Blog Archive

Sunday, December 27, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৭

[পূর্বকথা - কৃষ্ণের কথা মত অর্জুন সরস্বতীর তীর থেকে সুভদ্রাকে হরণ করলেন.. এ সংবাদ বলরাম শুনে কৃষ্ণের উপর অভিমান করতে লাগলেন... কৃষ্ণ এসে দাদাকে বোঝালেন সুভদ্রা অর্জুনকেই স্বামী হিসেবে চান..... বলরাম অর্জুনের কাছে বিবাহ প্রস্তাব পাঠালেন ...পার্থের সাথে সুভদ্রার বিবাহ হল .......দুর্যোধন অভিমানে স্বদেশ যাত্রা করল.....] 



খান্ডব-বন দহনঃ 

কিছুদিন পর এক গ্রীষ্মকালে পার্থ ও নারায়ণ যমুনায় বিহার করতে গেলেন। 
রুক্মিণী, সুভদ্রা সহ পরিবারের বহু সদস্যকে নিয়ে যমুনা কূলে সুন্দর ঘর করে বাস করেন। আনন্দে তারা পানাহার করে, ক্রীড়া করে দিন কাটান। 

একদিন ক্রীড়ান্তে দুজনে বসে বিশ্রাম করছিলেন, সে সময় সেখানে হুতাশন অগ্নি এক ব্রাহ্মণের বেশে প্রবেশ করলেন। মাথায় তাঁর ত্রিজটা, নয়ন তাঁর পিঙ্গল রক্তবর্ণ। আগুনের মত উত্তপ্ত শরীর। 
কৃষ্ণার্জুনের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের আশীর্বাদ করে অগ্নিদেব বলেন –হে কৃষ্ণ আপনি যদুকুলের শ্রেষ্ঠ, হে পার্থ আপনি কুরুকুলসার। ত্রিভুবনে আপনাদের সমান আর কাউকে দেখিনা। আপনারা দুজনে মিলে আমার ইচ্ছে পূরণ করুন। আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ আমায় ভোজন করান। 

পার্থ হেসে বলেন –হে পণ্ডিত! কোন ভক্ষ পেলে আপনি তৃপ্ত হবেন বলুন। আপনি যা চাইবেন এখনই তা এনে দিচ্ছি। 

আশ্বাস পেয়ে অগ্নি বলেন –আমি আমার পরিচয় দিচ্ছি শুনুন। আমি অগ্নি। বহুকাল ব্যাধিতে ভুগেছি, অরুচি হয়েছে। আমায় ব্যাধি মুক্ত করুন। 
কাছেই খান্ডব বন আছে। সেটি সকল জীবের আলয়। সেই বন ভক্ষণের জন্য দিন, ধনঞ্জয়! সেখানে সুরাসুর, যক্ষ, রক্ষ, পশু, পাখি যত আছে সব আমায় ভোজন করতে দিন। 

এত শুনে রাজা জন্মেজয় বিস্মিত হয়ে বৈশম্পায়ন মুনিকে জিজ্ঞেস করেন –হে মুনিরাজ, আমার বিস্ময় খন্ডন করুন। 
সে স্থানে ব্যাধিযুক্ত হুতাশন অগ্নি কেন এলেন! কিসের জন্য তিনি খান্ডব দাহন করতে চাইলেন। 

মুনি বলেন –শুনুন নৃপ, পূর্বের কাহিনী। 
সত্যযুগে শ্বেতকি নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি যজ্ঞ ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। নিরন্তর ব্রাহ্মণদের নিয়ে যজ্ঞ করতেন। বহুকাল এভাবে রাজা যজ্ঞ করতে থাকলে দ্বিজরা আর সে কষ্ট সহ্য করতে পারল না। তারা যজ্ঞ ত্যাগ করে চলে যেতে চাইলো। 

রাজা জোড়হাতে বিনয়ের সাথে বলেন –মহর্ষিরা কেন আপনারা যজ্ঞ ছেড়ে যাচ্ছেন! আমি তো পতিত নই, কোন দোষও তো করি নি! 

দ্বিজরা বলে –আপনার কোন দোষ নেই, মহারাজ! কিন্তু এই অপ্রমিত যজ্ঞের কোন শেষ দেখছি না। আমরা আর অগ্নিতাপের ক্লেশ সহ্য করতে পারছি না। নয়ন আমাদের নিরস হয়েছে, অঙ্গ লোমহীন, শরীরের রক্ত শুকুয়ে যাচ্ছে এই অগ্নির সংস্পর্শে। 

দ্বিজদের কথা শুনে রাজা তাদের নানা ভাবে তুষ্ট করে পুনরায় যজ্ঞে আহ্বান জানাতে লাগলেন। 

দ্বিজরা বলে –রাজা, আমাদের অকারণে স্তুতি করছেন, আমাদের দ্বারা আর এ কাজ সম্ভব নয়। এই যজ্ঞ করেন এমন ব্রাহ্মণও দেখছি না। ত্রিদশ(অমর)-ঈশ্বর শিবের সেবা করুন। তিনি ছাড়া আর কারো এ যজ্ঞ করা সম্ভব নয়। 

দ্বিজদের কথা মত রাজা অনেক কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। তাঁর তপস্যায় শিব সন্তুষ্ট হয়ে বর প্রার্থনা করতে বললেন। 

রাজা বলেন –কৃপা যখন করলেন, মহাদেব! তবে শুনুন। আমার যজ্ঞ করে এমন ব্রাহ্মণ নেই। আপনি আমার যজ্ঞের পুরোহিত হন। 

শিব হেসে বলেন –যজ্ঞ করা আমার কাজ নয়, ব্রাহ্মণের কাজ। যজ্ঞফল যা চাও তাই পাবে, প্রার্থনা কর। 

রাজা বিনয়ের সাথে বলেন –যজ্ঞ না করেই তার ফল ভোগ করা সুশোভন নয়। হে ত্রিলোচন! যজ্ঞের উপায় বার করে দিন।

শিব বলেন –তোমার যজ্ঞে এত মন! আমার অংশে জন্মেছেন দুর্বাসা মুনি। তাকে দিয়ে এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ কর। 
পূর্বে যজ্ঞের সামগ্রী সব সংগ্রহ করবে। দুর্বাসার যোগ্য যজ্ঞ বিধান মত করবে। দুর্বাসার মান যেন রক্ষা পায়, লক্ষ্য রেখ। 

শিবের আজ্ঞা পেয়ে রাজা নিজ রাজ্যে গিয়ে যজ্ঞের সামগ্রী সংগ্রহে নিযুক্ত হলেন। বারো বছর ধরে সব সামগ্রী সংগ্রহ করে শিবকে জানালেন। শিব তখন দুর্বাসা মুনিকে এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিলেন। 

শিবের আজ্ঞা পেয়ে দুর্বাসা মুনির মনে রাজার উপর ক্রোধ হল। তিনি ঠিক করলেন রাজার কোন ছিদ্র বার করে তাকে শাপ দেবেন। 

দুর্বাসা মনে মনে ভাবেন –শ্বেতকি রাজনের এত অহংকার যে আমায় যজ্ঞের জন্য আবাহন করল! 

মনে ক্রোধ নিয়ে মুনি যজ্ঞ করতে গেলেন। সঙ্গে দণ্ডধর(যম)ও গেলেন। 
মহাতপোধন দুর্বাসা মুনি সাঙ্ঘাতিক যজ্ঞ শুরু করলেন। মুনি যখন যা চান সঙ্গে সঙ্গে রাজাও তাই যোগাতে থাকেন। শ্বেতকি রাজার যজ্ঞের কথা সংসারে ছড়াতে থাকে। 
দুর্বাসা মুনি মুষলধারে যজ্ঞে আহুতি দিতে লাগলেন। বার বছর ধরে অবিরাম সে যজ্ঞ চলতে থাকে। ত্রিলোকে সকলে এই যজ্ঞের কথা শুনে চমৎকৃত হল। 

সেই যজ্ঞের হবিষ্যি খেয়ে খেয়ে অগ্নির অরুচি হল। ব্যাধিযুক্ত দেহে অগ্নি দুর্বল হলেন। অগ্নিদেব তখন ব্রহ্মার সদনে গিয়ে তাকে তাঁর দুঃখের কথা জানালেন। 

বিরিঞ্চি ব্রহ্মা বলেন –অতি লোভে আপনাকে এ দুঃখ পেতে হচ্ছে। বহু খাদ্য গ্রহণের ফলে আপনার এ ব্যাধি হয়েছে। তবে এ ব্যাধিরও ওসুধ আছে, হুতাশন। খান্ডববনে বহু জীব আছে। যদি আপনার পক্ষে বন দগ্ধ করা সম্ভব হয় তো তাই করে ব্যাধি মুক্ত হন। 

ব্রহ্মার কথা শুনে বেগে অগ্নি খান্ডব বনে চললেন। ক্রুদ্ধ অগ্নি সেখানে গিয়েই প্রচন্ড গর্জন করে জ্বলে উঠলেন। খান্ডববন বহু জীবের বাসস্থান, আগুন দেখে তারা বিস্মিত হল। কোটি কোটি মত্ত হস্তী তাদের হস্তিনীদের সাথে মিলে শুঁড়ে করে জল এনে সে আগুন নেভাল। বড় বড় সব ভয়ঙ্কর সাপরাও তাদের পঞ্চশত, সপ্ত-অষ্টাদশ ফণায় করে জল এনে আগুন নেভাল।

এভাবে যত জীব ছিল সবাই নিজেদের সাধ্যমত সাহায্য করল, মুখে করে জল এনে আগুন নেভালো। অগ্নি অনেক চেষ্টা করেও আর বন দহন করতে পারলেন না। 
......................................

Sunday, December 20, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৬

[পূর্বকথা - কৃষ্ণের কথা মত অর্জুন সরস্বতীর তীর থেকে সুভদ্রাকে হরণ করলেন...যদুবীররা ক্রুদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করল ... সুভদ্রা অর্জুনের সারথি হলেন...যদুবীররা পরাস্ত হতে লাগল ..... এ সংবাদ বলরাম শুনে কৃষ্ণের উপর অভিমান করতে লাগলেন... কৃষ্ণ এসে দাদাকে বোঝালেন সুভদ্রা অর্জুনকেই স্বামী হিসেবে চান..... বলরাম অর্জুনের কাছে বিবাহ প্রস্তাব পাঠালেন ..... ] 



দুর্যোধনের অভিমানে স্বদেশ যাত্রা ও পার্থের সহিত সুভদ্রার বিবাহঃ 

এদিকে রাজা দুর্যোধন সব সৈন্যদের নিয়ে যাদব সৈন্যদের মাঝে গিয়ে পরল। 
সেখানে সব শুনল যে পার্থ ভদ্রাকে হরণ করেছে।

মহাক্রোধে দুর্যোধন গর্জে উঠল –হে কৃপাচার্য, হে পিতামহ, আচার্য বিদুর সবাই দেখুন পান্ডুপুত্রের কান্ড। যে কন্যার জন্য বলরাম আমায় আমন্ত্রণ করলেন, দেখুন তাকেই দুষ্ট হরণ করল! আমাকে সবাই চেনে। আমি এখনই অর্জুনকে হত্যা করব, কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। 

কর্ণ বলে –মহারাজ, আপনি বসে দেখুন, আজ্ঞা দিলেই আমি তাকে বেঁধে আনতে পারি। 

শুনে গান্ধারী নন্দন দুর্যোধন তাকে আজ্ঞা দিল বীর কর্ণও দ্রুত লাল চোখ করে দৌড়াল। 

বৃকোদর ভীম বলেন –কোথায় যাও সূতপুত্র! অদ্ভুত কথা বললে অর্জুনকে তুমি ধরবে। সুরাসুর যক্ষ যাকে যুদ্ধে হারাতে পারে না তাকে ধরতে যেতে লজ্জা করছে না! ওরে মূর্খ দুরাচার, তোমার এত অহঙ্কার! আমার সামনে এমন প্রতিজ্ঞা কর! আমার হাত থেকে বাঁচলে তখন অর্জুনের সাথে যুদ্ধ করতে যেও। 

এই বলে ভীম লাফিয়ে ভূমিতে পরলেন। গদা ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি এগিয়ে আসতে লাগলেন, যেন সাক্ষাৎ দন্ডপাণি(যম)। 

বিদুর বলেন –হে দুর্যোধন, পার্থের সাথে তোমার যুদ্ধের কি প্রয়োজন! তোমাকে আমন্ত্রণ করে যিনি এনেছেন তাঁর কাছে গিয়ে সব জিজ্ঞেস করা উচিত। তিনি যেমন বলবেন তেমন না হয় করা যাবে। এখন পার্থের সাথে কলহ করা উচিত নয়। 

ভীষ্ম ও দ্রোণও তাতে সম্মত হয়ে বলেন –যিনি আমন্ত্রণ করেছেন, তাঁর কাছেই আগে চল। অনেক বোঝানোর পর রাজা দুর্যোধন দ্বারাবতী যেতে সম্মত হল। 

সে সময় সাত্যকি অর্জুনের কাছে উপস্থিত হল। 
পার্থকে ডেকে মধুর বচনে সে বলে –ক্রোধ ত্যাগ করুন ধনঞ্জয়, এরা শিশু এদের উপর আক্রোশের কি দরকার! না বুঝে এরা দোষ করেছে। আপনার সাথে মিথ্যে যুদ্ধ করল। সব শুনে কৃষ্ণ-রাম দুজনেই মন্দ বলেছেন। তাই আমাকে দ্রুত পাঠালেন। আপনাকে নিয়ে যেতে আমি এসেছি। যদুবংশীয়রা ও ভোজবংশীয়রা(দ্বারকা বর্তমানে গুজরাটের অঞ্চল, ভোজ গুজরাটের কচের কাছে দ্বারকার কিছু দূরে অবস্থিত) সকলে একত্রে বসে স্থির করেছেন সুভদ্রাকে আপনার হাতেই সমর্পণ করা হবে। 

সাত্যকির বিনয় বচন শুনে ফাল্গুনি(অর্জুন) শান্ত হলেন ও যুদ্ধ ত্যাগ করলেন। 
সব দেখে শুনে দুর্যোধনের অভিমান হল। সে তখনই সসৈন্য নিজের দেশের উদ্দেশ্যে ফিরে চলল। 

পার্থ তখন দারুককে মুক্ত করে কৃতাঞ্জলি সহকারে সবিনয়ে বলেন –কৃষ্ণ যেমন, আপনিও আমার কাছে তেমনই। আপনার প্রতি অপরাধ করেছি, আমায় ক্ষমা করুন। 

দারুক বলেন –পার্থ আপনি বড় একটি কাজ করলেন। এতো আমার বন্ধন ছিল না। এ আমার ধর্ম রক্ষা করলেন। আপনি আমায় বন্ধি না করলে আজ আমি বলরামকে কি ভাবে মুখ দেখাতাম! আমাকে এই অবস্থাতেই বলরামের কাছে নিয়ে চলুন। না হলে তিনি আমার উপর খুব রাগ করবেন। 

অর্জুন বলেন –তা আর উচিত কর্ম হবে না। আপনাকে বেঁধে নিয়ে গেলে কৃষ্ণ আমার উপর কুপিত হবেন। রাম অবশ্যই আমাদের ক্ষমা করবেন। 

এই বলে তখনই পার্থ দারুককে মুক্ত করলেন। তারপর সব যদুবীররা সন্তুষ্ট হয়ে অর্জুনকে আদর করে দ্বারকায় নিয়ে চলল। 

ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, বিদুর প্রমুখ এবং ভুরিশ্রবা, সোমদত্ত, বাহ্লিক প্রমুখদের নিয়ে সসৈন্য ভীমসেন অর্জুনের আগে আগে চললেন। পিছনে কাম প্রমুখ সকল যাদববীররা চলল। 

দেব নারায়ণ কৃষ্ণ এগিয়ে এসে সকলকে অভ্যর্থনা করলেন। যদুনারীরা উলুধ্বনি দিতে লাগল। 
রত্নময় সিংহাসনে ভদ্রা ও পার্থকে বসিয়ে বেদ অনুসারে তাদের বিবাহ দেওয়া হল। বসুদেব ভদ্রাকে সম্প্রদান করলেন। যদুরা আনন্দ মনে পার্থকে প্রচুর যৌতুক দান করল। 

পুণ্যকথা ভারতের শুনেন পুণ্যবান। পৃথিবীতে এর সমান সুখ আর কিছু নেই। 
সুভদ্রার হরণ কাহিনী যে নর শুনেন, তাঁর সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় ব্যাসদেবের বচনে।
......................................

Monday, December 14, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৫

[পূর্বকথা - কৃষ্ণের কথা মত অর্জুন সরস্বতীর তীর থেকে সুভদ্রাকে হরণ করলেন...যদুবীররা ক্রুদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করল ... সুভদ্রা অর্জুনের সারথি হলেন...যদুবীররা পরাস্ত হতে লাগল ..... এ সংবাদ বলরাম শুনে কৃষ্ণের উপর অভিমান করতে লাগলেন... ] 

বলরামের সহিত শ্রীকৃষ্ণের কথাঃ



দূত পুনরায় জোড়হাতে বলে –হে যদুনাথ, নিঃশব্দ রয়ে গেলেন কেন! আজ্ঞা করুন আমি এখন কি করি! কুমাররা আমায় বার্তার কারণে পাঠালেন! যাদব প্রধান মহাবীর কামদেব যিনি তিনলোকে অব্যর্থ তাঁর ধনুর্গুণ তিলতিল করে কাটা গেছে। একটিও আর অস্ত্র নেই, তূণও শূন্য। শাম্ব, গদ, সারণ প্রমুখ যতবীর যাদবরা আছেন, কারো তনুই অক্ষত নয়। কারো ধ্বজা কাটা গেছে, কারো বা সারথি, কারো রথ নষ্ট হয়েছে-সে এখন পদাতি। কারো অস্ত্র, ধনুর্গুণ কিচ্ছু নেই। সবাইকে একা অর্জুন জয় করেছেন। এখন আপনারা অস্ত্র, রথ, অশ্ব সব পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। আপনি চলুন বা দেবকীপুত্র কৃষ্ণ চলুক সব স্বচক্ষে দেখে আসবেন। কুমারদের পক্ষে অর্জুনকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। অর্জুনও স্নেহ করে কুমারদের প্রাণে মারেন নি। তাই প্রভু, তারা এখনও পরান নিয়ে বেঁচে আছেন। 

গোবিন্দ বলেন –আমি অর্জুনকে চিনি। তাকে পরাজিত করার মত পৃথিবীতে কাউকে দেখি না। আজ এমনকি ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ, পঞ্চাননও পার্থকে জিততে পারবেন না। কুমাররা তাঁর কাছে শিশু , তারা আর কি করবে! তুমি সত্যই বলেছ পার্থ তাদের প্রাণে মারবেন না। তাঁর সাথে যুদ্ধ করা উচিত নয়। সে তো অন্যায় কিছু করেন নি! শাস্ত্র মতে ক্ষত্রিয়ধর্মে বলপ্রয়োগ করে বিবাহের প্রশংসা আছে, যেখানে কন্যার সম্মতি আছে। ধনঞ্জয়ের দোষ দেখি না। 
আমাদের ভগিনীর কাজটাও দেখুন। অর্জুনে যদি তাঁর মন না থাকত, তবে সে অশ্ব চালাত কেন! তবে ধনঞ্জয় কি আপনার মহিমা জানেন না! আপনি এখনই গিয়ে তাঁর গরিমা খর্ব করতে পারেন। তবে পার্থকে জীবন্ত ধরা সম্ভব নয়। অনেক চেষ্টা করে তাকে প্রাণে মারতে হবে। পার্থকে হত্যা করলে সুভদ্রাও প্রাণ ত্যাগ করবে। বলুন দেবতা তাতে কি কর্ম সাধন হবে! 
এমন অবস্থায় আমার মত যদি সবাই আজ্ঞা দেন তো জানাই। আপনার প্রিয়ম্বদ কেউ অর্জুনের কাছে যাক। প্রিয় বাক্যে কুন্তীকুমারকে তুষ্ট করে ফিরিয়ে আনুন। এখনই তাকে এনে ভদ্রাকে তাঁর হাতে সমর্পণ করুন। এতে সবার মঙ্গল হবে। লোকসমাজে সম্মান থাকবে। আমার মনে আর কিছুই আসছে না। 

কৃষ্ণের এত কথা শুনে হলধর বলরাম ক্রোধ সংবরণ করে বলেন –আমাকে আর জিজ্ঞেস করছ কেন! তোমার মন যা চাইছে তাই কর। তোমার মনে যা আছে তাই হবে। তোমার অন্যথা আর কে করতে পারে। তখন যদি তোমার কথা মেনে নিতাম, তাহলে এখন আর আমায় এমন লজ্জায় পরতে হত না। 

এরপর বলরাম সাত্যকিকে ডেকে বলেন –আপনি এখনই আমার প্রতিনিধি হয়ে অর্জুনের কাছে গিয়ে তাকে মধুর বচনে বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনুন। 
এই বলে সাত্যকিকে রথে চড়িয়ে যুদ্ধ স্থলে পাঠালেন। 

আদি পর্ব মহাভারতের বিচিত্র উপাখ্যান, কাশীরাম দাস কহেন, সাধুজন সদা করেন পান।
......................................

Sunday, December 6, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৪

[পূর্বকথা - কৃষ্ণের কথা মত অর্জুন সরস্বতীর তীর থেকে সুভদ্রাকে হরণ করলেন...যদুবীররা ক্রুদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করল ... সুভদ্রা অর্জুনের সারথি হলেন...যদুবীররা পরাস্ত হতে লাগল .. ] 

বলরামের নিকট অর্জ্জুনের রণজয় সংবাদঃ



বলরাম যখন সসৈন্যে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন, তখন দূত এসে তাকে প্রণাম জানাল। 
সে উর্দ্ধশ্বাসে কাঁদতে কাঁদতে সব কথা বলে –হে প্রভু! আর অর্জুনের হাত থেকে আমাদের রক্ষা নেই। তাঁর উপর সুভদ্রা রথ চালাচ্ছেন। তারা কখনও মেঘে লুকায়, কখনওবা শূন্য মাঝে। খঞ্জন পাখির মত যেন নাচ করছে। সৈন্যদের মধ্যে দিয়ে ঘন ঘন ফণির মত চলে। সৈন্যদের ঘন ঘন প্রদক্ষিণ করে, যেমন মৎস জলে চরে। ডানদিকে, বামদিকে রথ বায়ুবেগে ছুটে, কখনও মাটিতে কখনওবা সূর্যমণ্ডলে ওঠে। 
সৈন্যদের সাথে অর্জুন যুদ্ধ করলেও, সে যে কোথায় কেউ বুঝতেই পারছে না। নানাবর্ণে ধনঞ্জয় অস্ত্র বর্ষণ করছেন। অগ্নি অস্ত্রে কোথাও দাবানল দেখা দিল। কোনখানে সৈন্য মাঝে বায়ু অস্ত্র মারছেন। কোথাও বা ভুজঙ্গ(সর্প) অস্ত্র মারলেন। কোনখানে জল-বৃষ্টি-শীতে তনু কাঁপে। কোথাওবা শর জালে ভানু(সূর্য) ঢেকে দেন। অর্জুনই সবাইকে মেরে যাচ্ছেন। কেউ তাঁকে ছুঁতেও পারছে না। কত যে সৈন্য মরছে, তা কেউ বলতে পারবে না। 
তাঁর এই যুদ্ধ দেখে সকলেই চমৎকৃত। সকল কুমাররা মিলে আমায় দূত করে বার্তা পাঠাল। 

মুষলী(বলরাম) দূতে বলেন –সত্য করে বল। অর্জুন এমন তুরগ রথ কোথায় পেল! 

দূত বলে –হে যাদবেন্দ্র(বলরাম), বলতে ভয় হয়। গোবিন্দের রথ, সুগ্রীবাদি ঘোড়া [কৃষ্ণের রথের চারটি ঘোড়া। শৈব্য-গায়ের রং সবুজাভ হরিতাভ, সুগ্রীব-স্বর্ণাভ তুষারসদ বর্ণ, মেঘপুষ্প-নীলাভ নবীন জলধরের মত এবং বলাহক-ভস্মবর্ণ] দেখলাম। 
সারথি দারুককে দেখলাম বাঁধা অবস্থায় রথে বসে আছেন। 
সুভদ্রাকে দেখলাম সারথি হয়ে রথ চালাচ্ছেন। 

দূত মুখে এত কথা শুনে বলরাম মাটিতে মাথা হেঁট করে বসে পরলেন। অভিমানে তাঁর চোখ দিয়ে জল বইতে থাকল। তাঁর অঙ্গের কস্তূরী গন্ধে চারদিক আমোদিত হয়ে উঠল। সর্বাঙ্গ বয়ে তাঁর কালঘাম বইতে থাকে। 
যদুবীরদের দিকে তাকিয়ে বলরাম বলেন –গোবিন্দ দেখছি আমায় অপমান করছে। নিজের সারথি ও ঘোড়া সহ রথ অর্জুনকে দিল। অর্জুনের কি শক্তি যে এমন কাজ করতে পারে! না বুঝে আমি অর্জুনকে দোষি মনে করেছিলাম। আমার সামনে মিথ্যে কথা বলল! এখন আমার সামনে আসবে কিভাবে তাই ভাবছে।
দুর্যোধনকে বিবাহ কারণে ডেকে পাঠালাম। অধিবাস অনুষ্ঠানের জন্য ব্রাহ্মণরা বসে আছেন! 

এতসব বলে বলরাম অধোমুখে বসে রইলেন। সেই সময় নবঘনশ্যাম কৃষ্ণ সেখানে উপস্থিত হলেন। ভূমিতে পরে বলরামকে প্রণাম করলেন। ক্রোধে বলরাম তাঁর দিকে তাকালেন না। 

গোবিন্দ বলেন –হে স্বামী(প্রভু), রাগ কেন করছেন! আপনার পদতলে আমি কোন অপরাধ করলাম! 

উগ্রসেন(বলরাম) বলেন –তুমি বড়ই কুকর্ম করেছ। তুমি পার্থকে ভদ্রা হরণ করতে বলেছ। সে কারণেই নিজের রথ, সারথি ও তুরঙ্গ(ঘোড়া) দিয়েছ। তোমাকে দোষ দেব না তো আর কাকে দোষ দেব! 

গোবিন্দ বলেন –সবাই জানেন সেই রথে পার্থ ভ্রমণ করতেন। আমি কি ভাবে জানব সে ভদ্রা হরণ করবে! নরমায়া বুঝতে আমি পারি না। প্রভু অকারণে আমার উপর আক্রোশ করছেন। সুভদ্রা যদি নিজেই রথ চালাতে চান, দারুকের তাতে কি দোষ! 
হে দূত সত্য করে বল দারুক সে রথে কি করছিল! 

দূত বলে –দারুক নিজের বশে নেই। পার্থ তাকে বেঁধে রেখেছেন। 

শ্রীকৃষ্ণ বলেন –যাদবরা সকলে শুনুন আমার কথা অনুভব করুন। 

আদিপর্ব মহাভারতের বিচিত্র উপাখ্যান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers