Blog Archive

Saturday, June 14, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৫৮

দ্রোণাচার্য্যের দক্ষিণা প্রার্থনাঃ 


কিছুদিন পর দ্রোণাচার্য শিষ্যদের কাছে তার গুরুদক্ষিণা প্রার্থনা করলেন।

দ্রোণ বললেন- হে, অর্জুন! দুর্যোধন! ধনরত্নের আমার কোন প্রয়োজন নেই। বিখ্যাত পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে যুদ্ধে হারিয়ে আমার সামনে বেঁধে আন – এই হবে আমার দক্ষিণা।

শিক্ষাগ্রহণের পূর্বে কুন্তীর পুত্ররা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন গুরু যা চাইবেন তাই দেবেন। তারা পূর্ব সত্য পালনে ব্রতী হলেন। 
গুরুর এই বাক্যে যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধনও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। সৈন্যদের প্রস্তুত হতে আদেশ দিলেন। রথ, হাতি, ঘোড়া, পদাতিক সকলের মধ্যে সাজসাজ রব উঠল। রাজকুমাররা দ্রোণকে সঙ্গে নিয়ে সসৈন্য পাঞ্চাল রাজ্য আক্রমণ করলেন। 
পাঞ্চাল রাজ দ্রূপদও তাঁর ভাইদের সাথে কৌরবদের প্রতি আক্রমণ করলেন। 

দুর্যোধনদের দর্প দেখে অর্জুন গুরুকে বলেন- এরা দ্রুপদকে বন্দী করতে পারবে না। ওরা আগে নিজেদের বিক্রম দেখাক তারপরে আমি যুদ্ধে নামব। এই বলে তিনি নগর থেকে অর্ধ ক্রোশ দূরে ভাইদের সাথে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

দ্রুপদের বাণবর্ষণে দুর্যোধনরা ব্যতিব্যস্ত হলেন। তাদের সৈন্যদের উপর নগরবাসী বালক বৃদ্ধ সকলে মুষল (মুগুর/গদা) ও যষ্টি(লাঠি) বর্ষণ করতে লাগল। কৌরবদের আর্তরব শুনে যুধিষ্ঠির যুদ্ধে যাওয়া উচিত মনে করলেন। সৈন্যদের প্রস্তুত হতে দেখে অর্জুন এক রথে চরে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। 
তিনি দু’হাত জোড় করে যুধিষ্ঠিরকে বলেন – আমি থাকতে আপনি যুদ্ধে যাবেন কেন, প্রভু! আমার দ্বারা যদি কর্ম সাধন সম্ভব না হয় তবে অন্য কাউকে এ দায়িত্ব দেবেন। 
এত বলেই অর্জুন দ্রুত পাঞ্চাল নগরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ভীমও তাঁকে অনুসরণ করলেন। 

দ্রুপদরাজ অর্জুনের আগমনের কারণ জানতে পারলেন এবং সৈন্যদের আবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে আজ্ঞা দিলেন। তিনি চিন্তিতও হলেন কেন অর্জুন হঠাৎ এভাবে এলেন এই ভেবে। রাজা তার মন্ত্রীকে অর্জুনের কাছে পাঠালেন। মন্ত্রী অর্জুনের কাছে করযোড়ে উপস্থিত হলেন এবং তিনি কি কারণে আগমন করেছেন জানতে চাইলেন। দ্রুপদরাজের প্রতিনিধি হয়ে তিনি অর্জুনের জন্য কি কাজ করতে পারেন জানতে চাইলেন এবং বিশেষ রূপে দ্রুপদ রাজার আশ্রয়ে অতিথি হতে আমন্ত্রণ জানালেন। 
অর্জুন বললেন তিনি সকল অতিথির পূজাই নেবেন যদি রাজা এসে তার সাথে যুদ্ধ করেন। তিনি সসৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে এসে যদি অর্জুনের সাথে যুদ্ধ না করেন তবে পাঞ্চালের ক্ষতি হবে এও জানালেন।
মন্ত্রী রাজার কাছে অর্জুনের সকল কথা জানালে দ্রুপদরাজ ক্রোধে কাঁপতে লাগলেন। ক্ষত্রিয় হয়ে এ বাক্য শুনে কেউই স্থির থাকতে পারে না। তিনি চতুরঙ্গে সেজে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। এত অশ্ব, গজ ও রথ এল যে তা গণনা করা গেল না। তিনি সসৈন্য গিয়ে পান্ডুপুত্র অর্জুনকে ঘিরে ফেললেন। সে সময় অর্জুন বিষণ্ণ মনে একা বসেছিলেন। চারদিক থেকে সৈন্যরা অস্ত্র বর্ষণ শুরু করলে তার চেতনা হল। তিনি আকর্ণ টেনে ধনুর্গুণে টঙ্কার ধ্বনি দিলেন। গুরু দ্রোণের চরণ স্মরণ করে যে শর নিক্ষেপ করলেন তাতে মুহুর্তে সূর্যের মুখ ঢেকে গেল। চারদিকে নতুন আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষণ শুরু হল। প্রবল বেগে সৈন্যদের উপর পরতে লাগল। ভীমও যমের মত গদা হাতে ধাবিত হলেন পাঞ্চালরাজের সৈন্যদের দিকে এবং অশ্ব, রথ সব ধ্বংস করতে লাগলেন। সারথিরা পালাল, রথী বা যোদ্ধারা কাটা পড়ল। হাতির দাঁত ভাঙ্গল-তাতে সে পালাল। ঘোড়ায় চড়ে যে বীর এলেন সে কাটা পড়লে অশ্বও পালাল। হাত কাটা গেলে পদাতিকরাও পালাল। যারা পালাল তারাই প্রাণে বাঁচল। বাকি সৈন্য যুদ্ধে প্রাণ দিল। অর্জুনের সাথে দ্রুপদ ও তার ভাই সত্যজিতের ভীষণ যুদ্ধ হল। অর্জুনের শরাঘাতে সত্যজিতের অশ্ব ও সারথি বিনষ্ট হলে সত্যজিত পালালেন। তখন অর্জুন দ্রুপদের ধনু ও রথধ্বজ ছিন্ন এবং অশ্ব ও সারথিকে শরবিদ্ধ করে খড়্গ হাতে লাফ দিয়ে তার রথে উঠলেন। সৈন্যদের দুর্দশা দেখে দ্রুপদও ভয়ে পলায়ন করতে লাগলেন। পিছন থেকে অর্জুন তাকে অভয় দিলেন। অর্জুন কথা দিলেন রাজা তার সাথে যুদ্ধ করলে তার প্রাণ অর্জুন নেবেন না। কিন্তু প্রাণ ভয়ে যদি তিনি পালাতে চান তা হলে অর্জুনের হাত থেকে তার আজ আর মুক্তি নেই। অর্জুনের কথায় রাজা সম্মত হলেন। তিনি অর্জুনের সাথে দারুন যুদ্ধ শুরু করলেন। মন্ত্র পরে অর্জুন যে দিব্য অস্ত্র ছাড়লেন তাতে রাজার ধনুক কাটা গেল। রাজা চিন্তিতত হলেন। অর্জুন রাজাকে দুহাতে ধরে নিজের রথে উঠিয়ে নিজ রাজ্যের উদ্দেশ্যে গমন করলেন এবং ভীমকে বললেন দ্রুপদরাজা কুরুবীরদের আত্মীয়, আর তার সৈন্য বধ করবেন না, আসুন আমরা গুরুদক্ষিণা দেব।

সে সময় পথে দুর্যোধনের সাথে দেখা হল। চতুরঙ্গে(হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতি) দল বেঁধে দুর্যোধন আসছিলেন। দুর্যোধন দ্রুপদকে অর্জুনের রথে দেখে বিরক্ত হলেন এবং এটা ঠিক হয়নি জানালেন। কারণ দ্রোণ দ্রুপদকে বেঁধে তার সামনে আনতে বলেছিলেন। এত বলে দুর্যোধন নিজেই রথে উঠে দ্রুপদের হাত-পা বাঁধলেন। রাজার চুল ধরে পথে হাঁটিয়ে তাকে দ্রোণের সম্মুখে এনে ফেললেন। দ্রোণের চরণে গিয়ে দ্রূপদ পতিত হলেন। 


দ্রুপদ

দ্রুপদকে দেখে দ্রোণ বললেন – হে রাজা তোমার সৈন্য, প্রজা, দন্ড, ছাতা সব কোথায় গেল! 
তিনি উপহাস্য করে দ্রুপদকে অভয় দান করলেন। বললেন –আমি জাতে ব্রাহ্মণ, আমার ক্রোধ ক্ষনিকের। বিশেষ করে বাল্যের বন্ধুর প্রতি। হে বন্ধু, পূর্বের কথা তোমার স্মরণ হয়! সেবককে আজ্ঞা দিয়েছিলে একটি ভোজনের। আজ আমরা সমান হলাম। এবার তুমিও আমায় রাজা বলতে পার। বাল্যকালে তুমি যে অঙ্গীকার করেছিলে রাজা হলে আমায় অর্ধেক রাজ্য দেবে – সে বচন তুমি পালন করনি। কিন্তু আজ তোমার সেই রাজ্য সম্পূর্ণরূপে আমার শাসনে। তুমি তোমার সত্য পালন করনি, কিন্তু আমি পালন করব। তুমি বাল্যকালে আমার সঙ্গে খেলেছিলে, সেজন্য তোমার প্রতি আমার এখনও স্নেহ আছে। অরাজা রাজার সখা হতে পারেনা। তাই তোমাকে আমি আমার অর্ধেক রাজ্য দিলাম, গঙ্গার দক্ষিণে চরমন্বতী নদী পর্যন্ত তুমি রাজত্ব কর। গঙ্গার উত্তরতটের রাজ্য পুরটাই আমার হল। অর্ধেক অর্ধেক রাজ্য দুজনেরই সমান হল। যদি ইচ্ছে কর তবে আমাকে সখা মনে করতে পার।
দ্রোণ দ্রুপদকে মুক্ত করে দিলেন এবং সখারূপে আহ্বান জানালেন।
দ্রুপদ বলেন, শক্তিমান মহাত্মার পক্ষে এমন আচরণ আশ্চর্য নয়, আমি প্রীত হয়েছি, আপনার চিরস্থায়ী প্রণয় কামনা করি। 

মুক্ত হয়ে দ্রুপদ নিজ রাজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন কিন্তু ক্ষত্রিয়েরা সহজে ক্ষমা করে না। শেষ পর্যন্ত তিনি অভিমানে রাজ্যে গেলেন না। ভাগীরথী নদী তীরে মাকন্দীনগরে থেকে গেলেন। সেখানে থেকে তিনি দুঃখের সাথে চিন্তা করতে লাগলেন কি ভাবে দ্রোণকে পরাজিত করবেন। কুরুকুলের বীররা যার শিষ্য তাকে সহজে পরাজিত করা যাবে না। শক্তিতে যে তিনি দ্রোণের সমান নন একথা সব সময় তার মাথায় ঘুরতে লাগলো। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের দুষ্টমতি পুত্র দুর্যোধন তাকে সভার মাঝে বেঁধে নিয়ে গেল-একথাও তিনি ভুলতে পারলেন না। ব্রাহ্মণের মন্ত্র ছাড়া যজ্ঞ সম্ভব নয় একথা তিনি জানেন। ব্রাহ্মণ দ্রোণকে ও দুর্যোধনকে বধ করার উদ্দেশ্যে তিনি ব্রাহ্মণদের নিয়ে যজ্ঞ শুরু করলেন। 
এভাবে ভাগীরথীর দক্ষিণদিকের রাজা হলেন দ্রুপদ ও অহিচ্ছত্রা নামে গঙ্গার উত্তরের রাজ্যের ঈশ্বর হলেন দ্রোণাচার্য। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, এক মনে শুনলে বাড়ে দিব্য জ্ঞান।
....................................

Sunday, June 1, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত -৫৭

অর্জুনের ধনুর্বেদ শিক্ষা দর্শন করিয়া রঙ্গস্থলে কর্ণের প্রবেশঃ

অর্জুনের বিদ্যা প্রদর্শন সমাধান হলে রঙ্গভূমির মাঝে কর্ণ এসে দাঁড়ালেন। স্বর্ণের মত তার অঙ্গের বর্ণ। পদ্মের মত দুই নয়ন কান স্পর্ষ করেছে। কানের কুন্ডল দুটি দীপ্ত সূর্যের মত উজ্জ্বল। অভেদ্য কবচে দেহ আবরিত। দুই দিকে দুই তূণ, বাঁদিকে ধনুক। আজানুলম্বিত বাহু। আনন্দিত কলেবর। 

সকলে তাকে বালক ক্রীড়া করতে এসেছে ভেবে অবহেলা করছিল। কিন্তু তার বাক্য শুনে সকলে চমৎকৃত হল। কেউ বলে এ দেবতার কুমার। কেউ তার রূপের প্রশংসা করে বলে সে অপ্সরা অপ্সরী অথবা দেবরাজ ইন্দ্র স্বয়ং। হঠাৎ কোথা থেকে উপস্থিত হল তা ভেবে সকলে অবাক হল। তাকে দেখতে হুড়োহুড়ি লেগে গেল। ঠেলাঠেলিতে একে অপরের উপর পরতে থাকে। তাকে দেখে লোকে বলে এসাক্ষাৎ অগ্নি। কেউবা বলে হঠাৎ সূর্য নিজে উপস্থিত হয়েছেন মঞ্চে। 

সূর্যের পুত্র কর্ণ তখন অর্জুনের দিকে তাকিয়ে গর্জন করে বলেন, অর্জুন যতগুলি বিদ্যা প্রদর্শন করেছেন তার থেকেও বেশি কর্ণ জানেন। সকলে কর্ণের বিদ্যা দেখে আশ্চর্য হবেন। কর্ণের বিদ্যাকে সংখ্যা দিয়ে গণনা করা যাবে না। 
যদিও তার কথা শুনে সকলে বিষণ্ণ হয়। কিন্তু দুর্যোধন অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে ওঠে। কর্ণের কথায় অর্জুন বিরস বদনে বসে রইলেন। 

দ্রোণ এগিয়ে এসে বলেন কি কি বিদ্যা তিনি জানেন তা সভায় প্রদর্শণ করুক। আজ্ঞা পেয়ে কর্ণ এগিয়ে এসে অর্জুন যে সকল চমৎকার দেখিয়েছিলেন সবকটি দেখালেন। সকলে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। 
দুর্যোধন সব কিছু দেখে প্রফুল্ল হলেন। অতি শীঘ্র আসন থেকে উঠে এসে কর্ণকে জড়িয়ে ধরে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। তিনি মনে করলেন কর্ণ তার ভাগ্য ফেরাতেই সভায় উপস্থিত হয়েছেন। দুর্যোধন সকলকে সাক্ষী রেখে বললেন পৃথিবীতে তার যে সকল বিষয়ে অধিকার আছে, আজ থেকে সে সবের উপর কর্ণেরও অধিকার হল। 

আনন্দিত কর্ণ সত্য অঙ্গীকার করলেন আজ থেকে তিনি দুর্যোধনের দাস হয়ে থাকবেন। কেবল একটিই নিবেদন তার আছে অর্জুনের সঙ্গে তাকে যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হোক। 

তার কথা শুনে অর্জুন ক্রোধিত হলেন এবং কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন। 
পার্থ কর্ণকে বললেন -কে তাকে সভায় ডেকেছে আর কেইবা তাকে এখানে কথা বলতে বলেছে। অনাহূত এসে সভায় দ্বন্দ্ব আহ্বান করার জন্য তাকে উচিত শাস্তি পেতে হবে। জিজ্ঞাসা না করতেই যে বলে আর নিমন্ত্রণ না করতেই যে এসে খায় –সে ঘোর পাপী হয়, তাকে নরকে যেতে হয়, আজ কর্ণকেও পার্থ সেই সাজা দেবে। 

কর্ণ বলেন - গর্ব পরিত্যাগ কর অর্জুন এবং সভা মাঝে এসে অস্ত্র ধর। বীর্য্যে যিনি অধিক তাকে রাজা বলা হয়। ধর্মবন্ত লোক বীর্যবন্তে পূজা করেন। হীনলোকের মত গালাগালি না দিয়ে অস্ত্র ধরে সভায় এসে যুদ্ধ করলে তবেই তিনি বীর বলে কর্ণ মানবেন। 
কর্ণ তাকে যুদ্ধে আহ্বান করে বললেন আজ তিনি অর্জুনের শির দ্রোণের সামনেই কাটবেন। 

একথা শুনে দ্রোণ চোখ ঘুরিয়ে অর্জুনকে যুদ্ধের জন্য আজ্ঞা দিলেন। 
গুরুর আজ্ঞা পেয়ে অর্জুন ধনুকে টঙ্কার দিয়ে মঞ্চে উপস্থিত হলেন। তার পেছনে চারভাই এসে দাঁড়ালেন, সঙ্গে রইলেন কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য এবং ভীষ্ম। 
কর্ণ ধনুঃশর নিয়ে এগিয়ে এলেন। তার সপক্ষে রইল শত কুরু সহোদর। 
এছাড়া আরো যত যোদ্ধা ছিল সকলে দুইপক্ষে ভাগ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। 
পুত্রস্নেহে গগনে ইন্দ্র উপস্থিত হলেন। মেঘেরা সকলে অর্জুনকে ছায়াদান করল। 
কর্ণের দিকে সূর্য তাপদান করলেন। 
সকলে যুদ্ধের জন্য সুসজ্জিত হয়ে উঠলেন।
সকুন্ডল বীর কর্ণকে চোখে দেখে কুন্তী আপন পুত্রকে চিনতে পারলেন। পুত্রে পুত্রে বিবাদ দেখে অনুতাপে তিনি ঘন ঘন মূর্ছা যেতে লাগলেন। 

এসময় কৃপাচার্য কর্ণকে ডেকে বললেন, এই পার্থবীর কুন্তীর পুত্র, ভুবন বিখ্যাত মহাবংশে তার জন্ম, সে আজ তোমার সঙ্গে যুদ্ধে প্রস্তুত। এবার কর্ণ তার বংশ পরিচয় দিক। সম বংশের হলে তবেই তিনি যুদ্ধের আজ্ঞা দেবেন। কারণ সমানদের মধ্যেই যুদ্ধ সুশোভন, জয়–পরাজয়ে কোন অভিমান নেই কিন্তু রাজপুত্র কখনই ইতরলোকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে না। 
কৃপাচার্য কর্ণকে তার পিতা-মাতার নাম কি এবং তিনি কোন দেশের রাজা তা জানতে চাইলেন। 

তার প্রশ্ন শুনে কর্ণ বিরস বদনে হেঁট মুখ হয়ে বসে পরলেন। বৃষ্টি হলে যে ভাবে পদ্ম ডাঁটি থেকে ছিন্ন হয় তেমনি কর্ণ্ কোন উত্তর দিতে পারলেন না। 
কৃপাচার্যের দিকে চেয়ে দুর্যোধন বললেন বিবিধ প্রকারে রাজা হওয়া যায়, শাস্ত্রে এমন বলা আছে। বংশানুক্রমে কেউ রাজা হন। আবার লোকেরা যাকে ভালবেসে পূজা করে, রাজা ভাবে -সেই প্রকৃত বীর্যবন্ত হন নিজের তেজে। সেই ব্যক্তিই প্রকৃত সৈন্যচালনা করতে যানেন, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জানেন। সেই রাজার সাথেও যুদ্ধ করা চলে-এ বিধান আছে। 
রাজা হলে পার্থ যদি যুদ্ধ করেন তবে আজ এখনই দুর্যো্ধন কর্ণকে অঙ্গদেশের রাজা করলেন। 

এই বলে তিনি অনুচরদের অভিষেক দ্রব্য আনতে নির্দে্শ দিলেন এবং কর্ণকে সোনার সিংহাসনে বসালেন। কর্ণের মাথায় রত্নমন্ডিত ছত্র ধরলেন, রাজারা দোলাতে লাগলেন। সকলে কনকাজ্ঞলি নিবেদন করলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ সকলে বিস্মিত হলেন।
কর্ণ তখন হৃষ্ট চিত্তে দুর্যো্ধনকে বললেন, তিনি কর্ণকে অঙ্গদেশের রাজা করে যে সন্মান দেখালেন তাতে কর্ণ কৃতার্থ্। দুর্যোেধন আজ থেকে যা আজ্ঞা করবেন কর্ণ তাই প্রাণপাত করে করবেন। 
দুর্যোধন বলেন সে সবের প্রয়োজন নেই। তার মনে কেবল বাসনা কর্ণ তার সখা হোন। চিরদিন তাদের সৌহাদ্য তিনি কর্ণের কাছে কামনা করেন। কর্ণের ইচ্ছাতেই আজ তা পূর্ণ হতে পারে। কর্ণ তাকে সখা বলে আলিঙ্গন করলেন। পরমস্নেহে দু’জনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন।
এ সময় অধিরথ যিনি জাতে সারথি, লোক মুখে তার পুত্র রাজা হয়েছে শুনে পুত্রকে দেখতে এগিয়ে এলেন। অতি বৃদ্ধ অধিরথ যষ্ঠি নিয়ে হাঁটেন। বৃদ্ধ দেখে সকলে পথ ছেরে দেয়। সভার মাঝে বৃদ্ধ প্রবেশ করলে কর্ণ তাকে দেখে আসন থেকে নেমে এসে বৃদ্ধের পায়ে মস্তক ঠেকিয়ে প্রণাম করেন। 
সকলে তা দেখে অবাক হন। পান্ডবরা বুঝতে পারলেন কর্ণ সূতের পুত্র। উপহাস করে ভীম কর্ণকে বললেন- তুমি অর্জুনের সাথে যুদ্ধ করতে চাও, এতক্ষণে তোমার প্রকৃত পরিচয় পাওয়া গেল -তুমি অধিরথ পুত্র। 
সভায় যে যার জাতের কাজ করা উচিত। এখনি কর্ণের অশ্বচালনার ছড়ি নিয়ে রথ চালাতে যাওয়া উচিত। 
ভীম একজন সূতপুত্রের অঙ্গদেশের রাজা হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তিনি ব্যঙ্গ করে কর্ণকে বললেন, শুনী(স্ত্রী কুকুর) যদি যজ্ঞের কাছে ভুল করে চলেও যায়, তবু সে যজ্ঞের হবিষ্য পেতে পারে না। 

তার একথা শুনে কর্ণর অধর কম্পিত হয়, নিশ্বাসের বেগ বেড়ে যায়। চোখ দিয়ে যেন অগ্নি নির্গরত হতে থাকে। দেখে মনে হল যেন স্বয়ং সূর্যদেব উপস্থিত। 
দুর্যো্ধনও ক্রোধিত হলেন। এগিয়ে এসে মেঘের মত গর্জণ করে ভীমকে বললেন সভার মাঝে তিনি কর্ণকে বন্ধু করেছেন। এসব দেখেও ভীম যে কথা বললেন তা তার যোগ্য নয়। 
ক্ষত্রিয়ের মধ্যে যিনি বলিষ্ঠ তাকেই শ্রেষ্ঠ বলা হয়। বীরের শেষকে যানে। 
যেমন আমরা জানি জলের থেকে শীতল ত্রিভূবনে কিছু নেই। অথচ এই জলেই জন্মে অগ্নি ত্রিভূবন দগ্ধ করছেন। যেমন মুনি দধীচির হাড় থেকে বজ্রের জন্ম হল, যা দৈত্যের পুত্রকে হত্যার কর্মে ব্যবহার করে দেবতারা বীর হলেন। 
তেমনি দেবকীর কার্তিকের প্রকৃত জন্ম রহস্য দৃঢ ভাবে কেউ যানেন না, কেউ বলেন তিনি শিব হতে জন্মগ্রহণ করেন কেউ বা বলেন অগ্নি তার পিতা। 
গঙ্গার পুত্রকেও অনেকে কৃত্তিকার বলেন। তাই জন্মের নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই, কারণ যারা শ্রেষ্ঠ তাদের সবাইকেই পুজা করা হয়। 
আমরা সকলেই জানি ব্রাহ্মণের মাধ্যমেই ক্ষত্রিয়ের জন্ম। আবার সেই ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণ হলেন বিশ্বামিত্র মুনি। 
তেমনি শোনা যায় কলসের মধ্যে বীর দ্রোণাচার্য জন্মেছেন এবং কৃপাচার্য শরবনে। 
তেমনি বিখ্যাত বশিষ্ঠ মুনি যে বেশ্যার(উর্বষী) পুত্র তা কে না জানে। 
ভীম তোমাদের জন্মের কথাও ভাল ভাবে জানা আছে-তুমি কোন সাহসে আমার সামনে আমার মিত্রের নিন্দা কর।
পৃথীবীতে কর্ণের মত এমন সুলক্ষণযুক্ত কেউ কি আছেন, যিনি সকুন্ডল কবচ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। কর্ণ অবশ্যই অধিরথ পুত্র নন। সকলেই প্রত্যক্ষ করছেন কর্ণ সূর্যের মতই দীপ্ত। বাঘ কখনই হরিণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন না। এই বীর কর্ণ প্রকৃতপক্ষে সমগ্র পৃথিবীর অধিপতি। তার কাছে অঙ্গদেশ সামান্য মাত্র। সকল বীর আজ থেকে কর্ণকে পূজা করবেন। আমি এবং আমার অনুগত রাজারা আজ থেকে তার মিত্র। 

যখন এসকল বাক্য সভার মাঝে দুর্যোধন বললেন তখন চারদিকে হাহাকার পরে গেল। কেউ বলেন এবার ভায়ে ভায়ে ভেদাভেদ শুরু হল। কেউ বলেন এবার যুদ্ধ শুরু হবে যা কোনদিন শেষ হবে না। কেউবা বলেন কুরুকুল আজ থেকে অস্ত হল। কেউবা তার বিরোধ করে বলেন পান্ডুকুল দুঃখে নিমজ্জিত হল।

এভাবে সূর্য অস্তাচলে গেলেন, রজনী প্রবেশ করলেন। রাজারা যে যার দেশে ফিরে গেলেন। কর্ণের হাত ধরে দুর্যোধন চললেন। তাদের সাথে চললেন একশত ভাই। পঞ্চপান্ডবও তাদের নিজস্থানে গমন করলেন। 
আর যারা এসেছিলেন সকলে যে যার পরিবারের সাথে নিজ স্থানে গমন করলেন। 

কুন্তীদেবী মনে মনে খুবই আনন্দিত হলেন এই যেনে যে তার পুত্র কর্ণ অঙ্গদেশের রাজা হলেন। দুর্যোধনও আনন্দে নির্ভয় হলেন। পূর্বে বীর অর্জুনকে দেখলে মনে মনে তিনি ভীত হতেন। কর্ণকে পেয়ে তিনি ধনঞ্জয় অর্থাৎ অর্জুন ভীতি থেকে মুক্ত হলেন। 
অন্যদিকে যুধিষ্ঠির যথেষ্ঠ ভীত হলেন কর্ণকে দেখে। কারণ তিনি বুঝলেন পৃথিবীতে কর্ণের মত বীর কমই আছে। ধর্মপুত্রের অন্তরে সর্বকালের জন্য কর্ণ ভীতি প্রবেশ করল।

আদিপর্ব ভারত ব্যাস রচনা করেছিলেন। কাশীরাম দাস তাই সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রচার করছেন। 
....................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers