Blog Archive

Sunday, December 14, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭০

 
কল্মাষপাদ রাজার উপাখ্যানঃ 

বিশ্বামিত্র মুনি হলেন অতি মহান যোগী তপস্বী। তাঁর সমান কেউ নেই। কিন্তু বিশ্বামিত্রের মনে সব সময় বশিষ্ঠের অপমানের কথা মনে ছিল। সুর(দেবতা), অসুর, নাগ, নর সকলে বশিষ্ঠের পূজা করে। দেবরাজ তাঁর সাথে বসে সুধা পান করেন। এত সব ভেবে ভেবে তিনি বশিষ্ঠের উপর আরো ক্রোধিত হলেন। বশিষ্ঠের কোন ছিদ্রতা, দুর্বলতার খোঁজে তিনি ঘুরতে লাগলেন। 

ইক্ষ্বাকুবংশের রাজা সর্বগুণ সম্পন্ন, সংসারে তিনি কল্মাষপাদ নামে বিখ্যাত। মহা মুনি বশিষ্ঠ তাঁর পুরহিত। রাজা যজ্ঞের কারণে বশিষ্ঠকে আমন্ত্রণ জানালেন। কিছু কাজ থাকায় বশিষ্ঠ আসতে পারলেন না। রাজা বলে পাঠালেন তিনি তখনই যজ্ঞ করতে চান। তবু বশিষ্ঠ না এলে রাজা রেগে গেলেন ও বিশ্বামিত্রকে যজ্ঞ করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। রাজা নিজে বিশ্বামিত্রকে নিয়ে এলেন। 
পথে বশিষ্ঠের পুত্র শক্ত্রির সঙ্গে দেখা হল। 
রাজা বলেন – মুনিবর আমার পথ ছেড়ে যান। 
শক্ত্রি বলেন – রাজা আমাকে আগে যেতে পথ দিন। 
রাজা বলেন – এ পথ রাজার, সবাই তা যানে। তাই আপনি আগে পথ ছাড়ুন। আমি এখনই যজ্ঞ করতে যাব। 
শক্ত্রি বলেন – বেদে আছে ব্রাহ্মণকে আগে পথ ছেড়ে দিতে হয়। আপনি একটু পথ ছাড়ুন, আমি চলে যাই। 
 
শক্ত্রি 

এইভাবে দু’জনের কথা কাটাকাটি হতে লাগল, কেউই পথ ছাড়তে রাজি হলেন না। রাজা রেগে গিয়ে হাতে যে দন্ড ছিল তা দিয়ে মুনিকে প্রহার করলেন। আঘাতে শক্ত্রির শরীর দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। 
শক্ত্রি মুনি রেগে গেলেন। ক্রুদ্ধ চোখে রাজাকে বললেন – উচ্চবংশে জন্মে এমন নীতি বিরুদ্ধ কাজ করলি। দুর্বুদ্ধিতে তুই ব্রাহ্মণকে হিংসা করলি! এই পাপে আমার অভিশাপে তুই নিশাচর হবি। নরমাংস ভোজী রাক্ষসে পরিণত হবি। 

শাপ শুনে সৌদাসপুত্র কল্মাষপাদ ভয় পেলেন। তিনি শক্ত্রিমুনিকে প্রসন্ন করার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। কল্মাষপাদকে যজমানরূপে পাওয়ার জন্য বিশ্বামিত্রেরও চেষ্টা ছিল। 
রাজা যখন কাকুতি মিনতি করছেন তখন বিশ্বামিত্রের আদেশে কিংকর নামে এক রাক্ষস রাজার শরীরে প্রবেশ করল। সঙ্গে সঙ্গে রাজা হতজ্ঞান হলেন। বিশ্বামিত্র মুনিও সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্দ্ধান হলেন। সামনে শক্ত্রিমুনিকে পেয়ে রাজা তাকে বাঘের মত চেপে ধরল। রাজা রেগে বলে – দুষ্ট তুমি আমাকে শাপ দিলে, এবার ফল ভোগ কর। 
বলেই শক্ত্রিকে বধ করে তাঁর ঘাড়ের রক্ত খেল। শক্ত্রিকে ভক্ষণ করে তাঁর ভয়ঙ্কর মূর্তি হল। উন্মাদের মত বনের ভিতর ঘুরতে লাগল। বিশ্বামিত্রমুনি এ অবস্থায় দেখে কৌশলে তাকে বশিষ্ঠের আশ্রমে নিয়ে গেলেন ও মুনির শতপুত্রকে দেখিয়ে দিলেন। রাক্ষস এক এক করে শতপুত্র ভক্ষণ করল। 
 
রাক্ষস রাজা 
বশিষ্ঠ আশ্রমে ফিরে পুত্রদের না দেখতে পেয়ে অবাক হলেন। ধ্যানের মাধ্যমে তিনি জানতে পারলেন বিশ্বামিত্রের প্ররোচনায় রাক্ষস তাঁর শতপুত্রসহ শক্ত্রিকে ভক্ষণ করেছে। অতি ধৈর্য্যবন্ত হলেও তিনি শতপুত্রের শোক সহ্য করতে পারলেন না। পুত্রশোকে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন। শোকাতুর মুনি সমুদ্রে ঝঁপ দিলেন। সমুদ্র তা দেখে সস্নেহে তাকে কূলে রেখে গেল। সমুদ্রে মরণ হল না দেখে মুনি উচ্চ পর্বতে উঠলেন। সেখান থেকে ঝাঁপ দিলেন। বিশ সহস্র ক্রোশ উঁচু থেকে পরেও মুনি তুলোর রাশির উপর পরলেন। তিনি শোকে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। এবার শোকতপ্ত মুনি আগুনের মাঝে প্রবেশ করলেন। অগ্নিও নিজেকে প্রসারিত করে আকাশ স্পর্শ করে শীতল হয়ে গেল। মুনিকে অগ্নির তাপ স্পর্শ করল না। এরপর বশিষ্ঠ ঘন অরণ্যে প্রবেশ করলে হিংস্র বন্য পশু- বাঘ, হাতী, ভাল্লুক, শুকর সকলে শোকাতুর মুনিকে দেখে পালালো। এভাবে অনেক চেষ্টা করেও বশিষ্ঠ মৃত্যু বরণ করতে পারলেন না। শোকে মুনি নানা দেশ ভ্রমণ করতে লাগলেন। অনেকদিন পর শেষে নিজের আশ্রমে ফিরলেন। ঘরে প্রবেশ করে শতপুত্রকে দেখতে না পেয়ে আবার পুত্রশোকে তাঁর শরীর অবশ হল। তিনি পূর্বকাল স্বপ্নের মত দেখতে লাগলেন, চারদিকে পুত্রেরা উচ্চ কন্ঠে বেদপাঠ করছে। এসব চিন্তা করতে করতে বশিষ্ঠ কষ্ট পেতে লাগলেন। গৃহে প্রবেশের মন চাইল না। পুনরায় তিনি দেশান্তরি হলেন। আবার আত্মহত্যার নানা চেষ্টা তিনি করতে লাগলেন। দেখলেন একটি গভীর নদীতে লক্ষ লক্ষ ভয়ঙ্কর কুমীর ভাসছে, তাতে ঝাঁপ দিতে গেলেন মুনি। সে সময় পিছন থেকে বেদপাঠের ধ্বনি শুনতে পেলেন। বিস্মিত হয়ে মুনি পিছন ফিরে দেখলেন শক্ত্রির স্ত্রী বিধবা অদৃশ্যন্তী দাঁড়িয়ে আছে। 

 
শক্ত্রির স্ত্রী বিধবা অদৃশ্যন্তী 

যোড়হাতে শক্ত্রির বিধবা স্ত্রী বলেন – প্রভূ, আমি আপনার সাথে এখানে এসেছি। 
মুনি প্রশ্ন করেন – তোমার সঙ্গে আর কে আছে! শক্ত্রির মত কণ্ঠস্বরে কে যেন বেদপাঠ করছিল মনে হল! 
অদৃশ্যন্তী বিনয়ের সঙ্গে জানান – আমার গর্ভে শক্ত্রির পুত্র বড় হচ্ছে। বার বছর ধরে সে বেদ অধ্যয়ন করেছে, সেই বেদপাঠ করছিল। 
তাঁর বংশের সন্তান জীবিত আছে জেনে বশিষ্ঠ আনন্দিত হয়ে পুত্রবধূকে নিয়ে আশ্রমে চললেন। পথে রাক্ষসরূপী কল্মাসপাদের সাথে দেখা হল। রাক্ষস বশিষ্ঠকে দেখে ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে তাকে খেতে গেল। তাঁর বিকটরূপ দেখে অদৃশ্যন্তী থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। বশিষ্ঠ তাঁর ভীত পুত্রবধূকে বললেন – ভয় নেই, ইনি কল্মাষপাদ রাজা। 
এই বলে তিনি হুঙ্কার করে কল্মাষপাদকে থামিয়ে তাঁর গায়ে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে তাকে শাপমুক্ত করলেন। চেতনা পেয়ে রাজা পূর্বের কথা সব মনে পরল। কৃতাঞ্জলিপুটে তিনি বশিষ্ঠের স্তব করে বলেন – অধম, পাপিষ্ঠ আমি, আমার পাপের অন্ত নেই। আপনি দয়াবন্ত, দয়া করুন, মুনিরাজ! 
মুনি বলেন- শীঘ্র অযোধ্যা নগরে ফিরে গিয়ে রাজ্য শাসন কর। কিন্তু আর কখনও ব্রাহ্মণের অপমান করো না। 
রাজা কল্মাষপাদ বলেন – আমি আপনার আজ্ঞাধীন হয়ে দ্বিজ-ব্রাহ্মণদের পূজা করব। সূর্যবংশে আমার জন্ম সৌদাস রাজার পুত্র আমি। এমন কিছু করুন যাতে আমায় কেউ নিন্দা না করে। 
আশীর্বাদ পেয়ে রাজা অযোধ্যায় ফিরলেন। পুত্রবধূকে নিয়ে বশিষ্ঠ নিজের ঘরে এলেন। কিছুদিন পর শক্ত্রির বিধবা স্ত্রী অদৃশ্যন্তী একটি পুত্র জন্ম দিল। ইনি হলেন মুনি পরাশর। পৌত্র দেখে বশিষ্ঠের শোক নিবৃত্ত হল। তিনি অতি যত্নে বালককে শিক্ষাদান করতে লাগলেন। শিশুকাল থেকেই পরাশর মহা মুনি। তিনি বশিষ্ঠকেই পিতা বলে জানতেন। একদিন পরাশর মায়ের সামনেই বশিষ্ঠকে পিতা বলে সম্বোধন করলে অদৃশ্যন্তী সাশ্রুনয়নে বলেন – পিতৃহীন পুত্র আমার বড় অভাগা। পিতামহকে পিতা বলে আর ডেকো না। যখন তুমি আমার গর্ভে ছিলে, তখনই তোমার পিতাকে বনে রাক্ষস খেয়ে নেয়। 
মায়ের মুখে একথা শুনে, বিশেষ করে মায়ের শোক ক্রন্দন দেখে পরাশর মুনি রাগে কাঁপতে লাগলেন। ক্রুদ্ধ পরাশর চিন্তা করতে লাগলেন- বিধাতা এত বড় নির্দয়! রাক্ষসের হাতে আমার পিতাকে মারলেন! আজ আমি বিধাতার সব সৃষ্টি বিনাশ করব। ত্রিলোকে তাঁর সৃষ্টির একজনকেও রাখব না। 
 
পরাশর মুনি 
পরাশর যখন এই সংকল্প করছেন বশিষ্ঠ মুনি সব কথা জানতে পারলেন। পৌত্রকে নিরস্ত করার জন্য মধুর বচনে প্রবোধ দিয়ে বলেন – অকারণে শিশু তুমি কার উপর রাগ কর! ক্রোধ ব্রাহ্মণের উচিত কর্ম নয়। বেদে বলে ক্ষমা ও শান্তি ব্রাহ্মণের ধর্ম। কর্ম অনুসারে শক্ত্রির এমন মৃত্যু হল। তাঁর জন্য অনুশোচনা করো না। কার এত শক্তি তাকে মারতে পারে। সবাই সংসারে কর্ম অনুরূপ ফল পায়। ক্রোধ শান্ত কর, বস! তত্ত্বে মন দাও। অকারণে সৃষ্টির বিনাশ কেন করবে। এই বলে এক উপাখ্যান শোনান।

মহাভারতের কথা অমৃত লহরী। শুনলে অধর্ম ক্ষয় হয়, পরলোকের পায় তরি। 
.................................... 

Sunday, November 30, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৯

 

বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠ বিরোধ: 

অর্জুন বিস্মিত হয়ে বিশ্বামিত্র ও বশিষ্ঠ মুনির অদ্ভূত কলহের কারণ জানতে চাইলেন। 

গন্ধর্ব তখন সে সব পুরানো কথা বললেন- ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্ঠ, অরুন্ধতির পতি এবং ইক্ষাকুকুলের পুরোহিত। 
 
অন্যদিকে কান্যকুব্জ দেশে কুশিকের পুত্র হলেন গাধি, তার পুত্র বিশ্বামিত্র ছিলেন সর্ব গুণ সম্পন্ন। বেদ, বিদ্যা, বুদ্ধিতে ভুবন বিখ্যাত। 
 
একদিন তিনি সসৈন্য মৃগয়া করতে মহাবনে প্রবেশ করলেন। মৃগয়ায় শ্রান্ত রাজা ক্ষুদা-পিপাসায় পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে বশিষ্ঠের আশ্রমে উপস্থিত হলেন। মনোহর স্থান দেখে রাজা খুশি হলেন। রাজাকে দেখে মুনি অতিথি সৎকারে মন দিলেন। রাজার সৈনিকদের পরিশ্রান্ত দেখে তিনি তার কামধেনু নন্দিনীকে ডেকে বললেন– দেখ রাজার সৈন্যরা আমার অতিথি। যে যা চায় তাই দিয়ে তাকে তুষ্ট কোরো। 
 
বশিষ্ঠ মুনির আজ্ঞা পেয়ে সুরভী সংসারে যা অদ্ভূত তেমন কর্ম করল। হুঙ্কার দিয়ে নানা দ্রব্য আনলেন চর্ব্য-চষ্য-লেহ্য-পেয় নানা রত্ন ধন। বস্ত্র, অলঙ্কার, মালা, কুসুম, চন্দন, বিচিত্র পালঙ্ক আর বসার আসন। যে যা চাইতে লাগলো, তাই পেলো। সকল সৈন্য আনন্দিত হল। 
 
দরিদ্র মুনির এমন বিস্ময় কর্ম দেখে গাধির পুত্র বিশ্বামিত্র অবাক হলেন। বশিষ্ঠের কাছে গিয়ে বলেন– আমি আপনাকে এক কোটি গরু দান করবো, যাদের খুর সোনায় মন্ডিত করে দেব। তার পরিবর্তে এই ধেনু আমায় দিন। অথবা আপনি যদি চান আমি রাজ্যও দিতে রাজি আছি। হস্তী, অশ্ব, পদাতিক যত সৈন্য সব আপনাকে দেব এই ধেনুর পরিবর্তে। 

বশিষ্ঠ বলেন– আমি কামধেনু দান করব না। এটি দেবতা ও অতিথিদের জন্য আমার কাছে আছে। 

রাজা বলেন– মুনি, তুমি জাতে ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণদের এমন জিনিষের প্রয়োজন হয় না। এ কেবল রাজার ঘরেই সাজে। একে বনে নিয়ে তুমি কি করবে। নিজের ইচ্ছেতে ধেনু দান না করলে, যেন আমি বল প্রয়োগ করে ছলে-বলে-কৌশলে একে অধিকার করবো। 

বশিষ্ঠ বলেন- তুমি তোমার দেশে শ্রেষ্ঠ, তাও সৈন্য সামন্ত নিয়ে। যা ইচ্ছে তুমি করে দেখ। আমি তপস্বী- আমার আর কি শক্তি! 
 
শুনে বিশ্বামিত্র সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন – কামধেনু সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চল। 
শুনে সৈন্যরা কামধেনুর গলায় দড়ি বেঁধে পিছনে বাড়ী মেরে মেরে নিয়ে চললো। প্রচন্ড মার খেয়েও কামধেনু নড়ল না। সজলাক্ষে ব্যাকুল ভাবে মুনির মুখের পানে চেয়ে রইলো। 
মুনি বলেন – নন্দিনী, আমার কাছে তুমি কি চাও। আমার সামনে তোমার এত কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। আমি সামান্য তপস্বী ব্রাহ্মণ, আমি আর কিবা করতে পারি তোমার জন্য। রাজা বল প্রয়োগ করে তোমায় নিয়ে যেতে চায়। 
সে সময় রাজার সৈন্যরা কামধেনুর সন্তান ছোট্ট বাছুরটিকে ধরে গলায় দড়ি বেঁধে আগে আগে টেনে নিয়ে চললো। সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে কামধেনু নন্দিনী ডাক ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মুনিকে বলে – ভগবান, বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের কশাঘাতে অনাথা আমি ও আমার সন্তান বিলাপ করছি। আপনি তা উপেক্ষা করছেন কেন! আমি কি করবো আজ্ঞা করুন। 
মুনি দুঃখিত হয়ে বলেন – ক্ষত্রিয়ের বল তেজ, ব্রাহ্মণের বল ক্ষমা। কল্যাণী, আমি তোমায় ত্যাগ করিনি। নিজের শক্তিবলে যদি থাকতে পার, তবে আমার কাছেই থাক, এর বেশি আর কি বলবো। 
 
মুনির মুখে একথা শোনা মাত্র পয়স্বিনী(দুগ্ধবতী গাভী) কামধেনু ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করল। ঊর্দ্ধমুখে গাভী হাম্বা রবে ডাক ছেরে শরীর বাড়াতে লাগল এবং বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের তাড়াতে লাগলো। তার বিভিন্ন অঙ্গ থেকে নানাজাতির সৈন্য লাখে লাখে বের হল। পুচ্ছ থেকে পহ্লব নামে জাতি নানা অস্ত্র হাতে তেড়ে এল। মূত্রে জন্ম হল বহু ব্যাধের। দুই পাশ থেকে জন্ম নিল কিরাত ও যবন। মুখের ফেণা থেকেও অনেক সৈন্যের জন্ম হল। চারি পা হতে নানাজাতির ম্লেচ্ছরা জন্ম নিল। সকলে নানা ধরনের অস্ত্র নিয়ে বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের তাড়া করল। দুই দলের সৈন্যদের প্রচন্ড যুদ্ধ হল। বিশ্বামিত্রের একজন সৈন্যের বিরুদ্ধে মুনির পাঁচজন সৈন্য হল। সহ্য করতে না পেরে বিশ্বামিত্রের সৈন্যরা রণে ভঙ্গ দিল। রাজার সামনেই তারা পালাতে লাগল। অনেক সৈন্য রক্তের নদীতে আহত হয়ে পরে রইল। এভাবে মুনির সৈন্য রাজার সৈন্যদের পিছনে পিছনে দৌড়ে তাদের বিতাড়িত করল। মুনির সৈন্য বিশ্বামিত্রকেও বনের বাইরে পাঠিয়ে মুনিকে এসে প্রণাম করল। 

বিশ্বামিত্র সব দেখে শুনে বড়ই অপমানিত বোধ করলেন। এমন অদ্ভূত ঘটনা দেখে তিনি মনে মনে আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হয়ে বলেন – ক্ষত্রিয় বলকে ধিক্‌! ব্রহ্মতেজই বল। সব দেখে বুঝেছি তপস্যাই পরম বল। সামান্য বিবাদে একটি ব্রাহ্মণ তপস্বীকে পরাজিত করতে পারলাম না, এ জন্মের আর কোন প্রয়োজন দেখি না। তপস্যা করে আমিও ব্রাহ্মণ হব, না হলে প্রাণত্যাগ করব। এসব ভেবে তিনি সব সৈন্যদের দেশে পাঠিয়ে গহন বনে তপস্যা করতে গেলেন। 
 
বিশ্বামিত্রের সেই তপস্যা ছিল সাঙ্ঘাতিক। তার তপে ত্রিভুবন তপ্ত হয়ে উঠল। গ্রীষ্মকালে রাজা চারদিকে হোমাগ্নি জ্বেলে তার মাঝে ঊর্দ্ধপদে তপস্যা করেন। নাকে, মুখে রক্ত বহে ভয়ঙ্কর দেখালো। ধিরে ধিরে রাজা অস্থি-চর্মসার হয়ে ওঠেন। আহার কেবল পবন(বাতাস)। বর্ষাকালে উন্মুক্ত স্থানে যোগাসনে বসেন। ঘোর বৃষ্টিবাদলের মাঝে তিনি অচেতন হয়ে তপস্যায় রত। শীতকালে হীনবস্ত্র নিরাশ্রয়ে থাকেন। এই ভাবে সহস্র বছর তিনি তপস্যা করলেন। তাঁর তপে ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে বর দিতে এলেন। 

ব্রহ্মা বলেন- বর প্রার্থনা কর, গাধির নন্দন, বিশ্বামিত্র! 
বিশ্বামিত্র যোড় হাতে বলেন- আমায় ব্রাহ্মণ করে দিন। 
বিরিঞ্চি(ব্রহ্মা) বলেন – ক্ষত্রিয়কুলে তোমার জন্ম। তুমি কি ভাবে ব্রাহ্মণ হবে! এতো দুস্কর কর্ম! অন্য যে কোন বর প্রার্থনা কর। 
বিশ্বামিত্র ক্ষুদ্ধ হয়ে বলেন – অন্য আর কিছুর প্রয়োজন নেই। 
ব্রহ্মা বলেন – পরের জন্মে তুমি ব্রাহ্মণই হবে। এখন যা চাও প্রার্থনা করে নাও। 
বিশ্বামিত্র বলেন- আমি অন্য কিছু চাই না। ব্রাহ্মণত্ব দান করুন না হয় প্রাণ নিন। 
এত কথা শুনে বিধাতা(ব্রহ্মা) সে স্থান ত্যাগ করলেন। 

গাধি পুত্র বিশ্বামিত্র পুনরায় তপস্যা শুরু করলেন। ঊর্দ্ধবাহু, ঊর্দ্ধমুখ করে এক পায়ের আঙ্গুলে দাঁড়িয়ে থাকেন। তপ করতে করতে তিনি শুষ্ক কাঠের মত হয়ে গেলেন। কেবল হাড়ের খাঁচায় প্রাণটা রয়ে গেল। তাঁর এই প্রচন্ড তপস্যার তেজে তিনলোক তপ্ত হতে লাগলো। ইন্দ্রাদি সকল দেবতারা ভয় পেলেন। এত সহ্য করতে না পেরে ব্রহ্মা আবার এসে বিশ্বামিত্রকে মিনতি করলেন বর চাওয়ার জন্য। 
 
বিশ্বামিত্র বলেন –আমি আগেই বলেছি আমি কি চাই। বর দিতে চাইলে আমাকে ব্রাহ্মণ কর। 
এবার ব্রহ্মা এড়িয়ে যেতে পারলেন না। তিনি নিজের উত্তরীয় বিশ্বামিত্রের গলায় পরিয়ে দিলেন। এভাবে ব্রহ্মা বর প্রদান করে ব্রহ্মলোকে ফিরে গেলেন। 
.................................... 

Saturday, November 15, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৮


তপতী সংবরণোপাখ্যানঃ
গন্ধর্ব বলেন– আপনি জীবন দিলেন, তার পরিবর্তে আমি চাক্ষুষী বিদ্যা দিচ্ছি। আমি জানি আপনার জন্মকথা, আপনি তপতীর গর্ভে জন্ম নিয়েছেন। আপনাকে পুরুষক্রমে ভাল ভাবে জানি। দ্রোণের মত গুরুর প্রিয় শিষ্য জেনেও আপনাদের পথ রোধ করলাম রাত্রে। তারও বিশেষ কারণ ছিল। সে সময় আমি স্ত্রীদের নিয়ে ক্রীড়ায় রত ছিলাম। স্ত্রীসঙ্গ ক্রীড়াকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। সে কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে আপনাদের রোধ করি। আপনারা জিতেন্দ্রিয় ধার্মিক, সে কারণে আমার বিরুদ্ধে জয়লাভ করলেন। আপনার আগ্নেয়অস্ত্র এবং চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব আমাকে দিন।

অর্জুন গন্ধর্বের প্রার্থনা অনুসারে চাক্ষুসীবিদ্যা ও অশ্ব নিলেন এবং আগ্নেয়াস্ত্র দান করে বন্ধু হলেন।
তিনি আবার প্রশ্ন করলেন– রাত্রে আমাদের এভাবে পথ আগলে আপনি কি বুঝাতে চাইলেন !

গন্ধর্ব বলেন– আপনাদের অগ্নিহোত্র(প্রত্যহ যজ্ঞকারী ব্রাহ্মণের করণীয় হোম) নেই। ব্রাহ্মণকে সঙ্গে নিয়েও চলেন না। সে জন্যেও আমি পথ রোধ করেছিলাম। হে, তাপত্য! কল্যাণপ্রাপ্তির জন্য পুরোহিত নিয়োগ করা কর্তব্য। পুরোহিত না থাকলে কোনও রাজা কেবল বীরত্ব বা আভিজাত্যের প্রভাবে রাজ্য জয় করতে পারেন না। ব্রাহ্মণকে পুরোভাগে রাখলে চিরকাল রাজ্যপালন করা যায়।

অর্জুন বলেন– আপনি আমাকে বারংবার তাপত্য বলছেন কেন! তপতী কে! আমরা তো কৌন্তেয়।

গন্ধর্ব বলেন– তবে শুনুন কেন আপনাদের তাপত্য বলে ডেকেছি। নিজেদের পূর্ববংশের কথা মন দিয়ে শুনুন।

যিনি নিজ তেজে সমস্ত আকাশ ব্যাপ্ত করে থাকেন সেই সূর্যদেবের এক কন্যা ছিলেন তপতী। ইনি সাবিত্রীর কনিষ্ঠা। রূপে, গুণে তপতী ছিলেন অতুলনীয়া। সূর্যদেব তার উপযুক্ত পাত্র খুঁজে পেলেন না। কন্যার কারণে তিনি চিন্তিত ছিলেন। সে সময় আপনাদের পূর্বতন পূর্বপুরুষ কুরুবংশীয় সংবরণ রাজা, যিনি প্রতিদিন উদয়কালে সূর্যের আরাধনা করতেন। তিনি ধার্মিক, রূপবান ও বিখ্যাত বংশের রাজা- সে জন্য সূর্য তাকেই কন্যা তপতীকে দিতে ইচ্ছে করলেন।

সূর্যদেব

একদিন সংবরণ মৃগয়া করতে গিয়ে একা একা অশ্বের পিঠে চড়ে বহু বনে বনে ভ্রমণ করলেন। পথশ্রমে ক্লান্ত অশ্বটি জলের অভাবে প্রাণ হারাল। অশ্বহীন রাজা পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করতে লাগলেন। দিক নির্ণয় করতে পর্বতের উপর উঠলেন। সেখানে এক অপরূপা সুন্দরী কন্যাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। কন্যার রূপের তেজে যেন পর্বত দীপ্ত হচ্ছিল। রাজা খুব খুশি হলেন। নিজেকে ভাগ্যবান ভাবলেন এমন কন্যার দর্শন পেয়ে। রাজার মনে হল এই কন্যার সমান পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তিনি পুতুলের মত স্থির চিত্তে কন্যাকে দর্শন করতে লাগলেন।

অনেক্ষণ পর কামে পীড়িত রাজা কন্যার কাছে গিয়ে মৃদু মধুর কন্ঠে বলেন– হে মন্মথমোহিনী, এই নির্জন বনে তুমি একা কি করছো! পদ্মের মত কোমল তোমার পদ যুগল। তার উপর স্থাপিত তোমার কদলীবৃক্ষের ন্যায় সুপুষ্ট ও সুন্দর ঊরু যুগল। নিতম্ব ঘটের মত সুন্দর, কোমরটি সরু, চক্ষু দুটি ছুড়ির মত আঘাত হানে, তার উপর কামচাপা ভুরু, কামপূর্ণ অতুল যুগল স্তন। সাপের মত বাহু দুটি কোমরের পাশে সরলভাবে অবস্থিত। নিখুঁত তোমার অঙ্গ দেখে রত্নালঙ্কার পরাতে মন চায়। তুমি কে, দেবী! দেবকন্যা, অপ্সরী, নাগিনী, মানবী নাকি কিন্নরী! এই চোখে কত দেখলাম, কানে কত শুনলাম- কিন্তু এমন অপরূপার কথা কেউ জানে না। কে তুমি, কার কন্যা। দয়া করে আমাকে বল। কি কারণে এই পর্বতে একা আছো! চাতক পাখির মত আমার কান তোমার মধুর ভাষণ শুনতে আগ্রহী। আমায় কিছু বলে তৃপ্ত কর।
এভাবে রাজা নানা ভাবে কন্যাকে বিনয় দেখালেন।

কিন্তু কন্যা কিছু না বলেই অদৃশ্য হলেন। মেঘের মধ্যে যেমন বিদ্যুৎ লুকায়, কন্যাও কোথায় লুকালো! রাজা উন্মাদের মত চারদিকে কন্যাকে খুঁজতে থাকেন। তাকে দেখতে না পেয়ে রাজা অচেতন হয়ে পরে গেলেন। এভাবে রাজা সংবরণ মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন।

অন্তরীক্ষ থেকে সেই কন্যা-তপতী রাজা সংবরণের এ অবস্থা দেখে দুঃখিত হলেন। রাজার কাছে এসে বলেন– নৃপ শ্রেষ্ঠ, উঠুন! মোহগ্রস্থ হবেন না। নিজের ঘরে ফিরে যান।

সংবরণ অস্পষ্ট বাক্যে অনুনয় করে বলেন– সুন্দরী, তুমি আমাকে ভজনা কর, নয়ত আমি প্রাণ ত্যাগ করবো। তুমি প্রসন্ন হও। আমি তোমার অনুগত ভক্ত। আমার প্রতি দয়া হলে আমায় আলিঙ্গন করে আমার প্রাণ রাখ।

কন্যা বলেন– রাজা তা হয় না। আমার পিতার কাছে আমার জন্য প্রার্থনা করুন। আমার পরিচয় দিচ্ছি। আমি সূর্যকন্যা তপতী। আপনি সূর্যের আরাধনা করে তাকে প্রীত করুন। তিনি আমাকে আপনার হাতে অর্পন করলে তবেই আমায় নিজের করে পাওয়া সম্ভব।

এত বলে তপতী অদৃশ্য হলেন। সংবরন রাজা আবার মুর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। অমাত্য ও অনুচরেরা অনেক খুঁজে রাজাকে দেখতে পেলেন এবং তার মাথায় পদ্মসুরভিত শীতল জল ঢালতে লাগলেন। রাজা জ্ঞান পেয়ে চতুরদিকে তপতীকে খুঁজতে লাগলেন। সৈন্যসামন্ত দেখে কিছু বললেন না। এক বৃদ্ধ মন্ত্রীকে সঙ্গে রেখে সকলকে রাজ্যে ফেরত পাঠালেন।
এরপর রাজা সূর্যের উদ্দেশ্যে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। এক পায়ে অধোমুখে উপবাসে সূর্যের উদ্দেশ্যে একচিত্তে তপস্যা করতে লাগলেন।
শেষে অনেক ভেবে পুরোহিত বশিষ্ঠ মুনিকে স্মরণ করলেন। বশিষ্ঠ মুনি রাজার সামনে উপস্থিত হলেন।

তিনি যোগবলে সমস্ত জেনে কিছুক্ষণ সংবরণের সঙ্গে কথা বলে উর্ধ্বে চলে গেলেন। দ্বিতীয় সূর্যের মত তার তেজ। সূর্য কৃতাঞ্জলি করে তাকে প্রণাম করলেন। কি প্রয়োজনে মুনি তার কাছে এসেছেন জানতে চাইলেন।
মুনিও সূর্যদেবকে প্রণাম করে জানালেন- আপনার তপতী নামের কন্যাকে আমি মহারাজ সংবরণের জন্য প্রার্থনা করছি। তিনি রূপে, গুণে ভুবন বিখ্যাত। তিনি আপনারও অনুগত।

সূর্যদেব খুশি হয়ে সম্মত জানিয়ে বলেন– মুনিদের মধ্যে আপনি প্রধান, ক্ষত্রিয়ের মধ্যে সংবরণ রাজ শ্রেষ্ঠ এবং কন্যাদের মধ্যে তপতীর সমান কেউ নেই। তিন স্থানের তিন শ্রেষ্ঠ!

মুনি শ্রেষ্ঠের বচন তিনি ফেলবেন না। এত বলে কন্যা তপতীকে মুনির হাতে সমর্পণ করলেন। কন্যাকে নিয়ে মুনি রাজা সংবরণের কাছে এলেন। তপতীকে দেখে রাজা তপ ত্যাগ করলেন। যোড়হাতে রাজা বশিষ্ঠ মুনির যপ করেন। ঋষি তপতী ও সংবরণের বিবাহ দেন। পরে বশিষ্ঠ মুনি নিজের আশ্রমে ফিরে যান। মুনির আজ্ঞা নিয়ে রাজা সেই মহাবনে সুখে বাস করতে লাগলেন। রাজার সাথে যে বৃদ্ধ মন্ত্রী ছিলেন তাকে রাজা রাজ্যভার দিয়ে দেশে পাঠালেন। পর্বতের উপর রাজা স্ত্রীর সাথে বারো বছর আনন্দে কাটালেন।

সেই বারো বছর রাজ্যে এক বিন্দু বৃষ্টি হল না। বৃক্ষ, শষ্য সব পুড়ে ভস্ম হল। ঘোড়া, পাখি সব মরে গেল। রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। চারদিকে চুরি, ডাকাতি শুরু হল। স্থাবর, অস্থাবর ও প্রজা ক্ষয় পেতে লাগল। মানুষ শবের মত হতে লাগল। হীনশক্তি হয়ে স্থানে স্থানে পরে রইল। চারদিকে হাহাকার রব শুরু হল। প্রমাদ গুণে মানুষ দেশান্তরি হতে লাগলো।
রাজ্যের এত কষ্টের কথা রাজা কিছুই জানলেন না। বশিষ্ঠ মুনি সে সময় দেশে এসে রাজ্যভঙ্গ হচ্ছে দেখে চিন্তিত হলেন। রাজাকে আনতে তিনি পর্বতে গেলেন।

সব জেনে রাজা সংবরণের অনুতাপ হল। তপতীকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। রাজ্যে ফিরে তিনি যজ্ঞ করলেন। ইন্দ্রদেব সুখি হয়ে বৃষ্টি দান করলেন। পুনরায় ভূমিতে শস্য ফললো। পূর্বের মত সংবরণ রাজ্যকে প্রাণবন্ত করে তুললেন।


এ সময় তপতী গর্ভবতী হলেন। তপতীর পুত্র হলেন শ্রষ্ঠ কুরু। কুরুর খ্যাতি অবিসংবাদিত(সর্বসম্মত)। সে জন্যই তার কুলের নাম হল কুরুবংশ।
পুরোহিত বশিষ্ঠ মুনির সাহায্যেই রাজা সংবরণ ধর্ম, অর্থ, কাম পেলেন।
হে অর্জুন, এই তপতীর গর্ভজাত কুরুর বংশধর হলেন আপনারা পাঁচভাই। সে কারণে আমি আপনাদের তাপত্য সম্বোধন করেছিলাম।

বংশের পূর্বকথা শুনে অর্জুন হরষিত হলেন। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন– রাজা সংবরণকে রক্ষা করলেন যে শ্রেষ্ঠ পুরোহিত বশিষ্ঠ মুনি, তার সম্পর্কে কিছু বলুন।

গন্ধর্ব বলেন- বশিষ্ঠ মুনি বিখ্যাত তার তপস্যার জন্য। তার গুণ, কাজ বর্ণনাতিত। তিনি কাম ও ক্রোধকে জয় করতে পেরেছিলেন। বিশ্বামিত্র বহুবার তাকে বিরক্ত করলেও বশিষ্ঠ তাকে কিছু বলেননি। ইক্ষ্বাকু(বৈবস্বত মনুর পুত্র, সূর্যবংশীয় প্রথম রাজা) বংশের রাজা এঁনার বুদ্ধিবলেই নিষ্কন্টক বৈভব ভোগ করেন ভূমন্ডলে।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।
....................................

Saturday, November 1, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৭

অর্জ্জুন-অঙ্গারপর্ণ সংবাদঃ

ব্যাসদেব পঞ্চপান্ডবকে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের অদ্ভূত আয়োজনের কথা শোনান। দ্রুপদরাজের আমন্ত্রণে বহু রাজরাজেশ্বর এসেছেন পাঞ্চালনগরে। রাজা অদ্ভূত এক লক্ষ্য রচনা করেছেন, সেই লক্ষ্যভেদ শক্তি কারও নেই। অর্জুন গিয়ে সেই লক্ষ্য সভা মাঝে ভেদ করবেন। এভাবে পাঞ্চালকন্যা প্রাপ্ত হবে। মুনি তাদের শীঘ্র পাঞ্চাল যেতে বললেন এবং নিজস্থানে ফিরে গেলেন।

মা কুন্তীদেবীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করলেন। দিনরাত্রি তারা পথ চললেন। নানা দেশ, নদ-নদী, গ্রাম পেরলেন। বিশ্রাম নেওয়ার সময় তাদের নেই। ঘোর রজণীতেও ধনঞ্জয় অর্জুন আগে আগে মশাল ধরে পথ দেখিয়ে চলেন। কয়েকদিন চলার পর তারা সন্ধ্যায় গঙ্গাতীরে পৌছলেন। সেখানে স্ত্রীসহ এক গন্ধর্ব বিহার করছিলেন।

পান্ডবদের শব্দ শুনে তাদের ডেকে তিনি বলেন – মানুষ হয়েও দেখি তোমাদের খুব অহঙ্কার! প্র্য়াগগঙ্গার মাঝে আমার বাস। প্রাতঃসন্ধ্যার পূর্বকাল পর্যন্ত সমস্ত রাত্রি যক্ষ-গন্ধর্ব -রাক্ষসদের, অবশিষ্ট কাল মানুষের। রাত্রিতে কোন মানুষ, এমন কি সসৈন্য নৃপতিও যদি জলের কাছে আসে তবে ব্রহ্মজ্ঞরা নিন্দা করেন। আমি কুবেরের সখা গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ এই বন আমার, তোমরা এখান থেকে দূরে চলে যাও।

গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ

অর্জুন বলেন– সমুদ্র, হিমালয় পার্শ্বে এবং এই গঙ্গায় দিনে, রাত্রিতে বা সন্ধ্যায় কারও আসতে বাঁধা নেই। তোমার কথায় কেন আমরা গঙ্গার পবিত্র জল স্পর্শ করব না!

তখন অঙ্গারপর্ণ পান্ডবদের উদ্দেশ্যে অনেকগুলি বাণ ছুঁড়লেন। অর্জুন তার মশাল ও ঢাল ঘুরিয়ে সমস্ত বাণ নিরস্ত করে দ্রোণের থেকে পাওয়া প্রদীপ্ত আগ্নেয় অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। গন্ধর্বরাজের রথ পুড়ে গেল। তিনি রণে ভঙ্গ দিয়ে পালালেন। অর্জুন তাকে তাড়া করে তার চুলের মুঠি ধরলেন।

স্বামীর ঘোর বিপদ বুঝে গন্ধর্বের স্ত্রী কুম্ভীলসী যুধিষ্ঠিরের পায়ে পরে স্বামীর হয়ে ক্ষমা চাইলেন। তিনি বলেন- সাধু শ্রেষ্ঠ তুমি ধর্ম অবতার। তোমার আশ্রয়ে সবার দুঃখমোচন হয়। এই পরম সঙ্কটে আমাদের উদ্ধার কর। সহস্র সতীনের সাথে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দাও।

নারীর শোকাশ্রু দেখে যুধিষ্ঠিরের মন আদ্র হল। তিনি অর্জুনকে গন্ধর্বরাজকে ছেড়ে দিতে আজ্ঞা দিলেন। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে অর্জুন তাকে ছেড়ে দিলেন।

যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে অর্জুন অঙ্গারপর্ণকে ছেড়ে দিলেন

গন্ধর্বরাজ জোড় হাতে বিনয়ের সাথে বলেন– আমায় আপনি প্রাণদান করলেন, আমিও আপনাকে কিছু দিতে চাই। অদ্ভূত চাক্ষুসী বিদ্যা আমি আপনাকে দান করতে চাই। আপনি ত্রিলোকের যা কিছু দেখতে ইচ্ছা করবেন, এই বিদ্যা বলে তাতে দেখতে পাবেন। মনু এ বিদ্যা চন্দ্রকে দিয়েছিলেন। পরে তিনি তা আমায় দান করেন। আজ তা আমি আপনাদের দেব। এছাড়া আপনাদের প্রতি ভাইকে একশত দিব্যবর্ণ বেগবান গন্ধর্বদেশীয় অশ্ব দিচ্ছি, এরা প্রভূর ইচ্ছানুসারে উপস্থিত হয়। পূর্বে ইন্দ্র বেত্রাসুরে বজ্র দিয়ে প্রহার করেছিলেন। অসুরের মুন্ডে বজ্র শতখান হল। স্থানে স্থানে সেই বজ্রকে নিয়োগ করা হল। সবার শ্রেষ্ঠ বজ্র ব্রাহ্মণের বচন। শূদ্ররা কাজ করে, বজ্র তাদের সেবা করে। বৈশ্যরা দান করেন- বজ্র তাদের ও বলে। ক্ষত্রিয় হয়ে আপনার সেই শক্তির বজ্রে আমার রথ আজ দগ্ধ হল। সে কারণে আপনাকে এই অশ্বদান করবো।
অর্জুন বলেন– গন্ধর্ব, আপনার প্রাণ সংশয়ে ভীত হয়ে যা আমাকে দিতে চাইছেন, তা নিতে আমার প্রবৃত্ত হচ্ছে না।

.....................................

Saturday, September 20, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৬

ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদীর উৎপত্তি কথনঃ 

কিছুকাল পর পান্ডবদের আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের গৃহে আরেক ব্রাহ্মণ অতিথিরূপে উপস্থিত হলেন। তিনি বিভিন্ন দেশের গল্প বলেন, কুন্তীসহ পঞ্চপান্ডব তা শ্রবণ করেন।

দ্বিজ(ব্রাহ্মণ) বলেন – বহু দেশ ভ্রমণ করলাম, বহু নদী, বহু তীর্থক্ষেত্র ঘুরলাম যা গণনা করে শেষ করা যায় না। 
বিবিধ উপাখ্যান ও নানা দেশের বিবরণ প্রসঙ্গে তিনি জানালেন পাঞ্চাল রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের আশ্চর্য মহোৎসব আয়োজনের কাহিনী। দ্রুপদরাজার কন্যা কৃষ্ণা। রূপে গুণে পৃথিবীতে তার তুল্য কেউ নেই। এই কন্যাটি অযোনিসম্ভবা, যজ্ঞ থেকে এঁনার জন্ম। যাজ্ঞসেনী(যজ্ঞ সেন অর্থাৎ দ্রুপদ্ররাজের কন্যা- দ্রৌপদী) নামে তিনি জগৎ বিখ্যাত। দ্রুপদের পুত্রটিও রূপে গুণে বিখ্যাত। দ্রোণকে বিনাশ করতেই তার জন্ম- নাম ধৃষ্টদ্যুম্ন। 
 বিভিন্ন দেশের গল্প কুন্তীসহ পঞ্চপান্ডব শ্রবণ করেন 

একথা শুনে পান্ডবরা সবিস্তারে সমস্ত ঘটনা জানতে চাইলেন। 
ব্রাহ্মণ বলেন – পূর্বে দ্রোণ ও দ্রুপদ বন্ধু ছিলেন। কিন্তু পরে তাদের মধ্যে কলহ হয়। অভিমানে দ্রোণ হস্তিনানগরে গিয়ে কৌরব কুমারদের অস্ত্রশিক্ষা দান করেন। শিক্ষা শেষে শিষ্যদের কাছে দক্ষিণা চান – দ্রুপদরাজাকে বেঁধে তার সামনে হাজির করতে হবে। কুন্তীপুত্র অর্জুন গুরুর আজ্ঞা পেয়ে দ্রুপদরাজাকে বেঁধে আনলেন। অর্ধেক রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে দ্রোণ পুনরায় দ্রুপদের বন্ধু হলেন ও তাকে মুক্তি দিলেন। 

দ্রুপদরাজা

অভিমানে দ্রুপদ অন্ন–জল ত্যাগ করলেন। প্রতিহিংসায় তিনি জর্জরিত হতে থাকেন। কিভাবে দ্রোণকে মারা যায় সেই চিন্তা ছাড়া মনে আর কোন ভাবনা ঘোরে না। সর্বদা রাজা সেই ভাবনা নিয়ে গঙ্গাতীরে ভ্রমণ করেন। সেখানে বেদে বিখ্যাত যাজ ও উপযাজ নামে দুই ভাই-ব্রাহ্মণকুমার বাস করতেন। উপযাজকে দ্রুপদ একদিন দেখতে পেলেন। তার পূজা ও পদসেবা করে যোড়হাতে পাঞ্চালরাজ বলেন – দশকোটি ধেনু(গরু) ও অসংখ্য সোনা দেব, যা চাইবেন তাই দেব যদি আমার মনবাঞ্ছা পূরণ করেন। আমার ইচ্ছে দয়া করে শুনুন। ভরদ্বাজ পুত্র দ্রোণ –পৃথিবীতে তার তুল্য অস্ত্রধারী কেউ নেই, কেউ তার সাথে যুদ্ধ করে পারে না। সে যেন দ্বিতীয় পরশুরাম। এমন বুদ্ধি করুন যাতে তাকে যুদ্ধে জয় করতে পারি। ক্ষত্রিয়ের অসাধ্য শক্তি তার। তপো মন্ত্র বলে এর প্রতিকার করুন। এমন যজ্ঞ করুন যাতে আমার পুত্র সন্তান হয় ও তার হাতেই দ্রোণের নিধন হয়। 

উপযাজ চিন্তা করে বলেন– আমার মতে ব্রাহ্মণ বধ উচিত কর্ম নয়।
তার কথা শুনে রাজা তাকে পুত্রের জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। 

উপযাজ বড় ভাই যাজের কাছে দ্রুপদকে পাঠালেন

দ্রুপদের বিনয় দেখে ব্রাহ্মণ প্রসন্ন হয়ে বলেন- আমার বড় ভাই যাজ পরম তপস্বী। বেদে পারদর্শি, অরণ্য নিবাসী। তাঁর কাছে তুমি প্রার্থনা কর। তিনি তোমার সব দুঃখ দুর করতে পারেন। 
উপযাজের কথায় রাজা যাজের কাছে গেলেন। প্রণাম করে সব কথা জানালেন। সদয় হয়ে যাজ যজ্ঞ করতে সম্মত হলেন। যজ্ঞ শুরু হলে রাণীকে নিয়ে রাজা ভক্তি ভরে সকল ব্রতের আচার পালন করলেন। 
যজ্ঞ পূর্ণ হলে এক কুমারের জন্ম হল। অগ্নিবর্ণ বীর, হাতে তার ধনুঃশর, অঙ্গে তার কবচ ও মাথায় টোপর। হাতে উদ্ধত খড়্গ ধরে, দেখে ভয়ঙ্কর লাগে। পুত্রকে দেখে পাঞ্চালরাজ খুবই আনন্দিত হলেন। 
তবে সেই যজ্ঞে আরেকটি কন্যারও জন্ম হল। জন্মমাত্র দশদিকে তার দ্যুতি ছড়িয়ে পরল। তিনি সুদর্শনা, শ্যামবর্ণা, পদ্মপলাশাক্ষী, পীনপয়োধরা, তাঁর নীলোৎপলতুল্য সৌরভ এক ক্রোশ দুরেও অনুভূত হয়। তিনি সুরাসুর, যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্বের বাঞ্ছিত। এভাবে পাঞ্চালরাজের পুত্র ও কন্যা যজ্ঞের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করল। সে সময় আকাশবাণী হল। 
এ কন্যার জন্ম হল ভার নিবারণের জন্য। এর মাধ্যমেই ক্ষত্রিয়দের নিধন হবে। কুরুবংশ ধ্বংস হবে-এই কন্যার মাধ্যমে। 
পুত্রটির জন্ম হল দ্রোণকে বধ করার জন্য। 
সকলে আকাশবাণী শুনে জয় জয় ধ্বনি দিতে লাগল। যত বীরযোদ্ধা সকলে হুঙ্কার দিলেন। আনন্দে দ্রুপদরাজা বিবাদ ত্যাগ করলেন। পুত্র কন্যার নামকরণ করা হল। ধৃষ্ট(প্রগল্‌ভ) ও দ্যুম্ন(দ্যুতি, যশ, বীর্য, ধন)-সমন্বিত এই কারণে কুমারের নাম ধৃষ্টদ্যুম্ন হল।

ধৃষ্টদ্যুম্ন

শ্যামবর্ণের জন্য কন্যার কৃষ্ণা নাম হল। পিতার নামানুসারে দ্রৌপদী ও যজ্ঞ থেকে যাজ্ঞসেনী। 
বর্তমানে সেই কন্যার স্বয়ম্বর উপস্থিত। দুরদুরান্ত থেকে রাজারা আসতে শুরু করেছেন। 

কৃষ্ণা দ্রৌপদী

ব্রাহ্মণের মুখে এত কথা শুনে পঞ্চপান্ডবের সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে হল। সবার মনের কথা বুঝে কুন্তী পুত্রদের ডেকে বললেন –বহুদিন এখানে বাস করেছি। এক জায়গায় বেশিদিন থাকা ঠিক নয়। পূর্বের মত এখন আর ভিক্ষাও মেলে না। পাঞ্চালরাজা খুব দয়ালু শুনছি। যদি তোমাদের মন চায় তো চল সেই রাজ্যে যাই। শুনে সব ভাইরা সম্মত হলেন। 
পুত্রদের নিয়ে কুন্তীদেবী যখন আলোচনা করছেন তখন ব্যাসদেব সেখানে উপস্থিত হলেন। কুন্তীদেবী ও পুত্ররা তাকে ভূমিষ্ট হয়ে প্রণাম জানান। মুনি সকলকে আশির্বাদ করলেন। তারা পরস্পর কুশল বাদানুবাদ করতে লাগলেন।
.....................................

Sunday, September 14, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৫

বক্‌-বধঃ
কিছু পরে চারভাই ঘরে ফিরলেন। ভীমকে না দেখতে পেয়ে যুধিষ্ঠির একান্তে ডেকে কুন্তীকে ভীম কোথায় যানতে চাইলেন। সব শুনে যুধিষ্ঠির চিন্তিত হলেন।

কুন্তী বলেন - ব্রাহ্মণকে রক্ষা করতে, এই নগরকে রক্ষা করতেই আমি ভীমকে বক রাক্ষস বধে পাঠালাম। 

যুধিষ্ঠির বিরস বদনে বলেন – মা হয়ে তুমি পুত্রকে রাক্ষসের কাছে পাঠালে! আমরা অজ্ঞাতবাসে আছি। ভীম আমাদের মধ্যে বলবান। তার শক্তির সাহায্যে রাজ্য অধিকারের আশা রাখি। কৌরবরা তাকে ভয়ও পায়। তার সাহায্যেই জতুগৃহে আমরা বাঁচলাম। সেই হিড়িম্ববনে আমাদের কাঁধে করে নিয়ে গেল ও হিড়িম্ব বধ করল। সেই বীর পুত্রকেই তুমি রাক্ষস ভোজনে পাঠালে! আমরা আর কি ভাবে বাঁচব। গর্ভধারিণী হয়ে তুমিই এমন কাজ করলে! বলে যুধিষ্ঠির হাহাকার করতে লাগলেন।

কুন্তী বলেন - যুধিষ্ঠির ভেব না। আমিও ভীমের প্রতাপ জানি। তার শরীরে অযুত হস্তীর বলতাকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। তার জন্মের সময়ই তার পরাক্রম দেখি। প্রসবের পর তাকে তুলতে পারিনি। একটু তুলেই ফেলে দিয়েছিলাম ধুলায়। তার আস্ফালনে পর্বতের শৃঙ্গ চূর্ণ হয়। বারণাবতে দেখলাম স্বচক্ষে সে হাতে করে তোমাদের চারজনকেই সহজে তুলেছিল। আমাদের সবাইকে কাঁধে তুলে হিড়িম্ববনে গেল, হিড়িম্ব বধ করল। তার শক্তিতে আমার বিশ্বাস আছে সেই এই রাক্ষস বধ করবে। ভীত মানুষদের যিনি ত্রাণ করেন তার সমান পূণ্যবান কেউ নেই। বিশেষ করে ব্রাহ্মণের জন্য প্রাণদান ও জন্মভূমির জন্য যুদ্ধ পৌরুষের প্রতীক। এমন পূণ্যকাজের জন্য তুমি দুঃখ করছ কেন! মায়ের কথা শোন।

মায়ের সকল কথা শুনে দয়ালু যুধিষ্ঠির ধন্য ধন্য করলেন। পরের দুঃখে নিজের পুত্রকে দিয়ে ত্রাণ করায় তিনি মাকে ধন্যবাদ জানালেন। মায়ের পূণ্যেই তারা সকল বিপদ থেকে রক্ষা পাবেন।
তিনি মাকে বলেন - তবে মা ব্রাহ্মণকে বোলো এ সকল কথা যেন অন্য কাউকে না জানায়।

রাত্রে ব্রাহ্মণরূপী ভীম রথে চড়ে বনে গেল বক রাক্ষসের কাছে। ভীম চিৎকার করে বককে ডেকে তারই খাবার খেতে শুরু করল। তার নাম ধরে ডাকায় বক রাক্ষস রেগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে ক্রোধে সেখানে উপস্থিত হল। তার চলনের ভারে ধরা যেন ভিতরে ঢুকে যেতে থাকল।
 ভীমকে তার অন্ন খেতে দেখে রেগে বক দুই চোখ লাল করে চিৎকার করে বলে – হে দুষ্টমতি মনুষ্য! তুই এমন অনীতির কাজ কেন করলি! তোর দোষে সকুটুম্ব ব্রাহ্মণকে আমি আজই ভক্ষণ করব।  
এই বলে রাক্ষস রাগে আস্ফালন করতে থাকে। যদিও ভীম রাক্ষসের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে পিছন ফিরে তার খাদ্য খেতে থাকেন গোগ্রাসে। দেখে ক্রোধে নিশাচর গর্জন করতে করতে দুহাত তুলে ভীমকে ধরতে যায়। সে দুই হাত দিয়ে ভীমের পিঠে আঘাত করতে থাকে। ভীম তাও গ্রাহ্য করেন না। রাক্ষস পিঠে মারতে থাকে ভীমও হেলায় তা সহ্য করে নির্ভয়ে পায়সান্ন খেতে থাকেন। তা দেখে রাক্ষস আরো রেগে বৃক্ষ উপড়ে ভীমকে ছুঁড়ে মারে। তবু ভীম হাসতে
হাসতে অন্ন খেতে খেতে বাঁ হাতে বৃক্ষ কেড়ে নেন। পুনরায় রাক্ষস একটি মহাবৃক্ষ উপড়ে গর্জন করে ভীমের উপর ছোঁড়ে। ভোজন শেষ করে ভীম আচমন সেরে বৃক্ষ উপড়ে যুদ্ধ শুরু করেন। বৃক্ষে বৃক্ষে সাংঘাতিক যুদ্ধ শুরু হয়। এভাবে বনের সব বৃক্ষ নষ্ট হল। এরপর দুজনে দুজনের উপর শিলাবৃষ্টি শুরু করল। দুজনে পরষ্পরকে জড়িয়ে ধরে বাহুযুদ্ধ শুরু করে। পরস্পর পরস্পরের মুন্ড ধরে, বাহুতে বাহু দিয়ে, হাত জড়িয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে যুদ্ধ করে। 
এত যুদ্ধ করে বক রাক্ষস শ্রান্ত হয়ে পরে। কুন্তীপুত্র ভীম সহজেই বক রাক্ষসকে ধরে ফেললেন বাম হাতে দুই জানু ও ডান হাতে মাথা রাক্ষসের চেপে ধরেন। রাক্ষসের বুকে হাটু দিয়ে ভীমবীর জোরে টান মারলেন। রাক্ষস দু’টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পরল। বক রাক্ষস আর্তচিৎকার করে মরল। বক রাক্ষসের যত অনুচর ছিল তারা ভয়ে সে স্থান ত্যাগ করে পালালো। নগরের কাছে ভীম বক রাক্ষসকে ফেলে মা ও ভাইদের কাছে গিয়ে সব জানালেন।

আনন্দিত মা কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে ডেকে ভীমকে আলিঙ্গন করে তার প্রশংসা করতে লাগলেন।
পরদিন ভোরে নগরবাসী বক রাক্ষসের পর্বত প্রমাণ দেহ নগর দ্বারপ্রান্তে পরে থাকতে দেখে চমৎকৃত হল। কেউ জিজ্ঞেস করে এমন কাজ কে করল, কেউ বলে যেই করুক সবাই নিষ্কন্টক হলাম। এই পরম দুষ্ট হিংস্র বক রাক্ষস নিজের পাপেই মরেছে। পরে তারা বিচার করে দেখল আগেরদিন বক রাক্ষসকে খাদ্য পাঠানোর দায়িত্ব কার ছিল। সেই বলতে পারবে বক রাক্ষস কি ভাবে মরল। দেখা গেল ব্রাহ্মণের দিন ছিল। সকলে তাকে দ্রুত ডেকে পাঠাল। কি ঘটেছিল সকলে জানতে উদগ্রিব।

ব্রাহ্মণ বলে – আমার ঘরে কাল পাঁচ মহাপুরুষ আসেন। আমাদের শোকার্ত দেখে তাদের মধ্যে একজন মন্ত্রসিদ্ধের দয়া হল। তিনি আমার পরিবর্তে রাক্ষসের কাছে অন্ন নিয়ে গেলেন। তিনিই বক রাক্ষসকে হত্যা করেছেন এবং রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। 


সব শুনে নগরবাসী খুশি হল। সকলে ব্রাহ্মণকে পূজা করল। আনন্দ মনে ব্রাহ্মণ ঘরে ফিরে এলো। এরপর থেকে পান্ডবদের ব্রাহ্মণ দেবতুল্য সন্মান করতে লাগল
মহাভারত অমৃতের ধারা, কাশীরাম কহে শুনে ইহলোকের দুঃখ পার হবে সর্ব জনা।
......................................................    

Sunday, September 7, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৪

পান্ডবগনের একচক্রা নগরে বাস: 

একচক্রা নগরে ব্রাহ্মণের গৃহে মাকে নিয়ে পান্ডবরা অজ্ঞাতবাসে রইলেন। নগরে সারাদিন ভিক্ষে করে রাতে ঘরে আনতেন। কুন্তী তাই রান্না করে অর্ধেক ভীমকে খেতে দিয়ে বাকি পাঁচজনে ভাগ করে খেতেন। যদিও তাতেও ভীমের তৃপ্তি হত না। এভাবে বহু কষ্টে তারা সেখানে বাস করতে লাগলেন। 

একদিন ভীম ঘরে রয়ে গেলেন, বাকি চারভাই ভিক্ষা করতে বেরলেন। হঠাৎ ব্রাহ্মণের গৃহে বিকট শব্দ হল ও ব্রাহ্মণ-বাহ্মণী বিলাপ করতে লাগল। 
কুন্তীদেবী তাদের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ভীমকে ডাকলেন। বললেন - এতদিন এই গরিব ব্রাহ্মণের আশ্রয়ে গোপনে বাস করছি। আজ এনার ঘোর বিপদ, অবশ্যই একে রক্ষা করতে হবে। উপকারী জনের যে সাহায্য না করে তার সংসারে অপযশ হয়, পরলোকেও পাপ হয়। 

ভীম বলেন – মা! ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস কর কি তার কষ্ট, সাধ্য অনুসারে তাকে রক্ষা করব। 

ভীমের আশ্বাস পেয়ে কুন্তী ব্যগ্র ভাবে ব্রাহ্মণের কাছে ছুটে গেলেন। 
তিনি গিয়ে দেখেন বিলাপ করে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণীকে বলছে- এই জন্যই তোমায় আগেই বলেছিলাম যে দেশে রাক্ষসের উপদ্রপ সেখানে বাস করে কাজ নেই। পিতামাতার স্নেহে সে কথা তুমি শুনলে না। এখন উচিত শিক্ষা পাও! কি করব ভেবে পাচ্ছি না। কোন বুদ্ধি বার করে এর প্রতীকার কর। তুমি আমার গৃহিনী ও ধর্মপত্নী। তুমিই আমায় সব সুখ ও শান্তি দিয়েছ। তোমার ধর্ম জ্ঞানে আমার বিশ্বাস আছে। আমার বালক পুত্রের জননী তুমি, তোমাকে ছেড়া সে বাঁচবে না। তোমাকে হারালে আমি দুঃখের অরণ্যে নিজেকে হারাব। নিজেকে বাঁচিয়ে তোমাকে যদি রাক্ষসের হাতে দিই তবে সংসারে আমার অপযশ হবে। অপূর্ব সুন্দরী কন্যাকে রাক্ষসের হাতে দিলে কুযশ কাহিনী রটবে। কন্যার জন্ম হলে পিতা আশা করে তাকে সুপাত্রে দান করে স্বর্গ বাস করবে। সেই কন্যাকে রাক্ষসের হাতে দিলে নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারব না। আমি নিজেই রাক্ষসের কাছে চললাম। 
এত বলে ব্রাহ্মণ কাঁদতে কাঁদতে চললেন। 



ব্রাহ্মণী তার পথ আগলে বলেন – তোমরা সুখে বাস কর, আমি রাক্ষসের কাছে যাব। তুমি গেলে পুর পরিবার না খেতে পেয়ে মরব। আমি সহমৃতা হব। পুত্রকন্যা না খেতে পেয়ে মরবে। আমি বাঁচলেও আমি কি ভাবে তাদের পালন করব। তোমাকে ছাড়া আমরা তিনজনেই অনাথ হব। অনাথের বহু কষ্ট। দরিদ্র দেখে অকুলীনজন কন্যাকে চাইবে। পুত্র ভিক্ষারী হবে কিছুদিনেই। কুলধর্ম বেদের বিমুখ হবে। দুর্বল অনাথ দেখে বলবান কামুক দুর্মুখ লোক আমাকে কামনা করবে। তোমাকে ছাড়া আমাদের পদে পদে বহু বিপদ হবে। সে জন্যেই তোমাকে যেতে বারণ করছি। অনেক স্নেহে ভালবাসায় এ সংসার তুমি গড়ে তুলেছ। পুত্রকন্যাও তোমার মত সুন্দর হয়েছে। কন্যাকে সুপাত্রে দান করো। পুত্রকে পড়িও। তুমিও আবার বিবাহ করো। আমি গেলেও আবার তোমার সংসার হবে। কিন্তু তোমাকে ছাড়া পুর পরিবার নষ্ট হবে। নারীর পরম ধর্ম স্বামীর সেবা করা, বিপদে নিজেকে দান করে স্বামীকে রক্ষা করা, তাতেই সে ইহলোকে যশ পায়, স্বর্গে অক্ষয় হয়। তপ, জপ, যজ্ঞ, ব্রত, নানা প্রকার দানের সমান ফল স্বামীর সেবায় লাভ করা যায়। শাস্ত্রে ও সকল ধর্মে একথাই বলা আছে। তাই রাক্ষসের কাছে আমিই যাব। 

স্ত্রীর কথা শুনে তাকে জড়িয়ে ব্রাহ্মণ চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। ব্রাহ্মণীও কাঁদতে লাগল। মা-বাবার অবস্থা দেখে পুত্র-কন্যাও কাঁদতে শুরু করল। 

কন্যা বলে- মা কেঁদো না, তুমি রাক্ষসের কাছে গেলে মা হারা বালকের মৃত্যু হবে, পিন্ডদানের কেউ থাকবে না, কুল বিনষ্ট হবে, তাই মার যাওয়া হবে না। কন্যার জন্ম হলে তাকে ত্যাগ করতেই হবে। বিধির সৃজন কেউ খন্ডন করতে পারবে না। পিতা তুমি আমায় অন্য কাউকেতো দান করতেই, এখন রাক্ষসের হাতেই আমায় দান কর। তোমরা রক্ষা পাবে। আমার মত আরো কন্যা তোমাদের হবে। তাই আমাকেই ত্যাগ কর। পরে আমার পুত্রও আমাকে হয়ত তাড়াবে। এখন আমিই নিশ্চিন্তে যাই। 
কন্যার কথা শুনে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী আরো কাঁদতে লাগলো। 

এত কথা শুনে ছোট্ট ছেলেটি সবার মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে বারণ করল। এক হাতে একটি তৃণ নিয়ে শিশুটি বলে উঠল – তোমরা কেউ রাক্ষসকে ভয় পেও না। এই তৃণ দিয়ে তাকে আমি মারব। তোমরা আমায় রাক্ষস কোথায় দেখিয়ে দাও। 

বালকের কথা শুনে তিনজনে কান্না ভুলে হাসতে লাগল। 
তাদের হাসতে দেখে কুন্তীদেবী এগিয়ে এসে সকাতরে বলেন – কি কারণে তোমরা কাঁদছো? কি ভাবে আমি তা মোচন করতে পারি বল। 
 

ব্রাহ্মণ বলে – মানুষের সাধ্য নেই এ দুঃখ মোচন করার। এই নগরে দুরন্ত বক রাক্ষস বাস করে। সেই এ রাজ্যের প্রভূ, ঈশ্বর। যক্ষ-রক্ষ-ভূত-প্রেত সকলে তাকে ভয় পায়। তার শক্তির কাছে সবাই হেরে গেছে। সে ঠিক করেছে নগরে যত মানুষ আছে একজন করে প্রতিদিন পায়েস-পিঠে-অন্ন রান্না করে রথে ভর্তি করে তার সামনে আনবে সঙ্গে দুটি মহিষও দিতে হবে। সকলকেই সে ভক্ষণ করবে। আজ আমার দায়িত্ব তার কাছে যাওয়ার, যে যেতে অস্বীকার করবে তাকে তার পরিবারের সবার সঙ্গে মেরে খাবে। আজ আমি কাকে পাঠাব। আমার স্ত্রী-পরিবারসহ চারজন। কাকে বলি দেব ভেবে পাচ্ছি না। মানুষ কিনে যে তার কাছে পাঠাব সে সম্পদও আমার নেই। পরিবারের কাউকেই ছারতে মনও চায় না। ঠিক করেছি সবাই মিলেই তার কাছে যাব। যা কপালে আছে দেখা যাবে। 

তার কথা শুনে কুন্তী বলেন – ভয় পেও না। তোমাদের কাউকেই যেতে হবে না। আমার পাঁচপুত্র আছে, তোমার জন্য আমি একটি পুত্রকে দান করব। 

ব্রাহ্মণ বলেন – অদ্ভূত কথা বললেন, দেবী! আপনারা আমার অতিথি। নিজের স্বার্থে অতিথিদের প্রাণ নেব! এমন পাপ কর্ম করতে পারব না। প্রাণ দিয়ে অতিথিকে রক্ষা করতে হয়। ব্রাহ্মণ হত্যা করে কুলের কলঙ্ক হতে চাই না। 
কুন্তী বলেন – আমিও এসব কথা জানি। 
ব্রাহ্মণ বলে- আমায় আর ও কথা বলবেন না। 
কুন্তী বলেন- শুনুন ব্রাহ্মণ আমার পুত্ররা মহা বলধর। তাদের রাক্ষস বধ করতে পারবে না। তারা বিদ্যান, বুদ্ধিমান। তারাই কৌশলে রাক্ষস বধ করবে। 

কুন্তীর কথায় ব্রাহ্মণ অবাক হল এবং আশার আলো দেখল। কুন্তী ব্রাহ্মণকে নিয়ে ভীমের কাছে এলেন। ভীম সব শুনে যেতে রাজি হলেন। ব্রাহ্মণ আনন্দ মনে ঘরে ফিরল। 
......................................

Sunday, August 31, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৩

হিড়িম্ব–রাক্ষস বধঃ 
 

ভীম ও হিড়ম্বা যখন কথোপকথন করছিলেন হিড়ম্ব তাদের দুর থেকে নিরীক্ষণ করল। হিড়িম্বা ভুবনমোহন রূপে বিদ্যু ঝলকে ভীমের বামদিক আলো করে বসে আলাপ করছে। খোপায় তার ফুলের মালা, গলায় মুক্তা-মানিক-প্রবালের মালা দুলছে। পায়ে নূপুর কঙ্কণ, বসন ভূষণ সজ্জায় যেন স্বর্গের বিদ্যাধরী, যৌবনের মোহে নবীন, কথায় প্রিয় সম্ভাষণ দেখে মনে হয় দম্পতী যুগল যেন কথা কয়। 
দেখে হিড়িম্ব ক্রোধে জ্বলতে লাগল। ভগিনীকে ডেকে সে বলে -এই জন্য তোর এত দেরি হচ্ছে! কুলের কলঙ্কিনী তুই, তোর জীবনকে ধিক্কার। হে পাপিনী তুই এক মানুষকে স্বামীরূপে লোভ করছিস! আমার ক্রোধ তুই ভুলে গেলি! আমার আহারে ব্যাঘাত ঘটালি! সেই কারণে আগে তোকে মারব তারপর এদের মেরে আহার করব। এত বলে চোখ লাল করে, দাঁত কড়কড় করতে করতে সে হিড়িম্বাকে মারতে গেল। 
ভীম তা দেখে বলে – রাক্ষস তোর লজ্জা করল না, বোনকে অচেনা পুরুষদের স্থানে পাঠালি। তুই পাঠালি তাই সে এলো ও মদনের শরে আক্রান্ত হয়ে আমাকে কামনা করল। আমার সামনে তুই আমার কামপত্নী, নিজের বোনকে যা খুশি বললি, আবার অহঙ্কার করে মারতে আসছিস! এখনি তোকে যমের দ্বারে পাঠাব। 
বেশি গর্জন করলে মা-ভাইদের ঘুম ভেঙ্গে যাবে ভেবে ভীম রাক্ষসকে দুরে টেনে নিয়ে গেল। 
ভীমের কথা শুনে হিড়িম্ব দুহাত বাড়িয়ে তাকে মারতে এগিয়ে এলো। হেসে কুন্তীপুত্র তাকে একটানে নিজের দিকে টেনে নিলেন। এভাবে রাক্ষস ও ভীমের ভীষণ যুদ্ধ শুরু হল। ভীম এই যুদ্ধে পরম আনন্দ পাচ্ছিলেন। দেখে মনে হল দুটি হাতি পরস্পরকে শুঁড়ে টেনে মাটিতে ফেলছে। দুই মোষ যেন মাথা ঠুকেঠুকে যুদ্ধ করছে। দুই মত্ত সিংহ যেন দাঁত কড়মড় করে ঘনঘন নিশ্বাস সিংহনাদ দিচ্ছে। মেঘেরা যেন আহ্লাদে গর্জন শুরু করেছে। তাদের আস্ফালনে বৃক্ষ ভেঙ্গে পড়তে লাগল। বন্যপ্রাণীরা পালাতে লাগল। সম্পূর্ণ বন তাদের গর্জনে কাঁপতে লাগল। 
কুন্তী ও চারভাই শব্দে জেগে উঠলেন। কুন্তী পাশে সুন্দরী চিন্তিতা হিড়িম্বাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন। আশ্চর্য হয়ে দ্রুত উঠে বসে তিনি হিড়িম্বাকে জিজ্ঞেস করলেন –কে তুমি অপ্সরা, নাগিনী না বনের দেবী! কোথা থেকে এলে! 

হিড়িম্বা কুন্তীকে প্রণাম করে বলে – জাতে আমি রাক্ষসী। এ বনেই আমার বাস। আমার ভাই হিড়িম্ব মহাযোদ্ধা বীর রাক্ষস। আপনাকে ও পাঁচভাইকে ধরে আনার জন্য আমাকে পাঠায়। কিন্তু আপনার পরম সুন্দর পুত্র ভীমকে দেখে আমি তাকে স্বামীরূপে কামনা করি। দেরি দেখে ভাই এখানে চলে আসে এবং আপনার ছেলের সাথে এখন তার যুদ্ধ হচ্ছে। 
হিড়িম্বার মুখে সব শুনে চারভাই যুদ্ধস্থানে উপস্থিত হলেন। ভীম-হিড়িম্বের বর্ণনাতিত সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ হতে দেখলেন। তাদের যুগল পর্বতের মত লাগল। দুজনেই ধুলোয় ধূসর। কুয়াসায় যেন পর্বত আচ্ছাদিত। দুজনেই দুজনকে টানছে। তাদের নিশ্বাস ঝড়ে বৃক্ষ উড়ে গেল। 
সব দেখে যুধিষ্ঠির চেঁচিয়ে বললেন- ভাই রাক্ষসকে ভয় পেয় না। আমরা ঘুমাচ্ছিলাম তাই তোমাদের ঝগড়ার কথা কিছু জানতে পারিনি। এখনি সব ভাই মিলে রাক্ষসকে মারব। 
শুনে দুঃখিত হয়ে ভীম বলেন – কেন আমায় সন্দেহ করছ। এখনি আমি রাক্ষস বিনাশ করব। তোমারা দুরে দাঁড়িয়ে দেখ। বলে হাত বাড়িয়ে হিড়িম্বকে মারতে গেলেন। 
অর্জুন বলেন – রাক্ষসের সাথে অনেক যুদ্ধ করলেন, অনেক পরিশ্রম হল, এখন আপনি বিশ্রাম করুন, আমি এই দুষ্ট নিশাচরের বিনাশ করব।

অর্জুনের কথায় ভীম আরো রেগে গেলেন চুল ধরে হিড়িম্বকে মাটিতে আছড়ে ফেললেন। চড়-চাপড়-ঘুষি-পদাঘাত চলতে লাগল। পাখির মত তাকে শেষ করলেন। মাঝখান থেকে দুইখান করলেন। তারপর ভাইদের দেখালেন। পঞ্চভাই পরষ্পরকে আলিঙ্গন করলেন। চারভাই বৃকোদর ভীমের বহু প্রশংসা করতে লাগলেন। 
অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে ব্যগ্র হয়ে বলেন- ঐ সামনে একটা গ্রাম দেখতে পাচ্ছি এখনি সেখান থেকে কেউ এসে সব দেখে দুর্যোধনকে খবর দেবে, তাই এখানে আমাদের থাকা নিরাপদ নয়, শীঘ্র অন্য স্থানে যাওয়া উচিত। এই সব ভেবে কুন্তী ও পাঁচভাই দ্রুত সেস্থান থেকে গমন করলেন। 

হিড়িম্বা কুন্তীর সাথেই যেতে লাগল। হিড়িম্বাকে দেখে ভীম রেগে গেলেন। চেঁচিয়ে বললেন – রাক্ষসরা সহজেই মায়া করতে পারে। মোহিনীরূপ ধরলেও স্বভাব একই থাকে। সময় গেলে এও আমাদের মারবে। ভায়ের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে, আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই সে আমাদের সাথে চলেছে। এক চড়ে তোকেও ভায়ের কাছে পাঠাব। 
এই বলে ভীম হিড়িম্বাকে মারতে এল। 

যুধিষ্ঠির তাকে বাঁধা দিয়ে বলেন- ভীম ধর্মে বলে স্ত্রীজাতিকে বধ করা অন্যায়। তুমি কেন এমন পাপ কাজ করছ! তোমাকে মহা বলবান হিড়িম্ব মারতে পারল না, এর কি শক্তি যে তোমায় সংহার করবে! 
যুধিষ্ঠিরের কথায় ভীম শান্ত হলেন।
হিড়িম্বা কাতর কণ্ঠে কুন্তীকে বলে –কায়মনোবাক্যে আমি সত্য অঙ্গীকার করছি তুমি ছাড়া আমার আর গতি নেই। তোমাকে মিথ্যে বলছি না, তুমিও নারী আমার মনোকষ্ট তুমি বুঝবে। কামবশে অজ্ঞান হয়ে আপন ভাই ও কুল ত্যাগ করে তোমার পুত্রকে ভালবাসলাম। এখন সব হারিয়ে আমি তোমার শরণে এসেছি। শরণাগতের উপর ক্রোধ অনুচিত, আপনি দয়া করে আমার ব্যবস্থা করুন। সব সময় আমি আপনার সেবা করব। সব সঙ্কট থেকে উদ্ধার করব। আপনি ভীমকে আজ্ঞা করুন আমাকে গ্রহণ করার জন্য। না হলে এখনি আপনার সামনে আমি প্রাণত্যাগ করব। কৃতাঞ্জলি করে আমি সবিনয়ে এ অনুরোধ জানাচ্ছি। না হলে অধর্ম অবশ্যই হবে।
 
হিড়িম্বার এত কথা শুনে দয়াময় যুধিষ্ঠির বলেন – হিড়িম্বা মন থেকে সত্য কথা বলছে। কেউ শরণ চাইলে তাকে রক্ষা করতে হয়। ভাই ভীম তুমি হিড়িম্বাকে নিয়ে সুখে বনের ভিতর বিচরণ কর । পরে আবার আমরা দেখা করব। আমার বাক্য লঙ্ঘন করো না। 


ধর্মপুত্রের আজ্ঞা পেয়ে হিড়িম্বা খুশি হল এবং ভীমকে নিয়ে শূণ্যপথে চলে গেল। নানা বনে উপবনে যেখানে খুশি তারা ঘুরে বেড়াতে লাগল মনের আনন্দে। কত নদ-নদী-পাহাড়-পর্বত ঘুরলো, নতুন নতুন সাজে পরস্পরকে আকর্ষণ করে বহুদিন কাটাল। এর কিছু পরেই ঋতুযোগে হিড়িম্বা গর্ভবতী হল। ভয়ঙ্কর মূর্তির এক পুত্র সে জন্ম দিল। জন্মমাত্র পুত্র মহাবীর যুবক হল। তার বিশাল শরীর ঘটের মত মাথা ও খাড়া খাড়া চুল – ভীম তার নাম রাখল ঘটোৎকচ। এই মহা বলবান হিড়িম্বাপুত্রই হবে ইন্দ্রের একাঘ্নী শক্তির আধার। ঘটোৎকচ মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে ভীমকে কৃতাজ্ঞলি সহ দন্ডবৎ করে বলেন – আজ্ঞা করুন আমরা নিজেদের স্থানে যাই। যখনই স্মরণ করবেন অবশ্যই উপস্থিত হব। 

মাতা ও পুত্র ভীমের আজ্ঞা পেয়ে উত্তরদিকে নিজেদের স্থানে যাত্রা করল। ভীম আবার মা ও ভাইদের সাথে মিলিত হলেন। তারা একস্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরতে লাগলেন। কোন স্থানে এক রাত্রের বেশি অবস্থান করলেন না। পরিধানে গাছের ছাল, মাথায় জটার ভার। কোথাও ব্রাহ্মণ কোথাও তপস্বী রূপে তারা থাকতে লাগলেন। পথে লোক দেখলে বনে লুকিয়ে পরতেন। যেখানে কেউ থাকেনা সেখানেই আশ্রয় নিতেন। ত্রিগর্ত, পাঞ্চাল, মৎস্য ও অনেক দেশে বহু কষ্টে ভ্রমণ করে বেরাতে লাগলেন।

হঠাৎ একদিন ব্যাসদেব পান্ডবদের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে কুন্তীদেবী এগিয়ে এসে সবার সাথে ব্যাসকে প্রণাম জানালেন। ব্যাসকে দেখে কুন্তী নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। বহু বিলাপ করতে করতে কাঁদতে লাগলেন। 
বেদব্যাস তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন - আমাকে কি আর বলবে, সবই আমি জানি। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা অধর্ম করল তোমাদের সাথে। তাই আজ তোমাদের বনে বনে ভয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। তারা যা করেছে সব আমার গোচরে এসেছে সে জন্যই তোমাদের দেখতে এলাম। তিনি পুত্রবধূকে মনস্থির করে দুঃখ করতে বারণ করলেন এবং আশির্বাদ করলেন অচিরেই সব দুঃখ দুর হবে। 
ব্যাস বলেন – তোমার পুত্রদের গুণ তুমি যান না, আমি সব জানি। ধর্মবলে, বাহুবলে সকলকে জয় করবে, সাগরান্ত ভূমন্ডলের সম্পদ হবে। এখন আমি যা বলছি সাবধানে শোন। বহু দুঃখে অনেক বনে ঘুরলে। এখন কাছেই একচক্রা নামে এক নগর আছে। কিছুদিন সেখানে বিশ্রাম কর। গোপনে ছন্মবেশে ছয়জনে বাস কর সেখানে যতদিন না আমি ফিরে আসি। 
এত বলে ব্যাসদেব তাদের নিয়ে একচক্রা নগরে চললেন। সেখানে এক ব্রাহ্মণের গৃহে তাদের থাকার ব্যবস্থা হল। ব্রাহ্মণের ঘরে ছয়জনকে রেখে ব্যাসদেব চলে গেলেন।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers