Blog Archive

Sunday, December 27, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৭

[পূর্বকথা - কৃষ্ণের কথা মত অর্জুন সরস্বতীর তীর থেকে সুভদ্রাকে হরণ করলেন.. এ সংবাদ বলরাম শুনে কৃষ্ণের উপর অভিমান করতে লাগলেন... কৃষ্ণ এসে দাদাকে বোঝালেন সুভদ্রা অর্জুনকেই স্বামী হিসেবে চান..... বলরাম অর্জুনের কাছে বিবাহ প্রস্তাব পাঠালেন ...পার্থের সাথে সুভদ্রার বিবাহ হল .......দুর্যোধন অভিমানে স্বদেশ যাত্রা করল.....] 



খান্ডব-বন দহনঃ 

কিছুদিন পর এক গ্রীষ্মকালে পার্থ ও নারায়ণ যমুনায় বিহার করতে গেলেন। 
রুক্মিণী, সুভদ্রা সহ পরিবারের বহু সদস্যকে নিয়ে যমুনা কূলে সুন্দর ঘর করে বাস করেন। আনন্দে তারা পানাহার করে, ক্রীড়া করে দিন কাটান। 

একদিন ক্রীড়ান্তে দুজনে বসে বিশ্রাম করছিলেন, সে সময় সেখানে হুতাশন অগ্নি এক ব্রাহ্মণের বেশে প্রবেশ করলেন। মাথায় তাঁর ত্রিজটা, নয়ন তাঁর পিঙ্গল রক্তবর্ণ। আগুনের মত উত্তপ্ত শরীর। 
কৃষ্ণার্জুনের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের আশীর্বাদ করে অগ্নিদেব বলেন –হে কৃষ্ণ আপনি যদুকুলের শ্রেষ্ঠ, হে পার্থ আপনি কুরুকুলসার। ত্রিভুবনে আপনাদের সমান আর কাউকে দেখিনা। আপনারা দুজনে মিলে আমার ইচ্ছে পূরণ করুন। আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ আমায় ভোজন করান। 

পার্থ হেসে বলেন –হে পণ্ডিত! কোন ভক্ষ পেলে আপনি তৃপ্ত হবেন বলুন। আপনি যা চাইবেন এখনই তা এনে দিচ্ছি। 

আশ্বাস পেয়ে অগ্নি বলেন –আমি আমার পরিচয় দিচ্ছি শুনুন। আমি অগ্নি। বহুকাল ব্যাধিতে ভুগেছি, অরুচি হয়েছে। আমায় ব্যাধি মুক্ত করুন। 
কাছেই খান্ডব বন আছে। সেটি সকল জীবের আলয়। সেই বন ভক্ষণের জন্য দিন, ধনঞ্জয়! সেখানে সুরাসুর, যক্ষ, রক্ষ, পশু, পাখি যত আছে সব আমায় ভোজন করতে দিন। 

এত শুনে রাজা জন্মেজয় বিস্মিত হয়ে বৈশম্পায়ন মুনিকে জিজ্ঞেস করেন –হে মুনিরাজ, আমার বিস্ময় খন্ডন করুন। 
সে স্থানে ব্যাধিযুক্ত হুতাশন অগ্নি কেন এলেন! কিসের জন্য তিনি খান্ডব দাহন করতে চাইলেন। 

মুনি বলেন –শুনুন নৃপ, পূর্বের কাহিনী। 
সত্যযুগে শ্বেতকি নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি যজ্ঞ ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। নিরন্তর ব্রাহ্মণদের নিয়ে যজ্ঞ করতেন। বহুকাল এভাবে রাজা যজ্ঞ করতে থাকলে দ্বিজরা আর সে কষ্ট সহ্য করতে পারল না। তারা যজ্ঞ ত্যাগ করে চলে যেতে চাইলো। 

রাজা জোড়হাতে বিনয়ের সাথে বলেন –মহর্ষিরা কেন আপনারা যজ্ঞ ছেড়ে যাচ্ছেন! আমি তো পতিত নই, কোন দোষও তো করি নি! 

দ্বিজরা বলে –আপনার কোন দোষ নেই, মহারাজ! কিন্তু এই অপ্রমিত যজ্ঞের কোন শেষ দেখছি না। আমরা আর অগ্নিতাপের ক্লেশ সহ্য করতে পারছি না। নয়ন আমাদের নিরস হয়েছে, অঙ্গ লোমহীন, শরীরের রক্ত শুকুয়ে যাচ্ছে এই অগ্নির সংস্পর্শে। 

দ্বিজদের কথা শুনে রাজা তাদের নানা ভাবে তুষ্ট করে পুনরায় যজ্ঞে আহ্বান জানাতে লাগলেন। 

দ্বিজরা বলে –রাজা, আমাদের অকারণে স্তুতি করছেন, আমাদের দ্বারা আর এ কাজ সম্ভব নয়। এই যজ্ঞ করেন এমন ব্রাহ্মণও দেখছি না। ত্রিদশ(অমর)-ঈশ্বর শিবের সেবা করুন। তিনি ছাড়া আর কারো এ যজ্ঞ করা সম্ভব নয়। 

দ্বিজদের কথা মত রাজা অনেক কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। তাঁর তপস্যায় শিব সন্তুষ্ট হয়ে বর প্রার্থনা করতে বললেন। 

রাজা বলেন –কৃপা যখন করলেন, মহাদেব! তবে শুনুন। আমার যজ্ঞ করে এমন ব্রাহ্মণ নেই। আপনি আমার যজ্ঞের পুরোহিত হন। 

শিব হেসে বলেন –যজ্ঞ করা আমার কাজ নয়, ব্রাহ্মণের কাজ। যজ্ঞফল যা চাও তাই পাবে, প্রার্থনা কর। 

রাজা বিনয়ের সাথে বলেন –যজ্ঞ না করেই তার ফল ভোগ করা সুশোভন নয়। হে ত্রিলোচন! যজ্ঞের উপায় বার করে দিন।

শিব বলেন –তোমার যজ্ঞে এত মন! আমার অংশে জন্মেছেন দুর্বাসা মুনি। তাকে দিয়ে এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ কর। 
পূর্বে যজ্ঞের সামগ্রী সব সংগ্রহ করবে। দুর্বাসার যোগ্য যজ্ঞ বিধান মত করবে। দুর্বাসার মান যেন রক্ষা পায়, লক্ষ্য রেখ। 

শিবের আজ্ঞা পেয়ে রাজা নিজ রাজ্যে গিয়ে যজ্ঞের সামগ্রী সংগ্রহে নিযুক্ত হলেন। বারো বছর ধরে সব সামগ্রী সংগ্রহ করে শিবকে জানালেন। শিব তখন দুর্বাসা মুনিকে এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিলেন। 

শিবের আজ্ঞা পেয়ে দুর্বাসা মুনির মনে রাজার উপর ক্রোধ হল। তিনি ঠিক করলেন রাজার কোন ছিদ্র বার করে তাকে শাপ দেবেন। 

দুর্বাসা মনে মনে ভাবেন –শ্বেতকি রাজনের এত অহংকার যে আমায় যজ্ঞের জন্য আবাহন করল! 

মনে ক্রোধ নিয়ে মুনি যজ্ঞ করতে গেলেন। সঙ্গে দণ্ডধর(যম)ও গেলেন। 
মহাতপোধন দুর্বাসা মুনি সাঙ্ঘাতিক যজ্ঞ শুরু করলেন। মুনি যখন যা চান সঙ্গে সঙ্গে রাজাও তাই যোগাতে থাকেন। শ্বেতকি রাজার যজ্ঞের কথা সংসারে ছড়াতে থাকে। 
দুর্বাসা মুনি মুষলধারে যজ্ঞে আহুতি দিতে লাগলেন। বার বছর ধরে অবিরাম সে যজ্ঞ চলতে থাকে। ত্রিলোকে সকলে এই যজ্ঞের কথা শুনে চমৎকৃত হল। 

সেই যজ্ঞের হবিষ্যি খেয়ে খেয়ে অগ্নির অরুচি হল। ব্যাধিযুক্ত দেহে অগ্নি দুর্বল হলেন। অগ্নিদেব তখন ব্রহ্মার সদনে গিয়ে তাকে তাঁর দুঃখের কথা জানালেন। 

বিরিঞ্চি ব্রহ্মা বলেন –অতি লোভে আপনাকে এ দুঃখ পেতে হচ্ছে। বহু খাদ্য গ্রহণের ফলে আপনার এ ব্যাধি হয়েছে। তবে এ ব্যাধিরও ওসুধ আছে, হুতাশন। খান্ডববনে বহু জীব আছে। যদি আপনার পক্ষে বন দগ্ধ করা সম্ভব হয় তো তাই করে ব্যাধি মুক্ত হন। 

ব্রহ্মার কথা শুনে বেগে অগ্নি খান্ডব বনে চললেন। ক্রুদ্ধ অগ্নি সেখানে গিয়েই প্রচন্ড গর্জন করে জ্বলে উঠলেন। খান্ডববন বহু জীবের বাসস্থান, আগুন দেখে তারা বিস্মিত হল। কোটি কোটি মত্ত হস্তী তাদের হস্তিনীদের সাথে মিলে শুঁড়ে করে জল এনে সে আগুন নেভাল। বড় বড় সব ভয়ঙ্কর সাপরাও তাদের পঞ্চশত, সপ্ত-অষ্টাদশ ফণায় করে জল এনে আগুন নেভাল।

এভাবে যত জীব ছিল সবাই নিজেদের সাধ্যমত সাহায্য করল, মুখে করে জল এনে আগুন নেভালো। অগ্নি অনেক চেষ্টা করেও আর বন দহন করতে পারলেন না। 
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers