Blog Archive

Wednesday, September 16, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০৯

[পূর্বকথা সুভদ্রা হরণের কথা... সুভদ্রার ইচ্ছে রাখতে সত্যভামা কৌশলে তার গন্ধর্ব বিবাহ দিলেন অর্জুনের সাথে ... কৃষ্ণ সভায় অর্জুনকে সুভদ্রার জন্য উপযুক্ত পাত্র নির্বাচন করলে বলরাম ক্রুদ্ধ হল, তিনি দুর্যোধনকে পাত্র ঠিক করলেন ... দুর্যোধনের কন্যার সাথে কৃষ্ণের পুত্রের বিবাহ প্রসঙ্গ উঠল...দুর্যোধনের কন্যা লক্ষণার স্বয়ম্বর হলে, কৃষ্ণ পুত্র শাম্ব তাকে হরণ করেন...কর্ণের সাহায্যে তাকে বন্দি করা হয়...]

শাম্বের বন্ধন-সংবাদ লইয়া নারদের গমনঃ 



নারদ মুনি কৃষ্ণের কাছে চললেন পুত্রের সংবাদ নিয়ে। 

কৃষ্ণকে গিয়ে নারদ বলেন –হে হরি, শাম্বের সংবাদ শুনুন। দুর্যোধনের কন্যার স্বয়ম্বরের স্থান থেকে তাকে হরণ করার অপরাধে দুর্যোধন তাকে যুদ্ধে ইন্দ্রজালে জয় করে বন্দী বানিয়েছে। তাকে এত মারা হল যে বলে বোঝাতে পারব না। শেষে শ্মশানে কাটতে নিয়ে যায়। যুধিষ্ঠিরের চেষ্টায় ভীমসেন তাকে রক্ষা করেন। অনেক কষ্টে ভীষ্ম তাকে তাঁর গৃহে বন্ধ করে রেখেছেন। সেখানেও ক্ষুধায় আকুল শাম্ব নানা কষ্টে প্রাণ মাত্র নিয়ে বেঁচে আছে। দুর্যোধন আপনাকে এত গালি দিল, আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। 

সব শুনে কৃষ্ণ ক্রোধে অস্থির হয়ে তখনই যদু সৈন্যদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিলেন। 
সব ঘটনা শুনে হলধর বলরাম দুর্যোধনের জন্য চিন্তিত হলেন। ক্রোধে কৃষ্ণ সেনা সাজিয়ে চলেছেন, আজ দুর্যোধন সবংশে ধ্বংস হবে নিশ্চয়ই। 
এত সব চিন্তা করে রেবতীপতি বলভদ্র কৃষ্ণের কাছে গিয়ে বিনয়ের সাথে বলেন –তুমি কি কারণে যাচ্ছ! আমি নিজে গিয়ে পুত্রবধূ ঘরে আনব। 
এভাবে কৃষ্ণকে অনেক বুঝিয়ে বলরাম নিজেই কৃষ্ণকে দ্বারকায় রেখে হস্তিনাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। 

হস্তিনানগরে পৌছে তিনি দ্রুত দুর্যোধনের কাছে দূত পাঠিয়ে বলেন –দুর্যোধন, না বুঝে তুমি কৃষ্ণের কুমারকে গৃহে বন্দি করেছ। তাই তোমার দোষ ক্ষমা করছি। এখন আমার সামনে পুত্র ও পুত্রবধূ এনে দাও। 

দূতের কাছে এ বার্তা শুনে দুর্যোধন ক্রোধে থরথর কাঁপতে গর্জন করে বলে –বলরামকে গুরু মেনেছি তাই ছেড়ে দিলাম, অন্য কেউ হলে আজই শেষ করে দিতাম। আগে পুত্রকে চুরি করার জন্য পাঠান হল। আর এখন পুত্রবধূ এনে দাও হুকুম হচ্ছে! তার লজ্জা করে না এমন আবদারে! 
হে দূত, তুমি গিয়ে বল বলরাম ভালয় ভালয় নিজ গৃহে ফিরে যান। 

দূত গিয়ে সে সংবাদ দিতে বলরাম ক্রোধে ফেটে পরলেন। হাতে হাল ও মুগুর তুলে নিলেন। লাফ দিয়ে রথ থেকে তিনি ভূমিতে পরলেন। ক্রোধে থরথর অঙ্গ, পা চলে না। ধরণীতে সেখানেই তার লাঙ্গল গাঁথলেন। সেই লাঙ্গল টেনে তিনি পঞ্চ যোজন বিস্তৃত হস্তিনানগরকে বিদীর্ণ করে চললেন। রাজা, প্রজা, পাত্র, মন্ত্রী সকলে নগর সমেত গঙ্গাজলে পরতে লাগল। নগরে হাহাকার শুরু হল। সকলে উর্দ্ধশ্বাসে বলরামের স্থানে দৌড়াতে লাগল। 

ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, বিদুরকে নিয়ে শত ভাই দুর্যোধন ও পাণ্ডবরা করজোড়ে বলভদ্রের স্তুতি শুরু করে –হে রেবতীপতি, আমাদের রক্ষা করুন। আপনিই ব্রহ্মা, আপনিই বিষ্ণু ও মহেশ্বর। আপনার আদি-অন্ত নেই, আপনি চরাচরে ব্যাপ্ত। আপনি এভাবে ক্রোধী হলে সংসার ভস্ম হয়, সেখানে হস্তিনানগর কোন ছার! এখানে কত অসহায় বৃদ্ধ, শিশু, গো, ব্রাহ্মণ, যুবা, নর, নারী বাস করে। 
বিশেষ করে আপনার পুত্রবধূ লক্ষণাও এখানে আছেন। ক্ষমা করুন, কৃপা করুন। আমরা সবাই আপনার পায়ে পরছি। এইবার প্রভূ দয়া করে রক্ষা করুন। 

সবার এত স্তুতু শুনে বলরামের ক্রোধ শান্ত হল। তিনি লাঙ্গল তুলে রাখলেন। 

ততক্ষণে দুর্যোধন শাম্বকে আদর যত্ন করে নানা অলঙ্কারে সাজিয়ে লক্ষণার সাথে রথে করে বলরামের সামনে উপস্থিত হল। বিবিধ যৌতুক রামের সামনে সাজিয়ে রাখা হল। 

সব দেখে শুনে রেবতীরমণ বলভদ্র আনন্দিত হলেন। তখনই তিনি পুত্রবধূ নিয়ে রওনা দিলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীদাস কহেন, সাধু সদা করেন পান। 
......................................

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০৮

[পূর্বকথা সুভদ্রা হরণের কথা... সুভদ্রার ইচ্ছে রাখতে সত্যভামা কৌশলে তার গন্ধর্ব বিবাহ দিলেন অর্জুনের সাথে ... কৃষ্ণ সভায় অর্জুনকে সুভদ্রার জন্য উপযুক্ত পাত্র নির্বাচন করলে বলরাম ক্রুদ্ধ হল, তিনি দুর্যোধনকে পাত্র ঠিক করলেন ... দুর্যোধনের কন্যার সাথে কৃষ্ণের পুত্রের বিবাহ প্রসঙ্গ উঠল... ]

দুর্যোধনের কন্যা লক্ষণার স্বয়ম্বরঃ 


বৈশম্পায়ন মুনি বলেন –অবধান করুন রাজা দুর্যোধনের কন্যার স্বয়ম্বরের কাহিনী। 
ভানুমতীর গর্ভে এই একটি কন্যার জন্ম। রূপে, গুণে অনুপমা, সর্বগুণযুক্তা। ভুবন মোহিনী সুলক্ষণা বিভূষণা তাই তার নাম রাখা হল লক্ষণা। 
কন্যাকে যুবতী হতে দেখে রাজা স্বয়ম্বরের আয়োজন করলেন। পৃথিবীর সব রাজাদের আমন্ত্রণ করা হল। রূপবন্ত, গুণবন্ত, কুলে শীলে খ্যাত বহু রাজা রথ, গজ, অশ্বে উপস্থিত হল।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে গগন ছাইল, ধ্বজা, ছত্র, পতাকায় মেদিনী(পৃথিবী) ঢাকল। ধূলায় সূর্য ঢাকে গেল। সবাইকে দুর্যোধন সসম্মানে সিংহাসনে বসাল। 

নারদের মুখে কৃষ্ণ-জাম্ববতীর পুত্র শাম্ব বীর কন্যার রূপ বর্ণনা শুনে অস্থির হল। একাই সে রথে চড়ে স্বয়ম্বর স্থানে যাত্রা করল। পথে যেতে যেতে কেবল চিন্তা করে কিভাবে কন্যাকে পাবে। সবার অলক্ষে একা রথের উপর বসে রইল। 
এমন সময় লক্ষণাকে বাইরে আনা হল। অনুপম মুখ তার জিনি শরদিন্দু(শরৎকালের স্নিগ্ধ চাঁদকেও জয় করে)। ঝলমল কুন্ডল তার, মিহির(সূর্য) যেন অধর(ঠোঁট)কে রাঙ্গিয়ে তুলেছে। ভ্রূভঙ্গে অনঙ্গ(কামদেব) জয় সম্ভব। পাখির মত চঞ্চল চক্ষু(খঞ্জন) অঞ্জনে(কাজলে) রঞ্জিত। শুকচঞ্চুর(টিয়াপাখির ঠোঁট) মত নাক, শ্রুতি(কান) গৃধিনীকেও(শকুনী) লজ্জা দেবে। বিপুল নিতম্ব গতি মরালের(রাজহাঁস) মত। চরণে রসাল কিঙ্কিণী ও নূপুর বাজে। ধূমহীন অগ্নি কিংবা বিদ্যুতে যেন এর সৃষ্টি। শিশু সূর্যের যেন উদয় হল। 
দৃষ্টিমাত্র রাজারা চেতনা হারাল। কন্যার রূপ দেখে জাম্ববতীর পুত্রের মদনপীড়া হল। দ্রুত গতিতে এসে সে কন্যাকে ধরে রথে তুলে দ্বারকার পথে রথ চালিয়ে দিল। 
‘ধর, ধর’ বলে সেনারা তাড়া করল। নানা অস্ত্র নিয়ে কৌরবরা ধেয়ে গেল। 

কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব কৃষ্ণের সমান বীর। ধনুকে টঙ্কার দিয়ে বাণ ছাড়ল। চক্ষের নিমেষে অনেক সৈন্য কাটা পরল। নির্ভয়ে শাম্ববীর যুদ্ধ শুরু করল। হস্তী, অশ্ব, রথ, রথী সব কাটা পরতে লাগল। ভয়ে কেউ আর তার সামনে গেল না। 

ক্রোধে আগুন হয়ে সূর্যের নন্দন কর্ণ বলে –বালক হয়ে তোমার এত অহংকার! আমার সামনে কন্যা হরণ করে নিয়ে যাও! এখনি এর উচিত শিক্ষা দেব। 

এই বলে বীর কর্ণ ইন্দ্রজাল অস্ত্র প্রয়োগ করে শাম্বকে বেঁধে ফেলল। ‘চোর ধর, চোর ধর’ বলে রব উঠল। দুর্যোধন ‘কাট, কাট’ বলে আজ্ঞা দিল। 
দুর্যোধন বলে –আমার সামনে আমায় লঙ্ঘন করার শাস্তি একে দেব। দক্ষিণের শ্মশানে নিয়ে গিয়ে একে কাট। 

রাজার আজ্ঞা পেয়ে দুঃশাসন মারতে মারতে শাম্বকে নিয়ে চলল। 

দুর্যোধন কর্ণকে জিজ্ঞেস করে –এই চোর কার পুত্র তুমি কি চিনতে পারলে! 

কর্ণ বলে –মহারাজ, এ গর্ব আর কার! চোরের পুত্র ছাড়া আর কে এমন কাজ করবে। 

শুনে দুর্যোধন রাগে কাঁপতে থাকে। দাঁত কড়মড় করতে করতে, হাত কচলে সে বলে –গোকুলে গোপের খেয়ে বাড়ল বলে ক্ষত্রিয়েরা কেউ কন্যা দেয় না, তাই চুরি করে বেরায়। সেই চোরের জাতের চুরিতে আর কি লাজ, ভয়! সবস্থানে চুরি করে মনে সাহস বেরে গেছে দেখছি! তাই এই যমের ঘরে চুরি করতে এসেছে। সভা মাঝে এমন ভাবে আমাকে অপদস্ত করা! আর সহ্য হয় না, এখনই একে কাট। 

দুর্যোধন যখন এতসব বলছে, তখন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সেখানে এসে কে চোর তা দেখতে গিয়ে কৃষ্ণের পুত্রকে চিনতে পারলেন। 

দুর্যোধন রেগে যুধিষ্ঠিরকে বলে –মহারাজ আপনি একে ঠিক চিনবেন। আপনি যাকে ভাই বলেন সেই গোকুলের চোর যে গোকুলের কামিনীদের(স্ত্রী) হৃদয় চুরি করত, আবার বিদর্ভে গিয়ে ভীষ্মকের কন্যাকে(রুক্মিণী) চুরি করল। 
পুত্র কাম চুরি করল বজ্রনাভের কন্যাকে(প্রভাবতী)। [শিবের দ্বারা ভস্ম হয়ে কামদেব পুনরায় রুক্মিণির গর্ভে প্রদ্যুম্ন রুপে জন্মান] 
পৌত্র অনিরুদ্ধ চুরি করে বাণাসুরের কন্যাকে(উষা)। [বাণাসুরঃ প্রহ্লাদ-বিরোচন-বলি মহারাজ-তার পুত্র বাণ শোণিতপুরের রাজা] 
এই তিন পুরুষ ধরণীতে তো চোর নামে বিখ্যাত! 

কৃষ্ণ নিন্দা শুনে দুঃখিত, বিষণ্ণ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলেন –ভাই, সবার সামনে কৃষ্ণ নিন্দা উচিত হচ্ছে না। যে চুরি করতে পারে, সেই করে। কৃষ্ণের শক্তির সামনে কে কি করতে পারে! 

দুর্যোধন বলে –ধর্মরাজ ভাল বললেন! যে আমার সম্মানহানি করল, আমার কন্যাকে চুরি করল, তার নিন্দা করতে পারব না! 

যুধিষ্ঠির বলেন –ঠিক আছে কে কন্যা হরণ করল দেখি! 

দুর্যোধন বলে –তাতে আর কোন কাজ নেই। যে কেউ পার এখনই তার মাথা কাট। 

যুধিষ্ঠির বলেন –সত্যি যদি ইনি কৃষ্ণের পুত্র হন তবে তাকে বধ করা কি উচিত হবে! ভাই কৃষ্ণ বৈরী(শত্রু) হলে কারো রক্ষা নেই। আমাদের কুরুকুলে বাতি দেওয়ার আর কেউ থাকবে না। কৃষ্ণের ক্রোধ থেকে ইন্দ্র, যম, বরুণ(জলের দেবতা), কুবের, পঞ্চানন(শিব) কেউই আমাদের রক্ষা করতে পারবেন না। 

দুর্যোধন বলে –তুমি যখন এত ভয় পেয়েছ তখন এখনই হস্তিনাপুর ত্যাগ করে ইন্দ্রপ্রস্থে প্রাণ নিয়ে পালাও আর সেখানে কৃষ্ণের শরণ নাও। আজ আমি এই দুষ্টকে মারবই। আমি কাউকে ভয় পাই না। 

দুর্যোধনের কথা শুনে চিন্তিত যুধিষ্ঠির ভাই বৃকোদর ভীমকে দ্রুত শাম্ব রক্ষায় পাঠালেন। শ্মশানে দুঃশাসন শাম্বের চুল টেনে ধরে খড়্গ দিয়ে মুন্ড কাটতে উদ্যত হল। বায়ুবেগে ভীম সেখানে উপস্থিত হয়ে দুঃশাসনের হাত থেকে খড়্গ কেড়ে নিলেন।

ভীম দুঃশাসনকে বলেন –তোমার এ কেমন বিচার, কৃষ্ণের পুত্রকে হত্যা করছ! ধর্মরাজ আমায় একে উদ্ধার করতে পাঠিয়েছেন। 

এই বলে ভীম শাম্বের বন্ধন ছিন্ন করলেন। শাম্বকে কোলে তুলে যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন। 
যুধিষ্ঠির জাম্বুবতীনন্দন শাম্বকে দেখে কাছে টেনে চুম্বন করলেন। 

দেখে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে দুর্যোধন বলে –দেখুন, দেখুন! ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য এর বিহিত করুন। আপনারা সব সময় বলেন পাণ্ডবরা ভাল। এখন দেখুন কুলের কলঙ্ক দিল যে দুরাচার তাকে আদর করা হচ্ছে। 

যুধিষ্ঠির বলেন –দেখ ভাই দুর্যোধন সভায় এর সমান রূপে-গুণে কে আছে! ইনি যদু মহাকুলে জন্মেছেন। তার উপর কৃষ্ণের কুমার। আমার কন্যা হলে আমি তাকে কৃষ্ণের পুত্রের হাতে সমর্পণ করতাম। কন্যাকে শাম্বের হাতেই দান কর। আর দেরি করলে কন্যার কলঙ্ক হবে। পরে কেউ আর তাকে বিবাহ করতে চাইবে না। সবাই দেখেছে শাম্ব তাকে কোলে তুলে হরণ করেছে। 

দুর্যোধন বলে –তাতে আমার কিছু আসে যায় না। কন্যা আমার ঘরেই থাকবে। কিন্তু এর হাতে আমি কন্যা দেব না। একে আজ মেরেই ফেলব। তুমি একে ছাড়। 

ভীম গর্জন করে বলেন –দুর্যোধন তোমার মতিচ্ছন্ন হয়েছে। তোমার এত কিসের গর্ব! আমার সামনে তুমি কৃষ্ণের পুত্রের হত্যা করবে! দেখি কত সাহস! শাম্বকে কেউ স্পর্শ করলে আমার গদাঘাতে সে যমের বাড়ি যাবে। 
এই বলে ভীমসেন মাথার উপর গদা ঘোরাতে থাকেন। 

ভীমের কথা শুনে দুর্যোধন আরো রেগে বলে –কেড়ে নাও শাম্বকে। 

আজ্ঞা পেয়ে দুর্যোধনের ভাইরা ঝাঁপিয়ে পরে। কিন্তু বাঘের সামনে ছাগল পড়লে যেমন হয়, তেমনি ভীমের বিক্রম দেখে সকলে পালাতে লাগল। 

তখন ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য তাদের মাঝে এসে বলেন –পুত্ররা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছ কেন! এখন শাম্বকে বন্দি করে রাখা হোক। পরে বিচার বিবেচনা করে একে শাস্তি দেওয়া যাবে। 
দুর্যোধনকে তারা বলেন –এ কৃষ্ণের পুত্র। যদুরা জানতে পারলে দলে দলে চলে আসবে। যদি একে মেরে ফেল তবে গোবিন্দের ক্রোধ থেকে কেউ রক্ষা পাব না। তিনি এলে তখন তাকে যুদ্ধ করে পরাজিত করা যাবে। এ যখন আমাদের ঘরে এসে গেছে এখন একে বন্দি করে রাখি। 

শুনে যুধিষ্ঠির ‘ভাল, ভাল’ বলে সমর্থন করলেন। 

দুর্যোধন বলে –তবে এর পায়ে শিকল পরান হোক। 

শাম্বের পায়ে শিকল দিয়ে গুরু দ্রোণ ভীষ্মের গৃহে নিয়ে চললেন। অন্যেরাও যে যার গৃহে গেল। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।
......................................

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০৭

[পূর্বকথা সুভদ্রা হরণের কথা... সুভদ্রার ইচ্ছে রাখতে সত্যভামা কৌশলে তার গন্ধর্ব বিবাহ দিলেন অর্জুনের সাথে ... কৃষ্ণ সভায় অর্জুনকে সুভদ্রার জন্য উপযুক্ত পাত্র নির্বাচন করলে বলরাম ক্রুদ্ধ হল, তিনি দুর্যোধনকে পাত্র ঠিক করলেন ]

দৈবকী-রোহিণী সহ বলরামের কথাঃ



দিন অবসানে সকল যদুরা যে যার গৃহে ফিরে গেল। 

সত্যভামা কৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করলেন –হে প্রাণপতি, ভদ্রার বিবাহের বিলম্ব করছ কেন! 

গোবিন্দ বলেন –সখি, কিসের বিবাহ! পার্থের নাম শুনলেই বলরামের অঙ্গ জ্বলে। তিনি দুর্যোধনকে পাত্র নির্বাচন করেছেন। তার কাছে দূতও পাঠান হয়েছে। 

শুনে সত্যভামা চমকে ওঠেন। 
অধোমুখে মাটিতে বসে পরে বলেন –হে দেব এখন কি হবে! সুভদ্রার কারণে দেখছি অনর্থ ঘটবে। সব শুনে অর্জুন যদি পালিয়ে যান, তাহলে কি ভগিণীর অন্য বরের সাথে বিবাহ দেবে! কিছু না বলে চুপ করে আছ কেন! যদুকুলে কি কলঙ্ক দেবে! 

গোবিন্দ বলেন –দেবী, গোল কেন করছ! উতলা হয়ো না, আমি ঠিক উপায় বার করব। 

সত্যভামা বলেন –আর বিলম্ব কর না। কেউ যদি সব কথা বলরামকে গিয়ে বলে! সেই লজ্জার ভয়ে আমি কাঁপছি। আর যে মুখ দেখাতে পারব না, জলে ঝাঁপ দিতে হবে। স্ত্রীলোকই স্ত্রীলোকের বেদনার কথা ঠিক ঠিক বুঝবে। আমি আগে গিয়ে শাশুড়িমাকে সব জানিয়ে আসি। 

এই বলে সত্যভামা উঠে দেবকীর গৃহে গেলেন।

দেবকীকে ডেকে তিনি বেলন –শুনুন ঠাকুরাণী আমার নিবেদন। কুললজ্জার ভয়ে আমি অস্থির। সুভদ্রা বীর ধনঞ্জয়ের প্রতি আসক্তা হয়ে ভয় দেখাল তাকে না পেলে সে প্রাণ দেবে। সে জন্য আমি দ্রুত তাদের গান্ধর্ব বিবাহ দিলাম। এখন শুনছি তার জন্য অন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। 

সব শুনে দেবকী দেবী বিস্মিত হলেন। রোহিণীর(বলরামের মা) সাথে বলরামের গৃহে যান। 

দেবকী বলরামকে ডেকে বলেন –হে হলপাণি, সুভদ্রাকে অর্জুনের হাতে দিচ্ছ না কেন। রূপে, গুণে, কূলে, শীলে সে ভদ্রার যোগ্য। কুটুম্বে কুটুম্বে সম্বন্ধও হবে। 

বলরাম বলেন –মা, সব না বুঝে একথা বলছেন। পাণ্ডবদের অবস্থার কথা সবাই জানে। পার্থ আমাদের কুটুম্বের যোগ্য নয়। অযোগ্য সম্বন্ধে মা সব নষ্ট হয়। সে জন্য দুর্যোধনের কাছে দূত পাঠিয়েছি। সে নিষ্কলঙ্ক সুভদ্রার যোগ্য। তিনলোকে সকলে জানে পাণ্ডবরা জারজ সন্তান। এমন জনকে সুভদ্রার স্বামী করতে চাও! 

রোহিণী বলেন –পুত্র, সবাই বিচার করেই পার্থকে নির্বাচিত করেছে। কেন সকলের বাক্য অবহেলা কর। সবাই আমরা চাই অর্জুনের হাতে সুভদ্রাকে সমর্পণ করা হোক। পার্থ সাধু ব্যক্তি, ধর্মশীল, সর্ব গুণে গুণী। তাকে না দিয়ে সুভদ্রাকে অন্যের হাতে দেবে! ক্রোধ ত্যাগ কর পুত্র! তুমি যাই বল কাল সকালেই আমি ভদ্রাকে অর্জুনের হাতে তুলে দেব। 

মায়ের কথা শুনে বলরামের ক্রোধে অধর(ঠোঁট) কাঁপে। দুই চোখ রাগে জ্বলতে থাকে। 
তিনি ক্রোধের সাথে বলেন –আপনারা বাতুলের(পাগলের) মত কথা বলছেন। সকলে গোবিন্দের মতে মত দিয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণের তো জাতিকুলের কোন বিচার নেই। ভক্তি ভরে যে জন ডাকে, কথা কয়, কোন বিচার না করেই সে তার বন্ধু হয়। 
অথচ কিছুকাল আগে তার পুত্রের হাতেই দুর্যোধন তার কন্যা দান করেছে। সেই নব কুটুম্বিতায় কৃষ্ণের সামান্য স্নেহও নেই! আমি তাকে শিষ্য বলে অতি স্নেহ করি, তাই সবাই তার উপর ক্রুদ্ধ। দেখি কার কত ক্ষমতা সুভদ্রাকে অর্জুনের হাতে তুলে দেয়! মা আপনারা যান, আমায় আর কিছু বলবেন না। 

বলরামের এত কথা শুনে বিষণ্ণ বদনে দেবকী ও রোহিণী উঠে চলে এলেন। 

জন্মেজয় বৈশম্পায়ন মুনিকে বলেন –হে মুনিরাজ, কৃষ্ণের কোন পুত্রকে দুর্যোধন তার কন্যা দিলেন! কই আমায় তো সে কাহিনী বললেন না! সে কাহিনী শুনতে মন চায়। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন শুনেন পুণ্যবান।
................................................

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০৬

[পূর্বকথা - পারিজাত হরণের কথা শেষ হল...এবার সুভদ্রা হরণের কথা... সুভদ্রার ইচ্ছে রাখতে সত্যভামা কৌশলে তার গন্ধর্ব বিবাহ দিলেন অর্জুনের সাথে ... ]

অর্জ্জুন-সহ সুভদ্রার বিবাহে বলরামের অসম্মতিঃ 



পরদিন প্রভাতে সব যাদব প্রধানরা স্থানদান করে একত্রে বসলেন। 
সভায় উগ্রসেন, বসুদেব, সাত্যকি, উদ্ধব, অক্রুর, সারণ, গদ, মুষলী, মাধব প্রমুখরা যখন বসে, তখন পূর্বদিনের প্রসঙ্গ টেনে নারায়ণ কৃষ্ণ বলেন –সুভদ্রাকে দেখে আমি চিন্তিত। বিবাহযোগ্য কন্যা অবিবাহিত থাকলে সে সবার কাছে অস্পৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। অনূঢ়া কুমারী ঋতুবতী হলে তার সপ্তকুল অধোগতি হয়, যা কুলের কলঙ্ক আর সংসারের লজ্জা। তাই কন্যাদানে ব্যাজ(দেরি) করা উচিত নয়। সাত বছরে কন্যা দিলে ফল পাবে, এর বেশি বিলম্ব উচিত নয়। সুভদ্রার জন্য তো যোগ্য কাউকেই দেখছি না! আমার মন কেবল কুন্তীর পুত্রকে নির্বাচন করছে। রূপে, গুণে, কুলে, শীলে, বলে বলবান পার্থই যোগ্য পাত্র অনুমান করছি।

শুনে বসুদেব বলেন –কৃষ্ণের কথা আমারও মনের ইচ্ছা। সাত্যকি বলে-আমাদের কুলের সৌভাগ্য থাকলে সুভদ্রা অর্জুনকে স্বামী হিসাবে পাবে। 

অন্যান্য যাদবরাও বলে ওঠে –ভাল, ভাল। অর্জুনের সমান ভূতলে আর কেউ নেই। 

সবার এমন বাক্য শুনে রক্তচক্ষু করে ক্রোধে হলধর বলরাম বলে ওঠেন –কেন মিছে সুভদ্রার জন্য চিন্তা করছ! আমি তার জন্য পাত্র ঠিক করে রেখেছি। কৌরবকুলের শ্রেষ্ঠ রাজা দুর্যোধন। উচ্চকুল বলে ভুবন বিখ্যাত। শক্তি বলে তিনি দশ সহস্র বারণ(হস্তি) সমান। রূপে সে কন্দর্প এবং জিনে ধরে বৈশ্রবণ(বিশ্রবামুনির পুত্র-কুবের, রারণ প্রমুখ)। 
অর্জুনকে তার শতাংশের মধ্যেও আমি গণি না। এসব না বুঝে কথা বলা উচিত নয়। এখনি হস্তিনানগরে দূত পাঠিয়ে তাকে এখানে দ্রুত আনা হোক। শুভদিন দেখে শুভকার্য করব। শত শত রাজ্যের রাজাদের আমন্ত্রণ করে আনব। 

বলরামের মুখে একথা শুনে সকলে অধোমুখে নিরুত্তর থাকলেন। ততক্ষণে বলরাম দূতকে ডেকে রাজ্যে রাজ্যে নিমন্ত্রণ পত্র লিখতে থাকেন। 

দুর্যোধনের উদ্দেশ্যে লিখে দেন –সুসজ্জিত হয়ে দ্রুত চলে আসুন, আপনার বিবাহ। 

মহাভারতের কথা অমৃত লহরী, কাশীরাম কহেন, সাধুজন যান ভব তরি।
....................................

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০৫

[পূর্বকথা - পারিজাত হরণের কথা...নারদ পারিজাতপুষ্প কৃষ্ণকে দিলে তিনি তা স্ত্রী রুক্মিণীকে পরিয়ে দেন... সে কথা শুনে সত্যভামার অভিমান হয়...তিনি আহার নিদ্রা ত্যাগ করেন, কৃষ্ণ এসে তার মানভঞ্জন করেন এবং পারিজাত বৃক্ষ উপহারের আঙ্গিকার করেন...শ্রীকৃষ্ণের সাথে ইন্দ্রের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ শুরু হয়...মহাদেবের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণ ইন্দ্রকে সম্মান দেখালে ইন্দ্র পারিজাত কৃষ্ণকে দান করেন ...কিন্তু শচীর হাসি সত্যভামাকে ক্রোধী করে...কৃষ্ণ পুনরায় ইন্দ্রের সাথে যুদ্ধ করতে চান... গড়ুরের ইন্দ্রকে সত্যভামার কাছে নিয়ে আসেন... ইন্দ্রের স্তবে সত্যভামা খুশি হন...কৃষ্ণকে নিজের করে পাওয়ার জন্য নারদ মুনির কথা মত সত্যভামা ব্রত পালন করেন... নারদ কৃষ্ণকে দান পেয়ে তাকে সাথে নিয়ে যেতে চান...সত্যভামা নিজের ভুল বোঝেন... উদ্ধবের প্রচেষ্টায় তুলসিপত্রে কৃষ্ণনাম দান পেয়ে নারদ সন্তুষ্ট হন...এবার সুভদ্রা হরণের কথা]

সুভদ্রার গান্ধর্ব্ব-বিবাহঃ 



রাজা জন্মেজয় বৈশম্পায়ন মুনিকে পুনরায় তার পিতামহ অর্জুনের কথা বলতে বলেন। 

মুনি বলেন –শুনুন মহারাজ, সুভদ্রা ও পার্থের স্বয়ম্বর কেমন হল। 
দ্রৌপদীর নিন্দা শুনে অর্জুন যখন সত্যভামাকে তার স্বামী কৃষ্ণবশের ওষুধ সম্পর্কে জানতে চান, 
তখন অর্জুনের কথা শুনে সত্যভামা হেসে বলেন –স্ত্রীরা স্বামীর উপর ওষুধ প্রয়োগ করে, এই বিধি। কিন্তু পুরুষ হয়ে তুমি কি ঔষধি করলে! ভন্ডতা করে ব্রহ্মচারী হলে, এদিকে নারীকে ভোলাতে মহৌষধিও শিখে রেখেছ! 

অর্জুন বলেন –দেবী সত্যভামা, আমি আপনার স্তুতি করছি। রাত্রি শেষ হতে চলেছে। আমি নিদ্রা যেতে চাই, আজ আমায় ক্ষমা করুন। আমি জিতেন্দ্রিয়, সত্যবাদী, ব্রহ্মচারী মানুষ। দেশ দেশান্তরে তীর্থযাত্রা করে ভ্রমণ করছি। আমার নামে কেন মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছেন, সংসারে আমার নিন্দা হবে। 
পার্থের মন বুঝে ভারতী সত্যভামা উঠে পরলেন। 

সুভদ্রা বলেন –সতী কোথায় যাচ্ছ! 

সত্যভামা বলেন –আমার সাথে এস। উপায় বার করি। 

এই বলে সুভদ্রাকে নিজের প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। মায়াবতী কামপ্রিয়া, যিনি নানা মায়ায় পারদর্শী। সত্যভামা দ্রুত তাকে ডেকে পাঠান। গোপনে তাকে সুভদ্রার মনের কামনার কথা সব জানান। 

রতি বলে –ঠাকুরাণি, এআর এমন কি! জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারী বলে পার্থ গর্ব করছেন তো! এই অস্থিচর্মী অনাহারীকে আমি মোহিত করতে সক্ষম। 
এই বলে সে সুভদ্রাকে সাজাতে বসল। কপালে সুন্দর করে সিঁদুর পরাল, মন্ত্রপূত কাজল দুই চক্ষে পরাল। 
সজ্জা করিয়ে হেসে সুভদ্রাকে বলে -দেবী এবার গেলে পথ পাবেন। আপনার হাতের স্পর্শে দ্বারের কপাট খুলে যাবে। 

রতির বাক্য শুনে সুভদ্রা আনন্দিত হয়ে পুনরায় অর্জুনের গৃহে গেলেন। হাত বারাতেই দরজা খুলে গেল। তিনি অর্জুনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাকে দেখে মনে হয় চিত্রকর যেন কনক প্রতিমা নির্মাণ করেছেন। সুভদ্রা যেন বত্রিশ কলাতে শোভিত এক চন্দ্রমা। 

অর্জুন তাকে ভাল করে নিরীক্ষণ না করেই ক্রোধে বলে ওঠেন –কে তুমি! স্ত্রীলোক না হলে এখনি খড়্গে তোমায় কাটতাম। শীঘ্র প্রাণ নিয়ে পালাও নইলে নাক, কান কেটে নেব। 
এই বলে হাতে ছুরি নিয়ে তেড়ে এলেন। দেখে সুভদ্রা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। 
কিন্তু ফাল্গুনি(অর্জুন) কাছে এসে সুভদ্রার সিঁথার সিঁদুর, চোখের কাজল ও মোহময় রূপ দেখে বিহ্বল হয়ে গেলেন। কাম এসে পার্থের জ্ঞান হরণ করল। তিনি হিল্লোলিত হলেন। সুভদ্রা পরে যাচ্ছেন ভেবে পার্থ তাকে কোলে তুলে নিলেন। 

কামে পীড়িত পার্থ বলেন –এস, এস, বস ওহে আমার প্রাণসখি! তোমার পূর্ণ চন্দ্রমার মত সুন্দর বদন একটু নিরীক্ষণ করি, এস। 

সুভদ্রা ‘না, না’ বলে মুখ বস্ত্রে ঢাকেন। ভয়ে সুভদ্রা বলে ওঠেন –আমার জাতিনাশ কেন কর! ছাড় পার্থ, ছাড়! অনূঢ়া কন্যাকে বলাৎকার করতে চাও! এ তোমার কেমন ব্যবহার! 

ঘরের বাইরে থেকে সত্রাজিত-কন্যা সত্যভামা বলেন –হে পার্থ এখানে কে গণ্ডগোল করছে! 

সুভদ্রা বলে ওঠেন –সখি এসে দেখ অর্জুনবীর আমায় জোর করে ধরে রেখেছেন। 

সত্যভামা বলেন –পার্থ, এযে অনূঢ়া নারী! তুমি ব্রহ্মচারী হয়ে তাকে বলপ্রয়োগ করে কেন ধরেছ! বসুদেবের কন্যা ইনি, কৃষ্ণের ভগিনী। ধার্মিক হয়ে এর সাথে আপনি এমন কর্ম করলেন! 

হতবিহ্বল পার্থ হাতজোড় করে বিনয় বাক্যে বলেন –অনন্ত নারীর মায়া, নরের বোধের বাইরে। তোমার অশেষ মায়া বিধির অগোচর। দামোদর কৃষ্ণ আপনাকে বুঝলেন না, আমি কি বুঝব! না জেনে আপনার আজ্ঞা লঙ্ঘন করেছিলাম তাই এমন হল। আমায় ক্ষমা করুন, আমি আপনার শরণ নিচ্ছি। 

অর্জুনের স্তবে তুষ্ট হলেন ভারতী সত্যভামা। হেসে বলেন –হে মহামতি, ভীত হয়ো না। যা কাজ করলেন এখন ক্ষত্রধর্ম অনুসারে গন্ধর্ব বিবাহ করে নিন। 

পাচঁ-সাতজন সখি উলুধ্বনি দিতে লাগল। সত্যভামার তত্ত্বাবধানে পার্থ ও সুভদ্রা পরস্পরের গলায় মালা পরালেন। 

এভাবে অর্জুন ও ভদ্রার বিবাহ দিয়ে সত্যভামা গোবিন্দের কাছে গিয়ে সব বলেন –তুমি যে আজ্ঞা দিলে সেই মত গান্ধর্ব বিবাহ দিয়ে এলাম। কাল সকালে তুমি সুভদ্রার বিবাহের ব্যবস্থা কর। দূত পাঠিয়ে কুটুম্বদের এন। 

গোবিন্দ বলেন –সতী আমারও তাই মত। কিন্তু বলভদ্র অর্জুনের উপর বিশেষ প্রীত নন। সুভদ্রাকেও তিনি পার্থের হাতে দিতে চাইবেন না। 

সত্যভামা বলেন –তা হলে কি উপায়! 

শ্রীহরি হেসে বলেন –উপায় আমি বার করব। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীদাস কহেন সদা সাধুরা করেন পান।
..................................

Monday, September 14, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০৪

[পূর্বকথা - পারিজাত হরণের কথা...নারদ পারিজাতপুষ্প কৃষ্ণকে দিলে তিনি তা স্ত্রী রুক্মিণীকে পরিয়ে দেন... সে কথা শুনে সত্যভামার অভিমান হয়...তিনি আহার নিদ্রা ত্যাগ করেন, কৃষ্ণ এসে তার মানভঞ্জন করেন এবং পারিজাত বৃক্ষ উপহারের আঙ্গিকার করেন...শ্রীকৃষ্ণের সাথে ইন্দ্রের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ শুরু হয়...মহাদেবের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণ ইন্দ্রকে সম্মান দেখালে ইন্দ্র পারিজাত কৃষ্ণকে দান করেন ...কিন্তু শচীর হাসি সত্যভামাকে ক্রোধী করে...কৃষ্ণ পুনরায় ইন্দ্রের সাথে যুদ্ধ করতে চান... গড়ুরের ইন্দ্রকে সত্যভামার কাছে নিয়ে আসেন... ইন্দ্রের স্তবে সত্যভামা খুশি হন...কৃষ্ণকে নিজের করে পাওয়ার জন্য নারদ মুনির কথা মত সত্যভামা ব্রত পালন করেন...] 

শ্রীকৃষ্ণকে দান পাইয়া নারদের গমনঃ



দান পেয়ে নারদমুনি উর্দ্ধবাহু নাচতে থাকেন। যত দান পেলেন সব ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। কৃষ্ণকে দান পেয়ে তিনি আনন্দের 
আপ্লুত। নারদ দ্বারকানাথ কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। একথা শুনে দ্বারকাবাসী নরনারী ধেয়ে আসে। 

পারিজাত বৃক্ষ থেকে কৃষ্ণকে মুক্ত করে নারদ বলেন –হে গোবিন্দ, আপনার বর্তমান আভরণ ত্যাগ করুন। এই রাজ বেশের আর কি কাজ। এখন তপস্বী হয়ে তপস্বীর সাজ ধারণ করুন। কিরীট ফেলে মাথায় পিঙ্গল জটা ধারণ করুন। কনক পইতে ফেলে যোগপাটা নিন। হে কৃষ্ণ, কনকমুক্তার হার ফেলে বলমালা কণ্ঠে ধরুন। পীতাম্বর ফেলে বাঘছাল পরুন। 



নারদমুনির কথায় কৃষ্ণ তখনই সব রাজবেশ ত্যাগ করে তপস্বীর বেশে সাজলেন। দেবকীনন্দনের কাঁধে উঠল মৃগছাল, হাতে বীণা। 
তিনি নারদের পিছু পিছু চলেন, দেখে মনে হয় তিনি নারদের চেলা। কৃষ্ণের এই বেশ দেখে উগ্রসেন, বসুদেব প্রমুখ সকল যাদব নর, নারী, শিশু কাঁদতে থাকে। এমনকি বন্য পশুরাও অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে। দ্বারকাবাসী বাল-বৃদ্ধ-যুবা সকলে ভূমিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে থাকে। মা দেবকী-রোহিণীরাও কাঁদেন। রুক্মিণী প্রমুখ ষোল সহস্র রমণীরাও কৃষ্ণের পিছে পিছে চলেন। 

নারদ বলেন –আপনারা কোথায় চলেছেন! 

রুক্মিণী বলেন –আপনি কৃষ্ণকে যেথায় নিয়ে যাবেন, আমরাও সেখানে যাব। 

নারদ বলেন –তার কি প্রয়োজন! আমি তপস্বী ব্রাহ্মণ, নানা স্থানে ভ্রমি। 

রুক্মিণী বলেন –হে মুনি, আপনি কৃষ্ণ দান পেলেন। সেই সাথে যৌতুক পেলেন ষোল সহস্র রমণী। 

মুনি বলেন –রুক্মিণী মিছে দ্বন্দ করতে আসছেন। পরে রাগ করবেন না, যদি কিছু ভাল- মন্দ বলে ফেলি। যখন সত্রাজিতের কন্যা সত্যভামা কৃষ্ণকে দান করছিলেন তখন তো কেউ স্বামীকে রক্ষার জন্য কোন কথা বলেন নি, কোন চেষ্টাও করেন নি। তখন কিছু না করে এখন আমাকে এসব শোনাচ্ছেন। 


রুক্মিণী বলেন –মুনিবর, সত্যভামার দানে আমার কোন দায় নেই। আপনি আমাদের প্রাণনাথকে নিয়ে গেলে আমরা কোথায় যাব! রক্ষা করুন আমাদের। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।
..........................................
নারদকে শ্রীকৃষ্ণ পরিমাণে ধনদানঃ



নারদমুনি গোবিন্দকে নিয়ে চলেছেন। বিষণ্ণবদনে সত্যভামা তা চেয়ে দেখেন। যখন হৃদয়ঙ্গম করেন কি ঘটনা ঘটতে চলেছে, তখন বাতুলের(পাগলের) মত উঠে এসে দুই হাত প্রসারিত করে মুনির পথ আগলে দাঁড়ান। 

সত্যভামা বলেন –হে নারদমুনি, তোমার চালাকি বুঝেছি। আমাকে বোকা বানিয়ে আমার স্বামীকে নিয়ে যাচ্ছ! বালককে যেমন হাতে কলা দিয়ে বোকা বানান হয়, তেমনি হাতে আমার কাঁচ দিয়ে কাঞ্চনমালা নিয়ে তুমি পালাও! শিলা দিয়ে নিয়ে যাও পরশ রতন! শরীর ফেলে জীবন সঙ্গে নিয়ে যাও! আমি এ ব্রতের ফল আর চাই না। আমার প্রাণনাথকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। 

নারদ বলেন –সত্যভামা সত্য ভ্রষ্টা হচ্ছেন। সকলের সামনে আপনি গোবিন্দকে আমায় দান করেছেন। এখন বলছেন ব্রতের প্রয়োজন নেই! আমি দান গ্রহণ করেছি তা আর ফেরত দেব কেন! আমায় একা পেয়ে বল প্রয়োগ করতে চান! আমার সম্পদ নেয় দেখি কার কত শক্তি! 
এই বলে ক্রোধে নারদমুনি দুই আঁখি ঘোরাতে থাকেন। 
তার এমন রূপ দেখে সত্যভামা ভয়ে কাঁপতে থাকেন। তবু তিনি বলেন –আপনার ক্রোধকে আমি ভয় পাই না। খুব বেশি ক্রোধ হলে আমায় ভস্ম করে দিন। গোবিন্দের বিচ্ছেদে মরেও আমার সুখ। কৃষ্ণকে আর দেখতে পাব না, এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কি আছে! 
হে মুনি আপনি কিন্তু পূর্বে বলেছিলেন এই ব্রতের ফলে ইন্দ্রাণী, পার্বতী ও অগ্নিপ্রিয়া স্বাহা সকলে স্বামীকে আরো গভীরভাবে পেয়েছিলেন। তারা স্বামীকে পেলে আমি কেন পাব না! 


অগ্নি ও স্বাহা

নারদ বলেন –সর্বভক্ষ হুতাশন অগ্নি, চারমুখে তার প্রচন্ড কিরণ। তাকে নিয়ে আমি কি করব! সে কারণে স্বাহাকে তার স্বামী ফিরিয়ে দিয়েছি। পার্বতীর পতি রুদ্র শিব, বলদ তার বাহন। হাড়মালা, ভস্ম মেখে গলায় সাপদের নিয়ে ঘোরেন। সব সময় ভূত প্রেত নিয়ে তার কারবার। তাই অবহেলা করে তাকে সঙ্গে নিলাম না।


শিব ও পার্বতী
শচী পতি পুরন্দর ইন্দ্র সহস্রলোচন। তিনলোক পালনের জন্য বিধাতা তাকে নিয়োজিত করেছেন। ইন্দ্র কখনও ঐরাবতে কখনও উচ্চৈঃশ্রবায় আবার কখনও রথে ঘোরেন। বিনা বাহনে তিনি চলতেই পারেন না। সে কারণে আমি আর তাকে সঙ্গে নিলাম না। তবু তিনি স্বর্গে আমার হয়েই আছেন। 


ইন্দ্র ও শচী
আপনার যে স্বামী কৃষ্ণ, তার রূপের সীমা নেই। তিনলোকের মধ্যে কাকে তার উপমা দেব। এখন থেকে যেখানে যাব সেখানেই তাকে সঙ্গে নেব। অনুক্ষণ দিনরাত তাকে চোখের সামনে দেখতে পাব। এ আমার বহু জন্মের ইচ্ছা। অনেক তপস্যার ফলে আজ বিধাতা আমায় সে সুযোগ করে দিলেন। চোখ বুজে সদা যাকে ধ্যান করি তাকে হাতে পেয়ে আপনাকে কি আর ফেরত দেব! 

একথা শুনে সতী সত্যভামা মুর্চ্ছিতা হলেন। দেখে বোঝা যায় না তিনি জীবিতা কি মৃতা। সত্যভামার কষ্ট দেখে কৃষ্ণের দয়া হল। 


তিনি নারদকে অনুরোধ করলেন –মুনি মায়া ত্যাগ করুন। 

মুনি বলেন –কর্মফল ভোগ করতেই হবে। তোমাকে ত্যাগ করে ব্রত ফলে মন দিল! 

কৃষ্ণ বলেন –স্ত্রীজাতি সহজেই অজ্ঞ হয়ে যান। তোমার মত জ্ঞান সে কোথায় পাবে। সতীর শরীরে প্রাণ নেই মনে হচ্ছে। যোগবলে তার আত্মা এক্ষুনি দিন মুনিবর। 

সতী সত্যভামার কষ্ট দেখে নারদমুনির দয়া হল। তিনি ‘উঠুন, উঠুন’ বলে সত্যভামাকে বারবার ডাকতে থাকেন। মুনির আশ্বাসে দেবী চেতনা ফিরে পেলেন। উঠে পুনরায় নারদমুনির চরণ ধরে প্রার্থনা করতে লাগলেন। 

নারদ বলেন –দেবী এক কাজ করুন। দান দিয়ে আবার ফেরত নেওয়া অধর্ম। তার চেয়ে গোবিন্দের সমান রত্ন দান করে পুনরায় কৃষ্ণকে গ্রহণ করুন। এতে ব্রতের ফল শাস্ত্রমতেই পাবেন। 

শুনে সত্যভামা উল্লাসিত হলেন। 
পুত্রদের ডেকে মৃদুভাষে বলেন –বিধিমত তূলাদন্ডের সজ্জা কর। আমার গৃহ থেকে সকল রত্ন নিয়ে এস। 

আজ্ঞা পেয়ে কাম ও অন্যান্য পুত্ররা দ্রুত কনক তূলা সজ্জা করল। একদিকে দেবকীনন্দন কৃষ্ণ বসলেন। অন্যদিকে সব রত্ন দেওয়া হল। কিন্তু তূলা সমান হল না।
সত্যভামার গৃহের রত্ন দিয়েও কোন কাজ হল না দেখে রুক্মিণী, কালিন্দী, লগ্নজিতা, জাম্ববতী প্রমুখ কৃষ্ণের অন্যান্য স্ত্রীরা সকলে দ্রুত নিজ নিজ ঘরের সকল সম্পদ তূলায় দিতে লাগলেন। তবু তূলা সমান হল না। 
তখন ষোড়শ সহস্র কন্যা তাদের ধন তুলে দিলেন। এমনকি কৃষ্ণের ভান্ডারের ধন যা কুবেরের সমান তাও সব চড়ান হল। তবু কিছুই কৃষ্ণের সমতুল হল না। 
দ্বারকাবাসী তখন নিজেদের দ্রব্যাদি শকটে(গাড়ি), উটে, বৃষে বয়ে এনে তূলায় চড়াতে লাগল। কিন্তু কিছুই তূলাকে নরাতে পারল না। সকলে অবাক হল। পর্বতের আকারের রত্ন চড়ান হল কিন্তু নারায়ণকে ভূমি থেকে সামান্যও তুলতে পারা গেল না। 

সব দেখে সত্যভামা কাঁদতে লাগলেন। 
তা দেখে নারদমুনি ক্রোধমুখে বলেন –উপেন্দ্রানী বলে বড়ই গর্ব কর! কিন্তু রত্ন দিয়ে তো স্বামিকে উদ্ধার করতে পার না! এদিকে খালি শিশুর মত কেঁদে যাচ্ছে! এতদিনে তার প্রকৃত মূল্য জানলে! এমন জন কেন যে এই ব্রত করে। এখন বুঝেছি তুমি ধন দিতে পারবে না। 

নারদ কৃষ্ণের হাত ধরে তাকে উঠতে বলেন। শুনে সত্যভামা ধূলায় গড়াগড়ি দিতে থাকেন। মুক্ত কেশ উড়তে থাকে। দ্বারকার সকল যাদব যাদবী কাঁদতে থাকে। 

তখন অনেক চিন্তা করে উদ্ধব(কৃষ্ণের সখা, সম্পর্কে পিতৃব্য) বলেন –কৃষ্ণ আপন মুখে বলেছেন বারবার-তার চেয়ে কেবল তার নাম বড়। সকলে মিলে এস আমরা তার নাম কীর্তন করি। তূলা থেকে সব রত্ন ফেলে দাও। সমগ্র ব্রহ্মান্ড যার এক লোমকূপে তাকে কোন দ্রব্যে সমান করতে চাও! 


এই বলে তিনি তুলসী পাতা তুলে এনে তাতে দুই অক্ষর কৃষ্ণ নাম লিখলেন। তূলার উপর সেই তুলসীপাতা রাখতেই নীচে এল তুলসী, জগন্নাথ উপরে উঠলেন। 
দেখে সকলে উল্লাসিত হল। “সাধু, সাধু” বলে মহাধ্বনি রব উঠল। কৃষ্ণনাম গুণের কোন সীমা নেই। বৈষ্ণবরাই কৃষ্ণনামের মহিমা জানেন। শ্রীকৃষ্ণের থেকেও কৃষ্ণনাম বড় ধন। চিত্ত দৃঢ় করে কৃষ্ণনাম জপ কর। কৃষ্ণ কৃষ্ণ বললে পাবে কৃষ্ণ দেহ, কৃষ্ণের মুখের বাক্য-এতে কোন সন্দেহ নেই। 

তুলসীপত্রে কৃষ্ণনাম পেয়ে নারদমুনি তুষ্ট হলেন। সত্যভামা সকল রত্ন ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। 



পারিজাত-হরণের এই হল বিবরণ। এবার সুভদ্রা হরণের কথা হবে।

মহাভারতের কথা অমৃতের ধারা, শুনলে অধর্মীও ভবসাগর পার হবে। পারিজাত হরণের আমোদিত রস কথা শুনলে সংসারের ব্যথা ঘুচে। পুরুষ শুনলে হয় কৃষ্ণপদে মতি, নারী শুনলে সৌভাগ্য হয় পতির। বংশ বাড়ে, পরমায়ু বৃদ্ধি ঘটে, সর্বত্র কল্যাণ হয়। কাশীদাস কহেন, তা করিয়া প্রমাণ। 
..................................

Sunday, September 6, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০৩

[পূর্বকথা - পারিজাত হরণের কথা...নারদ পারিজাতপুষ্প কৃষ্ণকে দিলে তিনি তা স্ত্রী রুক্মিণীকে পরিয়ে দেন... সে কথা শুনে সত্যভামার অভিমান হয়...তিনি আহার নিদ্রা ত্যাগ করেন, কৃষ্ণ এসে তার মানভঞ্জন করেন এবং পারিজাত বৃক্ষ উপহারের আঙ্গিকার করেন...শ্রীকৃষ্ণের সুরপুরী গমন করেন...শ্রীকৃষ্ণের সাথে ইন্দ্রের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ শুরু হয়...মহাদেবের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণ ইন্দ্রকে সম্মান দেখালে ইন্দ্র পারিজাত কৃষ্ণকে দান করেন ...কিন্তু শচীর হাসি সত্যভামাকে ক্রোধী করে...কৃষ্ণ পুনরায় ইন্দ্রের সাথে যুদ্ধ করতে চান... গড়ুরের ইন্দ্রকে সত্যভামার কাছে নিয়ে আসেন...] 



সত্যভামার প্রতি ইন্দ্রের স্তবঃ
সতী সত্যভামার সামনে শিরে যোড়হাত করে প্রণাম করেন দেবরাজ ইন্দ্র। সুরপতি অষ্টাঙ্গ পৃথিবীতে লুটিয়ে স্তব করতে থাকেন। স্বর্গের অন্যান্য দেবতারাও তাকে অনুসরণ করেন। 
সকলে স্তব করে বলতে থাকেন –হে দেবী, তুমি লক্ষ্মী- সরস্বতী-রতি-সতী-অরুন্ধতী-পার্বতী-সাবিত্রী সকল দেবের মাতা। তুমি অধঃ[পাতাল]-ক্ষিতি[পৃথিবী]-স্বর্গ। তুমিই চতুর্বর্গের[ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ] দাতা। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় বিধাতা। অনাদি পুরুষ প্রিয়া, কে জানে তোমার ক্রিয়া। মায়ায় মনুষ্য দেহ ধারণ করলে। তুমি বিধাতার ধাতা, আমাদের সবার অন্নদাতা। আমি তোমার কি বর্ণনা দিব। 
বেদপতি ব্রহ্মা যা করতে পারেন নই, পঞ্চানন শিবও পারলেন না-তাই তুমি করে দেখালে। 
তুমিই আমায় সর্বস্ব দিয়েছ তাই আমার গর্ব হল, তোমার চরণ ভুললাম। এবার কৃপা কর। 
তুমি দেবী বুদ্ধিরূপা, সুমতি –কুমতি প্রদায়িনী। তুমি শূণ্য-জল-স্থল, পৃথিবী পর্বতানল। তুমিই সব গৃহে জননী-রুপিনী। 
তোমার পদে আমি শরণ নিলাম। আমার অপরাধ ক্ষমা কর। এ অজ্ঞানের দুর্মতি দুর কর। সম্পদে মত্ত হয়ে সব কথা না জেনে নিজের ঈশ্বরকেই চিনতে পারিনি। 


এই বলে সুরপতি ইন্দ্র আমার ভূমিতে লুটিয়ে প্রলেন। তার কেশপাশ ধূলায় ধূসর। কিরীট(মুকুট), কুন্ডল হার, ছত্রদন্ড, অলঙ্কার সব ধুলোয় লুটাতে থাকে। ধূলিতে তনু লুটিয়ে প্রায় ইন্দ্রের চোখে ধূলি ঢুকে যায়, তিনি চখে আর দেখতে পান না। বারবার ক্ষমা চাইতে থাকেন। 

এতসব দেখে সতী সত্যভামার মন আদ্র হল। 
তিনি খগেশ্বরকে বলেন –ইন্দ্রকে উঠান। 
মন্দাকিনীর জল দিয়ে চক্ষু ধুয়ে দিলে দেবরাজের চোখ নির্মল হবে। শুনে সতীর বাণী সকলে মন্দাকিনীর জলে শ্রীবাসব ইন্দ্রকে স্নান করালেন। সহস্রলোচনের চক্ষু নির্মল হল। 
তিনি সবার আশীর্বাদ নিয়ে ঐরাবতে আরোহণ করে স্বর্গে গেলেন। 



নারদের সাথে পারিজাত পুষ্প নিয়ে যদুরায় কৃষ্ণও দ্বারকায় চললেন। 

মহাভারতের কথা শ্রবণ করলে সকল ব্যথার বিনাশ হয়, অধর্ম সব নাশ হয়। 
কমলাকান্তের পুত্র কাশীরাম দাস যিনি সৎ সজ্জনের প্রিয়, তিনি এটি রচনা করেছেন।
........................... 


সত্যভামার ব্রতারম্ভঃ 

দ্বারকায় সত্যভামার গৃহের দ্বারে পুষ্পরাজ পারিজাত বৃক্ষ রোপণ করা হল। নানা মূল্যবান রত্নে তাকে সাজিয়ে তোলা হল। দেখে মনে হল শত শত রবি শশি যেন শোভা পাচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে তার দীপ্তি আভা সৌরভ ছড়াতে লাগল। ঘরের সামনে চাঁদোয়া বেঁধে কৃষ্ণসহ সকলে পারিজাত তলে বিলাস করেন। 

সে সময় নারদমুনি সেখানে উপস্থিত হলেন। সত্যভামাকে দেখে তিনি তার বিস্তর স্তব করতে লাগলেন। 

নারদ বলেন –দেবী, আপনার সমান কেউ নেই, কোন দিন হবেও না। দেবের দুর্লভ যে পারিজাত পুষ্প তা স্বয়ং জগন্নাথ আপনার দুয়ারে স্থাপন করলেন। এখন দেবী এর যে কাজ তা আপনি করুন। অবহেলা করবেন না। 
আপনাকে ব্রতপালন করতে হবে। এই ব্রত পালন করলে আপনিই গোবিন্দের প্রধান সোহাগিনী হবেন। জন্ম জন্ম গোবিন্দ আপনাকে নিয়ে বিহার করবেন। ব্রহ্মান্ড দানের ফল পায় এই ব্রতে। জগতে আপনার যশ হবে। 
এ ব্রত করেছিলেন পুলোমাদৈত্যের কন্যা পৌলোমী(শচী)। তাই তিনি ইন্দ্রের সোহাগী, ইন্দ্রের ইন্দ্রাণী। 
পর্বতের কন্যাও পূর্বে এই ব্রত করে শিবের অর্ধাঙ্গ পেয়ে মহেশ্বরী হলেন। 
আর একজন এ ব্রত করেন, তিনি হলেন স্বাহা দেবী-অগ্নির গৃহিনী। যার ফলে তিনি অগ্নির সোহাগিনী। 

সব শুনে সত্যভামা নারদ মুনির চরণ ধরে বলেন –প্রভু, আমাকেও এখনি এই ব্রত করান। 

নারদ বলেন –তবে কৃষ্ণের অনুমতি নিন। যদিও শ্রীকৃষ্ণ কেবল আপনার স্বামী নন। আপনি যানেন না দেবী এ ব্রতের বিধান খুব কঠিন। বৃক্ষে বেঁধে স্বামীকে দান করতে হবে। এতে কি অন্য স্ত্রীরা মত দেবেন! 

সত্যভামা বলেন –এমন কেন বলছেন, মুনিবর! আমার বিরোধিতা করে, কোন সতিনীর এত সাহস! আমি গোবিন্দকে দান করব। যা বিধি আছে সব পালন করব। কৃষ্ণকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করব, এতে কোন সংশয় নেই। 

নারদ বলেন –তবে আর বিলম্ব করে কি কাজ! শীঘ্রই চলুন ব্রত আরম্ভ করুন। এক লক্ষ ধেনু(গরু) ও লক্ষ পৌটি ধান্য চাই। দক্ষিণা হিসাবে স্বর্ণ দিতে হবে লক্ষ কোটি। ষোড়শ বিধানে বসনভূষণ দান করতে হবে, অশ্ব-রথ-গজ-বৃষ যত রত্ন যানে। 

নারদের বাক্য মত সব আয়োজন করা হল। শুভদিন দেখে ব্রত আরম্ভ হল। 
সতী সত্যভামা গোবিন্দকে একান্তে ডেকে সকল সমাচার দিলেন। হেসে কৃষ্ণ সতীকে সম্মতি জানান। 
পৃথিবীর সকল মুনি ও ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ করা হল। বিধি মত ব্রতের সজ্জা সাজান হল। নারস মুনি ব্রতের পুরোহিত হয়ে বসলেন। পারিজাত বৃক্ষে হৃষীকেশ কৃষ্ণকে বেঁধে সত্যভামা বসলেন হাতে তিল কুশ নিয়ে। 
রুক্মিণী প্রমুখ ষোল সহস্র রমণী সকলে অভিমানে নিরবে কাঁদতে থাকেন। 
সত্যভামা সকলকে সাক্ষী রেখে জগন্নাথকে ব্রতের কারণে দান করলেন। 


“স্বস্তি” বলে নারদমুনিও হাতে হাত দিলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীদাস কহেন সদা শুনেন পূণ্যবান। 
..................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers