Blog Archive

Monday, September 14, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০৪

[পূর্বকথা - পারিজাত হরণের কথা...নারদ পারিজাতপুষ্প কৃষ্ণকে দিলে তিনি তা স্ত্রী রুক্মিণীকে পরিয়ে দেন... সে কথা শুনে সত্যভামার অভিমান হয়...তিনি আহার নিদ্রা ত্যাগ করেন, কৃষ্ণ এসে তার মানভঞ্জন করেন এবং পারিজাত বৃক্ষ উপহারের আঙ্গিকার করেন...শ্রীকৃষ্ণের সাথে ইন্দ্রের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ শুরু হয়...মহাদেবের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণ ইন্দ্রকে সম্মান দেখালে ইন্দ্র পারিজাত কৃষ্ণকে দান করেন ...কিন্তু শচীর হাসি সত্যভামাকে ক্রোধী করে...কৃষ্ণ পুনরায় ইন্দ্রের সাথে যুদ্ধ করতে চান... গড়ুরের ইন্দ্রকে সত্যভামার কাছে নিয়ে আসেন... ইন্দ্রের স্তবে সত্যভামা খুশি হন...কৃষ্ণকে নিজের করে পাওয়ার জন্য নারদ মুনির কথা মত সত্যভামা ব্রত পালন করেন...] 

শ্রীকৃষ্ণকে দান পাইয়া নারদের গমনঃ



দান পেয়ে নারদমুনি উর্দ্ধবাহু নাচতে থাকেন। যত দান পেলেন সব ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। কৃষ্ণকে দান পেয়ে তিনি আনন্দের 
আপ্লুত। নারদ দ্বারকানাথ কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। একথা শুনে দ্বারকাবাসী নরনারী ধেয়ে আসে। 

পারিজাত বৃক্ষ থেকে কৃষ্ণকে মুক্ত করে নারদ বলেন –হে গোবিন্দ, আপনার বর্তমান আভরণ ত্যাগ করুন। এই রাজ বেশের আর কি কাজ। এখন তপস্বী হয়ে তপস্বীর সাজ ধারণ করুন। কিরীট ফেলে মাথায় পিঙ্গল জটা ধারণ করুন। কনক পইতে ফেলে যোগপাটা নিন। হে কৃষ্ণ, কনকমুক্তার হার ফেলে বলমালা কণ্ঠে ধরুন। পীতাম্বর ফেলে বাঘছাল পরুন। 



নারদমুনির কথায় কৃষ্ণ তখনই সব রাজবেশ ত্যাগ করে তপস্বীর বেশে সাজলেন। দেবকীনন্দনের কাঁধে উঠল মৃগছাল, হাতে বীণা। 
তিনি নারদের পিছু পিছু চলেন, দেখে মনে হয় তিনি নারদের চেলা। কৃষ্ণের এই বেশ দেখে উগ্রসেন, বসুদেব প্রমুখ সকল যাদব নর, নারী, শিশু কাঁদতে থাকে। এমনকি বন্য পশুরাও অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে। দ্বারকাবাসী বাল-বৃদ্ধ-যুবা সকলে ভূমিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে থাকে। মা দেবকী-রোহিণীরাও কাঁদেন। রুক্মিণী প্রমুখ ষোল সহস্র রমণীরাও কৃষ্ণের পিছে পিছে চলেন। 

নারদ বলেন –আপনারা কোথায় চলেছেন! 

রুক্মিণী বলেন –আপনি কৃষ্ণকে যেথায় নিয়ে যাবেন, আমরাও সেখানে যাব। 

নারদ বলেন –তার কি প্রয়োজন! আমি তপস্বী ব্রাহ্মণ, নানা স্থানে ভ্রমি। 

রুক্মিণী বলেন –হে মুনি, আপনি কৃষ্ণ দান পেলেন। সেই সাথে যৌতুক পেলেন ষোল সহস্র রমণী। 

মুনি বলেন –রুক্মিণী মিছে দ্বন্দ করতে আসছেন। পরে রাগ করবেন না, যদি কিছু ভাল- মন্দ বলে ফেলি। যখন সত্রাজিতের কন্যা সত্যভামা কৃষ্ণকে দান করছিলেন তখন তো কেউ স্বামীকে রক্ষার জন্য কোন কথা বলেন নি, কোন চেষ্টাও করেন নি। তখন কিছু না করে এখন আমাকে এসব শোনাচ্ছেন। 


রুক্মিণী বলেন –মুনিবর, সত্যভামার দানে আমার কোন দায় নেই। আপনি আমাদের প্রাণনাথকে নিয়ে গেলে আমরা কোথায় যাব! রক্ষা করুন আমাদের। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।
..........................................
নারদকে শ্রীকৃষ্ণ পরিমাণে ধনদানঃ



নারদমুনি গোবিন্দকে নিয়ে চলেছেন। বিষণ্ণবদনে সত্যভামা তা চেয়ে দেখেন। যখন হৃদয়ঙ্গম করেন কি ঘটনা ঘটতে চলেছে, তখন বাতুলের(পাগলের) মত উঠে এসে দুই হাত প্রসারিত করে মুনির পথ আগলে দাঁড়ান। 

সত্যভামা বলেন –হে নারদমুনি, তোমার চালাকি বুঝেছি। আমাকে বোকা বানিয়ে আমার স্বামীকে নিয়ে যাচ্ছ! বালককে যেমন হাতে কলা দিয়ে বোকা বানান হয়, তেমনি হাতে আমার কাঁচ দিয়ে কাঞ্চনমালা নিয়ে তুমি পালাও! শিলা দিয়ে নিয়ে যাও পরশ রতন! শরীর ফেলে জীবন সঙ্গে নিয়ে যাও! আমি এ ব্রতের ফল আর চাই না। আমার প্রাণনাথকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। 

নারদ বলেন –সত্যভামা সত্য ভ্রষ্টা হচ্ছেন। সকলের সামনে আপনি গোবিন্দকে আমায় দান করেছেন। এখন বলছেন ব্রতের প্রয়োজন নেই! আমি দান গ্রহণ করেছি তা আর ফেরত দেব কেন! আমায় একা পেয়ে বল প্রয়োগ করতে চান! আমার সম্পদ নেয় দেখি কার কত শক্তি! 
এই বলে ক্রোধে নারদমুনি দুই আঁখি ঘোরাতে থাকেন। 
তার এমন রূপ দেখে সত্যভামা ভয়ে কাঁপতে থাকেন। তবু তিনি বলেন –আপনার ক্রোধকে আমি ভয় পাই না। খুব বেশি ক্রোধ হলে আমায় ভস্ম করে দিন। গোবিন্দের বিচ্ছেদে মরেও আমার সুখ। কৃষ্ণকে আর দেখতে পাব না, এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কি আছে! 
হে মুনি আপনি কিন্তু পূর্বে বলেছিলেন এই ব্রতের ফলে ইন্দ্রাণী, পার্বতী ও অগ্নিপ্রিয়া স্বাহা সকলে স্বামীকে আরো গভীরভাবে পেয়েছিলেন। তারা স্বামীকে পেলে আমি কেন পাব না! 


অগ্নি ও স্বাহা

নারদ বলেন –সর্বভক্ষ হুতাশন অগ্নি, চারমুখে তার প্রচন্ড কিরণ। তাকে নিয়ে আমি কি করব! সে কারণে স্বাহাকে তার স্বামী ফিরিয়ে দিয়েছি। পার্বতীর পতি রুদ্র শিব, বলদ তার বাহন। হাড়মালা, ভস্ম মেখে গলায় সাপদের নিয়ে ঘোরেন। সব সময় ভূত প্রেত নিয়ে তার কারবার। তাই অবহেলা করে তাকে সঙ্গে নিলাম না।


শিব ও পার্বতী
শচী পতি পুরন্দর ইন্দ্র সহস্রলোচন। তিনলোক পালনের জন্য বিধাতা তাকে নিয়োজিত করেছেন। ইন্দ্র কখনও ঐরাবতে কখনও উচ্চৈঃশ্রবায় আবার কখনও রথে ঘোরেন। বিনা বাহনে তিনি চলতেই পারেন না। সে কারণে আমি আর তাকে সঙ্গে নিলাম না। তবু তিনি স্বর্গে আমার হয়েই আছেন। 


ইন্দ্র ও শচী
আপনার যে স্বামী কৃষ্ণ, তার রূপের সীমা নেই। তিনলোকের মধ্যে কাকে তার উপমা দেব। এখন থেকে যেখানে যাব সেখানেই তাকে সঙ্গে নেব। অনুক্ষণ দিনরাত তাকে চোখের সামনে দেখতে পাব। এ আমার বহু জন্মের ইচ্ছা। অনেক তপস্যার ফলে আজ বিধাতা আমায় সে সুযোগ করে দিলেন। চোখ বুজে সদা যাকে ধ্যান করি তাকে হাতে পেয়ে আপনাকে কি আর ফেরত দেব! 

একথা শুনে সতী সত্যভামা মুর্চ্ছিতা হলেন। দেখে বোঝা যায় না তিনি জীবিতা কি মৃতা। সত্যভামার কষ্ট দেখে কৃষ্ণের দয়া হল। 


তিনি নারদকে অনুরোধ করলেন –মুনি মায়া ত্যাগ করুন। 

মুনি বলেন –কর্মফল ভোগ করতেই হবে। তোমাকে ত্যাগ করে ব্রত ফলে মন দিল! 

কৃষ্ণ বলেন –স্ত্রীজাতি সহজেই অজ্ঞ হয়ে যান। তোমার মত জ্ঞান সে কোথায় পাবে। সতীর শরীরে প্রাণ নেই মনে হচ্ছে। যোগবলে তার আত্মা এক্ষুনি দিন মুনিবর। 

সতী সত্যভামার কষ্ট দেখে নারদমুনির দয়া হল। তিনি ‘উঠুন, উঠুন’ বলে সত্যভামাকে বারবার ডাকতে থাকেন। মুনির আশ্বাসে দেবী চেতনা ফিরে পেলেন। উঠে পুনরায় নারদমুনির চরণ ধরে প্রার্থনা করতে লাগলেন। 

নারদ বলেন –দেবী এক কাজ করুন। দান দিয়ে আবার ফেরত নেওয়া অধর্ম। তার চেয়ে গোবিন্দের সমান রত্ন দান করে পুনরায় কৃষ্ণকে গ্রহণ করুন। এতে ব্রতের ফল শাস্ত্রমতেই পাবেন। 

শুনে সত্যভামা উল্লাসিত হলেন। 
পুত্রদের ডেকে মৃদুভাষে বলেন –বিধিমত তূলাদন্ডের সজ্জা কর। আমার গৃহ থেকে সকল রত্ন নিয়ে এস। 

আজ্ঞা পেয়ে কাম ও অন্যান্য পুত্ররা দ্রুত কনক তূলা সজ্জা করল। একদিকে দেবকীনন্দন কৃষ্ণ বসলেন। অন্যদিকে সব রত্ন দেওয়া হল। কিন্তু তূলা সমান হল না।
সত্যভামার গৃহের রত্ন দিয়েও কোন কাজ হল না দেখে রুক্মিণী, কালিন্দী, লগ্নজিতা, জাম্ববতী প্রমুখ কৃষ্ণের অন্যান্য স্ত্রীরা সকলে দ্রুত নিজ নিজ ঘরের সকল সম্পদ তূলায় দিতে লাগলেন। তবু তূলা সমান হল না। 
তখন ষোড়শ সহস্র কন্যা তাদের ধন তুলে দিলেন। এমনকি কৃষ্ণের ভান্ডারের ধন যা কুবেরের সমান তাও সব চড়ান হল। তবু কিছুই কৃষ্ণের সমতুল হল না। 
দ্বারকাবাসী তখন নিজেদের দ্রব্যাদি শকটে(গাড়ি), উটে, বৃষে বয়ে এনে তূলায় চড়াতে লাগল। কিন্তু কিছুই তূলাকে নরাতে পারল না। সকলে অবাক হল। পর্বতের আকারের রত্ন চড়ান হল কিন্তু নারায়ণকে ভূমি থেকে সামান্যও তুলতে পারা গেল না। 

সব দেখে সত্যভামা কাঁদতে লাগলেন। 
তা দেখে নারদমুনি ক্রোধমুখে বলেন –উপেন্দ্রানী বলে বড়ই গর্ব কর! কিন্তু রত্ন দিয়ে তো স্বামিকে উদ্ধার করতে পার না! এদিকে খালি শিশুর মত কেঁদে যাচ্ছে! এতদিনে তার প্রকৃত মূল্য জানলে! এমন জন কেন যে এই ব্রত করে। এখন বুঝেছি তুমি ধন দিতে পারবে না। 

নারদ কৃষ্ণের হাত ধরে তাকে উঠতে বলেন। শুনে সত্যভামা ধূলায় গড়াগড়ি দিতে থাকেন। মুক্ত কেশ উড়তে থাকে। দ্বারকার সকল যাদব যাদবী কাঁদতে থাকে। 

তখন অনেক চিন্তা করে উদ্ধব(কৃষ্ণের সখা, সম্পর্কে পিতৃব্য) বলেন –কৃষ্ণ আপন মুখে বলেছেন বারবার-তার চেয়ে কেবল তার নাম বড়। সকলে মিলে এস আমরা তার নাম কীর্তন করি। তূলা থেকে সব রত্ন ফেলে দাও। সমগ্র ব্রহ্মান্ড যার এক লোমকূপে তাকে কোন দ্রব্যে সমান করতে চাও! 


এই বলে তিনি তুলসী পাতা তুলে এনে তাতে দুই অক্ষর কৃষ্ণ নাম লিখলেন। তূলার উপর সেই তুলসীপাতা রাখতেই নীচে এল তুলসী, জগন্নাথ উপরে উঠলেন। 
দেখে সকলে উল্লাসিত হল। “সাধু, সাধু” বলে মহাধ্বনি রব উঠল। কৃষ্ণনাম গুণের কোন সীমা নেই। বৈষ্ণবরাই কৃষ্ণনামের মহিমা জানেন। শ্রীকৃষ্ণের থেকেও কৃষ্ণনাম বড় ধন। চিত্ত দৃঢ় করে কৃষ্ণনাম জপ কর। কৃষ্ণ কৃষ্ণ বললে পাবে কৃষ্ণ দেহ, কৃষ্ণের মুখের বাক্য-এতে কোন সন্দেহ নেই। 

তুলসীপত্রে কৃষ্ণনাম পেয়ে নারদমুনি তুষ্ট হলেন। সত্যভামা সকল রত্ন ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। 



পারিজাত-হরণের এই হল বিবরণ। এবার সুভদ্রা হরণের কথা হবে।

মহাভারতের কথা অমৃতের ধারা, শুনলে অধর্মীও ভবসাগর পার হবে। পারিজাত হরণের আমোদিত রস কথা শুনলে সংসারের ব্যথা ঘুচে। পুরুষ শুনলে হয় কৃষ্ণপদে মতি, নারী শুনলে সৌভাগ্য হয় পতির। বংশ বাড়ে, পরমায়ু বৃদ্ধি ঘটে, সর্বত্র কল্যাণ হয়। কাশীদাস কহেন, তা করিয়া প্রমাণ। 
..................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers