Blog Archive

Monday, February 23, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৮১

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষত্রিয়দের বারবার লক্ষ্যভেদের জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন...শেষে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় লক্ষ্য ভেদ করতে উঠলেন... তিনি গুরুজনদের প্রণাম জানালেন...কৃষ্ণ বলরামকে বলেন তিনি অর্জুনকে সর্বপ্রকার সাহায্য করবেন ...অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হলেন ...অন্যান্য রাজা ক্রুদ্ধ হল... ] 

অর্জ্জুনের সহিত রাজগণের যুদ্ধঃ 

 

ক্রুদ্ধ রাজারা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হন-জরাসন্ধ, শল্য, শাল্ব, কর্ণ, দুর্য্যোধন, শিশুপাল, দন্তবক্র(শিশুপালের ভাই, কৃষ্ণের শত্রু), কাশীর রাজা, রুক্মী, ভগদত্ত, ভোজ, কলিঙ্গ প্রভৃতি। চিত্রসেন, মদ্রসেন, চন্দ্রসেন, নীলধ্বজ, রোহিত, মহাতেজা বিরাট, কিচক(বিরাটের সেনাপতি), ত্রিগর্ত, সুবাহু রাজা প্রমুখ সকলে নানা অস্ত্রবর্ষণ শুরু করে। খট্টাঙ্গ(মুগুর বিশেষ), ত্রিশূল, জঠী, ভূষন্ডী, তোমর, শেল, শূল, চক্র, গদা, মুষল, মুদ্গর(গদা) প্রভৃতি অস্ত্র রাজারা প্রয়োগ করতে লাগলো। 

রাজাদের এমন রূপ দেখে দ্রৌপদীর হৃদয় কম্পিত হল, তিনি ভয়ে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বলেন –দ্বিজবর, এখন তো কোন উপায় দেখছি না। রাজারা সমুদ্রের মত আমাদের ঘিরে ফেলেছে। এদের বিরুদ্ধে আমার পিতার শক্তি খুবই সামান্য। আমি আপনাকে বরণ করে সকলকেই বিপদের ফেললাম। 

অর্জুন দ্রৌপদীকে অভয় দিয়ে বলেন –তুমি আমার কাছে থাক। আমার পিছনে নির্ভয়ে দাড়িয়ে দেখ আমি কি করি। 

কৃষ্ণা দ্রৌপদী অবাক হয়ে বলেন –একা আপনি কি করবেন এই লক্ষ রাজাদের বিরুদ্ধে! 

হেসে অর্জুন বলেন –হে গুণবতী, একাই আমি এই নরপতিদের বিনাশ করব। একার প্রতাপও কত শক্তিধারী তা তুমি দেখছি জাননা। একা সিংহ সকল শত্রুকে তাড়ায়, একেশ্বর গরুড় সকল পক্ষীকে নাশ করতে পারে, একেশ্বর পুরন্দর-ইন্দ্র সকল দানবকে বিনাশ করেন, একা বাঘ লক্ষ হরিণ নাশ করে, একা বিষধর শেষনাগ সমুদ্রমন্থন করলেন, একা হনুমান লঙ্কা জ্বালালেন-তেমনি আমিও এই রাজাদের নাশ করব, তুমি ভয় পেয় না। 

এভাবে অর্জুন দ্রৌপদী-কৃষ্ণাকে আশ্বাস দিলেন। অর্জুন ধনুরগুণে টঙ্কার দিলেন। দ্রুপদরাজা পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখন্ডী এবং ভাই সত্যজিতকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন কিন্তু মুহুর্তে রাজাদের আক্রমণে সসৈন্য পলায়ন করলেন। অর্জুনকে সকলে ঘিরে ফেললো। 
দেখে পবনকুমার ভীম ঠোঁট কামড়ালেন। তিনি যুধিষ্ঠিরের সম্মতি চাইলেন। 
যুধিষ্ঠির সব দেখে সম্মত হয়ে বলেন –অনর্থ হল, একলক্ষ রাজা অর্জুনকে ঘিরে ধরেছে। শীঘ্র গিয়ে ভীম অর্জুনকে নিয়ে এস। যুদ্ধ করার কোন প্রয়োজন নেই। 

বড়ভাইয়ের অনুমতি পেয়ে বৃকোদর ভীম একটি দীর্ঘ বৃক্ষ উপড়িয়ে দৌড়ে গেলেন। অতি উঁচু বৃক্ষটিকে নিষ্পত্র করলেন। বায়ুবেগে ধেয়ে ভীম সৈন্যদের মধ্যে প্রবেশ করলেন। ব্রাহ্মণরাও ক্ষত্রিয়দের এমন আক্রমণে রেগে গেল। ভীমের পিছন পিছন তারাও দৌড়াল। 
তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল –দেখ, এই পাপিষ্ট দুরাচার ক্ষত্রিয়রা স্বচক্ষে দেখল সভার মাঝে এই ব্রাহ্মণ-দ্বিজ লক্ষ্যভেদ করেছেন। নিজেদের শক্তি ছিল না, কিন্তু ব্রাহ্মণকে করতে দেখে প্রতিহিংসায় এতজন মিলে এক ব্রাহ্মণবধে চলেছে। এমন অন্যায় আমরা সহ্য করব না। যুদ্ধ করে আমরা সবাই প্রাণ দেব। আজ সবকটাকে যুদ্ধে মারব, এমন কর্ম সহ্য করব না। 

এসব বলতে বলতে ব্রাহ্মণরা হাতে দন্ড তুলে নিল। হরিণের চামড়া শরীরে দৃঢ় ভাবে বেঁধে নিল। লক্ষ লক্ষ্ ব্রাহ্মণ বায়ুবেগে দৌড়ে গেল রাজাদের দিকে। 

দেখে অর্জুন কৃতাঞ্জলি করে ব্রাহ্মণদের পায়েরধূলি গ্রহণ করলেন। বিনয়ের সঙ্গে বলেন –আপনারা এখানে এলেন কেন! আপনারা দাঁড়িয়ে দেখুন কি হয়। যাদের মুখের বচনে ভস্ম করেন, তাদের সাথে যুদ্ধ করা আপনাদের শোভা পায় না। আপনাদের চরণ প্রসাদে আমি অনায়াসে দুষ্ট ক্ষত্রিয়দের মারব। যে ভাবে এরা অন্যায় করল তার উচিত শিক্ষা এরা এখানেই পেয়ে যাবে। 
এভাবে ব্রাহ্মণদের নিবৃত্ত করে অর্জুন রাজাদের উদ্দেশ্যে ধেয়ে গেলেন। 

সব দেখে হেসে বলরাম কৃষ্ণকে বলেন –আমি আগে যা বলেছিলাম দেখ তাই হল। একলক্ষ রাজা সসৈন্য নিয়ে অর্জুনকে ঘিরে ধরেছে। একা পার্থ কত জনকে বাঁধা দেবে! এর তো কোন প্রতিকারই দেখছি না। রাজারা সবাই প্রতিজ্ঞা করেছে ব্রাহ্মণকে মেরে কন্যাকে দুর্যোধনের হাতে তুলে দেবে। 

 
বলরামের কথায় কৃষ্ণ দুঃখিত হলেন। করুণায় নয়ন বিকশিত হল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বলেন –হে যাদববীর! যা বললেন তা সত্য। একলক্ষ রাজারা একজন মানুষকে মারতে উদ্যত। কিন্তু অর্জুনের পরাক্রম সম্পর্কে আপনি জ্ঞাত নন। যদি সুরাসুর ও মনুষ্য এক সাথে অর্জুনের সাথে বিবাদ করে তবু সে মুহুর্তে সসাগর ভূমি জয় করতে পারে। সে হচ্ছে দুর্গম বনে মদমত্ত বাঘের মত, তাকে কি করতে পারে ছাগরূপ রাজারা! তুমি বললে রাজারা তাকে মেরে কন্যা দুর্যোধনকে দেবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ কবে কোথায় চাঁদ ধরতে পারে! বাঘের মুখে শেয়াল কবেই বা মাংস ধরে। তবে যদি দেখি অর্জুনের বিপদ উপস্থিত তখন সুদর্শনচক্রে আমি সবাইকে ছেদ করব। 

শুনে বলরাম মনে মনে ভয় পেলেন। তাঁর শিষ্য দুর্যোধনকে তিনি স্নেহ করতেন। পান্ডবদের শত্রু এই ছলে যদি কৃষ্ণ তাকে বশ করেন এই ভেবে তিনি কৃষ্ণকে বলেন –আমাদের এই যুদ্ধের মধ্যে যাওয়ার দরকার নেই। বিশেষত আপনার মতে যখন অর্জুন অনায়াসে এদের হারাবেন। আমরা বরং এখান থেকে যুদ্ধ দেখি। 

গোবিন্দ(কৃষ্ণ) বলেন –আমি যুদ্ধে যাব না। আপনার আজ্ঞা লঙ্ঘন করব না। পার্থকে ত্রিভুবনে জয় করার মত শক্তি কারো নেই। এক্ষুনি তা দেখতে পাবেন। আমার কথা না ফললে সুমেরু টলে যাবে, সিন্ধুর জল শুকাবে, দাবানলও চিরদিনের মত শীতল হবে। দিনমনি সূর্যও যদি পশ্চিমে উদয় হন তবুও কেউ যুদ্ধে অর্জুনকে পরাজিত করতে পারবে না। 

গোবিন্দের মুখে অর্জুনের এত কথা শুনে বলরাম চুপ করে গেলেন। একলক্ষ রাজারা পার্থকে ঘিরে ফেলল। কিন্তু পার্থ ব্যাঘ্রের মত মৃগরূপী রাজাদের সম্ভ্রম দেখালেন না। মহাবীর অর্জুন হিমাদ্রি পর্বতের মত অনড়। সমুদ্রের মত তাঁর গভীর বুদ্ধি। জন্তুদের মধ্যে যেন কালান্ত যম। ইন্দ্রের সন্তান ইন্দ্রের মতই পরাক্রমী। বৃক্ষ যেমন অনায়াসে বৃষ্টিধারা মাথা পেতে নেন, তেমনি অর্জুন রাজাদের বাণবৃষ্টি সহ্য করলেন। 
দেবতারা এই দৃশ্য দেখে অর্জুনের জন্য চিন্তিত হলেন। একা পার্থের লক্ষ বিপক্ষ। তাঁর হাতে আছে মাত্র তিনটি অস্ত্র লক্ষ্যভেদের জন্য। পুত্রকে সাহায্যের জন্য দেবরাজ ইন্দ্র দ্রুত অস্ত্রপূর্ণ তূণ(বাণ রাখার পাত্র) পাঠিয়ে দিলেন। প্রসাদরূপে পুত্রকে তিনি বৈজয়ন্তী মালাও পাঠালেন। 
খুশি হয়ে অর্জুন সিংহনাদ ছাড়েন। ধনুকে টঙ্কার দিয়ে নিমেষে সকল শরবৃষ্টি রোধ করেন। যেন মহাবাতাস এসে মেঘমালা উড়িয়ে দিল, সমুদ্রের ঢেউ সহজেই ভেলা উল্টে দিল। শিশুরা যেমন গেন্ডু(বল) খেলে, রাজারাও তেমনি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছিল। দাবাগ্নি যেমন ভাবে বৃষ্টির জলে শেষ হয়, তেমনি পার্থও নিমেষে তাদের শান্ত করলেন। 

মহাভারতের কথা সুধাসিন্ধুর সমান। কাশীদাস কহেন এবং সর্বদা সাধুরা তা পান করেন। 
................................... 

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers