Blog Archive

Sunday, January 29, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৩৭

[পূর্বকথা - পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ......যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... মুনিরা হোম যজ্ঞের আয়োজন শুরু করেন......দেবগণকে নিমন্ত্রণ করতে অর্জ্জুন যাত্রা করেন ...বাসুকি নাগকে নিমন্ত্রণে পাতালে পার্থ যাত্রা করেন... বাসুকিকে যজ্ঞস্থানে যেতে দেওয়ার জন্য পার্থ গান্ডীবে ক্ষিতিকে ধারণ করলেন...... ] 



দ্রুপদ প্রভৃতি রাজার আগমনঃ 

এদিকে দূত মুখে পাঞ্চালাধিকারী দ্রুপদ রাজসূয় যজ্ঞের সংবাদ পেয়ে খুবই সন্তুষ্ট হলেন। তার দুহিতা দ্রৌপদী রাষ্ট্র-পাটেশ্বরী হবেন ভেবেই তিনি গর্ব বোধ করলেন। 
ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখন্ডীরা সকলে হৃষ্ট চিত্তে যজ্ঞের জন্য দ্রব্যাদি সাজিয়ে দ্রুত যজ্ঞস্থলের দিকে যাত্রার ব্যবস্থা করল। 
চতুর্দশ সহস্র মনোরম সুধাংশু(চাঁদ)বদনী, পদ্মনয়নী, সুশ্যামা সেবকী সাথে চলল। অনেক দাসদাসী সমুদায় এল। মনোরম কায় সহস্র দাসী সাথে চলল। 
যুগল সহস্র বাজী(ঘোড়া) যাদের গতি বায়ু সমান, তারা সেজে উঠল। 
উত্তম দ্রব্যাদি বেছে বেছে নেওয়া হল। ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্যের সকলকে উপহার দেওয়ার মত প্রচুর সামগ্রী নিয়ে রাজা রাণির সাথে যজ্ঞস্থানে চললেন। 
চতুরঙ্গ দল এবং চার জাতির প্রজারাও সাথে চলল। তাদের নানা বাদ্য শব্দে বসুমতী কেঁপে কেঁপে ওঠেন। 
ইন্দ্রপ্রস্থে পৌঁছে তারা পূর্ব দ্বারে উপস্থিত হলেন। 

বেত্রহাতে ইন্দ্রসেন(যুধিষ্ঠিরের সারথি) সেখানে পাহারা দিচ্ছিল। সে দ্রুপদ রাজাকে বলে –হে পাঞ্চাল অধিকারী কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। এখনই ধনুর্ধর সহদেব আসবেন। তার মাধ্যমে রাজাকে আপনার আগমনবার্তা পাঠিয়ে রাজাজ্ঞা নিতে চাই। 

কিছু পরেই মাদ্রীপুত্র সহদেব এসে দ্রুপদকে দেখে ধর্মপুত্রকে সে বার্তা জানাতে গেলেন। 

সহদেব বলেন –বহু রত্ন, অনেক দাসদাসী, অশ্ব, হাতি, উট, খর(গাধা), নানা বর্ণ বাস নিয়ে দ্রুপদ মহারাজ উপস্থিত। আপনার আজ্ঞা পেলে তাকে সভায় নিয়ে আসি। 

শুনে ধর্মপুত্র সম্মতি জানিয়ে বলেন – ধনরত্ন, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি পশু দুর্যোধন ভান্ডারীকে সমর্পণ কর। দাসদাসীদের দ্রৌপদীর কাছে পাঠাও। পুত্রসহ যত্ন সহকারে দ্রুপদরাজকে আমার কাছে নিয়ে এস। 

দাদার আজ্ঞা মত সহদেব সব করেন। সপুত্র পাঞ্চাল-ঈশ্বর দ্রুপদ যুধিষ্ঠিররাজা সাক্ষাতে এলেন। তার সাথে আরো কয়েকজন রাজারাও চলল। 

ঘটোৎকচ মহাবীর হিড়িম্বার পুত্র যজ্ঞের আমন্ত্রণ পেয়ে সানন্দ হৃদয়ে উপস্থিত হল। 
হিড়িম্বক বনটি তার অধিকারে, তিন লক্ষ রাক্ষস নিয়ে তার পরিবার। হয়(ঘোড়া), হাতি, রথে করে যজ্ঞের জন্য নানা রত্ন সাজিয়ে নানা বাদ্য বাজিয়ে যজ্ঞস্থানে সে উপস্থিত হল এবং এক অদ্ভূত রাক্ষসী মায়া রচনা করল। 
সাদা হাতির পিঠে বসে তাকে দেখে মনে হল যেন ঐরাবতের পিঠে বসে সহস্রলোচন ইন্দ্র। মাথার মুকুটটি তার নানা মণি রত্নে মণ্ডিত। সারি সারি শ্বেত ছত্র চতুর্দিকে শোভা পায়। শত শত কৃষ্ণ-শ্বেত চামর দুলতে থাকে। এভাবে পাহাড়ি হাতি ও ঘোড়ার নানাবর্ণের রথ নিয়ে ভীমপুত্র ঘটোৎকচ উত্তর দ্বারে উপস্থিত হল। 
তাকে দেখতে চারদিকে হুড়াহুড়ি পরে গেল। কেউ বলে -ইন্দ্র এসেছেন। কেউ বলে –চন্দ্র। 
কেউবা বলে –প্রেতপতি যম। অথবা অরুণ, বরুণ কিংবা অন্য কোন মহামতি। 
কেউবা বলে –এ যদি দেবরাজ হবে তবে শরীরে সহস্র লোচন কোথায়! 
কেউ বলে –ইনি যদি শমন যম হতেন তবে মহিষ বাহন হত। 
কেউ বলে –হুতাশন অগ্নি হলে বাহন হত হংস। বরুণ হলে মকর(কুমীর) বাহন হত। দিবাকর সূর্য হলে সপ্ত অশ্ব রথে আসতেন। 

এত সব যখন আলোচনা হচ্ছে তখন গজ থেকে হিড়িম্বাকুমার নেমে এসে দ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে চাইল। 
কিন্তু দ্বারীরা তাকে বাঁধা দিয়ে বলে –আপনি কে, কোথা থেকে এসেছেন বলুন। রাজার কাছে বার্তা পাঠাই। 

ঘটোৎকচ বলেন –আমি ভীমের অঙ্গজ, হিড়িম্বার গর্ভে জন্ম-ঘটোৎকচ। 

সব শুনে অনিরুদ্ধ(কৃষ্ণের পৌত্র) তাকে মধুর সম্ভাষণে উত্তমস্থানে বসার ব্যবস্থা করলেন। 

সহদেব গিয়ে রাজাকে জানালেন –জননীর সাথে হিড়িম্বাকুমার উপস্থিত। 

ধর্মপুত্র আজ্ঞা দেন –শীঘ্র তাদের যত্ন করে নিয়ে এস। কুমার জননীকে পার্ষতী দ্রৌপদীর কাছে পাঠাও। তারা যত দ্রব্য এনেছে সব দুর্যোধনকে দাও। 

আজ্ঞা পেয়ে হিড়িম্বাকে স্ত্রীদের কাছে অন্তপুরে পাঠান হল। ঘটোৎকচকে রাজার কাছে উপস্থিত করা হল। 

হিড়িম্বাকে দেখে অন্তপুরীর সকলে চমকিত হল। সে যেন রূপে স্বর্গের বিদ্যাধরী। অলঙ্কারে বিভূষিতা আনন্দিত অঙ্গ। বিনা মেঘে স্থির যেন তড়িত-তরঙ্গ। 
হিড়িম্বা অন্তপুরে এসে কুন্তীর চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করল। কুন্তী আশীর্বাদ করে তাকে বসতে বললেন। 

রত্ন সিংহাসনে যেখানে দ্রৌপদী ও সুভদ্রা বসেছিলেন, তাদের মাঝে হিড়িম্বা গিয়ে বসল। 
অহঙ্কারে হিড়িম্বা দ্রৌপদীকে কোন সম্ভাষণ করল না। তা দেখে পার্ষতী দ্রৌপদী মনে মনে কুপিত হলেন। 
কৃষ্ণা দ্রৌপদী ব্যঙ্গ করে বলেন –খলের প্রকৃতি গোপন থাকে না। তার নিজের আচার আচরণে সব প্রকাশ পায়। তুমি কি আহার কর, কোথায় শয়ন কর কিছুই জানি না। তবে তোমার পূর্বের কথা সব শুনেছি। তোমার সহোদরকে ভীম হত্যা করেন। ভ্রাতৃবৈরীকে তো জানতাম কেউ সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু তুমি কামাতুরা হয়ে তাকেই ভজনা করলে! মন যা চায়, তুমি তাই কর। একে তোমার কুপ্রকৃতি তার উপর বারণ করার কেউ নেই। তাই সব সময় ভ্রমরের মত মধুর লোভে বেড়াও। তুমি তো স্বতন্তরা(স্বাধীনচেতা)! এখন কুলবধু সেজে সভার মাঝে বসা হচ্ছে! মর্যাদা থাকতে থাকতে এখান থেকে উঠে গিয়ে নিজের স্থানে বস। 

দ্রৌপদীর কথায় হিড়িম্বা রেগে দুইচক্ষু রক্তবর্ণ করে কৃষ্ণাকে বলে –হে পাঞ্চালী, অকারণে অহঙ্কার কর। অন্যের নিন্দা করছ, নিজের ছিদ্র দেখছ না। কুরূপা কুৎসিত লোক অন্যের ততক্ষণ নিন্দা করে যতক্ষণ না তার সামনে দর্পণ ধরা হয়। তোমার পিতাকে সবাই চেনে। পার্থ তাকে বেঁধে এনে কত অপমান করল। তবু কোন লজ্জায় তিনি তাকেই কন্যা দান করেন! 
আমি যে ভীমকে চেয়েছিলাম, সে তো দৈবের লিখন। পরে আমার ভাই নিজেই যুদ্ধ করতে গেল এবং সহ্য করতে নাপেরে মারা গেল। সে তো বীরধর্ম পালন করে গেছে। কিন্তু শত্রুকে যে ভজনা করে তাকে লোকে ক্লীব বলে। তোমার পিতা তো সেই কাজ করে সংসারে বিখ্যাত হল। 
তুমি আমার সপত্নী, আমি তোমার সপত্নী নই। তোমার বিবাহের বহু পূর্বে ভীম আমায় বিবাহ করেন। 
ঠাকুরাণী কুন্তীদেবীর পাঁচপুত্রের আমরা ত্রয়োদশ বধূ। কিন্তু তুমি একাই অর্ধেক ঐশ্বর্য স্বাধীনভাবে ভোগ করে চলেছ। আমরা বারোজন স্ত্রীরা আর অর্ধেকও ভোগ করার সুযোগ পাই না। তবু আমাদের দেখলে তোমার অঙ্গ জ্বলে! আমাকে স্বতন্তরা বলে তুমি কেন নিন্দা কর! আমার পুত্র হিড়িম্বক বনের রাজা। আমি পুত্রের গৃহে আশ্রিতা, স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী মোটেও নই। বাল্যকালে কন্যাকে পিতা রক্ষা করেন, যৌবনে স্বামী আর শেষ বয়সে পুত্র-শাস্ত্রেও একথা আছে। দেখে এস আমার বীর পুত্রকে সকলে কেমন পুজা করে। মামার রাজ্যে থেকে বাহুবলে সে সকল নিশাচরদের শাসন করে রাজা হয়েছে। সুমেরু পর্যন্ত যত রাক্ষসের বাস সকলে আমার পুত্রের বশ, সেই সেখানে একেশ্বর। 
রাজসূয় যজ্ঞের কথা শুনে রাক্ষসদের মধ্যে কত কানাকানি হচ্ছিল যান! বক রাক্ষসের অমাত্য আর আমার ভাই হিড়িম্বের বন্ধুদের মতে পাণ্ডবরা রাক্ষসদের শত্রু। তারা ঠিক করে সকলে এসে এই যজ্ঞ পন্ড করবে। আমার বুদ্ধিমান পুত্রের কানে সে কথা এসে পৌছায়। সে যুদ্ধ করে সেই কুচক্রীদের বন্দী করেছে। এখন তারা সব লৌহপাশে(শিকল) বন্দী কারাগারে। 
পৃথিবীতে আরো যত নিশাচরের বাস সবাইকে আমার পুত্র জয় করে বশে রেখেছে। 
হে কৃষ্ণা একবার পাণ্ডবদের সভায় গিয়ে দেখে এসো আমার পুত্রের প্রভায় সে সভা আলোকিত হয়ে আছে। 

হিড়িম্বার এত কথা শুনে কৃষ্ণা দ্রৌপদী রেগে বলেন –বার বার পুত্রের কথা বলে যে এত গর্ব করছ! আমি শাপ দিচ্ছি তোমার এই পাপেই তুমি নিজের পুত্রের বধ করলে। কর্ণের একাঘ্নী অস্ত্র বজ্রের সমান। তার আঘাতেই তোমার পুত্র প্রাণত্যাগ করবে। 

কৃষ্ণার এত বড় পুত্রশাপ শুনে হিড়িম্বা প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে কৃষ্ণাকে শাপ দিল –আমার নির্দোষ পুত্রকে তুমি এত বড় শাপ দিলে! তুমিও আমার মত পুত্র শোকে বড়ই কষ্ট পাবে। ক্ষত্রিয়রা যুদ্ধ করে মরে স্বর্গে যায়। কিন্তু তোমার পুত্ররা বিনা যুদ্ধে মরবে। 
এই বলে হিড়িম্বা ক্রোধের সাথে উঠে চলে যেতে গেল। 

কুন্তী তখন উঠে এসে দুই বধূকে সান্তনা দিতে লাগলেন। 

মহাভারতের কথা সুধা সিন্ধু প্রায়, পাঁচালী প্রবন্ধে কাশীরাম দাস তাই গান।
......................................

Sunday, January 15, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৩৬

[পূর্বকথা পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ......অর্জুন, ভীম নকুল ও সহদেব সে কারণে দ্বিগ্বিজয় যাত্রা করেন.....যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... চারদিকে দূতদের আমন্ত্রণের জন্য পাঠান শুরু হল...... মুনিরা হোম যজ্ঞের আয়োজন শুরু করেন......দেবগণকে নিমন্ত্রণ করতে অর্জ্জুন যাত্রা করেন ......] 



বাসুকি-নিমন্ত্রণে পাতালে পার্থের যাত্রাঃ 

অর্জুনকে দেব নারায়ণ জিজ্ঞাসা করেন –বল, কাকে কাকে নিমন্ত্রণ করে এলে! 
শুনে অর্জুন এত নাম বললেন যে লিখলে একটি বই হয়ে যাবে। তিনি জানালেন কুবেরাদি সকল দেবতাদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। সকল বৃত্তান্ত তিনি বিস্তারিত বললেন। 

গোবিন্দ বলেন –এবার তুমি পাতালে গিয়ে শেষনাগকে নিমন্ত্রণ করে এস। স্বর্গে যেমন দেবরাজ ইন্দ্র, পাতালে তেমনি শেষনাগ বাসুকি। তুমি ছাড়া কারো সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। বাসুকি এলেই যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে। বিলম্ব না করে সখা এখনই যাত্রা কর। 

কৃষ্ণের আজ্ঞায় পার্থ সঙ্গে সঙ্গে দিব্যরথে পাতালে গেলেন। 
নাগের আলয়ে গিয়ে দেখেন চারদিকে ফণী বেষ্টিত হয়ে শেষনাগ অবস্থান করছেন। দশ শত ফণা মস্তকের উপর, তিনশত ফণায় শোভিত চরাচর। কূর্মের(কচ্ছপ) পিঠে উপবিষ্ট রতন বেষ্টিত। 

পার্থ হৃষ্ট মনে জোড়হাতে প্রণাম জানিয়ে বলেন –রাজসূয় যজ্ঞের কারণে আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে এলাম, রাজন! সুরলোকের সকল দেবতারা উপস্থিত হবেন। ব্রহ্মা-শিব-ইন্দ্র আদি যত দিকপাল যজ্ঞে অধিষ্ঠান হবেন। আপনি এলে এ যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে। দয়া করে আপনি আসুন। 

শেষনাগ হেসে বলেন –শুনুন ধনঞ্জয়, এ যজ্ঞে গোবিন্দ উপস্থিত, তিনিই কর্তা। তার দর্শনে সকল যজ্ঞের ফল মেলে। কৃষ্ণ যেখানে আছেন সেখানে ব্রহ্মা-মহেশ আসবেনই। অকারণেই আমাকে নিমন্ত্রণ করতে এলেন। আপনি গিয়ে কৃষ্ণের অর্চনা ভাল ভাবে করুন, তাতেই সাফল্য মিলবে। অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে কত শত প্রাণী বিদ্যমান। কত ব্রহ্মা, শিব, ইন্দ্র, শেষনাগ-এই সব শাখাপাত্রকে তুষ্ট করা সম্ভব যদি মূলে জল সিঞ্চন করেন। 

অর্জুন বলেন –হে দেব, যা বললেন তা বেদেও প্রমাণিত। এসবই তার মায়া। তবু জেনে শুনে সবাই মায়া ধন্ধে পরে। 

নাগরাজ বলেন –আপনি কিছু না জেনেই আমায় নিতে এলেন। আমি আমার মস্তকে ক্ষিতির ভার ধারণ করি। আমি গেলে যজ্ঞের স্থানই বা কে ধরে রাখবে! 

অর্জুন বলেন –কৃষ্ণ আমায় আপনার কাছে পাঠালেন। আপনি গেলে তবেই এ যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে। ক্ষিতিভারের কারণ আপনি যদি না যেতে পারেন তবে আমার অনুরোধ, আপনি দয়া করে যজ্ঞে যান, আমি এই পৃথিবীর ভার ধারণ করছি। 

একথা শুনে বিস্মিত হয়ে বিষধর হেসে বলেন –পৃথিবী ধারণ করতে আপনি স্বীকার করছেন! তবে এই নিন আমি ছাড়ছি, আপনি সত্য পালন করুন। 

এত শুনে ধনঞ্জয় হাতে গান্ডীব ধনুক নিয়ে করজোড়ে গান্ডীবদাতা শিবকে স্মরণ করেন, ভক্তিভাবে কৃষ্ণকে প্রণাম জানান এবং গুরু দ্রোণের পদ বন্দনা করে তূণ থেকে অদ্ভুত স্তম্ভন(কন্দর্পের পঞ্চবাণের অন্যতম) অস্ত্র নিয়ে গান্ডীবে যুড়ে সেই অস্ত্রে ক্ষিতিকে ধারণ করলেন। 

তা দেখে সকল নাগেরা ধন্য ধন্য করল। তখন শেষনাগ সকল নাগদের নিয়ে দ্রুত যজ্ঞস্থলের দিকে যাত্রা করলেন। 
বাসুকি, আনিল, তক্ষক, কৌরব্য, নহুষ, কর্কট, ধৃতরাষ্ট্র, জরদ্গব, কোপন, কালীয়, ত্রিকপূর্ণ, ধনঞ্জয়, অজ্যক, উগ্রক, নীল, শঙ্খমুখ, শঙ্খপিন্ড, বক্রদন্ত, কলিচূড়, পিঙ্গচক্ষু আরো শত শত দুষ্ট রুষ্ট সর্প তাদের পুত্র-পৌত্র নিয়ে চলল। 
লক্ষ লক্ষ সাপ দেখে সকলে অশক্য(অসাধ্য) মানল। কারো পাঁচ, কারো সাত মাথা, কারো বা ছয়-সাতশত, কেউবা সহস্র মস্তক, কারো আকার পর্বতের মত। এভাবে ফণিরাজ সপরিবারে চললেন। 

এদিকে সুরেন্দ্রালয়ে দেবতাদের সমাজও সেজে উঠল। দেবরাজ ইন্দ্র ঐরাবতে আরোহণ করলেন। বজ্র তার হাতের শোভা বাড়ায়। মাতলি(ইন্দ্রের সারথি) মাথার উপর ছত্র ধরেন। অষ্টবসু, নবগ্রহ, অশ্বিনীকুমার, দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র, ঊনপঞ্চাশ বায়ু, সাতাশ হুতাশন-যজ্ঞ, যন্ত্র, পুরোধা, দক্ষিণা, দন্ড, ক্ষণ, যোগ, তিথি, করণ নিয়ে, নক্ষত্র, রাশিগণ, চারি মেঘ, বিদ্যুৎ, সঙ্গে সৈন্যসামন্ত, গন্ধর্ব, কিন্নর, সকল অপ্সর, অপ্সরী, দেবঋষি ব্রহ্মা সঙ্গে বিস্তর ঋষিদের নিয়ে চললেন। 
বশিষ্ঠ, পৌলস্ত্য, ভৃগু, পুলহ, অঙ্গিরা, পরাশর, ক্রতু, দক্ষ, লোমশ, সুধীরা, অসিত, দেবল, কুন্ড, শুক, সনাতন, মার্কণ্ড, ধ্রূব, জয়ন্ত, কোপন প্রমুখ যত ঋষিরা ইন্দ্রপ্রস্থে থাকতেন তারা লাখে লাখে দলে দলে ইন্দ্রের সাথে যজ্ঞস্থলে চললেন। 

পুষ্পরথে ধনের ঈশ্বর কুবের চড়লেন। তার সাথে চলল যক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নর, চিত্ররথ, তুম্বুরু, অঙ্গিরা, বিশ্বাবসু, মহেন্দ্র, মাতঙ্গ, ফলকর্ণ, ফলোদক, চিত্রক, লোত্রক প্রমুখ কতশত গুহ্যক(কুবেরের যক্ষ অনুচর) যে চলল বলে শেষ করা যায় না। 
ঘৃতাচী, উর্বশী, চিত্রা, রম্ভা, চিত্রসেনী, চারুনেত্রা, মিশ্রকেশী, বুদ্বুদা, মোহিনী, চিত্ররেখা, অলম্বুষা, সুরভি, সমাচী, পোনিকা, কদম্বা, অর্মা, শূদ্রা, রুচি, শুচি-লক্ষ লক্ষ বিদ্যাধরীরাও নৃত্য গীত করতে করতে আহ্লাদে কুবেরের সাথে চলল। 

যজ্ঞ দেখতে সব মহীধর পর্বতরাও চলল-হিমাদ্রি, কৈলাস, শ্বেত, নীল গিরিবর, কালগিরি, হেমকূট, মন্দর, মৈনাক, চিত্রগিরি, রামগিরি, গোবর্দ্ধন শাখ, চিত্রকূট, বিন্ধ্য, গন্ধমাদন, সুবল, ঋষ্যশৃঙ্গ, শতশৃঙ্গ, মহেন্দ্র, ধবল, রৈবতক, মুনিশিল গিরি, কামগিরি, খন্ডগিরি, নীলগিরি-এমন লক্ষ লক্ষ গিরিরা দেবরূপ ধরে যক্ষরাজের সঙ্গে যজ্ঞ দেখতে চলল। 

বরুণদেব নিজের অমাত্যদের সঙ্গে চললেন। সপ্ত সিন্ধু ও যত সরিৎ(নদী) মূর্তিমন্ত হলেন-গঙ্গা, সরস্বতী, শোণ, সূর্যকন্যা যমুনা-তাপ্তী, চিত্রপালা, প্রেতা, বৈতরণী, পুণ্যযুতা, চন্দ্রভাগা, গোদাবরী, সরযূ, লোহিতা, দেবনদী, মহানদী, মদাশ্বী, সবিতা, ভৈরবী, ভারবীনদী, ভদ্রা, বসুমতী, মেঘবতী, গোমতী, সৌবতী, নর্মদা, অজয়, ব্রাহ্মী, ব্রহ্মপুত্র, কংস, তমুল, কমল–বিষ কোলামুখ বংশ, গন্ডকী, ফল্গু, সিন্ধু, করতোয়া, স্বর্ণরেখা, পদ্মাবতী, শত লোকত্রয়া, ঝুমঝুমি, কালিন্দী, দামোদর, গিরিপুরী, সিন্ধুকা, কাবেরী-প্রমুখ অনেক নদনদী, সরোবর, বাপী(দীঘি), হ্রদ, তড়াগাদি দেহ ধারণ করে বরুনের সাথে যজ্ঞ দেখতে চলল। 

মহিষ বাহনে চড়ে প্রেত মহীপতি যম চললেন। পিতৃগণ, দূতগণ দন্ড মৃত্যুপাশ নিয়ে আকাশ যুড়ে আসতে লাগল। 

এভাবে দ্বাপর যুগে অদ্ভূত যজ্ঞ শুরু হল। এমন আগে কখনও অবনীতে(পৃথিবী) হয়নি। কত যে রাজারা এলেন লিখে শেষ করা যায় না। যযাতি, নহুষ, রঘু, মান্ধাতা, দিলীপ, সগর, ভগীরথ, দশরথ, কৃতবীর্য, কার্তবীর্য, ভরত, সুরথ প্রমুখ অনেক চন্দ্র ও সূর্যবংশীয় রাজারা অংশগ্রহণ করলেন। 
এর আগেও অনেকে রাজসূয় অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছেন। তারা যে দেবতার আরাধনা করতেন তাকেই নিয়ে আসতেন। কিন্তু এই যজ্ঞে সকলের আমন্ত্রণ। 

মহেশ এলেন পার্বতীকে সঙ্গে নিয়ে। তারা অলক্ষ্যে থেকে সকল দিক লক্ষ্য রাখেন। শিবের দক্ষিণ হাতে ত্রিশূল, শির শোভে জটা ভারে। দাড়ি চরণ স্পর্শে, বাম করে তাল। সদাশিব যতদুর যজ্ঞস্থল সেই অঞ্চলের সবার প্রতি দৃষ্টি রাখেন। পার্বতী অন্নদারূপে যজ্ঞস্থানে সকলকে ছায়ারূপে থেকে তোষণ করেন। যার যা মনোবাঞ্ছা তাই যোগাতে থাকেন। 

অশ্ব আরোহণ করে খর-করবাল(খড়্গ/তরবারি) হাতে ঊনকোটি দৈত্য নিয়ে আসে ক্ষেত্রপাল। ময়দানব শতকোটি দৈত্য নিয়ে আসেন। বিনতা-তনয় গরুড় ছয়পুত্র নিয়ে এলেন। 

এভাবে দেব, দৈত্য, নাগ-সবাই যজ্ঞে অংশগ্রহণ করলেন। 

স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা হংসে আরোহণ করে এলেন। অন্তরীক্ষে থেকেই চতুর্মুখ ব্রহ্মা যজ্ঞ দেখলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers