Blog Archive

Wednesday, September 29, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ২৮


দেবযানীর বিবাহঃ

এভাবে দেবযানী নানা আনন্দে দিন কাটাতে লাগলেন। দৈত্যরাজ নন্দিনী শর্মিষ্ঠা তাকে সেবা করতে লাগলেন।

আবার একদিন সহস্র দাসীসহ দেবযানী চৈত্রবনে বেড়াতে গেলেন। তিনি কিশলয়–শয্যায় শয়না, দৈত্য-রাজকন্যা শর্মিষ্ঠা তার পদ সেবায় রত।

দৈবের লিখন ঠিক সে সময় পুনরায় যযাতি সেখানে উপস্থিত হলেন।
তিনি দেবযানীর ও শর্মিষ্ঠার পরিচয় জানতে চাইলেন। দেবযানী পরিচয় দিলেন।

রাজা অবাক হলেন এমন সর্বাঙ্গসুন্দরী অসুররাজকন্যা কি করে দাসী হলেন।
দেবযানী বলেন -সবই দৈবের বিধানে ঘটে, এর দাসীত্বও সেই কারণে ঘটেছে।
দেবযানী আরো বলেন –রাজন, পূর্বে তুমি অন্ধকূপ থেকে আমাকেই হাত ধরে উদ্ধার করেছিলে। এখন আমার হাত গ্রহণ কর–আমায় বিবাহ কর।

রাজা জানান দেবযানী ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা, তিনি ক্ষত্রিয়-সে কারণে দেবযানীর যোগ্য নন।

দেবযানী বলেন –কোন ভয় নেই, আমি স্বেচ্ছায় তোমার কাছে ধরা দিচ্ছি।
তবু যযাতি শুক্রাচার্যের ভয়ে ভীত হন। জানান গুরু শুক্র যদি অনুমতি দেন তবেই এ বিবাহ সম্ভব।

দেবযানী পিতাকে সব কথা জানালেন। শুক্রাচার্য নিজে যযাতির কাছে উপস্থিত হলেন।

ব্রাহ্মণকন্যাকে বিবাহ করলে পাপ হবে কি না তা জানতে চান যযাতি।
শুক্র বলেন –ব্রাহ্মণকন্যা অপর তিন শ্রেণীর জননী তুল্য।
তবু যযাতি এ বিবাহ করুক। কাচের শাপে দেবযানীর স্ববর্ণে বিবাহ হতে পারে না। তপোবলে তিনি যযাতির সব দোষ খন্ডন করবেন।

এরপর তিনি যযাতির সাথের কন্যা দেবযানীর বিবাহ দেন এবং সাবধান করেন দৈত্য-কন্যা দাসী শর্মিষ্ঠাকে যেন শয়নের সময় কখনও ডাকা না হয়। দৈত্যরাজ শর্মিষ্ঠাসহ সহস্র দাসীর জন্য অশোকবনে রাজা বসতি স্থাপন করেন।

দেবযানী হলেন রাজার প্রধান পাটেশ্বরী। দেবযানী আনন্দে রাজার সাথে অবস্থান করলেন। দশমাস পর দ্বিতীয় চন্দ্রসম তাদের পুত্র হল। নাম রাখা হল যদু।

এ সময় দৈবের নির্দেশে দৈত্যকন্যা শর্মিষ্ঠা ঋতুমতী হলেন। ঋতুস্নান করে কন্যা চিন্তিত হলেন। ভাবলেন, নিজের দোষে তিনি স্বামীহীনা হলেন। দাসীরূপে পুত্রহীনা হয়ে তার যৌবন বৃথা গেল!

এসব ভাবতে ভাবতে তিনি ঠিক করলেন দেবযানী তার ঈশ্বরী, দেবযানীর ঈশ্বর যযাতি। সুতরাং যযাতি তারও অধিকারী।



যযাতি ছিলেন সংসারে সত্যব্রত নামে বিখ্যাত।

সে সময় রাজা সে বনে একা ভ্রমণ করতে এলেন। শর্মিষ্ঠা তার সামনে উপস্থিত হয়ে প্রার্থণা করলেন তাকে কাম ভাবে গ্রহণ না করে ধর্ম রক্ষার্থে তার ঋতুরক্ষা করুন, রাজন।

রাজা বলেন বিবাহের সময় তিনি গুরু শুক্রকে কথা দিয়েছেন শয়নকালে কখনও শর্মিষ্ঠাকে গ্রহণ করবেন না।

শর্মিষ্ঠা বলেন –রাজা, ধর্ম মতে আমি তোমারই। তোমার স্ত্রী আমার সখী এবং ঈশ্বরীও বটে! তাই তুমিই আমার অধিকারী।

শর্মিষ্ঠা যযাতির কাছে ধর্ম রক্ষার্থে সন্তান ভিক্ষা করেন।
রাজাও বলেন –আমিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে যা চাইবে তাকে তাই দেব। এই বলে তিনি শর্মিষ্ঠাকে গ্রহণ করলেন। কেউ একথা যানতে পারল না। তিনি আপন আলয়ে ফিরে গেলেন।

দশমাস দশদিন পর শর্মিষ্ঠার হস্ত-পদে চক্র শোভিত অপূর্ব পুত্র জন্মাল। সকলে সে কথা আলোচনা করতে লাগল। দেবযানী সে কথা শুনে তাকে দেখতে বনে এলেন এবং কামে মত্ত হয়ে সতীধর্ম নষ্ট করায় শর্মিষ্ঠাকে গাল দিলেন।

শর্মিষ্ঠা বলেন দৈবের লিখনে তার ঋতুকালে এক অপরূপ ঋষি বনে উপস্থিত হন এবং ধর্ম রক্ষার্থে তাকে গ্রহণ করেন। দেবযানী ঋষির পরিচয় যানতে চান। শর্মিষ্ঠা বলেন তার সূর্যের মত তেজ দেখে সাহস হয়নি পরিচয় জানবার।

দেবযানী বলেন –সখি, তুমি পূণ্যবতী। ঋষির বরেই তোমার চন্দ্রের মত পুত্র হল।

এই বলে দেবযানী অন্তঃপুরে ফিরে গেলেন। এর কিছুদিন পর দেবযানীর দ্বিতীয় পুত্র হল। নাম রাখা হল তুর্বসু। এভাবে দেবযানীর দুই পুত্র হল-যদু ও তুর্বসু।

অন্যদিকে শর্মিষ্ঠার গর্ভে রাজার তিনটি পুত্র জন্মাল। তারা হলেন-দ্রুহ্যু, অনু ও সর্ব কনিষ্ঠ সর্ব গুণাধার পুরু। রাজার কুমাররা এভাবে বড় হতে থাকেন। দেবযানী জানেন তারা ঋষির কুমার।
..........................................

Wednesday, September 22, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ২৭


বৃষপর্ব্ব-কন্যা শর্মিষ্ঠার দাসীত্বের বিবরণঃ

জন্মেজয় যোড়হাতে পুনরায় কি হল জিজ্ঞাসা করলেন।

মুনি বলেন –কচের দুঃখ দেবযানীর মনে থেকে গেল।

তিনি একদিন বৃষপর্ব্বপুরে স্নান করতে গেলেন।

বৃষপর্বরাজার কন্যা শর্মিষ্ঠাও দাসীদের সাথে সেখানে স্নান করতে এলেন।

চৈত্ররথ নামে বনে এক সরোবর ছিল। সেখানেই সকলে জলক্রীড়া করছিলেন। সকলে আপনার বস্ত্র পাড়ে রেখে জলে নামেন।

এমন সময় খরতর বায়ু বয়। সকলের বস্ত্র একত্র হয়ে যায়।
দৈত্য কন্যা শর্মিষ্ঠা সকলের আগে উঠে ভুল বশত দেবযানীর বস্ত্র পরিধান করেন।

দেবযানী দেখে ক্রোধান্বিত হয়ে বলেন -শুদ্র কন্যা হয়ে শর্মিষ্ঠার এত অহংকার! যে সে ব্রাহ্মণ কন্যার বস্ত্র পরে!

দেবযানীর বাক্যে শর্মিষ্ঠাও কুপিতা হয়ে বলেন -সত্যি, তাদের মধ্যে অনেক অন্তর! কারণ তার পিতার অন্ন গ্রহণ করেন দেবযানীর পিতা, তার পিতার সদা স্তুতি গান দেবযানীর পিতা।

এসব কথা বলতে বলতে রাগে শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে কূপে ফেলে নিজ গৃহে ফিরে গেলেন।

দেবযানী বাঁচল কি মরল কেউ তা দেখল না।

সেই বনেই ভাগ্যের ফেরে সে সময় যযাতি মৃগয়া করছিলেন।
যযাতির সৈন্যরা তৃষ্ণার্ত হয়ে জলের সন্ধানে বেড়িয়ে কূপে সুন্দরীকে পড়ে থাকতে দেখে রাজাকে সে কথা জানায়।

যযাতি এসে দেখেন এক অতি পুরাতন কূপ তৃণে আচ্ছন্ন, সেখানে চন্দ্রের সমান এক কন্যা পড়ে আছেন। তিনি কন্যার পরিচয় জানতে চান।

দেবযানী বলেন –সব পরিচয় দেব, আগে হাত বাড়িয়ে তোল। আমি শুক্রাচার্যের কন্যা।

রাজা ভয় পান। একে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ শুক্রের কন্যা, তায় যুবতী।

দেবযানী আশ্বস্ত করলেন নারীকে অন্ধকূপ থেকে বাঁচালে রাজার কোন পাপ হবে না।

যযাতি কন্যার ডান হাত ধরে তাকে কূপ থেকে উদ্ধার করলেন। পরে নিজ দেশে ফিরে গেলেন।

সে সময় ঘূর্ণিকা দাসীকে দেখে দেবযানী কেঁদে সব বৃত্তান্ত জানিয়ে পিতাকে বলে পাঠান তিনি কোন মুখে পিতৃগৃহে যাবেন।

ঘূর্ণিকার মুখে শর্মিষ্ঠার দেবযানীকে কূপে ফেলার ঘটনা শুনে শুক্র বিষণ্ণ হন এবং প্রাণপ্রিয় কন্যাকে দেখতে যান।

গিয়ে দেখেন কন্যা বনের ভিতর হেঁট মুখে বসে কাঁদছেন। তিনি কন্যাকে শান্তনা দিতে থাকেন। দেবযানী শর্মিষ্ঠার সকল কথা পিতাকে যানান।

শুক্র দেবযানীকে ক্রোধ দমন করতে বলেন।
তিনি বলেন –ক্রোধে মানুষ ভ্রষ্ট হয়, যে ক্রোধকে দমন করতে পারে সেই প্রকৃত সর্ব ধর্মে ধার্মিক।

তবু দেবযানীর মন থেকে কষ্ট দুর হয় না। শর্মিষ্ঠার অপমান তাকে পীড়িত করে।
বলেন –পিতা আমি ওসব কথা জানি, কিন্তু পন্ডিতেরা বলেন নীচ লোকের কাছে অপমানিত হওয়ার চেয়ে মরণ ভাল। অস্ত্রাঘাতে যে ক্ষত হয় তা সারে, কিন্তু বাক্ক্ষত সারে না।

কন্যার কথা শুনে শুক্র বৃষপর্ব রাজার সামনে উপস্থিত হয়ে জানালেন তিনি রাজ্য ত্যাগ করতে চান।
ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ বৃহস্পতির নন্দন কচকে তারা মিথ্যা হত্যার চেষ্টা করেছে। তার কন্যা শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে মারবার জন্য অন্ধকূপে ফেলেছে।
নারীবধ, ব্রাহ্মবধ যারা করে তারা পাপী। তাদের কাছে থাকলে তারও পাপ হবে।

দৈত্যরাজ শুক্রের পায়ে এসে পড়লেন। তাকে অনুনয় করতে লাগলেন, শুক্র যেন তাদের ত্যাগ না করেন। সকল পাপের জন্য তিনি ক্ষমা চাইলেন।

শুক্র বলেন –আমার আদরের কন্যা দেবযানীকে যদি তুষ্ট করতে পার তবেই আমি এস্থানে থাকব।

রাজা যোড়হাতে দেবযানীর কাছে গিয়ে ক্ষমা চান।
দেবযানী কোন কথা শুনতে নারাজ। তিনি শর্মিষ্ঠাকে দাসীরূপে চান।

রাজা অন্তপুরে দাসী পাঠান কন্যা শর্মিষ্ঠাকে আনার জন্য। কুল রক্ষার্থে, স্বজাতীর কল্যাণার্থে শর্মিষ্ঠা চতুরদোলায় চেপে পিতার সামনে উপস্থিত হলেন।

বৃষপর্ব বলেন দৈবের লিখন তাই শর্মিষ্ঠাকে দেবযানীর দাসী হতে হবে।
শর্মিষ্ঠা বলেন –পিতা আপনার আজ্ঞায় এবং নিজ কর্ম দোষে আমি দাসী হলাম।

দেবযানী বলেন –তুমি রাজকন্যা! তোমার পিতার স্তুতি আমার পিতা করেন। তুমি কি ভাবে আমার দাসী হবে!

এই ব্যঙ্গে শর্মিষ্ঠা বলেন –জ্ঞাতির কুশল আর পিতার বচন রাখতেই আমি দাসী হলাম। এতে আমার এতটুকু লজ্জা নেই।

এভাবে শুক্র কন্যা দেবযানীকে আপন গৃহে নিয়ে গেলেন। এবং শর্মিষ্ঠাও তার দাসীরূপে সে গৃহে অবস্থান করতে লাগলেন।

..........................................

Tuesday, September 21, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ২৬


কচ ও দেবযানীর পরস্পর অভিশাপঃ
কিছুদিন পর দেবযানী কচকে দেবপূজার জন্য ফুল আনতে বললেন। ফুল আনতে গিয়ে কচ পুনরায় দৈত্যদের হাতে পড়লেন।


এবার তাকে টুকরো টুকরো করে ঘৃতে ভাজা হল। তারা বিচার করল অন্য কেউ এ মাংস ভক্ষণ করলে তার নিস্তার নেই। কারণ শুক্রের মন্ত্রে কচ বাঁচবে কিন্তু ভক্ষকের প্রাণটি যাবে। শেষ পর্যন্ত সে মাংস সুরাসহ শুক্রকেই খাইয়ে দিল।

এদিকে দেবযানী পুনরায় পিতার কাছে কচের পুষ্প আনতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার কথা জানালেন। তিনি আশঙ্কা করলেন দৈত্যরা পুনরায় কচকে হত্যা করেছে।


শুক্রাচার্য কন্যাকে বোঝালেন মৃত জনের জন্য বিলাপ কর না। ব্রহ্মা, ইন্দ্র, চন্দ্র, সূর্য-এদের মৃত্যু হলে তারাও আর বাঁচবে না। দেবযানী বৃথাই মৃত কচের জন্য ক্রন্দন করছেন।
কিন্তু দেবযানী কচকে না দেখতে পেলে মৃত্যুবরণ করবেন জানালেন। কন্যার কথায় শুক্র চিন্তিত হলেন।


ধ্যানে বসে দেখলেন কচ তারই উদরে। তিনি কচকে কি ভাবে তার উদরে গেলেন জানতে চাইলেন। কচ সকল কথা জানালেন। শুক্র চিন্তিত হলেন। কারণ কচকে বাঁচালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আবার কচকে না বাঁচালে তার দ্বারা ব্রাহ্মণ হত্যা হয়।

শেষে শুক্র কচকে বললেন –বৃহস্পতি পুত্র, তুমি সিদ্ধিলাভ করেছ, দেবযানী তোমাকে স্নেহ করে। যদি তুমি কচরূপী ইন্দ্র না হও তবে আমার সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ কর। বৎস, তুমি পুত্ররূপে আমার উদর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আমাকে বাঁচিয়ে দিও, গুরুর নিকট বিদ্যা লাভ করে তোমার যেন ধর্মবুদ্ধি হয়।

তিনি কচকে সঞ্জীবনী মন্ত্র শিক্ষা দিচ্ছেন। কারণ কচ বাঁচলে তার মৃত্যু হবে। কচ পরে সেই মন্ত্রবলে গুরুকে বাঁচাবেন। এভাবে শুক্রের গর্ভে বসে কচ মন্ত্র অধ্যয়ন করলেন। শেষে শুক্র নিজের উদর চিরে শিষ্যকে মন্ত্রের বলে বাঁচালেন এবং নিজ়ে মৃত্যুবরণ করলেন। পরে কচ মন্ত্রের সাহায্যে গুরুকে প্রাণদান করলেন।


প্রাণ পেয়ে শুক্র সুরার উপর রেগে গিয়ে শাপ দিলেন –ব্রাহ্মণ হয়ে যে সুরা পান বা সুরার ঘ্রাণ নেবে সে অধার্মিক ও ব্রহ্মঘাতী হবে। তার ব্রহ্মতেজ নষ্ট হবে। ইহলোকে সে অপূজিত হবে এবং মরলে নরকে যাবে।
পরে শুক্র দৈত্যদের ডেকে বললেন তার শিষ্যকে কেউ হিংসা করবে না-এ বাক্য না শুনলে তার অশেষ দুঃখ আছে।


কচকে তিনি আশির্বাদ করলেন নির্ভয়ে যেখানে খুশি বিচরণ করতে পারবেন। এভাবে শুক্রের কাছে কচ সকল বিদ্যা অধ্যয়ন করলেন। শেষে দেবযানীর কাছে এসে প্রার্থনা করলেন নিজের দেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে।


দেবযানী বিষণ্ণ হলেন। কচকে ডেকে তাকে বিবাহ করতে অনুরোধ করলেন। কচ একথায় বিস্মিত হলেন। কারণ গুরুকন্যা তার কাছে ভগিনীর সমান।

দেবযানী বললেন –তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তাছাড়া আমার জন্যই তুমি বার বার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছো। এখন আমায় এভাবে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত নয়।


কচ চিন্তিত হলেন। তিনি দেবযানীকে বোঝাতে চাইলেন।
বললেন –দেবযানী, প্রসন্ন হও, তুমি আমার কাছে গুরুরও অধিক। তোমার যেখানে উৎপত্তি, শুক্রাচার্যের সেই দেহের মধ্যে আমিও বাস করেছি। ধর্মত তুমি আমার ভগিনী। অতএব আর ওরূপ কথা বলো না। তোমাদের গৃহে আমি সুখে বাস করেছি, এখন যাবার অনুমতি দাও, আশীর্বাদ করো, সাবধানে আমার গুরুদেবের সেবা করো।

একথা শুনে দেবযানী ক্রোধিত হলেন। তিনি অভিশাপ দিলেন, নারী হয়ে তিনি বারবার অনুরোধ করলেন কচ তাও কথা রাখলেন না। তাই তার পিতার কাছ থেকে কচ যত বিদ্যা শিখেছেন সব নিষ্ফল হবে।
দেবযানীর বাক্যে কচ ব্যাথিত হলেন। বললেন, বিনা অপরাধে তাকে দেবযানী এত বড় অভিশাপ দিলেন। কামে উত্তেজিত হয়ে তিনি কচকে অভিশাপ দিলেন। তাই তাকেও শাপ নিতে হবে।

কচ দেবযানীকে অভিশাপ দিলেন ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ শুক্রের কন্যা হয়ে তাকে ক্ষত্রিয়ের স্ত্রী হতে হবে। দেবযানীর শাপও তার লাগবে। কচ প্রত্যক্ষ ভাবে কোন বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারবেন না। তবে তার শিষ্যরা ফলদায়ী হবেন।

এই বলে কচ ইন্দ্রের নগরে উপস্থিত হলেন। কচকে দেখে দেবতারা আনন্দিত হলেন। তার কাছ থেকে দেবযানীর সকল কথা শুনলেন।
নিশঙ্ক হয়ে দেবতারা আবার যুদ্ধে উপনীত হলেন। দেব-দানবের সে যুদ্ধের বর্ণনা অবর্ণনীয়।
..........................................

Friday, September 17, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত – ২৫

চন্দ্রবংশের বিবরণঃ
চন্দ্র

জন্মেজয় মুনিকে জিজ্ঞাসা করলেন –চন্দ্রবংশে ভরতের জন্ম। চন্দ্রের দ্বারা কি ভাবে বংশ স্থাপন হল, সে কাহিনী শোনান।

মুনি বলেন –শুন, সোম বংশের কাহিনী।

মরীচি ব্রহ্মার পুত্র নামে বিখ্যাত।

কশ্যপ নামে তার পুত্রও জগৎ খ্যাত।

এই কশ্যপ ও স্ত্রী অদিতির(যিনি দক্ষের কন্যা) বিবস্বান(সূর্য) নামে পুত্র হয়।
সূর্যের পুত্র হলেন বৈবস্বত। ইনি সপ্তম মনু নামে পরিচিত।

এনার কন্যা ইলা। ইলার বিবাহ হয় চন্দ্রের পুত্র বুধের সাথে।

এদের সন্তান হলেন পুরুরবা। অষ্টাদশ দ্বীপের তিনি নরপতি হন। পুরুরবা উর্বশীর সাথে অবস্থান করেন।

তাদের পুত্র হলেন আয়ু।

আয়ুর পুত্র নহুষ। স্বর্গের রাজা ইন্দ্র যেন এলেন।

যযাতি হলেন নহুষের পুত্র। যযাতির গুণ অপার। শুক্রের শাপে তার শরীর জরাগ্রস্থ হল। পুত্রকে জরা দান করে তিনি বহুদিন রাজ্য শাসন করেন।
………………………………
শুক্র স্থানে কচের বিদ্যা শিক্ষাঃ

জন্মেজয় প্রশ্ন করলেন –যযাতি কোন দোষে শুক্রাচার্যের কাছে অভিশাপ পেলেন! কেনই বা ভৃগুর পুত্র যযাতিকে জরাগ্রস্থ করলেন!

মুনি এবার সে ঘটনার বর্ণনা শুরু করলেন।

দেবাসুরের সব সময় মহাযুদ্ধ লেগেই থাকত। তখন তারা আলোচনা করে নিজেদের মনমত পুরোহিত নিয়োগ করে।

দেবতাদের পুরোহিত হলেন বৃহস্পতি। অন্যদিকে দানবদের ভার্গব তথা ভৃগুপুত্র শুক্রাচার্য।

যুদ্ধে যত দৈত্যবধ হয় শুক্রের মন্ত্রে সকলে বেঁচে ওঠে। শুক্রাচার্যের সঞ্জীবনী মন্ত্রের প্রভাবে দানবদের যত মৃত্যু হয় তত তারা বেঁচে ওঠে।
এদিকে দেবতারা যুদ্ধে নিহত হলে অঙ্গিরা পুত্র বৃহস্পতি তাদের বাঁচাতে পারেন না।

দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য

শুক্রের ক্ষমতায় দেবতারা চিন্তিত হলেন।

কচ নামে বৃহস্পতির এক পুত্র ছিল। সকলে তাকে শুক্রের কাছে সেই গুপ্তমন্ত্র শিখতে পাঠালেন।

বললেন –তুমি অসুররাজ বৃষপর্বার কাছে যাও, সেখানে শুক্রাচার্যকে পাবে। শুক্রের প্রিয়কন্যা দেবযানীকে যদি সন্তুষ্ট করতে পার তবে নিশ্চয় মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করবে।

বৃষপর্বপুরে শুক্রের বাস। শিষ্য হয়ে কচ সেখানে উপস্থিত হলেন।
শুক্রাচার্যের তাঁর সুন্দরী কন্যা দেবযানীকে অসম্ভব স্নেহ করতেন।

কচ শুক্রের কাছে নিজের পরিচয় দিলেন। অঙ্গিরার পৌত্র তথা বৃহস্পতির পুত্ররূপে।

তার প্রতি খুশি হয়ে শুক্রাচার্য তাকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করলেন। তাকে সকল বিদ্যাপাঠ দিতে লাগলেন।

কচ নানা রূপে গুরুর সেবা করতে থাকেন এবং দেবযানীকেও তুষ্ট করতে থাকেন। কচ দেবযানীর সামনে হাতযোড় করে থেকেন, তিনি যা চান তাই সঙ্গে সঙ্গে করেন। নৃত্য, গীত, বাদ্যে সব সময় তাকে মনোরঞ্জন করেন। তার আজ্ঞার্থে পাশে পাশে থাকেন। এভাবে পঞ্চশত বৎসর অতিক্রান্ত হল।


কচ ও দেবযানী

কচ শুক্রের গাভীদের দেখাশোনা করতেন। গরুদের নিয়ে প্রতিদিন বনে যান।

একদিন দৈত্যেরা তাকে দেখতে পেল। সকলে যানে সে দেবতাদের পুরোহিত বৃহস্পতির পুত্র এবং মায়া করে এসেছে সঞ্জীবনী মন্ত্র শিখতে। তাই সকলে তাকে ধরে তীক্ষ্ণ খড়্গে খন্ড খন্ড করে বাঘকে সে মাংস খাওয়াল। এভাবে কচকে মেরে দৈত্যেরা ফিরে গেল।



দিন শেষ হল, গাভীরা গৃহে ফিরল কিন্তু কচ আর এল না। দেবযানী চিন্তিত হলেন। তিনি পিতার কাছে কেঁদে কচকে বাঘ, সিংহ বা দৈত্যেরা মেরেছে-অভিযোগ জানালেন। কচকে ছাড়া তিনি যে বাঁচতে পারবেন না, তাও জানালেন।

শুক্র কন্যাকে কাঁদতে বারণ করলেন এবং ‘এসো কচ’ বলে তিনবার ডাকতেই সঞ্জীবনী মন্ত্রের প্রভাবে কচ শুক্রের সামনে এসে উপস্থিত হলেন।

তাকে দেখে দেবযানী আনন্দিত হলেন এবং তিনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন জানতে চাইলেন। কচ জানালেন দৈত্যেরা তাকে মেরে ফেলে এবং গুরু তাকে পুনরায় প্রাণদান করেন। দেবযানী পিতাকে দিয়ে কচের গাভী রক্ষণবেক্ষণের কার্য বন্ধ করালেন।
……………………………………

Thursday, September 9, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ২৪

দুষ্মন্ত রাজার সহিত শকুন্তলার বিবাহঃ

রাজা বলেন –কন্যা তুমি পরমা সুন্দরী। তুমি রাজার যোগ্য, তাই আমার নারী হও। গাছের বাকল ত্যাগ করে, পট্টবস্ত্র পরিধান কর। অঙ্গে রত্ন-অলঙ্কার ধারণ কর।

একথা শুনে শকুন্তলা লজ্জিত হলেন। মৃদু ভাষে জানালেন তিনি অঙ্গীকার করছেন পিতা এসে তাকে রাজার হাতেই সম্প্রদান করবেন।

শুনে ব্যাকুল দুষ্মন্ত বলেন মুনির অপেক্ষা করতে করতে তিনি হয়ত মারাই যাবেন। বেদে আট প্রকার বিবাহের কথা আছে। গন্ধর্ব মতেও ক্ষত্রিয়েরা বিবাহ করেন। সেই মতে তাদের বিবাহ হলে মুনির বচনে দোষ হবে না।

রাজার কথায় শকুন্তলা আশ্বস্ত হলেন এবং রাজাকে সত্যবচন করতে বললেন যে তিনি শাস্ত্র মেনে গান্ধর্ব মতে বিবাহ করতে প্রস্তুত, কিন্তু রাজাকে কথা দিতে হবে যে তার গর্ভজাত সন্তানকেই রাজা করা হবে।

কামে মত্ত রাজা অঙ্গীকার করলেন।

গান্ধর্ব মতে তাদের বিবাহ হল এবং তারা শৃঙ্গারে মত্ত হলেন।

রাজা ফিরে যাওয়ার সময় বললেন লোক পাঠিয়ে তিনি শকুন্তলাকে রাজ্যে নিয়ে যাবেন।

পথে যেতে যেতে নৃপতি ভীত হলেন মুনি আশ্রমে ফিরে কি বলবেন একথা ভেবে।


এদিকে কণ্বমুনি আশ্রমে ফিরে কন্যাকে কাছে ডাকলেন। লজ্জায় শকুন্তলা পিতার সামনে এলেন না।

বিস্মিত মুনি ধ্যানের মাধ্যমে সকল ঘটনা জানতে পারলেন।
হেসে তিনি কন্যাকে বললেন –আমাকে না বলে এই কর্ম করলে!
নির্জনে বিনা মন্ত্রপাঠে সকাম পুরুষের সকামা স্ত্রীর সঙ্গে যে মিলন তাকেই গান্ধর্ব বিবাহ বলে, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে তাই শ্রেষ্ঠ।
তোমায় কন্যা স্নেহে পালন করেছি তাই ক্ষমা করলাম।

শকুন্তলা করজোড়ে বললেন –ক্ষমা করুন, পিতা!
তিনি আরো বললেন, দুষ্মন্তই তার যোগ্য পাত্র। তারা গন্ধর্ব মতে বিবাহ করেছেন। রাজাকেও যেন মুনি ক্ষমা করেন।

এত শুনে মুনি কন্যাকে আশ্বাস দিলেন এবং রাজাকেও ক্ষমা করে দিলেন।
তিনি শকুন্তলাকে বর প্রার্থনা করতে বললেন।

শকুন্তলা বললেন –পিতা, প্রসন্ন হয়ে এই বর দিন যেন অতুল প্রতাপে পৌরব অর্থাৎ পুরু বংশ পৃথিবী শাসন করে। রাজ্য চ্যুত অথবা অধর্ম পরায়ণ যেন পুরু বংশীয়েরা কোনদিন না হয়।

শকুন্তলার মুখে এই বাণী শুনে মুনি ‘তথাস্তু’ বলে বর দিলেন। এভাবে কণ্বমুনির কাছে শকুন্তলা রয়ে গেলেন।

এদিকে রাজভোগে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে ভুলে গেলেন।

কিছুকাল পর শকুন্তলা এক পরম সুন্দর পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। সেই পুত্র দিনে দিনে মুনিগৃহে বাড়তে লাগলো। ছয় বছর এভাবে কেটে গেল। রাজা কিছুই জানতে পারলেন না।


সেই শিশু ক্রমে মহা পরাক্রমী বীর হয়ে উঠল। বাঘ-সিংহ কিছুতেই তার ভয় নেই। সে বাঘ, সিংহ, মহিষ, হাতি প্রভৃতি ধরে এনে আশ্রমের বৃক্ষে বেঁধে রাখে। তার বিক্রম দেখে মুনি চমৎকৃত হলেন। সকল জন্তুকেই সে দমন করে তাই দমনক নাম রাখা হল সেই পুত্রের।

মুনি শকুন্তলার সাথে আলোচনা করলেন পুত্র যুবরাজের যোগ্য হয়ে উঠেছে, এবার তাকে নিয়ে রাজগৃহে যাওয়া উচিত। কন্যাকে বুঝিয়ে এক শিষ্যের সাথে তাকে দুষ্মন্তের কাছে পাঠালেন।

শকুন্তলা পুত্র নিয়ে রাজার সামনে উপস্থিত হলেন। পাত্র-মিত্র নিয়ে সভাগৃহে দুষ্মন্ত বসেছিলেন। রাজাকে দেখে শকুন্তলা তার পুত্রকে দেখালেন এবং পূর্বে করা প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করালেন।


সভাসদরা বিস্মিত হল।
রাজা হেসে শকুন্তলাকে চিনতে অস্বীকার করলেন।

এই অপমানে শকুন্তলা লজ্জায় ও দুঃখে সংজ্ঞাহীন স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর চক্ষু রক্তবর্ণ হল, ওষ্ঠ কাঁপতে লাগল, কটাক্ষে তিনি যেন রাজাকে দগ্ধ করতে লাগলেন। তবু ক্রোধ সম্বরণ করে তিনি রাজাকে বোঝাতে লাগলেন।

দৈবের কারণে তাদের কথা কেউ যানে না কিন্তু রাজা নিজের মনকে প্রশ্ন করুক।
জ়েনে শুনে যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে সে সহস্র বৎসর নরক গমন করে। লুকিয়ে যে পাপ কর্ম করে লোকে না জানুক ধর্ম সব জানে।
চন্দ্র, সূর্য, বায়ু, অগ্নি, পৃথিবী আর জল-আকাশ, দিন, রাত্রি, সন্ধ্যা, প্রাতঃ-শমন, ধর্ম জানেন সব জন।
বালক বৃদ্ধ সকলেই জানে ধর্মাধর্ম অনুসারে তার ফল শমন(যম) ঠিকই দেন।
তাই মিথ্যা বাক্য রাজার উচিত কাজ নয়। মিথ্যার মত পাপ নেই-একথা সকল শাস্ত্র মানে।

পতিব্রতা শকুন্তলাকে রাজার এমন নীচ ভাবা উচিত নয়। পুত্ররূপে পিতাই স্ত্রীর গর্ভে জন্মায়-শাস্ত্রে এর প্রমাণ আছে। সে কারণে ভার্যাকে জননীর সমান দেখা উচিত।

তাকে উপেক্ষা করে রাজা বিস্তর দোষ করলেন-কারণ সর্ব শাস্ত্রে স্ত্রীকে পুরুষের অর্ধেক শরীর বলা হয়। তাই ভার্যার সমান বন্ধু পৃথিবীতে আর হয় না। সে কারণে পুরুষের পতিব্রতা নারী হল পরম সহায়। তার সাহায্যেই সর্ব ধর্ম সুসম্পন্ন হয়।

ভার্যাবিনা গৃহ, শূণ্য অরণ্যের মত। আবার বনে ভার্যার সঙ্গ থাকলে গৃহস্থের বেষ্টনী মেলে। স্ত্রীহীন ব্যক্তিকে কেউ বিশ্বাসও করে না। সর্বদা এরা দুঃখিত ও উদাস থাকে।

স্ত্রীযুক্ত ব্যক্তি সুখে ইহলোকে বাস করে।
স্বামী জীবিত অবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যু হলে, সে স্বামীর পথ চেয়ে থাকে, তাকে অনুসরণ করে।
স্বামী মারা গেলে স্বামীকে উদ্ধার করে স্বর্গে নিয়ে যায়।
একথা দেবতারাও স্বীকার করেন।

ভার্যার দ্বারাই রাজা পুত্র মুখ দেখা সম্ভব। সন্তান হলেই মানুষ সব দুঃখ ভুলে সুখ পায়। স্ত্রী বিনা কারো সন্তান গ্রহণ সম্ভব নয়-দেবতা, ঋষি, মুনি প্রমুখ যতই মহামতি হোন।

পুত্রের সমান রাজা সংসারে আর কিছুই নেই। সন্তানের জন্মের পর তার মুখ দেখে পিতামাতা স্বর্গসুখ পান। পিন্ডদানের মাধ্যমে পুত্র তাদের উদ্ধার করে-এই নির্দেশ বেদে ব্রহ্মা দিয়েছেন।

চতুষ্পদের মধ্যে গাভী শ্রেষ্ঠ, দ্বিপদে ব্রাহ্মণ, অধ্যয়নে গুরু শ্রেষ্ঠ, আলিঙ্গনে পুত্র। ধূলায় ধূসর পুত্রকে আলিঙ্গন করে হৃদয়ের সর্ব দুঃখ অন্তর্হিত হয়।
সেই পুত্র তোমার সামনে দাড়িয়ে, রাজন! তাকে পরমানন্দে আলিঙ্গন কর। একে নীচ পুত্র ভেবে অবজ্ঞা করো না। এর মহিমাগীত একদিন জগৎ গাইবে। শত শত অশ্বমেধ যজ্ঞ হবে। সসাগর ধরার রাজ্য পাবে। এই পুত্রের দ্বারাই বংশ উজ্জ্বল হবে। ভাল করে প্রত্যক্ষ কর রাজা, এই দ্বিতীয় তপন।
পিতার অভাবে পুত্র সদা দুঃখ পায়-সে কারণেই তাকে এখানে আনা হয়েছে। একে আপনার কুমার রূপে আলিঙ্গন কর।


দুঃখ নেই তুমি আমাকে গ্রহণ কর বা ত্যাগ কর। কারণ পিতা বিশ্বামিত্র এবং মাতা মেনকা আমায় বনে ত্যাগ করেছেন। আমায় পূর্বেই জননী ত্যাগ করলেন! এখন তুমিও করো! আমার মৃত্যুতে দুঃখ নেই, কিন্তু এই পুত্র বিচ্ছেদই আমায় শত দুঃখ দিচ্ছে।

এত শুনে দুষ্মন্ত প্রত্যুত্তর করলেন, কেন তাকে বারবার এসকল কথা শোনান হচ্ছে! এসকল বাক্য শুনেও কেউ শকুন্তলাকে শ্রদ্ধা করবে না। কারণ, তার পিতা বিশ্বামিত্র ছিলেন পরম লোভী এবং মাতা মেনকা গণিকা। তাদের পথই শকুন্তলা অনুসরণ করেছে।

শকুন্তলার সকল বাক্য মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চান রাজা।

শকুন্তলা রাজাকে দেবলোকের নিন্দা করতে বারণ করেন।
বিশ্বামিত্র মহাঋষি সকলেই তা জানেন।
অন্যদিকে দেব-অপ্সরা মেনকাকে দেবতারাও পূজা করেন।
তাছাড়া শকুন্তলার নিজেরও অন্তরে অনেক শক্তি আছে। তিনি ইচ্ছা করলেই সব স্থানে যেতে পারেন।
তবু স্বামীর জন্যই আজ সকল নিন্দা সহ্য করছেন। কিন্তু মুনিকন্যা কখনও মিথ্যা কথন করে না-এত বলে তিনি প্রস্থানে উদ্যত হলেন।

এসময় আকাশ থেকে বাণী ঘোষিত হল -শকুন্তলার সকল বাক্য সত্য, তিনি প্রকৃতই দুষ্মন্তের স্ত্রী। তিনি পতিব্রতা এবং তার পুত্রের পিতা রাজা দুষ্মন্ত।
স্বামী বলেই শকুন্তলা আজ তোমায় ক্ষমা করলেন। তার ক্রোধে রাজার কখনও ভাল হবে না। এই পুত্রই তার বংশের তিলক। আজ থেকে এর নাম হল-ভরত। এর মাধ্যমেই দুষ্মন্তের বংশোজ্জ্বল হবে।

এই আকাশবাণী শুনে রাজা বলেন –মন্ত্রীরা সব অবগত হলেন! আমি এ সত্য প্রকৃতই জানতাম। কিন্তু লোকাচারের ভয়ে শকুন্তলাকে গ্রহণে অক্ষম ছিলাম। তাকে অপমান করলাম।

এত বলে তিনি সিংহাসন থেকে নেমে শকুন্তলার হাত ধরলেন এবং তাকে ফিরিয়ে আনলেন। পুত্রকে ক্রোড়ে তুলে শত শত চুম্বন একে দিলেন
কপোলে।

শকুন্তলা হলেন রাজ পাটেশ্বরী। পরমানন্দে তারা রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। বৃদ্ধ বয়সে তারা রাজ্যভার ভরতের হাতে অর্পণ করে বনবাসে গেলেন।

পৃথিবীর মহারাজ হলেন ভরত। তিনি অশ্বম্বেধ যজ্ঞ করেন। দানধ্যান করেন। দাতারূপে জগৎ খ্যাত হন। তার ঘোষিত ভূমি ভারতভূমি নামে খ্যাতি লাভ করে।

ভরত–উপাখ্যান যারা করেন শ্রবণ, আয়ুর্যশ পূণ্যযশ তাদের বাড়ে দিন দিন।।
..........................................

Saturday, September 4, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ২৩


শকুন্তলার উপাখ্যানঃ
এরপর মুনি বলেন -শুন পরীক্ষিত পুত্র, ভরত বংশের কথাও অদ্ভূত।

জগৎবিখ্যাত রাজা ছিলেন দুষ্মন্ত। তিনি সংসারে এসে যেমন বসুন্ধরাকে ভোগ করেন তেমনি ধর্মের সাথে প্রজাপালন করেন এবং দুষ্টের সংহার করেন। তিনি রূপবান সুপুরুষ-একছত্র অধিপতি, মৃগয়াপ্রিয়।

একদা তিনি বনে মৃগয়া করতে গেলেন। সসৈন্য মহারাজ এক মহাবন ঘিরে ফেললেন। অসংখ্য সিংহ, ব্যাঘ্র, ভল্লুক, বরাহ, মৃগ শিকার করলেন। সৈন্যরাও নির্বিচারে শিকার করল। কিছু রথে রাখা হল, কিছু কাধে নিয়ে যাওয়া হল-কেউ কেউ আবার সেখানেই পুড়িয়ে খেল।

হিরণ্য নামে এক অতি মনোরম বন-যেখানে কণ্বমুনির আশ্রম ছিল। নানাজাতির বৃক্ষ তাতে নানা ফুল-ফল, নানা শ্রেণীর পাখি সেথায় সদা গান গায়। গাছে গাছে যেন মধুচক্রের অবস্থান। বায়ুর তেজে সেথায় সদা পুষ্পবৃষ্টি হয়। সেই বনের পাশ দিয়ে বয়ে যায় মালিনী নদী। মুনিরা এই নদীর দু’তীরে বসে ধ্যান করেন।

সেই বনে মুনির আশ্রম আছে বুঝতে পেরে দুষ্মন্ত এগিয়ে গেলেন এবং সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন তিনি না ফেরা পর্যন্ত এই স্থানেই তারা অপেক্ষা করবে। এই বলে তিনি কণ্বমুনির আশ্রমে উপস্থিত হলেন। কিন্তু আশ্রমে মুনি নেই দেখে তিনি বিষণ্ণ হলেন।
সে সময় মুনির পালিতা কন্যা শকুন্তলা এসে রাজাকে পাদ্য-অর্ঘ্য নিবেদন করলেন। শকুন্তলার রূপে রাজা মোহিত হলেন।

কামান্ধ রাজা শকুন্তলাকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কে, কি ভাবে এখানে এসেছেন।

শকুন্তলা বললেন –পিতা কণ্বমুনি ফলের সন্ধানে বেরিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ফিরে আসবেন।

রাজা পুনরায় প্রশ্ন করলেন দারাত্যাগী জিতেন্দ্রিয় মহা ব্রহ্মচারী কণ্বমুনির কন্যা তিনি হতেই পারেন না! সত্য পরিচয় জানতে তিনি উৎসুক।

তখন কন্যা তার জন্মরহস্য উদ্ঘাটন করলেন। তিনি প্রকৃতই মুনির কন্যা। তার পিতা বিখ্যাত বিশ্বামিত্র মুনি।

বিশ্বামিত্রের তপস্যার তেজে পুরন্দর কম্পমান হন। তার ভয় হয় এই মুনি তার ইন্দ্রত্ব হরণ করবেন। সব দেবতাদের সাথে অনেক পরামর্শ করে তিনি শেষ পর্যন্ত অপ্সরা মেনকাকে ডেকে পাঠান।

মেনকাকে তিনি বলেন রূপে, গুণে তার তুল্য ত্রিভূবনে কেউ নেই। নিজ গুণে মেনকা যেন ইন্দ্রের সাহায্য করেন। বিশ্বামিত্রের তপস্যা যে করে হোক মেনকাকে ভঙ্গ করতেই হবে।

একথা শুনে মেনকা কম্পিত হন।
যোড়হাতে বলেন -বিশ্বামিত্র মহাতেজা ঋষি। তার ক্রোধে বশিষ্ঠের শত পুত্রের মৃত্যু হয়েছে। তার আজ্ঞাতে কৌশিকী নদীর উদ্ভব। যাকে দেবরাজ ইন্দ্র ভয় পান-তার তপস্যা নষ্ট করতে মেনকারও সাহস হয় না।

যদিও দেবরাজের আজ্ঞা কোন মতেই লঙ্ঘন সম্ভব নয়, তাই কামদেব ও বায়ুকে সঙ্গে নিয়ে মেনকা হেমন্ত পর্বতে যেখানে বিশ্বামিত্র মুনি তপস্যায় রত সেখানে উপস্থিত হলেন।

মুনিকে দেখে মেনকার অন্তর কম্পিত হল। তিনি মুনির সামনে মায়ার ক্রীড়া শুরু করলেন। এই সময় প্রবলবেগে বায়ু প্রবাহিত হয়ে মেনকার সকল বস্ত্র উড়িয়ে নিয়ে গেল। ধিরে ধিরে মেনকা বস্ত্র আনতে গেলেন এবং বায়ুর নিন্দা শুরু করলেন।

এইসব কৌতুক দেখতে দেখতে মুনির শরীরে কাম পঞ্চশর ভেদ করলেন। কামান্ধ মুনি মেনকাকে নিজের অবয়বে ধারণ করলেন। কামে মত্ত হয়ে শৃঙ্গার রসে তারা মত্ত হলেন। এভাবে বহুদিন ক্রীড়ারসে গেল। জপতপ ত্যাগ করে মুনি কামের বশ হলেন।

একদিন সন্ধ্যাকালে বিশ্বামিত্র সন্ধ্যা আহ্নিকের জন্য মেনকাকে জল আনতে বললেন।
শুনে মেনকা হেসে বললেন -ভাল, এতদিনে সন্ধ্যার কথা স্মরণ হল!

একথা শুনে মুনি অত্যন্ত কুপিত হলেন। তা দেখে মেনকা ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন।

তার গর্ভে মুনির ঔরসে সন্তানের উদ্ভব হয়। সে সন্তান তিনি অরণ্যে প্রসব করে আবার স্বর্গে ফিরে যান। সেই সন্তানই হলেন শকুন্তলা।

এভাবে মেনকা মুনির তপস্যা ভঙ্গ করে শকুন্তলাকে অরণ্যে ফেলে চলে যান। অদ্ভুতভাবে বাঘ, সিংহ-পশুরা কেউ শিশুকে হিংসা করল না। পাখিরা শিশুকে ঘিরে রাখল। সে সময় কণ্বমুনি তপস্যা করতে সে বনে উপস্থিত হন এবং দয়া বশত অনাথাকে নিজ কুটীরে এনে পালন করেন। সেই থেকে তিনি কণ্বমুনির কন্যা। শকুন তথা পক্ষীরা তাকে আগলে রাখে তাই তার নাম হয় শকুন্তলা।
এক মুনি কন্বকে শকুন্তলার জন্ম কথা জিজ্ঞাসা করলে শকুন্তলা সে কাহিনী জানেন।
..........................................

Wednesday, September 1, 2010

শিউলি ফুলের পৌরাণিক কাহিনীঃ



শিউলির আরেক নাম পারিজাত।

কৃষ্ণের দুই স্ত্রী-সত্যভামা ও রুক্মিণীর খুব ইচ্ছে তাদের বাগানও পারিজাতের ঘ্রাণে আমোদিত হোক।
কিন্তু পারিজাত তো স্বর্গের শোভা!
কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে চান। তাই লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে এনে সত্যভামার বাগানে রোপণ করেন, যার ফুল রুক্মিণীর বাগানেও ঝরে পড়ে সুগন্ধ ছড়ায়।

এদিকে স্বর্গের রাজা ইন্দ্র তো ঘটনাটা জেনে খুব রেগে যান! তিনি বিষ্ণু অবতারের উপর গোপনে ক্রুদ্ধ ছিলেন। এই অছিলায় তিনি কৃষ্ণকে শাপ দেন কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই কিন্তু ফল কোনদিনও আসবেনা, তার বীজে কখনও নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না।

আরেকটি গল্পও আছে, এই ভেষজ বৃক্ষের!

পারিজাতিকা নামে এক রাজকন্যা সূর্যের প্রেমে পড়ে তাকে কামনা করেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও পান না। তাই তিনি আত্মহত্যা করেন।
তার দেহের ভস্ম পারিজাতবৃক্ষ রূপে ফুটে ওঠে। যে কিনা নিরব ব্যর্থ প্রেমের প্রতীক! সূর্যের স্পর্ষ মাত্র যে ঝরে পড়ে আশ্রুবিন্দুর মত।
পৃথিবীর বুকে তুমি তার দুঃখের চিহ্ন দেখবে শত শত অশ্রুবিন্দুর মত সে সুগন্ধি ছড়িয়ে থাকে চারদিকে, আমরা এখন তাকে শিউলি রূপে দেখি তার শুভ্র দেহে গৈরিক বসনে...
হিন্দু দেবতার পুজোয় শিউলিই এমন ফুল যেটি মাটিতে ঝড়ে পড়লেও তাকে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়ে থাকে...

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers