Blog Archive

Sunday, July 26, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৯৭

[পূর্বকথা - ইন্দ্রপ্রস্থে কৃষ্ণের সহায়তায় পঞ্চপাণ্ডবরা অবস্থান করতে লাগলেন...দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব সুখে বাস করতে লাগলো... একদিন অর্জুন বাধ্য হলেন যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদী একসাথে অবস্থান কালে গৃহে প্রবেশ করায়...তিনি নিজেই বারো বছরের বনবাসে যান... উলুপী ও চিত্রাঙ্গদার সাথে তার বিবাহ হয়... পরে প্রভাস তীর্থে এলে গোবিন্দ শুনে শীঘ্র সেখানে এসে পার্থকে আলিঙ্গন করলেন এবং দ্বারকায় নিয়ে আসেন..সেখানে সুভদ্রাকে দেখে অর্জুনের ভাল লাগে, সুভদ্রাও অর্জুনের প্রেমে পাগল হন এবং সত্যভামাকে তার মনের কথা জানান... ] 

সুভদ্রার সহিত অর্জুনের বিবাহ কারণ সত্যভামার সহিত অর্জুনের কথাঃ 



রাত্রে সত্রাজিতের কন্যা সত্যভামা একান্তে শ্রীকৃষ্ণকে বলেন –অবধান কর, তোমার ভগিনী ভদ্রা প্রাণ ত্যাগ করতে চায় তার উপায় কর। যখন থেকে সে অর্জুনকে দেখেছে তখন থেকে আমায় ধরেছে অর্জুনকে পতিরূপে তাকে পাইয়ে দিতে হবে। অর্জুনকে না পেলে সে আত্মহত্যা করবে আর সে দোষ আমার হবে। 

গোবিন্দ বলেন –আমিও মনে মনে তাই ভাবছিলাম। অর্জুন এখানে বহুদিন এসেছে। তাকে কি ধন দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ভাল হল সুভদ্রাকেই তার হাতে দান করব। তুমি আজ রাত্রেই সুভদ্রাকে আমার সম্মতির কথা জানিয়ে দিও। 

সত্যভামা বলেন –সে বিলম্ব সহ্য করতে পারছে না। আজ রাত্রেই পার্থকে না পেলে সে প্রাণত্যাগ করবে। 

গোবিন্দ বলেন –এতো আমার সাধ্যে নেই। তুমি গিয়ে দেখ কোন বিপদ যেন না হয়। 

কৃষ্ণের আদেশ পেয়ে সত্যভামা সুভদ্রাকে নিয়ে পার্থের কাছে চললেন। 
কনক কপাট দিয়ে পার্থ রত্নময় খাটে শুয়ে বিশ্রাম করছিলেন। সত্যভামা –‘অর্জুন, অর্জুন’ বলে ডাক দিতে থাকেন। 

পার্থ জিজ্ঞেস করেন –কে তুমি! 

সত্যভামা বলেন –সত্রাজিতের কন্যা আমি সত্যভামা। দরজা খোল কিছু গোপন কথা আছে। 

অর্জুন বেলন –মাঝরাত্রে আপনি এখানে কি কারণে এলেন! অতি দরকারি কাজ থাকলে দূত পাঠাতে পারতেন, আমি উপস্থিত হতাম! তা না করে এত রাত্রে আপনি কেন এলেন! আপনি কাল আমায় আজ্ঞা করবেন। 

সত্যভামা বলেন –দূতের মাধ্যমে একথা বলা সম্ভব নয়। বিপদে পরে আমি তোমার কাছে এসেছি। 
তোমার সব কথা শুনে আমার খুব কষ্ট হয়েছে। পাঁচভায়ের মাত্র এক স্ত্রী! তার উপর সে কারণেই বার বছরের বনবাস। তোমার কষ্টে আমি থাকতে না পেরে এক পরমাসুন্দরীকে তোমায় দিতে চাই। 

অর্জুন বলেন –এত স্নেহ করেন আপনি, আমি ধন্য। তবে আপনার আজ্ঞা আমি গোবিন্দের সামনেই পালন করব। 

সত্যভামা বলেন –দেরি করে কি কাজ। এই রজনীতেই গন্ধর্ব মতে বিবাহ কর। 

পার্থ বলেন –একি অদ্ভূত কথা! কিছু না জেনে কিভাবে বিবাহ করব! কে সেই সুন্দরী, কার কন্যা-এসব কিছুই তো আমি জানি না। 

সত্যভামা বলেন –দরজা খুলে দেখ। স্বচক্ষে কন্যাকে দেখে নাও। তাকেও সঙ্গে করে এনেছি। একন্যা যদুকুলে জন্মেছেন। এখন তিনি প্রথম যৌবনা। বিদ্যুতবরণী রূপে ত্রৈলোক্যমোহিনী। 

অর্জুন বলেন –এ আমার শক্তিতে সম্ভব নয়। বলভদ্র ও জনার্দন কৃষ্ণ যদুকুলপতি, তাদের আজ্ঞাতেই যাদবী সুভদ্রাকে আমি গ্রহণ করব। আপনি তাদের কাছে আমায় বিপদে ফেলছেন। 

সত্যভামা তখন রেগে বলেন –সেই তো! তুমি কি ভাবে করবে! তোমার মন বাঁধা পরেছে কৃষ্ণা দ্রৌপদীর ওষুধের গুণে। পাঞ্চালের এই কন্যা ভাল ভাবেই জানে পাঁচ স্বামীকে কিভাবে নিজের মুঠোয় রাখতে হয়। একটি স্বামীকেও সে হাতছাড়া করবে না। বার বছর বনে বনে ঘুরছে তাও তার কথা ভুলতে পারছে না! নারদের বাক্য অমান্য করার সময় তোমার লজ্জা করেনি! এতদিন বাড়ি ছাড়া তাও দ্রৌপদীর ভয়ে কিছু করতে পারছ না। 

পার্থ বলেন –দেবী, দ্রৌপদীর নিন্দা করবেন না দয়া করে। আপনার মহৌষধির গুণও কম নয়। ষোলশত সহস্র স্ত্রী ও আট পাটরাণীর মধ্যে সব থেকে আপনি কৃষ্ণের সোহাগিনী কোন্‌ গুণে বলুন। সাত অন্য পাটরাণীরা কি কেউ অপুত্রা, কি রূপহীনা বা হীনকুলজাত! তাদের মধ্যে তো রুক্মিণী বিখ্যাত। তবু আপনার ওষুধের গুণে হরি আপনাকে ভয় পান। আপনার সাক্ষাতে অন্যের দিকে চোখ তুলে চান না। দিব্য-রত্ন, বসন, ভূষণ, অলঙ্কার যেখানে যা পান কৃষ্ণ আগে আপনাকে এসে দেন। অন্য জনকে দিলে আপনি তা আর গ্রহণ করেন না। বলুন দেবী তা আপনি কোন গুণে করেন! 
দেবী রুক্মিণীকে কৃষ্ণ এজদিন পারিজাত দিলেন। তাই নিয়ে আপনি এক সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটালেন।

-জন্মেজয় মুনিকে জিজ্ঞেস করেন –আমিও পারিজাত হরণের কথা শুনেছি। কি কারণে রুক্মিণীর সাথে সত্যভামার সংঘাত হল তা শুনতে মন চায়। 

মহাভারতের কথা অমৃতের ধারা, কাশীরাম বলেন এটি ছাড়া আর কিছুতেই সুখ নেই।
...................................

Sunday, July 19, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৯৬

[পূর্বকথা - ইন্দ্রপ্রস্থে কৃষ্ণের সহায়তায় পঞ্চপাণ্ডবরা অবস্থান করতে লাগলেন... নারদমুনি এসে সুন্দ-উপসুন্দের কাহিনী বলে পঞ্চপান্ডবদের মধ্যে দ্রৌপদীকে নিয়ে একটি নিয়ম স্থাপন করলেন...এভাবে দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব সুখে বাস করতে লাগলো... একদিন অর্জুন বাধ্য হলেন যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদী একসাথে অবস্থান কালে গৃহে প্রবেশ করায়...তিনি নিজেই বারো বছরের বনবাসে যান... উলুপী ও চিত্রাঙ্গদার সাথে তার বিবাহ হয়...]

অর্জুনের বনবাসঃ




এরপর পার্থ দক্ষিণ সাগরের দিকে যাত্রা করলেন। সব তীর্থে তিনি পুণ্যস্নান ও দান করলেন।
এভাবে ঘুরতে ঘুরতে অর্জুন লক্ষ্য করলেন পঞ্চতীর্থ নামে একস্থানকে মুনিরা এড়িয়ে চলছেন। বিস্মিত হয়ে পার্থ এর কারণ জিজ্ঞেস করেন।
মুনিরা বলেন –এই পঞ্চতীর্থ পুণ্যস্থান। কিন্তু কুম্ভীরের ভয়ে কেউ এর পানি স্পর্শ করে না।
শুনে অর্জুন সেখানে স্নান করতে চললেন, সকলে তাকে নিষেধ করতে লাগল। অর্জুন সৌভদ্র নামের তীর্থে প্রবেশ করে নিসঙ্কোচে স্নান করতে লাগলেন। স্নানের শব্দ শুনে এক বিরাট কুম্ভীরিণী দ্রুত এসে তার পা চেপে ধরল। বল প্রয়োগ করে অর্জুন তাকে কূলে টেনে তুলতেই সে এক অপরূপা সুন্দরীতে রূপান্তরিত হল।
অবাক হয়ে অর্জুন তাকে জিজ্ঞেস করেন –তুমি কে, কি কারণে কুম্ভীরের শরীরে এখানে বাস করছিলে।

কন্যা বলে –আমি অপ্সরী, আমার নাম বর্গা। কুবেরের প্রিয়া। আমরা পাঁচ কুমারী সুবেশা হয়ে ধনেশ্বরের(কুবের) সাথে ঘুরি। পথে একদিন এক ব্রাহ্মণকে তপ করতে দেখি। চন্দ্র-সূর্যের সমান মহা তেজ সেই তপস্বীর। তার তপস্যা ভঙ্গ করতে আমরা তার স্থানে গিয়ে নৃত্যগীত শুরু করি। কিন্তু তিনি এতটুকু বিচলিত না হয়ে বিরক্ত বোধ করে আমাদের অভিশাপ দেন, আমাদের বহু বছর গ্রাহরূপে(জলচর হিংস্র প্রাণী/কুম্ভীর) থাকতে হবে। আমরা করযোড়ে কেঁদে তার বহু স্তুতি করলে তিনি অবধ্য অবলা যেনে করুণা করে বলেন গ্রাহরূপে তীর্থে থাকবে। কোনদিন কোন মানুষ যদি টেনে কূলে তলে তবে মুক্তি পাবে।
তার কথা শুনে আমরা বিমনা হয়ে ঘরে ফেরার সময় নারদমুনির সাথে দেখা হলে তিনি সব শুনে বলেন এই পঞ্চতীর্থে গ্রাহরূপে পাঁচজনে থাক। ধনঞ্জয় তীর্থ করতে আসলে তিনিই তোমাদের মুক্তি দেবেন।
সে কথা আজ সত্য হল। আমি আজ মুক্তি পেলাম। আপনি দয়া করে আমার চার সখীকেও উদ্ধার করুন।

দয়াবান পার্থ অপর চারতীর্থ –পৌলম, অগস্ত্য, কারন্ধম ও ভারদ্বাজ থেকে অন্য অপ্সরীদেরও মুক্তি দিলেন।
এভাবে বহু তীর্থ ঘুরে পার্থ পুনরায় মণিপুরে আসেন। চিত্রাঙ্গদার সাথে তার পুনরায় মিলন হয়। চিত্রাঙ্গদার গর্ভে তার এক পুত্র জন্মায়, তার নাম রাখেন শ্রী বভ্রুবাহন। সেই পুত্রকে বহুদিন লালন করে তাকে সে রাজ্যে স্থাপন করে পার্থ পুনরায় তীর্থ ভ্রমণে বার হলেন। গোকর্ণাদি তীর্থে স্নান করে ক্রমে পশ্চিমে প্রভাস তীর্থে এলেন।


এসংবাদ দ্বারকায় গোবিন্দ শুনে শীঘ্র সেখানে এসে পার্থকে আলিঙ্গন করলেন। দেবকী নন্দন অর্জুনকে নিয়ে রৈবতক পর্বতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। গোবিন্দের আদেশে যদুরা পূর্বেই রৈবতক পর্বতে যাত্রা করেছিল।
অতিশয় মনোরম সে গিরিপর্বত। নানা জাতির বৃক্ষে, পুষ্প ও ফলে শোভিত, নানা জাতির পশু পাখি আনন্দে ক্রীড়া করছে দেখে সকল যদুরা সুখী হল।
কৃষ্ণের নির্দেশে দ্বারকাবাসী রৈবতক পর্বতে মহোৎসবের আয়োজন করল। বাল-বৃদ্ধ-যুবা আর সকল নরনারীরা নানা বাদ্যে নৃত্য-গীতে মত্ত হল। সকল তরুবৃক্ষ নানা রত্নে সাজান হল। শ্বেত, পীত(হলুদ), রক্ত, নীলবর্ণের বসনে সেজে উঠল। শ্বেত ও কৃষ্ণ চামর রাখা হল চার ডালে। প্রবাল-মুক্তার ঝারি বাঁধা হল।

উগ্রসেন(কংসের পিতা), বসুদেব(কৃষ্ণের পিতা), অক্রূর(কৃষ্ণের সখা), উদ্ধব(কৃষ্ণের সখা), জয়সেন(জম্বুকাশ্মীরের উত্তর সীমায় অবস্থিত কেকয়রাজ্যের রাজা যিনি বসুদেবের বোন রাধাদেবীর স্বামী, এদের পুত্র ভিন্দ দুর্যোধনের মিত্র), প্রদ্যুম্ন(রুক্মিণীর পুত্র), কামদেব(কৃষ্ণপুত্র), বলভদ্র, চারুদেষ্ণ(রুক্মিণীর পুত্র), সাত্যকি(কৃষ্ণের অনুচর, শিনির পুত্র ও সত্যকের পুত্র), সারণ(কৃষ্ণের বৈমাত্রের ভাই, সুভদ্রার সহোদর), গদ(যদুবীর), উপগদ, দারুক(কৃষ্ণের সারথি), প্রমুখ বীররা এবং ঝিল্লি উপঝিল্লি সমেত সপ্তবংশনারীরা উদ্যানে ভ্রমণ করতে থাকেন। দৈবকী(কৃষ্ণের মা), রোহিণী(বলরামের মা), ভদ্রা(কৃষ্ণের স্ত্রী), বিদর্ভরাজ ভীষ্মক কন্যা রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, নগ্নজিতা, কালিন্দী, লক্ষণা, মিত্রবৃন্দা প্রমুখ কৃষ্ণের পত্নীরা রত্নালঙ্কারে ভূষিতা হয়ে এলেন।
শোণিতপুরের রাজা বাণদৈত্যের কন্যা ঊষা(কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের স্ত্রী), চন্দ্রাবতী, ভদ্রাবতী এবং কৃষ্ণের ষোলসহস্র রমণীরা(নরকাসুর দ্বারা অপহৃত কন্যারা) সকলে রৈবতক পর্বতে বিহার করছিলেন। সে সময় ইন্দ্রপুত্র অর্জুনের আগমনবার্তা পেয়ে সকলে তাকে অভ্যর্থনা করতে গেল।

কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয় অর্জুন এক রথে আরোহণ করে আসছিলেন। তাদের যেন আলাদা করে চেনার উপায় নেই। দুজনেই নীলঘন বর্ণ, অরুণ অধর(ঠোঁট), মাথায় কিরীট(মুকুট), গলায় কুন্ডল হার শোভা পাচ্ছে, পীতাম্বর(হলুদ) বস্ত্রধারী কেউ কৃষ্ণকে অর্জুন ভাবে, কেউবা অর্জুনকে কৃষ্ণ। দুজনের যুগল মূর্তি দেখে নরনারী সকলে বিস্মিত হল।
তখন বীর ধনঞ্জয় রথ থেকে নেমে শ্রীবসুদেবের পদধূলি নিলেন। বসুদেব তার শিরে চুম্বন করে আলিঙ্গন করলেন। অর্জুনকে বসিয়ে সকল বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। অর্জুন সকল কথা জানালেন। নারদের নিয়ম প্রবর্তন এবং তা লঙ্ঘন করায় তীর্থে ভ্রমণের কাহিনী।

বসুদেব সব শুনে বলেন –এখন এখানেই বসবাস কর, যতদিন না বার বছর শেষ হয়।
বলভদ্র, উগ্রসেন, সত্যক, সাত্যকী সকলে এসে অর্জুনকে সম্ভাষণ করে রৈবতক পর্বতে নিয়ে চলল। সকল যদু নারীরাও এসে সম্ভাষে। সবাই অর্ঘ দিয়ে কল্যাণবার্তা জানিয়ে পরম আনন্দে শুভেচ্ছা জানায়। অর্জুন মামার গৃহে মামীস্থানীয়াদের প্রণাম জানাতে থাকেন।

সে সময় বসুদেবের কন্যা যুবতী সুভদ্রা-যিনি সর্বরূপগুণে সম্পূর্ণা সেখানে উপস্থিত হন। বিচিত্র কবরী(খোঁপা) ভারে সুচাঁচর(কোঁকড়ান) চুল তার। দেখে মনে হয় মেঘেতে সঞ্চরে যেন কুরুবক ফুল(ঝিন্টী বা ঝাঁটি ফুল)। তার গন্ধে যেন মকরন্দ(পুষ্পমধু) ত্যাগ করে অলিকুল(ভ্রমর)। কানের সুন্দর কুন্ডল দুই গালকেও মণ্ডিত করেছে। তিলফুলের মত নাক, চাঁদের মত মুখ। তার চাহনির কটাক্ষে মুনিরাও মন ভোলে। কুচযুগ সম পূগ(সুপারি), মধ্যদেশ মৃগ ঈশ(ঈর্ষা ধরায়), জঘন(কোমর) নর্তকীর মত। চরণের অঙ্গুল দেখেও মুগ্ধ হতে হয়। নিতম্ব কুঞ্জরকুম্ভ(হস্তিনীর মত) বিপুল। যুঁই, যুথি, মালতি, বকুলের মালায় সজ্জিতা।



তাকে দেখে অর্জুন গোবিন্দকে জিজ্ঞেস করেন –হে সখা, এই সুন্দরী কন্যা কে! এই অবিবাহিতা কন্যা আমার মন অধিকার করেছেন।

শুনে শ্রীমধুসূদন বলেন –ইনি বসুদেবের কন্যা, আমার ভগিনী। সারণের সহোদরা, এঁর নাম সুভদ্রা। যোগ্য বর না মেলায় এঁর এখনও বিবাহ হয়নি।
শুনে অর্জুন অত্যন্ত লজ্জিত হলেন।
অর্জুনের সতৃষ্ণ চাহনিতে সুভদ্রার মনও অতি চঞ্চল হল, তিনি হঠাৎ মুর্চ্ছিত হলেন। সত্যভামা ও অন্যান্য নারীরা তাকে সুস্থ করে এর কারণ জিজ্ঞেস করতে থাকে।

সুভদ্রা বলেন –দেবী, আমায় ধরুন। পায়ে আমার কাঁটা ফুটেছে। শুনে সত্যভামা তার পা তুলে দেখলেন কাঁটা ফোটেনি।

সত্যভামা জিজ্ঞেস করেন –কেন মিথ্যা বলছ বোন, কাঁটা তো তোমার পায়ে ফোটেনি!

নিভৃতে সুভদ্রা বলেন –কি বলব সখি! যে কাঁটা ফুটল তা কারো পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। অর্জুনের নয়নের চাহনি তীক্ষ্ণশরের মত আজ আমার অঙ্গে ফুটে আমারে জরজর করে তুলেছে। আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখ কম্প দিয়ে জ্বর আসছে। প্রাণ ছটফট করে বেরিয়ে যেতে চাইছে। আমায় ছাড় সত্যভামা, আমি আর পারছি না।
বলে সুভদ্রা অর্জুনকে আবার দেখতে লাগলেন।

সত্যভামা বলেন –ভদ্রা, লজ্জার মাথা খেলে নাকি! নিষ্কলঙ্ক কুলে দেখছি কলঙ্ক দিবে! পিতা বসুদেব, ভাই রাম-নারায়ণ, তিনলোকে সবাই তাদের পূজা করে। এদের লজ্জা দিতে চাও! এক পুরুষকে দেখে প্রাণ ধরে রাখতে পারছ না! রাজকুলে কি আর অনূঢা কন্যা নেই! দেখতো কে পরপুরুষে মন ভুলেছে! তোমার চেয়ে নির্লজ্জ সংসারে আর কেউ নেই। ধৈর্য ধরে ঘরে চল। অন্য কেউ যেন এসব কিছু না শোনে।

সত্যভামার নিষ্ঠুর কথা শুনে সুভদ্রার চক্ষে জল বহে।
তিনি বলে ওঠেন –ধিক্‌ ধিক্‌! নারী হয়ে জন্মে ব্যর্থ হল জীবন। পরের বশে এ তনু বিরহ অনলে দগ্ধ হচ্ছে।

সত্যভামা বলেন –নারীজাতির নিন্দা কেন কর। দেখ নারীরূপেই পৃথিবী সংসার ধারণ করছেন। স্ত্রীজাতির মাধ্যমেই সৃষ্টির সৃজন হল। তিনিই শক্তিরূপে সবার জীবন রক্ষা করেন। সকল মঙ্গলকর্মে স্ত্রী আগে থাকেন। লক্ষ্মী আগে বসেন, পিছনে নারায়ণ। শঙ্করের আগে ভবানীর নাম উচ্চারিত হয়। রাম-সীতা কেউ বলে না, সকলে সীতা-রাম উচ্চারণ করে। গৃহিণী থাকলে তবেই লোকে তাকে গৃহী বলে। সংসারে নারী বিনা কেউ রয় না। স্ত্রীর থেকেই সবার উৎপত্তি। স্ত্রী বিনা কার শক্তি আছে বংশ বিস্তার করে।

সুভদ্রা বলেন –সত্য কথাই সব বললে। কিন্তু পুরুষ বিনাও তো জীবন বিফল।

সত্যভামা বলেন –তুমি উতলা হয়ো না। স্থির হও আমি কথা দিচ্ছি তোমার বিবাহ দেব। সে পুরুষ উত্তম বংশজ, বলিষ্ঠ, পণ্ডিত, পরম সুন্দর হবে-তোমার মনের মত।

সুভদ্রা বলেন –তোমার কথা আমি শুনছি না। তোমার সামনে এখনই আমি প্রাণ ত্যাগ করব। কৌরববংশীয় যে বলবান পান্ডব সেই ধনঞ্জয়কে ছাড়া আমি বাঁচব না। আজি যদি ধনঞ্জয়কে আমায় না দেবে তো আমার বধের পাপ তোমারই লাগবে।

সত্যভামা বলেন –দেবী, আমি এক্ষুনি চললাম। আজ রজনীতেই পার্থের সঙ্গে তোমার মিলন ঘটাব।

সত্যভামার মুখে তার মনের কথা শুনে সুভদ্রা হরষিত চিত্তে তার সাথে চললেন।
...................................

Sunday, July 12, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৯৫

[পূর্বকথা - পঞ্চ পান্ডবের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ হল ... ইন্দ্রপ্রস্থে কৃষ্ণের সহায়তায় পঞ্চপাণ্ডবরা অবস্থান করতে লাগলেন... নারদমুনি এসে সুন্দ-উপসুন্দের কাহিনী বলে পঞ্চপান্ডবদের মধ্যে দ্রৌপদীকে নিয়ে একটি নিয়ম স্থাপন করলেন...এভাবে দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব সুখে বাস করতে লাগলো...]




অর্জ্জুনের নিয়মভঙ্গ ও বনে গমনঃ

কিছুদিন পর রাজ্যে এক ব্রাহ্মণের গরু চোরেরা চুরি করে পালাল। ব্রাহ্মণ অর্জুনের কাছে এসে কেঁদে পরল।

বিলাপ করে ব্রাহ্মণ বলে –তোমার রাজ্যে থেকে আমার সর্বনাশ হল। মনে তার যত গালি এলো দিতে লাগল।
সঙ্কোচে অর্জুন ব্রাহ্মণকে বলেন –আপনি কেন কাঁদছেন। আমাকে কি করতে আজ্ঞা করেন।
দ্বিজ ব্রাহ্মণ বলে –এখনি তুমি অস্ত্র নিয়ে আমার সাথে এস। চোররা বেশি দুর এখনও যায়নি।

ব্রাহ্মণের কথায় অর্জুন ব্যস্ত হয়ে আয়ুধ মন্দিরে(অস্ত্রশস্ত্রের কক্ষ) চললেন।
দৈবযোগে অস্ত্রগৃহে সে সময় যুধিষ্ঠির ও কৃষ্ণা অবস্থান করছিলেন। পার্থ তা জানতে পেরে গৃহের বাইরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পরলেন।

দ্বিজ বলে –শীঘ্র অস্ত্র নিয়ে চল। সে উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকে।
ব্রাহ্মণের অশ্রুজল দেখে অর্জুন ভয় পেলেন। কি করবেন ভেবে পেলেন না। অস্ত্রগৃহে এসময় প্রবেশ করলে বার বছরের জন্য অরণ্যে যেতে হবে, সে বড় দুঃখের। এদিকে ব্রাহ্মণের চক্ষুজল যত ভূমিতে পরছে তত তার উপর মহাপাপ বর্ষিত হচ্ছে। এখন ব্রাহ্মণের দুঃখ দুর করাই তার বড় ধর্ম। বিনা ক্লেশে কখনও ধর্ম উপার্জন হয় না-এত সব ভেবে অর্জুন অস্ত্রগৃহে প্রবেশ করে ধনুক নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলেন। ব্রাহ্মণের সাথে গিয়ে চোরদের মেরে তার অপহৃত গরু এনে দিলেন।

ফাল্গুনি(অর্জুন) ফিরে এসে যুধিষ্ঠিরকে বলেন –আমি নিয়ম লঙ্ঘন করেছি, বনবাসে যাওয়ার আজ্ঞা দিন, রাজন!

যুধিষ্ঠির বলেন –কেন এমন বলছ, ধনঞ্জয়! নারদঋষি বলেছিলেন ছোট ভায়ের সাথে কৃষ্ণা থাকলে বড়ভাই সে স্থানে গেলে তবে তাকে বনে যেতে হবে। তুমি আমার চেয়ে ছোট, তোমার কোন দোষ হয়নি।

পার্থ বলেন –স্নেহের বশে আপনি একথা বলছেন। ধর্মাচরণে ছল করা চলে না। সত্যকে অস্বিকার করতে মন চায় না। আজ্ঞা করুন মহারাজ আমি বনে যাই।

এই বলে অর্জুন মা, ভাই, বন্ধুদের সবার কাছে বিদায় নিয়ে বনবাসে যাত্রা করলেন। সকলে অত্যন্ত দুঃখিত হল।
অর্জুনের সাথে ব্রাহ্মণ, পৌরাণিক কথক, গায়ক, চারণ কবিরা চললো। মহাবনে প্রবেশ করে অর্জুন আরো অনেক পুণ্যতীর্থে ভ্রমণ করলেন ও স্নানদান করতে লাগলেন।

এভাবে বহুদিন পর তিনি হরিদ্বারে উপস্থিত হয়ে আনন্দিত হলেন। গঙ্গায় স্নান করে তিনি অগ্নিহোত্র(অগ্নির পূজা) করে তর্পণের উদ্দেশ্যে গঙ্গায় প্রবেশ করেন।


অগ্নিহোত্র স্থানে অর্জুনকে তর্পণ করতে দেখে নাগকন্যা জলের মধ্যে অর্জুনকে ধরলেন। টেনে নিয়ে নাগকন্যা অর্জুনকে নিজের গৃহে নিয়ে চললেন।
অর্জুন দেখেন সে এক সুন্দর প্রাসাদ। সেখানেও অগ্নিহোত্র জ্বলছে দেখে কুন্তীপুত্র সেই অগ্নিরও পূজা করলেন।
নিশঙ্ক হয়ে অর্জুন কন্যাকে জিজ্ঞেস করেন –এটি কার গৃহ, তুমি কার কন্যা! কেন এই পুরীতে আমায় টেনে আনলে।

কন্যা বলেন –আমি ঐরাবত নাগরাজ কুলজাত কৌরব্য নাগের কন্যা। আমার নাম উলুপী। তোমাকে দেখে আমার কাম জাগ্রত হয়েছে, সে কারণে তোমাকে নিয়ে এলাম। তুমি আমায় ভজনা করে আমার মন তৃপ্ত কর।

অর্জুন বলেন –আমার সব কথা তুমি যান না, কন্যা। আমি ব্রহ্মচারী হয়ে বার বছর বনবাসে এসেছি। আমি তা লঙ্ঘন করতে চাই না।

উলুপী বলেন –আমি সব জানি। তোমার এই নিয়ম কেবল দ্রৌপদীর জন্য। আমার সঙ্গে মিলিত হলে তোমার দোষ হবে না। আমি তোমার কাছে আর্তি জানাচ্ছি, আমার ধর্ম রক্ষা কর। আর্তজনের মনের ইচ্ছে পূর্ণ করাই ধর্ম, এতে কোন পাপ নেই। আমি চিরদিন তোমার অনুগত থাকব। আমায় একবারমাত্র গর্ভদান করে, আমার প্রাণ রক্ষা করুন, স্বামী!

পার্থ উলুপীর করুণ আর্তি শুনে তার প্রার্থনা পূরণে সম্মত হলেন। একরাত্রি তিনি উলুপীর সাথে কাটিয়ে পরেরদিন পুনরায় গঙ্গা থেকে উঠে এলেন। ব্রাহ্মণরা বিস্মিত হয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলে পার্থ সকল ঘটনা তাদের জানালেন। এরপর অর্জুন দ্বিজদের সাথে হিমালয় পর্বতে আরোহণ করলেন। বহু তীর্থে ঘুরে পুণ্যস্নান করতে লাগলেন। বশিষ্টের আশ্রমে অগস্ত্য নামে এক বট দেখলেন। পৃথিবীর দক্ষিণাবর্ত ঘুরে ঘুরে তা তিনি করের মত চিনলেন। পূর্ব দিকে সিন্ধুতীরে বীর ঘুরতে গেলেন। গয়া, গঙ্গা, প্রয়াগ, নৈমিষারণ্য(প্রাচীন তপোবন) প্রমুখ সব তীর্থ ঘোরা হল।

অঙ্গ-বঙ্গের মধ্যে সব তীর্থ স্নান করে কলিঙ্গ প্রদেশের দিকে যাত্রা করলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণরা কলিঙ্গে প্রবেশ করলেন না, কারণ সেখানে প্রবেশ করলে ব্রাহ্মণরা ভ্রষ্ট হয়। অর্জুন একাই কলিঙ্গে প্রবেশ করেন। সেখানে একাই সব তীর্থ ঘোরেন।

সমুদ্রতীরে মহেন্দ্র পর্বতে মণিপুর নামে এক নগর ছিল। চিত্রভানু নামে এক রাজার সেটি রাজত্ব। চিত্রাঙ্গদা নামে তার এক কুমারী কন্যা ছিল। দেবতার বাঞ্ছিত সে কন্যা রূপে গুণে অনন্যা। নগরে ঘুরতে ঘুরতে পার্থ তাকে দেখলেন। কন্যাকে দেখে অর্জুন আকৃষ্ট হয়ে রাজার কাছে গেলেন। রাজার কাছে তিনি কন্যার পাণি প্রার্থনা করলেন।


চিত্রভানু রাজা বলেন –কে তুমি, কোথায় তোমার ঘর, কোন বংশেই বা তোমার জন্ম, কার পুত্র! তীর্থবাসী হয়ে রাজকন্যাকে কামনা করছ! কোন সাহসে তুমি এ কথা বল!

অর্জুন বলেন –আমি পান্ডুর পুত্র, কুন্তীর গর্ভজাত। আমার নাম ধনঞ্জয়।
এত শুনে রাজা দ্রুত উঠে এসে পার্থকে আলিঙ্গন করে বসতে আসন দেন।

রাজা বলেন –এতদুর কি কারণে এলেন।
পৃথার নন্দন পার্থ সবিস্তারে সব জানান।

রাজা বলেন –আমার সৌভাগ্য তুমি আমার রাজ্যে এলে। এবার আমি আমার কথা বলতে চাই। প্রভঞ্জন নামে এক দ্বিজ আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন। সেই রাজা পুত্র কামনা করে শিবের তপস্যা করেন। প্রসন্ন হয়ে মহাদেব বর দিলেন, আমাদের বংশে প্রতি পুরুষের একটি করে কুমার হবে। কুলক্রমে এক ভিন্ন দুটি সন্তান হল না। যে পুত্র হত, সেই রাজা হতেন। ধূর্জটির(শিব) পূর্বের বর এভাবেই চলছিল। কিন্তু আমার পুত্র হয়নি, একটি কন্যা হল। তাই আমি তাকে পুত্রের মত লালন-পালন করেছি। আমার পর আর রাজা হওয়ার কেউ নেই দেখে আমি ঠিক করেছি এই কন্যা যাকে দান করব, সেই এ রাজ্যের ভার গ্রহণ করবে। কুরুবংশের শ্রেষ্ঠ তুমি, তোমাকে বলা উচিত নয় তবু এক সত্য করলে কন্যা তোমায় দিতে পারি। আমার কন্যার গর্ভে যে জ্যেষ্ঠপুত্র হবে সেই এ রাজ্যের রাজা হবে।

পার্থ রাজার কথায় সম্মত হলেন। চিত্রাঙ্গদার সাথে পার্থের শুভবিবাহ হল। এক বছর পার্থ সেখানে থেকে গেলেন।
...................................

Sunday, July 5, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৯৪

[পূর্বকথা - পঞ্চ পান্ডবের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ হলে দুর্যোধনরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকে....কিন্তু ভীষ্ম, বিদুর ও কৃপাচার্যের সৎ বুদ্ধিতে ধৃতরাষ্ট্র তাদের স্বিকার করতে বাধ্য হন... বিদুর গিয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে দ্রৌপদী সহ যত্ন করে নিয়ে এলেন... ইন্দ্রপ্রস্থে কৃষ্ণের সহায়তায় পঞ্চপাণ্ডবরা অবস্থান করতে লাগলেন... ]



সুন্দ-উপসুন্দের বিবরণ ও পান্ডবদের দ্রৌপদী সম্বন্ধে নিয়ম নির্দ্ধারণঃ

জন্মেজয় মুনিকে প্রশ্ন করেন –পাঁচভাই এক স্ত্রীকে নিয়ে কিভাবে সংসার ধর্ম করতেন। তাদের মধ্যে কি বিরোধ হত না!
মুনি বলেন –নরপতি সাবধানে শুনুন।
পাঁচভাই যখন ইন্দ্রপ্রস্থে বাস শুরু করছেন তখন একদিন নারদমুনি সেখানে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণসহ পান্ডবরা তাঁর শ্রীচরণ পূজা করলেন। ছয়জন করযোড়ে দাঁড়ালেন। মুনি তাদের বসার আজ্ঞা দিলেন।

নারদ বলেন –হে পান্ডুর পুত্ররা, আপনারা পাঁচজন এবং আপনাদের একজন স্ত্রী। ভায়ে ভায়ে এতে বিরোধ হতে পারে। পূর্বেও এমন হয়েছে। সুন্দ ও উপসুন্দ নামে দুই ভাই ছিল স্ত্রীর কারণে দুইজন যুদ্ধ করে মরল।

যুধিষ্ঠির বলেন –মুনিবর বলুন কেন দুই সহোদর যুদ্ধ করেছিল।

নারদ বলেন –কশ্যপমুনির দুই পুত্র হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যাক্ষ। এই হিরণ্যাক্ষ দৈত্যবংশে নিকুম্ভ অসুরের জন্ম। তার সুন্দ-উপসুন্দ নামে দুই পুত্র হয়। এরা পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত ছিল। এক সাথে সব কাজ করত। এরা অসুর কুলেও শ্রেষ্ঠ মহাভয়ঙ্কর রূপে দেখা দেয়। দুই ভাই এক বাক্য, একই জীবন। অল্প সময়ের জন্যেও তারা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না।
দুজনে মিলে তারা যুক্তি করল তপোবলে ত্রৈলোক্য অধিকার করবে। বিন্ধ্যপর্বতে গিয়ে মহা তপস্যা শুরু করল। বহু বৎসর কেবল বায়ু আহার করে তপস্যা করে গেল। অনাহারে বহু তপ করল দুজনে। এত কষ্ট সহ্য করল যে তা বলে বোঝান যায় না। তাদের এই কঠোর তপ দেখে পিতামহ ব্রহ্মা তাদের বর দিতে চাইলেন।
দুই ভাই বলে –আমাদের অমর কর।

বিবিঞ্চি(ব্রহ্মা) বলেন –তোমরা অন্য বর চাও।

দুই ভাই বলে –আমরা অন্য বর চাই না। যবে এই বর পাব তবেই তপস্যা ত্যাগ করব।


বিধাতা বলেন –জন্ম হলে মরণ হবেই। মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু চাইতে পার।

দৈত্যরা বলে –পরহস্তে যেন আমাদের মৃত্যু না হয়, নিজেদের মধ্যে বিভেদ হলেই যেন পরস্পরের হাতে আমাদের মৃত্যু হয়।



ব্রহ্মা -“স্বস্তি” বলে বর দিয়ে গেলেন। সুন্দ–উপসুন্দও আনন্দ মনে নিজেদের গৃহে গেল।
ত্রৈলোক্য জয় করার উদ্দেশ্যে তারা সৈন্য সাজাল। নানা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা সুরপুরে(স্বর্গ) গেল। দেবলোকে সকলে ব্রহ্মার বরের কথা জানত তাই ভয়ে যুদ্ধ না করেই অমরাবতী ছেড়ে পালাল।
ইন্দ্রপুরে ইন্দ্রত্ব করতে লাগল দুই ভাই-সুন্দ ও উপসুন্দ। যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্ব, নাগলোক সব জয় করল, সবাই এই দুই দৈত্যের ভয়ে পালাতে লাগল।
দ্বিজমুনিরা যজ্ঞ-হোম-ব্রত করলে দুই ভাই উপস্থিত হয়ে তা পন্ড করত। দেবকন্যা, নাগকন্যা, অপ্সরী, কিন্নরী ত্রৈলোক্যে যত অপূর্ব সুন্দরী ছিল সবাইকে অপহরণ করে নিজেদের ঘরে নিয়ে আসত। যখন যেখানে ইচ্ছে বিহার করতে থাকে। সব দেবতাদের বাহন, ভূষণ, অলঙ্কার ছিনিয়ে নিজেদের ভান্ডার পূর্ণ করতে থাকে।

এভাবে স্থানভ্রষ্ট হয়ে দেবতা ও ঋষিরা ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হলেন।
সব শুনে ব্রহ্মা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বিশ্বকর্মাকে বললেন –আপনি মনোহরা এক নারী রচনা করুন। তার তুলনা যেন এ ত্রিভূবনে না হয়।

তখনই বিচক্ষণ বিশ্বকর্মা বিধাতার আজ্ঞা পেয়ে ত্রৈলোক্যে যত রূপবন্ত ছিল তাদের সর্ব রূপ থেকে তিল তিল নিয়ে এক অপূর্ব সুন্দরী নারী রচনা করলেন। ব্রহ্মার সামনে তাকে উপস্থিত করা হল। দেবতারাও কন্যাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। কন্যার অঙ্গের যেখানে দৃষ্টি পরে সেখানেই চক্ষুস্থির হয়।




ব্রহ্মা বলেন –এর রূপের সীমা নেই। তিলে তিলে গড়ে তুললেন তাই এর নাম হল তিলোত্তমা।

তখন কন্যা ব্রহ্মার সামনে হাতযোড় করে বলেন –কি করতে হবে আমায় আজ্ঞা করুন।

বিরিঞ্চি(ব্রহ্মা) বলেন –সুন্দ-উপসুন্দ দুই দৈত্য তপোবলে ত্রিভুবন জয় করে সবার উপর অত্যাচার করছে। তাদের মধ্যে ভেদ হলেই তারা পরস্পরকে হত্যা করবে। তুমি কোন উপায় তাদের মধ্যে বিরোধ ঘটাও।

ব্রহ্মার আজ্ঞা পেয়ে সুন্দরী তিলোত্তমা প্রণাম জানিয়ে তাকে প্রদক্ষিণ করলেন। কন্যা দেখে মোহিত হলেন ত্রিলোচন, কন্যা যেদিকে যায় সে দিকেই মুখ রয়। এভাবে দেখতে দেখতে চারদিকে তাঁর চারটি মুখ হয়। এভাবে পূর্বসহ মৃত্যুঞ্জয়ের পাঁচটি মুন্ড হল।
পুরন্দর(ইন্দ্র) কামে পীড়িত হয়ে কন্যাকে দেখতে লাগলেন। তার শরীরে দশশত চক্ষু হল।
অন্য দেবতারাও একদৃষ্টে কন্যাকে দেখতে থাকেন। সকল দেবতা বলতে থাকে –এবার কার্যসিদ্ধি হবে। এনাকে দেখে কোনজন না ভুলবে।




তখন তিলোত্তমা যেখানে দুই ভাই সুন্দ-উপসুন্দ স্ত্রীদের নিয়ে ক্রীড়া করছে সেখানে উপস্থিত হলেন।
কোটি কোটি দৈত্য নিয়ে তাদের পরিবার। অশ্ব, গজ, রথ, সৈন্যে পূর্ণ ভান্ডার। লক্ষ লক্ষ বিদ্যাধরী নিয়ে দুজনে বিন্ধ্যপর্বতে হৃষ্ট মনে ক্রীড়ায় মত্ত।
রক্তবস্ত্র পরে তিলোত্তমা সেখানে উপস্থিত হলেন। সে পর্বতের উপর পুষ্প চয়ন করতে লাগলেন। তাকে দেখে দৈত্য ভাইরা ধিরে ধিরে তার কাছে উপস্থিত হল। সুন্দ-উপসুন্দ তখন মধুপানে মত্ত ছিল। সুন্দরী কন্যা দেখে শীঘ্র তাকে পেতে উদ্যত হল।
জ্যেষ্ঠ সুন্দ কন্যার সব্যকর(ডানহাত) ধরল। বামহাত ধরল কনিষ্ঠ উপসুন্দ। সুন্দ কন্যাকে নিজের কাছে ডাকতে লাগল।

সুন্দ বলে –ভাই, কন্যার হাত ছাড়। আমার ভার্য্যা তোর গুরুজন হবে। তাকে তুই কিভাবে ধরিস!

উপসুন্দ বলে –একে আমি বরণ করেছি। তুমি ভাতৃবধুর হাত ছার।

সুন্দ বলে –আগে আমি কন্যাকে দেখেছি।

উপসুন্দ বলে –কন্যা আমাকে আগে বরণ করেছে।

এভাবে ‘ছাড়, ছাড়’ বলে দুজনে দুজনকে গালাগাল দিতে থাকে। দুজনে পরস্পরকে ক্রুদ্ধ ভাবে দেখতে থাকে। সুরামধু পান করে ও কামবাণে তারা হিতাহিত জ্ঞান হারাল। পরস্পরের প্রতি অগ্নিসম ক্রোধিত হল। দুজনেই পরস্পরকে মারতে ভয়ঙ্কর গদা তুলে পরস্পরকে প্রহার করতে লাগল। দেখে মনে হল দুই পর্বতের যুদ্ধ হচ্ছে। শেষে যুগল মিহির(সূর্য)যেন প্রাণত্যাগ করে খসে পরল।
আর যত দৈত্যরা ছিল তারা এসব দেখে কন্যাকে কালরূপা বুঝে সেখান থেকে পালাল।

দেবতাদের নিয়ে ব্রহ্মা সেখানে উপস্থিত হলেন।
ব্রহ্মা তিলোত্তমাকে আশীর্বাদ করে বর দিলেন –সূর্যের কিরণে তুমি চিরকাল থেক। কারো দৃষ্টি তোমার অঙ্গে আর পরবে না। তোমার কারণে তপ, যজ্ঞ ভঙ্গ হবে। ধর্ম নষ্ট হবে লোকে তোমার দর্শনে। সেই জন্য সূর্যের রশ্মির মধ্যে তুমি থেক।
এই বলে ব্রহ্মা চলে গেলেন।

উপাখ্যান শেষ করে নারদ বলেন –শুনুন ধর্মপুত্র মহারাজ যুধিষ্ঠির, আপনারা পাঁচভাই পরস্পরের প্রতি অতি প্রীত, যেমন ছিল সুন্দ-উপসুন্দ। তাদের মাঝেও কন্যাকে নিয়ে এমন পরিনতি হল।
আপনারা পাঁচজন মহাবংশে জন্মেছেন। আপনাদের মাঝে স্ত্রীকে নিয়ে যাতে ভেদ না হয় তা দেখুন।

সব শুনে পঞ্চপান্ডব নারদের সামনে যোড়হাতে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলেন – কৃষ্ণা এক বছর একজনের গৃহে বাস করবেন। সেই সময় অন্যরা কেউ সেখানে প্রবেশ করবে না। সে সময় অন্য কোন ভাই যদি তাদের দেখেন তবে বার বছরের জন্য তাকে বনবাসে যেতে হবে।

এভাবে ব্রহ্মার পুত্র নারদ পঞ্চপান্ডবদের মধ্যে একটি নিয়ম স্থাপন করলেন। এভাবে দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব সুখে বাস করতে লাগলো।
...................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers