Blog Archive

Wednesday, June 16, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৫


অমৃতের নিমিত্ত সুরাসুরের যুদ্ধ ও শ্রীকৃষ্ণের মোহিনীরূপ ধারণ:

মুনিরা বলে -শোন সুতের নন্দন, শুনলাম যে কথা সে অদ্ভূত কথন! অমর, অসুর মিলে সমুদ্রমন্থন করল। দেবতারা সব রত্ন নিল। রত্নের ভাগ কিছু কি অসুররা পেল?

সৌতি বললেন -দৈত্যেরা একত্র হয়ে দেবতাদের কাছ থেকে অমৃত-ভান্ড কেড়ে নিল। সকলে শ্রম দিয়ে সমুদ্রমন্থন করল। যা কিছু উঠল তা নিল দেবতারা। ঐরাবত, উচ্চৈঃশ্রবা, লক্ষ্মী, কৌস্তভমনি – সবই দেবতারা নিল। এতকিছু বলে দৈত্যরা সুধাভান্ড কেড়ে নেয়। ফলে দেবতা ও দৈত্যদের মধ্যে কলহ শুরু হল।

তখন শিব তাদের ডেকে বললেন সকলের অর্জিত সুধা সকলে সমান করে নাও। এভাবে কলহ মিটল।

কিন্তু কে সুধা বন্টন করে দেবে!

সেই সময় নারায়ণ নারী বেশে সেখানে উপস্থিত হলেন।

তাঁর রূপে চতুর্দিক আলোকিত হয়ে উঠল। তাঁর চরণের নূপুর সোনায় রচিত, পদ্ম দিয়ে যেন তাঁর চরণ গঠিত এবং তাঁর গতিও অতি মনোহর।

এই চরণ থেকেই জন্মালেন গঙ্গা-ভাগীরথী।

তাঁর অঙ্গের সৌরভে মৌমাছিরা অলি ত্যাগ করে তাঁর দিকে মধুগন্ধে ছুটে এল। দুই উরু তাঁর কদলীবৃক্ষের ন্যায় সুপুষ্ট ও সুন্দর। কটি তাঁর ক্ষীণ, তা দেখে মৃগনাথও দুঃখ পাবেন। অপূর্ব সুন্দর তাঁর পদ্মসদৃশ নাভি। বক্ষ দুটি তাঁর দাড়িম্বের ন্যায়। হাত দুটি যেন পদ্মের নাল!

তাঁর রূপ দেখে সুরাসুর মুর্চ্ছাপ্রায়। দেবীর অঙ্গুলী যেন চাঁপাফুলের মত। নখবৃন্তে চাঁদের প্রভা। কোটিকাম যেন তাঁর শরীরে অবস্থান করেছে।
ঠোঁট দুটি অরুণের মত রক্তাভ। তাঁর নাসিকার কাছে শুকচঞ্চুও লজ্জা পাবে। চোখ দুটি যেন নীলপদ্ম দিয়ে গঠিত। ভ্রু দুটি কামদেবের ধনুর মত। কপোল দুটি প্রাত দিননাথের মত গোলাপি।

হলুদবস্ত্র পরিধান করে তিনি স্থির বিদ্যুতের মত হাসচ্ছেন। দন্তপাটি মুক্তার গাঁথনির মত উজ্জল। পিঠে তাঁর লম্বা বেনী দুলছে। তাঁর দৃষ্টিতে সর্বদা কামাগ্নি জ্বলছে।

সুরাসুর সকলেই তাঁর দিকে ঢলে পরল। তাঁর রূপে মোহিত হয়ে সকলে মূর্চ্ছাগত।

শূলপানিও বহুক্ষণ অচেতন রইলেন। মোহিনীর প্রতি তিনি একদৃষ্টে চান এবং দুই হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে পেতে চান।

মোহিনী কন্যা বলেন -যোগী, এ তোমার কেমন প্রকৃতি! বৃদ্ধ বয়সের ছন্নমতি!

এই বলে নারায়ণ এগিয়ে চলেন, শিবও তাঁর পিছে পিছে চলেন।

হর বলেন -হরিণাক্ষি মুহুর্তের জন্য একটু দাড়িয়ে আমার সাথে কথা কহ। কে তুমি! কার কন্যা! কিসের কারণে তোমার আগমণ! সত্য করে কহ।
ত্রিভূবনের যত রূপবতী আছেন, সকলে তোমার কাছে পায়ের নখের তুল্য। দূর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, শচী, অরুন্ধতী, উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, রতি, নাগিনী, মানুষী, দেবী সকল ত্রৈলোক্যবাসিনী। সকলে আমায় চেনে, আমিও চিনি। ব্রহ্মান্ডে কোথায় তুমি ছিলে! কখনো তো তোমায় দেখিনি! কোথা থেকে এলে সত্য করে কহ, হে শশিমুখী।

কন্যা বলে -বুড়া তোমার লজ্জা নেই! আমার পরিচয়ে তোমার কি কাজ? মাথায় তোমার তেলহীন জটা, ছাই। দাঁত না মেজে তা স্ফটিকাকার। দেহের পরিধান বাঘের ছাল! বড় বড় হাতের নখ, পাকা দাড়ি-গোঁফ! গায়ের গন্ধে মুখে বমন আসে।

দেখ আমার অঙ্গের সৌরভে ব্রহ্মান্ড পূর্ণ। আমার অঙ্গের ছটায় ত্রিভূবন দীপ্ত। কোন লজ্জায় তুমি আমায় প্রার্থনা কর! কি সাহসে তুমি আমার কাছে আসো?
.....................

মোহিনীর সহিত হরের মিলন:

হর নানা ভাবে মোহিনীকে তুষ্ট করতে চান।
তিনি বলেন -ত্রিভূবনের সকলের ঈশ্বর আমি। ব্রহ্মার পঞ্চমশির নখেতে ছেদন করে বহুকাল সেবা করে বিষ্ণু অভয় পেলেন। ইন্দ্র, যম, বরুণ, কুবের, অগ্নি সকলে আমার আরাধনা করেন। জ্ঞান যোগে আমি মৃত্যুকে জয় করেছি। কামদেব আমার নয়নানলে ভস্ম হন। মহামায়া অর্থাৎ দূর্গা, গঙ্গা আমায় দাসীভাবে সেবা করেন। আমায় যে মন দিয়ে ভজনা করে সে মনের মত বর লাভ করে। তুমিও তোমার মান ভঙ্গ করে আমার ভজনা কর। তোমারও অভিলাষ সিদ্ধ হবে।

মোহিনী বলেন –যোগী তোমায় আমি এতক্ষণে চিনলাম। তোমাকে সকলে মহেশ অর্থাৎ মহান ঈশ্বর বলে। কিন্তু তোমার জপ-তপ-যোগ-জ্ঞান সব ব্যর্থ। তুমি ব্যর্থ যোগী, ভন্ডামী করে লোকে বলে তোমায় বৈরাগী। কামিনী দেখে তুমি এত বিহ্বল হলে! কোন মুখে তুমি বল যে কামদেবকে তুমি ভস্ম করেছ!

হর বলেন -মনহরা, এখন তোমায় দেখে আমার জ্ঞান হয়েছে। আমি এক কামকে নয়নে ভস্ম করেছিলাম, এখন সহস্র কাম আমার দেহ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তপ, জপ, যোগ, জ্ঞান, জ্ঞানের বৈরাগ্য এই সকল কর্ম যদি হয় সর্বশ্রেষ্ঠ তবে তুমি আমায় আলিঙ্গন করে আমায় হরষিত কর। যত আমি জপ, তপ করেছিলাম শ্মশানে বসে তার সমুচিত ফল আজ মিলল বিধাতা তোমাকে পাঠিয়ে সর্ব কর্ম আজ আমি তোমার পায়ে সমর্পন করলাম। কৃপা করে তুমি আমায় আলিঙ্গন কর।

হরের বাক্য শুনে হাসেন হয়গ্রীব।
তিনি বলেন –অপ্রাপ্য দ্রব্য কেন তুমি চাও! সর্ব কর্ম যে ত্যাগ করতে পারে, অন্যমনা না হয়ে যে আমার প্রতি একমনা হয়, তাকে আমি যেচে আলিঙ্গন করি।

শিব বলেন –কন্যা, আমি এই সত্য অঙ্গীকার করছি, আজ হতে তোমা বিনা আর কিছু আমার নেই। আজ আমি সর্ব কর্ম ত্যাগ করলাম। স্ত্রী-পুত্রকেও আমি ছারলাম। তোমার চরণ আমি সেবা করব। এবার তুমি আমায় আলিঙ্গন কর।

হরি তখন বলেন –তুমি আমায় ছলনা করছ। কেমন করে তুমি তোমার স্ত্রী-পুত্র ত্যাগ করবে! এক স্ত্রীকে তুমি জটায় রেখেছ। অন্য স্ত্রীকে অর্ধেক দেহ দিয়েছ।

হর বলেন –হরিণাক্ষি, কেন ছলনা কর। কপটতা ত্যাগ করে আমায় অনুগ্রহ কর। কি ছার সেই নারী পুত্রের নাম কর! শত গঙ্গা ও দূর্গা তোমায় দাসীরূপে সেবা করবে। আমি নিজে তোমায় তোমার দাস হয়ে সেবা করব। এবার তুমি আমার আশা পূরণ কর। আর যদি তুমি তা না কর, তবে আমি এখনই নিজ়েকে বধ করব। আমার দিকে একবার চাও, চারু মুখে! না হলে আমি ত্রিশূল দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করব। এই বলে তিনি ত্রিশূল হাতে তুলে নিলেন।

হরি এবার হেসে উঠলেন।
বললেন –তোমার এত জ্ঞান! আর তুমি কিনা কামের বশ হয়ে প্রাণ ত্যাগ করতে চাও! ধৈর্য্য ধর, দুঃখ ত্যাগ কর, স্থির হও। আমি তোমায় আলিঙ্গন করব। বিশ্বনাথ তুমি আমার হৃদয় চেন না। যে ভক্ত আমায় ডাকে, তাকে আমি অভয় দিই। যে ভক্ত যে ভাবে আমায় কাছে চায়, আমি তার কাছে সে ভাবেই ধরা দিই। তুমি আমায় পূর্ব হতেই চাইছ, তাই আমি তোমায় আমার অর্ধ অঙ্গ দেব।

এই বলে জগন্নাথ দুই হাত বাড়িয়ে হরকে আহ্বান করলেন।
আলিঙ্গনের ফলে দুই দেহ এক হল।
অর্ধ অঙ্গ জটাযুক্ত, ফণাধর, শশিকলাযুক্ত, হাড়মালা পরিহিত, নীলকন্ঠ, বাঘাম্বর, ভস্ম আবৃত।
আর অর্ধেক অঙ্গ হল কস্তুরীগন্ধ যুক্ত, কুঞ্চিত কেশ বিশিষ্ট, মুকুট পরিহিত, কস্তুরী তিলক যুক্ত, বনমালা শোভিত, কর্ণ বালাযুক্ত, কটি হলুদবাস পরিহিত।
এক পায়ে সাপ, অন্য পায়ে নূপুর।
এক হাতে শঙ্খ-চক্র, অন্য হাতে ত্রিশূল-ডম্বুর।
একদিকে দূর্গা, অন্যদিকে লক্ষ্মী।

হরিহর মূর্তি
.....................
পাদটীকাঃ
হয়গ্রীব - অশ্বের মত সুন্দর গ্রীবা বা ঘাড় যার
মৃগনাথ - হরিণ

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers