Blog Archive

Saturday, July 29, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৫০

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করেন....সকল রাজারা নিজ দেশে ফিরলেও দুর্যোধন থেকে যায় ও পাণ্ডবদের হিংসা করতে থাকে ... শেষে মামা শকুনির সাথে পরামর্শ করে পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে বাধ্য করে পাণ্ডবদের পাশা খেলায় আমন্ত্রণের জন্য ... শকুনির ছলনায় যুধিষ্ঠির একে একে সব হারতে থাকেন.... পঞ্চ পাণ্ডবদের যেমন পাশা হারলেন তেমনি দ্রৌপদীকেও হেরে এ খেলা শেষ হল ... ] 



পঞ্চপাণ্ডবকে সভাতলস্থ করণঃ

সূর্যপুত্র কর্ণ আনন্দে অট্টহাস্যে বলে ওঠে –দেখ দেখ কেমন দৈবের লিখন। হে দুর্যোধন মনে পরে আমাদের সবার মাঝে তোমাকে এরা লজ্জা পাইয়েছিল, উপহাস করেছিল। আজ তার ফল পেল। সেদিন নিজ ভবনে এই ভীমার্জুন, এই মাদ্রীর দুই পুত্র তোমায় দেখে বারবার হেসেছিল। যেন তারা বাতুল(পাগল) দেখছিল। আজ তুমিও নিজ প্রাসাদে তার সোধ তুললে। 
হে যুধিষ্ঠির দৈবের লিখন দেখ আজ তোমরা সেই অধর্মের ফল পাচ্ছ। দৈব আজ তোমাদের দাস করে দুর্যোধনের পায়ে ফেলল। সবাই দেখ যুধিষ্ঠির আর তার ভাইরা আজ দুর্যোধনের দাস। দাসরা সম যোগ্য আসন পায় না। এসভায় এদের সাথে আর বসে থাকা যাচ্ছে না। 

দুর্যোধন বলে – সখা উত্তম কথা বললে। 
সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবদের দাসস্থানে গমনের আজ্ঞা হল। 

দুর্যোধন বলে ওঠে – এদের সবার দামী বস্ত্র আভরণ কেড়ে নাও। সখা কর্ণ তুমি বিচার করে এই পাঁচ দাসকে যোগ্য কর্মে নিযুক্ত কর। 

একথা শুনে দুষ্ট বৈকর্তন(সূর্যপুত্র কর্ণ) বলে –দৈবের কারণে বহুজন ভৃত্যকর্ম করে। কর্ম বিনা সংসারে কারো স্থান নেই। রাজার যেমন রাজধর্ম কাজ, ভৃত্যদেরও ভৃত্যকর্ম অনেক আছে। সখা দুর্যোধন তুমি যখন আমায় এ দায়িত্ব দিলে, অবশ্যই পালন করব। পাঁচজনকে সঠিক কর্ম দেব। 
ধর্মরাজের সুকোমল অঙ্গ, অন্যকাজে এর ক্ষমতা হবে না। একে তাম্বুল সেবার জন্য নিযুক্ত করছি। পান নিয়ে সব সময় সঙ্গে সঙ্গে ঘুরবে। 
হৃষ্টপুষ্ট বৃকোদর ভীম- বলবান পুরুষ। তাই আমার মতে একে চতুর্দোলার দায়িত্ব দেওয়া হোক। এতো ক্ষীণ জন নয়, সহজেই অনেক ভার বহন করতে পারবে। স্বচ্ছন্দে তোমাকে ও তোমার ভাইদের কাঁধে নিয়ে ভীমসেন বিভিন্ন স্থানে যেতে পারবে। 
অর্জুনের জন্য আমার অনুরোধ আছে। একে কেবল দামী বস্ত্র ও অলঙ্কার সুরক্ষার ভার দেওয়া হোক। 
আর মাদ্রীর দুই সুন্দর কুমারকে তোমার নিজের সেবায় রাখ দুর্যোধন। তারা সব সময় তোমার সাথে সাথে থাকবে। চামর নিয়ে তোমায় ব্যজন করবে। এভাবে পাঁচ ভাইকে পাঁচটি কর্মে নিযুক্ত কর। 
কৃষ্ণা দ্রৌপদীও আজ দাসী। তাকেও গৃহের কাজে নিযুক্ত করা হোক। 

দুরাচার কর্ণের এত কথা শুনে গান্ধারীকুমার দুর্যোধন হেসে বলে –সখা উত্তম বিধান দিলে। তোমার কথা আমার মনে ধরেছে। 
দুর্যোধন কৌরবদের ইঙ্গিতে পাণ্ডবদের সভাতলে বসাতে আজ্ঞা দেয়। 
সঙ্গে সঙ্গে কৌরবরা কর্কশ বচলে ‘ওঠ, ওঠ’ করে তেড়ে আসে। তারা বলে – কোন লজ্জায় এখনও সিংহাসনে তোরা বসে থাকিস! নিজেদের যোগ্য স্থানে গিয়ে বস। 
দুঃশাসন উঠে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে ধরে ‘চল, চল’ বলে পিঠে ধাক্কা মারে। ক্রোধে, অপমানে ধর্মপুত্র কাঁপতে থাকেন। চক্ষু রক্তবর্ণ, লোহ(চোখের জল) বহে ঝরঝর। 
যুধিষ্ঠিরের এমন রূপ দেখে ভীমসেন ক্রোধে থরথর কাঁপতে কাঁপতে ভৈরব গর্জনে দাঁত কড়মড়িয়ে ওঠে। দেখে মনে হয় প্রলয়কাল আগত। যুগান্তে যম যেন সৃষ্টির সংহার করবেন। অরুণ আকার চক্ষে একদৃষ্টে চায়, নাকে ঝড় বহে প্রলয় সমান। মহাবীর ভীমসেন কর্ণের দিকে চায়। তা দেখে কৌরবরা শঙ্কিত হয়ে ওঠে। হাতে গদা তুলে ভীম মাথার উপর চক্রাকারে ঘোরাতে থাকে। তার চরণ ভারে ক্ষিতি বিদীর্ণ হয়। ক্রোধমুখে ভীম দুঃশাসনের দিকে ধায়। অনুমতির জন্য ভীম যুধিষ্ঠিরের পানে চায়। যুধিষ্ঠিরকে হেঁট মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অর্জুন গিয়ে ভীমকে ধরে, বোঝাতে চায়। 

অর্জুন বলেন –ভাই অনৈতিক কাজ কিছু কর না। ধর্মরাজের অনুমতি বিনা কিছু করা সম্ভব নয়। আজ যদি দিক্‌পালদের নিয়ে দেবরাজ আসেন এবং পৃথিবীর শত শত বীর এসে ধর্মরাজকে অপমান করেন তবে মুহূর্তে আমরা তাদের যমের গৃহে পাঠাতে পারি। এরা তো সব তৃণ তুল্য। এখনই এদের দগ্ধাতে পারি। কিন্তু ধর্মরাজের আজ্ঞা বিনা আমাদের কোন শক্তি নেই। আজ ধর্মরাজ একাজের সমর্থন করছেন না, তাই আর এসব করতে যেও না। 

অর্জুনের কথায় ভীম ক্রোধ সম্বরণ করলেন, গদা ছুড়ে ফেলে দিলেন। 
পঞ্চপাণ্ডব তাদের শরীরের সকল আভরণ খুলে দিলেন। সভা ত্যাগ করে তারা ধূলাসনে অধোমুখে বসে থাকেন। 

হেনকালে দুষ্ট কর্ণ বলে ওঠে –দ্রৌপদীকে আনতে এবার দূত পাঠান হোক। 

শুনে দুর্যোধন বিদুরকে উপহাস্যে ডাকে। 
তখন অবস্থা বুঝে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র সভা ছেড়ে আপন গৃহে চলে যায়।
......................................

Saturday, July 15, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৯

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করেন....শিশুপাল কৃষ্ণকে অপমান শুরু করলে কৃষ্ণ সুদর্শন চক্রে তার প্রাণ হরণ করেন .... সকল রাজারা নিজ দেশে ফিরলেও দুর্যোধন থেকে যায় ও পাণ্ডবদের হিংসা করতে থাকে ... শেষে মামা শকুনির সাথে পরামর্শ করে পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে বাধ্য করে পাণ্ডবদের পাশা খেলায় আমন্ত্রণের জন্য ... শকুনির ছলনায় যুধিষ্ঠির একে একে সব হারতে থাকেন



ভ্রাতৃবর্গকে ও দ্রৌপদীকে পণ করণ ও যুধিষ্ঠিরের পরাজয়ঃ

শকুনি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের দিকে চেয়ে বলে –সর্বস্ব হেরেছ এবার আর কি পণ রাখবে! 

যুধিষ্ঠির বলেন – আমার অসংখ্য রত্ন এখনও আছে। চারি সিন্ধু মাঝে আমার যত ধন আছে, অযুত, নিযুত, খর্ব, মহাখর্ব, পদ্ম, শঙ্খ, করি যত অনন্ত সম্পদ সব পণ রাখছি। 

সঙ্গে সঙ্গে পাশা ফেলে শকুনি বলে – জিতে নিলাম। 

যুধিষ্ঠির বলেন –আমার পশুশালার পশুদের বাজি রাখছি। গাভী, উষ্ট্র, খর(গাধা), মেষ অগণন। 

এবারও গান্ধারপুত্র বলে ওঠে-সব আমার। 

যুধিষ্ঠির বলেন –এবার আমার শাসিত রাজ্যভূমি পণ রাখছি। ব্রাহ্মণের গৃহ ও ভূমি ছাড়া সব পণে দিলাম। 

শকুনি আবার বলে ওঠে –এবারও জিতে নিলাম। আর কিছু আছে! 

ধর্মপুত্র বলেন –আর তো কিছু ধন নেই! 

কুমারদের অঙ্গের যত অলঙ্কার ছিল সব পণ করে শকুনি তাও জিতে নিল। তা দেখে ধর্মনৃপমণি যুধিষ্ঠির চিন্তিত হলেন। 

শকুনি বলে ওঠে –এবার বিচার করে বল কি পণ রাখবে! 

অনেক ভেবে যুধিষ্ঠির বলেন –আমার ভাই নকুল সুধীর, যিনি এই পৃথিবীতে কামদেব তুল্য তনুর জন্য সুবিখ্যাত। যার সিংহের মত গ্রীবা, পদ্মপত্র যুগল নয়ন। সেই নকুলবীরকে পণ রাখছি। 

কপট শকুনি বলে –আহা প্রিয় ভাই যদি, তবে পাণ্ডুর এ সুন্দর কুমারকে কি ভাবে পণে দিচ্ছ! 
এই বলে পাশা ফেলে নকুলকেও জিতে নিল। 

যুধিষ্ঠির এবার বলে ওঠে –ধর্মজ্ঞ সুপণ্ডিত সহদেব আমার পরম প্রিয় জগৎ বিদিত। এবার তাকে বাজি রাখছি। 

গান্ধার নন্দন শকুনি বলে ওঠে –তাকেও জিতে নিলাম। 
চতুর কপট শকুনি বলে – আর কি পণ করার আছে, হে নৃপমণি! বৈমাত্রের ভাইদের তো বাজিতে হেরে বসলে। ভীমার্জ্জুনকে কি পণ রাখতে পারবে! বিশ্বাস তো হয় না। 

ধর্মরাজ বলেন –মামা আপনার মন কালিমালিপ্ত, তাই আমাদের ভাইয়েদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করছেন। আমরা পাঁচ ভাই এক প্রাণ। না জেনে আপনি এমন কুবাক্য বললেন। 

ভীত শকুনি সবিনয়ে বলে ওঠে –হে রাজা, পাশা খেলায় মত্ত হয়ে অন্যায় বাক্য বলে ফেলেছি। আপনি মানবকুলে শ্রেষ্ঠ, আমি গরিষ্ঠ অধম। আমায় ক্ষমা করে দিন। 

যুধিষ্ঠির আবার খেলায় ফেরেন। এবার রাজা বলেন –তিন লোক খ্যাত আমার এ সহোদর ধনঞ্জয় অর্জুন। যিনি অবহেলায় দেবরাজকেও জয় করেন। অগণিত গুণে যিনি পৃথিবী বিখ্যাত। সেই ভাইকে এবার পণ রাখছি। যানি ইনি পণ যোগ্য নন। তবু এই দ্যূত ক্রীড়ার কারণে তাকে বাজি ধরলাম। 

সঙ্গে সঙ্গে শকুনি বাজি ফেলে বলে ওঠে –জিতে নিলাম। 
অর্জুনকে জিততেই কৌরবদের মধ্যে আনন্দলহরী ওঠে। 

যুধিষ্ঠির বলেন –এবার আমি পণ রাখছি আমার সেই ভাইকে যার তুল্য বলশালী মনুষ্যলোকে নেই। ইন্দ্র যেমন দৈত্যদের থেকে দেবতাদের রক্ষা করে চলেছেন, সেইমত এই ভীমসেন পাণ্ডুপুত্রদের সর্বদা রক্ষা করেছেন। এ পাশায় ইনিও পণ যোগ্য নন, তবু দৈব্য নির্বন্ধ। 

শকুনি এবার গর্জে ওঠে –এই পাশা ফেলে তাকেও নিলাম, মহারাজ! আর কি আছে আপনার পণ করুন। 

এত শুনে যুধিষ্ঠির বলেন –এখন কেবলমাত্র আমিই আছি। আমি নিজেকে পণ রাখছি। 

তাকেও জিতে শকুনি বলে –হে কুন্তীকুমার বড়ই পাপ কর্ম করে চলেছ। এবার দ্রুপদ কুমারীকে পণ রেখে নিজেকে উদ্ধার কর। নিজেকে উদ্ধার করলে অমন বহু নারী আবার তোমার হবে। 

রাজা যুধিষ্ঠির বলে ওঠেন – মামা আপনার এ কথা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কিভাবে দ্রৌপদীকে পণ রাখতে পারি! লক্ষ্মী রূপিণী, অসংখ্য গুণের অধিকারী, যিনি সব সময় সকলকে তুষ্ট রাখার কাজে ব্রতী। এই রাণী দ্রৌপদী-যিনি সকল দ্বিজ, ক্ষত্রিয়, দাস, দাসী, পশু, পাখী সবাইকে জননী রূপে প্রতিপালন করেন, ভালবাসেন-সেই স্ত্রীকে পণ রাখার মত দুর্মতি এখনও আমার হয় নি। 

কপট শকুনি বলে ওঠে –ঠিক বলেছেন রাজা। আপনার এই গৃহিণী সাক্ষাৎ লক্ষ্মীর অবতার। তার ভাগ্যেই হয়ত আপনার পাশা উল্টে যাবে। যা কিছু হেরেছেন এবার ফিরে পাবেন। এর ভাগ্যেই সব উদ্ধার হতে পারে। 

বিপদে পরলে বিদ্যান পণ্ডিতও বুদ্ধি হারায়। শকুনির কথা শুনে যুধিষ্ঠিরের মন পরিবর্তিত হল। 
তিনি বলে ওঠেন – মামা ঠিক বলেছেন, এবার আমি আমার লক্ষ্মীকেই পণ স্থির করছি। 

একথা শুনেই দুষ্ট শকুনি পাশা ফেলে অট্টহাস্যে বলে ওঠে – জিতেছি, জিতেছি। 
শুনে দুর্যোধন, কর্ণ সকলে আনন্দে ফেটে পরে। মহা আনন্দে কৌরবরা খলখল করে হাসতে থাকে। 
সভাসদরা সব দেখে শুনে আশ্চর্য হয়। 
ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপের নয়ন সজল হয়ে অঠে।বিমর্ষ বিদুর অধোমুখে বসে থাকেন। 
জ্ঞানবন্ত জন মহাশোকে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। 

হৃষ্ট চিত্তে অন্ধ রাজা চেঁচিয়ে ওঠেন –কে জিতল, কে জিতল! 
বহুকালের লুকিয়ে রাখা কুটিল মনকে আজ আর অন্ধ রাজা গোপন করতে পারলেন না। 

এভাবে সব কিছু হেরে গেলেন ধর্মরায় যুধিষ্ঠির। 

সভাপর্বের এই সুধারস গান কাশীরাম দাস।

......................................

Saturday, July 1, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৮

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করেন....শিশুপাল কৃষ্ণকে অপমান শুরু করলে কৃষ্ণ সুদর্শন চক্রে তার প্রাণ হরণ করেন .... সকল রাজারা নিজ দেশে ফিরলেও দুর্যোধন থেকে যায় ও পাণ্ডবদের হিংসা করতে থাকে ... শেষে মামা শকুনির সাথে পরামর্শ করে পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে বাধ্য করে পাণ্ডবদের পাশা খেলায় আমন্ত্রণের জন্য ...] 


যুধিষ্ঠিরের সহিত শকুনির দ্যূতক্রীড়া ও শকুনির জয়ঃ

পরদিন প্রভাতে পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র আনন্দিত মনে নব নির্মিত সভায় প্রবেশ করলেন। একে একে সকলের সাথে কুশল সম্ভাষণ করে তারা কনক সিংহাসনে বসলেন। শকুনি তখন তার পাশা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হল। 

শকুনি বলে – হে ধর্ম নৃপমণি মহারাজ যুধিষ্ঠির পুরুষদের মনোরম দ্যূতক্রীড়ার সূচনা করুন। 

যুধিষ্ঠির বলেন –পাশা খেলা সব অনর্থের মূল। এ খেলার মাধ্যমে ক্ষত্রিয়ের পরাক্রম প্রদর্শন হয়না। এ খেলায় কপটতা আছে। এই অনীতি ক্রীড়ায় আমার মনের সায় নেই। 

শকুনি বলে –রাজা, পাশা খেলায় বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পাশা খেলা অথবা যুদ্ধ করা। যুদ্ধে জাতি অজাতির বিচার চলে না। সেখানে হীন জাতীর প্রহারও সইতে হয়। কিন্তু পাশা সম মন ও সম বুদ্ধির সমর। মুনিরাও বলেন ক্ষত্রিয়েরা পাশা খেলতে পারে। 

যুধিষ্ঠির বলেন –পাশা শঠতার খেলা। মামা আপনি অধর্ম করে আমায় জেতার চেষ্টা করবেন না। 

শকুনি বলে –রাজন এত ভয়! তবে আপনি নিজ স্থানে ফিরে যান। পণ্ডিতে পণ্ডিতেই এ ক্রীড়া সম্ভব। আপনার যদি দ্যূতক্রীড়ায় মন না চায় তবে এখনই গৃহে ফিরে যান। 

যুধিষ্ঠির বলেন –আমায় যখন ডেকে পাঠিয়েছেন, তখন আমি খেলব। সত্যের পথ থেকে সরে যাব না। এ সভায় কার সাথে আমার খেলা! পণ কে দেবে! মেরুতুল্য সম্পদ আমার, চার সমুদ্রের সমান রত্ন আমার ভান্ডারে। 

দুর্যোধন বলে –আমার হয়ে মাতুল শকুনি খেলবেন। মামা যত রত্ন হারবে সব আমি দেব। 

এভাবে সভার মাঝে শকুনি ও যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে বসল। মনে অসন্তোষ নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য এবং বিদুর ও অন্যান্য সভাসদরা ক্রীড়া দেখতে লাগল। 

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলেন –আমি পণ রাখছি আমার ইন্দ্রপ্রস্থের সকল রত্নের ভান্ডার। হে দুর্যোধন সে পরিমান ধন কি তোমার আছে! কোথা থেকে সে পণ তুমি দেবে! 

দুর্যোধন বলে –আমারো অনেক সম্পদ আছে। আমাদের জিতলে অবশ্যই সব আমি তোমায় সমর্পণ করব। 

সারি নির্ণয় করে শকুনি তখন পাশা ফেলল এবং এক কটাক্ষে সব রত্ন জিতে নিল। 

ক্রোধে যুধিষ্ঠির পুনরায় পণ করলেন – আমার কোটি কোটি সব মহা বলশালী অশ্ব বাজি রাখছি। 

শকুনিও সাথে সাথে হেসে পাশা ফেলে বলে –এই সব জিতে নিলাম। এবার কি পণ করতে চান! 

যুধিষ্ঠির বলেন –আমার অগণিত রথ আছে, সে সব নানা রত্নে বিভূষিত। মেঘের মত তাদের গর্জন। তাই পণ রাখছি। 

শকুনি হেসে পাশা ফেলে বলে – দেখুন সে সবও জিতে নিলাম। এবার অন্য পণ রাখুন। 

ধর্মরাজ বলেন –আমার ইষদন্ত মহাকায় দুর্নিবার হস্তিবৃন্দ পণ রাখছি। 

এবারও শকুনি বলে ওঠে –জয় করলাম। 

যুধিষ্ঠির বলেন – নানা রত্নে সজ্জিতা সহস্র সুন্দরী দাসী আছে, যারা ব্রাহ্মণের সেবায় ব্রত, তাদের পণ দিচ্ছি। 

শকুনি পাশা ফেলে হেসে ওঠে –ওহে এবার আর কিছু পণ রাখ। তারাও আমার হল। 

ধর্মপুত্র বলেন –আমার অগণন গন্ধর্ব অশ্ব আছে, যাদের সাথে সারা ভুবন ভ্রমণ করলেও এতকুটু কষ্ট হয় না। চিত্ররথ গন্ধর্ব আমায় উপহার দেন। এবার তাদের পণ রাখছি। 

হেসে সুবলপুত্র শকুনি বলে –অশ্ব সব জিতে নিলাম। 

যুধিষ্ঠির বলেন –আমার যত দুর্ধর্ষ যোদ্ধা সৈনিক আছে তাদের পণ দিচ্ছি। 

গান্ধার নন্দন শকুনি সামান্য হেসে সে সবও জয় করল। 

এভাবে কপট শকুনি একে একে সব জয় করতে থাকে। অন্যদিকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সব ধন একে একে হারাতে লাগলেন। 
................................................

ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি বিদুরের উক্তিঃ 

সব দেখে শুনে বিদুর ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। 
বিদুর রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বলেন –হে রাজন, আমার কথা আপনার একটুও মন নেয় না! মৃত্যুকালে যেমন রূগী ওসুধ খেতে চায় না। 
হে অন্ধরাজা আপনি এখনও স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন! জন্মমাত্র যখন আপনার এই পুত্র খর(গর্দভ)শব্দ করেছিল তখনই আমি বলেছিলাম কুরুকুলের ক্ষয় করতে এর জন্ম। একে ত্যাগ করুন। আমার কথা শুনলেন না। এখন তার ফল সে দেখাচ্ছে। সংহার রূপে এ আপনার ঘরে আছে। স্নেহে অন্ধ হয়ে এর দোষ আপনি দেখতে পান না। দেব গুরু নীতি রাজা আমি আপনাকে বলি। মধুর কারণে মধুলোভীরা বৃক্ষোপরে ওঠে। মধুর নেশায় তারা পতনের ভয় ভুলে যায়। আপনার এ পুত্র দুর্যোধনও সেরূপ আজ মত্ত। এভাবে মহারথীদের সাথে শত্রুতা করছে। আজ আমার কথা না শোনার ফল পরে আপনি বুঝবেন। এর মত কংসভোজ জন্মেছিল। সে দুষ্টও মত্ত হয়ে পিতার বংশ নাশ করেছে। সকলে তাকে ত্যাগ করে। শেষে গোবিন্দের হাতে তার সংহার হয়। 
হে রাজন, গোবিন্দের সাথে সখ্যতা রাখলে সপ্তবংশ সুখে থাকবেন। আমার বাক্য শুনুন মহারাজ! এখনই পার্থ অর্জুনকে আজ্ঞা দিন, সে দুর্যোধনকে পরাজিত করে বন্দি করুক। তারপর নির্ভয়ে পরম সুখে রাজকার্য করুন। এভাবে কাকের হাতে ময়ূরের অপমান হতে দেবেন না। এতো শিবার(শেয়াল) হাতে সিংহের অপমান। এভাবে শোক সিন্ধুর মাঝে নিজের পতন ঘটাবেন না। যে পক্ষী অমূল্য রত্ন প্রসব করে মাংস লোভে বিজ্ঞজনরা কখনই তাকে খায় না। রাজা, সোনার বৃক্ষ যত্ন করে রোপণ করে রক্ষা করলে পরে দিনে দিনে সুন্দর পুষ্প পেতেন। 
হে নরপতি যা হয়ে চলেছে এখনই তা বন্ধ করুন। নিজ পুত্রদের কেন যমের অতিথি করছেন! এই পঞ্চপাণ্ডবের সাথে কার যুদ্ধ করার ক্ষমতা আছে শুনি! পাণ্ডবদের আজ যে শক্তি, যে ক্ষমতা – দিক্‌পাল সহ বজ্রপাণি ইন্দ্র এলেও পরাজিত হবেন। 
হে ভীষ্ম, হে দ্রোণ, হে কৃপ-কেউ তো আমার কথা শুনুন! সবাই মিলে নত মস্তকে এই অন্যায় হতে দেখে যাচ্ছেন! 
হে বীর, এভাবে অগাধ সমুদ্রে অবহেলায় নৌকা ডোবাবেন না। এভাবে তো সবাই মিলে দেখছি যম গৃহে যেতে চলেছেন। 
অক্রোধী, অজাতশত্রু আমাদের এই যুধিষ্ঠির রাজন। কিন্তু যখন ভীম ও ধনঞ্জয় অর্জুন ক্রুদ্ধ হবে, সেই যুগল যখন ক্রোধে সংহার শুরু করবে তখন কে প্রবোধ দেবে তাদের! 
হে অন্ধরাজা, পাশার ছলনায় সব নেবার কি ছিল। আজ্ঞামাত্র তো ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সব আপনাকে নিবেদন করত। এই শকুনিকে আমি ভাল মত চিনি। কপট, কুবুদ্ধি, খলচূড়ামণি। কোথায় পর্বতপুরে এর নিবাস, কিন্তু সর্বনাশ করতে এখানে পরে আছে। একে এক্ষুনি বিদায় করুন, নিজ গৃহে ফিরে যাক। 
হে শকুনি উঠে এস, পাশা ত্যাগ কর। 

বিদুরের এত কথা শুনে দুর্যোধন ক্রোধিত হল, যেন আগুনে ঘৃত ঢালা হল। 
দুর্যোধন গর্জন করে বলে –আমরা তোমার কথা শুনব না। কার হয়ে তুমি এত কথা সভা মাঝে বলছ! তুমি সর্বদা পিতা ধৃতরাষ্ট্রের হানি চেয়েছ। সবাই যানে পান্ডুর ছেলেরা তোমার অতি প্রিয়। আমি আমার ধারে কাছে শত্রুহিতকারীদের রাখতে চাই না। তুমি এই সভা থেকে উঠে যেখানে খুশি যেতে পার। এখানে থাকার যোগ্য তুমি নও। কুজনকে যত্ন করে রাখলেও সে অসৎ পথে গমন করবেই। সভার মাঝে তুমি যে সব কথা বললে অন্য কেউ হলে আজ তার প্রাণের আশা থাকত না। আমি তোমায় যত সম্মান করি, তুমি ততই আমায় আনাদর কর, জ্ঞানহীন ভাব। সভা মাঝে এমনভাবে কথা বলছ যেন তুমি এখানকার প্রভু! কেউ তোমার মত এমন কদর্য আচরণ করবে না। 

বিদুর বলেন –আমি তোমায় কিছু বলছি না। হে ধৃতরাষ্ট্র আপনার দুঃখ দেখে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। দুর্যোধন তোমায় আর কি বলব। ধৃতরাষ্ট্র আমার কোন কথাই শুনলেন না। হতায়ু(আয়ু যার শেষ) জন কখনও হিতের কথা শোনে না। তুমি আমায় কি কথা বলতে আসছ! নিজের সমকক্ষ কাউকে এসব কথা বল। 

এত বলে ক্ষত্তা বিদুর চুপ করে গেলেন। 

সুবলপুত্র শকুনি আবার পাশা খেলা শুরু করল।
......................................

Saturday, June 17, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৭

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করেন.....ভীষ্মের পরামর্শে যুধিষ্ঠির সকলের শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের পূজা করতে গেলে চেদিরাজ শিশুপাল তীব্র প্রতিবাদ করে কৃষ্ণ নিন্দা করতে লাগল .....ভীষ্ম শিশুপালের জন্মকথা সবাইকে বলেন... কৃষ্ণ শিশুপালের মাকে তার একশত অন্যায় ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দেন . ....... শিশুপাল কৃষ্ণকে অপমান শুরু করলে কৃষ্ণ সুদর্শন চক্রে তার প্রাণ হরণ করেন .... সকল রাজারা নিজ দেশে ফিরলেও দুর্যোধন থেকে যায় ও পাণ্ডবদের হিংসা করতে থাকে ......] 



পাশা খেলিবার মন্ত্রণাঃ

রাজা জন্মেজয় বলেন – কহ মুনিবর শুনি কি ভাবে পাশাখেলা অনর্থ আনল। পিতামহ পিতামহী যে কারণে এত দুঃখ পেলেন সেই খেলা কে কে নিবৃত্ত করতে চাইল, আর কেই বা প্রবর্ত্তিল(রত/নিযুক্ত)। যে পাশাখেলা থেকে বিখ্যাত ভারত-সমর(যুদ্ধ) হল সেই ক্রীড়াসভায় কে কে উপস্থিত ছিল। 

মুনি বলেন – শুনুন পরীক্ষিত পুত্র ক্ষত্তার(বিদুর) বাক্য শুনে অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র চিন্তিত হলেন। তিনিও মনে মনে দৃঢ় ভাবে জানলেন কাজটি সঠিক হচ্ছে না। 
চিন্তিত রাজা পুত্র দুর্যোধনকে একান্তে ডেকে বলেন – হে পুত্র তুমি এ পাশা খেল না। বিদুর এ খেলা সুনজরে দেখছে না। সুবুদ্ধি বিদুর কখনো আমার অহিত চায় না যেন। তার বাক্য না শুনলে পরে কষ্ট পেতে হবে। দেবতাদের রাজহিতে দেব পুরোহিত যেমন বৃহস্পতি, তেমনি ক্ষত্তা আমার হিতাকাঙ্ক্ষী নিশ্চিত ভাবে যেন। ক্ষত্তা বিদুরের মন্ত্রণা গুরুর অধিক মেন। বিচক্ষণ ক্ষত্তা কুরুবংশের শুভাকাঙ্ক্ষী। সুরকুলে(দেবকুলে) বৃহস্পতির যে স্থান, বৃষ্ণিকুলে(যদুবংশে) সুবুদ্ধি জ্ঞানদাতা উদ্ধবের যে স্থান, কুরুকুলে ক্ষত্তা বিদুরেরও সে স্থান। তার মতে পাশাখেলা অনর্থ ঘটাবে। এই দ্যূতক্রীড়ার মাধ্যমে ভেদাভেদ শুরু হবে। 
হে পুত্র, ভাতৃভেদ সর্বনাশ আনবে-বিদুরের এ বাক্য শুনে আমার মনে আশঙ্কা হচ্ছে। পুত্র, পিতামাতাকে যদি মান্য কর তবে আমার কথা শোন, এ পাশা খেলা বর্জন কর। 
পুত্র তুমিও পণ্ডিত, কি কারণে তবে পান্ডুর পুত্রদের হিংসা করছ! কুরুকুলে যুধিষ্ঠির জ্যেষ্ঠ এবং সকল দিকদিয়ে শ্রেষ্ঠ। এই হস্তিনানগর কুরুকুলের রাজধানী। যুধিষ্ঠির এখানে থাকতে তুমি তাকে যা দিলে যেটুকু দিলে তাই নিয়ে তারা পাঁচ ভাই সন্তুষ্ট হয়ে গেল। এখন তো পুত্র তোমার বৈভব ইন্দ্রের সমান। নরযোনিতে জন্মে কার এত সম্পদ সম্ভব! তাও কিসের জন্য তোমার এত অনুশোচনা, কিসের জন্য উদ্বিঘ্ন! 

দুর্যোধন বলে –পিতা আমি সমর্থ পুরুষ। শত্রুকে দেখিয়ে অহঙ্কার যদি না করি তবে কাপুরুষ গণ্য হব। বিশেষ করে আমার বন্ধুদের আপনি চেনেন। আমার যে সম্পদের কথা আপনি বললেন এমন বহুজনের আছে। কিন্তু আজ কুন্তীপুত্রদের লক্ষ্মী যেন দীপ্ত হুতাশন(আগুন)। তা দেখেও আমি যে এখনও প্রাণে বেঁচে আছি এতেই আমি ধন্য। 
হে পিতা, পৃথিবী জুড়ে আজ পাণ্ডবদের যশ কীর্তন হচ্ছে। সকল রাজা আজ তাদের বশে। যদু, ভোজ, অন্ধক, কুক্কুর, অঙ্গ, কারস্কর, বৃষ্ণি-এই সাতটি বিখ্যাত বংশ তাদের মিত্র সঙ্গ। যুধিষ্ঠিরের কথামত কৃষ্ণ সদা খেটে চলেছেন। সমস্ত ভূপতি রাজারা করপুটে তাকে কর দিচ্ছে। আর পান্ডবরাও ইচ্ছে করে সব ধন সম্পদ আমার কাছে রাখতে দিল। পিতা যে সব রত্নের নামও কখনো শুনিনি, সে সবও দেখে এলাম যুধিষ্ঠিরের পুরীতে। নানাবর্ণের নানা রত্নের সে সব সম্পদ কোনটা গিরিপর্বতে, কোনটা বা সিন্ধু মধ্যে উৎপন্ন। তাদের সবার কথা বলে শেষ করা যায় না। ধরার মধ্যে, বৃক্ষের মধ্যে, জীবের অঙ্গেতে যত রত্ন আছে আজ সব তা যুধিষ্ঠিরের ভান্ডারে জমা হচ্ছে। লোমজ(লোমজাতীয়), পট্টজ(রেশমাদি), চীর(গাছের ছাল) বিবিধ বসন, গজদন্ত বিরচিত দিব্য সিংহাসন; হস্তী, অশ্ব, উট, গাধা, মেষ আর অজা(ছাগল) নানাবর্ণের এনে দিল নানা দেশীয় রাজা। 
শ্যামলা তরুণী, দিব্যরূপা দীর্ঘকেশী সহস্র দাসী নানাবর্ণে ভূষিতা হয়ে ঘুরছে, দেখতে দেখতে আমার মনে ভ্রম হল। সেই সুযোগে পাণ্ডবরা আমার অপমান করল। 
মায়া সভার মধ্যে আমি কিছু দেখতে পাইনি, সবই স্ফটিকের বেদী মনে হয়েছে। জল ভেবে বসন গোটাতে দেখে সভার সকলে হেসে উঠল। সেখান থেকে কিছু দুরেই ছিল জলাশয়, তাকে স্ফটিক ভাবায় সবস্ত্র মহাশব্দে সেখানে পড়লাম। চারদিকে লোক হাসতে লাগল। তাদের সাথে ভীম, ধনঞ্জয় অর্জুন, অন্যদিকে দ্রৌপদীও পুরনারীদের নিয়ে হাসছিল। এভাবে সবাই আমায় উপহাস করল। শেষে যুধিষ্ঠির কিঙ্করদের(কাজের লোক) দিয়ে বাপী(দীঘি) থেকে তুলে অন্য বস্ত্র পরাল। 
হে পিতা এত অপমান কে সহ্য করে! আরও কত শুনতে চান, আপনি! এরা ইচ্ছে করে স্থানে স্থানে স্ফটিকের প্রাচীর নির্মাণ করেছে। দ্বার ভেবে বেরতে গিয়ে এত জোর মাথায় আঘাত লাগল যে মাটিতে উল্টে পরে গেলাম। মাদ্রীর দুই পুত্র দ্রুত এসে আমায় তুলে খুব দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। আমার হাত ধরে দুয়ার দেখিয়ে দিল। এসব অপমান পিতা আর সহ্য হয় না। আমি এই হীন পাণ্ডবদের এত অপমান আর সহ্য করব না। হয় তাদের লক্ষ্মী কেড়ে নেব নয় প্রাণ দেব। 

ধৃতরাষ্ট্র বলেন – পুত্র হিংসা বড় পাপ। হিংসক জনের পুত্র জন্মে বড় কষ্ট নিয়ে। অহিংসক পান্ডবদের হিংসা কর না। একটু শান্ত হয়ে ধৈয্য ধরে থাক দেখবে প্রশংসা পাবে। তাদের মত যদি যজ্ঞ করতে চাও বল। আমি এখনই সকল রাজাদের নিমন্ত্রণ পত্র পাঠাচ্ছি। আমাকে সকল নৃপ সম্মান করেন। তারা আরও অধিক রত্ন আমাদের পাঠাবেন। আমার এ কথা শোন। 
হে পুত্র, অসৎ মার্গে গেলে তোমার সাথে পুর সংসার রসাতলে যাবে। স্বধর্মে থেকে যে সদা মনকে সন্তুষ্ট রাখে সেই পরের দ্রব্য দেখে হিংসা পরিত্যাগ করতে পারে। পরোপকারীরা স্বকর্মে সব সময় উদ্যোগী থাকে তাই দুঃখ তাদের স্পর্শ করে না, সদা সুখে থাকে। আর পান্ডু পুত্রদের পর ভাবছ কেন, তারা তোমার আপন। তাদের কখন হিংসা দ্বেষ কর না। 

দুর্যোধন বলে –পিতা আমি প্রজ্ঞাবান(তত্ত্বজ্ঞানী) নই। আমি অত শাস্ত্রের কথা বুঝি না। চাটু কি যানে পিষ্টকের(পিঠে) স্বাদ। আমি যানি শুধু শত্রুকে কখনো বিশ্বাস করা যায় না। যেমন নমুচি দানবের সহস্রলোচন ইন্দ্রকে করা উচিত হয় নি। এক পিতার থেকেই তাদের উৎপত্তি। বহুকাল তারা একসাথে খুশি ছিল। তবু ইন্দ্র তাকে সংহার করে। এভাবে নিষ্কণ্টক হয়ে অদিতিকুমার সব একাই ভোগ করতে থাকে। এভাবে সামান্য শত্রুকেও নাশ করতে হবে। মূলস্থ বল্মীক(উই) যেমন পুর তরুকে গ্রাস করে। জ্ঞাতি মধ্যে যে জন ধনে জনে বলবান ক্ষত্র মধ্যে তাকেই প্রধান শত্রু মানি। আপনি সব যেনেও আমাকে বঞ্চিত করতে চান। বুঝেছি পিতা আপনি আমার নিধন চান। 

পুত্রস্নেহে অন্ধ রাজা অনেক বোঝাতে চেয়েও পারলেন না। শেষে বিদুরকে ডেকে বলেন – তুমি দ্রুত গিয়ে যুধিষ্ঠিরদের নিয়ে এস। 

বিদুর বলেন –রাজা এটা ঠিক হচ্ছে না। কুলের নাশ হবে ভেবে আমি শঙ্কিত হচ্ছি। 

অন্ধ রাজা বলেন –হে বিদুর, আমার আর কিছু করার নেই। এ সংসার যেন দৈবের বশ, আমিও তার অধিন। 

বিদুর রাজাজ্ঞা অবহেলা করতে পারলেন না। রথে চড়ে ইন্দ্রপ্রস্থের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলেন। বিদুরের আগমনে পাণ্ডবরা খুশি হলেন। যথা নিয়মে তাকে আহ্বান জানান হল। 

যুধিষ্ঠির বলেন – হে তাত, কি সমাচার আছে বলুন। আপনাকে অন্যমনস্ক ও চিন্তিত লাগছে কেন! 

বিদুর বলেন –রাজা ধৃতরাষ্ট্র আপনাদের হস্তিনাপুরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি যা বলি মন দিয়ে শুনুন। সেখানে আপনাদের সভার সমান সভা নির্মাণ হচ্ছে। সে সভা দেখার জন্য এ আমন্ত্রণ। সেখানে দ্যূত আদি ক্রীড়ারও আয়োজন হচ্ছে। সে সব কারণেই আমাকে পাঠান হয়েছে। 

যুধিষ্ঠির বলেন –দ্যূত ক্রীড়া সব অনর্থের মুল। জ্ঞানভ্রষ্টরা এই খেলায় মাতে। তবু আমি এ আমন্ত্রণ শিরধার্য করছি। আমায় কি করতে হবে আজ্ঞা দিন, তাত! 

বিদুর বলেন – রাজা আপনি ঠিক বলেছেন পাশা অনর্থের মূল। এই খেলা কুল ভ্রষ্ট করে। অন্ধ রাজাকে অনেক বলেও বোঝানো গেল না। তবু তিনি আমায় পাঠালেন। হে রাজন, আপনি যথেষ্ঠ বুদ্ধিমান, ভেবে চিন্তে যা শ্রেয় মনে করেন করুন। আপনার ইচ্ছে না হলে সেখানে গিয়ে কাজ নেই। 

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলেন – হে কুরুপতি আজ্ঞা দিন। গুরু আজ্ঞা ভঙ্গ করলে নরকে যেতে হবে। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম আপনি যানেন তাত। দ্যূতে বা যুদ্ধে কেউ আহ্বান যানালে পিছনর স্থান নেই। আমিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কেউ যুদ্ধে বা দ্যূতে আহ্বান জানালে তাকে ফিরাব না। 
এই বলে যুধিষ্ঠির ভাইদের নিয়ে দ্রৌপদীকে সব জানাতে গেলেন। 

দৈব যেমন মানুষকে বেধে ঘোরায় তেমনি ক্ষত্রা দ্রৌপদী সহ পাঁচভাই হস্তিনাপুরে পৌছালেন। সভায় ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, সোমদত্ত সহ অন্তপুরের গান্ধারী ও সকলকে তারা একে একে সম্ভাষণ করেন। 
সে রাতে পঞ্চপাণ্ডব সুখে হস্তিনাপুরে কাটালেন।
......................................

Sunday, June 4, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৬

[পূর্বকথা যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... যথাকালে যুধিষ্ঠির যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করলেন.....ভীষ্মের পরামর্শে যুধিষ্ঠির সকলের শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের পূজা করতে গেলে চেদিরাজ শিশুপাল তীব্র প্রতিবাদ করে কৃষ্ণ নিন্দা করতে লাগল .....ভীষ্ম শিশুপালের কৃষ্ণ নিন্দার বিরোধ করলেন .....শিশুপাল ভীষ্মকেও অপমান করতে থাকে.. ... ভীষ্ম শিশুপালের জন্মকথা সবাইকে বলেন... কৃষ্ণ শিশুপালের মাকে তার একশত অন্যায় ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দেন . ....... শিশুপাল কৃষ্ণকে অপমান শুরু করলে কৃষ্ণ সুদর্শন চক্রে তার প্রাণ হরণ করেন ..........] 


দুর্যোধন

যজ্ঞান্তে দুর্যোধনের গৃহে গমনঃ 

রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হলে সকল রাজারা নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন। 

দেব নারায়ণ কৃষ্ণ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে বলেন –রাজা, আজ্ঞা দিন এবার দ্বারকায় ফিরি। আমি সৌভাগ্যবান যে আপনার যজ্ঞ সুসম্পন্ন হল তা চাক্ষুস করতে পারলাম। এবার অপ্রমাদে(ভয়শূণ্য হয়ে) রাজ্য শাসন করুন, প্রজা পালন করুন, সুহৃদ কুটুম্বদের আদর যত্ন করুন। 
এত বলে দেব নারায়ণ ধর্মরাজের সাথে কুন্তীর কাছে উপস্থিত হলেন। 

কুন্তীকে প্রণাম করে কৃষ্ণ বলেন –আপনার পুত্রদের সাম্রাজ্য লাভ সুসম্পন্ন হয়েছে, আজ্ঞা করুন এবার দ্বারকায় যাই। 

কুন্তী বলেন –যাদের উপর অচ্যুত(যিনি নিজের পদ থেকে চ্যুত হন না) কৃষ্ণের কিঞ্চিৎ দয়া আছে তাদের কাছে এ আর এমন কি! 
এই বলে তিনি কৃষ্ণের শির চুম্বন করলেন। হরি কুন্তীর চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করেন। 

এরপর দ্রৌপদী ও সুভদ্রাকে সম্ভাষণ করে একে একে পাঁচ ভাইকে বিদায় আলিঙ্গন জানিয়ে শুভক্ষণে রথে চড়ে দ্বারাবতীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। 
কৃষ্ণের বিচ্ছেদে যুধিষ্ঠির বড়ই ব্যাথিত হলেন। 

ধিরে ধিরে সকলে সে যার দেশে চলে গেল। তবে ইন্দ্রপ্রস্থে রয়ে গেল মামা-ভাগ্নে শকুনি-দুর্যোধন। তাদের বড় সাধ ভাল ভাবে ঘুরে ঘুরে ধর্মরাজের সভা দেখার। দুর্যোধন শকুনির সাথে নিত্য সভার মনোহর দিব্য অনুপম আলোক অবলোকন করে। নানা রত্নে খচিত এযেন দেবতার পুরী। দেখতে দেখতে কুরুরাজ দুর্যোধন বিস্ময়াপন্ন হয়। সকল গৃহ অমূল্য রত্নে মণ্ডিত। এদের এক গৃহের তুল্যও নয় সমগ্র হস্তিনাভুবন। এসব ভেবে ভেবে অন্তরে অন্তরে সে দগ্ধ হতে থাকে। 
এর মধ্যে দৈবের লিখন এক অঘটন ঘটল। মাতুল শকুনির সাথে দুর্যোধন ঘুরছিল। সামনে এক স্ফটিকের বেদী দেখে তাকে সরোবর ভেবে সে জলে নামবে ভেবে পায়ের বসন গুটিয়ে বেদীর কাছে গিয়ে লজ্জিত হয়। দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে এলেও লজ্জা মলিন মুখ থরথর কাঁপতে থাকে। 
এবার স্ফটিকের বাপী(দীঘি) চিনতে না পেরে সবসনে ভুল করে বাপীতে পড়ে। তা দেখে সভার সকলে হাসতে লাগল। তাদের সাথে ভীমসেন, পার্থ, দুই মাদ্রীপুত্রও যোগ দিলেন। 
ধর্মরাজ সঙ্গে সঙ্গে ভাইদের দুর্যোধনকে তোলার নির্দেশ দিলেন। পান্ডুপুত্রেরা দুর্যোধনের সোদক(ভেজা)বস্ত্র ছাড়িয়ে নতুন বস্ত্র পরালেন। ধর্মরাজ যত লোকজন হাসছিল তাদের সকলকে নিবৃত করতে লাগলেন। 

এসব ঘটনায় দুর্যোধন অপমানে অভিমানে লজ্জায় কাঁপতে কাঁপতে সেখান থেকে চলে গেল। ক্রোধান্ধ গান্ধারীকুমার ভুল করে আবার দুয়ার খুঁজে পায় না। সকল স্থানের পাঁচিল স্ফটিকের ভেবে দুর্যোধন দিকে দিকে ফিরতে থাকে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে দেওয়ালে মাথা ঠুকে আবার আছাড় খেল। তা দেখে আবার সকলে হাসতে লাগল।
তা দেখে ধর্মরাজ দ্রুত নকুলকে পাঠান দ্বার দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। নকুল হাত ধরে তুললে অপমানে দুর্যোধনের শরীর কাঁপতে লাগল। কিছুমাত্র সময় নষ্ট না করে সে তখনই যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা নিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে চলল। 

বিমনা দুর্যোধন হেঁট মাথায়, ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে মামা শকুনির সাথে বাড়ি চলল। 

শকুনি অনেক কথা বলে চলল কিন্তু কোন উত্তর না পেয়ে অবাক হয়ে সে ভাগ্নেকে বলে –ভাগ্নে তোমার এমন মলিন বদন কেন, কেনই বা এত সঘন নিশ্বাস ফেলছ! এত চিন্তাই বা কিসের! 

দুর্যোধন বলে –মামা, অপমানে আমার হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে। সমগ্র পৃথিবী আজ পাণ্ডবদের বশে। নিজের চোখে দেখে এলাম একলক্ষ নরপতি তাদের জন্য খাটছে। কুন্তীর পুত্রেরা আজ ইন্দ্রের বৈভব জয় করেছে। কুবের ভান্ডার জিতে নিজেদের ভান্ডার পূর্ণ করেছে। এসব দেখে শুনে আমার দেহ মন গ্রীষ্মের সরোবরের মন শুকিয়ে যাচ্ছে। কুন্তীপুত্রদের কর্মকাণ্ড দেখে আশ্চর্য হতে হয়। নারায়ণ শিশুপালকে বধ করলেন। কোন রাজা একটাও কথা বলল না! অথচ এরাই যুদ্ধ করতে এক হয়েছিল। শিশুপাল মরতেই সকলে লুকিয়ে পড়ল! পাণ্ডবদের তেজে আজ রাজারা ছত্রভঙ্গ। কোন ক্ষত্রিয় এসব সহ্য করবে! তুমিও মামা এদের সব কর্মকাণ্ড দেখে এলে। কত শত শত রত্ন নিয়ে রাজারা দ্বারে দাড়িয়ে, বৈশ্যরাও কর দানের জন্য দণ্ডায়মান। দ্বারে প্রবেশ না করতে পারলেও তারা সব দ্বারে রেখে আসছে। এসব দেখে আমার আর সহ্য হচ্ছে না। অভিমানে আমি শীর্ণ হচ্ছি। ভাই ভেবে এদের মোটেও ক্ষমা করতে পারছি না। এদের দেখলেই আমার অঙ্গ জ্বলে, মামা! চিন্তায় চিন্তায় আমি পাগল হচ্ছি। জলে ডুবি, নাকি আগুনে ঝাঁপাই অথবা বিষ খেয়ে মরে এ জ্বালা মেটাই! আর সহ্য হয় না! বৈরী/শত্রুর সম্পদ হীনলোক যদি দেখে তবে তা সে সহ্য করতে পারে না, নিত্য শোকে পোড়ে। আমিও এমন মানুষ হয়ে শত্রুর বাড়বাড়ন্ত চোখে দেখি কি করে! আজ যুধিষ্ঠিরের বল আমার অধিক, আমি হীনবল। সাগরান্ত ধরা আজ তার অধিন। হে মামা! কি আর বলি, সবই দৈববশ। কি বলি এদের রূপ গুণ, সৌভাগ্য, সাহস। পান্ডুর এই পাঁচ পুত্র বনে জন্মেছিল। যখন হস্তিনাপুরে প্রথম এসে দাঁড়াল-দেখে মনে হল বনবাসী জংলী। পিতৃহীনের দুঃখ এই আমার গৃহে এসেই ঘুচেছিল। কতবার যে কতভাবে এদের মারার চেষ্টা করেছি, কিন্তু হায় আমার দুর্ভাগ্য। পদ্মবনের মত এদের দিনে দিনে শ্রীবৃদ্ধিই হয়ে চলেছে। মামা, দৈবের কারণেই আজ আমরা রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা হীনবল হয়েছি। পৃথার(কুন্তী) পুত্রেরা আজ আমায় দেখে হাসে-এ আমি কি করে সহ্য করি! আমার এসকল কথা তুমি পিতাকে জানিও। আমি আর গৃহে ফিরছি না, আজই পাবকে(আগুনে) প্রবেশ করব। 

দুর্যোধনের এত কথা শুনে শকুনি বলে – হে ভাগ্নে, তোমার ক্রোধ নিবারণ কর। মনে মনেও কখনো যুধিষ্ঠিরকে হিংসা করো না। ধর্মপুত্র সর্বদা তোমার প্রীতি কামনা করেছেন। তোমরা বিচার বিবেচনা করে তাকে যা ভাগ করে দিলে তিনি তাতেই সন্তুষ্ট হয়েছেন। তুমি তো তাদের মারতে কত চেষ্টা করলে। দেখ জতুগৃহ থেকে মুক্ত হয়ে তারা পাঞ্চালে গিয়ে লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে পেলেন। এভাবে দ্রুপদ ও বীর ধৃষ্টদ্যুম্ন তাদের সহায় হল। এভাবে আজ যুধিষ্ঠির রাজ চক্রবর্তী হলেন। সসাগর পৃথিবী আজ তার ছত্রতলে। তারা সব কিছুই পেয়েছে নিজেদের শক্তিতে। 
এতে তুমি কেন দুঃখ পাচ্ছ! তোমার অংশ থেকে তো তারা কিছু নেয়নি। অক্ষয় যুগল তূণ, গান্ডীব ধনুক এসবই তারা পাবক অগ্নিকে তৃপ্ত করে পেয়েছেন। আবার অগ্নির হাত থেকে ময়দানবকে রক্ষা করায় সে এই দিব্য সভা নির্মাণ করে দেয়। নিজেদের পরাক্রমে ক্রতু(যজ্ঞ)রাজ রাজসূয় যজ্ঞ করেছেন। সেই যজ্ঞের তাপ তুমি কেন হৃদয়ে ধারণ করছ! তুমিও এসব নিজের ক্ষমতায় আয়ত্ত কর! 
আমায় বল তুমি কি এসব কর্মে নিজেকে অসমর্থ ভাব! তুমি বলছ তোমার অনুগত, তোমার সহায় কেউ নেই! তবে শোন তোমার সাথে কারা কারা আছে। একশত ভাই তোমার প্রচন্ড মহারথী। এই একশত ভাগ্নের প্রতাপের কথা আমি আর কি বলি! এছাড়া ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্যের মত মহাবীরেরা আছেন। ভূরিশ্রবা, সোমদত্ত-এরাও প্রতাপে মিহির(সূর্য)। জয়দ্রথ, বাহ্লীক, আমরা থাকতে তোমায় বধ করবে পৃথিবীতে কার এত সাহস। তুমিও এবার পৃথিবী শাসন করতে রত্ন সঞ্চয় কর। কোন কাজে নিজেকে হীন ভেব না। 

দুর্যোধন বলে –আগে আমি পাণ্ডবদের জয় করব। এদের জিতলেই সব আমার বশ হবে। 

শকুনি বলে –বাঃ! ভালই বিচার করলে। কিন্তু যুদ্ধ করে কে আর পাণ্ডবদের হারাবে! তাদের সাথে পুত্রসহ দ্রুপদরাজ আছেন, স্বয়ং নারায়ণ তাদের সহায়। ইন্দ্রও আজ পাণ্ডুদের জয় করতে পারবেন না। 
তবে আমার কাছে আর এক বিদ্যা আছে, তার সাহায্যে পাণ্ডবদের জিততে পার। চাও তো সে বিদ্যা তোমায় দিতে পারি। 

দুর্যোধন বলে –হে মামা, যদি তেমন বিদ্যা তোমার জানা থাকে শীঘ্র সে সম্পর্কে বল। বিনা অস্ত্র প্রয়োগ করে কি করে পাণ্ডবদের জয় করতে পারি বল, শুনে আনন্দ লাভ করি। 

শকুনি বলে –শুন দুর্যোধন, পাশা খেলায় ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির নিপুণ নয় তবু তার পাশা খেলার বড় সখ। তুমি যান সংসারে কেউ আমার সাথে পাশা খেলায় জিততে পারে না। ক্ষত্রনীতিতে বলা আছে যুদ্ধে বা দ্যূতে(পাশা খেলায়) কেউ আহ্বান জানালে বিমুখ হতে নেই। যুধিষ্ঠিরকে খেলতে ডাকলে সেও বিমুখ হবে না, ফলে তোমার জয় নিশ্চিত। এখন আমার আগে দ্রুত গিয়ে পিতাকে সব বলে সম্মতি আদায় কর। আমি তাকে এসব বলতে পারব না। 

মামা ভাগ্নে এসব পরামর্শ করতে করতে হস্তিনগরে প্রবেশ করল। ধৃতরাষ্ট্রকে প্রণাম জানালে তিনি আশীর্বাদ করে সকলের কুশল সংবাদ নিতে লাগলেন। কিন্তু দুর্যোধন কোন কথা বলল না। 

সুবলনন্দন শকুনি সব উত্তর দিল –হে রাজন আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র সর্বগুণবান, তার কথাই বলি অবধান করুন। দিন দিন সে ক্ষীণ হয়ে পরছে। দেহ তার জীর্ণ শীর্ণ। পিঙ্গ(অগ্নির মত) শরীর দেখে আজ মনে হয় তা যেন রক্তহীন হয়েছে। বুঝতে পারছিনা তার কিসের এত মনস্তাপ। সঘন নিশ্বাস ফেলে চলেছে, যেন সে দন্ডহত সাপ। 

সব শুনে আকুল হয়ে ধৃতরাষ্ট্র বলেন – পুত্র দুর্যোধন বল কিসের কারণে তোমার অঙ্গ হীনবল হল। শকুনি কি বলল, তুমি শুনলে। তোমার কিসের দুঃখ আমায় বল, আমি যে তোমার কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। কে তোমার শত্রু, কার এত বল! কোন সুখের অভাবে তুমি আজ দুর্বল! ধন-জন-সম্পদে কে আজ তোমার সমান পুত্র! কেইবা তোমার চেয়ে বীর আছে এ বসুধায়! সুন্দর বস্ত্র, সুস্বাদু খাদ্য, সুন্দরী নারী, মনোহর গৃহ সবই তোমায় রত্নে মণ্ডিত করে দিয়েছি। তোমার অসাধ্য তো কিছুই রাখিনি। তবু তুমি পুত্র কেন অনুশোচনা করছ! 

এত শুনে দুর্যোধন বলে –এসব বৈভব যে কুপুরুষজনের সমান তা আমি প্রমাণ করতে পারি। আমার মনস্তাপের কারণ শুনুন পিতা। আমার কঠিন প্রাণ তাই এখনও মরি নি। পিতা শত্রুর সম্পদ এ নয়নে দেখে আমার শরীর পুষ্ট হচ্ছে না, ভোজনেও তৃপ্তি পাচ্ছি না। পাণ্ডবদের সম্পদ-লক্ষ্মী দিন দিন দীপ্ত দিনকরের মত বেড়ে চলেছে, সেই তাপদাহে আমার কলেবর/দেহ দগ্ধ হচ্ছে। পাণ্ডবদের যা সম্পদ দেখে এলাম তার তুল্য কখনো দেখিনি বা শুনিনি। তাদের সে সম্পদ কাহিনী আমি এখন বলতে পারব না। অষ্টাশী সহস্র দ্বিজ নিত্য তাদের গৃহে ভুঞ্জে(ভোজন করে)। সুবর্ণ পাত্রে সে ভোজন দেখে মন মোহিত হয়। পৃথিবীর রাজারা এমন কি বৈশ্যরাও নানা রত্ন নিয়ে পাণ্ডবদের দ্বারে দাড়িয়ে থাকে। শত শত রাজারা এই যজ্ঞে এসেছে। নাজানি কত শত দ্বিজকে ভোজন করিয়েছে। শুনেছি এক লক্ষ দ্বিজ ব্রাহ্মণের ভোজন হলে একবার শঙ্খ বাজে। আমি তো এক লক্ষবার শঙ্খ শুনেছি। মুহুর্মুহু সেই শঙ্খধ্বনি গুণে শেষ হয়না। সেই শঙ্খধ্বনি শুনে আমি চমকে চমকে উঠেছি। ধনসম্পদের বর্ণনা আর কি দেব, পিতা! সব দেখে বিস্মিত হতে হয়। আমি আর বলতে পারছি না পিতা। এর উপায় বার করুন আপনি। পাণ্ডবদের জয় না করে আমার মনে শান্তি নেই। বিনা যুদ্ধে তাদের হারাতে চাই। আপনি আজ্ঞা করুন। পাশাক্রীড়ায় মামা শকুনি পটু, সেই পাশা খেলায় পাণ্ডবদের লক্ষ্মী জয় করতে চাই। 

এত শুনে অন্ধ রাজা বলেন –বিদুরের সাথে তবে পরামর্শ করি। বুদ্ধিদাতা বিদুর মন্ত্রী চূড়ামণি। সে আমার হিতের জন্য অবশ্যই পরামর্শ দেবে। তার বুদ্ধি না নিয়ে আমি অনুমতি দিতে পারি না। 

দুর্যোধন বলে –বিদুরকে একথা বললে সে অবশ্যই আপনাকে নিষেধ করবে। তার কথা শুনলে আমার মরণ আপনি নিশ্চিত করবেন। আমি মরলে আপনি সুখে বিদুরের সাথে পরামর্শ করবেন। 

পুত্রের এত নিষ্ঠুর বচনে অন্ধ রাজা বড়ই দুঃখ পেলেন। 
দুর্যোধনের মন বুঝে তাকে আশ্বাস দিতে রাজা বলেন – তোমরা পাশা খেলার ব্যবস্থা কর। বহু স্তম্ভে বহু রত্নে এক মনোরম সভা নির্মাণ কর। গোটা চারেক দ্বার কর পরিসর। সে সভা নির্মাণ হলে আমায় জানিও। 

এত বলে রাজা পুত্রকে শান্ত করলেন। বিচক্ষণ বিদুর সব জানতে পেরে অন্ধ রাজার কাছে দ্রুত গেলেন। 

বিদুর রাজাকে বলেন – রাজন এ আপনি কি সিদ্ধান্ত নিলেন! শুনে পর্যন্ত আমার চিত্ত অসন্তুষ্ট। রাজন, পুত্রে পুত্রে ভেদাভেদ করা উচিত নয়, এতে সর্বনাশ নিশ্চিত। 

অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র বলেন ¬– আমায় কিছু বলো না। দৈবের লিখন কে খন্ডাতে পারে। তুমি চিন্তা করো না। ভীষ্ম আর আমি ক্রীড়াস্থলে থেকে ন্যায় বিচার করব। সেখানে পুত্রে পুত্রে কখনই দ্বন্ধ হতে দেব না। বিদুর, দৈব যদি প্রতিকূল না হয় তবে কলহ আমাকে দুঃখ দেবে না। বিধাতা সর্ব জগৎ দৈবের বশে রেখেছেন। এখন তুমি দ্রুত ইন্দ্রপ্রস্তে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে এখানে ডেকে আনো। ধর্মরাজকে এসব বিবরণ বিস্তারিত বলতে হবে না। 

এত কথা শুনে ক্ষত্তা(দাসীপুত্র বিদুরের উপাধি)বিষণ্ণ হলেন। 
বিদুর বলেন – রাজা উচিত কথা বললেন না। আজ থেকে জানলাম কূলের সর্বনাশ শুরু হল। 

এত বলে বিষণ্ণ ও ক্ষুব্ধ বিদুর দ্রুত ভীষ্মের কাছে সব জানাতে গেলেন। 

সভা পর্বের সুধারস পাশা অনুবন্ধ(প্রসঙ্গ), কাশীরামদাস কহেন পাঁচালি প্রবন্ধ। 
......................................

Saturday, May 20, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৫

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... যথাকালে যুধিষ্ঠির যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করলেন.....সকলকে যার যা যজ্ঞভাগ তা দান করে তুষ্ট করলেন.... ভীষ্মের পরামর্শে যুধিষ্ঠির সকলের শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের পূজা করতে গেলে চেদিরাজ শিশুপাল তীব্র প্রতিবাদ করে কৃষ্ণ নিন্দা করতে লাগল .....কিছু রাজারা শিশুপালের সঙ্গ দিল...... ভীষ্ম শিশুপালের কৃষ্ণ নিন্দার বিরোধ করলেন .....শিশুপাল ভীষ্মকেও অপমান করতে থাকে.. ... ভীষ্ম শিশুপালের জন্মকথা সবাইকে বলেন, যা শুনে শিশুপাল রেগে যায়......] 




শিশুপাল বধ ও যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ সমাপনঃ

শিশুপালের গর্জন শুনে কমললোচন কৃষ্ণ মৃদু হেসে বলেন –সকল রাজারা মন দিয়ে শুনুন এই দুষ্ট শিশুপাল প্রথম থেকেই কিভাবে যাদবদের উপর অত্যাচার করছে। এক যাদবী নারীর গর্ভে জন্মেও এই দুরাচার আমাদের অপকার করে চলেছে। 
একসময় আমি দ্বারকা ছেড়ে প্রাগজ্যোতিষে গেছিলাম, সেই সুযোগে এই দুষ্ট সসৈন্য দ্বারকায় আক্রমণ করে। রাজা উগ্রসেন তখন রৈবত পর্বতে ছিলেন। আমার পিতা বসুদেব যিনি শিশুপালের মাতুল(মামা)-তার শত উপরোধও সে শোনেনি, দ্বারকা নিষ্ঠুর ভাবে লুঠ করে নিয়ে যায়। 
তারপর একসময় আমার পিতা অশ্বমেধ যজ্ঞ সঙ্কল্প করেন। তিনি তুরঙ্গ(ঘোড়া) ছারেন, যদুরা সে অশ্ব রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকে। সেই ঘোড়াটিও এই দুর্জন হরণ করে নিয়ে যায়। এর যে আরো কত দুষ্কর্ম আছে, কত বলি! 
এক সময় সৌরীর দেশে মহোৎসব হচ্ছিল, যাদব বভ্রুর গুণবতী ভার্যা(স্ত্রী) সেখানে যাচ্ছিলেন তাকেও এই পাপমতি বল প্রয়োগ করে হরণ করে। 
এর আরো দুষ্ট কাহিনী আছে। যাদব নন্দিনী ভদ্রাকে এ হরণের চেষ্টা করেছিল। মাতুলের কন্যা তো নিজের ভগিনী সমান! তাকেও এ হরণ করতে চায়। 
এভাবে এর কত দোষের কথা শোনাবো! একে দেখেই সে সব কথা মনে পরছে। তবু পিতৃষ্বসার(পিসি) কাছে সত্যবচন করায় আমি সব ক্ষমা করে চলেছি। 
আজ আপনাদের সবার সামনে অপমান করেই চলেছে, ভালই হয়েছে সকলের সামনে এসব বলে চলেছে। আজ আমি আর একে সহ্য করব না। এ পাপী আজ নিজেই মৃত্যু প্রার্থনা করছে। 
এক সময় এ আমার স্ত্রী, ভীষ্মকের কন্যা লক্ষ্মীরূপা রুক্মিণীকে কামনা করেছিল। শূদ্র যেমন বেদবাক্য পাঠের ইচ্ছে করে, শিশু যেমন চাঁদ ধরতে চায় বা চন্ডাল যেমন কখনও হব্যের(যজ্ঞে দেবতাদের উৎসর্গ করা অন্ন) ভাগ পায় না, তেমনি এও আর রুক্মিণীকে পায় নি। 

শ্রীমধুসূদনের এত কথা শুনে শিশুপাল হাসতে হাসতে কৃষ্ণ নিন্দা করে বলে –কৃষ্ণ তুমি দেখছি অতি নির্লজ্জ। তোমার দুষ্কর্ম তো সংসার বিখ্যাত। ভীষ্মকের কন্যার সাথে আমার বিবাহ স্থির হয়, সে কথা তো বললে না! তুমি তাকে সভা থেকে হরণ করেছিলে। আর আজ সে কথা সবার সামনে নির্লজ্জের মত বলছ! তোমরা সবাই বল অন্যের বাগদত্তাকে কি হরণ করা উচিত! ক্ষত্রিয়দের মধ্যে কৃষ্ণ তুমি সবচেয়ে বেশি এমন কর্ম করেছ। গোকুলে তুমি কি করতে সকলে জানে। কত ব্রজাঙ্গনার পরদা হরণ করেছ কে জানে! তোমার সে সব কাজকর্ম আবার সভার মাঝে গর্ব করে বলছ! তুমি আমাকে ক্ষমা করছ! ক্ষমা করা ছাড়া তোমার আর কি ক্ষমতা আছে শুনি! ক্রোধ করেই বা তুমি আমার কি করতে পার! আমিও আজ তোমার শক্তি দেখতে চাই। 

চেদীশ্বরের এত কথা শুনে শ্রীধর কৃষ্ণ সুদর্শন চক্রকে আজ্ঞা দিলেন। সুদর্শন মহাচক্র অগ্নির মত জ্বলতে জ্বলতে শিশুপালের শির কেটে ভূমিতলে ফেলল। বজ্রাঘাতে যেন পর্বত চূর্ণ হল। দেখে সব ক্ষিতীশ্বর(রাজারা) বিস্মিত হল। তারা দেখল শিশুপালের শরীর থেকে এক উজ্জ্বল জ্যোতি বের হয়ে আকাশে উঠে গেল, যেন দ্বিতীয় মিহির(সূর্য)। রাজারা এক দৃষ্টে অবাক হয়ে দেখতে থাকে।
সেই উজ্জ্বল জ্যোতি পুনরায় এসে কৃষ্ণের চরণ প্রণাম করে কৃষ্ণপদেই অদৃশ্য হল। এসব দেখে সভাসদরা বিস্মিত হল। 

বিনা মেঘে বর্ষণ, বজ্রপাত শুরু হল, বসুন্ধরা কেঁপে উঠল। আর যে সব রাজারা তর্জন গর্জন করছিল তারা ভয়ে আকুল হয়ে লুকাতে লাগল। অধর কামড়ে কেউবা ইঙ্গিত ইশারা করে বাঁচার চেষ্টা করতে লাগল। অনেকেই আবার গোবিন্দের স্তুতি শুরু করে দিল। 

রাজা যুধিষ্ঠির তখন সহোদরদের ডেকে আজ্ঞা দিলেন –শিশুপালের শরীরের সৎকারের ব্যবস্থা কর। 

শিশুপালের পুত্রকে চেদীরাজ রূপে অভিষেক করা হল। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সকল রাজারা তাদের অর্ঘ্য নিবেদন করতে লাগল। এভাবে রাজসূয় যজ্ঞ সুসম্পন্ন হল। 

সকল রাজারা একযোগে যুধিষ্ঠিরকে বলে –আপনি লক্ষ রাজার উপরে, আপনিই আমাদের মহারাজ। আপনার মহিমা অপার। এখন আজ্ঞা দিন, আমরা নিজ নিজ রাজ্যে ফিরি। 

রাজাদের কথা শুনে যুধিষ্ঠির ভাইদের ডেকে বলেন –সকল রাজাকে পুজো করা হোক। সকলকে যথাযোগ্য মান্য করে তাদের গন্তব্য পথে এগিয়ে দিয়ে আসবে। 

এভাবে সকল রাজাদের বহু ধনরত্ন দিয়ে সন্তুষ্ট করে বিদায় জানানো হল। 

মহাভারতে কথা সুধার সাগর, যা শ্রবণে নিষ্পাপ হয় নর।
......................................

Saturday, May 6, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৪

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... যথাকালে যুধিষ্ঠির যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করলেন.....সকলকে যার যা যজ্ঞভাগ তা দান করে তুষ্ট করলেন.... ভীষ্মের পরামর্শে যুধিষ্ঠির সকলের শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের পূজা করতে গেলে চেদিরাজ শিশুপাল তীব্র প্রতিবাদ করে কৃষ্ণ নিন্দা করতে লাগল .....কিছু রাজারা শিশুপালের সঙ্গ দিল...... রাজা যুধিষ্ঠির শিশুপালকে শান্ত করতে চাইলেন..... ভীষ্ম শিশুপালের কৃষ্ণ নিন্দার বিরোধ করলেন .....শিশুপাল ভীষ্মকেও অপমান করতে থাকে.. ... ] 



ভীষ্ম কর্তৃক শিশুপালের জন্মকথন ও শিশুপালের ক্রোধঃ

ভীষ্ম বলেন –চেদিরাজ দমঘোষের গৃহে শিশুপাল চারটি হাত ও তিন চোখ নিয়ে ভুমিষ্ট হয়েছিল এবং জন্মমাত্র গর্দভের মত চিৎকার করতে থাকে। এমন অদ্ভূত শিশু দেখে তার বাপ-মা কষ্ট পায়। তারা তখনই শিশুটিকে ত্যাগ করতে চায়। 
তখন হঠাৎ শূন্য থেকে আসুরী বচনে বাণী আসে –শ্রীমন্ত বলিষ্ঠ হবে এই নন্দন। ভয় না পেয়ে একে পালন কর। এর অদ্ভূত গড়ন দেখে চিন্তিত হচ্ছে বটে তবে তার কারণও সাবধানে শুনে রাখ। সেই ব্যক্তি এর সংহার করবে যার স্পর্শে শিশুর হাত লুকাবে। 

এদিকে চেদিরাজের চতুর্ভুজ সন্তান হয়েছে চারদিকে সে খবর ছড়াতে লাগল। বিভিন্ন রাজ্যের রাজারা সেই শিশু দেখতে আসতে লাগল। দশ-বিশজন রাজা প্রতিদিন এই পুত্রকে দেখতে আসে। দমঘোষও সবার কোলে পুত্রকে অর্পণ করতে থাকেন। 

কিছুদিন পর সব ঘটনা শুনে রাম ও নারায়ণ সেই শিশুকে দেখতে চললেন। শিশুপালের জননী গোবিন্দ-কৃষ্ণের পিতৃস্বসা(পিসি)। তাদের দেখে পিসি খুব খুশি হলেন। অনেক আদর যত্ন করলেন যদুমণি কৃষ্ণ গোপালকে। নিজ সন্তানকে কৃষ্ণের কোলে দিলেন। তখনই শিশুটির দুটি হাত মাটিতে খসে পরে গেল এবং কপালের চোখটি অদৃশ্য হল। 
তা দেখে শিশুপালের মা আতঙ্কিত হলেন। তিনি জোড়হাতে দেব দামোদর কৃষ্ণকে বলেন –হে কৃষ্ণ তুমি আমায় একটি বর দাও। আমি খুবই ভয় পাচ্ছি, দেখ আমার শরীর কাঁপছে। দয়া করে আমার এ ভয় ভেঙ্গে আমায় সুস্থ কর। 

শ্রীকৃষ্ণ বলেন –হে মাতা, আপনি কিছু মাত্র ভয় পাবেন না, কি বর চান আজ্ঞা করুন। 

মহাদেবী বলেন –আমায় এই বর দাও যে তুমি আমার পুত্রের একশত অপরাধ ক্ষমা করে দেবে। আমি বুঝতে পারছি এ তোমার প্রতি অনেক অন্যায় করবে। আমার কথা ভেবে একে ক্ষমা করে দিও, পুত্র! 

কৃষ্ণ বলেন –মাতা, আপনার বচন আমি লঙ্ঘন করব না। এর একশত অপরাধ আমি ক্ষমা করব। তবে কেবল একশতবারই সে আমার ক্ষমা লাভ করবে। আপনার সামনে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম। 

এই মূঢ শিশুপালের দুই চোখ থেকেও সে আজও অন্ধ। গর্বে মত্ত হয়ে সে তোমায় যুদ্ধে ডাকছে। কিন্তু একে নাশ করা ভীম তোমার কাজ নয়। শ্রীকৃষ্ণ যবে থেকে প্রতিজ্ঞা করলেন, তবে থেকেই তার কিছু অংশ এর মধ্যে আছে। তাই এর সাথে তোমার যুদ্ধ করা উচিত নয়। 
হে পুত্র ভীম, তুমি আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছ। কিন্তু এ কুলাঙ্গারের কুবচনে দুঃখ পেওনা। এ শরীরে বিষ্ণুর কিছু অংশ পেয়ে আমাদের সকলকে তৃণবৎ মনে করে অপমান করে চলেছে। আমায় কেউ অপমান করার সাহস পায় না। এর গালি সহ্য করছি কেবল গোবিন্দের কথা ভেবে। 

ভীষ্মের এত কথা শুনে চেদীশ্বর শিশুপাল উপহাস করে বলে –ভাল হয়েছে আমার শত্রু নন্দের নন্দন কৃষ্ণ। তুমি ভীষ্ম তার এত স্তুতি করছ, কারণ কি! অন্য কারো এত স্তুতি করলে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই এতক্ষণে পেতে। 
বাহ্লীক রাজার এত স্তুব করলে অনেক পুরস্কার পেতে। 
মহাদাতা কর্ণবীরের স্তব করতে পারতে। ইনি জরাসন্ধকেও যুদ্ধে হারিয়েছেন। কর্ণের শ্রবণে কুন্ডল যা দেবের নির্মাণ, অভেদ্য কবচ অঙ্গে-যা সূর্যের মত দীপ্তিমান। এই অঙ্গ রাজ্যেশ্বর দানে অকাতর। সেই কর্ণের স্তুতি করলে ভাল বর পেতে পারতে। 
এছাড়া দ্রোণদ্রোণি পিতাপুত্রও বিখ্যাত সংসারে। তাদের এত স্তব করলে তারা মুহূর্তে তোমার জন্য ভূমণ্ডল জয় করে দিত। 
রাজাদের মধ্যে দুর্যোধন মহাবল, সাগরান্ত পৃথিবী এর করতলে। 
ভগদত্ত, জয়দ্রথ, ভীষ্মক, দ্রুপদ, রুক্মি, দন্ডবক্র, মৎস্য, কলিঙ্গ, কামদ, বৃষসেন, বিন্দ, অনুবিন্দ, কৃপাচার্য-এদের এত স্তুতু করলে কিছু কার্য সিদ্ধি হত। 
তোমার বুদ্ধিকে ধিক্কার, কি আর বলব তোমায়! হিমাদ্রিতে(হিমালয়) ভূলিঙ্গ পাখির মত তোমার চরিত্র। এই পাখির কথা লোকমুখে শুনেছি। সব পাখিদের সে উপদেশ দিয়ে বেরায় –সাহস ভাল না। বেশি সাহস দেখাতে গেলে দুঃখ পাবে। পাখিরাও খুব মন দিয়ে তার কথা শোনে। সেখানেই এক সিংহ আহার করে বিশ্রাম নেয়। ভূলিঙ্গ তার সামনে বসে থাকে, কখন সিংহ হাই তুলবে। সিংহের দাঁতের ফাঁকে ভক্ষ্য মাংস সে অতি দ্রুত খুটে খায়। নিজের এই কাজ আবার অন্যকে শিক্ষা দেয়! সে জানে না যে সিংহের কৃপায় তার জীবন রক্ষা পাচ্ছে। সিংহ সামান্য ইঙ্গিতেই মনে করলে ভূলিঙ্গকে মারতে পারে। 
তেমনি এই সব রাজারা তোমায় এখনও ক্ষমা করে চলেছে। এরা ক্ষেপে উঠলে এখনই তোমায় যমের ঘরে পাঠাতে পারে। 

এমন অসহ্য কটু কথা শুনে বীর ভীষ্ম অস্থির হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলেন – আরে মূর্খ, দুরাচার, ক্রুরমনা, কৃষ্ণ স্তুতি করছি বলে এত কথা শোনাচ্ছ! চতুর্বেদে চতুর্মুখে যার গুণ গায়, পঞ্চমুখে স্তুতি যাকে করেন দেবরায়। সহস্র মুখে শেষনাগ যার স্তুতি করেন, চরাচরের আর যত মহামতি আছেন সকলে কৃষ্ণের স্তুতি করেন। সংসারে যার জ্বিহ্বাতে কৃষ্ণের গুণগান নেই সে তার পাপতনু ধারণ করে অকারণ। 
আমি অতি সামান্য ক্ষুদ্র মানুষ, আমি কি আর কৃষ্ণের তেমন স্তুতি করতে পারি! 
হে পাপী তুমি বললে এই রাজারা ক্ষমা করে আমায় বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি এদের তৃণতুল্যও জ্ঞান করি না। 

গঙ্গাপুত্র ভীষ্মের এই কথায় রাজারা ক্রোধে গর্জাতে থাকে। সাধু রাজারা ভীষ্মের কথা শুনে হাসে, দুষ্ট রাজারা কর্কশ ভাবে গালাগাল দিতে থাকে – গর্বিত দুর্মতি পাপাচারী, ভীষ্ম! একে আজ পশুর মত হত্যা করব। কেউ বলে –একে বেঁধে নিয়ে চল। এর আবার ইচ্ছামৃত্যুর অহঙ্কার আছে। আজ একে পুড়িয়ে মারব। 

হেসে ভীষ্ম বলেন –হে রাজগণ, অকারণ কথা বলে যাচ্ছ, এই বিবাদের কোন শেষ নেই। আমি তোমাদের সবার শিরে পা দিয়ে বলছি, যার মৃত্যুর ইচ্ছা আছে সে যুদ্ধে আহ্বান কর। পূজায় সন্তুষ্ট থাকেন দৈবকী নন্দন কৃষ্ণ। কিন্তু যার মরণের ইচ্ছে হয়েছে সে তাকে যুদ্ধে ডাকুক, যদি সাহস থাকে। শিশুপালের দেহে গোবিন্দের কৃপাংশ আছে। তাই এখনও কৃষ্ণ তাকে ক্ষমা করে যাচ্ছেন। এর ব্যবস্থা হলে তারপর তোমাদেরও সবাইকে যমের বাড়ি পাঠাবো। 

ভীষ্মের একথায় শিশুপাল অতি ক্রুদ্ধ হয়ে হাক দিয়ে কৃষ্ণকে বলে –ওই, গোপাল! আজ তোমার সাথে এই পাণ্ডুপুত্রদেরও আমি হত্যা করব। তারা কেন এত রাজা থাকতে সবার আগে তোমার পূজা করল! আজ তোমাদের সবার শেষ দিন।
......................................

Sunday, April 23, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৩

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... মুনিরা হোম যজ্ঞের আয়োজন শুরু করেন.......দ্রুপদ ও অন্যান্য গণ্যমান্য রাজারা আসতে লাগলেন...... ভীমের সাজাপ্রাপ্ত কিছু রাজাকে কৃষ্ণ প্রাণদান করেন.... অবশেষে কৃষ্ণ ও বিভীষণ সভায় এলেন...... কৃষ্ণ সকলকে বিশ্বরূপ দেখালেন....... সভার সকলে মূর্ছা গেল.......যুধিষ্ঠির যজ্ঞ সমাপন করলেন.....সকলকে যার যা যজ্ঞভাগ তা দান করে তুষ্ট করলেন.... ভীষ্মের পরামর্শে যুধিষ্ঠির সকলের শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের পূজা করতে গেলে চেদিরাজ শিশুপাল তীব্র প্রতিবাদ করে কৃষ্ণ নিন্দা করতে লাগল .....কিছু রাজারা শিশুপালের সঙ্গ দিল...... ] 


যুধিষ্ঠির ও ভীষ্ম

শিশুপালের প্রতি যুধিষ্ঠিরের ও ভীষ্মের বাক্যঃ 

শিশুপাল চলে যাচ্ছে দেখে যুধিষ্ঠির দ্রুত সিংহাসন ত্যাগ করে তার কাছে গিয়ে মধুর বচনে বলেন –একাজ তোমার যোগ্য নয়, হে চেদীরাজ। যজ্ঞ ত্যাগ করে কেন তোমরা যাচ্ছ! কেনই বা মিছে গঙ্গাপুত্র পিতামহ ভীষ্মের নিন্দা করছ। নিজেই দেখ কৃষ্ণের পুজোয় অন্য বড় রাজাদের কোন আপত্তি নেই। তারা একে অপমানও মনে করছেন না। পিতামহ ভীষ্ম গোবিন্দের প্রকৃত তত্ত্ব জানেন। তাই তিনি কৃষ্ণের পূজা প্রথমে করালেন। 

ভীষ্ম বলেন –হে ধর্মপুত্র, দমঘোষের পুত্র শান্তি যোগ্য নয়। কৃষ্ণ পূজার যে নিন্দা করে তাকে মান্য করার কোন দরকার নেই। দুষ্টবুদ্ধি শিশুপালের সামান্য জ্ঞানও নেই। রাজাদের মধ্যে গণ্য করার মত এ নয়। কৃষ্ণপদ পূজা করেন ত্রৈলোক্যের সকলে। আমি তো সেখানে এক সামান্য ক্ষুদ্র মানুষ মাত্র। বহু জ্ঞানী বৃদ্ধজনের মুখে শুনেছি কৃষ্ণের মহিমা। তিনি স্বয়ং পদ্মযোনি ব্রহ্মারও অগোচর। আমি আর তার কথা কি বলি! 
পূর্বেরও সাধুজনেরা এই পৃথিবীশ্রেষ্ঠ রাজার রাজাকে পুজো করে গেছেন। বিপ্র মধ্যে পুজো পায় জ্ঞানী বৃদ্ধজন, ক্ষত্রিয়ের মধ্যে বলবান, বৈশ্য মধ্যে যার ধন ধান্য বেশি সে আগে পূজ্য আর শূদ্র মধ্যে আগে পুজো পায় বয়োধিক জন। 
এই সভায় যত ক্ষত্রিয়রা আছেন সকলে দামোদরের সম্পর্কে জানেন। কোন রূপে তিনি এ সভায় ছোট শুনি! কূলে-বলে কে আর আছে কৃষ্ণ তুল্য! দান-যজ্ঞ-ধর্মকর্ম-সম্পদ-কীর্তিতে এ সংসারে কৃষ্ণই সকল গুণের আধার। সংসারে যত কর্ম মানুষ করে সব যদি গোবিন্দকে সমর্পণ করে তবেই তা সিদ্ধিলাভ করে। প্রকৃতি আকৃতি কৃষ্ণ আদি সনাতন। সর্বভূতে আত্মরূপে তিনি সবার মাঝে আছেন। আকাশ, পৃথিবী, তেজ, সলিল(জল), মরুত(বায়ু) সংসারে যা কিছু সব কৃষ্ণ হতে প্রস্তুত। 
অল্পবুদ্ধির শিশুপাল কিছু জানে না তাই কৃষ্ণ পূজার নিন্দা করছে। 

গঙ্গাপুত্র ভীষ্মের কথা শুনে সহদেব বলেন –দেব নারায়ণ অজ্ঞেয়, অসীম। তার পূজায় যে নিন্দা করে তার মস্তকে আমি বাম পদ রাখি। রাজকার্য পরিচর্চায় কৃষ্ণের চেয়ে বুদ্ধিমান কে আছে শুনি! 

মাদ্রীপুত্র সহদেবের এ কথায় আগুনে যেন ঘি পরল। শিশুপাল ও তার সাথী রাজারা ক্রোধে গর্জে উঠল –এ যজ্ঞ আমরা বন্ধ করব আর পাণ্ডবদের মারব। সেই সাথে বৃষ্ণিবংশ ধ্বংস করে মাধবকেও হত্যা করব। এই বলে তারা কোলাহল শুরু করল।

প্রলয়ের সময় যেমন সমুদ্র উতলায় তেমনি রাজাদের মধ্যেও ক্রোধের রেশ দেখে ধর্মরায় যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে ডেকে বলেন –পিতামহ, এর উপায় বলুন। রাজাদের ক্রোধ দেখে অনর্থ হওয়ার আশঙ্কা করছি। এদের কিভাবে শান্ত করব, কি ভাবেই বা যজ্ঞ পূর্ণ হবে! 

ভীষ্ম বলেন –হে রাজন, ভয় পেয় না। প্রথমেই এর উপায় আমি বলে দিয়েছি। যে জন গোবিন্দের আরাধনা করে তার এ তিন ভুবনে কোন ভয় নেই। তুমি এই রাজাদের ক্রোধ দেখেই ভয় পাচ্ছ! দেবকীনন্দন কৃষ্ণ তো সিংহের সমান। সিংহ যতক্ষণ নিদ্রা থেকে না ওঠে শৃগালরা ততক্ষণ গর্জায়। গোবিন্দ যতক্ষণ এদের অবজ্ঞা করছেন ততক্ষণ এরা গর্জেই যাবে। শিশুপালের বুদ্ধিতে যারা চলছে তাদের বিনাশ শীঘ্রই ঘটবে। আগুন দেখে পতঙ্গরা যেমন বিক্রম দেখায়, কিন্তু স্পর্শ মাত্র ভস্ম হয়। তেমনি উৎপত্তি, প্রলয়, স্থিতি যার হাতে সেই কৃষ্ণের শক্তি মূঢ শিশুপাল কিছুমাত্র বুঝবে না। 

ভীষ্মের এতকথা শুনে দমঘোষের পুত্র শিশুপাল আরো রেগে বহু কটুবাক্য ও নিন্দা করতে লাগল –ওরে বৃদ্ধ কুলাঙ্গার ভীষ্ম! সবাইকে তুমি বিভীষিকা, প্রাণভয় দেখাচ্ছ! বুড়ো হলে সবার মতিচ্ছন্ন ভীমরতি হয়। তোমারও তাই হয়েছে। তাই ধর্মচ্যুত কথা বলে যাচ্ছ। কুরুদের মধ্যে তুমি হচ্ছ সেই অন্ধ যার কাছে বংশের অন্য অন্ধরা পথের নির্দেশ চাইছে। কৃষ্ণের বড়াই তোমাকে আর করতে হবে না। তার গুণের কথা সবার জানা আছে। স্ত্রীজাতির পুতনাকে এই দুষ্ট হত্যা করেছিল। কাঠের শকট(শকটাসুর) ভেঙ্গে বীরত্ব দেখাল। পুরাতন দুই বৃক্ষ(প্রলম্বাসুর) ভাঙ্গল, আবার যুদ্ধে অক্ষম বৃষ(বৃষভাসুর) ও অশ্ব(অশ্বাসুর) বধ করে অহঙ্কার হল। ইন্দ্রজাল করে এ কংসকে হত্যা করেছে। এক সপ্তাহ গোবর্ধন পর্বত ধারণ করে, যা আমার কাছে উইঢিবি মাত্র। এসব ঘটনা আমার চিত্ত দুর্বল করতে পারবে না। মূঢ গোপরাই একে বড় করে তুলেছে। এই কৃষ্ণ মোটেও সাধু ব্যক্তি নয়। ধার্মিকরা বলেন স্ত্রীজাতী, গরু, ব্রাহ্মণ আর অন্নদাতার হত্যা উচিত নয়। কিন্তু কৃষ্ণ এসবই করেছে। এ পুতনাকে মেরেছে। মাঠে বৃষ হত্যা করেছে। আবার যে কংসের অন্ন গ্রহণ করত তাকেও হত্যা করেছে। তোমাদের গোবিন্দ নারীঘাতী পাপী দুরাচার। তার স্তুতু যারা করে তারাও সব কুলাঙ্গার। তোমার কুকর্মে পাণ্ডবরা ডুববে। তুমি দুষ্টমতি ধর্মচ্যুত পাপী, সকলের মাঝে নিজেকে ধর্মজ্ঞ বলে প্রচার করছ কোন মুখে! 
সব রাজারা এর গুণের কীর্তি শুনুন। কাশীরাজের কন্যা অম্বা শাল্বকে বরণ করে তবু এই দুষ্ট গিয়ে তাকে হরণ করে। পরে সব জেনে আবার তাকে বর্জন করে। কিন্তু শাল্ব অম্বাকে আর গ্রহণ করেনি, তখন অম্বাকে আগুনে ঝাঁপ দিতে হয়। এই ভীষ্মও স্ত্রী বধকারী মহাপাপী। ওরে ভীষ্ম, তোমার ভাই বিচিত্রবীর্য তো তোমার স্বধর্মে ছিলেন। তবু তিনি মরতে তার স্ত্রীদের গর্ভে অন্যের সন্তান উৎপাদন করেছিলে। নিজেকে ব্রহ্মচারী বলে বড়াই করে হচ্ছে! এমন ব্রহ্মচর্য অনেক নপুংসকই করে থাকে। নিঃসন্তানের যজ্ঞ, দান, উপবাস সবই ব্যর্থ। এক প্রাচীন উপাখ্যান শোন। হাঁসেদের মধ্যে এক বৃদ্ধ হংস ছিল। সে সবাইকে ধর্মের কথা শোনাত। ধার্মিক ভেবে সকলে তার কথা মানত। হাঁসেরা যা খায় তার কিছু করে এনে তাকে দিত এবং নিজেদের ডিম বিশ্বাস করে তার কাছে রেখে যেত। কিন্তু সেই ভণ্ড বৃদ্ধ হাঁসটা সুযোগ বুঝে ডিম ভেঙ্গে খেতে থাকে। হাঁসেরা শোকাতুর হয়। তাদের মধ্যে এক বুদ্ধিমান হাঁস ধিরে ধিরে সব বুঝতে পারে যে বুড়ো হাসঁই ডিম খাচ্ছে। শেষে সব হাঁসেরা প্রচন্ড রেগে সেই বুড়োকে বধ করে। সেই বুড়ো হাঁসের মত তোমারও একই অবস্থা হবে ভীষ্ম। এই সব রাজারা তোমার সে ভাবেই হত্যা করবে। 
ওরে জ্ঞানহারা বৃদ্ধ ভীষ্ম, যে গোপজাতির নিন্দা সকলে করছে, বৃদ্ধ হয়ে তাকেই তুমি স্তব করছ! তোমায় ধিক্‌! তুমি ক্ষত্র নাম ধারণ করছ অকারণে। 
জরাসন্ধ রাজা ছিলেন রাজ চক্রবর্তী, তিনি এই কৃষ্ণকে গোপ জেনে ঘৃণা করে কোনদিন এর সাথে যুদ্ধ করেন নি। সেই রাজার ভয়ে এই গোপ সমুদ্রে গিয়ে আশ্রয় নেয়। দেশছাড়া শৃগাল প্রকৃতির কৃষ্ণ কপটতা করে জরাসন্ধকে মারল। কৃষ্ণ দ্বিজের ছন্মবেশে রাজপুরীতে প্রবেশ করে। এর দেখছি জাতের ঠিক নেই! কখনও নিজেকে ক্ষত্র বলে, কখনও গোপ, কখনোবা দ্বিজ। 
হে ভীষ্ম এই যদি পৃথ্বীপতি তবে কেন ক্ষণে ক্ষণে নানা জাতির হয়! তোমার বুদ্ধি দেখেও অবাক হতে হয়। দুর্দৈব হবে তার, যার তুমি বুদ্ধিদাতা হবে। তোমার বুদ্ধি দোষেই রাজসূয় যজ্ঞ পণ্ড হল। 

এভাবে শিশুপাল বিভিন্ন ভাবে ভীষ্মকে কটু কথা বলে অপমান করতে লাগল। শুনতে শুনতে পবনপুত্র ভীম ক্রোধে জ্বলে উঠলেন। তার দুই চক্ষু রক্তবর্ণ হল। সর্বাঙ্গ ক্রোধে ঘেমে উঠল। ভুরু কুঁচকে, দাঁত কটমট করে রক্তমুখ বিকৃত হয়ে উঠল। অধর দন্তে চেপে সিংহাসন থেকে বীর ভীম লাফিয়ে পড়লেন। দেখে মনে হল যুগান্তের যম সৃষ্টি সংহার করতে চলেছেন। ক্রোধ দৃষ্টিতে ভীম শিশুপালের দিকে ধেয়ে চললেন। গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম ভীমের দুই হাত ধরে ফেললেন। যেন দেব ত্রিলোচন শিব কুমার কার্তিককে ধরলেন। অনেক মিষ্ট কথায় ভীষ্ম ভীমকে শান্ত করতে লাগলেন। যেন সমুদ্র তরঙ্গ কূলে লুকাল। ভীম ভীষ্মের হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে আস্তে পারলেন না। জল যেন দীপ্ত হুতাশন অগ্নিকে নিভাতে লাগল। 

দুষ্ট শিশুপাল তা দেখে অবজ্ঞা করে হেসে ভীষ্মকে বলে –আরে ভীষ্ম ওর হাত ছেড়ে দাও। সভাস্থ সকলে রাজারা কৌতুক দেখুক! পতঙ্গের মত এই ভীমকে আজ আমি দগ্ধ করে ছাড়ব।

ভীমকে শান্ত করে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম বলেন –এই শিশুপালের সকল বিবরণ আগে শোন।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers