Blog Archive

Sunday, May 24, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৮৯

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হলেন .......পঞ্চপান্ডবরা গৃহে উপস্থিত হলে মা কুন্তী ঘরের ভিতর থেকে বললেন –যা এনেছ তা পাঁচভাই ভাগ করে নাও।...পরে ভুল বুঝে বিলাপ করতে থাকেন.....দ্রুপদরাজ যজ্ঞসেন যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীর শোকে অভিভূত...পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন তাকে প্রবোধ দেয়...রাজা দ্রুপদ পুরোহিত পাঠিয়ে পঞ্চপাণ্ডবদের আমন্ত্রণ জানান....যুধিষ্ঠির বলেন মায়ের বচনানুসারে দ্রৌপদীকে পাঁচভাই বিবাহ করতে চান....যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে...দ্রুপদরাজ যখন তার কন্যার বিবাহ নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত, সে সময় অন্তর্যামী সর্বজ্ঞ মুনিরা পান্ডবদের বিবাহের উদ্দেশ্যে সেখানে উপস্থিত হলেন........]

দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী হইবার কারণঃ



ব্যাস বলেন –মুনিগণ শুনুন, হে দ্রুপদ রাজা আপনিও পূর্বের ঘটে যাওয়া সকল কথা জানুন।
ত্রেতাযুগে(সত্য ও দ্বাপর যুগের মধ্যবর্তী যুগ) দ্রৌপদী দ্বিজকন্যা ছিলেন।
মনমত স্বামী লাভের আশায় তিনি শিবের কঠোর তপস্যা ও পূজা করছিলেন। মাটির লিঙ্গ তৈরী করে নানা পুষ্প-ঘৃত-মধু দিয়ে বাজনা বাজিয়ে পূজা করে অবশেষে প্রণাম করে ভূমিতে পরে গেলেন এবং ‘পতিং দেহি’ বলে পাঁচবার প্রার্থনা করলেন।
এভাবে বহুকাল পূজা করলে মহাদেব তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিয়ে বলেন –তোমার পরম সুন্দর পঞ্চস্বামী হবে।

শুনে কন্যা বিস্মিত হয়ে যোড়হাতে বলেন –কেন এমন উপহাস করছেন, শূলপাণি! এমন কথা তো লোকে বা বেদে কখনও শুনিনি।

শঙ্কর বলেন –কন্যা এতে আমার কোন দোষ নেই। তুমিই পাঁচবার সর্বগুণ সম্পন্ন স্বামী প্রার্থনা করে গেছ। এখন অকারণে রোদন করছ। আমার বচন খন্ডন হবার নয়। শোন তোমার পঞ্চ মহারথী স্বামী হবে, তবু তুমি পৃথিবীতে সতী নারী রূপেই সন্মান পাবে। তোমার চরিত্রকথা সকলে শুনবে, তোমার নাম নিলে লোকে পবিত্র হবে।
এই বলে শিব অন্তর্হিত হলেন।
গঙ্গাজলে গিয়ে কন্যা প্রাণত্যাগ করেন।

পুনর্বার তিনি কাশীর রাজার কন্যা হয়ে জন্মান। সে জন্ম তিনি পতিহীন থাকেন। বিবাহ না করে যৌবনকাল কেটে গেল।
তিনি নিজেকে তিরস্কার করে হিমাদ্রি পর্বতে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। তার তপস্যা দেখে দেবতারা বিস্মিত হলেন। সবাই তার কাছে এসে তাকে দেখে যেতে লাগল।

ধর্ম, ইন্দ্র, পবন ও অশ্বিনীভাইরা তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন –কন্যা কি কারণে এই নবযৌবনে এমন কঠোর তপস্যা করছেন। হে সুন্দরী আপনি যদি পতিলাভের ইচ্ছায় তপস্যা করেন তবে আমাদের মধ্যে যাকে খুশি স্বামী হিসাবে নির্বাচন করতে পারেন।

এত শুনে কন্যা চোখ মেলে পাঁচজনকে দেখেন। পাঁচজনেই সমান সুন্দর রূপবান, পাঁচজনকেই ভাল লেগে গেল। কাকে বরণ করবেন ভেবে পেলেন না তাই অধোমুখে নিশব্দে কন্যা রয়ে গেলেন।

কন্যার হৃদয়ের কথা বুঝতে পেরে পাঁচজনেই তাকে বর দিয়ে বলেন –তপস্যা এবার ত্যাগ করুন, কন্যা। পরের জন্মে আমরা আপনার স্বামী হব।
এই বলে দেবতারা অন্তর্হিত হলেন।
কন্যা এরপর তপস্যা করে প্রাণত্যাগ করলেন।

সেই কন্যাই আজ আপনার ঘরে দ্রৌপদী রূপে এসেছেন। ইনি অযোনিসম্ভবা। এঁনার জন্ম হল যজ্ঞভেদ করে।
অন্যদিকে ধর্ম, ইন্দ্র, বায়ু ও অশ্বিনীভাইরাও পঞ্চঅংশে পান্ডব হয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। পঞ্চপান্ডবের জন্যই বিধাতা কৃষ্ণাকে নির্মাণ করেছেন। পূর্বেই তা নির্ধারিত।

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পূণ্যবান।
.....................
দ্রৌপদীর পূর্ব্ববৃত্তান্তঃ

ব্যাসের কথা শুনে অগস্ত্যমুনি বলেন –ঠিক বলেছেন, ব্যাসমুনি। আমিও যা জানি বলছি শুনুন -

পূর্বে একবার শমন/যমরাজ যজ্ঞে ব্যস্ত ছিলেন ফলে প্রাণীর মৃত্যু বন্ধ হল। পৃথিবীতে মানুষ অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে লাগল, দেখে দেবতারা ভয় পেলেন। সকলে ব্রহ্মার কাছে সমাধানের জন্য গেলেন। সব শুনে ব্রহ্মা দেবতাদের নিয়ে নৈমিষ কাননে চললেন যেখানে শমনরাজ যজ্ঞ করছিলেন।
ব্রহ্মাকে দেখে যমরাজ উঠে এসে প্রণাম জানালেন।

ব্রহ্মা যমকে বলেন –এখানে তুমি কি করছ! সৃষ্টির উপর তোমার অধিকার। তাদের পাপ-পূণ্য বুঝে দন্ড দেওয়া তোমার কাজ, সে সব ছেড়ে যজ্ঞ করছ। আমার আজ্ঞা ঠিক মত পালন করছ না!

শুনে যম করযোড়ে বলেন –হে পদ্মযোনি (বিষ্ণুর নাভিপদ্ম যার উৎপত্তিস্থল), আমি আর সে কর্ম করতে পারছি না। এ কঠিন কর্ম আমার পক্ষে আর সম্ভব না। দেব পুরন্দর (ইন্দ্র) ত্রিলোকের রাজা হয়ে যজ্ঞ করে পূর্ণ অর্জনের সময় পান। কুবের, বরুণরাও ইচ্ছে মত যজ্ঞ করার সুযোগ পান। কেবল আমারই কোন অবকাশ নেই। আপনি এ কাজের দায়িত্ব দয়া করে অন্য কাউকে দিন। আমি আর পরের পাপপূণ্য বিচার করতে পারছি না।

যমের কথায় ব্রহ্মা প্রজাপতি চিন্তিত হলেন। তখন তার শরীর থেকে এক কায়স্থের জন্ম হল- ইনিই চিত্রগুপ্ত, যার ডানহাতে লেখনী এবং বামহাতে তালপাতা।

ব্রহ্মা যমকে বলেন –তুমি এই চিত্রগুপ্তকে তোমার সঙ্গে রাখ। এই সব হিসাব রাখবে। এর কাছ থেকেই তুমি সবার কাজের খবর পাবে। ব্যাধিরূপে অন্যায়ের বিনাশ করবে। সংসারে সকল প্রাণী তার কর্ম অনুসারে ফল ভোগ করবে। এসব কাজের দায়িত্ব তোমারই থাকবে। ব্রহ্মার বচনে যম আশ্বস্থ হলেন।

যজ্ঞ শেষ করে সঞ্জীবনী স্থানে যাত্রা করেন। যমকে প্রবোধ দিয়ে অন্য দেবতারাও যাত্রা করেন।
যেতে যেতে তারা গঙ্গার জলে স্বর্ণপদ্ম দেখতে পেলেন। সহস্র সহস্র পুষ্প স্রোতে ভেসে যাচ্ছে দেখে সকলে বিস্মিত হলেন। সেই কমলপুষ্পের গন্ধে সকলের মন মোহিত হল।

দেবরাজ ইন্দ্র ধর্মরাজকে সেই ফুলের সম্বন্ধে তথ্য নিতে পাঠালেন। ইন্দ্রের আজ্ঞায় ধর্মরাজ দ্রুত এগিয়ে গেলেন কিন্তু বহুক্ষণ সময় চলে গেলেও আর ফিরলেন না।
ইন্দ্র চিন্তিত হলেন। ধর্মকে খুঁজতে বায়ু গেলেন। তিনিও ফিরলেন না। তাদের খুঁজতে ইন্দ্র অশ্বিনীভাইদের পাঠালেন। কিন্তু চারজনের কেউই আসছে না দেখে তিনিই এগিয়ে গেলেন।
হিমালয়ের গঙ্গাকূলে দেখলেন এক সুন্দরী যুবতী কাঁদছেন। সেই সুন্দরীর অশ্রুবিন্দু স্বর্ণপদ্ম হয়ে জলে পরে ভেসে যাচ্ছে।

দেবরাজ ইন্দ্র কন্যাকে জিজ্ঞেস করেন –কে আপনি, কেন কাঁদছেন! হে মৃগনয়না, বিম্বাধর(লাল ঠোঁট), ধূমহীন আগুনের মত মনোহর অঙ্গ। চাঁদের মত মুখে মৃগের মত চঞ্চল আখিঁ। সুন্দর আপনার ভুরু, যুগ্ম ঊরু হস্তিহাতকেও নিন্দা করবে। কি কারণে আপনি একাকিনী কাঁদছেন! হে বিরহিনী আমাকে বরণ করতে পারেন।

কন্যা বলেন –আমি দক্ষের কন্যা। সংসারে সুখ ছেড়ে তপস্বিনী হয়েছি। আমাকে এমন বলা আপনার উচিত হয়নি। পাপ চক্ষে আমাকে দেখলে অনেক কষ্ট পেতে হয়। এর আগেও চারজন একই কথা আমায় বলেছেন। তারা যে কষ্ট এখন পাচ্ছেন তা বলে বোঝান সম্ভব নয়।

ইন্দ্র উৎকন্ঠিত হয়ে বলেন –তাঁরা কোথায় আছেন আমায় দ্রুত বলুন।

কন্যা বলেন –তাদের দেখতে ইচ্ছে করে তো আমার সাথে আসুন।

ইন্দ্র কন্যার পিছু পিছু কিছু দুর গিয়ে দেখেন পর্বতের উপর এক সুন্দর পুরুষ।

সেই কন্যা সুন্দর পুরুষকে বলেন –হে মহাদেব, আমি কেতকী। একা তপস্বিনী দেখে ইনি আমাকে কুপ্রস্থাপ দিলেন।

ক্রুদ্ধ হয়ে শিব ইন্দ্রকে বলেন –মূঢ় না দেখে বুঝে যা খুশি বললে এর ফল তুমিও এখনই পাবে। তুমি তো অসীম বলশালী ওই পর্বতটি তুলে দেখ।

শিবের আজ্ঞায় ইন্দ্র পর্বত তুলে দেখেন সেই পর্বতের গহ্বরের শিবের অদ্ভূত কারাগার। সেখানে ধর্ম, বায়ু ও অশ্বিনীভাই-চারজনে বন্ধি আছেন। দেখে সহস্রলোচন ইন্দ্র ভয় পেলেন। হাতযোড় করে শিবের স্তব শুরু করলেন।



বিস্তর স্তব করার পর মহাদেব তুষ্ট হয়ে বলেন –তোমার পূজায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। তোমার কারণে এই চারজনকেও ক্ষমা করলাম। তোমাদের আমি বিষ্ণুর কাছে নিয়ে যাব। তিনি যা আজ্ঞা দেন তাই করবেন বাসব(ইন্দ্র)।

এই বলে ত্রিলোচন শিব তাদের শ্বেতদ্বীপে নিয়ে গেলেন যেখানে নারায়ণ আছেন। মহাদেব বিষ্ণুকে কেতকীর সকল কথা জানালেন।

শুনে শ্রীমধুসূদন ইন্দ্রকে বলেন –ইন্দ্রত্ব পেয়েও আপনার লোভ গেল না। সেই পাপে আপনাকে মর্তে জন্মাতে হবে এবং কর্মফল ভোগ করতে হবে। এই কেতকী সুন্দরী আপনাদের স্ত্রী হবেন। আপনারা পাঁচজনেই মানুষ হয়ে জন্মাবেন। কেতকী আপনাদের পাঁচজনেরই ভামিনী(স্ত্রী) হবেন। আপনাদের ভালর জন্য আমিও জন্মগ্রহণ করব। দ্বাপরে ক্ষত্রিয়দের অহংকার চূর্ণ করব।
এত বলে তিনি মহেশকে দুটি কেশ দিলেন। শুক্ল কেশ বলরাম ও কৃষ্ণ কেশ কৃষ্ণ হলেন।

-এত বলে অগস্ত্যমুনি বলেন –শুনুন দ্রুপদ সেই দেবী কেতকীই হলেন যাজ্ঞসেনী কৃষ্ণা দ্রৌপদী।

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীদাস কহে সদা শুনে পূণ্যবান।

...................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers