Blog Archive

Sunday, November 29, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৩

[পূর্বকথা - সুভদ্রা বিবাহ-কারণে সত্যভামার মহাচিন্তা শুরু হল ..... কৃষ্ণের মত জেনে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা নিলেন সুভদ্রাকে বিবাহের .....অন্যদিকে বলরাম হস্তিনায় দূত প্রেরণ করে দুর্যোধনে বিবাহের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন ...দুর্যোধন আনন্দে বরবেশে দ্বারকায় গমন করল...যুধিষ্ঠির ও সংবাদে আশ্চর্য হলেও ভীমকে সাথে যেতে আজ্ঞা দিলেন...কৃষ্ণের কথা মত অর্জুন সরস্বতীর তীর থেকে সুভদ্রাকে হরণ করলেন... ] 

যাদবগণের অর্জ্জুনের পশ্চাদ্ধাবনঃ



গদ, শাম্ব, চারুদেষ্ণ, সাত্যকি, সারণ প্রমুখ বীর তাদের রথ পবনের গতিতে চালিয়ে দিল। 
যদুবীররা উচ্চস্বরে অর্জুনকে বলতে থাকে –পালিও না, হে অর্জুন! আমাদের কথা শোন। 

শুনে অর্জুন সারথি দারুককে বলেন –হে দারুক, রথের মুখ ফেরান। ক্ষত্রিয়েরা ডাকছে, তাদের প্রবোধ না দিয়ে যেতে পারব না। 

দারুক বলে –পার্থ একি অদ্ভুত কথা বলছেন! গোবিন্দের চেয়েও গোবিন্দের সন্তানদের কথা বেশি শুনচ্ছেন! পিছনে দেখুন অপ্রমিত, পরাক্রমী, ত্রৈলোক্য অজেয় সেনাবাহিনী। এদের সাথে আপনার একা যুদ্ধ করা ঠিক হবে না। ক্ষত্রনীতিতেও বলে সময় বুঝে যুদ্ধ করা উচিত। আমি রথ ফেরাতে পারব না। আপনি যেখানে যেতে চান নিয়ে যাব। বলুন এখন ইন্দ্রপ্রস্থে রথ নেব, না ইন্দ্রের নগরে যাব। কুবের, বরুণ, যম, ইন্দ্রের সদন যেখানেই বলবেন সেখানেই যেতে পারি। কিন্তু রথের মুখ ঘোরাতে পারব না। আর কি ভাবে যাদবদের সাথে যুদ্ধ করাব! কৃষ্ণের এই রথে চড়ে কৃষ্ণপুত্রদের মারতে দিতে আমি পারি না।

পার্থ বলেন –দারুক, এ উচিত কার্য নয়। তারা যুদ্ধের জন্য আমায় ডাকছে। ক্ষত্রধর্ম অনুসারে আমি এখন পালাতে পারি না। তাঁর উপর এরা যে আমায় তাড়া করেছে। এখন পালালে এই অপযশ পৃথিবীতে প্রচার হবে যে শৃগালের মত আমি পালিয়েছি। কৃষ্ণপুত্র আসুক কিংবা স্বয়ং কৃষ্ণ অথবা যুধিষ্ঠির বা ভীম যুদ্ধক্ষেত্রে যিনি আমায় যুদ্ধে ডাকবেন ক্ষত্রধর্ম অনুসারেই আমি তাঁর সাথে সংগ্রাম করব। 
আমি জানি তুমি যদুকুলের হিত চাইবে। এখন আর তোমার সারথি কর্ম সম্ভব নয় বুঝেছি। প্রবোধ দেওয়া বন্ধ কর, ছাড় কড়িয়ালি(বলগার কড়া যা ঘোড়ার মুখে থাকে)। আমি নিজেই রথ চালিয়ে যুদ্ধ করব, তুমি সরে যাও। 

এই বলে পার্থ নিজেই রথের রশি কেড়ে নিয়ে ডান দিকের রথস্তম্ভে দারুককে বাঁধলেন। এক পায়ে কড়িয়ালি, অন্য পায়ে বাড়ি(লাঠি/দন্ড) আর হাতে তুলে নিলেন ধনুর্গুণ। 

সুভদ্রা বলেন –হে মহাবীর, এত কষ্ট কেন করছেন। আজ্ঞা করুন আমি ঘোড়াদের চালাই। এই রথে আমি সত্যভামা, রুক্মিণীর সাথে তিনপুর ভ্রমণ করতাম। সত্যভামা স্নেহ করে সব সময় আমায় সঙ্গে নিতেন। আমিই তাঁর সারথি হয়ে রথ চালাতাম। আমার নৈপুণ্য দেখে দেব দামোদর কৃষ্ণ কত ধন্য ধন্য করতেন! আজ্ঞা করুন কোন পথে রথ চালাতে হবে। 
এই বলে ভদ্রা কাড়িয়ালি হাত বাড়িয়ে নিয়ে বায়ুবেগে রথ চালালেন। চোখের নিমেষে রথ আদিত্যমন্ডলে গেল। সেখান থেকে ভদ্রা হয়বর(ঘোড়াদের) সৈন্যদের প্রদক্ষিণ করে নিয়ে এলেন। রথের চঞ্চল গতি অতি মনোহর, দেখে মনে হয় যেন সৈন্য মাঝে নর্তকী নাচ করছে। বিদ্যুৎবরণী ভদ্রা, পার্থ জলধর। বিদ্যুতের মত তিনি যেন মেঘে প্রবেশ করেন। 

দেখতে দেখতে যাদববীররা মুর্চ্ছিত হয়ে রথে পরে গেল। পার্থ ধনুর্ধর অনেক সেনা মারলেন। কোটি কোটি রথী মারা পরল, অসংখ্য কুঞ্জর(হাতি) কাটা পরল। রক্তের নদী বয়ে গেল। সকলে তাতে সাঁতার কাটে। 

পার্থকে কালরূপে দেখে সকলে ভয় পেল। কামদেব ও সারণ বিচার বিবেচনা করে বলরামের কাছে দূত প্রেরণ করল। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরামদাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।
......................................

Sunday, November 22, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১২

[পূর্বকথা সুভদ্রা বিবাহ-কারণে সত্যভামার মহাচিন্তা শুরু হল ..... কৃষ্ণের মত জেনে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা নিলেন সুভদ্রাকে বিবাহের .....অন্যদিকে বলরাম হস্তিনায় দূত প্রেরণ করে দুর্যোধনে বিবাহের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন ...দুর্যোধন আনন্দে বরবেশে দ্বারকায় গমন করল...যুধিষ্ঠির ও সংবাদে আশ্চর্য হলেও ভীমকে সাথে যেতে আজ্ঞা দিলেন...] 

অর্জ্জুনের সুভদ্রা হরণঃ 



বলরামের আজ্ঞা পেয়ে সব নারীরা পিটালি(চালগুঁড়ো গোলা), হরিদ্রা(হলুদ) নিয়ে উদ্ধর্ত্তন(মাখান) শুভকর্ম শুরু করল। 
ভদ্রার চুলে আমলকী সুগন্ধী তেল মাখান হল। স্নান করাতে তাকে সরস্বতী নদীর কূলে নিয়ে চলল। 
কৃষ্ণের আজ্ঞা পেয়ে দেবী সত্যভামা অনেক যুবতীর সাথে ভদ্রাকে নিয়ে চললেন। 

অর্জুনকে ডেকে কৃষ্ণ বলেন –শুনেছ তো দুর্যোধন কি বলে পাঠাল। বলরাম আজ অধিবাস করাতে বলছেন। সেই কারণে আজ ভদ্রাকে সরস্বতী নদীতে স্নানে পাঠালাম। আমার রথ নিয়ে তুমি ছলনা করে মৃগয়ায় যাও। সেই পথ ধরে ভদ্রাকে নিয়ে পালাও। 

কৃষ্ণ তার সারথী দারুককে ডেকে ইঙ্গিতে বলেন –অর্জুনকে নিয়ে তুমি আমার রথে যাও। অর্জুনের আজ্ঞা পালন করবে। যেখানে রথ নিয়ে যেতে বলবে, সেখানেই যাবে। 
কৃষ্ণের আজ্ঞা পেয়ে দারুক দ্রুত কৃষ্ণের রথ সাজিয়ে অর্জুনের সামনে হাজির হল। 
অর্জুন সুসজ্জিত হয়ে রথে উঠলেন। সঙ্গে ধনুঃশর, খড়্গ, ছুরী, গদা, শূল, চক্র নিলেন। 

কৃষ্ণরথে আরোহণ করে মহাবীর অর্জুন সরস্বতীর তীরের উদ্দেশ্যে চললেন। সুভদ্রা যেখানে নারীদের মাঝে স্নান করছিলেন সেখানে পার্থ ধিরে ধিরে পদব্রজে গেলেন। ভদ্রাকে ধরে রথে তুলে ইন্দ্রপ্রস্থের পথে ছুটলেন। 

অন্যান্য যুবতীরা হাহাকার করতে লাগল –‘কুন্তীপুত্র সুভদ্রা হরণ করল’-রব উঠল। 
শব্দ শুনে সভাপালরা দৌড়ে এল। ‘ধর, ধর’ বলে তারা অর্জুনকে তাড়া করল –আরে পার্থ তোমার কি মতিচ্ছন্ন হল! কোন সাহসে তুমি এমন ঘরে চুরি করলে! পালিয়ে যেও না! 
বলে সকলে দৌড়াতে লাগল। সিংহকে দেখে যেন শৃগালরা ডাক ছারল। পার্থ ধনুকে গুণ দিয়ে শরজালে সহজেই নিমেষে তিন লক্ষ সভাপালকে কাটল। সভাপালদের মেরে রথ চালিয়ে পার্থ দশ ক্রোশ পথ নিমেষে চলে গেলেন। 

সুভদ্রার হরণ বার্তা শুনে সবাই পিছু তাড়া করতে গেল। যদুরা কেউ স্নান করছিল, কেউবা দান, ভোজন, শয়নে ব্যস্ত ছিল। সকলে এই সংবাদ শুনে তখনই সব কাজ ফেলে দৌড়াল। 

কামপাল বলরাম ক্রোধে কাঁপতে থাকেন। দুই চোখ যেন স্ফুটিত কোকনদ(লালপদ্ম)। চারদিকে ‘ধর, ধর’ রব। 
বলরামও যাকে সামনে পান তাকেই ‘ধর গিয়ে’ আজ্ঞা দেন। কাঁপতে কাঁপতে তিনি নীলধ্বজে উঠলেন। সঙ্গে তাঁর সাতকোটি রথ ও গজ চলল। 
বলরামের আজ্ঞা পেয়ে সবার আগে কাম(কৃষ্ণ পুত্র) চললেন। সারণ(কৃষ্ণের বৈমাত্রের ভাই) এলেন সাত কোটি রথী নিয়ে। গজ, অশ্ব, পদাতিক নিয়ে কৃপ, বৃন্দ, উপগদ, কৃতবর্মা প্রমুখ যদুবীররা এল। গদ, শাম্ব(কৃষ্ণ পুত্র)ও বহু সেনা নিয়ে এল। বলরামের আজ্ঞা পেয়ে সবাই অর্জুনকে ধরতে দৌড়াল। 

হলধর –‘ধর গিয়া’ বলামাত্র সারণ বীর সসৈন্য সত্বর চলল। উগ্রসেন, বসুদেব, সাত্যকি, উদ্ধব প্রমুখ বীররা বলরামের কাছে এলেন। ক্রোধে বলরামের শরীর থরথর কাঁপতে থাকে। শরীর ফুলে ফুলে পর্বতের আকার নেয়। প্রলয় মেঘের মত শব্দ হতে থাকে তাঁর গলা দিয়ে। শরীর থেকে তাঁর মালা ছিঁড়ে পরে। 

বলরাম ক্রোধের সাথে বলেন – পান্ডবের এত গর্ব হল! শ্বা(কুকুর) হয়ে যজ্ঞহবি(যজ্ঞের ফল) নেওয়ার সাধ! চন্ডাল হয়ে ব্রাহ্মণী পাওয়ার ইচ্ছে! গরুড়কে ভুলে যেমন কালফণী মাথা তোলে, তেমনি এর আচরণ! যে পুরীতে চন্দ্র, সূর্য, বায়ুর তেজ ধিরে চলে, যেখানে শমনের(যম)ও আসার শক্তি নেই, সেখান থেকে আমার বোনকে চুরি করে নিয়ে গেল। ঐ দুরাচারের নিশ্চয়ই মতিচ্ছন্ন হয়েছে। এই দোষে তাকে আজ সমূলে মারব। বংশে বাতি দেওয়ার কেউ থাকবে না। তাঁর বংশে যে যে আছে সকলকে মারব। পৃথিবী খুঁড়ে আজ তাদের বংশ ধ্বংস করব। ইন্দ্রপ্রস্থের মাটি আজ লাঙ্গল চালিয়ে উল্টে দেব সমুদ্রের জলে। দেখি আজ আমার শত্রুকে কে রক্ষা করতে পারে। ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ, পঞ্চানন কেউ আজ পাণ্ডবদের রক্ষা করতে পারবে না। আমি পাণ্ডবদের মন্দ রীতিনীতির কথা সব জানি। 
কৃষ্ণ সে সব না জেনেই তাদের প্রতি সখ্যতা দেখায়। তাদের উপর সব সময় প্রীত থাকে। সেই প্রীতির ফলেই অর্জুনকে অন্তঃপুরে থাকতে দিলেন। সে জন্যই আজ এতবড় অপমান হল। যত স্নেহ করা হল তার গুণ শোধ করল। বোনকে চুরি করে কুলের মুখে চুন কালি দিল। এর প্রতিফল দুষ্ট আজই পাবে। 

এই বলে রাম সুসজ্জিত হয়ে বের হলেন। বাম হাতে লাঙ্গল ধরলেন, ডান হাতে মুষল(মুদ্গর, মুগুর/গদা)। দেখে তাকে মনে হল বজ্র হাতে ইন্দ্র যেন উপস্থিত হয়েছেন। 

কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে দূত পাঠালেন –এসে দেখ তোমার প্রিয় সখার কুকর্ম! 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীদাস কহেন সাধুজন সদা করেন পান। 
......................................

Sunday, November 15, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১১

[পূর্বকথা দুর্যোধনের কন্যা লক্ষণার স্বয়ম্বর হলে, কৃষ্ণ পুত্র শাম্ব তাকে হরণ করেন...কর্ণের সাহায্যে তাকে বন্দি করা হয়...নারদের মুখে পুত্রের দুর্দশার সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণ ক্রোধে যুদ্ধে যাত্রা করতে গেলে বলরাম তাকে নিরস্ত করে নিজে যান…কিন্তু দুর্যোধন শাম্বকে ছাড়তে না চাইলে ক্রোধে বলরাম হস্তিনানগর ধ্বংসে উদ্যত হন…তখন দুর্যোধন ভয়ে কন্যা লক্ষণা ও জামাতা শাম্বকে বলরামের হাতে তুলে দেন…এদিকে সুভদ্রা বিবাহ-কারণে সত্যভামার মহাচিন্তা শুরু হল ..... কৃষ্ণের মত জেনে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা নিলেন সুভদ্রাকে বিবাহের .....অন্যদিকে বলরাম হস্তিনায় দূত প্রেরণ করে দুর্যোধনে বিবাহের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন ......]

দুর্যোধনের বরবেশে দ্বারকায় গমনঃ 



দুর্যোধন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের কাছে দূত পাঠাল –আপনারা সকলে সপরিবারে আমার বিবাহে আসবেন। 

পত্র পেয়ে যুধিষ্ঠির অবাক হলেন। তিনি সহদেবকে বলেন –অর্জুন আগে লিখে জানাল সুভদ্রার কথা। দুর্যোধন আবার এখন সেই ভদ্রাকে বিবাহ করতে চলেছে। এযে অসম্ভব ব্যাপার! একিভাবে সম্ভব সহদেব, কিছু বল! 

সহদেব বলেন –শুনুন নরনাথ! সুভদ্রার সাথে অর্জুনের সাতদিন আগেই বিবাহ হয়ে গেছে। সত্যভামা লুকিয়ে এই বিবাহ দিয়েছেন। কৃষ্ণের আজ্ঞায় বলরামকে সে কথা জানান হয়নি। বলরামের ইচ্ছে ভদ্রাকে দুর্যোধনের হাতে দেবেন। তাই রামের অনুরোধে দুর্যোধন চলেছে। এর উচিত বিধান আপনাকেই করতে হবে, মহারাজ! এ নিয়ে বেশি চিন্তা করবেন না। 

যুধিষ্ঠির বলেন –এতো লজ্জার বিষয়। আমার সেখানে যাওয়া উচিত হবে না। কেউ না গেলে রাজা দুর্যোধন দুঃখী হবে। 
সে কারণে যুধিষ্ঠির ভীমকে সসৈন্য যাত্রার আজ্ঞা দিলেন। 

রাজার আজ্ঞা পেয়ে বীর বৃকোদর ভীম পাঁচ অক্ষৌহিণীর দল নিয়ে দ্রুত রওনা হলেন। 

আনন্দে দুর্যোধন বরবেশে সেজে ওঠে। রত্নময় চতুর্দোলায় আরোহণ করে। নানা শব্দে বাদ্য বাজতে থাকে। হয়(ঘোড়া), হাতি, রথ, সেনা অগণন চলতে থাকে। 

দুর্যোধনের বরবেশ দেখে ভীম রেগে বলেন –আরে অবোধ! এখান থেকে দ্বারকা তো বহু দূর। এখান থেকে বরবেশে যাত্রার কি আছে! 

দুঃশাসন বলে –এতে কি দোষ হল! সুন্দর সজ্জা যদি সহ্য না হয় তবে আমাদের পিছু পিছু এস। 

ভীম বলেন –ভাল কি মন্দ তা শেষে বুঝবে। কোন কন্যাকে বরবেশে বিবাহ করতে চলেছ! তোমাদের কাছে দূত দেরিতে গেছে। সুভদ্রার বিবাহ আজ এক সপ্তাহ আগেই হয়ে গেছে। অকারণে সভার মাঝে বরবেশে গিয়ে লজ্জা পাবে। তাই ও বেশের দরকার নেই বলছিলাম। পিছু পিছু কেন যাব, আমি বরং এগিয়ে চলি। 
এই বলে সসৈন্য বীর ভীম বেগের সাথে এগিয়ে গেলেন।

ভীমের কথা শুনে শকুনি, কর্ণ সহ দুর্যোধন বিস্মিত হল। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর পরস্পরের মধ্যে কানাকানি করতে থাকেন। 

দুঃশাসন বলে –বৃকোদর এমন ভাবে কথা গুলো বলে গেল যেন সবই সত্য। তোমরা কি যান না ভীমের দুষ্ট বুদ্ধি! দুর্যোধনকে বরবেশে দেখে তার হিংসা হয়েছে। তাই বাতুলের(ক্ষেপা) মত যা মুখ এল তাই বলে গেল। বুকে শেল বেজেছে তাই এত দ্রুত চলেছে। 

কর্ণ ও দুর্যোধন সে কথায় খুশি হয়ে বলে –ঠিক বলেছ।এই বৈভব দেখতে পারছে না বলে এগিয়ে গেছে। 
এসব বিচার করে তারা যাত্রা করতে লাগল। তিন দিনে শত যোজন পথ চলল। 

রাজা দুর্যোধন তখন যুক্তি করে দূতের হাতে পত্র লিখে শীঘ্র গতি বলরামের কাছে পাঠাল –রোহিণীনক্ষত্র শেষ অক্ষয় তৃতীয়া দ্বিতীয় প্রহরে কাল আমরা উপস্থিত হচ্ছি। আজ রাতেই কন্যার অধিবাসের(বিবাহের পূর্ববর্তী শুভ অনুষ্ঠান) ব্যবস্থা করুন। কাল রাত্র বিবাহের জন্য শ্রেষ্ঠ লগ্ন তিথি। 

দূত সেই পত্র গিয়ে মুষলীর(বলরাম) হাতে দিল। 
পত্র পড়ে আনন্দিত বলরাম সভায় সকলকে বলেন –আজ রাতেই ভদ্রার গন্ধ অধিবাস করা হোক। রাজা দুর্যোধন সাজসজ্জা করে কাছেই চলে এসেছেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীরাম কহেন সদা, শুনেন পুণ্যবান।
......................................

Monday, November 9, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১০

[পূর্বকথা - সুভদ্রার ইচ্ছে রাখতে সত্যভামা কৌশলে তার গন্ধর্ব বিবাহ দিলেন অর্জুনের সাথে ... কৃষ্ণ সভায় অর্জুনকে সুভদ্রার জন্য উপযুক্ত পাত্র নির্বাচন করলে বলরাম ক্রুদ্ধ হল, তিনি দুর্যোধনকে পাত্র ঠিক করলেন ... দুর্যোধনের কন্যার সাথে কৃষ্ণের পুত্রের বিবাহ প্রসঙ্গ উঠল...দুর্যোধনের কন্যা লক্ষণার স্বয়ম্বর হলে, কৃষ্ণ পুত্র শাম্ব তাকে হরণ করেন...কর্ণের সাহায্যে তাকে বন্দি করা হয়...নারদের মুখে পুত্রের দুর্দশার সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণ ক্রোধে যুদ্ধে যাত্রা করতে গেলে বলরাম তাকে নিরস্ত করে নিজে যান…কিন্তু দুর্যোধন শাম্বকে ছাড়তে না চাইলে ক্রোধে বলরাম হস্তিনানগর ধ্বংসে উদ্যত হন…তখন দুর্যোধন ভয়ে কন্যা লক্ষণা ও জামাতা শাম্বকে বলরামের হাতে তুলে দেন…]

সুভদ্রা বিবাহ-কারণ সত্যভামার মহাচিন্তা ও হস্তিনায় দূত-প্রেরণঃ


সুভদ্রার সাথে অর্জুন

মুনি বলেন –শুনুন মহারাজ, বলরামের কথা শুনে মা দেবকী ও রোহিণী অত্যন্ত দুঃখী হয়ে অধোমুখে বসে থাকেন। 

দেখে সতী সত্যভামা বলেন –হে ঠাকুরাণী, সর্বনাশ হবে। পার্থকে ভদ্রা সমর্পণ না করলে সে সকলকে মারবে। 

রোহিণি বলেন –কত প্রাণ যাবে তার ঠিক নেই। সুভদ্রার কারণে অনেক হত্যা হবে। এর চেয়ে এখনই ভদ্রার মৃত্যু ভাল ছিল। বিষ খাক, অথবা জলে ডুবে মরুক। তার মৃত্যুতে সব বিপদ কাটবে। আমি তাঁকে নিয়ে জলে ঝাঁপ দেব। 

সংসারে লোকলজ্জা, স্ত্রীহত্যা পাপ এসব ভেবে অস্থির সতী সত্যভামা আবার গোবিন্দের কাছে উপস্থিত হয়ে দেবকী ও রোহিণীর সব কথা বলেন। 

গোবিন্দ বলেন –হে প্রিয়ে, তোমার ভয় কি! এর উপায় আমি বার করব। তুমি দূত পাঠাও ধনঞ্জয়ের কাছে। 

সতী বলেন –এসব দূতের কাজ নয়, আমি নিজেই চললাম। 

এই বলে দেবি একাই পার্থের গৃহে উপস্থিত হলেন। 

সেখানে সুভদ্রার সাথে অর্জুনকে দেখে তিনি বলেন –কি নিশ্চিন্তে পার্থ ভদ্রার সাথে আছ! এদিকে যে কি বিপদ উপস্থিত হয়েছে কিছু যান না। 

পার্থ বলেন –কিসের বিপদ আমার! দেবী আপনার দুই পা যার সহায় তার কোন বিপদ হতে পারে না। 

পার্থকে নিয়ে সতী কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হলেন। 

কৃষ্ণ পার্থের হাত ধরে তাকে পালঙ্কে বসিয়ে বলেন –হে সখা, শুন! পিতার আজ্ঞা দিলেন সুভদ্রা তোমার হাতে সমর্পণের জন্য। কিন্তু লাঙ্গলী বলরাম বলছেন তিনি দুর্যোধনের হাতে ভদ্রাকে দেবেন। সে কারণে দুর্যোধনের কাছে দূতও পাঠান হয়েছে। এখন কি উপায় বার করা যায় বল। 

সব শুনে হেসে কুন্তীপুত্র বলেন –এই কথা ভেবে আপনার এত চিন্তা কেন, সখা! আপনার প্রসাদে আমি ত্রিভুবন জয় করতে পারি। কামপাল বলরামের কত শক্তি দেখি, আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। আপনি এত চিন্তা করবেন না। আমি সবার সামনে দিয়ে ভদ্রাকে নিয়ে যাব। যুদ্ধ করতে হলে করব। হলধরও দেখবেন। 

শ্রীকৃষ্ণ বলেন –দ্বন্দ্বে কাজ নেই। তুমি লুকিয়ে ভদ্রাকে নিয়ে চলে যাও। আমার রথে চড়ে ছলনা করে মৃগয়া করতে যাও। পরে আমি ভদ্রাকে স্নানের হেতু পাঠাব। সে সময় তুমি তাকে নিয়ে চলে যাবে। পরে আমি রেবতীরমণ বলরামকে শান্ত করব। 

দেবকীপুত্র কৃষ্ণের সব কথা শুনে অর্জুন সম্মত হয়ে বলেন –হে দেবতা, যা আপনার আজ্ঞা তাই হবে। 

এতসব বিচার বিবেচনা করে দুজনে নিজেদের গৃহে শুতে গেলেন। 

প্রভাতে উঠে স্নানদান করে পার্থ চিন্তিত হলেন –বিপদ উপস্থিত হবে যদি বলরামের সাথে যুদ্ধ হয়। এদিকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এসব কথা কিছুই জানেন না। 

এতসব ভেবে তিনি ইন্দ্রপ্রস্থে দূত পাঠালেন। 
দূতের হাতে সবিস্তারে সব লিখে জানালেন –হে মহারাজ! কৃষ্ণের ইচ্ছে আমার হাতে সুভদ্রাকে তুলে দেওয়ার। কিন্তু কামপাল বলভদ্র তা চান না। তাই কৃষ্ণ বলছেন ভদ্রাকে লুকিয়ে নিয়ে যেতে। এই কারণে আমি আপনার আজ্ঞা চাইছি। 

সব পড়ে, শুনে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলে পাঠান –বল ও বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠ নারায়ণ কৃষ্ণ সব সময় পাণ্ডবদের প্রিয় সখা। তিনি যে কাজ করতে বলবেন তাই করবে। 

দাদার আজ্ঞা পেয়ে পার্থ মনে মনে আনন্দিত হলেন। এভাবে সাতটি রাত কেটে গেল। 
এদিকে রাজা দুর্যোধনও সকল বার্তা শুনল। পিতা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ও মাতা গান্ধারী এ সম্বন্ধে আনন্দিত হল। 
অন্য সকলেও খুশি হয়ে ভাবে –কৃষ্ণের ভগ্নীপতি হবে দুর্যোধন! দেশে দেশে তার আরো বন্ধু সংখ্যা বেড়ে যাবে। 
সবাই সেই আনন্দে বিবাহ সামগ্রী নিয়ে আলোচনা করে, স্থানে স্থানে বসে সে বিষয়ে বিচার বিবেচনা হতে থাকে। 
সবাই বলে –দুর্যোধনকে পাণ্ডবদের আর ভয় পেতে হবে না, আজ থেকে নির্ভয় হল। নারায়ণ কৃষ্ণ সব সময়ই পাণ্ডবদের সহায়। এখন থেকে দুর্যোধনও তাদের আত্মবন্ধু হল। 

দ্রোণাচার্য বলেন –কৃষ্ণ কুটুম্বতায় প্রীত হন না। কৃষ্ণ কেবল ভক্তের হিত করেন। 

বিদুর বলেন –এতো আশ্চর্য কথা বললেন! 

কৃপাচার্য বলেন –একথা মনে হচ্ছে ঠিক নয়। গোবিন্দ কখনই দুর্যোধনের উপর খুশি নন। তিনি এমন সম্বন্ধ করবেন বিশ্বাস হয় না। 

তখন তারা সকলে দূতের কাছে উপস্থিত হয়ে সবিস্তারে সব জানলেন –দ্বারকায় বর্তমানে কুন্তীপুত্র অর্জুন আছেন। অচ্যুত(যিনি নিজ পদ থেকে চ্যুত হন না) কৃষ্ণ তাকেই ভদ্রা দান করতে চান। কিন্তু পান্ডবে অপ্রীত বলরাম পার্থকে ভদ্রা দিতে অস্বীকার করেছেন। রোহিণীকুমার দুর্যোধনকেই ভগ্নী অর্পণ করতে চান। কৃষ্ণ দুর্যোধনকে ভদ্রা দিতে চান না। তাই এখনও কিছু ঠিক হয়নি। পরে কি হয় তাই দেখার। 

ভীষ্ম সব শুনে বলেন –দুর্যোধন গিয়ে লজ্জা পাবে মাত্র। তবে যেই বিয়ে করুক আমরা অবশ্যই বরযাত্রী হব। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম কহেন সদা শুনেন পুণ্যবান।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers