Blog Archive

Wednesday, July 30, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬১



জতুগৃহ-দাহঃ 

পরিবার নিয়ে পুরোচন গৃহে শুতে গেলো এবং নিদ্রায় অচেতন হল। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বৃকোদর ভীমকে আজ্ঞা দিলেন এখনই পুরোচনের গৃহে অগ্নি দেওয়ার জন্য। ভীম পুরোচনের দরজায় আগুন দিলেন। ভাইরা মাকে নিয়ে সুরঙ্গে প্রবেশ করলেন। ভীম অন্যান্য গৃহে আগুন লাগিয়ে সুরঙ্গে প্রবেশ করলেন। মাকে নিয়ে পাঁচভাই দ্রুত এগিয়ে চললেন। এদিকে প্রবল বায়ুতে জতুগৃহে আগুন ছড়াতে লাগল। আগুনের উত্তাপে ও শব্দে গ্রামবাসীরা ছুটে এলো। জল নিয়ে সকলে দৌড়াতে লাগল। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখার জন্য জতুগৃহের কাছে কেউ যেতে সাহস পেল না। চারদিকে লোকজন হাহাকার করে ঘুরতে লাগল। গালা(জৌ), ঘি, তেলের গন্ধ চারদিকে ছড়াতে লাগলো। দুষ্ট ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতিতেই এই জতুগৃহ নির্মাণ ও তার দুর্বুদ্ধিতেই পান্ডুপুত্রদের ছলনা করে দগ্ধ করা হল-এই কথা সকলে আলোচনা করতে লাগলো। ধর্মশীল পাঁচ ভায়ের কোন অপরাধ ছিল না, তারা ছিলেন সর্ব গুণে গুণী, জিতেন্দ্রিয়, সত্যবাদী। ভাগ্যক্রমে পাপাত্মা পুরোচনও পুড়ে মরেছে। সবই ভাগ্য বলে সবাই আলোচনা করতে লাগল –নির্দোষীদের যারা হিংসে করে নারায়ণ তাদের এমনই শাস্তি দেন। এতসব বলে সকলে পান্ডবদের গূণ স্মরণ করে শোকে রোদন করতে লাগলো। 

এদিকে মায়ের সাথে পান্ডবরা সুরঙ্গ থেকে বেরিয়ে গহন বনে প্রবেশ করলেন। ঘোর অন্ধকার রাত্রি, গহনবন, লতা, বৃক্ষ, কাঁটা পেরিয়ে ছয়জন এগোতে থাকেন। রাজার পত্নী কুন্তী ও তার রাজপুত্ররা অন্ধকারে পথের দিশা ঠিক করতে পারলেন না। পথে চলতে চলতে ক্লান্ত কুন্তী অশক্ত হয়ে পরলেন। যুধিষ্ঠির, ধনঞ্জয় অর্জুন, নকুল ও সহদেবও পথের শ্রান্তিতে ভেঙ্গে পরলেন। কুন্তীদেবী অচেতন হয়ে পরলেন। পাঁচভাইও আর দ্রুত এগোতে পারলেন না। তখন ভীম মাকে কাঁধে বসিয়ে নকুল-সহদেবকে কোলে নিয়ে যুধিষ্ঠির-অর্জুনের হাত ধরে বেগে চলতে লাগলেন। মহাবলী ভীমের চরণে বৃক্ষ, শীলা চূর্ণ হতে লাগল। শেষরাত্রে তারা গঙ্গারতীরে উপস্থিত হলেন। গভীর গঙ্গার জলের বিস্তার দেখে পান্ডবরা চিন্তিত হলেন কিভাবে গঙ্গা পার হবেন। ভীম জলের গভীরতা পরিমাপ করতে গেলেন। 

সে সময় গঙ্গারতীরে একটি পতাকা শোভিত নৌকা উপস্থিত হল। নৌকাটি বিদুরের এক কৈবর্ত (কৃষিজীবী ও মৎসজীবী) অনুচরের। তিনিও গঙ্গাতীরে পান্ডবদের খুঁজছিলেন। দুর থেকে পান্ডবদের দেখতে পেয়ে তিনি নমস্কার করে এগিয়ে এসে বিদুরের সংবাদ দিলেন। 
তিনি বললেন-বিদুর পরম যত্ন্রে আপনাদের গঙ্গার পর পারে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন। পান্ডবরা যাতে তাকে অবিশ্বাস না করেন সে জন্য তিনি বিদুরের সেই সঙ্কেতটি বললেন যেটি বারণাবতে আসার সময় বিদুর যুধিষ্ঠিরকে বলেন। যেখানে জন্ম সেখানেই ভক্ষ্য হওয়া শীতল বিনাশের সমান, বিপক্ষের ভয় আছে যেখানে সেই দেশেই যাওয়া ভাল। সেই সঙ্কেত আসার সময় আমায় বলে পাঠালেন গঙ্গা পার করার জন্য। 
তার কথা শুনে পান্ডবদের বিশ্বাস জন্মাল। ছয়জনে নৌকায় আরোহণ করলেন। নৌকা বায়ু বেগে চলল। পুনরায় বিদুরের অনুচর বলে বিদুর আরো বলে পাঠিয়েছেন –কিছুকাল অজ্ঞাতবাসে কোন স্থানে দুঃখকষ্ট সহ্য করে এই দুঃসময় কাটিয়ে নিও। এভাবে গঙ্গার পর পারে পান্ডবরা উপস্থিত হলেন। 
কূলে উঠে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কৈবর্তকুমারকে বলেন বিদুরকে গিয়ে বলবেন ভীষণ বিপদ থেকে আপনার সাহায্যে উদ্ধার হতে পারলাম। তার চেয়ে পান্ডবদের কাছের বন্ধু কেউ আর নেই। তার জন্যেই আজ আমরা প্রাণে বাঁচলাম। আবার ভাগ্য সদয় হলে তার দর্শণ অবশ্যই পাব। এত বলে বিদায়কালীন সম্ভাষণ জানালেন। ভোর হতেই পান্ডবরা বনে প্রবেশ করলেন। গঙ্গার দক্ষিণদিকে কুন্তীসহ পুত্ররা যাত্রা করলেন। উত্তরদিকে নৌকা নিয়ে ধীবর গমন করল। 


এদিকে প্রভাত হলে নগরের লোকজন জতুগৃহের সামনে এসে শোক করতে লাগল। জল দিয়ে আগুন নেভাল। ছাই উল্টে সকলকে খুঁজতে শুরু করল। দ্বারের মধ্যে পুরোচনকে দেখল তার ভাই ও বন্ধুদের নিয়ে পুড়ে গেছে। অস্ত্রগৃহে যত অস্ত্রধারী ছিল তারাও সেখানে পুড়ে মারা গেছে। সকলে প্রতিটি ভস্ম পরখ করে দেখতে লাগল। সে সময় এক সাথে ছয়টি দগ্ধ মৃতদেহ দেখে তারা হাহাকার করে উঠল। ভূমির উপর গড়াগড়ি দিতে লাগলো শোকে। কোথায় কুন্তী কোথায় পান্ডব ভাইরা-সকলে হায় হায় করতে থাকল। চারদিকে ভস্মস্তূপ দেখে ক্রন্দন রোল উঠল। পাপিষ্ঠ দুর্যোধনের এই কাজ। সেই পুরোচনকে জতুগৃহ তৈরী করতে পাঠাল। দুষ্টবুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রও সব জানত। সেই ছলনা করে পান্ডবদের পুড়িয়ে মারল। এখনই আমাদের উচিত হস্তিনাপুরে লোক পাঠিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে জানান যে তার আর কিছু ভয় নেই, তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। হস্তিনাপুরে দূত গেল, অন্ধ রাজাকে গিয়ে সব জানান হল। গালায় নির্মিত গৃহে কুন্তীসহ পান্ডুর পুত্ররা রাত্রে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে। পরিবারসহ পুরোচনও দগ্ধ হয়েছে। এতশুনে শোকে ধৃতরাষ্ট্র অচেতন হলেন। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান হলে কুন্তী ও পাঁচপুত্রের নাম করে হাহাকার করতে করতে কাঁদতে লাগলেন। নিজেই নিজেকে দোষ দিতে লাগলেন –আমিই পান্ডবদের মারলাম। ভাতৃশোকে এ পাপ ছিল না। এমন বহুবিধ বিলাপ করতে লাগলেন অন্ধরাজা। অন্তঃপুরীর ভিতরও সংবাদ গেল। গান্ধারীসহ যত পুরনারীরা ছিলেন সকলে আকুল হয়ে শোক করতে লাগলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, পন্ডীত বিদুর সকলে পান্ডবদের মৃত্যু শুনে শোকাতুর হলেন। নগরের লোকেরা পান্ডবদের গুণের কথা স্মরণ করে কাঁদতে লাগল। কেউ যুধিষ্ঠিরের নাম নিয়ে হাহাকার করে, কেউবা ভীম কেউ অর্জুন ও মাদ্রীপুত্রদের কথা ভেবে, অনেকে মা কুন্তীর কথা ভেবে কেঁদে ওঠে। এভাবে নগরে সকলে পান্ডবদের হারিয়ে শোকে আকুল হয়ে উঠল। শেষে ধৃতরাষ্ট্র বিধান মত শ্রাদ্ধ করালেন। ব্রাহ্মণদের বহু রত্ন ও গরু দান করলেন। 

এদিকে পান্ডবরা অতি কষ্টে হিড়িম্বের অরণ্যে প্রবেশ করল। পথ শ্রমে, ভয়ে, ক্ষুদায় ও তৃষ্ণায় কুন্তী আর চলতে পারেন না। তিনি পাঁচপুত্রকে ডেকে বলেন – বহুদুর এই অরণ্যের ভিতর চলে এলাম, তৃষ্ণায় আমার প্রাণ যায়, আর বিনা জলপান করে যেতে পারব না। কিছুক্ষণ এই স্থানে বিশ্রাম নেওয়া যাক। শুনে চিন্তিত হয়ে যুধিষ্ঠির বলেন - না জানি পুরোচন মরল কি বেঁচে গেল, সে দুষ্ট দুর্যোধনের মন্ত্রী। আমাদের সমাচার কেউ যদি তাদের গিয়ে জানায় তবে তো তারা সৈন্য সাজিয়ে এখানে যুদ্ধ করতে চলে আসবে। তখন আমরা কি করবো। 
ভীম বলেন এখানে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, জলপান করে তৃপ্ত হয়ে আবার রওনা হওয়া যাবে। চারভাই ও মাকে একটি বটমূলে বিশ্রাম করতে রেখে ভীম জলের খোঁজে বেরিয়ে পরল। জলচরদের শব্দ শুনে শুনে জলের কাছে তিনি পৌছালেন। জলে নেমে ভীম স্নান করলেন এবং প্রাণ ভরে জলপান করলেন। কিন্তু মা ও ভাইদের জন্য জল নিয়ে যাওয়ার জন্য কোন পাত্র খুঁজে পেলেন না। কিছু না পেয়ে ভীম কাপড় ভিজিয়ে বস্ত্রে করেই জল নিয়ে চললেন। জলের খোঁজে তিনি প্রায় দুই ক্রোশ চলে আসেন। দ্রুত তিনি মা ও ভাইদের কাছে ফিরে চললেন। এসে দেখেন সকলে নিদ্রায় অচেতন। তাদের দেখে ভীমের প্রচন্ড মনোকষ্ট হল। তিনি আপন মনে প্রলাপ শুরু করলেন। -বসুদেবের বোন, ভোজরাজের রাজকন্যা, বিচিত্রবীর্য্যের পুত্রবধু, মহারাজ পান্ডুর পত্নী -যিনি বিচিত্র পালঙ্কের মনোহর শয্যায় শয়ন করতেন, আমাদের সেই মা আজ ভূমিতে শুয়ে আছেন। বিধি কি বিধান লিখলেন কপালে! পদ্মের মত কোমল শরীর হেন ভাইরাও আজ মাটিতে লুটিয়ে আছে। ঈশ্বরের মত সত্যবাদী যোগ্যবান সহজ মানুষ বড়ভাই, বীর্যবন্ত অর্জুন, অনুপম সহদেব, সুন্দর নকুল –এই সর্বগুণ সম্পন্ন ভাইদের ভূমিতে শুয়ে থাকতে দেখে তিনি হাহাকার করতে লাগলেন। তাদের এই দুর্গতির জন্য দায়ি দুষ্টবুদ্ধির জ্ঞাতি ভাই দুর্যোধন। বিপদে লোকে জ্ঞাতির কাছেই সাহায্য পায়। বনে যেমন বৃক্ষে বৃক্ষকে রক্ষা করে। কিন্তু কুলাঙ্গার দুর্যোধন জ্ঞাতি শত্রু। তার জন্য আজ পাঁচভাই বনে ঘুরে ফিরছি। দুর্যোধন, কর্ণ আর শকুনি দুর্মতি –ধৃতরাষ্ট্র এই তিনজনের অনীতি পরামর্শ গ্রহণ করলেন! লোভে তারা ধর্ম মানল না, পাপে নিমগ্ন হল। আসলে পুণ্যবলে দুষ্ট পাপীলোক জয় লাভ করতে পারবে না সৎলোকের বিরুদ্ধে। কোন দেবতাও এমন বর দেবেন না। তারা যে অন্যায় আমাদের সাথে করল কেউ কখনও জ্ঞাতির সাথে তা করে না। দৈবের নির্বন্ধ কখনও খন্ডন হওয়ার নয়। রাজা ধৃতরাষ্ট্র যখন এমন অন্যায় করতে পারলেন, বিধি মতে শাস্তিও তখন আমিই তাকে ভাল ভাবে দেব। সকলের চেয়ে বড় এবং শক্তিতে শ্রেষ্ঠ দুষ্ট ধৃতরাষ্ট্রকে নিষেধ করার ক্ষমতাও অন্য রাজাদের নেই। রাজার এই পাপই কৌরবদের নিধন করবে। অবশ্যই তার শতেক পুত্রকে হত্যা করব। এত দুঃখ আমার ঈশ্বরসম বড়ভাই যুধিষ্ঠির কেন সহ্য করছেন! তার সামান্য নির্দেশ পেলেই সকলকে সংহার করতে পারি। মহাধর্মশীল তুমি ধর্মে তৎপর বলেই তোমায় এত দুঃখ পেতে হয়, হে গুণের সাগর যুধিষ্ঠির! দয়াশীল বলেই তুমি আজ্ঞা দিলে না গদা দিয়ে সকল দুষ্টের দমনের। সে কারণে এখনও দুষ্ট তোমাদের জীবন রয়ে গেল। ধার্মিক যুধিষ্ঠিরের সাথে ছলনা করে আজ আমাদের সকলকে এই দুঃখে পতিত করলে। তিনি জানেন আমি সকলকে সংহার করতে পারি, তবু ধর্মের কারণে আজ্ঞা দিচ্ছেন না। 
এসব বলতে বলতে বৃকোদর রেগে গেলেন। দুই চোখ কচ্‌লে লাল করে তুললেন। আবার মা ও ভাইদের দেখে ক্রোধ দমন করলেন। তাদের নিদ্রাভঙ্গ করা ঠিক হবে না ভেবে তাদের পাশে বটবৃক্ষমূলে জেগে বসে পাহারা দিতে লাগলেন। 

সে সময় হিড়িম্ব নামে এক নিশাচর ভয়ঙ্করদর্শ রাক্ষস দন্তপাটি বার করে জিভ লক্‌লক্‌ করে তাদের লক্ষ্য করছিল। তার দীর্ঘ কর্ণ, রক্তবর্ণ চক্ষু কূপের মত কোঠরে ঢোকা। কুচ্‌কুচে কাল, বিশাল মাথা। সে কাছেই এক গাছের উপর বসেছিল। মানুষের গন্ধ পেয়ে লোভে অন্ধ হয়ে সে চারদিকে চাইতে লাগল। বটবৃক্ষমূলে ছয়জনের চাঁদের মত রূপ দেখে তার জিভে জল এলো। মনে মনে খুশি হয়ে সে তার স্বসা অর্থাৎ বোন হিড়িম্বাকে বললো – কতদিন আমরা খাবার না পেয়ে উপবাসে আছি। দেখ দৈব যোগে মানুষ নিজে এসে হাজির হয়েছে। ভাল সময় মাংস উপস্থিত। ছয়জনকে এক্ষুনি গিয়ে ধরে আন। ভয় পাবে না, এটা আমার বন, এখানে কেউ তোমার বিরোধ করবে না। ভায়ের কথা শুনে রাক্ষসী হিড়িম্বা ভীম যেখানে বসে ছিলেন সেখানে উপস্থিত হল। 
মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।

Monday, July 14, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬০

 
ধৃতরাষ্ট্রের প্ররোচনায় পান্ডবদিগের বারণাবতে গমনঃ 

জন্মেজয় মুনিকে অনুরোধ করেন তারপর কি ঘটনা ঘটল বর্ণনা করে তার মনের আঁধার ঘুচান। মুনি তখন ভারতের অপূর্ব ঘটনার বর্ণনা শুরু করলেন।

যুধিষ্ঠির রাজা হবেন এ আলোচনায় প্রজারা সুখী হলো। ধর্মশীল যুধিষ্ঠির দয়ার সাগর –রাজা, প্রজা, ধনী, দরিদ্র সকলে তাকে পুত্রের মত স্নেহ করে। যুধিষ্ঠির রাজা হলে সবাই সুখে থাকবে, তিনিও সকলকে সন্মান করবেন। ভীষ্ম রাজা হননি সত্য রক্ষার জন্য। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হওয়ায় রাজা হতে পারেন নি, তাই পূর্বে পান্ডু রাজা হন। তারপর তার যোগ্য পুত্র সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয়, সুবুদ্ধি যুধিষ্ঠির রাজা হবেন এই যথার্থ। তাই প্রজারাও সকলে ঠিক করল যুধিষ্ঠির যাতে দ্রুত সিংহাসন গ্রহণ করেন তার জন্য আবেদন যানাবে। 

নগরে, হাটে, বাজারে সারাদিন এই নিয়ে প্রজারা আলোচনা করছে-এ সংবাদে দুর্যোধন মনে বড় ব্যথা পেলেন। বিরস বদনে তিনি পিতার কাছে গেলেন। দেখলেন পিতা একা বসে আছেন। সকরুন স্বরে দুর্যোধন পিতাকে সাবধান করে দিলেন যে প্রজারা তাকে আর রাজা হিসাবে চায় না। নগরে অদ্ভূত রব উঠেছে সকলে যুধিষ্ঠিরকে রাজা রূপে চায়, ধৃতরাষ্ট্রকে অনাদর করে। তারা বলে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ সে রাজার যোগ্য নয়। কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির প্রকৃত রাজার পুত্র – সেই সিংহাসনে বসার যোগ্য। প্রজাদের কথা মত যদি রাজপুত্র যুধিষ্ঠির রাজা হন, তবে তার পুত্রই তারপরে রাজা হবে। তখন কৌরবদের প্রজারা আর মান্য করবে না। একথা স্মরণ করে দুর্যোধন নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকেন। তিনি তার ধর্ম, আত্মা, শিক্ষা, দেহ এমনকি সকল কর্মকেও ধিক্কার দেন। শেষে বলেন এই ব্যর্থ জীবনের তিনি আর প্রয়োজন দেখছেন না, তাই তিনি আজই পিতার সামনে জীবন ত্যাগ করবেন। অকারণে যে জন্মায় সে তো পরভাগ্যজীবি। পৃথিবী তাকেও অকারণে এখনও ধারণ করে আছেন।

পুত্রের এই হাহাকার শুনে অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয়ে শেল বাজল। তিনি চিন্তিত হলেন। পুত্র স্নেহে অন্ধ রাজা মনে মনে ভাবেন- কি করব, কি বা হবে। 
সে সময় সেখানে মন্ত্রণা দিতে তার দুষ্ট মন্ত্রীরা আসে-দুঃশাসন, কর্ণ ও শকুনি দুর্মতি। তারা পরামর্শ করে অন্ধ রাজাকে বলে – পান্ডবদের ভয় তখনই দুর হবে যখন রাজা কোন উপায়ে তাদের রাজ্য থেকে বার করে দেবেন। 

কিছুক্ষণ চিন্তা করে অম্বিকাপুত্র ধৃতরাষ্ট্র বলেন কি করে পান্ডুর পুত্রদের তিনি বিতারিত করবেন। যখন পান্ডু এই পৃথিবীতে ছিলেন তখন তিনি সেবকের মতই ধৃতরাষ্ট্রকে পুজা করতেন। তিনি যেন নাম মাত্র রাজা, ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞা ছাড়া কিছু করতেন না। তার আজ্ঞাতেই পান্ডু চলতেন। ভাই হয়ে কেউ ভায়ের এত সেবা কখনও করবে না। আর পান্ডুর পুত্ররা যেন পিতারও উপরে। তারা সর্বক্ষণ ধৃতরাষ্ট্রের দিকেই তাকিয়ে। দেবতার মতই যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের সেবা করেন। কোন দোষে তাকে রাজ্য থেকে তিনি বার করবেন। যদি ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরের প্রতি অবিচার করেন তবে অবশ্যই তার ফলও ধৃতরাষ্ট্রকেই ভোগ করতে হবে-একথাও তিনি মন্ত্রীদের শুনিয়ে দিলেন। 
আরও বললেন –অহিংসকজনকে যে হিংসা করে অবশ্যই সে নিজেকে নরকে পতিত করে। সবাই জেনে রাখ হিংসার সমান পাপ আর কিছু নেই। তেমনি দয়া বিনা ধর্মও নেই এই তিন ভুবনে। তাছাড়া পান্ডবরা পাঁচ ভাইই সবদিক দিয়ে খুবই বলিষ্ঠ। তাদের অনুগতের সংখ্যাও অনেক। পিতৃ-পিতামহ তাদের সযত্নে পালন করছেন-তাদের বলপূর্বক বিতারণ অসম্ভব। 

এত শুনে দুর্যোধন বলেন পিতা যা প্রমাণ করলেন তা তিনি পূর্বেই জানতেন তাই তার ব্যবস্থাও তিনি ভেবে রেখেছেন। যত রথী-মহারথী আছে সকলকে কৌরবভাইরা বহু ধন দিয়ে বশ করবে। পিতার উচিত তার সকল দিক বিবেচনা করে কাজ করা। 
তারপর দুর্যোধন প্রস্তাব করলেন দেশের বাইরে বারণাবত নগর অতি অনুপম স্থান। সেখানে যুধিষ্ঠির তার ভাই ও মাকে নিয়ে চলে যাক। সে সময় সে নিজের রাজ্যের সকলকে সন্তুষ্ট করে নিজের বশে আনবে। তার পর না হয় যুধিষ্ঠির এখানে আসবে, অবশ্যই বহুদিন পর। 

ধৃতরাষ্ট্র সঙ্গে সঙ্গে বলেন দুর্যোধন যে কথা বলে তাই ধৃতরাষ্ট্রের মনের ইচ্ছা। কিন্তু লোকাচারের ভয়ে এই পাপকার্য তিনি প্রকাশ করতে পারছেন না। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, বিদুর-এরা সকলে ধর্মাচারি, এরা কিন্তু কখনই এ প্রস্তাবে সম্মত হবেন না। আর এই চারজন যদি স্বীকৃতি না দেন তাহলে যুধিষ্ঠিরদের অন্য স্থানে পাঠানও অসম্ভব। তিনি কার্যসিদ্ধির কোন উপায়ই দেখছেন না। 
এত শুনে পুনরায় দুর্যোধন বলেন, ভীষ্মের কাছে যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন সমান, ফলে ভীষ্মকে রাজি করান যাবে। কারণ এ প্রস্তাবে কোন পাপ নেই, অধর্মও নেই। 

গুরুপুত্র অশ্বত্থামা যেহেতু আমার অনুচর তাই দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যকে তার দ্বারাই সম্মত করান যাবে। যদিও বিদুর সর্বাংশে পান্ডবদের প্রতি সহানুভূতিশীল, তবু একা সে কিবা করতে পারে। 
দুর্যোধন আরো বলেন পিতা চিন্তা করে এর উপায় বার কর কারণ পান্ডবরা এখানে থাকলে আমার নিদ্রাও হয় না।
ধৃতরাষ্ট্র বলেন- যোর করে তাদের বিতারিত করলে চারদিকে অপযশ ছড়াবে। এমন উপায় বার কর মন্ত্রণা করে যাতে তারা আপনার ইচ্ছায় সেখানে যেতে চায়। 

এত শুনে তখনই দুর্যোধন বহু ধরনের রত্ন নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রীদের ঘরে ঘরে গেলেন। ক্রমে সকল মন্ত্রী তার বশ হল। দুর্যোধন তাদের মিথ্যা বুলি শিখিয়ে দিল। নগর বারণাবত অতি উত্তম একথা যেন দরবারে সকলে বারে বারে ঘোষণা করে। তার কথা মত সকলে বারণাবতের আলোচনাই করতে লাগল। 
দুর্যোধনের প্ররচনায় দরবারে সেই কথাই উঠল। কিছুদিন পরেই শিবরাত্রি চতুর্দশী আসছে, সে সময় বারণাবত নগর পূণ্যক্ষেত্রে পরিণত হয়। কেউবা বলে সেখানে শিব নিজে এসে এসময় বাস করেন। অন্য মন্ত্রী বলে তার মত সুন্দর নগর জগতে আর নেই। কেউবা বলে স্বর্গের কিন্নররা সেখানেই বাস করেন। সেখানে ভোরে সকল দেবতারা এসে নিত্য কর্ম করেন। এভাবে মন্ত্রীরা বারণাবতের অসংখ্য গুণ বর্ণনা করতে থাকল। 

এত শুনে যুধিষ্ঠির বলেন সেই পূণ্যক্ষেত্র বারণাবত নগর দেখতে তারও মনে খুব ইচ্ছে করছে। 
একথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন কিন্তু মুখে কপট দুঃখের ভান করে ভাল ভাল কথা বলতে লাগলেন। 
শেষে বললেন একান্ত যদি ইচ্ছাই হয় তবে পরিবারের সকলকে নিয়ে পূণ্যস্থান দর্শণে যেতে হয়। যুধিষ্ঠিরও তার মা ও ভাইদের নিয়ে সুখে কিছুদিন বারণাবত নগর ঘুরে আসুক। ধনরত্ন যত মনের ইচ্ছা যুধিষ্ঠির নিয়ে যান, বহুদিন থাকতে ইচ্ছা করলেও কোন অসুবিধা হবে না। এভাবে তিনি বারবার ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে সেখানে যেতে প্ররচনা দেন। 

যুধিষ্ঠিরও মনে মনে কিছু আশ্চর্য হলেন কারণ একবার কথায় কথায় তিনি যাওয়ার উৎসাহ দেখাতেই ধৃতরাষ্ট্র স্বপরিবার সেখানে তাকে জোর করেই পাঠাতে চান। তবু ধর্মের পুত্র সত্যবাদী যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের কোন আজ্ঞায়ই অমান্য করেন না তাই ধৃতরাষ্ট্রের চরণে নমস্কার করে বারণাবত যাবার অঙ্গীকার তিনি করলেন। বিজ্ঞ মন্ত্রীদেরও নমস্কার জানিয়ে তিনি মায়ের কাছে চললেন। 

তা দেখে দুর্যোধন মনে মনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে পুরোচন নামে তার অতি বিশ্বস্ত এক মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন। জাতিতে পুরোচন যবন ছিলেন। একান্তে ডেকে মৃদুস্বরে তারা পরামর্শ করতে লাগল। 
দুর্যোধন বললেন তোমাকে আমি সকলের চেয়ে বিশ্বাস করি, তোমার সমান কোন মন্ত্রী নেই তাও বিশ্বাস করি, তাই আজ তোমাকেই এক বিশেষ কাজে নিযুক্ত করছি যা আর কেউ জানে না এবং বিশ্বাস করব তুমিও একথা কাউকে প্রচার করবে না। 
পান্ডবরা বারণাবত নগরে যাচ্ছে তাদের পূর্বে তুমি সেখানে যাবে। খরচের সমস্ত সামগ্রি এখান থেকে নিয়ে যাবে। এখনই দ্রুত রথে আরোহণ করবে। সেখানে অতি দ্রুত গিয়ে একটি উত্তম স্থান দেখে গৃহ নির্মাণ করবে। অগ্নিগৃহ তোমায় নির্মাণ করতে হবে, কিন্তু তা যেন বোঝা না যায়। স্তম্ভ এমন ভাবে রচনা করবে যা ঘৃতে পূর্ণ থাকবে। তার উপর সোনার নানা কারুকার্য করে দেবে। মাঝে মাঝে ঘৃত পূর্ণ বাঁশ বসাবে, যেন আগুন লাগলে সহজে তা না নেভে। এমন ভাবে সম্পূর্ণ রচনা করবে যাতে কেউ লক্ষ না করে। মানুষের ভাল লাগে এমন সুন্দর সুন্দর চিত্র দিয়ে অন্দরসজ্জা করবে। জতুগৃহকে ঘিরে অস্ত্রঘরও তৈরি রাখবে। উপযুক্ত অস্ত্রসস্ত্র তাতে মজুত রাখবে। জতুগৃহ থেকে কোন ভাবে যদিওবা প্রাণ বাঁচে অস্ত্রগৃহের অস্ত্রে যেন প্রাণ হারায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। অস্ত্রগৃহের চারপাশে গভীর খাদ খুঁড়ে রাখবে যাতে বীর ভীমও লাফিয়ে পালাতে না পারে। সময় বুঝে জতুগৃহে আগুন দেবে। সব সময় তার পূর্বে তাদের সাথে থাকবে। 
এত বলে শীঘ্র তাকে বারণাবতের উদ্দেশ্যে গমন করতে নির্দেশ দিলেন। দ্রুত গিয়ে গৃহ নির্মাণ করতে হবে। তার আদেশ পেয়ে পুরোচনমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে রথে উঠে দ্রুত কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ঝড়ের বেগে মিলিয়ে গেল। দ্রুত পুরোচন বারণাবতে পৌছে রাতের অন্ধকারে দুর্যোধনের নির্দেশ মত গৃহ নির্মাণ করতে লাগল। 

এদিকে ভাই ও মাকে নিয়ে যুধিষ্ঠির সব বড়দের আশির্বাদ নিতে গেলেন। ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য সকলের আশির্বাদ নিলেন। গান্ধারীসহ সকল নারীদের কাছেও বিদায় নিলেন। একে একে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে পুরোহিত ব্রাহ্মণদেরও আশির্বাদ নিলেন। 
পান্ডবদের এই মিলন ও বিদায় গ্রহণ দেখে অনেকে ধৃতরাষ্ট্রের নিন্দাও করল। সকলে বলল দুষ্টবুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রের কুমতি হয়েছে, সে কারণে এমন অনৈতিক কাজ করলেন। দুষ্ট দুর্যোধনের সে কারণে সাহস হল সত্যবুদ্ধি ধর্মশীল পান্ডুপুত্রদের দেশের বার করে দেওয়ার। 
কেউবা বলল এই রাজ্যে আর থাকবে না, যেখানে যুধিষ্ঠির যাবেন তারাও সেখানেই তাকে অনুসরণ করবে। যে এই রাজ্যে বাস করবে সেই এ রাজ্যের রাজার মত হয়ে যাবে। কুরুকুলের মহাপাপী এই রাজা এর পাপেতেই সকলে মারা যাবে। 
তারা অবাক হয় যে ধৃতরাষ্ট্রের এই অন্যায় গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম মানলেন কি ভাবে। হয়ত তারা সকলেই এদের মত দুষ্ট চিন্তা করে কিন্তু আমরা এ অন্যায় সহ্য করব না। এই বলে ব্রাহ্মণরা যে যার সংসার-স্ত্রী-পুত্র নিয়ে যুধিষ্ঠিরদের অনুসরণ করল। 
বিদুর তাদের সাথে বহুদুর পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। তিনি ম্লেচ্ছ ভাষায় যুধুষ্ঠিরকে ভবিষ্যৎ বিপদ থেকে সাবধানে থাকার জন্য ইঙ্গিতও করলেন। বিদুর তাদের স্নেহালিঙ্গন করলেন। প্রত্যেকের শির চুম্বন করলেন। তার দুচোখ অশ্রুপূর্ণ হল। যুধিষ্ঠিররা পঞ্চভাই তাকে প্রণাম করলেন। শেষে বিদুর চিন্তান্বিত হয়ে নিজ গৃহে ফিরে গেলেন। যুধিষ্ঠির পঞ্চভাইরা বারণাবত যাত্রা করলেন। 

পুরোচক পঞ্চ পান্ডবদের নমস্কার জানাচ্ছে

তারা বারণাবতে প্রবেশ করতেই সেখানকার অধিবাসীরা তাদের আদর করে নিজ গৃহে নিয়ে গেল। সে সময় দুষ্ট পুরোচক সেখানে উপস্থিত হয়ে নমস্কার করে বিনয়ের সঙ্গে নিবেদন করল সে নিজে কেবল পঞ্চ পান্ডবদের জন্য অতি মনোহর প্রাসাদ তৈরী করিয়েছে সেখানে প্রভূরা পদার্পন করলে সে ধন্য হবে। তার নির্মিত প্রাসাদ যেন কুবেরের ভাস্কর্য, তার মত সুন্দর প্রাসাদ কেবল স্বর্গেই আছে, মর্তে কেউ কখনও এত সুন্দর প্রাসাদ দেখেনি। এত প্রশংসা শুনে পঞ্চ পান্ডব হৃষ্ট হলেন এবং মাতা কুন্তীকে নিয়ে সেখানে প্রবেশ করলেন। বিচিত্র সজ্জায় নির্মিত এই প্রাসাদ দেখে পান্ডবরা খুশি হলেন। 

যুধিষ্ঠির হঠাৎ সন্দেহের বশে ভীমকে ডেকে বললেন গৃহ ঠিক ভাবে পরীক্ষা করতে হবে, কারণ তার মন ঠিক এই ঘরকে বিশ্বাস করতে চাইছে না। বৃকোদর ভীম ঘরের আঘ্রাণ নিয়ে অবাক হয়ে জানালেন গৃহে ঘি, সর্ষের তেল ইত্যাদি ভষ্মের গন্ধে পূর্ণ। 
যুধিষ্ঠির বুঝলেন তাদের পুড়িয়ে মারার জন্যই এই প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছে। তারা আসার সময় লক্ষ্য করেছেন যে প্রচুর পরিমান দাহ্যবস্তু বারণাবতে আনা হচ্ছে। এখন যুধিষ্ঠির বুঝলেন বিদুর তখন যবন ভাষায় একথাই বলতে চেয়েছেন যে বিশ্বাস করে এ ঘরে থাকলে যখন অচেতনে তারা নিদ্রা যাবেন তখন পুরোচন আগুন লাগিয়ে তাদের হত্যা করবে। এসবই যে দুর্যোধনের বুদ্ধি তাতে তাদের সন্দেহ রইল না। 
ভীম বললেন – কি দরকার এই জতুগৃহে থাকার! চলো সকলে আবার হস্তিনাগরে ফিরে যাই। 
যুধিষ্ঠির বললেন – তা ঠিক হবে না। কারণ লোক মাধ্যমে দুর্যোধনরা জানতে পারবে, তখন সে সৈন্য সাজিয়ে যুদ্ধ করতে চাইবে। এখন তার হাতেই সব সৈন্যসামন্ত ও ধনরত্ন। 
যুধিষ্ঠির এখন নির্ধন ও নির্সৈন্য –তাই এভাবে যুদ্ধে হার অবসম্ভাবী। এ কারণে দুর্যোধনের সাথে বিবাদ করে এখন লাভ নেই। 
তিনি বলেন – তার চেয়ে আমরা সাবধানে এই গৃহেই বাস করব এবং সকল অভিসন্ধি যে আমরা জানি তা কাউকে বুঝতে দেব না। পাঁচভাই কখনই একস্থানে একত্রে অবস্থান করব না, সুযোগ পেলে অবশ্যই আমরা এখান থেকে পালাবো। বনে মৃগয়া করে আমরা থাকবো। এভাবে আমাদের পথ-ঘাট-বন-উপবন সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান হবে। 
এভাবে তারা যে সব জেনে গেছে তা গোপন করে খুব সতর্ক ভাবে বারণাবতে বাস করতে লাগলেন। 

 
বিদুর 

এদিকে হস্তিনানগরে বিদুর পঞ্চপান্ডবদের জন্য চিন্তিত হয়ে উঠলেন। তিনি অনেক ভেবেও পঞ্চপান্ডবরা জতুগৃহ থেকে কি ভাবে আত্মরক্ষা করবে তা ভেবে পেলেন না। তার অনুশোচনা হতে লাগল। 
শেষে অনেক বিচার বিবেচনা করে তিনি তার অতি বিশ্বস্থ এক সুরঙ্গ খনককে ডেকে পাঠালেন। বিদুর তাকে বিপদের সকল কথা বললেন এবং পঞ্চপান্ডবদের সুরঙ্গের মাধ্যমে জতুগৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার জন্য তার সাহায্য চাইলেন। 
খনক দ্রুত বারণাবতে গেল এবং যুধিষ্ঠিরের কাছে বিদুরের সকল কথা জানাল। শেষে এও জানাল সে বিদুরের কথা মত যুধিষ্ঠিরের কাছে যুধিষ্ঠিরের লোক না বলে ছদ্মবেশে এসেছে এবং যুধিষ্ঠির যাতে তাকে বিশ্বাস করেন সে কারণে বিদুর তাকে বিদায় কালে যে ম্লেচ্ছ ভাষায় গুঢ় কথা বলেছিলেন তাও জানায়। 
যুধিষ্ঠির সকল কথা শুনে নিশ্চিন্ত হলেন। বিদুর যখন খনককে সকল কথা জানিয়ে তাদের রক্ষা করতে পাঠিয়েছেন তখন এই খনকও যে তাদের কাছে বিদুরের মতই প্রণম্য তাও জানালেন। 
এরপর যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের দুষ্ট বুদ্ধির পরিচয় দিতে লাগলেন। বাঁশের জতুগৃহের উপর স্বর্ণের আবরণ, গৃহের চারদিকে অস্ত্রের ঘর, প্রাসাদের বাইরে গভীর খাদ-যা পান্ডবদের পলায়নে বাঁধা হয়ে আছে। অন্য দিকে পুরোচন নিজে চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে দ্বার পাহারা দিচ্ছে। 
শেষে যুধিষ্ঠির খনককে অনুরোধ করলেন এমন ভাবে তিনি তাদের ছয়জনকে উদ্ধার করুন যাতে এ বিষয়ে কেউ কিছু না যানতে পারে। 
সব দেখে শুনে খনক ঘরের ভিতর থেকেই গর্ত খুঁড়তে শুরু করল। সুরঙ্গের মুখে সুন্দর কপাট বসাল এবং তার উপর মাটি দিয়ে সমানও করে দিল, উপর থেকে আর কিছুই বোঝা গেল না। প্রাসাদের চতুরদিকে গভীর গর্ত ছিল খনক তার চেয়েও গভীর সুরঙ্গ খনন করতে লাগল। শেষে গঙ্গাতীর পর্যন্ত খনক খনি তৈরী করল। 
কার্য সম্পূর্ণ করে সে পান্ডবদের কাছে পথের নির্দেশ দিল। শুনে পঞ্চপান্ডব খুবই খুশি হলেন। তাদের প্রণাম করে খনক নিজের গৃহে ফিরে গেল। যাবার পূর্বে বিদুরের নির্দেশ মত এও জানিয়ে গেল যে চতুর্দশীর রাত্রে পুরোচন প্রাসাদে অগ্নি সংযোগ করবে, সে জন্য তাদের ছয়জনকে অতি সাবধানে থাকতে হবে। এত বলে খনক চলে গেল। এ সকল কথা কেবল পান্ডবরা ছয়জনে জানল। 


জতুগৃহ

পঞ্চপান্ডবরা মৃগয়া করে বেড়াতে লাগল। এভাবে এক বছর কেটে গেল। এদিকে তাদের দেখে পুরোচনের সম্পূর্ণ বিশ্বাস হল পান্ডবরা তাকে খুব বিশ্বাস করেছে। এতে সে খুব খুশিও হল। 
পুরোচনের মন বুঝে যুধিষ্ঠির ভাইদের ডেকে বললেন আমাদের আজ সাবধানে থাকতে হবে কারণ আজ রাতেই পুরোচন গৃহে আগুন দেবে। বিদুরের কথা তাদের মনে পড়ল। 
ভীম বললেন দিনে সাহস নেই তাই রাতে দুর্যোধন অসৎ পথে তাদের হত্যা করতে চায়, অবশ্যই তার ফল সে পাবে। 

সব শুনে কুন্তী চিন্তিত হলেন। বনে বনে কোথায় পালিয়ে বেড়াতে হবে ভেবে তিনি ভয় পেলেন। শেষে পুত্রদের বললেন আজ তিনি ভাল ভাবে ব্রাহ্মণ ভোজন করাতে চান। মাতার আজ্ঞায় পান্ডবরা ক্ষুধিত ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ করে আনলেন এবং বহু ধন দিলেন। কুন্তীও প্রাণ ভরে তাদের ভোজন করালেন। ব্রাহ্মণদের ভোজন হয়ে গেলে যত দুঃখী মানুষ আছে তাদের কুন্তীদেবী ভোজন করালেন। এদের মধ্যে এক নিষাদ গৃহিনী তার পাঁচ পুত্রকে নিয়ে উপস্থিত হল। পুত্রদের দেখে কুন্তী সেই নিষাদ গৃহিনীর কাছে তাদের দুঃখের কথা শুনলেন। তার দুঃখে কুন্তীদেবীও দুঃখিত হলেন। তাদের আশ্রয় নেই তাই সেখানেই তারা থেকে গেল। ধিরে ধিরে সূর্য অস্ত গেল এবং যথা সময় সকলে শয়ন করতে গেল।
....................................

Tuesday, July 1, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৫৯

যুধিষ্ঠিরের যৌবরাজ্যে অভিষেকঃ 
 

মুনি বলেন, রাজা অবধান কর, তোমার পিতামহের উপাখ্যান।
রাজা ধৃতরাষ্ট্র বিধান বুঝে যুবরাজ ঘোষণায় অনুমতি দিলেন। কুরুকুলের জৈষ্ঠ হলেন কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির। ধর্মশীল ধীর এই রাজকুমারকে সকলে ভালবাসতেন। যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজরূপে অভিষেক করা হলে সমাজে সকলে প্রীত হলেন। যুধিষ্ঠিরের সৌজন্যে সকলে বশেও থাকল। পৃথিবীর চারদিকে ধর্মপুত্রের যশ ছরিয়ে পড়ল। বৃকোদর(যার উদরে বৃক বা জঠরাগ্নি আছে, বহুভোজী) ভীম বলরামের কাছে অসিযুদ্ধ গদাযুদ্ধ ও রথযুদ্ধ শিখলেন। অর্জুন নানাবিধ অস্ত্রের প্রয়োগে পটুতা লাভ করলেন। সহদেব সর্ব প্রকার নীতিশাস্ত্রে অভিজ্ঞ হলেন। দ্রোণের শিক্ষার ফলে নকুলও অতিরথ(যিনি অসংখ্য শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারেন) এবং চিত্রযোধী(বিচিত্র যুদ্ধকারী) নামে খ্যাত হলেন। 

ভীম ও অর্জুন দুই ভাই রাজার আজ্ঞায় চারদিকের রাজাদের শাসন করে বেড়ান। বহু রাজাদের সাথে তাদের যুদ্ধ হল এবং এত রাজ্য জয় করলেন যে তাদের নাম বলে শেষ করা যাবে না। উত্তর পশ্চিম পূর্ব জম্মুদ্বীপ প্রভৃতি থেকে দু’জনে বহু রত্ন জিতে আনলেন। পূর্বে কুরুকুলের পক্ষে যা যা অসাধ্য ছিল ভীমার্জুন দুইভাই তাই আয়ত্ত করলেন। নানা রত্নে হস্তিনানগর পূর্ণ হল, পৃথিবীতে দুই সহোদর ভাইদের যশ ছরিয়ে পড়ল। সহদেবও মন্ত্রী হয়ে ভুবনে নাম করলেন। তিনি দেবগুরুর আরাধনা করে সর্বজ্ঞ হলেন। নকুলও দুর্জয় যোদ্ধা, সর্বগুণ সম্পন্ন এবং ধীর। কৌরবকুমারদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর শরীরের অধিকারী। পান্ডবদের প্রশংসায় পৃথিবীর সকলে মুখরিত হল। কুরুকুলের অন্য রাজপুরুষরা পান্ডবদের কাছে ম্লান হয়ে গেল। দিনে দিনে পান্ডবদে গৌরব শুক্লপক্ষের শশীর মত বাড়তেই থাকল। পান্ডবদের বীরগাঁথা মানুষ দিনরাত গাইতে লাগলো। 

এতসব শুনে ধৃতরাষ্ট্র বিষণ্ণ হলেন। পান্ডবদের যশ দিন দিন বাড়তেই থাকল। বিধির লিখন কেউই খন্ডন করত পারে না। তবু অন্ধ রাজা মনে মনে ভয় পেলেন। কারণ তার পুত্রদের কথা কেউ বলেই না। পান্ডবরাই যেন পৃথিবীর মন জয় করেছে। এসব ভেবে ভেবে তার নিদ্রা গেল, আহারের রুচি নেই। তখন তিনি কুরুবংশের অতি বৃদ্ধ এক মন্ত্রী নাম কণিক-যিনি জাতে ব্রাহ্মণ, তাকে ডেকে পাঠালেন। 

একান্তে কণিককে ডেকে তিনি বললেন -পরম বিশ্বাস করি বলেই তোমায় ডেকে পাঠালাম। দিনরাত আমার অন্তরে একটু সুখ নেই, তোমার মন্ত্রণা বলেই আমি এই দুঃখ খন্ডন করতে চাই। পান্ডবদের যশের কীর্তি দিনে দিনে যত বাড়ছে আমার চিত্তও ততই আশঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠছে। এর কি উপায় আছে তুমি বলো। 

কণিক বলে -যদি আমার কথা শুন তা হলে এই দুশ্চিন্তা খন্ডাবে। 
ধৃতরাষ্ট্র বলেন তিনি অবশ্যই কণিকের পরামর্শ শুনবেন।

তখন কণিক রাজাকে প্রকৃত রাজনীতি কি তা বোঝাল। শাস্ত্রে এমন বিহিত আছে- কাজ না থাকলেও দন্ড দেবে। সকলকে নিজের বশে রাখবে। নিজের ভুল সব সময় পরম যত্নে লুকাবে। পরের ভুল অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে ধরবে। 
রাজা বুঝে শুনে কাজ করবেন-কখনও গোপন করবেন, কখনও সব ব্যক্ত করবেন- যখন যেমন দরকার। শত্রুকে দুর্বল দেখেও দয়া করবেন না। শত্রু শরণ নিলেও রক্ষা করবেন না। শত্রুকে বালক দেখেও সাহায্য করবেন না। ব্যাধি, আগুন, রিপু, জল সবই এক ও সমান। তবে শত্রুকে যখন শক্তিশালী দেখবে তখন তার প্রতি বিনয় দেখাবে। বহু ক্লেশ হলেও অপমান সহ্য করে নেবে। সব সময় তাকে কাঁধে চড়িয়ে রাখবে অর্থাৎ যত্নবান হবে। তবে সময় পেলেই তাকে সেখান থেকে টেনে আছড়ে মাটিতে ফেলবে। 

এ প্রসঙ্গে একটি পূর্বের কাহিনী বলি রাজা ভাল করে শুনুন।–
বনেতে সবচেয়ে বিজ্ঞ হল শেয়াল। বনে সিংহ, বাঘ, বেজি, ইদুঁর ও শেয়াল- পাঁচজনে বহুদিন বন্ধু হয়ে বাস করে। একদিন বনে একটি হরিণী চরছিল। সে গর্ভবতী হওয়ায় তার শরীরে অনেক মাংস। শেয়াল দেখে হরিণীর ঈশ্বর তাকে সাহায্য করলেন ফলে সিংহও বহু চেষ্টা করে তাকে ধরতে পারল না। শেয়াল তখন বন্ধুদের ডেকে বলল, আমার কথা মন দিয়ে শোন তা হলেই আমরা হরিণ ধরতে পারব। শক্তিতে যখন একে ধরতে পারছি না তখন ইদুঁরের মাধ্যমেই এর প্রাণ নেব। শ্রান্ত হয়ে হরিণী অবশ্যই কোথাও শোবে। তখন ইদুঁর সেখানে লুকিয়ে ধিরে ধিরে যাবে। দুর থেকে সুরঙ্গ করে সে হরিণের কাছে যাবে। খুব নিঃশব্দে যেতে হবে যাতে হরিণী না যানতে পারে। সুরঙ্গ শেষ হবে হরিণের পায়ের কাছে। ইদুঁর সুরঙ্গ থেকে বেরিয়েই হরিণের পায়ের শির কেটে দেবে। পায়ের শির কাটা গেলে হরিণ অশক্ত হবে। তখন সহজেই সিংহ তাকে বধ করবে। এত শুনে সবাই রাজি হল। শেয়াল যা নির্দেশ দিল সকলেই তা পালন করল। ইদুঁরের দংশনে হরিণের পায়ের শির কাটা গেল। হীনশক্তি দেখে সিংহ তাকে ধরে ফেলল। হরিণ মারা পরতে সকলে আনন্দিত হল। কিন্তু শেয়াল মনে মনে অন্য চিন্তা শুরু করল। মনে মনে সে ভাবল আমার বুদ্ধিতেই হরিণ মরল, কিন্তু সিংহ আর বাঘ মাংস খাবার পর আমি আর কতটুকু পাব। খেতে হলে আমি পুর মাংসই খাব এবং তার জন্য যা করতে হয় তাই করব। এই ভেবে শেয়াল যোড়হাত করে সবার কাছে গিয়ে বলল দেখ দৈবযোগে আজ হরিণ মরল তাই প্রথমে পিতৃলোকে মাংস শ্রাদ্ধ দেওয়া উচিত। স্নান করে সবাই আগে শুদ্ধ হয়ে এস ততক্ষণ আমি হরিণকে লক্ষ রাখছি। বুদ্ধিমান শেয়ালের কথা শুনে সকলে স্নান করতে গেল। 
সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও বলিষ্ঠ সিংহ দ্রুত স্নান করে চলে এল। সিংহ এসে দেখে শেয়াল বিরস বদনে বসে আছে। সে শেয়ালকে বিরস বদনের কারণ জিজ্ঞেস করল এবং তাকে দ্রুত স্নান করে আসতে বলল। 
শৃগাল সিংহকে বন্ধু সম্বোধন করে বলল, কি বলি বন্ধু ইদুঁরের কথা শুনে আমি বড়ই ব্যথা পেলাম। যখন তুমি স্নানে গেলে তখন সে তোমার নামে যে কুবচন করল তা বলতেও আমার লজ্জা হয়। ইদুঁর বলল সকলে সিংহকে বীর বলে অথচ আমি হরিণ মারলাম আর তাই সিংহ খাবে। 
শুনে সিংহ দুঃখিত হল। অভিমান করে বলল –কি ছার ইদুঁর! তার এত সাহস! আমি কিছুতেই ঐ মাংস খাব না। নিজের বীর্য্যে হরিণ এখনই ধরে আমি খাব। যে এমন অন্যায় বাক্য বলতে পারে তার মুখও আমি আর দেখব না। নিজের অর্জিত বস্তু আমি নিজেই ভক্ষণ করব। এত বলে সিংহ ঘন বনে ঢুকে গেল। 
এরপর স্নান করে বাঘ সেখানে উপস্থিত হল। আস্তে আস্তে শিয়াল তার কাছে গিয়ে বলল -প্রাণসখা শুন তোমার ভাগ্য ভাল এখনই তোমার সিংহের সাথে দেখা হল না। সে তোমার উপর খুব রেগে আছে, হয়ত তোমার নামে কেউ তাকে কিছু বলে থাকবে। এখনই সে তোমাকে ধরতে গেল। আমাকে বলে গেল যেন একথা আমি তোমায় না জানাই। কিন্তু আমার প্রিয় বন্ধু তোমায় না বলে আমি থাকতে পারলাম না, এবার তুমি কি করবে ভেবে দেখ। 
শেয়ালের কথা শুনে বাঘ অবাক হল এবং ভাবল কি জানি কি ভাবে আমি সিংহের কি ক্ষতি করলাম যে সে আমায় ধরতে চায়। কি করবে কোথা যাবে সে ভেবে অস্থির হল। তবে এ স্থান অবশ্যই নিরাপদ নয়, এখনই হয়ত সিংহ ঘুরে চলে আসবে-এই ভেবে বাঘ দ্রুত ঘোর বনে প্রবেশ করে আত্মগোপন করল। 
এসময় ইদুঁর সেখানে এল। তাকে দেখে শেয়াল কান্না জুড়ে দিল। কাঁদতে কাঁদতে ইদুঁরকে জড়িয়ে ধরে প্রলাপ করে বলল -বন্ধু নকুলের(বেজি) কি দুর্মতি হল সে নিজের পূর্ব প্রকৃতি এখনও ছাড়তে পারেনি। হঠাৎ তার সাপের সাথে দেখা হল। যুদ্ধে তার কাছে হেরে তাকেও বন্ধু করে নিল। স্নান করে এখানে দু’জনে উপস্থিত হল। বেজি সাপকেও মাংসের ভাগ দিতে হবে বলল। অথচ আমরা পাঁচজন মিলে হরিণ মারলাম। তাই আমি সাপকে ভাগ দিতে না চাইলে সে রেগে গেল এবং তোমাকে ধরে খেতে বলল। এখন বেজি ও সাপ তোমায় খুঁজতে গেছে। আমাকেও বলে গেছে তুমি এলে যেন তোমায় ধরি। এত শুনে ইদুঁরের প্রাণ উড়ে গেল। দ্রুত সে পালিয়ে অন্য স্থানে চলে গেল। 
তখন বেজি সেখানে উপস্থিত হল। তাকে দেখে শেয়াল ক্রোধের সঙ্গে বলল -দেখ সিংহ, বাঘ আর ইদুঁরের সাথে আমার যুদ্ধ হল। তারা হেরে পালিয়েছে বনে। তোমার যদি শক্তি থাকে তা হলে আমার সাথে এসে যুদ্ধ কর, নয় প্রাণ নিয়ে পালাও। বেজি শেয়ালের চেয়ে ছোট ও দুর্বল। সহজেই সে ভয়ে পালিয়ে গেল।
এভাবে শেয়াল বুদ্ধি দিয়ে চারজনকে চারভাবে ঠকিয়ে নিজেই পুর মাংস খেল। 

কণিক আরো বললে -রাজা ভাল করে শুনুন এভাবেই রাজা রাজ্যবান হন। বলিষ্ঠকে বুদ্ধিতে জিতে মারবে। লোভিকে ধন দিয়ে ছলনা করে মারবে। শত্রুকে কোন ভাবে পেলে অবশ্যই ছাড়বে না। বিশ্বাস জন্মিয়ে বিপক্ষকে মারবে। সব সময় মনে রাখবে শত্রু তোমার জীবনের বৈরী। তাকে যেকোন প্রকারে মারতে হবে। ছলে–বলে–কৌশলে শত্রুকে যমের বাড়ি পাঠাতেই হবে। বেদেও এমন বিচার আছে। সেখানেও বলে বিশ্বাস জন্মিয়ে শত্রুকে মারা যায়। ভার্গব(পরশুরাম)ও বলেন এতে পাপ নেই। শত্রুকে বিশ্বাস করে পালন করলে তার গর্ভেই তোমার বিনাশ হবে। এসব ভাল ভাবে বুঝে রাজা উপায় বার করুন। এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরে দুঃখই পাবেন। এত বলে কণিক নিজের গৃহে ফিরে গেল।

অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্র গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। 

ভারতের পূণ্যকথা শুনলে পবিত্র হবে। কাশীরাম দাস সেই অদ্ভূত কাহিনীই বর্ণনা করেছেন।
....................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers