Blog Archive

Saturday, September 20, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৬

ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদীর উৎপত্তি কথনঃ 

কিছুকাল পর পান্ডবদের আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের গৃহে আরেক ব্রাহ্মণ অতিথিরূপে উপস্থিত হলেন। তিনি বিভিন্ন দেশের গল্প বলেন, কুন্তীসহ পঞ্চপান্ডব তা শ্রবণ করেন।

দ্বিজ(ব্রাহ্মণ) বলেন – বহু দেশ ভ্রমণ করলাম, বহু নদী, বহু তীর্থক্ষেত্র ঘুরলাম যা গণনা করে শেষ করা যায় না। 
বিবিধ উপাখ্যান ও নানা দেশের বিবরণ প্রসঙ্গে তিনি জানালেন পাঞ্চাল রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের আশ্চর্য মহোৎসব আয়োজনের কাহিনী। দ্রুপদরাজার কন্যা কৃষ্ণা। রূপে গুণে পৃথিবীতে তার তুল্য কেউ নেই। এই কন্যাটি অযোনিসম্ভবা, যজ্ঞ থেকে এঁনার জন্ম। যাজ্ঞসেনী(যজ্ঞ সেন অর্থাৎ দ্রুপদ্ররাজের কন্যা- দ্রৌপদী) নামে তিনি জগৎ বিখ্যাত। দ্রুপদের পুত্রটিও রূপে গুণে বিখ্যাত। দ্রোণকে বিনাশ করতেই তার জন্ম- নাম ধৃষ্টদ্যুম্ন। 
 বিভিন্ন দেশের গল্প কুন্তীসহ পঞ্চপান্ডব শ্রবণ করেন 

একথা শুনে পান্ডবরা সবিস্তারে সমস্ত ঘটনা জানতে চাইলেন। 
ব্রাহ্মণ বলেন – পূর্বে দ্রোণ ও দ্রুপদ বন্ধু ছিলেন। কিন্তু পরে তাদের মধ্যে কলহ হয়। অভিমানে দ্রোণ হস্তিনানগরে গিয়ে কৌরব কুমারদের অস্ত্রশিক্ষা দান করেন। শিক্ষা শেষে শিষ্যদের কাছে দক্ষিণা চান – দ্রুপদরাজাকে বেঁধে তার সামনে হাজির করতে হবে। কুন্তীপুত্র অর্জুন গুরুর আজ্ঞা পেয়ে দ্রুপদরাজাকে বেঁধে আনলেন। অর্ধেক রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে দ্রোণ পুনরায় দ্রুপদের বন্ধু হলেন ও তাকে মুক্তি দিলেন। 

দ্রুপদরাজা

অভিমানে দ্রুপদ অন্ন–জল ত্যাগ করলেন। প্রতিহিংসায় তিনি জর্জরিত হতে থাকেন। কিভাবে দ্রোণকে মারা যায় সেই চিন্তা ছাড়া মনে আর কোন ভাবনা ঘোরে না। সর্বদা রাজা সেই ভাবনা নিয়ে গঙ্গাতীরে ভ্রমণ করেন। সেখানে বেদে বিখ্যাত যাজ ও উপযাজ নামে দুই ভাই-ব্রাহ্মণকুমার বাস করতেন। উপযাজকে দ্রুপদ একদিন দেখতে পেলেন। তার পূজা ও পদসেবা করে যোড়হাতে পাঞ্চালরাজ বলেন – দশকোটি ধেনু(গরু) ও অসংখ্য সোনা দেব, যা চাইবেন তাই দেব যদি আমার মনবাঞ্ছা পূরণ করেন। আমার ইচ্ছে দয়া করে শুনুন। ভরদ্বাজ পুত্র দ্রোণ –পৃথিবীতে তার তুল্য অস্ত্রধারী কেউ নেই, কেউ তার সাথে যুদ্ধ করে পারে না। সে যেন দ্বিতীয় পরশুরাম। এমন বুদ্ধি করুন যাতে তাকে যুদ্ধে জয় করতে পারি। ক্ষত্রিয়ের অসাধ্য শক্তি তার। তপো মন্ত্র বলে এর প্রতিকার করুন। এমন যজ্ঞ করুন যাতে আমার পুত্র সন্তান হয় ও তার হাতেই দ্রোণের নিধন হয়। 

উপযাজ চিন্তা করে বলেন– আমার মতে ব্রাহ্মণ বধ উচিত কর্ম নয়।
তার কথা শুনে রাজা তাকে পুত্রের জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। 

উপযাজ বড় ভাই যাজের কাছে দ্রুপদকে পাঠালেন

দ্রুপদের বিনয় দেখে ব্রাহ্মণ প্রসন্ন হয়ে বলেন- আমার বড় ভাই যাজ পরম তপস্বী। বেদে পারদর্শি, অরণ্য নিবাসী। তাঁর কাছে তুমি প্রার্থনা কর। তিনি তোমার সব দুঃখ দুর করতে পারেন। 
উপযাজের কথায় রাজা যাজের কাছে গেলেন। প্রণাম করে সব কথা জানালেন। সদয় হয়ে যাজ যজ্ঞ করতে সম্মত হলেন। যজ্ঞ শুরু হলে রাণীকে নিয়ে রাজা ভক্তি ভরে সকল ব্রতের আচার পালন করলেন। 
যজ্ঞ পূর্ণ হলে এক কুমারের জন্ম হল। অগ্নিবর্ণ বীর, হাতে তার ধনুঃশর, অঙ্গে তার কবচ ও মাথায় টোপর। হাতে উদ্ধত খড়্গ ধরে, দেখে ভয়ঙ্কর লাগে। পুত্রকে দেখে পাঞ্চালরাজ খুবই আনন্দিত হলেন। 
তবে সেই যজ্ঞে আরেকটি কন্যারও জন্ম হল। জন্মমাত্র দশদিকে তার দ্যুতি ছড়িয়ে পরল। তিনি সুদর্শনা, শ্যামবর্ণা, পদ্মপলাশাক্ষী, পীনপয়োধরা, তাঁর নীলোৎপলতুল্য সৌরভ এক ক্রোশ দুরেও অনুভূত হয়। তিনি সুরাসুর, যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্বের বাঞ্ছিত। এভাবে পাঞ্চালরাজের পুত্র ও কন্যা যজ্ঞের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করল। সে সময় আকাশবাণী হল। 
এ কন্যার জন্ম হল ভার নিবারণের জন্য। এর মাধ্যমেই ক্ষত্রিয়দের নিধন হবে। কুরুবংশ ধ্বংস হবে-এই কন্যার মাধ্যমে। 
পুত্রটির জন্ম হল দ্রোণকে বধ করার জন্য। 
সকলে আকাশবাণী শুনে জয় জয় ধ্বনি দিতে লাগল। যত বীরযোদ্ধা সকলে হুঙ্কার দিলেন। আনন্দে দ্রুপদরাজা বিবাদ ত্যাগ করলেন। পুত্র কন্যার নামকরণ করা হল। ধৃষ্ট(প্রগল্‌ভ) ও দ্যুম্ন(দ্যুতি, যশ, বীর্য, ধন)-সমন্বিত এই কারণে কুমারের নাম ধৃষ্টদ্যুম্ন হল।

ধৃষ্টদ্যুম্ন

শ্যামবর্ণের জন্য কন্যার কৃষ্ণা নাম হল। পিতার নামানুসারে দ্রৌপদী ও যজ্ঞ থেকে যাজ্ঞসেনী। 
বর্তমানে সেই কন্যার স্বয়ম্বর উপস্থিত। দুরদুরান্ত থেকে রাজারা আসতে শুরু করেছেন। 

কৃষ্ণা দ্রৌপদী

ব্রাহ্মণের মুখে এত কথা শুনে পঞ্চপান্ডবের সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে হল। সবার মনের কথা বুঝে কুন্তী পুত্রদের ডেকে বললেন –বহুদিন এখানে বাস করেছি। এক জায়গায় বেশিদিন থাকা ঠিক নয়। পূর্বের মত এখন আর ভিক্ষাও মেলে না। পাঞ্চালরাজা খুব দয়ালু শুনছি। যদি তোমাদের মন চায় তো চল সেই রাজ্যে যাই। শুনে সব ভাইরা সম্মত হলেন। 
পুত্রদের নিয়ে কুন্তীদেবী যখন আলোচনা করছেন তখন ব্যাসদেব সেখানে উপস্থিত হলেন। কুন্তীদেবী ও পুত্ররা তাকে ভূমিষ্ট হয়ে প্রণাম জানান। মুনি সকলকে আশির্বাদ করলেন। তারা পরস্পর কুশল বাদানুবাদ করতে লাগলেন।
.....................................

Sunday, September 14, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৫

বক্‌-বধঃ
কিছু পরে চারভাই ঘরে ফিরলেন। ভীমকে না দেখতে পেয়ে যুধিষ্ঠির একান্তে ডেকে কুন্তীকে ভীম কোথায় যানতে চাইলেন। সব শুনে যুধিষ্ঠির চিন্তিত হলেন।

কুন্তী বলেন - ব্রাহ্মণকে রক্ষা করতে, এই নগরকে রক্ষা করতেই আমি ভীমকে বক রাক্ষস বধে পাঠালাম। 

যুধিষ্ঠির বিরস বদনে বলেন – মা হয়ে তুমি পুত্রকে রাক্ষসের কাছে পাঠালে! আমরা অজ্ঞাতবাসে আছি। ভীম আমাদের মধ্যে বলবান। তার শক্তির সাহায্যে রাজ্য অধিকারের আশা রাখি। কৌরবরা তাকে ভয়ও পায়। তার সাহায্যেই জতুগৃহে আমরা বাঁচলাম। সেই হিড়িম্ববনে আমাদের কাঁধে করে নিয়ে গেল ও হিড়িম্ব বধ করল। সেই বীর পুত্রকেই তুমি রাক্ষস ভোজনে পাঠালে! আমরা আর কি ভাবে বাঁচব। গর্ভধারিণী হয়ে তুমিই এমন কাজ করলে! বলে যুধিষ্ঠির হাহাকার করতে লাগলেন।

কুন্তী বলেন - যুধিষ্ঠির ভেব না। আমিও ভীমের প্রতাপ জানি। তার শরীরে অযুত হস্তীর বলতাকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। তার জন্মের সময়ই তার পরাক্রম দেখি। প্রসবের পর তাকে তুলতে পারিনি। একটু তুলেই ফেলে দিয়েছিলাম ধুলায়। তার আস্ফালনে পর্বতের শৃঙ্গ চূর্ণ হয়। বারণাবতে দেখলাম স্বচক্ষে সে হাতে করে তোমাদের চারজনকেই সহজে তুলেছিল। আমাদের সবাইকে কাঁধে তুলে হিড়িম্ববনে গেল, হিড়িম্ব বধ করল। তার শক্তিতে আমার বিশ্বাস আছে সেই এই রাক্ষস বধ করবে। ভীত মানুষদের যিনি ত্রাণ করেন তার সমান পূণ্যবান কেউ নেই। বিশেষ করে ব্রাহ্মণের জন্য প্রাণদান ও জন্মভূমির জন্য যুদ্ধ পৌরুষের প্রতীক। এমন পূণ্যকাজের জন্য তুমি দুঃখ করছ কেন! মায়ের কথা শোন।

মায়ের সকল কথা শুনে দয়ালু যুধিষ্ঠির ধন্য ধন্য করলেন। পরের দুঃখে নিজের পুত্রকে দিয়ে ত্রাণ করায় তিনি মাকে ধন্যবাদ জানালেন। মায়ের পূণ্যেই তারা সকল বিপদ থেকে রক্ষা পাবেন।
তিনি মাকে বলেন - তবে মা ব্রাহ্মণকে বোলো এ সকল কথা যেন অন্য কাউকে না জানায়।

রাত্রে ব্রাহ্মণরূপী ভীম রথে চড়ে বনে গেল বক রাক্ষসের কাছে। ভীম চিৎকার করে বককে ডেকে তারই খাবার খেতে শুরু করল। তার নাম ধরে ডাকায় বক রাক্ষস রেগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে ক্রোধে সেখানে উপস্থিত হল। তার চলনের ভারে ধরা যেন ভিতরে ঢুকে যেতে থাকল।
 ভীমকে তার অন্ন খেতে দেখে রেগে বক দুই চোখ লাল করে চিৎকার করে বলে – হে দুষ্টমতি মনুষ্য! তুই এমন অনীতির কাজ কেন করলি! তোর দোষে সকুটুম্ব ব্রাহ্মণকে আমি আজই ভক্ষণ করব।  
এই বলে রাক্ষস রাগে আস্ফালন করতে থাকে। যদিও ভীম রাক্ষসের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে পিছন ফিরে তার খাদ্য খেতে থাকেন গোগ্রাসে। দেখে ক্রোধে নিশাচর গর্জন করতে করতে দুহাত তুলে ভীমকে ধরতে যায়। সে দুই হাত দিয়ে ভীমের পিঠে আঘাত করতে থাকে। ভীম তাও গ্রাহ্য করেন না। রাক্ষস পিঠে মারতে থাকে ভীমও হেলায় তা সহ্য করে নির্ভয়ে পায়সান্ন খেতে থাকেন। তা দেখে রাক্ষস আরো রেগে বৃক্ষ উপড়ে ভীমকে ছুঁড়ে মারে। তবু ভীম হাসতে
হাসতে অন্ন খেতে খেতে বাঁ হাতে বৃক্ষ কেড়ে নেন। পুনরায় রাক্ষস একটি মহাবৃক্ষ উপড়ে গর্জন করে ভীমের উপর ছোঁড়ে। ভোজন শেষ করে ভীম আচমন সেরে বৃক্ষ উপড়ে যুদ্ধ শুরু করেন। বৃক্ষে বৃক্ষে সাংঘাতিক যুদ্ধ শুরু হয়। এভাবে বনের সব বৃক্ষ নষ্ট হল। এরপর দুজনে দুজনের উপর শিলাবৃষ্টি শুরু করল। দুজনে পরষ্পরকে জড়িয়ে ধরে বাহুযুদ্ধ শুরু করে। পরস্পর পরস্পরের মুন্ড ধরে, বাহুতে বাহু দিয়ে, হাত জড়িয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে যুদ্ধ করে। 
এত যুদ্ধ করে বক রাক্ষস শ্রান্ত হয়ে পরে। কুন্তীপুত্র ভীম সহজেই বক রাক্ষসকে ধরে ফেললেন বাম হাতে দুই জানু ও ডান হাতে মাথা রাক্ষসের চেপে ধরেন। রাক্ষসের বুকে হাটু দিয়ে ভীমবীর জোরে টান মারলেন। রাক্ষস দু’টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পরল। বক রাক্ষস আর্তচিৎকার করে মরল। বক রাক্ষসের যত অনুচর ছিল তারা ভয়ে সে স্থান ত্যাগ করে পালালো। নগরের কাছে ভীম বক রাক্ষসকে ফেলে মা ও ভাইদের কাছে গিয়ে সব জানালেন।

আনন্দিত মা কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে ডেকে ভীমকে আলিঙ্গন করে তার প্রশংসা করতে লাগলেন।
পরদিন ভোরে নগরবাসী বক রাক্ষসের পর্বত প্রমাণ দেহ নগর দ্বারপ্রান্তে পরে থাকতে দেখে চমৎকৃত হল। কেউ জিজ্ঞেস করে এমন কাজ কে করল, কেউ বলে যেই করুক সবাই নিষ্কন্টক হলাম। এই পরম দুষ্ট হিংস্র বক রাক্ষস নিজের পাপেই মরেছে। পরে তারা বিচার করে দেখল আগেরদিন বক রাক্ষসকে খাদ্য পাঠানোর দায়িত্ব কার ছিল। সেই বলতে পারবে বক রাক্ষস কি ভাবে মরল। দেখা গেল ব্রাহ্মণের দিন ছিল। সকলে তাকে দ্রুত ডেকে পাঠাল। কি ঘটেছিল সকলে জানতে উদগ্রিব।

ব্রাহ্মণ বলে – আমার ঘরে কাল পাঁচ মহাপুরুষ আসেন। আমাদের শোকার্ত দেখে তাদের মধ্যে একজন মন্ত্রসিদ্ধের দয়া হল। তিনি আমার পরিবর্তে রাক্ষসের কাছে অন্ন নিয়ে গেলেন। তিনিই বক রাক্ষসকে হত্যা করেছেন এবং রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। 


সব শুনে নগরবাসী খুশি হল। সকলে ব্রাহ্মণকে পূজা করল। আনন্দ মনে ব্রাহ্মণ ঘরে ফিরে এলো। এরপর থেকে পান্ডবদের ব্রাহ্মণ দেবতুল্য সন্মান করতে লাগল
মহাভারত অমৃতের ধারা, কাশীরাম কহে শুনে ইহলোকের দুঃখ পার হবে সর্ব জনা।
......................................................    

Sunday, September 7, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৪

পান্ডবগনের একচক্রা নগরে বাস: 

একচক্রা নগরে ব্রাহ্মণের গৃহে মাকে নিয়ে পান্ডবরা অজ্ঞাতবাসে রইলেন। নগরে সারাদিন ভিক্ষে করে রাতে ঘরে আনতেন। কুন্তী তাই রান্না করে অর্ধেক ভীমকে খেতে দিয়ে বাকি পাঁচজনে ভাগ করে খেতেন। যদিও তাতেও ভীমের তৃপ্তি হত না। এভাবে বহু কষ্টে তারা সেখানে বাস করতে লাগলেন। 

একদিন ভীম ঘরে রয়ে গেলেন, বাকি চারভাই ভিক্ষা করতে বেরলেন। হঠাৎ ব্রাহ্মণের গৃহে বিকট শব্দ হল ও ব্রাহ্মণ-বাহ্মণী বিলাপ করতে লাগল। 
কুন্তীদেবী তাদের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ভীমকে ডাকলেন। বললেন - এতদিন এই গরিব ব্রাহ্মণের আশ্রয়ে গোপনে বাস করছি। আজ এনার ঘোর বিপদ, অবশ্যই একে রক্ষা করতে হবে। উপকারী জনের যে সাহায্য না করে তার সংসারে অপযশ হয়, পরলোকেও পাপ হয়। 

ভীম বলেন – মা! ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস কর কি তার কষ্ট, সাধ্য অনুসারে তাকে রক্ষা করব। 

ভীমের আশ্বাস পেয়ে কুন্তী ব্যগ্র ভাবে ব্রাহ্মণের কাছে ছুটে গেলেন। 
তিনি গিয়ে দেখেন বিলাপ করে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণীকে বলছে- এই জন্যই তোমায় আগেই বলেছিলাম যে দেশে রাক্ষসের উপদ্রপ সেখানে বাস করে কাজ নেই। পিতামাতার স্নেহে সে কথা তুমি শুনলে না। এখন উচিত শিক্ষা পাও! কি করব ভেবে পাচ্ছি না। কোন বুদ্ধি বার করে এর প্রতীকার কর। তুমি আমার গৃহিনী ও ধর্মপত্নী। তুমিই আমায় সব সুখ ও শান্তি দিয়েছ। তোমার ধর্ম জ্ঞানে আমার বিশ্বাস আছে। আমার বালক পুত্রের জননী তুমি, তোমাকে ছেড়া সে বাঁচবে না। তোমাকে হারালে আমি দুঃখের অরণ্যে নিজেকে হারাব। নিজেকে বাঁচিয়ে তোমাকে যদি রাক্ষসের হাতে দিই তবে সংসারে আমার অপযশ হবে। অপূর্ব সুন্দরী কন্যাকে রাক্ষসের হাতে দিলে কুযশ কাহিনী রটবে। কন্যার জন্ম হলে পিতা আশা করে তাকে সুপাত্রে দান করে স্বর্গ বাস করবে। সেই কন্যাকে রাক্ষসের হাতে দিলে নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারব না। আমি নিজেই রাক্ষসের কাছে চললাম। 
এত বলে ব্রাহ্মণ কাঁদতে কাঁদতে চললেন। 



ব্রাহ্মণী তার পথ আগলে বলেন – তোমরা সুখে বাস কর, আমি রাক্ষসের কাছে যাব। তুমি গেলে পুর পরিবার না খেতে পেয়ে মরব। আমি সহমৃতা হব। পুত্রকন্যা না খেতে পেয়ে মরবে। আমি বাঁচলেও আমি কি ভাবে তাদের পালন করব। তোমাকে ছাড়া আমরা তিনজনেই অনাথ হব। অনাথের বহু কষ্ট। দরিদ্র দেখে অকুলীনজন কন্যাকে চাইবে। পুত্র ভিক্ষারী হবে কিছুদিনেই। কুলধর্ম বেদের বিমুখ হবে। দুর্বল অনাথ দেখে বলবান কামুক দুর্মুখ লোক আমাকে কামনা করবে। তোমাকে ছাড়া আমাদের পদে পদে বহু বিপদ হবে। সে জন্যেই তোমাকে যেতে বারণ করছি। অনেক স্নেহে ভালবাসায় এ সংসার তুমি গড়ে তুলেছ। পুত্রকন্যাও তোমার মত সুন্দর হয়েছে। কন্যাকে সুপাত্রে দান করো। পুত্রকে পড়িও। তুমিও আবার বিবাহ করো। আমি গেলেও আবার তোমার সংসার হবে। কিন্তু তোমাকে ছাড়া পুর পরিবার নষ্ট হবে। নারীর পরম ধর্ম স্বামীর সেবা করা, বিপদে নিজেকে দান করে স্বামীকে রক্ষা করা, তাতেই সে ইহলোকে যশ পায়, স্বর্গে অক্ষয় হয়। তপ, জপ, যজ্ঞ, ব্রত, নানা প্রকার দানের সমান ফল স্বামীর সেবায় লাভ করা যায়। শাস্ত্রে ও সকল ধর্মে একথাই বলা আছে। তাই রাক্ষসের কাছে আমিই যাব। 

স্ত্রীর কথা শুনে তাকে জড়িয়ে ব্রাহ্মণ চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। ব্রাহ্মণীও কাঁদতে লাগল। মা-বাবার অবস্থা দেখে পুত্র-কন্যাও কাঁদতে শুরু করল। 

কন্যা বলে- মা কেঁদো না, তুমি রাক্ষসের কাছে গেলে মা হারা বালকের মৃত্যু হবে, পিন্ডদানের কেউ থাকবে না, কুল বিনষ্ট হবে, তাই মার যাওয়া হবে না। কন্যার জন্ম হলে তাকে ত্যাগ করতেই হবে। বিধির সৃজন কেউ খন্ডন করতে পারবে না। পিতা তুমি আমায় অন্য কাউকেতো দান করতেই, এখন রাক্ষসের হাতেই আমায় দান কর। তোমরা রক্ষা পাবে। আমার মত আরো কন্যা তোমাদের হবে। তাই আমাকেই ত্যাগ কর। পরে আমার পুত্রও আমাকে হয়ত তাড়াবে। এখন আমিই নিশ্চিন্তে যাই। 
কন্যার কথা শুনে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী আরো কাঁদতে লাগলো। 

এত কথা শুনে ছোট্ট ছেলেটি সবার মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে বারণ করল। এক হাতে একটি তৃণ নিয়ে শিশুটি বলে উঠল – তোমরা কেউ রাক্ষসকে ভয় পেও না। এই তৃণ দিয়ে তাকে আমি মারব। তোমরা আমায় রাক্ষস কোথায় দেখিয়ে দাও। 

বালকের কথা শুনে তিনজনে কান্না ভুলে হাসতে লাগল। 
তাদের হাসতে দেখে কুন্তীদেবী এগিয়ে এসে সকাতরে বলেন – কি কারণে তোমরা কাঁদছো? কি ভাবে আমি তা মোচন করতে পারি বল। 
 

ব্রাহ্মণ বলে – মানুষের সাধ্য নেই এ দুঃখ মোচন করার। এই নগরে দুরন্ত বক রাক্ষস বাস করে। সেই এ রাজ্যের প্রভূ, ঈশ্বর। যক্ষ-রক্ষ-ভূত-প্রেত সকলে তাকে ভয় পায়। তার শক্তির কাছে সবাই হেরে গেছে। সে ঠিক করেছে নগরে যত মানুষ আছে একজন করে প্রতিদিন পায়েস-পিঠে-অন্ন রান্না করে রথে ভর্তি করে তার সামনে আনবে সঙ্গে দুটি মহিষও দিতে হবে। সকলকেই সে ভক্ষণ করবে। আজ আমার দায়িত্ব তার কাছে যাওয়ার, যে যেতে অস্বীকার করবে তাকে তার পরিবারের সবার সঙ্গে মেরে খাবে। আজ আমি কাকে পাঠাব। আমার স্ত্রী-পরিবারসহ চারজন। কাকে বলি দেব ভেবে পাচ্ছি না। মানুষ কিনে যে তার কাছে পাঠাব সে সম্পদও আমার নেই। পরিবারের কাউকেই ছারতে মনও চায় না। ঠিক করেছি সবাই মিলেই তার কাছে যাব। যা কপালে আছে দেখা যাবে। 

তার কথা শুনে কুন্তী বলেন – ভয় পেও না। তোমাদের কাউকেই যেতে হবে না। আমার পাঁচপুত্র আছে, তোমার জন্য আমি একটি পুত্রকে দান করব। 

ব্রাহ্মণ বলেন – অদ্ভূত কথা বললেন, দেবী! আপনারা আমার অতিথি। নিজের স্বার্থে অতিথিদের প্রাণ নেব! এমন পাপ কর্ম করতে পারব না। প্রাণ দিয়ে অতিথিকে রক্ষা করতে হয়। ব্রাহ্মণ হত্যা করে কুলের কলঙ্ক হতে চাই না। 
কুন্তী বলেন – আমিও এসব কথা জানি। 
ব্রাহ্মণ বলে- আমায় আর ও কথা বলবেন না। 
কুন্তী বলেন- শুনুন ব্রাহ্মণ আমার পুত্ররা মহা বলধর। তাদের রাক্ষস বধ করতে পারবে না। তারা বিদ্যান, বুদ্ধিমান। তারাই কৌশলে রাক্ষস বধ করবে। 

কুন্তীর কথায় ব্রাহ্মণ অবাক হল এবং আশার আলো দেখল। কুন্তী ব্রাহ্মণকে নিয়ে ভীমের কাছে এলেন। ভীম সব শুনে যেতে রাজি হলেন। ব্রাহ্মণ আনন্দ মনে ঘরে ফিরল। 
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers