Blog Archive

Saturday, January 31, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭৪

[পূর্বকথা –গন্ধর্ব অর্জুনকে বিভিন্ন কাহিনীর মধ্য দিয়ে বোঝালেন তাদেরও একজন পুরোহিত প্রয়োজন সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য......তারই কথা মত পাণ্ডবরা দেবল ঋষির কনিষ্ঠ ভাই ধৌম্যকে পৌরোহিত্যে বরণ করে নিলেন এবং পাঞ্চালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

দ্রৌপদীর স্ব্য়ম্বরঃ- 
 

পাঞ্চাল নগরে পঞ্চপান্ডব এক কুম্ভকারের গৃহে অতিথিরূপে আশ্রয় নিলেন। তারা ব্রাহ্মণের বেশে থাকেন ও ভিক্ষা করেন। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যায়। 

এদিকে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ কন্যার স্বয়ম্বরের অদ্ভূত আয়োজন করতে থাকেন। যখন দ্রৌপদী সুন্দরীর জন্ম হল অগ্নি থেকে তখনই দ্রুপদ ঠিক করে ফেলেছিলেন এই কন্যার যোগ্য বর হবেন বীর ধনঞ্জয় অর্জুন। কিন্তু জতুগৃহে পঞ্চপান্ডবের মৃত্যুর সংবাদ পেলে দ্রুপদ তা বিশ্বাস করেন নি। তিনি বহুদেশে পঞ্চপান্ডবদের খোঁজার জন্য দূত পাঠান। কিন্তু কোন খবর না পেলে চিন্তিত হন। শেষে অনেক চিন্তা করে এমন এক ধনুক তৈরী করান যা কেউ কখনও দেখে নি। তিনি শূণ্যে একটি যন্ত্র স্থাপন করে তার উপরে লক্ষ্য বস্তুটি রাখলেন। পঞ্চশরসহ সেই ধনুকটি সভায় রাখলেন। 
এই ধনুঃশরে ঐ যন্ত্র রন্ধ্রপথ দিয়ে যে লক্ষ্যভেদ করবে তার সাথেই কন্যার বিবাহ হবে- রাজা এমন ঘোষণা করলেন। 
সেই মত সর্বত্র রাজাদের নিমন্ত্রণ করা হল। সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত সকল রাজ্যের রাজারা আমন্ত্রণ পেয়ে সসৈন্য পাঞ্চালে উপস্থিত হলেন। এত রথ, অশ্ব, পদাতিক এল যে গুণে শেষ করা যায় না। চারদিকে বিবিধ বাজনা বাজতে থাকে, মহা কোলাহল। জল, স্থল, পর্বত, কানন, নদ, নদী পেরিয়ে-দশদিক থেকে সকলে পাঞ্চাল রাজ্যে আসতে থাকে। ধ্বজা, ছাতা, পতাকায় আকাশ ঢেকে গেল। চারদিকে এত মানুষের কলরব যে কিছুই শোনা যায় না। নগরের ঈশান ভাগে অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব দিকে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ এক বিচিত্র মনোহর সভা রচনা করলেন। চারদিকে সুপরিসর মঞ্চ রচিত হল। বিবিধ বসন, মণি, রত্ন দিয়ে তাদের মুড়ে দেওয়া হল। কৈলাস শিখরের মত সুন্দর সুসজ্জিত রাজাদের ঘর তৈরী করা হল। সোনা, রূপা, মণি, মুক্তা, প্রবাল দিয়ে মঞ্চ বেষ্টিত করে যেন সুবর্ণের জাল তৈরী হল। গুবাক(সুপারী) ও কলাগাছ স্থানে স্থানে মঙ্গলসূচক রূপে স্থাপিত হল। উপর নীচ কেটে তাদের সমান করা হল। চারদিকে চন্দন ছড়িয়ে ধুলো নাশ করা হল। সুগন্ধি কুসুম গন্ধে ভ্রমররাও মত্ত হয়ে উঠল। মঞ্চের স্থানে স্থানে বিচিত্র সিংহাসন রাখা হল। বিচিত্র উত্তম শয্যা, বিচিত্র বসন, চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় যা লিখে শেষ করা যায় না। বহুদিন ধরে এসব ধিরে ধিরে সঞ্চয় করা হয়েছিল। আমন্ত্রিত রাজারা মঞ্চের উপর তাদের যথাযোগ্য স্থানে বসলেন। এ যেন আরেক ইন্দ্রের সভা বসল অমর ভুবনে। রাজাদের নানা চিত্র-বিচিত্র বিবিধ বিভূষণ। কানে তাদের কুন্ডল, গলায় মণিমুক্তার হার। মাথায় মুকুট, অঙ্গে নানা অলঙ্কার। সকলেই রূপবন্ত, কুলবন্ত, বলে মহাবলীয়ান, সর্বশাস্ত্রে বিশারদ, সর্ব গুণশালী। এত রাজা এলেন যে সকলের বর্ণনা সম্ভব নয়। সকলে চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে উপস্থিত। 
ধৃতরাষ্ট্রের একশত কুমার সহ দুর্যোধন, দুঃশাসন, ভীষ্ম, দ্রোণ, দ্রোণী অশ্বত্থামা, কর্ণ, কৃপ, সোমদত্ত(বাহ্লীকরাজপুত্র, সম্পর্কে ধৃতরাষ্ট্রের কাকা) কুরুবীররা কোটি কোটি রথ, অশ্ব, পদাতিক নিয়ে এল। এছাড়া- জরাসন্ধ, জয়সেন, শল্য, শল্ব, সুবল পুত্র শকুনি-যিনি গান্ধার(বর্তমান সিন্ধপ্রদেশ, রাওলপিন্ড) রাজপুত্র ও মহাবীর, অংশুমান, চেদিপাল, পশুপাল, শ্বেতশঙ্খ, বিরাট, প্রতিভূতি, পুন্ডরীক, রুক্মাঙ্গদ, রুক্মরথ, রুক্মী, শতভাই কলিঙ্গ, বৃন্দ, অনুবৃন্দ, চিত্রসেন, জয়দ্রুথ, নীলধ্বজ, শ্রীবৎস রাজা সত্রাজিত, চিত্র, উপচিত্র, দূর্বানন্দ, বৃহক্ষত্র, উলূক, জলসন্ধ, ভগদত্ত, চক্রসেন, শূরসেন, চিত্রাঙ্গদ, শুভাঙ্গদ, শিরসিবাহন, ভূরিশ্রবা, সুশর্মা, বাহ্লীক প্রমূখ আরো অনেক বীর এলেন ও যথাযোগ্য স্থানে বসে সভা আলোকিত করলেন। 

 
দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর শুনে ইন্দ্রও উপস্থিত হলেন দেখতে। তাঁর সাথে দেবলোকের যম, কুবের, বরুণ, হুতাশন-অগ্নি সহ তেত্রিশকোটি দেবতা, গন্ধর্ব, চারণ, সিদ্ধ, বিদ্যাধর, ঋষি, অপ্সর, অপ্সরীরা উপস্থিত হলেন। নৃত্য-গীত-বাদ্যে সভা যেন স্বর্গপুরীতে পরিণত হল। স্বয়ং জগন্নাথ গরুড়ারোহণে উপস্থিত হলেন। পান্ডব বিবাহের জন্যেই তাঁর এই আগমন। তাঁর সাথে এলেন তাঁর আত্মীয়েরা-কামদেব(কৃষ্ণ ও রুক্মিণীর পুত্র) , গদ(যাদববীর), শাম্ব(কৃষ্ণ ও জাম্ববতীর পুত্র), চারুদেষ্ণ, সাত্যকি(যাদববীর), সারণ(কৃষ্ণের বৈমাত্রের ভাই, সুভদ্রার সহোদর), বিদুরথ, কৃতবর্মা, উদ্ধব, অক্রুর(কৃষ্ণের সখা), পৃথুঝিল্লী, পিন্ডারক, শঙ্কু, উশীনর। 
খগপতি গরুড়ের সাহায্যে নারায়ণ শূণ্যেই অবস্থান করলেন। নারায়ণ বিষ্ণু স্বয়ং শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন। পাঞ্চজন্য (পঞ্চজন-নামক দৈত্যের অস্থি দ্বারা নির্মিত) শঙ্খনাদে স্বর্গ-মর্ত-পাতাল পূর্ণ হল। পৃথিবীর সকল বাদ্যের শব্দ যেন লুকালো। যত সভ্যরা সভায় বসেছিলেন গোবিন্দকে(কৃষ্ণ) আসতে দেখে সম্ভ্রমে উঠে দাড়ালেন। 
 

ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, সত্যসেন, সত্রাজিত, শল্য, ভূরিশ্রবা, ক্রথ, কৌশিক- সকলে যুক্তকরে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানালেন। দুষ্ট রাজারা তা দেখে হাসল। শিশুপাল, শাল্ব, দন্তবক্র, জরাসন্ধ প্রমুখ দুষ্টচক্র। তারা বলে – কাকে সবাই এত ভক্তিভরে প্রণাম করলে দেবতা কি পশুত্ব ত্যাগ করে কাম জাগ্রত করবে! 
হাততালি দিয়ে শিশুপাল বলে – সবার থেকে ভাল শঙ্খ বাজায় গোপাল। দ্রুপদ তাঁকে বাদ্যকরদের নিয়ে বাজনা বাজাবার জন্যই বরণ করে নিয়ে এসেছেন। 
জরাসন্ধ বলে- ভীষ্ম, তুমিতো জানতাম জ্ঞানবান। তোমার মত জ্ঞানী ব্যক্তি এমন অজ্ঞান হলেন কি করে! সবার মাঝে তুমি কি কান্ড করলে! গোপপুত্রকে কি কখনও ক্ষত্রিয়ের প্রণাম করা সাজে! নন্দগোপের গৃহে এ চিরকাল থেকেছে। গোপেদের অন্নে প্রতিপালিত হয়ে গরুর পাল চরিয়েছে। সর্বজ্ঞ হিসেবে তুমি ভারতখ্যাত, ভীষ্ম! সব জেনে তুমি এমন কান্ড করলে! 

ভীষ্ম বলেন- ওসব বুঝি না। আমি পুরাতন বৃদ্ধ জ্ঞানী মানুষদের মুখে শুনে এসেছি গোপালের চরিত্র বেদের অগোচর। তিনলোকে কে তাঁর সম্পর্কে বলতে পারে! তিনি তাঁর এক লোমকূপে ব্রহ্মান্ড ধারণ করতে পারেন। সেই প্রভূই এই গোপাল অবতাঁর। মায়াভরে মনুষ্যদেহ ধারণ করে এলেন। তাঁর লীলায় পৃথিবীবাসী ধন্য হল। এঁনার নাভি কমল থেকেই স্রষ্টা ব্রহ্মার সৃজন হয়েছিল। এঁনার ললাট বা কপাল থেকে বিধাতার জন্ম, চক্ষু থেকে সূর্যের। এঁনার মনেতে জন্মালেন চন্দ্র, নিশ্বাসে পবন। ব্রহ্মান্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীট থেকে শ্রেষ্ঠ মহীপাল সবার মধ্যেই মায়ারূপে এই গোপালের অবস্থান। হর্তা-কর্তা বিধাতা যিনি তিনিও গোপালের চরণ বন্দনা করেন। পঞ্চমুখে সর্বক্ষণ মহেশ্বর শিব এঁনাকেই প্রণাম জানান। চারি মুন্ডে বিধাতা ব্রহ্মা, সহস্র মুন্ডে শেষনাগ যাকে প্রণাম জানান তাদের কাছে আমি তো সামান্য মনুষ্য মাত্র! হে রাজন, অজ্ঞান হয়ে তুমি এমন কথা বললে। 

ভীষ্মের কথা শুনে বৃহদ্রথের পুত্র তথা মগধরাজ জরাসন্ধ হেসে বলে- ভ্রান্তির বশে তুমি এসব বলছো। যখন এই দুষ্ট আমার জামাতা কংসকে হত্যা করল, কৈ তখন তো এসবের নিদর্শন পেলাম না! এতো তখন আমার ভয়ে মথুরা ত্যাগ করে সিন্ধুতীরে গেল। এ যদি দেব নারায়ণ হন, তবে ভীষ্ম বল কেন আমার ভয়ে পালাল। 

ভীষ্ম বলেন – সে সব কথা আমার জানা আছে। না জেনে আমি কিছুই বলি না। তবে শোন সকল কথা। পূর্বে ছিলে তুমি দৈত্য বিপ্রচিত্তি। কৃষ্ণের হাতে মরলে দিব্যগতি পেতে, তাই তিনি তোমায় মারলেন না। বলরাম না জেনে মারতে চাইলেন। আকাশবাণী শুনে তিনি আর তোমায় প্রাণে মারলেন না। তাঁর কাছে আঠারোবার হেরে যুদ্ধ ত্যাগ করলে। 
এত শুনে জরাসন্ধ ক্রোধে রক্তচক্ষে ভীষ্মকে দেখতে থাকে। 

ভীষ্মও তাঁর ক্রোধ মুখ দেখে বলেন – কি কারণে এত ক্রোধ তোমার, মগধরাজ! যেখানে কৃষ্ণের নিন্দা হয় সেখানে তিলমাত্র থাকার আমার রুচি নেই। আমি এখনই এস্থান ত্যাগ করছি। হয় নিন্দুককে মারি নয় সেস্থান উপেক্ষা করি। এই বলে তিনি সেখান থেকে অন্যস্থানে চলে যান। 
কাশীদাস বিরচিল শুনে পুণ্যবান। 

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers