Blog Archive

Sunday, February 14, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২৪

[পূর্বকথা - অগ্নির হাত থেকে রক্ষা করায় কৃতজ্ঞ ময়দানব কৃষ্ণের আদেশে ত্রিলোক বিখ্যাত দিব্য মণিময় সভা নির্মাণ করলেন ইন্দ্রপ্রস্থে... একদিন নারদমুনি সভায় উপস্থিত হলেন এবং নানা উপদেশ দিলেন.....]


নারদ কর্ত্তৃক লোকপালগণের সভা-বর্ণনাঃ 

নারদ বলেন –হে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির শুনুন আপনাকে প্রথমে ইন্দ্রের সভার বর্ণনা দিই। 
দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে দিয়ে দেবরাজ তার সভা নির্মাণ করান। সে বিচিত্র সভা যেন কোটি চন্দ্রের প্রভায় আলোকিত। দেবঋষি, ব্রহ্মঋষি ও ধার্মিকরা সে সভায় বসেন। সে সভা উচ্চতায় পঞ্চ যোজনের(চারক্রোশ পরিমাণ দৈর্ঘ্য) অধিক, শত যোজন দীর্ঘ বিস্তার। 


শচীদেবী ও ইন্দ্র

শচীদেবীকে নিয়ে ইন্দ্র সদা এই সভায় বিহার করেন। সে সভা শূন্যপথে থাকতে পারে এবং ইচ্ছানুসারে যেথায় খুশি যেতে পারে। সেখানে জরা, শোক, ভয়ের স্থান নেই। সকলে সর্বদা আনন্দে থাকেন। 

ইন্দের এই আশ্রমে সকল দেবতাদের অবস্থান। মরুৎ(বায়ুদেবতা), কুবের প্রমুখ সিদ্ধপুরুষরা অম্লান-কুসুম বস্ত্রে ও বিবিধ ভূষণে সজ্জিত হয়ে অবস্থান করেন। 
এছাড়া অষ্টবসু, নবগ্রহ, ধর্ম, কাম, অর্থ, তড়িৎ, বিদ্যুৎ, সপ্তবিংশ কৃষ্ণবর্ত্ম(অগ্নি), যজ্ঞ, মন্ত্র, দক্ষিণা সব যেন মূর্তিমন্ত হয়ে আছেন। সেই পুণ্যজনের অনন্ত কথা লিখে শেষ করা যায় না। সেখানে তেত্রিশকোটি দেবতা পুরন্দর-ইন্দ্রের সেবা করছেন। এসভার গুণ বর্ণনাতীত। 
রাজা হরিশচন্দ্রও এই সভা অলঙ্কৃত করছেন। 


যমরাজ

এবার আপনাকে যমরাজের সভার কথা বলি, শুনুন জৈষ্ঠ্য পান্ডব! 
যমরাজের সভা দৈর্ঘে-প্রস্থে শত শত যোজন বিস্তৃত। আদিত্য-সূর্যের সমান সে সভার প্রভা। সে সভা না শীতল, না তপ্ত। সেখানে দুঃখের স্থান নেই। চারদিক প্রেমময়। হিংসার স্থান নেই, সব স্থানে সুখ অবস্থান করে। 
সব কথা এত অল্প সময়ে বলে শেষ করতে পারবো না, কিছু কিছু বলছি, শুনুন। 

যযাতি, নহুষ, পুরু, ভরত, কৃতবীর্য্য, কার্ত্তবীর্য্য, সুনীথ, সুরথ, শিবি, মৎস্য, বৃহদ্রথ, নল, বহীনর, শ্রতশ্রবা, পৃথুলাশ্ব, দিবোদাস, অম্বরীষ, রঘু, প্রতর্দ্দন, পৃষদশ্ব, সদশ্ব, মরুত্ত, বসুমন, শরভ, সৃঞ্জয়, বেণ, ঐন, উশীনর, পুরু, কুৎস, প্রদ্যুম্ন, বাহ্লীক রাজা, শশবিন্দু, কক্ষসেন, সগর, কেকয়, জনক, ত্রিগর্ত, বার্ত্ত, জয়, জন্মেজয়, অজ, ভগীরথ, দিলীপ, লক্ষ্মণ, রাম, ভীমজানু, পৃথু, পৃথুবেগ, করন্দম প্রমুখ রাজারা তো আছেনই, এমনকি ধৃতরাষ্ট্রের মত শতজন, ভীষ্মের মত দুইশত, ভীমের মত শত ও কৃষ্ণার্জুনের মত শত শত জন এখানে আছেন। প্রতীপ, শান্তনু ও তোমাদের পিতা পান্ডুও এখানে থাকেন। 
অশ্বমেধ যজ্ঞের মত বহু যজ্ঞ ফলের দান এখানেই থাকে। 


এবার বরুণদেবের(জলদেবতা) সভার কথা বলি। সেও এক অপূর্ব সভা। এটিও বিশ্বকর্মার নির্মাণ। 
জলের মধ্যে এই সভার নাম পুষ্করমালী। এই সভা শত শত যোজন বিস্তৃত। নানা রত্নে এই সভাকে সজ্জিত করা হয়েছে। বরুণদেব সেখানে স্ত্রী বারুণীর সাথে পুত্র, পৌত্র, পাত্র, মিত্র, পুরোহিতসহ অবস্থান করেন। 


বিশ্বকর্মা

দ্বাদশ আদিত্য(বিবস্বান্‌, অর্যমা, পূষা, ত্বষ্টা, সবিতা, ভগ, ধাতা, বিধাতা, বরুণ, মিত্র, শক্র ও উরুক্রম) ও সকল নাগ এখানে অবস্থান করেন। বাসুকি, তক্ষক, কর্কোটক, ঐরাবত, সংহ্লাদ, প্রহ্লাদ, বলি, নমুচি দানব, বিপ্রচিত্তি, কালকেয়, দুর্মুখ শরভ(পৌরাণিক অষ্টপদ ও সিংহাপেক্ষা বলবান মৃগবিশেষ), এছাড়া মূর্তিমন্ত চার সিন্ধু(সাগর), এবং আরো নদীরা-যেমন জাহ্নবী(গঙ্গা), যমুনা, সিন্ধু, সরস্বতী, শোণ, চন্দ্রভাগা, বিপাশা, বিতস্তা, ইরাবতী, শতদ্রু, সরযূ, চর্মণ্বতী, কিম্পুনা, বিদিশা, কৃষ্ণবেণ্বা, গোদাবরী, নর্মদা, বিশল্যা, বেণ্বা, লাঙ্গলী, কাবেরী, দেবনদী মহানদী, ভারবী, ভৈরবী, ক্ষীরবতী, দুগ্ধবতী, লোহিতা, সুরভি, করতোয়া, গান্ডকী, আত্রেয়ী, শ্রীগোমতী, ঝুম্‌ঝুমি, স্বর্ণরেখা নদী, পদ্মাবতী প্রমুখ এবং বিভিন্ন তড়াগ(দীঘি) ও পুষ্করিণ্যাদিরা মূর্তিমতী হয়ে সকলে বরুণদেবের সেবা করেন। 
এছাড়া চারি মেঘ(জলধর, জীমূত, বারিদ, নীরদ) সেখানে পরিবার সহ অবস্থান করেন। 


কুবের 

এবার কুবেরের সভার কথা বলি, শুনুন। কৈলাস-শিখরে এই সভাও বিশ্বকর্মার অপূর্ব নির্মাণ। শতেক যোজন দীর্ঘ, সত্তর যোজন বিস্তৃত। সেখানে গুহ্যক(কুবের অনুচর) যক্ষ, কিন্নর, কিন্নরী, চিত্রসেনা, রম্ভা, ইরা, ঘৃতাচী, মেনকা, চারুনেত্রা, উর্বশী, বুদ্বুদা, চিত্ররেখা, মিশ্রকেশী, অলম্বুষা প্রমুখ সুন্দরী মহাদেবীরা নৃত্যগীত করে সর্বদা কুবেরের সেবা করেন। 

পুত্র নলকুবর ও অন্য মন্ত্রীরা মণিভদ্র, শ্বেতভদ্র, ভদ্র, সুলোচন, গন্ধর্ব, কিন্নর, যক্ষরা, লক্ষ লক্ষ প্রেত, ভূত, পিশাচ, রাক্ষস, দিব্যরক্ষ, ফলকক্ষ, ফলোদক, তুম্বুরু প্রভৃতি, হাহা, হূহূ, বিশ্বাবসু, চিত্রসেন, কৃতী, চিত্ররথ, মহেন্দ্র, মাতঙ্গ বিদ্যাধর, বিভীষণ ও তার ভাইরা, এছাড়া সকল পর্বতরা মূর্তিমান হয়ে এখানে থাকেন-হিমাদ্রি, মৈনাক, গন্ধমাদন, মলয়া, এমনকি আমি ও আমার মত আরো অনেকে এখানে থাকেন। 
উমা সহ সদানন্দ শিব তাঁর নন্দী, ভৃঙ্গী, গণপতি/গণেশ, কার্ত্তিক, বৃষভ, পিশাচ, খেচর, শিবাগণ সকলকে নিয়ে সেখানে সুখে বাস করেন।


ব্রহ্মা

এবার আমি ব্রহ্মার সভার বর্ণনা করি। পূর্বে দেবযুগে দিবাকর-সূর্য মনুষ্যদেহ ধারণ করে মনুষ্যলোকে ভ্রমণ করছিলেন। পথে আমার সাথে দেখা হলে তিনি দিব্যচক্ষে আমার পরিচয় জানতে পেরে আলাপ করেন ও ব্রহ্মার সভার গুণ বর্ণনা করেন। শুনে আমার সে সভা দেখার ইচ্ছে হল। আমি তাঁকে অনুরোধ করি কিভাবে ব্রহ্মার সভায় উপস্থিত হওয়া যায় তা জানানোর জন্য। তিনি আমায় হিমালয়ে সহস্র বছর ব্রহ্মার উদ্দেশ্যে কঠোর তপস্যা করতে বলেন। আমি সেই তপস্যা শুরু করি। সহস্র বছর পর সেই দেব দিবাকর এসে আমায় ব্রহ্মপুরী নিয়ে যান। সেখানের যা অপূর্ব রূপ দেখলাম, বলে বোঝাতে পারব না। সে সভার আদি-অন্ত নেই। 
ব্রহ্মা নিজে এই সভা নির্মাণ করেন। চন্দ্র-সূর্যের প্রভায় সে সভা সর্বদা আলোকিত হয়। শূন্যে সে সভা শোভা পাচ্ছে। 

সেই সভায় বসে বিধাতা ব্রহ্মা বিধির বিধান দেন। সকল প্রজাপতিরা তাকে ঘিরে থাকেন। প্রচেতা, মরীচি, দক্ষ, পুলহ, গৌতম, অঙ্গিরা, বলিষ্ঠ ভৃগু, সনক, কর্দম, কশ্যপ, বশিষ্ঠ, ক্রতু, পুলস্ত্য, প্রহ্লাদ, বালখিল্য, অগস্ত্য, মান্ডব্য, ভরদ্বাজ প্রমুখ এই সভা উজ্জ্বল করেন। 
এছাড়া শরীরী ও অশরীরী পিতৃগণ সেখানে ব্রহ্মার উপাসনা করেন। 
গন্ধর্বরাও সেখানে আছেন। এমনকি আয়ুর্বেদ, চন্দ্র, তারা, সূর্য, সন্ধ্যা, ছায়া, ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ, কান্তি, শান্তি, ক্ষমা, অষ্টবসু, নবগ্রহ, শিব সহ উমা সকলেই সেথায় যান। 
চতুর্বেদ, ষটশাস্ত্র, তন্ত্র, স্মৃতি, শ্রুতি, চারযুগ, বর্ষ, মাস, দিবা সহ রাত যেমন আছেন। তেমনি সাবিত্রী, ভারতী, লক্ষ্মী, অদিতি, বিন্তা, ভদ্রা, ষষ্ঠী, অরুন্ধতী, নাগমাতা কদ্রু প্রমুখ মহান নারীরাও এখানে ব্রহ্মার উপাসনা করেন। 
মূর্তিমন্ত হয়ে নারায়ণ এখানে আছেন। ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ, হুতাশন-অগ্নি আরো কত বলি! সবাই এখানে অবস্থান করেন। 
নিত্য এসে সকলে সৃষ্টির অধিকারী ব্রহ্মার সেবা করেন। 

এই দুই নয়নে আমি অনেক সভা দেখলাম কিন্তু ব্রহ্মার সভার মত নয়নাভিরাম আর কখনও দেখিনি। মনুষ্যলোকেও নয়। 

যুধিষ্ঠির বলেন –হে দেব! আপনার প্রসাদে আমি এমন সুন্দর সভার বর্ণনা শুনতে পেলাম। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। তবে একটি কথা ভেবে বিস্মিত হচ্ছি। 
যত নৃপতিরা পৃথিবীতে শাসন করেছেন সকলে যমের ভবনে আছেন। কেবল রাজা হরিশচন্দ্র কিভাবে ইন্দ্রের সভা আলো করলেন! তিনি কোন পুণ্যবলে এমন সম্মান পেলেন! 
আমার পিতা পান্ডুকে যমালয়ে আপনি দেখেছেন। তিনি কি আমার জন্য কোন বার্তা প্রেরণ করেছেন! 


রাজা হরিশচন্দ্র

নারদ বলেন –হে যুধিষ্ঠির, সূর্যবংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি হরিশচন্দ্রের আখ্যান শুনুন। এক রথে তিনি সমগ্র মর্তপুরী জয় করেন। বাহুবলে তিনি সপ্তদ্বীপের অধিপতি হন। ইনিই আবার রাজসূয় যজ্ঞ করেন। অনেক ব্রাহ্মণ সে যজ্ঞে আমন্ত্রিত হন। রাজা প্রতি জনের সেবা করেন। শাস্ত্রমতে যিনি যে দক্ষিণা প্রার্থনা করেছেন তার পাঁচগুণ রাজা তাদের দান করেন। সকল রাজার থেকে তিনি অধিক দানধ্যান করে এই স্বর্গস্থানের ফল লাভ করেন। 
যে রাজারা রাজসূয় যজ্ঞ করেন, যারা পলায়ন না করে সংগ্রামে নিহত হন এবং যারা তীব্র তপস্যায় দেহ ত্যাগ করেন, তারাই ইন্দ্র সভায় নিত্য বিরাজ করেন। 
তোমার পিতা পান্ডুর সাথে আমার যমালয়ে দেখা হয়। তিনি আমায় বিনয়ের সাথে বলেন –ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আমার সন্তান। তার বীর্যবন্ত ভাইরা তার অনুগত। কমললোচন কৃষ্ণ তার সুহৃদ। পৃথিবীতে তার অসাধ্য নেই। পুত্র অনায়াসে রাজসূয় যজ্ঞ করতে পারে। এই রাজসূয় যজ্ঞ যদি সফল হয় তবে আমিও রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান পাবো। 

হে যুধিষ্ঠির পান্ডু মহারাজ আমার মাধ্যমে আপনাকে একথা বলে পাঠালেন, এবার আপনি ভেবে দেখুন কি করবেন। সব যজ্ঞের শ্রেষ্ঠ এই রাজসূয় যজ্ঞ। তবে এই যজ্ঞে বহু বিঘ্ন ঘটে। সামান্য ছিদ্র পেলেই যক্ষ রক্ষ সকলে যজ্ঞ পন্ড করে। এই যজ্ঞের কারণে রাজারা যুদ্ধ করে। এখন আপনি দেখুন যা ভাল বোঝেন, করুন। আমায় এবার বিদায় দিন আমি দ্বারাবতী যাব। 

এই বলে নারদ অন্য মুনিদের নিয়ে দ্বারকায় চললেন কৃষ্ণ দর্শনে। 

সভাপর্বের এই অনুপম বর্ণনা করেন কাশীরাম দাস এবং তা শ্রবণ করেন সকল সাধু জন। 
......................................


পাদটীকাঃ

দশটি দিক/কোণের রক্ষকঃ-

ইন্দ্র- পূর্ব দিকের রক্ষক [বৃষ্টির দেবতা, মিষ্টি জলের উৎস]
বরুণ- পশ্চিম দিকের রক্ষক [সমুদ্রের দেবতা, নোনতা জলের উৎস]
যম- দক্ষিণ দিকের রক্ষক [মৃত্যুর দেবতা, শেষ বা নাশ]
কুবের- উত্তর দিকের রক্ষক [ধন সম্পদের দেবতা, উন্নতি]

এছাড়া, 
উত্তর-পূর্ব দিকের/ ঈশাণ কোণের রক্ষক -শিব
উত্তর-পশ্চিম দিকের রক্ষক - পবন/বায়ু দেবতা
দক্ষিণ-পূর্ব দিকের রক্ষক - অগ্নি
দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের রক্ষক - নৈঋত

উপর দিকের রক্ষক - ব্রহ্মা
নিচের দিকে রক্ষক - বিষ্ণু [বিষ্ণু আমাদের পালন কর্তা, তিনি উত্তর-পূর্ব দিকে মাথা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে পা করে অবস্থান করেন]

.....................................

Sunday, February 7, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২৩

[পূর্বকথা - সভাপর্বঃ....অগ্নির হাত থেকে রক্ষা করায় কৃতজ্ঞ ময়দানব কৃষ্ণের আদেশে ত্রিলোক বিখ্যাত দিব্য মণিময় সভা নির্মাণ করলেন ইন্দ্রপ্রস্থে........]



যুধিষ্ঠিরের সভায় নারদের আগমন ও জিজ্ঞাসাচ্ছলে বিবিধ উপদেশ প্রদানঃ 

মুনি বৈশ্বম্পায়ন বলেন –হে রাজন শ্রী জন্মেজয় এভাবে পাণ্ডবরা মহাসুখে রাজ্যশাসন করছিলেন। 

একদিন হঠাৎ শ্রী নারদমুনি উপস্থিত হলেন। তাঁর সর্বত্র গমনের অধিকার। ইনি ধ্যান ও জ্ঞানের অধিকারী, অমর দেবতা ও অসুরদেরও পূজ্য। এনার জিহ্বাগ্রে চতুর্বেদ বসেন।

ব্রহ্মার অঙ্গে এঁনার জন্ম এবং সকল ব্রহ্ম কর্মের ইনি বিজ্ঞ। সমগ্র ব্রহ্মান্ড ইনি অনায়াসে ভ্রমণ করেন। ইনি পরম সত্যের অনুবর্তী। 

কলহযুদ্ধে বিজ্ঞ তাই কলহ লাগিয়ে বড়ই প্রীত হন। 

এঁনার মাথায় পিঙ্গল(রক্তবর্ণ) জটা, ললাটে পিঙ্গল ফোঁটা, কর্ণে সিত(সাদা) কুণ্ডল। হাতে বীণা নিয়ে সর্বক্ষণ হরিনাম জপেন। জল ভরা মেঘের মত তাঁর আঁখি। পুলকে কদম্ব পুষ্পের মত অঙ্গ। শরদিন্দু(শরতের চাঁদ) মুখাম্বুজ(অম্বুজ-পদ্ম), আজানুলম্বিত(হাঁটু পর্যন্ত প্রসারিত) ভুজ(হাত), প্রজ্বলিত অনলের(আগুন) দীপ্তি সারা দেহে। পরিধানে কৃষ্ণাজিন(কৃষ্ণসার মৃগের চামড়া)। 

সঙ্গে আরো মুনিদের নিয়ে তিনি পাণ্ডবদের কাছে এলেন। নারদ মুনিকে দেখে সভার সকলে সম্ভ্রমের উঠে দাঁড়াল। শশব্যস্ত হয়ে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির ও তাঁর ভাইরা এগিয়ে এসে মুনিকে প্রণাম করেন। 

যুধিষ্ঠির সুগন্ধি উদক(জল) দিয়ে মুনির পা ধুয়ে তাকে সিংহাসনে বসালেন এবং ভক্তিভরে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে পূজা করলেন।

তখন নারদ স্নেহ স্বরে বলেন – হে রাজন, বলুন কেমন আছেন! আপনার কুলের কৌলীন্য/কুলাচার, ধন উপার্জন কর্ম নির্বিঘ্নে হচ্ছে তো! সাদু, বিজ্ঞ ও অনুরক্ত মন্ত্রীদের কিভাবে পালন করেন। বহু মানুষের সাথে কক্ষনো একসাথে মন্ত্রণা করবেন না। 
যে কোন কার্য্যক্ষেত্রে মুখ্যলোককেই নিয়োগ করবেন। 
রাজ্যে ভক্ষ্য দ্রব্য সামগ্রী ন্যায্যমূল্যে বিক্রি হয় কিনা লক্ষ্য রাখবেন। 
কখনও প্রাপ্যের দক্ষিণা বাকি রাখা উচিত না। 
রাজ্যে বিজ্ঞজন, যোগ্য পুরুষরা, পুরোহিত, দৈবজ্ঞ, জ্যোতিষবিদ, বৈদ্য, চিকিৎসক যথেষ্ঠ আছেন তো! 
অনাথ, অতিথি, ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণদের সর্বদা অন্নদান করবেন। 
রাজ্যের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপযুক্ত সম্মান পাচ্ছেন কিনা দেখবেন। তারা সর্বদা যেন আপনার অনুগত থাকেন! 
ধন, ধান্য, উদক, আয়ুধে(অস্ত্র) ভান্ডার পূর্ণ রাখবেন। 
প্রাতকালে নিদ্রাবশ, বিকালে ক্রীড়ারস, আলস্য নিবারণ করেন তো! 
ধর্ম কর্মে ধন ব্যয় করবেন, নিত্য উপচয়(শ্রীবৃদ্ধি) করবেন। 
আশাকরি প্রজাদের পুত্রের সমান পালন করেন। 

এভাবে ব্রহ্মাপুত্র নারদ বিভিন্ন বিষয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে সংবাদ নিলেন ও উপদেশ দিলেন। 
সব শুনে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বিনয়ের সাথে মুনিকে প্রণাম করে বলেন –যা কিছু আপনি বললেন আমি সবই যথাসাধ্য পূর্বজ্ঞান মত করার চেষ্টা করি। এখন আপনার কাছ থেকে আরো জ্ঞান আহোরণের আশা করছি। এবং তা সঠিকভাবে পালনের চেষ্টা করব। 
হে তপোধন, আপনার কাছে আমার কিছু নিবেদন আছে। চরাচরের সব কিছু আপনার গোচর। আপনিই বলুন এই সভার মত মনোহর অনুরূপ আর কি দেখেছেন ব্রহ্মাণ্ডে! 

যুধিষ্ঠিরের কথায় নারদমুনি হেসে বলেন – আপনার সভার মত সভা মনুষ্যলোকে আর দেখি নি। তবে ব্রহ্মার সভা-সে বিচিত্র যেন কৈলাসের প্রভা। এছাড়া ইন্দ্র, যম, বরুণের পুরীও আমি দেখেছি। সে সব স্থানের অদ্ভূত কথা আপনাকে বলবো ধর্মরাজ। 

যুধিষ্ঠির সবিনয়ে বলেন –সে সব সভার কথা বলুন, শুনি। 

দিব্যসভাপর্ব কথা, বিচিত্র মহাভারত গাঁথা, শুনলে অধর্ম নাশ হয়। 

গোবিন্দের চরণে সর্বদা অনুক্ষণ মন সমর্পণ করে কাশীরাম দাস এই অপূর্ব কথা রচনা করলেন।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers