Blog Archive

Tuesday, February 24, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৮২

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষত্রিয়দের বারবার লক্ষ্যভেদের জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন...শেষে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় লক্ষ্য ভেদ করতে উঠলেন... তিনি গুরুজনদের প্রণাম জানালেন...কৃষ্ণ বলরামকে বলেন তিনি অর্জুনকে সর্বপ্রকার সাহায্য করবেন ...অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হলেন ...অন্যান্য রাজা ক্রুদ্ধ হল... অর্জুনের সাথে তাদের যুদ্ধ শুরু হল

দ্বিজগণের সহিত ক্ষত্রগণের যুদ্ধঃ 
 
প্রলয়কালে যেমন সাগর উথলে ওঠে, তেমনি রাজারা ‘মার, মার’ শব্দে ধেয়ে এলো। চারদিকে সবার মুখে একই রব-দুষ্টমতি দ্বিজ ব্রাহ্মণদের আজ মেরে ফেলতে হবে। 
সেই সিংহনাদে ব্রাহ্মণরা প্রমাদ গণল। যুধিষ্ঠিরকে ডেকে তারা বলে –দেখ মনে হচ্ছে যেন শেষকাল উপস্থিত। বাঁধভাঙ্গা সমুদ্র যেন উথলাচ্ছে। চল সকল ব্রাহ্মণ-আমরা দ্রুত এখান থেকে চলে যাই। মরতে এই ব্রাহ্মণদের আমরা সঙ্গে আনলাম। নিজে তো মরবেই সঙ্গে অন্য দ্বিজ-ব্রাহ্মণদেরও দুঃখ দেবে। ক্ষত্রিয় রাজাদের সঙ্গে মিছে বিবাদ ঘটাল। দক্ষিণার অভিপ্রায় ত্যাগ করে এখন প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলে হয়। এখানে থাকলে মরতে হবে। ক্ষত্রিয়ের কাজ কখনও ব্রাক্ষণকে সাজে না। রাজকন্যা দেখে লোভে লক্ষ্যভেদ করে বসল। যাক্‌ সে সব কথা বলে আর লাভ নেই। দেখ ক্ষত্রিয়রা ‘দ্বিজ মার’ রব তুলে এগিয়ে আসছে। 
পালাও, পালাও বলে সব ব্রাহ্মণরা ডাকতে লাগল। 

মুনিরাও ঊর্দ্ধমুখে পালাল। বিশসহস্র শিষ্য নিয়ে মার্কন্ড মুনি, পঞ্চাশজন শিষ্য নিয়ে কৌন্ডমুনি পালালেন। বাইশসহস্র শিষ্য নিয়ে ব্যাস পালালেন। পুলস্ত্যমুনিও পিছু নিলেন। ষাটশত শিষ্য নিয়ে পালালেন দুর্বাসা। পচিশসহস্র নিয়ে পরাশরমুনিও স্থান ত্যাগ করলেন। 
চারদিকে দৌড়াদৌড়ি শুরু হল। সব দেখে দ্বন্দ্ব প্রিয় ঋষি আনন্দিত হয়ে উল্লাসে করতালি দিয়ে নাচেন। ‘লাগ, লাগ’ বলে ডাক ছাড়ে আর ক্ষণে ক্ষণে রাজাদের গালি দিতে থাকে -ক্ষত্রকুলে তোমাদের জন্ম ব্যর্থ হল। একজন বামুন সকলকে পরাজিত করল। কন্যা নিয়ে সে যদি এই সভা ছেড়ে যায় তবে কোন লজ্জায় তোমরা মুখ দেখাবে! 
এই বলে ঊর্দ্ধবাহু নাচে ঋষিবর। 
তা শুনে রাজারা ক্ষিপ্ত হয়ে ব্রাহ্মণদের সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু করল। যদিও সকল ক্ষত্রের অস্ত্র ইন্দ্রপুত্র অর্জুন সহজেই কাটলেন। নিজের অস্ত্রে রাজাদের প্রহার করতে লাগলেন। কারো ধনুক কাটা গেল, কারোবা গুণ, কারো কাটে খড়্গ, তো কারো তূণ। কেউ সারথি হারায়, কেউ বা রথ, কারোবা শর, শেল, শূল, শক্তি সব নষ্ট হল। শেষ পর্যন্ত সকল রাজা নিরস্ত্র হল। দশ দশ বাণে সবাইকে বিদ্ধ করলেন অর্জুন। মুখে, বাহুতে, পায়ে বাণ খেয়ে কেউ মূর্ছা গেল, কেউ বা গড়াগড়ি খেতে লাগল। সকল সারথিরা ভয়ে রথের মুখ ঘুরিয়ে নিল। চারদিকে রাজারা যুদ্ধ ভঙ্গ দিয়ে পালাতে শুরু করল। 
পেছন ফিরে পার্থ কৃষ্ণাকে আশ্বাস দিতে থাকেন। 

তাই দেখে বীর কর্ণ খলখল করে হেসে বলে –কি কাজ করছ দ্বিজ, তোমার কি লজ্জা নেই! সভার মাঝে পরের নারীর সাথে সম্ভাষণ করছ! আগে কৃষ্ণাকে নিজের স্ত্রী কর, তারপর তাঁর সাথে কথা বলতে এসো। ভিক্ষুক হয়ে এ অদ্ভূত ইচ্ছা কি ভাবে হল যে রাজার কন্যাকে কামনা কর। 

পার্থ ঘুরে রাধার পুত্রকে বলেন –কর্ণ তুমি এখনও জীবিত! ওরে দুরাচার, ধন্য তোর প্রাণ! আমার বাণ খেয়েও বেঁচে আছিস। 

কর্ণ বলে -দ্বিজ বুঝে ভাষা প্রয়োগ কর। তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ জানি না। ব্রাহ্মণ বলেই তোমায় অনুরোধ করলাম। আমি রেগে গেলে কারো প্রাণে বাঁচা সম্ভব নয়। 

কর্ণের কথা শুনে পার্থ বলেন –আমি দ্বিজ একথা কে বলেছে। যুদ্ধ ভয় আছে বলেই তুমি এ অযুহাত দিচ্ছ। দুর্যোধনের ভাঁড়, তুমি বৃথা রাজ্য ভোগ কর। শাস্ত্রমতে ক্ষত্রনীতিতে বলে তাঁর সাথে যুদ্ধ করতে নেই যে রণে ভীত। আর সেখানেই বলেছে যুদ্ধে ব্রাহ্মণ গুরু একই সমান। তুমি দেখছি বড়ই ধার্মিক ও ব্রহ্মবধে ভীত। তাই একজনকে ঘিরে ধরেছিলে সকলে মিলে। এখন বল হারিয়ে অনুরোধ করতে এসেছ। কে তোমায় ক্রোধ শান্ত করতে বলেছে! যত শক্তি আছে প্রয়োগ কর, আমাকে ব্রাহ্মণ ভেবে ক্ষমা করতে চেয়ো না। 

অর্জুনের কথায় কর্ণ রাগে জ্বলতে থাকে। নানা ধরনের অস্ত্র বীর পার্থের উপর বর্ষণ করতে থাকে। এভাবে কর্ণ ও ধনঞ্জয়ের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ শুরু হল। 
বীর বৃকোদর ভীমও বৃক্ষ হাতে আসরে নেমে পরলেন। মার মার রবে চারদিকে অস্ত্র কাটতে থাকেন। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যেমন মেঘ ফেটে বৃষ্টি হয় তেমনি অস্ত্রবর্ষণ হতে থাকে। মুষল-মুদ্গর-শেল-শূল-শক্তি-জাঠ-গদা-চক্র-পরশু-ভুশুন্ডি কোটি কোটি পরতে লাগল। চতুর্দিকে মার মার রব ওঠে, ঝাঁকে ঝাঁকে বৃষ্টির মত অস্ত্র ফেলতে থাকে। বীর বৃকোদর শরজালে ঢেকে গেলেন। কুয়াসা যেমন ভাবে পর্বতকে আচ্ছাদিত করে। 
বায়ুনন্দন ভীমের বায়ু পরাক্রম। এমন অজাযুদ্ধ(যাতে প্রকৃত যুদ্ধ অপেক্ষা আস্ফালনই বেশি) দেখে তিনি বাঘের মত ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি প্রকৃত সংগ্রামে আনন্দ পান তাই এসব অস্ত্র প্রহারে একটুও তার শ্রম হল না। সংগ্রাম, আহার ও রমণী-রমণে তিনি সহজে ঠাঁই নারা হন না। ঘি পরলে যেমন আগুনে তেজ বাড়ে তেমনি যত অস্ত্র পড়তে থাকে ভীমের ক্রোধ ততই উথলে ওঠে। জন্তুদের সামনে তিনি কালরূপে উপস্থিত হলেন। গর্জন করতে করতে বৃক্ষ ঘুরিয়ে তিনি সব অস্ত্র নিবারণ করে বৃক্ষ দিয়ে আথালিপাথালি মারতে থাকেন। রথ, রথী, অশ্ব, হাতি, ধ্বজ সব চূর্ণ হতে থাকে। ডানে-বামে-আগে-পিছের বহু সৈন্য তাঁর গাছে নিপাতিল। তারপর মুখ তুলে বৃকোদর যেদিকে চান সেদিকের সৈন্য প্রাণ ভয়ে পালায়। সিন্ধুজলের মাঝে যেন তিনি মন্দর পর্বত। মত্ত হস্তিবর যেন পদ্মবন ভাঙ্গে। মৃগেন্দ্র(সিংহ) বিহার করছেন যেন গজেন্দ্রমন্ডলে। দানবের মধ্যে যেন দেব আখন্ডল(ইন্দ্র)। দন্ড হাতে যম, যেন বজ্র হাতে ইন্দ্র। সব রাজাদের তিনি তাড়িয়ে নিয়ে যান। বাঘ যেন ছাগলের পালকে খেদিয়ে নিয়ে যায়। সকল রাজা ভয়ে পালাল। 
বিংশ অক্ষৌহিনীপতি(১০৯৩৫০পদাতিক, ৬৫৬১০অশ্ব, ২১৮৭০হস্তী, ২১৮৭০রথ- মোট ২১৮৭০০ চতুরঙ্গ সেনাবিশিষ্ট বাহিনী) জরাসন্ধ পালাল, একাদশ অক্ষৌহিনীপতি দুর্যোধন, সপ্ত অক্ষৌহিনীপতি বিরাটরাজা, পঞ্চ অক্ষৌহিনীপতি শিশুপাল, নব অক্ষৌহিনীপতি কলিঙ্গরাজ, বিন্দ-অনুবিন্দ চার অক্ষৌহিনীপতি সবাই পালাল। কোথায় গেল রথ, গজ, তুরঙ্গ, পদাতি-সকলে যে যার প্রাণ নিয়ে একাই পালাতে লাগল। ‘আসছে, আসছে’ বলে সকলে পিছনে আর না তাকিয়ে দৌড়ায়। মাথা থেকে মুকুট, হাত থেকে ধনুক খসে পরে। কেউ আর সাহস করে সে সব তুলতে যায় না। উর্দ্ধশ্বাসে সব পালায় আর পিছনে ভীমসেন ‘মার, মার’ বলে ডাক দেন। 

 
সব দেখে মদ্ররাজ গর্জে ওঠে। নানা অস্ত্রে ভীমকে প্রহার করতে থাকে। রেগে ভীম বৃক্ষ দিয়ে প্রহার করে তাঁর রথ চূর্ণ করেন। লাফ দিয়ে শল্য মাটিতে পরে। হয়(ঘোড়া), রথ চূর্ণ হতে গদা হাতে শল্য ও বৃক্ষ হাতে ভীমের অসীম যুদ্ধ হল। সকলে লুকিয়ে লুকিয়ে কৌতুক দেখতে লাগল। গোল করে দু’জনে দুজনকে ঘুরতে থাকে। শেষে পর্বতের উপর যেন পর্বত পরল। সকলে অবাক হয়ে দেখতে লাগল। পর্বতে বজ্রাঘাত হলে যেমন শব্দ হয় তেমনি দুজনের শব্দে চারদিক পূর্ণ হল। মত্ত হাতির মত তারা লড়তে লাগল। মনে হল মত্ত ষাঁড় যেন প্রলয়ের মেঘের মত গর্জন করছে। তাদের ঘনঘন হুঙ্কারে সকলে কাঁপতে লাগল। তারা পরস্পরকে দেখে দাঁত কড়মড়ি করতে লাগল। তাদের চরণের দর্পে ভূমিকম্প হতে লাগল। এভাবে অনেক্ষণ যুদ্ধ হতে থাকল। শেষে ভীম রাগে ঠোঁট কামড়ে শল্যের হাতে বৃক্ষের প্রহার করলেন। গুরুতর আঘাতে গদা খসে পরল। নিরস্ত্র শল্যের আর কিছু রইল না। লাফ দিয়ে পবনকুমার ভীম তাকে ধরে ফেললেন। শল্যের পা ধরে তাকে শূন্যে ঘোরাতে লাগলেন। 
তা দেখে ব্রাহ্মণমন্ডলী হাসতে লাগল। তারা টিটকারি দিয়ে, করতালি দিয়ে নাচতে নাচতে বলে -আরে দুষ্ট ক্ষত্রগণ যে কাজ করলে তাঁর উচিত ফলও হাতেনাতে পেলে। তবে এই মদ্রপতি সর্বদা ব্রাহ্মণদের সেবা করেছে, সে কারণে একে মারা উচিত নয়। 
শল্য প্রায় জ্ঞান হারাতে বসেছিল। আর দু-তিন পাকে প্রাণ বেরিয়ে যেত। ভীম ব্রাহ্মণদের অনুরোধে এবং সম্পর্কে তাঁর মামা হওয়ায় শল্যকে ছেড়ে দিলেন। 
দেখে রাজারা অবাক হল। বাহুযুদ্ধে শল্যকে কেউ পরাজিত করতে পারত না-এক হলধর বলরাম এবং বীর বৃকোদর ভীম ছাড়া। 

মহাভারতের কথা সুধা সিন্ধুর মত, কাশীদাস কহেন সাধু শুনেন অবিরত। 
................................... 

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers