Blog Archive

Friday, August 7, 2009

আমার লেজ ব্যাঁকা বুলবুলি

অনেকদিন পর আবার বুলবুলি!

সে অনেকদিন আগের কথা...তখন থাকতাম জলপাইগুড়ি......আমাদের একতলা বাড়ির সামনে-পিছনে অনেক জায়গা ছিল......নারকেল, সুপারী, পেয়ারা, আম, জাম, লিচু, জলপাই, কলা, পেঁপে, সাদা চন্দন, নিম, গাবগাছ যেমন ছিল। তেমনি ছিল, জবা, স্থলপদ্ম, গন্ধরাজ, গোলাপ, শিউলি, ধুতরা, কফি, দারচিনি, ছোট এলাচ, গোলমরিচ গাছ।

এ সবই আমার বাবা-দাদুদের সখ, বাবা মানে পাপার সখ বিশেষ করে......বাড়ির বেশি বয়স ছিল না...মাত্র ১৫-১৬ বছর...আমি থাকি ১২বছর...গাছগুলিও পরে লাগান......ফলে সব ছেরে যখন আসছি তখন তারা বড় হচ্ছে......আমার প্রিয় নিমগাছ, এখন নিশ্চয়ই বৃক্ষ.........পাপার প্রিয় ছিল সাদা চন্দন গাছ।

এক রবার গাছটা কলকাতায় এসে টিকেছে...কিন্তু বড় বড় কৃষ্ণচূড়ার সাথে
এখনো লড়াইয়ে পেরে উঠছে না...তাই একদম বাড় নেই।

জলপাইগুড়িতে যে সাজান বাগান ছিল, তা নয়, গাছগুলোও আমার মতই আপন খেয়ালে বারত।
এত গাছ বলে পাখির আনাগোনা খুব ছিল।

ওখানের স্মৃতিতেই প্রথমেই আসে বড় বড় দাঁড়কাক......সকালে বাড়িতে বাসি রুটি কাকদের দেওয়ার চল আছে।

বড় বড় দাঁড়কাক তাদের ছানাদের নিয়ে আসত। সে একটা দেখার জিনিষ! ছানারা অধিকাংশ বাবা-মার মত কিন্তু মাঝে মাঝেই ব্রাউন ব্রাউন মার চেয়ে সাইজে বড় ছানাও আস্ত! সেগুলি চিলের ছানা। কিন্তু মা কাক পরম মমতায় তাকেও খাওয়াত। কাক অত বোকা নয়, সে কি বুঝত না এটা তার ছানা নয়! তবু দেখেছি মা কাক তার চিল-ছানার জন্য অন্য কাকের সঙ্গে লড়ছে।


জলপাইগুড়িতে বর্ষা ছিল মজার। তখন স্কুলে পড়ি, খুব বৃষ্টি হলে স্কুল ছুটি, কিন্তু ওখানে রাতে দেদার বৃষ্টি হত, দিনে আকাশ পরিষ্কার। তখন ঘুম থেকে উঠেই ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ মনে মনে গাইতাম। তবু বৃষ্টি হত না। রিক্সা আসত, মুখ ব্যাজার করে স্কুল যেতাম। স্কুলে বন্ধুদের পেয়ে আনন্দ হত, পড়া ধরলেই আবার মুড খারাপ হত।

একবার এরকম বর্ষায় পরীক্ষা শুরু হবে। সারা বছর অনেকের মতই বিনদাস থাকতাম। পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়া চলছে। ভোরে কাজের ছেলেটা এসে বলল, পিছনে পেয়ারা গাছে একটা পাখির বাসা ছিল, সেটা পরে গেছে। তার ক’দিন আগে একটা বিড়ালছানা নিয়ে একটু অশান্তি হয়ে গেছে, নাক-কান মুলেছি এসব আর না, মন দিয়ে পড়ে মানুষ হব। ওকেই বল্লাম, তুই যা পারিস কর। দুপুরে বেরনো ছিল। সন্ধেবেলা ফিরে কি মনে হল, খবর নিলাম। বলল বাসাটা গাছে তুলে দিয়েছে।

পরদিন ভোরে এমনি পেছনের বাগানে গেলাম। পিছনের জমি নিচু, জল জমে। রুটি দেওয়ার সময়ও লক্ষ করলাম পেয়ারা গাছের দিকে কোন পাখিকে দেখছি না। মনটা খচ্‌-খচ্‌ করছে। শেষে পাপা অফিস বেরলে ছেলেটাকে নিয়ে দেখতে গেলাম। বাচ্চা ছেলে, বাসাটাতে প্লাস্টিক দিয়েছিল। জল ভরে গেছে। ৩টে বাচ্চার মধ্যে একটি মারা গেছে, ২টির তখনও প্রাণ আছে।

২টিকে নিয়ে ঘরে এলাম। বাচ্চা দুটির চোখও ফোটেনি। পাখির ছানার যতক্ষণ পালক না হয় দেখতে ভাল লাগেনা, কেমন একট্টূখানি লাল মাংস। বাপ্পা মাটি খুঁড়ে অনেক কেঁচো তুলে দিল।

এদিকে দু’দিন পর থেকে পরীক্ষা। পাপা বাড়ি ফিরে খুব বকা-বকি শুরু করল। আর এত্ত ছোট্ট পাখি হাতে বেশিক্ষন নিলে নোনা লেগেও মারা যেতে পারে। শেষে এক বুদ্ধি বার করলাম।

পরদিন পাখিদের রুটি দেওয়ার সময় একটা মোড়ায় ছোট্ট ঝুরিতে ছানা দুটিকে একটা গাছের নিচে রাখলাম। কাকেরা যাতে না ঠোঁকরায় সেটাও লক্ষ রাখছি। ছানা দুটো...চিঁ-চিঁ করছে!

কিছু পরেই দুটো বুলবুলি কিচিমিচি করে তাদের কাছে ঘুর ঘুর শুরু করল। এদিকে মানুষ দেখেই পালায়! বাড়িতে ভুলো আছে। সে বাগানে ঘুরবে! কি করি! বাপ্পা-আমি বুদ্ধি বার করলাম।
মা-বাবা যখন খাবার খোঁজে যাচ্ছে তখন মোড়াটা একটু একটু সরিয়ে আমাদের সিড়ির নিচে আনলাম। অন্ধকার হতে ঝুরিটা সিড়ির নিচে টাঙিয়ে দিলাম। যায়গাটা মাদুর দিয়ে ঘেরা হল -ভুলোর জন্য। তিনি বাড়ির আনাচে-কানাচের খবর রাখেন আর সবাইকে খুব বকেন!

পরেরদিন থেকে ভোর ৩-৪টে নাগাদ বাচ্চাগুলোকে ওখানে রেখে আসতাম। সারাদিন বাবা-মা খাওয়াতো, সন্ধেবেলা তুলে আনতাম।

এর মধ্যে একদিন যেটার স্বাস্থ্য ভাল সেটা ছট–ফট করছে, ধরতে গিয়ে হাত কাটল। শেষ পরীক্ষার আগের দিন সেটা আমারই সামনে বাবা-মার সাথে উড়ে চলে গেল। আমি আড়াল থেকে দেখলাম। বাবা-মা অন্যটাকেও ডেকে ডেকে ওড়াতে চাইল। কিন্তু সেটা ছিল দুর্বল। উড়তে গিয়ে পরে যাচ্ছিল। শেষ পরীক্ষার দিন দেখলাম বাবা-মা একবারও এলো না! বাচ্চাটা খিদেতে কাঁদলো।

আমারও ভাল হল। পরীক্ষা শেষ! সারাদিন ওকে নিয়েই পরে রইলাম।
এবার থেকে আমিই হলাম বুলবুলির বাবা-মা। তার তখন গায়ে হালকা পালক বেরচ্ছে, সারাদিন খিদে। আমি মাথায় পাপার কালো-নরম মান্নাদের মত টুপি পরে থাকি। আর ও তাতে বসে থাকে। সারাদিন বসে থাকে মাথার উপর আর খিদেতে চেচাঁয়। আমার তখন পাগল পাগল অবস্থা! দিনরাত ফড়িং খুঁজি। কোনদিন ফড়িং ধরিনি। সেই আমি ফড়িং ধরে ধরে খাওয়াচ্ছি! দিনে ৩০টা পর্যন্ত খেয়েছে। আমি ৩-৪টের বেশি ধরতে পারতাম না। কাজের বাচ্চা ছেলেটা লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ধরত। বাপ্পা কেঁচোও ধরে দিত। পাপার সাইটে সিকিউরিটিদেরও বলে রাখতাম। এতো করেও সে বুলবুলির পেট ভরাতে পারি না! দু’দিন চানও করতে পারিনি। খুব ভোরে বাতরুম যেতাম।

শেষে একদিন ঘরে ওকে রেখে চান করতে গেছি, জানলাটা খোলা ছিল আর ও তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। ঘর বাইরে থেকে ভেজিয়ে গেছি। বেরিয়ে এসে দেখি কি! সেই মা বুলবুলটা মুখে করে খাওয়ার নিয়ে এসেছে কিন্তু ঝুড়িতে ফুটো ছোট হওয়ায় খাওয়ার অসুবিধা হচ্ছে। বাপ্পা তখন একটা খোঁড়া শালিকের খাঁচা ছিল, সেটাকে ঠিক-ঠাক করে বারান্দায় বসিয়ে দিল। ওর মাও এসে এসে খাওয়াতে লাগলো-আমারওই ভাল হল! দরজা খোলা, খাট থেকেই গল্পের বই পড়তে পড়তে দেখছি মা আর মেয়েকে।

বিকেলে মাথায় নিয়ে বাগানে ঘুরতাম আর শিষ দিতাম। বাবা-মা এসে মাথার কাছে ঘুরত। ছানাকে ওড়ার জন্য ওস্কাত। বাচ্চাটা প্রথম প্রথম বুঝত না। এদিকে একদিন পাপা শুনে এলো পাহাড়ী বুলবুল পোষা মানা, আর ওরা ভুট্টাও খায়। ভুট্টা এলো, ছোলা এলো, মুনিয়া পাখির লাঠিয়া নাকি! এই ছোট ছোট তাও এলো। সব গুঁড়ো করেও খাওয়াছি। আর ভাবছি।

বুলবুলিকে আমগাছের নিচু ডালে বসিয়ে এলে ও ঠিক উড়ে এসে আমার মাথায় বসত। ভোরে ওকে বাইরে বসিয়ে শিষ দিলেই মা-বাবা-ভাই সব চলে আসত। কি সুন্দর ছোট ছোট ফল মুখে করে এনে খাওয়াত। একটা পরে গেলে তুলে খেয়ে দেখেছি-কেমন কষা আর মিষ্টি মিষ্টি মত।

শেষে বুলবুলি বেশ বুঝল ও পাখি। তখন স্বাস্থ্যটাও ভাল হয়েছে। পুরপুরি আমার কাছে ও ২১দিন ছিল। শেষের দিকে সন্ধ্যেবেলা ঘরে তুললে ও কেমন খুনখুন করে কাঁদত। বেশ বুঝতাম ওর কষ্ট হচ্ছে। ও কাঁদছে। ঠিক করলাম ছেরে দেব। প্রতিদিন ওকে অল্প অল্প ওড়ার অভ্যেস করাতাম। যদি ও একটু উল্টো-পাল্টা উড়ত, তো আমার প্রাণও উড়ে যেত।

শেষের আগের দিন উড়ে পাশের বাড়ি ডোবায় একটা কুল গাছের ঝোঁপে আটকে গেল। ওর বাবা-মা ওকে যে দিকে উড়তে বলে তার উল্টো দিকে গিয়ে এই অবস্থা! আমি পড়ি-মড়ি করে পাশের বাড়ি ছুটলাম। কিছুতেই ওর কাছে যাওয়া যাচ্ছে না! পাক মত হয়ে আছে! ঢুকে যাছি! একেক্কার অবস্থা! শেষে বাপ্পা পাঁচিল টপকে সেই পাঁকের মধ্যে দাঁড়িয়ে, লম্বা বাঁশের সাহায্যে, অন্ধকার হতে ওকে কুলগাছ থেকে নামিয়ে আনল।

সেদিন কি কান্না বুলবুলির! রাতটা ছিল আজকের মতই পূর্ণিমার- বড় গোল চাঁদ উঠেছে। কাজের মাসি আর ছেলেটা বারান্দায় শুয়েছিল। আমিও ঘরের মাটিতে মাদুর পেতে শুলাম। চাঁদ দেখতে দেখতে ঠিক করলাম –এবার বুলবুলিকে ছাড়তেই হবে। বাড়িতে সবাই তখন বলছে ও উড়তে পারে না, উল্টো-পাল্ট যায়। ডানা দুর্বল! ওকে যেন আর না ছাড়ি। কিন্তু আমি যানতাম ও আকাশে উড়তে চায়।

পরেরদিন ভোরবেলায় আমগাছের নিচু ডালে বসিয়ে শিষ দিলাম। বাবা-মা এলো, খাওয়াতে লাগলো। আমি বাতরুমে চলে গেলাম। এসে দেখলাম ও ডালে নেই- বুলবুলি আমার উড়ে গেছে! দৌড়ে এসে ছেলেটাকে ডাকলাম। অনেক দৌড়াদৌড়ি করলাম। তখন সবে সূর্য উঠছে। শেষে ৮টার সময় ছেলেটা এসে বললো অন্যপাশের বাড়ির কাঁঠালগাছের অনেক উঁচুতে চারজনে বসে আছে।

সেদিন ছিল রবিবার। মনটা আনন্দে ভরপুর - বুলবুলি স্বাধীন। তবু কোথায় যেন ভেতরটা কেঁদে কেঁদে উঠছে! শেষে গানের স্কুলে চলে গেলাম।

সে দিন রাতেও বৃষ্টি হল। কত চিন্তা! বুলবুলি এতদিন জলে ভেজেনি - কি হবে?

ওমা! পরেরদিন পাউরুটি দিয়ে শিষ দিতেই চারজনে হাজির। তারপর কত বসন্ত চলে যাচ্ছে! এখনো নিশ্চয়ই সে বুলবুলি আকাশে উড়ে বেরায়। আজও ওকে দেখে আমি চিনবো। লাল ঝুড়িতে থাকতে থাকতে লেজ বেড়ে যায় কিন্তু ঝুড়ি ছোট –শেষে লেজের পালকগুলো ছোট-বড় হয়ে যায়। আমার লেজ ব্যাঁকা বুলবুলি আজও আকাশে ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায়। আমি চোখ বুজে দেখতে পাই।

আশ্চর্য! বুলবুলি উড়ে যাওয়ার ক’দিন পরেই বাপ্পার সাদা খরগোসের চারটে বাচ্চা হয়। সে আরেক গল্প!

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers