Blog Archive

Saturday, July 29, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৫০

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করেন....সকল রাজারা নিজ দেশে ফিরলেও দুর্যোধন থেকে যায় ও পাণ্ডবদের হিংসা করতে থাকে ... শেষে মামা শকুনির সাথে পরামর্শ করে পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে বাধ্য করে পাণ্ডবদের পাশা খেলায় আমন্ত্রণের জন্য ... শকুনির ছলনায় যুধিষ্ঠির একে একে সব হারতে থাকেন.... পঞ্চ পাণ্ডবদের যেমন পাশা হারলেন তেমনি দ্রৌপদীকেও হেরে এ খেলা শেষ হল ... ] 



পঞ্চপাণ্ডবকে সভাতলস্থ করণঃ

সূর্যপুত্র কর্ণ আনন্দে অট্টহাস্যে বলে ওঠে –দেখ দেখ কেমন দৈবের লিখন। হে দুর্যোধন মনে পরে আমাদের সবার মাঝে তোমাকে এরা লজ্জা পাইয়েছিল, উপহাস করেছিল। আজ তার ফল পেল। সেদিন নিজ ভবনে এই ভীমার্জুন, এই মাদ্রীর দুই পুত্র তোমায় দেখে বারবার হেসেছিল। যেন তারা বাতুল(পাগল) দেখছিল। আজ তুমিও নিজ প্রাসাদে তার সোধ তুললে। 
হে যুধিষ্ঠির দৈবের লিখন দেখ আজ তোমরা সেই অধর্মের ফল পাচ্ছ। দৈব আজ তোমাদের দাস করে দুর্যোধনের পায়ে ফেলল। সবাই দেখ যুধিষ্ঠির আর তার ভাইরা আজ দুর্যোধনের দাস। দাসরা সম যোগ্য আসন পায় না। এসভায় এদের সাথে আর বসে থাকা যাচ্ছে না। 

দুর্যোধন বলে – সখা উত্তম কথা বললে। 
সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবদের দাসস্থানে গমনের আজ্ঞা হল। 

দুর্যোধন বলে ওঠে – এদের সবার দামী বস্ত্র আভরণ কেড়ে নাও। সখা কর্ণ তুমি বিচার করে এই পাঁচ দাসকে যোগ্য কর্মে নিযুক্ত কর। 

একথা শুনে দুষ্ট বৈকর্তন(সূর্যপুত্র কর্ণ) বলে –দৈবের কারণে বহুজন ভৃত্যকর্ম করে। কর্ম বিনা সংসারে কারো স্থান নেই। রাজার যেমন রাজধর্ম কাজ, ভৃত্যদেরও ভৃত্যকর্ম অনেক আছে। সখা দুর্যোধন তুমি যখন আমায় এ দায়িত্ব দিলে, অবশ্যই পালন করব। পাঁচজনকে সঠিক কর্ম দেব। 
ধর্মরাজের সুকোমল অঙ্গ, অন্যকাজে এর ক্ষমতা হবে না। একে তাম্বুল সেবার জন্য নিযুক্ত করছি। পান নিয়ে সব সময় সঙ্গে সঙ্গে ঘুরবে। 
হৃষ্টপুষ্ট বৃকোদর ভীম- বলবান পুরুষ। তাই আমার মতে একে চতুর্দোলার দায়িত্ব দেওয়া হোক। এতো ক্ষীণ জন নয়, সহজেই অনেক ভার বহন করতে পারবে। স্বচ্ছন্দে তোমাকে ও তোমার ভাইদের কাঁধে নিয়ে ভীমসেন বিভিন্ন স্থানে যেতে পারবে। 
অর্জুনের জন্য আমার অনুরোধ আছে। একে কেবল দামী বস্ত্র ও অলঙ্কার সুরক্ষার ভার দেওয়া হোক। 
আর মাদ্রীর দুই সুন্দর কুমারকে তোমার নিজের সেবায় রাখ দুর্যোধন। তারা সব সময় তোমার সাথে সাথে থাকবে। চামর নিয়ে তোমায় ব্যজন করবে। এভাবে পাঁচ ভাইকে পাঁচটি কর্মে নিযুক্ত কর। 
কৃষ্ণা দ্রৌপদীও আজ দাসী। তাকেও গৃহের কাজে নিযুক্ত করা হোক। 

দুরাচার কর্ণের এত কথা শুনে গান্ধারীকুমার দুর্যোধন হেসে বলে –সখা উত্তম বিধান দিলে। তোমার কথা আমার মনে ধরেছে। 
দুর্যোধন কৌরবদের ইঙ্গিতে পাণ্ডবদের সভাতলে বসাতে আজ্ঞা দেয়। 
সঙ্গে সঙ্গে কৌরবরা কর্কশ বচলে ‘ওঠ, ওঠ’ করে তেড়ে আসে। তারা বলে – কোন লজ্জায় এখনও সিংহাসনে তোরা বসে থাকিস! নিজেদের যোগ্য স্থানে গিয়ে বস। 
দুঃশাসন উঠে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে ধরে ‘চল, চল’ বলে পিঠে ধাক্কা মারে। ক্রোধে, অপমানে ধর্মপুত্র কাঁপতে থাকেন। চক্ষু রক্তবর্ণ, লোহ(চোখের জল) বহে ঝরঝর। 
যুধিষ্ঠিরের এমন রূপ দেখে ভীমসেন ক্রোধে থরথর কাঁপতে কাঁপতে ভৈরব গর্জনে দাঁত কড়মড়িয়ে ওঠে। দেখে মনে হয় প্রলয়কাল আগত। যুগান্তে যম যেন সৃষ্টির সংহার করবেন। অরুণ আকার চক্ষে একদৃষ্টে চায়, নাকে ঝড় বহে প্রলয় সমান। মহাবীর ভীমসেন কর্ণের দিকে চায়। তা দেখে কৌরবরা শঙ্কিত হয়ে ওঠে। হাতে গদা তুলে ভীম মাথার উপর চক্রাকারে ঘোরাতে থাকে। তার চরণ ভারে ক্ষিতি বিদীর্ণ হয়। ক্রোধমুখে ভীম দুঃশাসনের দিকে ধায়। অনুমতির জন্য ভীম যুধিষ্ঠিরের পানে চায়। যুধিষ্ঠিরকে হেঁট মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অর্জুন গিয়ে ভীমকে ধরে, বোঝাতে চায়। 

অর্জুন বলেন –ভাই অনৈতিক কাজ কিছু কর না। ধর্মরাজের অনুমতি বিনা কিছু করা সম্ভব নয়। আজ যদি দিক্‌পালদের নিয়ে দেবরাজ আসেন এবং পৃথিবীর শত শত বীর এসে ধর্মরাজকে অপমান করেন তবে মুহূর্তে আমরা তাদের যমের গৃহে পাঠাতে পারি। এরা তো সব তৃণ তুল্য। এখনই এদের দগ্ধাতে পারি। কিন্তু ধর্মরাজের আজ্ঞা বিনা আমাদের কোন শক্তি নেই। আজ ধর্মরাজ একাজের সমর্থন করছেন না, তাই আর এসব করতে যেও না। 

অর্জুনের কথায় ভীম ক্রোধ সম্বরণ করলেন, গদা ছুড়ে ফেলে দিলেন। 
পঞ্চপাণ্ডব তাদের শরীরের সকল আভরণ খুলে দিলেন। সভা ত্যাগ করে তারা ধূলাসনে অধোমুখে বসে থাকেন। 

হেনকালে দুষ্ট কর্ণ বলে ওঠে –দ্রৌপদীকে আনতে এবার দূত পাঠান হোক। 

শুনে দুর্যোধন বিদুরকে উপহাস্যে ডাকে। 
তখন অবস্থা বুঝে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র সভা ছেড়ে আপন গৃহে চলে যায়।
......................................

Saturday, July 15, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৯

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করেন....শিশুপাল কৃষ্ণকে অপমান শুরু করলে কৃষ্ণ সুদর্শন চক্রে তার প্রাণ হরণ করেন .... সকল রাজারা নিজ দেশে ফিরলেও দুর্যোধন থেকে যায় ও পাণ্ডবদের হিংসা করতে থাকে ... শেষে মামা শকুনির সাথে পরামর্শ করে পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে বাধ্য করে পাণ্ডবদের পাশা খেলায় আমন্ত্রণের জন্য ... শকুনির ছলনায় যুধিষ্ঠির একে একে সব হারতে থাকেন



ভ্রাতৃবর্গকে ও দ্রৌপদীকে পণ করণ ও যুধিষ্ঠিরের পরাজয়ঃ

শকুনি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের দিকে চেয়ে বলে –সর্বস্ব হেরেছ এবার আর কি পণ রাখবে! 

যুধিষ্ঠির বলেন – আমার অসংখ্য রত্ন এখনও আছে। চারি সিন্ধু মাঝে আমার যত ধন আছে, অযুত, নিযুত, খর্ব, মহাখর্ব, পদ্ম, শঙ্খ, করি যত অনন্ত সম্পদ সব পণ রাখছি। 

সঙ্গে সঙ্গে পাশা ফেলে শকুনি বলে – জিতে নিলাম। 

যুধিষ্ঠির বলেন –আমার পশুশালার পশুদের বাজি রাখছি। গাভী, উষ্ট্র, খর(গাধা), মেষ অগণন। 

এবারও গান্ধারপুত্র বলে ওঠে-সব আমার। 

যুধিষ্ঠির বলেন –এবার আমার শাসিত রাজ্যভূমি পণ রাখছি। ব্রাহ্মণের গৃহ ও ভূমি ছাড়া সব পণে দিলাম। 

শকুনি আবার বলে ওঠে –এবারও জিতে নিলাম। আর কিছু আছে! 

ধর্মপুত্র বলেন –আর তো কিছু ধন নেই! 

কুমারদের অঙ্গের যত অলঙ্কার ছিল সব পণ করে শকুনি তাও জিতে নিল। তা দেখে ধর্মনৃপমণি যুধিষ্ঠির চিন্তিত হলেন। 

শকুনি বলে ওঠে –এবার বিচার করে বল কি পণ রাখবে! 

অনেক ভেবে যুধিষ্ঠির বলেন –আমার ভাই নকুল সুধীর, যিনি এই পৃথিবীতে কামদেব তুল্য তনুর জন্য সুবিখ্যাত। যার সিংহের মত গ্রীবা, পদ্মপত্র যুগল নয়ন। সেই নকুলবীরকে পণ রাখছি। 

কপট শকুনি বলে –আহা প্রিয় ভাই যদি, তবে পাণ্ডুর এ সুন্দর কুমারকে কি ভাবে পণে দিচ্ছ! 
এই বলে পাশা ফেলে নকুলকেও জিতে নিল। 

যুধিষ্ঠির এবার বলে ওঠে –ধর্মজ্ঞ সুপণ্ডিত সহদেব আমার পরম প্রিয় জগৎ বিদিত। এবার তাকে বাজি রাখছি। 

গান্ধার নন্দন শকুনি বলে ওঠে –তাকেও জিতে নিলাম। 
চতুর কপট শকুনি বলে – আর কি পণ করার আছে, হে নৃপমণি! বৈমাত্রের ভাইদের তো বাজিতে হেরে বসলে। ভীমার্জ্জুনকে কি পণ রাখতে পারবে! বিশ্বাস তো হয় না। 

ধর্মরাজ বলেন –মামা আপনার মন কালিমালিপ্ত, তাই আমাদের ভাইয়েদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করছেন। আমরা পাঁচ ভাই এক প্রাণ। না জেনে আপনি এমন কুবাক্য বললেন। 

ভীত শকুনি সবিনয়ে বলে ওঠে –হে রাজা, পাশা খেলায় মত্ত হয়ে অন্যায় বাক্য বলে ফেলেছি। আপনি মানবকুলে শ্রেষ্ঠ, আমি গরিষ্ঠ অধম। আমায় ক্ষমা করে দিন। 

যুধিষ্ঠির আবার খেলায় ফেরেন। এবার রাজা বলেন –তিন লোক খ্যাত আমার এ সহোদর ধনঞ্জয় অর্জুন। যিনি অবহেলায় দেবরাজকেও জয় করেন। অগণিত গুণে যিনি পৃথিবী বিখ্যাত। সেই ভাইকে এবার পণ রাখছি। যানি ইনি পণ যোগ্য নন। তবু এই দ্যূত ক্রীড়ার কারণে তাকে বাজি ধরলাম। 

সঙ্গে সঙ্গে শকুনি বাজি ফেলে বলে ওঠে –জিতে নিলাম। 
অর্জুনকে জিততেই কৌরবদের মধ্যে আনন্দলহরী ওঠে। 

যুধিষ্ঠির বলেন –এবার আমি পণ রাখছি আমার সেই ভাইকে যার তুল্য বলশালী মনুষ্যলোকে নেই। ইন্দ্র যেমন দৈত্যদের থেকে দেবতাদের রক্ষা করে চলেছেন, সেইমত এই ভীমসেন পাণ্ডুপুত্রদের সর্বদা রক্ষা করেছেন। এ পাশায় ইনিও পণ যোগ্য নন, তবু দৈব্য নির্বন্ধ। 

শকুনি এবার গর্জে ওঠে –এই পাশা ফেলে তাকেও নিলাম, মহারাজ! আর কি আছে আপনার পণ করুন। 

এত শুনে যুধিষ্ঠির বলেন –এখন কেবলমাত্র আমিই আছি। আমি নিজেকে পণ রাখছি। 

তাকেও জিতে শকুনি বলে –হে কুন্তীকুমার বড়ই পাপ কর্ম করে চলেছ। এবার দ্রুপদ কুমারীকে পণ রেখে নিজেকে উদ্ধার কর। নিজেকে উদ্ধার করলে অমন বহু নারী আবার তোমার হবে। 

রাজা যুধিষ্ঠির বলে ওঠেন – মামা আপনার এ কথা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কিভাবে দ্রৌপদীকে পণ রাখতে পারি! লক্ষ্মী রূপিণী, অসংখ্য গুণের অধিকারী, যিনি সব সময় সকলকে তুষ্ট রাখার কাজে ব্রতী। এই রাণী দ্রৌপদী-যিনি সকল দ্বিজ, ক্ষত্রিয়, দাস, দাসী, পশু, পাখী সবাইকে জননী রূপে প্রতিপালন করেন, ভালবাসেন-সেই স্ত্রীকে পণ রাখার মত দুর্মতি এখনও আমার হয় নি। 

কপট শকুনি বলে ওঠে –ঠিক বলেছেন রাজা। আপনার এই গৃহিণী সাক্ষাৎ লক্ষ্মীর অবতার। তার ভাগ্যেই হয়ত আপনার পাশা উল্টে যাবে। যা কিছু হেরেছেন এবার ফিরে পাবেন। এর ভাগ্যেই সব উদ্ধার হতে পারে। 

বিপদে পরলে বিদ্যান পণ্ডিতও বুদ্ধি হারায়। শকুনির কথা শুনে যুধিষ্ঠিরের মন পরিবর্তিত হল। 
তিনি বলে ওঠেন – মামা ঠিক বলেছেন, এবার আমি আমার লক্ষ্মীকেই পণ স্থির করছি। 

একথা শুনেই দুষ্ট শকুনি পাশা ফেলে অট্টহাস্যে বলে ওঠে – জিতেছি, জিতেছি। 
শুনে দুর্যোধন, কর্ণ সকলে আনন্দে ফেটে পরে। মহা আনন্দে কৌরবরা খলখল করে হাসতে থাকে। 
সভাসদরা সব দেখে শুনে আশ্চর্য হয়। 
ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপের নয়ন সজল হয়ে অঠে।বিমর্ষ বিদুর অধোমুখে বসে থাকেন। 
জ্ঞানবন্ত জন মহাশোকে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। 

হৃষ্ট চিত্তে অন্ধ রাজা চেঁচিয়ে ওঠেন –কে জিতল, কে জিতল! 
বহুকালের লুকিয়ে রাখা কুটিল মনকে আজ আর অন্ধ রাজা গোপন করতে পারলেন না। 

এভাবে সব কিছু হেরে গেলেন ধর্মরায় যুধিষ্ঠির। 

সভাপর্বের এই সুধারস গান কাশীরাম দাস।

......................................

Saturday, July 1, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৮

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করেন....শিশুপাল কৃষ্ণকে অপমান শুরু করলে কৃষ্ণ সুদর্শন চক্রে তার প্রাণ হরণ করেন .... সকল রাজারা নিজ দেশে ফিরলেও দুর্যোধন থেকে যায় ও পাণ্ডবদের হিংসা করতে থাকে ... শেষে মামা শকুনির সাথে পরামর্শ করে পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে বাধ্য করে পাণ্ডবদের পাশা খেলায় আমন্ত্রণের জন্য ...] 


যুধিষ্ঠিরের সহিত শকুনির দ্যূতক্রীড়া ও শকুনির জয়ঃ

পরদিন প্রভাতে পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র আনন্দিত মনে নব নির্মিত সভায় প্রবেশ করলেন। একে একে সকলের সাথে কুশল সম্ভাষণ করে তারা কনক সিংহাসনে বসলেন। শকুনি তখন তার পাশা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হল। 

শকুনি বলে – হে ধর্ম নৃপমণি মহারাজ যুধিষ্ঠির পুরুষদের মনোরম দ্যূতক্রীড়ার সূচনা করুন। 

যুধিষ্ঠির বলেন –পাশা খেলা সব অনর্থের মূল। এ খেলার মাধ্যমে ক্ষত্রিয়ের পরাক্রম প্রদর্শন হয়না। এ খেলায় কপটতা আছে। এই অনীতি ক্রীড়ায় আমার মনের সায় নেই। 

শকুনি বলে –রাজা, পাশা খেলায় বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পাশা খেলা অথবা যুদ্ধ করা। যুদ্ধে জাতি অজাতির বিচার চলে না। সেখানে হীন জাতীর প্রহারও সইতে হয়। কিন্তু পাশা সম মন ও সম বুদ্ধির সমর। মুনিরাও বলেন ক্ষত্রিয়েরা পাশা খেলতে পারে। 

যুধিষ্ঠির বলেন –পাশা শঠতার খেলা। মামা আপনি অধর্ম করে আমায় জেতার চেষ্টা করবেন না। 

শকুনি বলে –রাজন এত ভয়! তবে আপনি নিজ স্থানে ফিরে যান। পণ্ডিতে পণ্ডিতেই এ ক্রীড়া সম্ভব। আপনার যদি দ্যূতক্রীড়ায় মন না চায় তবে এখনই গৃহে ফিরে যান। 

যুধিষ্ঠির বলেন –আমায় যখন ডেকে পাঠিয়েছেন, তখন আমি খেলব। সত্যের পথ থেকে সরে যাব না। এ সভায় কার সাথে আমার খেলা! পণ কে দেবে! মেরুতুল্য সম্পদ আমার, চার সমুদ্রের সমান রত্ন আমার ভান্ডারে। 

দুর্যোধন বলে –আমার হয়ে মাতুল শকুনি খেলবেন। মামা যত রত্ন হারবে সব আমি দেব। 

এভাবে সভার মাঝে শকুনি ও যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে বসল। মনে অসন্তোষ নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য এবং বিদুর ও অন্যান্য সভাসদরা ক্রীড়া দেখতে লাগল। 

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলেন –আমি পণ রাখছি আমার ইন্দ্রপ্রস্থের সকল রত্নের ভান্ডার। হে দুর্যোধন সে পরিমান ধন কি তোমার আছে! কোথা থেকে সে পণ তুমি দেবে! 

দুর্যোধন বলে –আমারো অনেক সম্পদ আছে। আমাদের জিতলে অবশ্যই সব আমি তোমায় সমর্পণ করব। 

সারি নির্ণয় করে শকুনি তখন পাশা ফেলল এবং এক কটাক্ষে সব রত্ন জিতে নিল। 

ক্রোধে যুধিষ্ঠির পুনরায় পণ করলেন – আমার কোটি কোটি সব মহা বলশালী অশ্ব বাজি রাখছি। 

শকুনিও সাথে সাথে হেসে পাশা ফেলে বলে –এই সব জিতে নিলাম। এবার কি পণ করতে চান! 

যুধিষ্ঠির বলেন –আমার অগণিত রথ আছে, সে সব নানা রত্নে বিভূষিত। মেঘের মত তাদের গর্জন। তাই পণ রাখছি। 

শকুনি হেসে পাশা ফেলে বলে – দেখুন সে সবও জিতে নিলাম। এবার অন্য পণ রাখুন। 

ধর্মরাজ বলেন –আমার ইষদন্ত মহাকায় দুর্নিবার হস্তিবৃন্দ পণ রাখছি। 

এবারও শকুনি বলে ওঠে –জয় করলাম। 

যুধিষ্ঠির বলেন – নানা রত্নে সজ্জিতা সহস্র সুন্দরী দাসী আছে, যারা ব্রাহ্মণের সেবায় ব্রত, তাদের পণ দিচ্ছি। 

শকুনি পাশা ফেলে হেসে ওঠে –ওহে এবার আর কিছু পণ রাখ। তারাও আমার হল। 

ধর্মপুত্র বলেন –আমার অগণন গন্ধর্ব অশ্ব আছে, যাদের সাথে সারা ভুবন ভ্রমণ করলেও এতকুটু কষ্ট হয় না। চিত্ররথ গন্ধর্ব আমায় উপহার দেন। এবার তাদের পণ রাখছি। 

হেসে সুবলপুত্র শকুনি বলে –অশ্ব সব জিতে নিলাম। 

যুধিষ্ঠির বলেন –আমার যত দুর্ধর্ষ যোদ্ধা সৈনিক আছে তাদের পণ দিচ্ছি। 

গান্ধার নন্দন শকুনি সামান্য হেসে সে সবও জয় করল। 

এভাবে কপট শকুনি একে একে সব জয় করতে থাকে। অন্যদিকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সব ধন একে একে হারাতে লাগলেন। 
................................................

ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি বিদুরের উক্তিঃ 

সব দেখে শুনে বিদুর ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। 
বিদুর রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বলেন –হে রাজন, আমার কথা আপনার একটুও মন নেয় না! মৃত্যুকালে যেমন রূগী ওসুধ খেতে চায় না। 
হে অন্ধরাজা আপনি এখনও স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন! জন্মমাত্র যখন আপনার এই পুত্র খর(গর্দভ)শব্দ করেছিল তখনই আমি বলেছিলাম কুরুকুলের ক্ষয় করতে এর জন্ম। একে ত্যাগ করুন। আমার কথা শুনলেন না। এখন তার ফল সে দেখাচ্ছে। সংহার রূপে এ আপনার ঘরে আছে। স্নেহে অন্ধ হয়ে এর দোষ আপনি দেখতে পান না। দেব গুরু নীতি রাজা আমি আপনাকে বলি। মধুর কারণে মধুলোভীরা বৃক্ষোপরে ওঠে। মধুর নেশায় তারা পতনের ভয় ভুলে যায়। আপনার এ পুত্র দুর্যোধনও সেরূপ আজ মত্ত। এভাবে মহারথীদের সাথে শত্রুতা করছে। আজ আমার কথা না শোনার ফল পরে আপনি বুঝবেন। এর মত কংসভোজ জন্মেছিল। সে দুষ্টও মত্ত হয়ে পিতার বংশ নাশ করেছে। সকলে তাকে ত্যাগ করে। শেষে গোবিন্দের হাতে তার সংহার হয়। 
হে রাজন, গোবিন্দের সাথে সখ্যতা রাখলে সপ্তবংশ সুখে থাকবেন। আমার বাক্য শুনুন মহারাজ! এখনই পার্থ অর্জুনকে আজ্ঞা দিন, সে দুর্যোধনকে পরাজিত করে বন্দি করুক। তারপর নির্ভয়ে পরম সুখে রাজকার্য করুন। এভাবে কাকের হাতে ময়ূরের অপমান হতে দেবেন না। এতো শিবার(শেয়াল) হাতে সিংহের অপমান। এভাবে শোক সিন্ধুর মাঝে নিজের পতন ঘটাবেন না। যে পক্ষী অমূল্য রত্ন প্রসব করে মাংস লোভে বিজ্ঞজনরা কখনই তাকে খায় না। রাজা, সোনার বৃক্ষ যত্ন করে রোপণ করে রক্ষা করলে পরে দিনে দিনে সুন্দর পুষ্প পেতেন। 
হে নরপতি যা হয়ে চলেছে এখনই তা বন্ধ করুন। নিজ পুত্রদের কেন যমের অতিথি করছেন! এই পঞ্চপাণ্ডবের সাথে কার যুদ্ধ করার ক্ষমতা আছে শুনি! পাণ্ডবদের আজ যে শক্তি, যে ক্ষমতা – দিক্‌পাল সহ বজ্রপাণি ইন্দ্র এলেও পরাজিত হবেন। 
হে ভীষ্ম, হে দ্রোণ, হে কৃপ-কেউ তো আমার কথা শুনুন! সবাই মিলে নত মস্তকে এই অন্যায় হতে দেখে যাচ্ছেন! 
হে বীর, এভাবে অগাধ সমুদ্রে অবহেলায় নৌকা ডোবাবেন না। এভাবে তো সবাই মিলে দেখছি যম গৃহে যেতে চলেছেন। 
অক্রোধী, অজাতশত্রু আমাদের এই যুধিষ্ঠির রাজন। কিন্তু যখন ভীম ও ধনঞ্জয় অর্জুন ক্রুদ্ধ হবে, সেই যুগল যখন ক্রোধে সংহার শুরু করবে তখন কে প্রবোধ দেবে তাদের! 
হে অন্ধরাজা, পাশার ছলনায় সব নেবার কি ছিল। আজ্ঞামাত্র তো ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সব আপনাকে নিবেদন করত। এই শকুনিকে আমি ভাল মত চিনি। কপট, কুবুদ্ধি, খলচূড়ামণি। কোথায় পর্বতপুরে এর নিবাস, কিন্তু সর্বনাশ করতে এখানে পরে আছে। একে এক্ষুনি বিদায় করুন, নিজ গৃহে ফিরে যাক। 
হে শকুনি উঠে এস, পাশা ত্যাগ কর। 

বিদুরের এত কথা শুনে দুর্যোধন ক্রোধিত হল, যেন আগুনে ঘৃত ঢালা হল। 
দুর্যোধন গর্জন করে বলে –আমরা তোমার কথা শুনব না। কার হয়ে তুমি এত কথা সভা মাঝে বলছ! তুমি সর্বদা পিতা ধৃতরাষ্ট্রের হানি চেয়েছ। সবাই যানে পান্ডুর ছেলেরা তোমার অতি প্রিয়। আমি আমার ধারে কাছে শত্রুহিতকারীদের রাখতে চাই না। তুমি এই সভা থেকে উঠে যেখানে খুশি যেতে পার। এখানে থাকার যোগ্য তুমি নও। কুজনকে যত্ন করে রাখলেও সে অসৎ পথে গমন করবেই। সভার মাঝে তুমি যে সব কথা বললে অন্য কেউ হলে আজ তার প্রাণের আশা থাকত না। আমি তোমায় যত সম্মান করি, তুমি ততই আমায় আনাদর কর, জ্ঞানহীন ভাব। সভা মাঝে এমনভাবে কথা বলছ যেন তুমি এখানকার প্রভু! কেউ তোমার মত এমন কদর্য আচরণ করবে না। 

বিদুর বলেন –আমি তোমায় কিছু বলছি না। হে ধৃতরাষ্ট্র আপনার দুঃখ দেখে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। দুর্যোধন তোমায় আর কি বলব। ধৃতরাষ্ট্র আমার কোন কথাই শুনলেন না। হতায়ু(আয়ু যার শেষ) জন কখনও হিতের কথা শোনে না। তুমি আমায় কি কথা বলতে আসছ! নিজের সমকক্ষ কাউকে এসব কথা বল। 

এত বলে ক্ষত্তা বিদুর চুপ করে গেলেন। 

সুবলপুত্র শকুনি আবার পাশা খেলা শুরু করল।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers