুখ আর কিছু নেই। 
সুভদ্রার হরণ কাহিনী যে নর শুনেন, তাঁর সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় ব্যাসদেবের বচনে।
......................................

Monday, December 14, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৫

[পূর্বকথা - কৃষ্ণের কথা মত অর্জুন সরস্বতীর তীর থেকে সুভদ্রাকে হরণ করলেন...যদুবীররা ক্রুদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করল ... সুভদ্রা অর্জুনের সারথি হলেন...যদুবীররা পরাস্ত হতে লাগল ..... এ সংবাদ বলরাম শুনে কৃষ্ণের উপর অভিমান করতে লাগলেন... ] 

বলরামের সহিত শ্রীকৃষ্ণের কথাঃ



দূত পুনরায় জোড়হাতে বলে –হে যদুনাথ, নিঃশব্দ রয়ে গেলেন কেন! আজ্ঞা করুন আমি এখন কি করি! কুমাররা আমায় বার্তার কারণে পাঠালেন! যাদব প্রধান মহাবীর কামদেব যিনি তিনলোকে অব্যর্থ তাঁর ধনুর্গুণ তিলতিল করে কাটা গেছে। একটিও আর অস্ত্র নেই, তূণও শূন্য। শাম্ব, গদ, সারণ প্রমুখ যতবীর যাদবরা আছেন, কারো তনুই অক্ষত নয়। কারো ধ্বজা কাটা গেছে, কারো বা সারথি, কারো রথ নষ্ট হয়েছে-সে এখন পদাতি। কারো অস্ত্র, ধনুর্গুণ কিচ্ছু নেই। সবাইকে একা অর্জুন জয় করেছেন। এখন আপনারা অস্ত্র, রথ, অশ্ব সব পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। আপনি চলুন বা দেবকীপুত্র কৃষ্ণ চলুক সব স্বচক্ষে দেখে আসবেন। কুমারদের পক্ষে অর্জুনকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। অর্জুনও স্নেহ করে কুমারদের প্রাণে মারেন নি। তাই প্রভু, তারা এখনও পরান নিয়ে বেঁচে আছেন। 

গোবিন্দ বলেন –আমি অর্জুনকে চিনি। তাকে পরাজিত করার মত পৃথিবীতে কাউকে দেখি না। আজ এমনকি ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ, পঞ্চাননও পার্থকে জিততে পারবেন না। কুমাররা তাঁর কাছে শিশু , তারা আর কি করবে! তুমি সত্যই বলেছ পার্থ তাদের প্রাণে মারবেন না। তাঁর সাথে যুদ্ধ করা উচিত নয়। সে তো অন্যায় কিছু করেন নি! শাস্ত্র মতে ক্ষত্রিয়ধর্মে বলপ্রয়োগ করে বিবাহের প্রশংসা আছে, যেখানে কন্যার সম্মতি আছে। ধনঞ্জয়ের দোষ দেখি না। 
আমাদের ভগিনীর কাজটাও দেখুন। অর্জুনে যদি তাঁর মন না থাকত, তবে সে অশ্ব চালাত কেন! তবে ধনঞ্জয় কি আপনার মহিমা জানেন না! আপনি এখনই গিয়ে তাঁর গরিমা খর্ব করতে পারেন। তবে পার্থকে জীবন্ত ধরা সম্ভব নয়। অনেক চেষ্টা করে তাকে প্রাণে মারতে হবে। পার্থকে হত্যা করলে সুভদ্রাও প্রাণ ত্যাগ করবে। বলুন দেবতা তাতে কি কর্ম সাধন হবে! 
এমন অবস্থায় আমার মত যদি সবাই আজ্ঞা দেন তো জানাই। আপনার প্রিয়ম্বদ কেউ অর্জুনের কাছে যাক। প্রিয় বাক্যে কুন্তীকুমারকে তুষ্ট করে ফিরিয়ে আনুন। এখনই তাকে এনে ভদ্রাকে তাঁর হাতে সমর্পণ করুন। এতে সবার মঙ্গল হবে। লোকসমাজে সম্মান থাকবে। আমার মনে আর কিছুই আসছে না। 

কৃষ্ণের এত কথা শুনে হলধর বলরাম ক্রোধ সংবরণ করে বলেন –আমাকে আর জিজ্ঞেস করছ কেন! তোমার মন যা চাইছে তাই কর। তোমার মনে যা আছে তাই হবে। তোমার অন্যথা আর কে করতে পারে। তখন যদি তোমার কথা মেনে নিতাম, তাহলে এখন আর আমায় এমন লজ্জায় পরতে হত না। 

এরপর বলরাম সাত্যকিকে ডেকে বলেন –আপনি এখনই আমার প্রতিনিধি হয়ে অর্জুনের কাছে গিয়ে তাকে মধুর বচনে বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনুন। 
এই বলে সাত্যকিকে রথে চড়িয়ে যুদ্ধ স্থলে পাঠালেন। 

আদি পর্ব মহাভারতের বিচিত্র উপাখ্যান, কাশীরাম দাস কহেন, সাধুজন সদা করেন পান।
......................................

Sunday, December 6, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৪

[পূর্বকথা - কৃষ্ণের কথা মত অর্জুন সরস্বতীর তীর থেকে সুভদ্রাকে হরণ করলেন...যদুবীররা ক্রুদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করল ... সুভদ্রা অর্জুনের সারথি হলেন...যদুবীররা পরাস্ত হতে লাগল .. ] 

বলরামের নিকট অর্জ্জুনের রণজয় সংবাদঃ



বলরাম যখন সসৈন্যে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন, তখন দূত এসে তাকে প্রণাম জানাল। 
সে উর্দ্ধশ্বাসে কাঁদতে কাঁদতে সব কথা বলে –হে প্রভু! আর অর্জুনের হাত থেকে আমাদের রক্ষা নেই। তাঁর উপর সুভদ্রা রথ চালাচ্ছেন। তারা কখনও মেঘে লুকায়, কখনওবা শূন্য মাঝে। খঞ্জন পাখির মত যেন নাচ করছে। সৈন্যদের মধ্যে দিয়ে ঘন ঘন ফণির মত চলে। সৈন্যদের ঘন ঘন প্রদক্ষিণ করে, যেমন মৎস জলে চরে। ডানদিকে, বামদিকে রথ বায়ুবেগে ছুটে, কখনও মাটিতে কখনওবা সূর্যমণ্ডলে ওঠে। 
সৈন্যদের সাথে অর্জুন যুদ্ধ করলেও, সে যে কোথায় কেউ বুঝতেই পারছে না। নানাবর্ণে ধনঞ্জয় অস্ত্র বর্ষণ করছেন। অগ্নি অস্ত্রে কোথাও দাবানল দেখা দিল। কোনখানে সৈন্য মাঝে বায়ু অস্ত্র মারছেন। কোথাও বা ভুজঙ্গ(সর্প) অস্ত্র মারলেন। কোনখানে জল-বৃষ্টি-শীতে তনু কাঁপে। কোথাওবা শর জালে ভানু(সূর্য) ঢেকে দেন। অর্জুনই সবাইকে মেরে যাচ্ছেন। কেউ তাঁকে ছুঁতেও পারছে না। কত যে সৈন্য মরছে, তা কেউ বলতে পারবে না। 
তাঁর এই যুদ্ধ দেখে সকলেই চমৎকৃত। সকল কুমাররা মিলে আমায় দূত করে বার্তা পাঠাল। 

মুষলী(বলরাম) দূতে বলেন –সত্য করে বল। অর্জুন এমন তুরগ রথ কোথায় পেল! 

দূত বলে –হে যাদবেন্দ্র(বলরাম), বলতে ভয় হয়। গোবিন্দের রথ, সুগ্রীবাদি ঘোড়া [কৃষ্ণের রথের চারটি ঘোড়া। শৈব্য-গায়ের রং সবুজাভ হরিতাভ, সুগ্রীব-স্বর্ণাভ তুষারসদ বর্ণ, মেঘপুষ্প-নীলাভ নবীন জলধরের মত এবং বলাহক-ভস্মবর্ণ] দেখলাম। 
সারথি দারুককে দেখলাম বাঁধা অবস্থায় রথে বসে আছেন। 
সুভদ্রাকে দেখলাম সারথি হয়ে রথ চালাচ্ছেন। 

দূত মুখে এত কথা শুনে বলরাম মাটিতে মাথা হেঁট করে বসে পরলেন। অভিমানে তাঁর চোখ দিয়ে জল বইতে থাকল। তাঁর অঙ্গের কস্তূরী গন্ধে চারদিক আমোদিত হয়ে উঠল। সর্বাঙ্গ বয়ে তাঁর কালঘাম বইতে থাকে। 
যদুবীরদের দিকে তাকিয়ে বলরাম বলেন –গোবিন্দ দেখছি আমায় অপমান করছে। নিজের সারথি ও ঘোড়া সহ রথ অর্জুনকে দিল। অর্জুনের কি শক্তি যে এমন কাজ করতে পারে! না বুঝে আমি অর্জুনকে দোষি মনে করেছিলাম। আমার সামনে মিথ্যে কথা বলল! এখন আমার সামনে আসবে কিভাবে তাই ভাবছে।
দুর্যোধনকে বিবাহ কারণে ডেকে পাঠালাম। অধিবাস অনুষ্ঠানের জন্য ব্রাহ্মণরা বসে আছেন! 

এতসব বলে বলরাম অধোমুখে বসে রইলেন। সেই সময় নবঘনশ্যাম কৃষ্ণ সেখানে উপস্থিত হলেন। ভূমিতে পরে বলরামকে প্রণাম করলেন। ক্রোধে বলরাম তাঁর দিকে তাকালেন না। 

গোবিন্দ বলেন –হে স্বামী(প্রভু), রাগ কেন করছেন! আপনার পদতলে আমি কোন অপরাধ করলাম! 

উগ্রসেন(বলরাম) বলেন –তুমি বড়ই কুকর্ম করেছ। তুমি পার্থকে ভদ্রা হরণ করতে বলেছ। সে কারণেই নিজের রথ, সারথি ও তুরঙ্গ(ঘোড়া) দিয়েছ। তোমাকে দোষ দেব না তো আর কাকে দোষ দেব! 

গোবিন্দ বলেন –সবাই জানেন সেই রথে পার্থ ভ্রমণ করতেন। আমি কি ভাবে জানব সে ভদ্রা হরণ করবে! নরমায়া বুঝতে আমি পারি না। প্রভু অকারণে আমার উপর আক্রোশ করছেন। সুভদ্রা যদি নিজেই রথ চালাতে চান, দারুকের তাতে কি দোষ! 
হে দূত সত্য করে বল দারুক সে রথে কি করছিল! 

দূত বলে –দারুক নিজের বশে নেই। পার্থ তাকে বেঁধে রেখেছেন। 

শ্রীকৃষ্ণ বলেন –যাদবরা সকলে শুনুন আমার কথা অনুভব করুন। 

আদিপর্ব মহাভারতের বিচিত্র উপাখ্যান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।
......................................

Sunday, November 29, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৩

[পূর্বকথা - সুভদ্রা বিবাহ-কারণে সত্যভামার মহাচিন্তা শুরু হল ..... কৃষ্ণের মত জেনে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা নিলেন সুভদ্রাকে বিবাহের .....অন্যদিকে বলরাম হস্তিনায় দূত প্রেরণ করে দুর্যোধনে বিবাহের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন ...দুর্যোধন আনন্দে বরবেশে দ্বারকায় গমন করল...যুধিষ্ঠির ও সংবাদে আশ্চর্য হলেও ভীমকে সাথে যেতে আজ্ঞা দিলেন...কৃষ্ণের কথা মত অর্জুন সরস্বতীর তীর থেকে সুভদ্রাকে হরণ করলেন... ] 

যাদবগণের অর্জ্জুনের পশ্চাদ্ধাবনঃ



গদ, শাম্ব, চারুদেষ্ণ, সাত্যকি, সারণ প্রমুখ বীর তাদের রথ পবনের গতিতে চালিয়ে দিল। 
যদুবীররা উচ্চস্বরে অর্জুনকে বলতে থাকে –পালিও না, হে অর্জুন! আমাদের কথা শোন। 

শুনে অর্জুন সারথি দারুককে বলেন –হে দারুক, রথের মুখ ফেরান। ক্ষত্রিয়েরা ডাকছে, তাদের প্রবোধ না দিয়ে যেতে পারব না। 

দারুক বলে –পার্থ একি অদ্ভুত কথা বলছেন! গোবিন্দের চেয়েও গোবিন্দের সন্তানদের কথা বেশি শুনচ্ছেন! পিছনে দেখুন অপ্রমিত, পরাক্রমী, ত্রৈলোক্য অজেয় সেনাবাহিনী। এদের সাথে আপনার একা যুদ্ধ করা ঠিক হবে না। ক্ষত্রনীতিতেও বলে সময় বুঝে যুদ্ধ করা উচিত। আমি রথ ফেরাতে পারব না। আপনি যেখানে যেতে চান নিয়ে যাব। বলুন এখন ইন্দ্রপ্রস্থে রথ নেব, না ইন্দ্রের নগরে যাব। কুবের, বরুণ, যম, ইন্দ্রের সদন যেখানেই বলবেন সেখানেই যেতে পারি। কিন্তু রথের মুখ ঘোরাতে পারব না। আর কি ভাবে যাদবদের সাথে যুদ্ধ করাব! কৃষ্ণের এই রথে চড়ে কৃষ্ণপুত্রদের মারতে দিতে আমি পারি না।

পার্থ বলেন –দারুক, এ উচিত কার্য নয়। তারা যুদ্ধের জন্য আমায় ডাকছে। ক্ষত্রধর্ম অনুসারে আমি এখন পালাতে পারি না। তাঁর উপর এরা যে আমায় তাড়া করেছে। এখন পালালে এই অপযশ পৃথিবীতে প্রচার হবে যে শৃগালের মত আমি পালিয়েছি। কৃষ্ণপুত্র আসুক কিংবা স্বয়ং কৃষ্ণ অথবা যুধিষ্ঠির বা ভীম যুদ্ধক্ষেত্রে যিনি আমায় যুদ্ধে ডাকবেন ক্ষত্রধর্ম অনুসারেই আমি তাঁর সাথে সংগ্রাম করব। 
আমি জানি তুমি যদুকুলের হিত চাইবে। এখন আর তোমার সারথি কর্ম সম্ভব নয় বুঝেছি। প্রবোধ দেওয়া বন্ধ কর, ছাড় কড়িয়ালি(বলগার কড়া যা ঘোড়ার মুখে থাকে)। আমি নিজেই রথ চালিয়ে যুদ্ধ করব, তুমি সরে যাও। 

এই বলে পার্থ নিজেই রথের রশি কেড়ে নিয়ে ডান দিকের রথস্তম্ভে দারুককে বাঁধলেন। এক পায়ে কড়িয়ালি, অন্য পায়ে বাড়ি(লাঠি/দন্ড) আর হাতে তুলে নিলেন ধনুর্গুণ। 

সুভদ্রা বলেন –হে মহাবীর, এত কষ্ট কেন করছেন। আজ্ঞা করুন আমি ঘোড়াদের চালাই। এই রথে আমি সত্যভামা, রুক্মিণীর সাথে তিনপুর ভ্রমণ করতাম। সত্যভামা স্নেহ করে সব সময় আমায় সঙ্গে নিতেন। আমিই তাঁর সারথি হয়ে রথ চালাতাম। আমার নৈপুণ্য দেখে দেব দামোদর কৃষ্ণ কত ধন্য ধন্য করতেন! আজ্ঞা করুন কোন পথে রথ চালাতে হবে। 
এই বলে ভদ্রা কাড়িয়ালি হাত বাড়িয়ে নিয়ে বায়ুবেগে রথ চালালেন। চোখের নিমেষে রথ আদিত্যমন্ডলে গেল। সেখান থেকে ভদ্রা হয়বর(ঘোড়াদের) সৈন্যদের প্রদক্ষিণ করে নিয়ে এলেন। রথের চঞ্চল গতি অতি মনোহর, দেখে মনে হয় যেন সৈন্য মাঝে নর্তকী নাচ করছে। বিদ্যুৎবরণী ভদ্রা, পার্থ জলধর। বিদ্যুতের মত তিনি যেন মেঘে প্রবেশ করেন। 

দেখতে দেখতে যাদববীররা মুর্চ্ছিত হয়ে রথে পরে গেল। পার্থ ধনুর্ধর অনেক সেনা মারলেন। কোটি কোটি রথী মারা পরল, অসংখ্য কুঞ্জর(হাতি) কাটা পরল। রক্তের নদী বয়ে গেল। সকলে তাতে সাঁতার কাটে। 

পার্থকে কালরূপে দেখে সকলে ভয় পেল। কামদেব ও সারণ বিচার বিবেচনা করে বলরামের কাছে দূত প্রেরণ করল। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরামদাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।
......................................

Sunday, November 22, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১২

[পূর্বকথা সুভদ্রা বিবাহ-কারণে সত্যভামার মহাচিন্তা শুরু হল ..... কৃষ্ণের মত জেনে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা নিলেন সুভদ্রাকে বিবাহের .....অন্যদিকে বলরাম হস্তিনায় দূত প্রেরণ করে দুর্যোধনে বিবাহের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন ...দুর্যোধন আনন্দে বরবেশে দ্বারকায় গমন করল...যুধিষ্ঠির ও সংবাদে আশ্চর্য হলেও ভীমকে সাথে যেতে আজ্ঞা দিলেন...] 

অর্জ্জুনের সুভদ্রা হরণঃ 



বলরামের আজ্ঞা পেয়ে সব নারীরা পিটালি(চালগুঁড়ো গোলা), হরিদ্রা(হলুদ) নিয়ে উদ্ধর্ত্তন(মাখান) শুভকর্ম শুরু করল। 
ভদ্রার চুলে আমলকী সুগন্ধী তেল মাখান হল। স্নান করাতে তাকে সরস্বতী নদীর কূলে নিয়ে চলল। 
কৃষ্ণের আজ্ঞা পেয়ে দেবী সত্যভামা অনেক যুবতীর সাথে ভদ্রাকে নিয়ে চললেন। 

অর্জুনকে ডেকে কৃষ্ণ বলেন –শুনেছ তো দুর্যোধন কি বলে পাঠাল। বলরাম আজ অধিবাস করাতে বলছেন। সেই কারণে আজ ভদ্রাকে সরস্বতী নদীতে স্নানে পাঠালাম। আমার রথ নিয়ে তুমি ছলনা করে মৃগয়ায় যাও। সেই পথ ধরে ভদ্রাকে নিয়ে পালাও। 

কৃষ্ণ তার সারথী দারুককে ডেকে ইঙ্গিতে বলেন –অর্জুনকে নিয়ে তুমি আমার রথে যাও। অর্জুনের আজ্ঞা পালন করবে। যেখানে রথ নিয়ে যেতে বলবে, সেখানেই যাবে। 
কৃষ্ণের আজ্ঞা পেয়ে দারুক দ্রুত কৃষ্ণের রথ সাজিয়ে অর্জুনের সামনে হাজির হল। 
অর্জুন সুসজ্জিত হয়ে রথে উঠলেন। সঙ্গে ধনুঃশর, খড়্গ, ছুরী, গদা, শূল, চক্র নিলেন। 

কৃষ্ণরথে আরোহণ করে মহাবীর অর্জুন সরস্বতীর তীরের উদ্দেশ্যে চললেন। সুভদ্রা যেখানে নারীদের মাঝে স্নান করছিলেন সেখানে পার্থ ধিরে ধিরে পদব্রজে গেলেন। ভদ্রাকে ধরে রথে তুলে ইন্দ্রপ্রস্থের পথে ছুটলেন। 

অন্যান্য যুবতীরা হাহাকার করতে লাগল –‘কুন্তীপুত্র সুভদ্রা হরণ করল’-রব উঠল। 
শব্দ শুনে সভাপালরা দৌড়ে এল। ‘ধর, ধর’ বলে তারা অর্জুনকে তাড়া করল –আরে পার্থ তোমার কি মতিচ্ছন্ন হল! কোন সাহসে তুমি এমন ঘরে চুরি করলে! পালিয়ে যেও না! 
বলে সকলে দৌড়াতে লাগল। সিংহকে দেখে যেন শৃগালরা ডাক ছারল। পার্থ ধনুকে গুণ দিয়ে শরজালে সহজেই নিমেষে তিন লক্ষ সভাপালকে কাটল। সভাপালদের মেরে রথ চালিয়ে পার্থ দশ ক্রোশ পথ নিমেষে চলে গেলেন। 

সুভদ্রার হরণ বার্তা শুনে সবাই পিছু তাড়া করতে গেল। যদুরা কেউ স্নান করছিল, কেউবা দান, ভোজন, শয়নে ব্যস্ত ছিল। সকলে এই সংবাদ শুনে তখনই সব কাজ ফেলে দৌড়াল। 

কামপাল বলরাম ক্রোধে কাঁপতে থাকেন। দুই চোখ যেন স্ফুটিত কোকনদ(লালপদ্ম)। চারদিকে ‘ধর, ধর’ রব। 
বলরামও যাকে সামনে পান তাকেই ‘ধর গিয়ে’ আজ্ঞা দেন। কাঁপতে কাঁপতে তিনি নীলধ্বজে উঠলেন। সঙ্গে তাঁর সাতকোটি রথ ও গজ চলল। 
বলরামের আজ্ঞা পেয়ে সবার আগে কাম(কৃষ্ণ পুত্র) চললেন। সারণ(কৃষ্ণের বৈমাত্রের ভাই) এলেন সাত কোটি রথী নিয়ে। গজ, অশ্ব, পদাতিক নিয়ে কৃপ, বৃন্দ, উপগদ, কৃতবর্মা প্রমুখ যদুবীররা এল। গদ, শাম্ব(কৃষ্ণ পুত্র)ও বহু সেনা নিয়ে এল। বলরামের আজ্ঞা পেয়ে সবাই অর্জুনকে ধরতে দৌড়াল। 

হলধর –‘ধর গিয়া’ বলামাত্র সারণ বীর সসৈন্য সত্বর চলল। উগ্রসেন, বসুদেব, সাত্যকি, উদ্ধব প্রমুখ বীররা বলরামের কাছে এলেন। ক্রোধে বলরামের শরীর থরথর কাঁপতে থাকে। শরীর ফুলে ফুলে পর্বতের আকার নেয়। প্রলয় মেঘের মত শব্দ হতে থাকে তাঁর গলা দিয়ে। শরীর থেকে তাঁর মালা ছিঁড়ে পরে। 

বলরাম ক্রোধের সাথে বলেন – পান্ডবের এত গর্ব হল! শ্বা(কুকুর) হয়ে যজ্ঞহবি(যজ্ঞের ফল) নেওয়ার সাধ! চন্ডাল হয়ে ব্রাহ্মণী পাওয়ার ইচ্ছে! গরুড়কে ভুলে যেমন কালফণী মাথা তোলে, তেমনি এর আচরণ! যে পুরীতে চন্দ্র, সূর্য, বায়ুর তেজ ধিরে চলে, যেখানে শমনের(যম)ও আসার শক্তি নেই, সেখান থেকে আমার বোনকে চুরি করে নিয়ে গেল। ঐ দুরাচারের নিশ্চয়ই মতিচ্ছন্ন হয়েছে। এই দোষে তাকে আজ সমূলে মারব। বংশে বাতি দেওয়ার কেউ থাকবে না। তাঁর বংশে যে যে আছে সকলকে মারব। পৃথিবী খুঁড়ে আজ তাদের বংশ ধ্বংস করব। ইন্দ্রপ্রস্থের মাটি আজ লাঙ্গল চালিয়ে উল্টে দেব সমুদ্রের জলে। দেখি আজ আমার শত্রুকে কে রক্ষা করতে পারে। ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ, পঞ্চানন কেউ আজ পাণ্ডবদের রক্ষা করতে পারবে না। আমি পাণ্ডবদের মন্দ রীতিনীতির কথা সব জানি। 
কৃষ্ণ সে সব না জেনেই তাদের প্রতি সখ্যতা দেখায়। তাদের উপর সব সময় প্রীত থাকে। সেই প্রীতির ফলেই অর্জুনকে অন্তঃপুরে থাকতে দিলেন। সে জন্যই আজ এতবড় অপমান হল। যত স্নেহ করা হল তার গুণ শোধ করল। বোনকে চুরি করে কুলের মুখে চুন কালি দিল। এর প্রতিফল দুষ্ট আজই পাবে। 

এই বলে রাম সুসজ্জিত হয়ে বের হলেন। বাম হাতে লাঙ্গল ধরলেন, ডান হাতে মুষল(মুদ্গর, মুগুর/গদা)। দেখে তাকে মনে হল বজ্র হাতে ইন্দ্র যেন উপস্থিত হয়েছেন। 

কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে দূত পাঠালেন –এসে দেখ তোমার প্রিয় সখার কুকর্ম! 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীদাস কহেন সাধুজন সদা করেন পান। 
......................................

Sunday, November 15, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১১

[পূর্বকথা দুর্যোধনের কন্যা লক্ষণার স্বয়ম্বর হলে, কৃষ্ণ পুত্র শাম্ব তাকে হরণ করেন...কর্ণের সাহায্যে তাকে বন্দি করা হয়...নারদের মুখে পুত্রের দুর্দশার সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণ ক্রোধে যুদ্ধে যাত্রা করতে গেলে বলরাম তাকে নিরস্ত করে নিজে যান…কিন্তু দুর্যোধন শাম্বকে ছাড়তে না চাইলে ক্রোধে বলরাম হস্তিনানগর ধ্বংসে উদ্যত হন…তখন দুর্যোধন ভয়ে কন্যা লক্ষণা ও জামাতা শাম্বকে বলরামের হাতে তুলে দেন…এদিকে সুভদ্রা বিবাহ-কারণে সত্যভামার মহাচিন্তা শুরু হল ..... কৃষ্ণের মত জেনে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা নিলেন সুভদ্রাকে বিবাহের .....অন্যদিকে বলরাম হস্তিনায় দূত প্রেরণ করে দুর্যোধনে বিবাহের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন ......]

দুর্যোধনের বরবেশে দ্বারকায় গমনঃ 



দুর্যোধন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের কাছে দূত পাঠাল –আপনারা সকলে সপরিবারে আমার বিবাহে আসবেন। 

পত্র পেয়ে যুধিষ্ঠির অবাক হলেন। তিনি সহদেবকে বলেন –অর্জুন আগে লিখে জানাল সুভদ্রার কথা। দুর্যোধন আবার এখন সেই ভদ্রাকে বিবাহ করতে চলেছে। এযে অসম্ভব ব্যাপার! একিভাবে সম্ভব সহদেব, কিছু বল! 

সহদেব বলেন –শুনুন নরনাথ! সুভদ্রার সাথে অর্জুনের সাতদিন আগেই বিবাহ হয়ে গেছে। সত্যভামা লুকিয়ে এই বিবাহ দিয়েছেন। কৃষ্ণের আজ্ঞায় বলরামকে সে কথা জানান হয়নি। বলরামের ইচ্ছে ভদ্রাকে দুর্যোধনের হাতে দেবেন। তাই রামের অনুরোধে দুর্যোধন চলেছে। এর উচিত বিধান আপনাকেই করতে হবে, মহারাজ! এ নিয়ে বেশি চিন্তা করবেন না। 

যুধিষ্ঠির বলেন –এতো লজ্জার বিষয়। আমার সেখানে যাওয়া উচিত হবে না। কেউ না গেলে রাজা দুর্যোধন দুঃখী হবে। 
সে কারণে যুধিষ্ঠির ভীমকে সসৈন্য যাত্রার আজ্ঞা দিলেন। 

রাজার আজ্ঞা পেয়ে বীর বৃকোদর ভীম পাঁচ অক্ষৌহিণীর দল নিয়ে দ্রুত রওনা হলেন। 

আনন্দে দুর্যোধন বরবেশে সেজে ওঠে। রত্নময় চতুর্দোলায় আরোহণ করে। নানা শব্দে বাদ্য বাজতে থাকে। হয়(ঘোড়া), হাতি, রথ, সেনা অগণন চলতে থাকে। 

দুর্যোধনের বরবেশ দেখে ভীম রেগে বলেন –আরে অবোধ! এখান থেকে দ্বারকা তো বহু দূর। এখান থেকে বরবেশে যাত্রার কি আছে! 

দুঃশাসন বলে –এতে কি দোষ হল! সুন্দর সজ্জা যদি সহ্য না হয় তবে আমাদের পিছু পিছু এস। 

ভীম বলেন –ভাল কি মন্দ তা শেষে বুঝবে। কোন কন্যাকে বরবেশে বিবাহ করতে চলেছ! তোমাদের কাছে দূত দেরিতে গেছে। সুভদ্রার বিবাহ আজ এক সপ্তাহ আগেই হয়ে গেছে। অকারণে সভার মাঝে বরবেশে গিয়ে লজ্জা পাবে। তাই ও বেশের দরকার নেই বলছিলাম। পিছু পিছু কেন যাব, আমি বরং এগিয়ে চলি। 
এই বলে সসৈন্য বীর ভীম বেগের সাথে এগিয়ে গেলেন।

ভীমের কথা শুনে শকুনি, কর্ণ সহ দুর্যোধন বিস্মিত হল। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর পরস্পরের মধ্যে কানাকানি করতে থাকেন। 

দুঃশাসন বলে –বৃকোদর এমন ভাবে কথা গুলো বলে গেল যেন সবই সত্য। তোমরা কি যান না ভীমের দুষ্ট বুদ্ধি! দুর্যোধনকে বরবেশে দেখে তার হিংসা হয়েছে। তাই বাতুলের(ক্ষেপা) মত যা মুখ এল তাই বলে গেল। বুকে শেল বেজেছে তাই এত দ্রুত চলেছে। 

কর্ণ ও দুর্যোধন সে কথায় খুশি হয়ে বলে –ঠিক বলেছ।এই বৈভব দেখতে পারছে না বলে এগিয়ে গেছে। 
এসব বিচার করে তারা যাত্রা করতে লাগল। তিন দিনে শত যোজন পথ চলল। 

রাজা দুর্যোধন তখন যুক্তি করে দূতের হাতে পত্র লিখে শীঘ্র গতি বলরামের কাছে পাঠাল –রোহিণীনক্ষত্র শেষ অক্ষয় তৃতীয়া দ্বিতীয় প্রহরে কাল আমরা উপস্থিত হচ্ছি। আজ রাতেই কন্যার অধিবাসের(বিবাহের পূর্ববর্তী শুভ অনুষ্ঠান) ব্যবস্থা করুন। কাল রাত্র বিবাহের জন্য শ্রেষ্ঠ লগ্ন তিথি। 

দূত সেই পত্র গিয়ে মুষলীর(বলরাম) হাতে দিল। 
পত্র পড়ে আনন্দিত বলরাম সভায় সকলকে বলেন –আজ রাতেই ভদ্রার গন্ধ অধিবাস করা হোক। রাজা দুর্যোধন সাজসজ্জা করে কাছেই চলে এসেছেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীরাম কহেন সদা, শুনেন পুণ্যবান।
......................................

Monday, November 9, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১০

[পূর্বকথা - সুভদ্রার ইচ্ছে রাখতে সত্যভামা কৌশলে তার গন্ধর্ব বিবাহ দিলেন অর্জুনের সাথে ... কৃষ্ণ সভায় অর্জুনকে সুভদ্রার জন্য উপযুক্ত পাত্র নির্বাচন করলে বলরাম ক্রুদ্ধ হল, তিনি দুর্যোধনকে পাত্র ঠিক করলেন ... দুর্যোধনের কন্যার সাথে কৃষ্ণের পুত্রের বিবাহ প্রসঙ্গ উঠল...দুর্যোধনের কন্যা লক্ষণার স্বয়ম্বর হলে, কৃষ্ণ পুত্র শাম্ব তাকে হরণ করেন...কর্ণের সাহায্যে তাকে বন্দি করা হয়...নারদের মুখে পুত্রের দুর্দশার সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণ ক্রোধে যুদ্ধে যাত্রা করতে গেলে বলরাম তাকে নিরস্ত করে নিজে যান…কিন্তু দুর্যোধন শাম্বকে ছাড়তে না চাইলে ক্রোধে বলরাম হস্তিনানগর ধ্বংসে উদ্যত হন…তখন দুর্যোধন ভয়ে কন্যা লক্ষণা ও জামাতা শাম্বকে বলরামের হাতে তুলে দেন…]

সুভদ্রা বিবাহ-কারণ সত্যভামার মহাচিন্তা ও হস্তিনায় দূত-প্রেরণঃ


সুভদ্রার সাথে অর্জুন

মুনি বলেন –শুনুন মহারাজ, বলরামের কথা শুনে মা দেবকী ও রোহিণী অত্যন্ত দুঃখী হয়ে অধোমুখে বসে থাকেন। 

দেখে সতী সত্যভামা বলেন –হে ঠাকুরাণী, সর্বনাশ হবে। পার্থকে ভদ্রা সমর্পণ না করলে সে সকলকে মারবে। 

রোহিণি বলেন –কত প্রাণ যাবে তার ঠিক নেই। সুভদ্রার কারণে অনেক হত্যা হবে। এর চেয়ে এখনই ভদ্রার মৃত্যু ভাল ছিল। বিষ খাক, অথবা জলে ডুবে মরুক। তার মৃত্যুতে সব বিপদ কাটবে। আমি তাঁকে নিয়ে জলে ঝাঁপ দেব। 

সংসারে লোকলজ্জা, স্ত্রীহত্যা পাপ এসব ভেবে অস্থির সতী সত্যভামা আবার গোবিন্দের কাছে উপস্থিত হয়ে দেবকী ও রোহিণীর সব কথা বলেন। 

গোবিন্দ বলেন –হে প্রিয়ে, তোমার ভয় কি! এর উপায় আমি বার করব। তুমি দূত পাঠাও ধনঞ্জয়ের কাছে। 

সতী বলেন –এসব দূতের কাজ নয়, আমি নিজেই চললাম। 

এই বলে দেবি একাই পার্থের গৃহে উপস্থিত হলেন। 

সেখানে সুভদ্রার সাথে অর্জুনকে দেখে তিনি বলেন –কি নিশ্চিন্তে পার্থ ভদ্রার সাথে আছ! এদিকে যে কি বিপদ উপস্থিত হয়েছে কিছু যান না। 

পার্থ বলেন –কিসের বিপদ আমার! দেবী আপনার দুই পা যার সহায় তার কোন বিপদ হতে পারে না। 

পার্থকে নিয়ে সতী কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হলেন। 

কৃষ্ণ পার্থের হাত ধরে তাকে পালঙ্কে বসিয়ে বলেন –হে সখা, শুন! পিতার আজ্ঞা দিলেন সুভদ্রা তোমার হাতে সমর্পণের জন্য। কিন্তু লাঙ্গলী বলরাম বলছেন তিনি দুর্যোধনের হাতে ভদ্রাকে দেবেন। সে কারণে দুর্যোধনের কাছে দূতও পাঠান হয়েছে। এখন কি উপায় বার করা যায় বল। 

সব শুনে হেসে কুন্তীপুত্র বলেন –এই কথা ভেবে আপনার এত চিন্তা কেন, সখা! আপনার প্রসাদে আমি ত্রিভুবন জয় করতে পারি। কামপাল বলরামের কত শক্তি দেখি, আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। আপনি এত চিন্তা করবেন না। আমি সবার সামনে দিয়ে ভদ্রাকে নিয়ে যাব। যুদ্ধ করতে হলে করব। হলধরও দেখবেন। 

শ্রীকৃষ্ণ বলেন –দ্বন্দ্বে কাজ নেই। তুমি লুকিয়ে ভদ্রাকে নিয়ে চলে যাও। আমার রথে চড়ে ছলনা করে মৃগয়া করতে যাও। পরে আমি ভদ্রাকে স্নানের হেতু পাঠাব। সে সময় তুমি তাকে নিয়ে চলে যাবে। পরে আমি রেবতীরমণ বলরামকে শান্ত করব। 

দেবকীপুত্র কৃষ্ণের সব কথা শুনে অর্জুন সম্মত হয়ে বলেন –হে দেবতা, যা আপনার আজ্ঞা তাই হবে। 

এতসব বিচার বিবেচনা করে দুজনে নিজেদের গৃহে শুতে গেলেন। 

প্রভাতে উঠে স্নানদান করে পার্থ চিন্তিত হলেন –বিপদ উপস্থিত হবে যদি বলরামের সাথে যুদ্ধ হয়। এদিকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এসব কথা কিছুই জানেন না। 

এতসব ভেবে তিনি ইন্দ্রপ্রস্থে দূত পাঠালেন। 
দূতের হাতে সবিস্তারে সব লিখে জানালেন –হে মহারাজ! কৃষ্ণের ইচ্ছে আমার হাতে সুভদ্রাকে তুলে দেওয়ার। কিন্তু কামপাল বলভদ্র তা চান না। তাই কৃষ্ণ বলছেন ভদ্রাকে লুকিয়ে নিয়ে যেতে। এই কারণে আমি আপনার আজ্ঞা চাইছি। 

সব পড়ে, শুনে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলে পাঠান –বল ও বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠ নারায়ণ কৃষ্ণ সব সময় পাণ্ডবদের প্রিয় সখা। তিনি যে কাজ করতে বলবেন তাই করবে। 

দাদার আজ্ঞা পেয়ে পার্থ মনে মনে আনন্দিত হলেন। এভাবে সাতটি রাত কেটে গেল। 
এদিকে রাজা দুর্যোধনও সকল বার্তা শুনল। পিতা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ও মাতা গান্ধারী এ সম্বন্ধে আনন্দিত হল। 
অন্য সকলেও খুশি হয়ে ভাবে –কৃষ্ণের ভগ্নীপতি হবে দুর্যোধন! দেশে দেশে তার আরো বন্ধু সংখ্যা বেড়ে যাবে। 
সবাই সেই আনন্দে বিবাহ সামগ্রী নিয়ে আলোচনা করে, স্থানে স্থানে বসে সে বিষয়ে বিচার বিবেচনা হতে থাকে। 
সবাই বলে –দুর্যোধনকে পাণ্ডবদের আর ভয় পেতে হবে না, আজ থেকে নির্ভয় হল। নারায়ণ কৃষ্ণ সব সময়ই পাণ্ডবদের সহায়। এখন থেকে দুর্যোধনও তাদের আত্মবন্ধু হল। 

দ্রোণাচার্য বলেন –কৃষ্ণ কুটুম্বতায় প্রীত হন না। কৃষ্ণ কেবল ভক্তের হিত করেন। 

বিদুর বলেন –এতো আশ্চর্য কথা বললেন! 

কৃপাচার্য বলেন –একথা মনে হচ্ছে ঠিক নয়। গোবিন্দ কখনই দুর্যোধনের উপর খুশি নন। তিনি এমন সম্বন্ধ করবেন বিশ্বাস হয় না। 

তখন তারা সকলে দূতের কাছে উপস্থিত হয়ে সবিস্তারে সব জানলেন –দ্বারকায় বর্তমানে কুন্তীপুত্র অর্জুন আছেন। অচ্যুত(যিনি নিজ পদ থেকে চ্যুত হন না) কৃষ্ণ তাকেই ভদ্রা দান করতে চান। কিন্তু পান্ডবে অপ্রীত বলরাম পার্থকে ভদ্রা দিতে অস্বীকার করেছেন। রোহিণীকুমার দুর্যোধনকেই ভগ্নী অর্পণ করতে চান। কৃষ্ণ দুর্যোধনকে ভদ্রা দিতে চান না। তাই এখনও কিছু ঠিক হয়নি। পরে কি হয় তাই দেখার। 

ভীষ্ম সব শুনে বলেন –দুর্যোধন গিয়ে লজ্জা পাবে মাত্র। তবে যেই বিয়ে করুক আমরা অবশ্যই বরযাত্রী হব। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম কহেন সদা শুনেন পুণ্যবান।
......................................

Wednesday, September 16, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০৯

[পূর্বকথা সুভদ্রা হরণের কথা... সুভদ্রার ইচ্ছে রাখতে সত্যভামা কৌশলে তার গন্ধর্ব বিবাহ দিলেন অর্জুনের সাথে ... কৃষ্ণ সভায় অর্জুনকে সুভদ্রার জন্য উপযুক্ত পাত্র নির্বাচন করলে বলরাম ক্রুদ্ধ হল, তিনি দুর্যোধনকে পাত্র ঠিক করলেন ... দুর্যোধনের কন্যার সাথে কৃষ্ণের পুত্রের বিবাহ প্রসঙ্গ উঠল...দুর্যোধনের কন্যা লক্ষণার স্বয়ম্বর হলে, কৃষ্ণ পুত্র শাম্ব তাকে হরণ করেন...কর্ণের সাহায্যে তাকে বন্দি করা হয়...]

শাম্বের বন্ধন-সংবাদ লইয়া নারদের গমনঃ 



নারদ মুনি কৃষ্ণের কাছে চললেন পুত্রের সংবাদ নিয়ে। 

কৃষ্ণকে গিয়ে নারদ বলেন –হে হরি, শাম্বের সংবাদ শুনুন। দুর্যোধনের কন্যার স্বয়ম্বরের স্থান থেকে তাকে হরণ করার অপরাধে দুর্যোধন তাকে যুদ্ধে ইন্দ্রজালে জয় করে বন্দী বানিয়েছে। তাকে এত মারা হল যে বলে বোঝাতে পারব না। শেষে শ্মশানে কাটতে নিয়ে যায়। যুধিষ্ঠিরের চেষ্টায় ভীমসেন তাকে রক্ষা করেন। অনেক কষ্টে ভীষ্ম তাকে তাঁর গৃহে বন্ধ করে রেখেছেন। সেখানেও ক্ষুধায় আকুল শাম্ব নানা কষ্টে প্রাণ মাত্র নিয়ে বেঁচে আছে। দুর্যোধন আপনাকে এত গালি দিল, আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। 

সব শুনে কৃষ্ণ ক্রোধে অস্থির হয়ে তখনই যদু সৈন্যদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিলেন। 
সব ঘটনা শুনে হলধর বলরাম দুর্যোধনের জন্য চিন্তিত হলেন। ক্রোধে কৃষ্ণ সেনা সাজিয়ে চলেছেন, আজ দুর্যোধন সবংশে ধ্বংস হবে নিশ্চয়ই। 
এত সব চিন্তা করে রেবতীপতি বলভদ্র কৃষ্ণের কাছে গিয়ে বিনয়ের সাথে বলেন –তুমি কি কারণে যাচ্ছ! আমি নিজে গিয়ে পুত্রবধূ ঘরে আনব। 
এভাবে কৃষ্ণকে অনেক বুঝিয়ে বলরাম নিজেই কৃষ্ণকে দ্বারকায় রেখে হস্তিনাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। 

হস্তিনানগরে পৌছে তিনি দ্রুত দুর্যোধনের কাছে দূত পাঠিয়ে বলেন –দুর্যোধন, না বুঝে তুমি কৃষ্ণের কুমারকে গৃহে বন্দি করেছ। তাই তোমার দোষ ক্ষমা করছি। এখন আমার সামনে পুত্র ও পুত্রবধূ এনে দাও। 

দূতের কাছে এ বার্তা শুনে দুর্যোধন ক্রোধে থরথর কাঁপতে গর্জন করে বলে –বলরামকে গুরু মেনেছি তাই ছেড়ে দিলাম, অন্য কেউ হলে আজই শেষ করে দিতাম। আগে পুত্রকে চুরি করার জন্য পাঠান হল। আর এখন পুত্রবধূ এনে দাও হুকুম হচ্ছে! তার লজ্জা করে না এমন আবদারে! 
হে দূত, তুমি গিয়ে বল বলরাম ভালয় ভালয় নিজ গৃহে ফিরে যান। 

দূত গিয়ে সে সংবাদ দিতে বলরাম ক্রোধে ফেটে পরলেন। হাতে হাল ও মুগুর তুলে নিলেন। লাফ দিয়ে রথ থেকে তিনি ভূমিতে পরলেন। ক্রোধে থরথর অঙ্গ, পা চলে না। ধরণীতে সেখানেই তার লাঙ্গল গাঁথলেন। সেই লাঙ্গল টেনে তিনি পঞ্চ যোজন বিস্তৃত হস্তিনানগরকে বিদীর্ণ করে চললেন। রাজা, প্রজা, পাত্র, মন্ত্রী সকলে নগর সমেত গঙ্গাজলে পরতে লাগল। নগরে হাহাকার শুরু হল। সকলে উর্দ্ধশ্বাসে বলরামের স্থানে দৌড়াতে লাগল। 

ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, বিদুরকে নিয়ে শত ভাই দুর্যোধন ও পাণ্ডবরা করজোড়ে বলভদ্রের স্তুতি শুরু করে –হে রেবতীপতি, আমাদের রক্ষা করুন। আপনিই ব্রহ্মা, আপনিই বিষ্ণু ও মহেশ্বর। আপনার আদি-অন্ত নেই, আপনি চরাচরে ব্যাপ্ত। আপনি এভাবে ক্রোধী হলে সংসার ভস্ম হয়, সেখানে হস্তিনানগর কোন ছার! এখানে কত অসহায় বৃদ্ধ, শিশু, গো, ব্রাহ্মণ, যুবা, নর, নারী বাস করে। 
বিশেষ করে আপনার পুত্রবধূ লক্ষণাও এখানে আছেন। ক্ষমা করুন, কৃপা করুন। আমরা সবাই আপনার পায়ে পরছি। এইবার প্রভূ দয়া করে রক্ষা করুন। 

সবার এত স্তুতু শুনে বলরামের ক্রোধ শান্ত হল। তিনি লাঙ্গল তুলে রাখলেন। 

ততক্ষণে দুর্যোধন শাম্বকে আদর যত্ন করে নানা অলঙ্কারে সাজিয়ে লক্ষণার সাথে রথে করে বলরামের সামনে উপস্থিত হল। বিবিধ যৌতুক রামের সামনে সাজিয়ে রাখা হল। 

সব দেখে শুনে রেবতীরমণ বলভদ্র আনন্দিত হলেন। তখনই তিনি পুত্রবধূ নিয়ে রওনা দিলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীদাস কহেন, সাধু সদা করেন পান। 
......................................

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০৮

[পূর্বকথা সুভদ্রা হরণের কথা... সুভদ্রার ইচ্ছে রাখতে সত্যভামা কৌশলে তার গন্ধর্ব বিবাহ দিলেন অর্জুনের সাথে ... কৃষ্ণ সভায় অর্জুনকে সুভদ্রার জন্য উপযুক্ত পাত্র নির্বাচন করলে বলরাম ক্রুদ্ধ হল, তিনি দুর্যোধনকে পাত্র ঠিক করলেন ... দুর্যোধনের কন্যার সাথে কৃষ্ণের পুত্রের বিবাহ প্রসঙ্গ উঠল... ]

দুর্যোধনের কন্যা লক্ষণার স্বয়ম্বরঃ 


বৈশম্পায়ন মুনি বলেন –অবধান করুন রাজা দুর্যোধনের কন্যার স্বয়ম্বরের কাহিনী। 
ভানুমতীর গর্ভে এই একটি কন্যার জন্ম। রূপে, গুণে অনুপমা, সর্বগুণযুক্তা। ভুবন মোহিনী সুলক্ষণা বিভূষণা তাই তার নাম রাখা হল লক্ষণা। 
কন্যাকে যুবতী হতে দেখে রাজা স্বয়ম্বরের আয়োজন করলেন। পৃথিবীর সব রাজাদের আমন্ত্রণ করা হল। রূপবন্ত, গুণবন্ত, কুলে শীলে খ্যাত বহু রাজা রথ, গজ, অশ্বে উপস্থিত হল।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে গগন ছাইল, ধ্বজা, ছত্র, পতাকায় মেদিনী(পৃথিবী) ঢাকল। ধূলায় সূর্য ঢাকে গেল। সবাইকে দুর্যোধন সসম্মানে সিংহাসনে বসাল। 

নারদের মুখে কৃষ্ণ-জাম্ববতীর পুত্র শাম্ব বীর কন্যার রূপ বর্ণনা শুনে অস্থির হল। একাই সে রথে চড়ে স্বয়ম্বর স্থানে যাত্রা করল। পথে যেতে যেতে কেবল চিন্তা করে কিভাবে কন্যাকে পাবে। সবার অলক্ষে একা রথের উপর বসে রইল। 
এমন সময় লক্ষণাকে বাইরে আনা হল। অনুপম মুখ তার জিনি শরদিন্দু(শরৎকালের স্নিগ্ধ চাঁদকেও জয় করে)। ঝলমল কুন্ডল তার, মিহির(সূর্য) যেন অধর(ঠোঁট)কে রাঙ্গিয়ে তুলেছে। ভ্রূভঙ্গে অনঙ্গ(কামদেব) জয় সম্ভব। পাখির মত চঞ্চল চক্ষু(খঞ্জন) অঞ্জনে(কাজলে) রঞ্জিত। শুকচঞ্চুর(টিয়াপাখির ঠোঁট) মত নাক, শ্রুতি(কান) গৃধিনীকেও(শকুনী) লজ্জা দেবে। বিপুল নিতম্ব গতি মরালের(রাজহাঁস) মত। চরণে রসাল কিঙ্কিণী ও নূপুর বাজে। ধূমহীন অগ্নি কিংবা বিদ্যুতে যেন এর সৃষ্টি। শিশু সূর্যের যেন উদয় হল। 
দৃষ্টিমাত্র রাজারা চেতনা হারাল। কন্যার রূপ দেখে জাম্ববতীর পুত্রের মদনপীড়া হল। দ্রুত গতিতে এসে সে কন্যাকে ধরে রথে তুলে দ্বারকার পথে রথ চালিয়ে দিল। 
‘ধর, ধর’ বলে সেনারা তাড়া করল। নানা অস্ত্র নিয়ে কৌরবরা ধেয়ে গেল। 

কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব কৃষ্ণের সমান বীর। ধনুকে টঙ্কার দিয়ে বাণ ছাড়ল। চক্ষের নিমেষে অনেক সৈন্য কাটা পরল। নির্ভয়ে শাম্ববীর যুদ্ধ শুরু করল। হস্তী, অশ্ব, রথ, রথী সব কাটা পরতে লাগল। ভয়ে কেউ আর তার সামনে গেল না। 

ক্রোধে আগুন হয়ে সূর্যের নন্দন কর্ণ বলে –বালক হয়ে তোমার এত অহংকার! আমার সামনে কন্যা হরণ করে নিয়ে যাও! এখনি এর উচিত শিক্ষা দেব। 

এই বলে বীর কর্ণ ইন্দ্রজাল অস্ত্র প্রয়োগ করে শাম্বকে বেঁধে ফেলল। ‘চোর ধর, চোর ধর’ বলে রব উঠল। দুর্যোধন ‘কাট, কাট’ বলে আজ্ঞা দিল। 
দুর্যোধন বলে –আমার সামনে আমায় লঙ্ঘন করার শাস্তি একে দেব। দক্ষিণের শ্মশানে নিয়ে গিয়ে একে কাট। 

রাজার আজ্ঞা পেয়ে দুঃশাসন মারতে মারতে শাম্বকে নিয়ে চলল। 

দুর্যোধন কর্ণকে জিজ্ঞেস করে –এই চোর কার পুত্র তুমি কি চিনতে পারলে! 

কর্ণ বলে –মহারাজ, এ গর্ব আর কার! চোরের পুত্র ছাড়া আর কে এমন কাজ করবে। 

শুনে দুর্যোধন রাগে কাঁপতে থাকে। দাঁত কড়মড় করতে করতে, হাত কচলে সে বলে –গোকুলে গোপের খেয়ে বাড়ল বলে ক্ষত্রিয়েরা কেউ কন্যা দেয় না, তাই চুরি করে বেরায়। সেই চোরের জাতের চুরিতে আর কি লাজ, ভয়! সবস্থানে চুরি করে মনে সাহস বেরে গেছে দেখছি! তাই এই যমের ঘরে চুরি করতে এসেছে। সভা মাঝে এমন ভাবে আমাকে অপদস্ত করা! আর সহ্য হয় না, এখনই একে কাট। 

দুর্যোধন যখন এতসব বলছে, তখন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সেখানে এসে কে চোর তা দেখতে গিয়ে কৃষ্ণের পুত্রকে চিনতে পারলেন। 

দুর্যোধন রেগে যুধিষ্ঠিরকে বলে –মহারাজ আপনি একে ঠিক চিনবেন। আপনি যাকে ভাই বলেন সেই গোকুলের চোর যে গোকুলের কামিনীদের(স্ত্রী) হৃদয় চুরি করত, আবার বিদর্ভে গিয়ে ভীষ্মকের কন্যাকে(রুক্মিণী) চুরি করল। 
পুত্র কাম চুরি করল বজ্রনাভের কন্যাকে(প্রভাবতী)। [শিবের দ্বারা ভস্ম হয়ে কামদেব পুনরায় রুক্মিণির গর্ভে প্রদ্যুম্ন রুপে জন্মান] 
পৌত্র অনিরুদ্ধ চুরি করে বাণাসুরের কন্যাকে(উষা)। [বাণাসুরঃ প্রহ্লাদ-বিরোচন-বলি মহারাজ-তার পুত্র বাণ শোণিতপুরের রাজা] 
এই তিন পুরুষ ধরণীতে তো চোর নামে বিখ্যাত! 

কৃষ্ণ নিন্দা শুনে দুঃখিত, বিষণ্ণ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলেন –ভাই, সবার সামনে কৃষ্ণ নিন্দা উচিত হচ্ছে না। যে চুরি করতে পারে, সেই করে। কৃষ্ণের শক্তির সামনে কে কি করতে পারে! 

দুর্যোধন বলে –ধর্মরাজ ভাল বললেন! যে আমার সম্মানহানি করল, আমার কন্যাকে চুরি করল, তার নিন্দা করতে পারব না! 

যুধিষ্ঠির বলেন –ঠিক আছে কে কন্যা হরণ করল দেখি! 

দুর্যোধন বলে –তাতে আর কোন কাজ নেই। যে কেউ পার এখনই তার মাথা কাট। 

যুধিষ্ঠির বলেন –সত্যি যদি ইনি কৃষ্ণের পুত্র হন তবে তাকে বধ করা কি উচিত হবে! ভাই কৃষ্ণ বৈরী(শত্রু) হলে কারো রক্ষা নেই। আমাদের কুরুকুলে বাতি দেওয়ার আর কেউ থাকবে না। কৃষ্ণের ক্রোধ থেকে ইন্দ্র, যম, বরুণ(জলের দেবতা), কুবের, পঞ্চানন(শিব) কেউই আমাদের রক্ষা করতে পারবেন না। 

দুর্যোধন বলে –তুমি যখন এত ভয় পেয়েছ তখন এখনই হস্তিনাপুর ত্যাগ করে ইন্দ্রপ্রস্থে প্রাণ নিয়ে পালাও আর সেখানে কৃষ্ণের শরণ নাও। আজ আমি এই দুষ্টকে মারবই। আমি কাউকে ভয় পাই না। 

দুর্যোধনের কথা শুনে চিন্তিত যুধিষ্ঠির ভাই বৃকোদর ভীমকে দ্রুত শাম্ব রক্ষায় পাঠালেন। শ্মশানে দুঃশাসন শাম্বের চুল টেনে ধরে খড়্গ দিয়ে মুন্ড কাটতে উদ্যত হল। বায়ুবেগে ভীম সেখানে উপস্থিত হয়ে দুঃশাসনের হাত থেকে খড়্গ কেড়ে নিলেন।

ভীম দুঃশাসনকে বলেন –তোমার এ কেমন বিচার, কৃষ্ণের পুত্রকে হত্যা করছ! ধর্মরাজ আমায় একে উদ্ধার করতে পাঠিয়েছেন। 

এই বলে ভীম শাম্বের বন্ধন ছিন্ন করলেন। শাম্বকে কোলে তুলে যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন। 
যুধিষ্ঠির জাম্বুবতীনন্দন শাম্বকে দেখে কাছে টেনে চুম্বন করলেন। 

দেখে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে দুর্যোধন বলে –দেখুন, দেখুন! ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য এর বিহিত করুন। আপনারা সব সময় বলেন পাণ্ডবরা ভাল। এখন দেখুন কুলের কলঙ্ক দিল যে দুরাচার তাকে আদর করা হচ্ছে। 

যুধিষ্ঠির বলেন –দেখ ভাই দুর্যোধন সভায় এর সমান রূপে-গুণে কে আছে! ইনি যদু মহাকুলে জন্মেছেন। তার উপর কৃষ্ণের কুমার। আমার কন্যা হলে আমি তাকে কৃষ্ণের পুত্রের হাতে সমর্পণ করতাম। কন্যাকে শাম্বের হাতেই দান কর। আর দেরি করলে কন্যার কলঙ্ক হবে। পরে কেউ আর তাকে বিবাহ করতে চাইবে না। সবাই দেখেছে শাম্ব তাকে কোলে তুলে হরণ করেছে। 

দুর্যোধন বলে –তাতে আমার কিছু আসে যায় না। কন্যা আমার ঘরেই থাকবে। কিন্তু এর হাতে আমি কন্যা দেব না। একে আজ মেরেই ফেলব। তুমি একে ছাড়। 

ভীম গর্জন করে বলেন –দুর্যোধন তোমার মতিচ্ছন্ন হয়েছে। তোমার এত কিসের গর্ব! আমার সামনে তুমি কৃষ্ণের পুত্রের হত্যা করবে! দেখি কত সাহস! শাম্বকে কেউ স্পর্শ করলে আমার গদাঘাতে সে যমের বাড়ি যাবে। 
এই বলে ভীমসেন মাথার উপর গদা ঘোরাতে থাকেন। 

ভীমের কথা শুনে দুর্যোধন আরো রেগে বলে –কেড়ে নাও শাম্বকে। 

আজ্ঞা পেয়ে দুর্যোধনের ভাইরা ঝাঁপিয়ে পরে। কিন্তু বাঘের সামনে ছাগল পড়লে যেমন হয়, তেমনি ভীমের বিক্রম দেখে সকলে পালাতে লাগল। 

তখন ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য তাদের মাঝে এসে বলেন –পুত্ররা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছ কেন! এখন শাম্বকে বন্দি করে রাখা হোক। পরে বিচার বিবেচনা করে একে শাস্তি দেওয়া যাবে। 
দুর্যোধনকে তারা বলেন –এ কৃষ্ণের পুত্র। যদুরা জানতে পারলে দলে দলে চলে আসবে। যদি একে মেরে ফেল তবে গোবিন্দের ক্রোধ থেকে কেউ রক্ষা পাব না। তিনি এলে তখন তাকে যুদ্ধ করে পরাজিত করা যাবে। এ যখন আমাদের ঘরে এসে গেছে এখন একে বন্দি করে রাখি। 

শুনে যুধিষ্ঠির ‘ভাল, ভাল’ বলে সমর্থন করলেন। 

দুর্যোধন বলে –তবে এর পায়ে শিকল পরান হোক। 

শাম্বের পায়ে শিকল দিয়ে গুরু দ্রোণ ভীষ্মের গৃহে নিয়ে চললেন। অন্যেরাও যে যার গৃহে গেল। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers