Blog Archive

Monday, July 14, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬০

 
ধৃতরাষ্ট্রের প্ররোচনায় পান্ডবদিগের বারণাবতে গমনঃ 

জন্মেজয় মুনিকে অনুরোধ করেন তারপর কি ঘটনা ঘটল বর্ণনা করে তার মনের আঁধার ঘুচান। মুনি তখন ভারতের অপূর্ব ঘটনার বর্ণনা শুরু করলেন।

যুধিষ্ঠির রাজা হবেন এ আলোচনায় প্রজারা সুখী হলো। ধর্মশীল যুধিষ্ঠির দয়ার সাগর –রাজা, প্রজা, ধনী, দরিদ্র সকলে তাকে পুত্রের মত স্নেহ করে। যুধিষ্ঠির রাজা হলে সবাই সুখে থাকবে, তিনিও সকলকে সন্মান করবেন। ভীষ্ম রাজা হননি সত্য রক্ষার জন্য। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হওয়ায় রাজা হতে পারেন নি, তাই পূর্বে পান্ডু রাজা হন। তারপর তার যোগ্য পুত্র সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয়, সুবুদ্ধি যুধিষ্ঠির রাজা হবেন এই যথার্থ। তাই প্রজারাও সকলে ঠিক করল যুধিষ্ঠির যাতে দ্রুত সিংহাসন গ্রহণ করেন তার জন্য আবেদন যানাবে। 

নগরে, হাটে, বাজারে সারাদিন এই নিয়ে প্রজারা আলোচনা করছে-এ সংবাদে দুর্যোধন মনে বড় ব্যথা পেলেন। বিরস বদনে তিনি পিতার কাছে গেলেন। দেখলেন পিতা একা বসে আছেন। সকরুন স্বরে দুর্যোধন পিতাকে সাবধান করে দিলেন যে প্রজারা তাকে আর রাজা হিসাবে চায় না। নগরে অদ্ভূত রব উঠেছে সকলে যুধিষ্ঠিরকে রাজা রূপে চায়, ধৃতরাষ্ট্রকে অনাদর করে। তারা বলে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ সে রাজার যোগ্য নয়। কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির প্রকৃত রাজার পুত্র – সেই সিংহাসনে বসার যোগ্য। প্রজাদের কথা মত যদি রাজপুত্র যুধিষ্ঠির রাজা হন, তবে তার পুত্রই তারপরে রাজা হবে। তখন কৌরবদের প্রজারা আর মান্য করবে না। একথা স্মরণ করে দুর্যোধন নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকেন। তিনি তার ধর্ম, আত্মা, শিক্ষা, দেহ এমনকি সকল কর্মকেও ধিক্কার দেন। শেষে বলেন এই ব্যর্থ জীবনের তিনি আর প্রয়োজন দেখছেন না, তাই তিনি আজই পিতার সামনে জীবন ত্যাগ করবেন। অকারণে যে জন্মায় সে তো পরভাগ্যজীবি। পৃথিবী তাকেও অকারণে এখনও ধারণ করে আছেন।

পুত্রের এই হাহাকার শুনে অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয়ে শেল বাজল। তিনি চিন্তিত হলেন। পুত্র স্নেহে অন্ধ রাজা মনে মনে ভাবেন- কি করব, কি বা হবে। 
সে সময় সেখানে মন্ত্রণা দিতে তার দুষ্ট মন্ত্রীরা আসে-দুঃশাসন, কর্ণ ও শকুনি দুর্মতি। তারা পরামর্শ করে অন্ধ রাজাকে বলে – পান্ডবদের ভয় তখনই দুর হবে যখন রাজা কোন উপায়ে তাদের রাজ্য থেকে বার করে দেবেন। 

কিছুক্ষণ চিন্তা করে অম্বিকাপুত্র ধৃতরাষ্ট্র বলেন কি করে পান্ডুর পুত্রদের তিনি বিতারিত করবেন। যখন পান্ডু এই পৃথিবীতে ছিলেন তখন তিনি সেবকের মতই ধৃতরাষ্ট্রকে পুজা করতেন। তিনি যেন নাম মাত্র রাজা, ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞা ছাড়া কিছু করতেন না। তার আজ্ঞাতেই পান্ডু চলতেন। ভাই হয়ে কেউ ভায়ের এত সেবা কখনও করবে না। আর পান্ডুর পুত্ররা যেন পিতারও উপরে। তারা সর্বক্ষণ ধৃতরাষ্ট্রের দিকেই তাকিয়ে। দেবতার মতই যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের সেবা করেন। কোন দোষে তাকে রাজ্য থেকে তিনি বার করবেন। যদি ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরের প্রতি অবিচার করেন তবে অবশ্যই তার ফলও ধৃতরাষ্ট্রকেই ভোগ করতে হবে-একথাও তিনি মন্ত্রীদের শুনিয়ে দিলেন। 
আরও বললেন –অহিংসকজনকে যে হিংসা করে অবশ্যই সে নিজেকে নরকে পতিত করে। সবাই জেনে রাখ হিংসার সমান পাপ আর কিছু নেই। তেমনি দয়া বিনা ধর্মও নেই এই তিন ভুবনে। তাছাড়া পান্ডবরা পাঁচ ভাইই সবদিক দিয়ে খুবই বলিষ্ঠ। তাদের অনুগতের সংখ্যাও অনেক। পিতৃ-পিতামহ তাদের সযত্নে পালন করছেন-তাদের বলপূর্বক বিতারণ অসম্ভব। 

এত শুনে দুর্যোধন বলেন পিতা যা প্রমাণ করলেন তা তিনি পূর্বেই জানতেন তাই তার ব্যবস্থাও তিনি ভেবে রেখেছেন। যত রথী-মহারথী আছে সকলকে কৌরবভাইরা বহু ধন দিয়ে বশ করবে। পিতার উচিত তার সকল দিক বিবেচনা করে কাজ করা। 
তারপর দুর্যোধন প্রস্তাব করলেন দেশের বাইরে বারণাবত নগর অতি অনুপম স্থান। সেখানে যুধিষ্ঠির তার ভাই ও মাকে নিয়ে চলে যাক। সে সময় সে নিজের রাজ্যের সকলকে সন্তুষ্ট করে নিজের বশে আনবে। তার পর না হয় যুধিষ্ঠির এখানে আসবে, অবশ্যই বহুদিন পর। 

ধৃতরাষ্ট্র সঙ্গে সঙ্গে বলেন দুর্যোধন যে কথা বলে তাই ধৃতরাষ্ট্রের মনের ইচ্ছা। কিন্তু লোকাচারের ভয়ে এই পাপকার্য তিনি প্রকাশ করতে পারছেন না। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, বিদুর-এরা সকলে ধর্মাচারি, এরা কিন্তু কখনই এ প্রস্তাবে সম্মত হবেন না। আর এই চারজন যদি স্বীকৃতি না দেন তাহলে যুধিষ্ঠিরদের অন্য স্থানে পাঠানও অসম্ভব। তিনি কার্যসিদ্ধির কোন উপায়ই দেখছেন না। 
এত শুনে পুনরায় দুর্যোধন বলেন, ভীষ্মের কাছে যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন সমান, ফলে ভীষ্মকে রাজি করান যাবে। কারণ এ প্রস্তাবে কোন পাপ নেই, অধর্মও নেই। 

গুরুপুত্র অশ্বত্থামা যেহেতু আমার অনুচর তাই দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যকে তার দ্বারাই সম্মত করান যাবে। যদিও বিদুর সর্বাংশে পান্ডবদের প্রতি সহানুভূতিশীল, তবু একা সে কিবা করতে পারে। 
দুর্যোধন আরো বলেন পিতা চিন্তা করে এর উপায় বার কর কারণ পান্ডবরা এখানে থাকলে আমার নিদ্রাও হয় না।
ধৃতরাষ্ট্র বলেন- যোর করে তাদের বিতারিত করলে চারদিকে অপযশ ছড়াবে। এমন উপায় বার কর মন্ত্রণা করে যাতে তারা আপনার ইচ্ছায় সেখানে যেতে চায়। 

এত শুনে তখনই দুর্যোধন বহু ধরনের রত্ন নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রীদের ঘরে ঘরে গেলেন। ক্রমে সকল মন্ত্রী তার বশ হল। দুর্যোধন তাদের মিথ্যা বুলি শিখিয়ে দিল। নগর বারণাবত অতি উত্তম একথা যেন দরবারে সকলে বারে বারে ঘোষণা করে। তার কথা মত সকলে বারণাবতের আলোচনাই করতে লাগল। 
দুর্যোধনের প্ররচনায় দরবারে সেই কথাই উঠল। কিছুদিন পরেই শিবরাত্রি চতুর্দশী আসছে, সে সময় বারণাবত নগর পূণ্যক্ষেত্রে পরিণত হয়। কেউবা বলে সেখানে শিব নিজে এসে এসময় বাস করেন। অন্য মন্ত্রী বলে তার মত সুন্দর নগর জগতে আর নেই। কেউবা বলে স্বর্গের কিন্নররা সেখানেই বাস করেন। সেখানে ভোরে সকল দেবতারা এসে নিত্য কর্ম করেন। এভাবে মন্ত্রীরা বারণাবতের অসংখ্য গুণ বর্ণনা করতে থাকল। 

এত শুনে যুধিষ্ঠির বলেন সেই পূণ্যক্ষেত্র বারণাবত নগর দেখতে তারও মনে খুব ইচ্ছে করছে। 
একথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন কিন্তু মুখে কপট দুঃখের ভান করে ভাল ভাল কথা বলতে লাগলেন। 
শেষে বললেন একান্ত যদি ইচ্ছাই হয় তবে পরিবারের সকলকে নিয়ে পূণ্যস্থান দর্শণে যেতে হয়। যুধিষ্ঠিরও তার মা ও ভাইদের নিয়ে সুখে কিছুদিন বারণাবত নগর ঘুরে আসুক। ধনরত্ন যত মনের ইচ্ছা যুধিষ্ঠির নিয়ে যান, বহুদিন থাকতে ইচ্ছা করলেও কোন অসুবিধা হবে না। এভাবে তিনি বারবার ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে সেখানে যেতে প্ররচনা দেন। 

যুধিষ্ঠিরও মনে মনে কিছু আশ্চর্য হলেন কারণ একবার কথায় কথায় তিনি যাওয়ার উৎসাহ দেখাতেই ধৃতরাষ্ট্র স্বপরিবার সেখানে তাকে জোর করেই পাঠাতে চান। তবু ধর্মের পুত্র সত্যবাদী যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের কোন আজ্ঞায়ই অমান্য করেন না তাই ধৃতরাষ্ট্রের চরণে নমস্কার করে বারণাবত যাবার অঙ্গীকার তিনি করলেন। বিজ্ঞ মন্ত্রীদেরও নমস্কার জানিয়ে তিনি মায়ের কাছে চললেন। 

তা দেখে দুর্যোধন মনে মনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে পুরোচন নামে তার অতি বিশ্বস্ত এক মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন। জাতিতে পুরোচন যবন ছিলেন। একান্তে ডেকে মৃদুস্বরে তারা পরামর্শ করতে লাগল। 
দুর্যোধন বললেন তোমাকে আমি সকলের চেয়ে বিশ্বাস করি, তোমার সমান কোন মন্ত্রী নেই তাও বিশ্বাস করি, তাই আজ তোমাকেই এক বিশেষ কাজে নিযুক্ত করছি যা আর কেউ জানে না এবং বিশ্বাস করব তুমিও একথা কাউকে প্রচার করবে না। 
পান্ডবরা বারণাবত নগরে যাচ্ছে তাদের পূর্বে তুমি সেখানে যাবে। খরচের সমস্ত সামগ্রি এখান থেকে নিয়ে যাবে। এখনই দ্রুত রথে আরোহণ করবে। সেখানে অতি দ্রুত গিয়ে একটি উত্তম স্থান দেখে গৃহ নির্মাণ করবে। অগ্নিগৃহ তোমায় নির্মাণ করতে হবে, কিন্তু তা যেন বোঝা না যায়। স্তম্ভ এমন ভাবে রচনা করবে যা ঘৃতে পূর্ণ থাকবে। তার উপর সোনার নানা কারুকার্য করে দেবে। মাঝে মাঝে ঘৃত পূর্ণ বাঁশ বসাবে, যেন আগুন লাগলে সহজে তা না নেভে। এমন ভাবে সম্পূর্ণ রচনা করবে যাতে কেউ লক্ষ না করে। মানুষের ভাল লাগে এমন সুন্দর সুন্দর চিত্র দিয়ে অন্দরসজ্জা করবে। জতুগৃহকে ঘিরে অস্ত্রঘরও তৈরি রাখবে। উপযুক্ত অস্ত্রসস্ত্র তাতে মজুত রাখবে। জতুগৃহ থেকে কোন ভাবে যদিওবা প্রাণ বাঁচে অস্ত্রগৃহের অস্ত্রে যেন প্রাণ হারায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। অস্ত্রগৃহের চারপাশে গভীর খাদ খুঁড়ে রাখবে যাতে বীর ভীমও লাফিয়ে পালাতে না পারে। সময় বুঝে জতুগৃহে আগুন দেবে। সব সময় তার পূর্বে তাদের সাথে থাকবে। 
এত বলে শীঘ্র তাকে বারণাবতের উদ্দেশ্যে গমন করতে নির্দেশ দিলেন। দ্রুত গিয়ে গৃহ নির্মাণ করতে হবে। তার আদেশ পেয়ে পুরোচনমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে রথে উঠে দ্রুত কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ঝড়ের বেগে মিলিয়ে গেল। দ্রুত পুরোচন বারণাবতে পৌছে রাতের অন্ধকারে দুর্যোধনের নির্দেশ মত গৃহ নির্মাণ করতে লাগল। 

এদিকে ভাই ও মাকে নিয়ে যুধিষ্ঠির সব বড়দের আশির্বাদ নিতে গেলেন। ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য সকলের আশির্বাদ নিলেন। গান্ধারীসহ সকল নারীদের কাছেও বিদায় নিলেন। একে একে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে পুরোহিত ব্রাহ্মণদেরও আশির্বাদ নিলেন। 
পান্ডবদের এই মিলন ও বিদায় গ্রহণ দেখে অনেকে ধৃতরাষ্ট্রের নিন্দাও করল। সকলে বলল দুষ্টবুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রের কুমতি হয়েছে, সে কারণে এমন অনৈতিক কাজ করলেন। দুষ্ট দুর্যোধনের সে কারণে সাহস হল সত্যবুদ্ধি ধর্মশীল পান্ডুপুত্রদের দেশের বার করে দেওয়ার। 
কেউবা বলল এই রাজ্যে আর থাকবে না, যেখানে যুধিষ্ঠির যাবেন তারাও সেখানেই তাকে অনুসরণ করবে। যে এই রাজ্যে বাস করবে সেই এ রাজ্যের রাজার মত হয়ে যাবে। কুরুকুলের মহাপাপী এই রাজা এর পাপেতেই সকলে মারা যাবে। 
তারা অবাক হয় যে ধৃতরাষ্ট্রের এই অন্যায় গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম মানলেন কি ভাবে। হয়ত তারা সকলেই এদের মত দুষ্ট চিন্তা করে কিন্তু আমরা এ অন্যায় সহ্য করব না। এই বলে ব্রাহ্মণরা যে যার সংসার-স্ত্রী-পুত্র নিয়ে যুধিষ্ঠিরদের অনুসরণ করল। 
বিদুর তাদের সাথে বহুদুর পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। তিনি ম্লেচ্ছ ভাষায় যুধুষ্ঠিরকে ভবিষ্যৎ বিপদ থেকে সাবধানে থাকার জন্য ইঙ্গিতও করলেন। বিদুর তাদের স্নেহালিঙ্গন করলেন। প্রত্যেকের শির চুম্বন করলেন। তার দুচোখ অশ্রুপূর্ণ হল। যুধিষ্ঠিররা পঞ্চভাই তাকে প্রণাম করলেন। শেষে বিদুর চিন্তান্বিত হয়ে নিজ গৃহে ফিরে গেলেন। যুধিষ্ঠির পঞ্চভাইরা বারণাবত যাত্রা করলেন। 

পুরোচক পঞ্চ পান্ডবদের নমস্কার জানাচ্ছে

তারা বারণাবতে প্রবেশ করতেই সেখানকার অধিবাসীরা তাদের আদর করে নিজ গৃহে নিয়ে গেল। সে সময় দুষ্ট পুরোচক সেখানে উপস্থিত হয়ে নমস্কার করে বিনয়ের সঙ্গে নিবেদন করল সে নিজে কেবল পঞ্চ পান্ডবদের জন্য অতি মনোহর প্রাসাদ তৈরী করিয়েছে সেখানে প্রভূরা পদার্পন করলে সে ধন্য হবে। তার নির্মিত প্রাসাদ যেন কুবেরের ভাস্কর্য, তার মত সুন্দর প্রাসাদ কেবল স্বর্গেই আছে, মর্তে কেউ কখনও এত সুন্দর প্রাসাদ দেখেনি। এত প্রশংসা শুনে পঞ্চ পান্ডব হৃষ্ট হলেন এবং মাতা কুন্তীকে নিয়ে সেখানে প্রবেশ করলেন। বিচিত্র সজ্জায় নির্মিত এই প্রাসাদ দেখে পান্ডবরা খুশি হলেন। 

যুধিষ্ঠির হঠাৎ সন্দেহের বশে ভীমকে ডেকে বললেন গৃহ ঠিক ভাবে পরীক্ষা করতে হবে, কারণ তার মন ঠিক এই ঘরকে বিশ্বাস করতে চাইছে না। বৃকোদর ভীম ঘরের আঘ্রাণ নিয়ে অবাক হয়ে জানালেন গৃহে ঘি, সর্ষের তেল ইত্যাদি ভষ্মের গন্ধে পূর্ণ। 
যুধিষ্ঠির বুঝলেন তাদের পুড়িয়ে মারার জন্যই এই প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছে। তারা আসার সময় লক্ষ্য করেছেন যে প্রচুর পরিমান দাহ্যবস্তু বারণাবতে আনা হচ্ছে। এখন যুধিষ্ঠির বুঝলেন বিদুর তখন যবন ভাষায় একথাই বলতে চেয়েছেন যে বিশ্বাস করে এ ঘরে থাকলে যখন অচেতনে তারা নিদ্রা যাবেন তখন পুরোচন আগুন লাগিয়ে তাদের হত্যা করবে। এসবই যে দুর্যোধনের বুদ্ধি তাতে তাদের সন্দেহ রইল না। 
ভীম বললেন – কি দরকার এই জতুগৃহে থাকার! চলো সকলে আবার হস্তিনাগরে ফিরে যাই। 
যুধিষ্ঠির বললেন – তা ঠিক হবে না। কারণ লোক মাধ্যমে দুর্যোধনরা জানতে পারবে, তখন সে সৈন্য সাজিয়ে যুদ্ধ করতে চাইবে। এখন তার হাতেই সব সৈন্যসামন্ত ও ধনরত্ন। 
যুধিষ্ঠির এখন নির্ধন ও নির্সৈন্য –তাই এভাবে যুদ্ধে হার অবসম্ভাবী। এ কারণে দুর্যোধনের সাথে বিবাদ করে এখন লাভ নেই। 
তিনি বলেন – তার চেয়ে আমরা সাবধানে এই গৃহেই বাস করব এবং সকল অভিসন্ধি যে আমরা জানি তা কাউকে বুঝতে দেব না। পাঁচভাই কখনই একস্থানে একত্রে অবস্থান করব না, সুযোগ পেলে অবশ্যই আমরা এখান থেকে পালাবো। বনে মৃগয়া করে আমরা থাকবো। এভাবে আমাদের পথ-ঘাট-বন-উপবন সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান হবে। 
এভাবে তারা যে সব জেনে গেছে তা গোপন করে খুব সতর্ক ভাবে বারণাবতে বাস করতে লাগলেন। 

 
বিদুর 

এদিকে হস্তিনানগরে বিদুর পঞ্চপান্ডবদের জন্য চিন্তিত হয়ে উঠলেন। তিনি অনেক ভেবেও পঞ্চপান্ডবরা জতুগৃহ থেকে কি ভাবে আত্মরক্ষা করবে তা ভেবে পেলেন না। তার অনুশোচনা হতে লাগল। 
শেষে অনেক বিচার বিবেচনা করে তিনি তার অতি বিশ্বস্থ এক সুরঙ্গ খনককে ডেকে পাঠালেন। বিদুর তাকে বিপদের সকল কথা বললেন এবং পঞ্চপান্ডবদের সুরঙ্গের মাধ্যমে জতুগৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার জন্য তার সাহায্য চাইলেন। 
খনক দ্রুত বারণাবতে গেল এবং যুধিষ্ঠিরের কাছে বিদুরের সকল কথা জানাল। শেষে এও জানাল সে বিদুরের কথা মত যুধিষ্ঠিরের কাছে যুধিষ্ঠিরের লোক না বলে ছদ্মবেশে এসেছে এবং যুধিষ্ঠির যাতে তাকে বিশ্বাস করেন সে কারণে বিদুর তাকে বিদায় কালে যে ম্লেচ্ছ ভাষায় গুঢ় কথা বলেছিলেন তাও জানায়। 
যুধিষ্ঠির সকল কথা শুনে নিশ্চিন্ত হলেন। বিদুর যখন খনককে সকল কথা জানিয়ে তাদের রক্ষা করতে পাঠিয়েছেন তখন এই খনকও যে তাদের কাছে বিদুরের মতই প্রণম্য তাও জানালেন। 
এরপর যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের দুষ্ট বুদ্ধির পরিচয় দিতে লাগলেন। বাঁশের জতুগৃহের উপর স্বর্ণের আবরণ, গৃহের চারদিকে অস্ত্রের ঘর, প্রাসাদের বাইরে গভীর খাদ-যা পান্ডবদের পলায়নে বাঁধা হয়ে আছে। অন্য দিকে পুরোচন নিজে চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে দ্বার পাহারা দিচ্ছে। 
শেষে যুধিষ্ঠির খনককে অনুরোধ করলেন এমন ভাবে তিনি তাদের ছয়জনকে উদ্ধার করুন যাতে এ বিষয়ে কেউ কিছু না যানতে পারে। 
সব দেখে শুনে খনক ঘরের ভিতর থেকেই গর্ত খুঁড়তে শুরু করল। সুরঙ্গের মুখে সুন্দর কপাট বসাল এবং তার উপর মাটি দিয়ে সমানও করে দিল, উপর থেকে আর কিছুই বোঝা গেল না। প্রাসাদের চতুরদিকে গভীর গর্ত ছিল খনক তার চেয়েও গভীর সুরঙ্গ খনন করতে লাগল। শেষে গঙ্গাতীর পর্যন্ত খনক খনি তৈরী করল। 
কার্য সম্পূর্ণ করে সে পান্ডবদের কাছে পথের নির্দেশ দিল। শুনে পঞ্চপান্ডব খুবই খুশি হলেন। তাদের প্রণাম করে খনক নিজের গৃহে ফিরে গেল। যাবার পূর্বে বিদুরের নির্দেশ মত এও জানিয়ে গেল যে চতুর্দশীর রাত্রে পুরোচন প্রাসাদে অগ্নি সংযোগ করবে, সে জন্য তাদের ছয়জনকে অতি সাবধানে থাকতে হবে। এত বলে খনক চলে গেল। এ সকল কথা কেবল পান্ডবরা ছয়জনে জানল। 


জতুগৃহ

পঞ্চপান্ডবরা মৃগয়া করে বেড়াতে লাগল। এভাবে এক বছর কেটে গেল। এদিকে তাদের দেখে পুরোচনের সম্পূর্ণ বিশ্বাস হল পান্ডবরা তাকে খুব বিশ্বাস করেছে। এতে সে খুব খুশিও হল। 
পুরোচনের মন বুঝে যুধিষ্ঠির ভাইদের ডেকে বললেন আমাদের আজ সাবধানে থাকতে হবে কারণ আজ রাতেই পুরোচন গৃহে আগুন দেবে। বিদুরের কথা তাদের মনে পড়ল। 
ভীম বললেন দিনে সাহস নেই তাই রাতে দুর্যোধন অসৎ পথে তাদের হত্যা করতে চায়, অবশ্যই তার ফল সে পাবে। 

সব শুনে কুন্তী চিন্তিত হলেন। বনে বনে কোথায় পালিয়ে বেড়াতে হবে ভেবে তিনি ভয় পেলেন। শেষে পুত্রদের বললেন আজ তিনি ভাল ভাবে ব্রাহ্মণ ভোজন করাতে চান। মাতার আজ্ঞায় পান্ডবরা ক্ষুধিত ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ করে আনলেন এবং বহু ধন দিলেন। কুন্তীও প্রাণ ভরে তাদের ভোজন করালেন। ব্রাহ্মণদের ভোজন হয়ে গেলে যত দুঃখী মানুষ আছে তাদের কুন্তীদেবী ভোজন করালেন। এদের মধ্যে এক নিষাদ গৃহিনী তার পাঁচ পুত্রকে নিয়ে উপস্থিত হল। পুত্রদের দেখে কুন্তী সেই নিষাদ গৃহিনীর কাছে তাদের দুঃখের কথা শুনলেন। তার দুঃখে কুন্তীদেবীও দুঃখিত হলেন। তাদের আশ্রয় নেই তাই সেখানেই তারা থেকে গেল। ধিরে ধিরে সূর্য অস্ত গেল এবং যথা সময় সকলে শয়ন করতে গেল।
....................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers